খেলনাও শিশুদের জন্য বিষাক্ত হতে পারে। এ কথাটি অনেকের কাছে অবিশ্বাস্য ঠেকতে পারে। কেননা শিশুদের আনন্দ- উল্লাস করতে এবং তাদের চিত্ত বিনোদনের জন্যই তো খেলনা। কিন্তু এরপরও সত্য যে শিশুদের খেলনা কোনো কোনো সময় বিষাক্ত হয়ে যায়। বিশেষ করে ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে।
তাই এ বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বনের জন্য বাবা-মা ও অভিভাবকদের সচেতনতা থাকতে হবে এ অভিমত ব্যক্ত করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও চিকিৎসকরা।
জাতীয় অধ্যাপক এম আর খান এ বিষয়ে বলেন, বিষাক্ত কেমিক্যাল যেমন- লেড, ক্যাডমিয়াম, ব্রোমিন, ক্রোমিয়াম ইত্যাদি শিশুদের জন্য অনেক ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে। খেলনার কারণে সৃষ্ট বিষাক্ততা শিশুদের মারাত্মক ক্ষতি যেমন- হাড় নরম হয়ে যাওয়া, কিডনির জটিলতা, জননেন্দ্রীয়র সমস্যা এমনকি ক্যানসার এবং শিশুদের জ্ঞানার্জনে বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
এম আর খান বলেন, শিশুরা খেলনা হাতে মুখে দেয়ায় ফলে সেখান থেকে বিষাক্ত কেমিক্যাল খুব সহজেই তাদের পেটের ভেতরে চলে যায়। কোনো কোনো খেলনা অতিমাত্রায় ধাতব পদার্থ আছে, সেগুলো শিশুরা গিলে ফেললে কিংবা চুষলে তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর এমনকি, তা স্থায়ী ক্ষতিও হতে পারে।
একই ধরনের অভিমত ব্যক্ত করেছেন স্বাস্থ্য-পরিবেশ বিশষজ্ঞ হোসেন শাহরিয়ার। তিনি বলেন, বাজারে অনেক খেলনা পাওয়া যায় যেগুলোতে উচ্চ মাত্রার বিষাক্ত ধাতব পদার্থ যুক্ত থাকে। এসব খেলনা শিশুদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। ‘প্লাস্টিক ক্ষতি করে না’- এমন ধারণা অনেকের। কিন্তু এমন প্রচলিত ধারণা অনেক ক্ষেত্রেই সত্যি নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই প্লাস্টিকের খেলনায় উঁচু মাত্রায় ক্ষতিকর বা বিষাক্ত পদার্থ পাওয়া গেছে। অনেক খেলনায় লেড, ক্যাডমিয়াম ও ক্রোমিয়াম থাকে। রঙিন কাদামাটির খেলনাতেও উঁচু মাত্রায় লেড ও ক্রোমিয়াম পাওয়া গেছে।
সরকারি শিশু হাসপাতালের পরিচালক ও শিশু বিশেষজ্ঞ প্রফেসর ডা. মনজুর হোসেন বলেন, খেলনার কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি পুরোপুরি এড়ানো সম্ভব নয়, তবে খেলনা কেনার ব্যাপারে অভিভাবকদের সতর্ক হওয়া উচিত। শিশুদের মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধির জন্য খেলনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তবে কোনো কোনো খেলনা হিতে বিপরীত হয়ে যায়। শিশুদের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে।
তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর আমাদের হাসপাতালে খেলনা-সংক্রান্ত আঘাতের কারণে অনেক শিশুকে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু বিষাক্ত খেলনার কারণে দীর্ঘ মেয়াদে শিশুদের বৃদ্ধি বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে এবং বিভিন্ন অঙ্গপ্রতঙ্গের ক্ষতি হতে পারে।
এ বিষয়ে বিশিষ্ট নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, যেসব খেলনা বেশি শব্দ করে সেগুলোর কারণে শিশুদের শ্রবণশক্তির ব্যাঘাত ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যেতে পারে। শুধু তাই নয়, শিশুদের ঘুমেরও ব্যাঘাত ঘটাতে পারে। ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলে শিশুদের নানা রোগের উপসর্গ দেখা দেয়। খেলনা যেন বেশি শব্দ না করে সে বিষয়টি অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে।
শারীরিক ও মানসিক বিকাশে উন্নত দেশগুলোর অভিভাবকরা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করে থাকেন। কিন্তু আমাদের দেশের অভিভাবকদের বেলায় তা অনেক কম। তাই আমাদের শিশুরা খেলনা ব্যবহার করে নানা ধরনের সমস্যায় পড়ে।
দেশের আধুনিক মার্কেট ঢাকার বসুন্ধরা সিটিতে দেখা গেছে, এক ব্যক্তি তার ১১ বছরের ছেলের জন্য ধাতব পদার্থে তৈরি খেলনা গাড়ি কিনছিলেন। খেলনা-সংক্রান্ত বিষাক্ততার বিষয়েতার কাছ থেকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো কোনো খেলনার গায়ে বয়স উল্লেখ থাকার ব্যাপারটি আমি জানি। তবে বিষাক্ততার বিষয়টি আমার জানা নেই। সাধারণ আমি বয়স বিবেচনা করে এবং যেগুলো আমার ভালো লাগে সেসব খেলনাগুলোই আমার ছেলের চিত্ত বিনোদনের জন্য কিনে নিয়ে যাই।
প্রসঙ্গত, আমাদের মতো অনুন্নত দেশগুলোর অনেক মানুষ তার নিজের স্বাস্থ্যের বিষয়ে তেমন একটা সচেতন নন। তারা শিশু স্বাস্থ্যের বেলায়ও তেমন একটা সচেতন নন। এর ফলে শিশুরা বিপত্তির মধ্যে পড়ছে। বিশেষ করে তা নগর জীবনের শিশুরা। তাই এক্ষেত্রে খেলনা নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান এবং যারা এগুলো বিপণনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট তাদেরকে দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রথমে খেলনা তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের তৈরিকৃত খেলনা কোন্ কোন্ বয়সের শিশুরা ব্যবহার করতে পারবে। কোন্ খেলনায় বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে খেলনার গায়ে লিখে দিতে হবে। আর যারা বিপণনের সঙ্গে জড়িত, তারা এ ব্যাপারে শিশু ও তাদের অভিভাকদের জানিয়ে দেবে।
যারা এসব করবে না, এসব উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোকে তাদের সব ধরনের খেলনার উৎপাদন বন্ধ করতে হবে।এধরনে অভিমত প্রকাশ করেছেন দেশের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।এছাড়া আমদানিকৃত বাহারি খেলনার প্রতিও নজর দিতে হবে। সেগুলোতে বিষাক্ত পদার্থ রয়েছে কি না সেগুলো যাচাই-বাছাই করেতে হবে। -বাসস