তৃণমূল মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রকল্প এখন স্বাস্থ্যসেবায় মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। মা ও শিশুর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় এক নীরব বিপ্লব ঘটিয়েছে এ প্রকল্প। কমিউিনিটি ক্লিনিকে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থাও চালু হয়েছে। এসব ক্লিনিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হচ্ছে। কমিউনিটি ক্লিনিক এখন সাধারণ মানুষের শেষ ভরসাস্থল।
দেশের জনগণকে একটি নির্দিষ্ট মানসম্মত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানের উদ্দেশে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১৯৯৮ সালের ২৮ জুন জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়ন পরিকল্পনা অনুমোদন করা হয়। ১ জুলাই স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা সেক্টর কর্মসূচি বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়। এ কর্মসূচির আওতায় গ্রামীণ জনগণের দোরগোড়ায় সমন্বিত স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা প্রদানের লক্ষ্যে গ্রাম বা ওয়ার্ড পর্যায়ে ‘কমিউনিটি ক্লিনিক’ স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৯৯৯ সালের এপ্রিলে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনসংক্রান্ত একটি নীতিমালা জারি করে। এরপর ১৯৯৯ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ১০ হাজার ৭২৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক তৈরি করা হয়। নতুন সরকার ক্ষমতা নেয়ার কারণে মাঝে জনকল্যাণমূলক এই প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার আবারও দায়িত্ব নেয়ার পর ১০ হাজার ৬২৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরায় চালু করে। সরকার ক্লিনিকগুলো পুনরুজ্জীবিতকরণের লক্ষ্যে ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে একনেক সভায় ‘রিভাইটালাইজেশন অব কমিউনিটি হেলথ কেয়ার ইনিশিয়েটিভস ইন বাংলাদেশ (কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্প’ শীর্ষক পাঁচ বছর মেয়াদি (২০০৯ জুলাই থেকে ২০১৪ জুন) উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন করে। প্রকল্প কার্যালয় সূত্র মতে, দেশে বর্তমানে ১২ হাজার ৫৩৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক চালু আছে।
সার্বিক প্রজনন স্বাস্থ্য পরিচর্যার আওতায় অন্তঃসত্ত্বা নারী প্রসবপূর্ব (প্রতিষেধক টিকাদানসহ) এবং প্রসবপরবর্তী (নবজাতকের সেবাসহ) সেবা প্রদানকারী কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো সময়মতো প্রতিষেধক টিকাদান যক্ষ্মা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, পোলিও, ধনুষ্টঙ্কার, হাম, হেপাটাইটিস-বি, নিউমোনিয়া, ম্যালেরিয়া, কুষ্ঠ, কালা-জ্বর, ডায়রিয়াসহ, অন্যান্য অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এবং সেগুলোর সীমিত চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করছে। এছাড়া জ্বর, ব্যথা, কাটা/পোড়া, হাঁপানি, চর্মরোগ, ক্রিমি এবং চোখ, দাঁত ও কানের সাধারণ রোগের ক্ষেত্রে লক্ষণ ভিত্তিক প্রাথমিক চিকিৎসাও প্রদান করা হচ্ছে। ক্লিনিকগুলোতে অস্থায়ী পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিভিন্ন উপকরণসহ বিনামূল্যে ৩২ ধরনের ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিক নিয়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) একটি মূল্যায়ন প্রতিবেদন তৈরি করে। ২০১৩ সালে তৈরি এ প্রতিবেদনটি এ বছরের প্রথম দিকে প্রকাশ করা হয়। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রত্যন্ত অঞ্চলের ৮২ শতাংশ মানুষ সেবা নেয়। আর দিনের হিসাবে গড়ে সেবা নেওয়া মানুষের সংখ্যা ৩৫ জন। ক্লিনিকগুলো বাড়ির কাছাকাছি হওয়ায় এবং সেখানে বিনামূল্যে সাধারণ রোগের ওষুধ পাওয়া যায় বলে দিন দিন এ সেবাগ্রহীতার সংখ্যাও বাড়ছে। সরকারের পৃথক দুটি জরিপেও এসব ক্লিনিক নিয়ে ৮০ থেকে ৯৮ শতাংশ মানুষের সন্তুষ্টির কথা প্রকাশ করা হয়। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের (নিপোর্ট) জরিপে দেখা গেছে, বাড়ির পাশের ক্লিনিক থেকে ওষুধ আর পরামর্শ নিয়ে ৮০ শতাংশ মানুষ সন্তুষ্ট।
কমিউনিটি ক্লিনিক প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেন, শুধু স্বাস্থ্যসেবাই নয় কর্মক্ষেত্র তৈরিতে এই কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। প্রতিটি কমিউনিটি ক্লিনিকে কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার (সিএইচসিপি)-দের সঙ্গে সপ্তাহে ৩ দিন সেবা দিয়ে থাকেন একজন পরিবার কল্যাণ সহকারী ও একজন স্বাস্থ্য সহকারী। বর্তমানে সিইচসিপিদের বেতন ভাতা বহন করছে কমিউনিটি বেসড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি)।
বিশ্ববাসী বাংলাদেশের কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা দেবার প্রক্রিয়ার প্রশংসা করেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব বান কি মুন ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মহাপরিচালক মার্গারেট চ্যান বাংলাদেশ সফরের সময় কমিউনিটি ক্লিনিকের কাজ দেখে গেছেন। এই উদ্যোগকে বিপ্লব আখ্যা দিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ‘কমিউনিটি ক্লিনিক হেলথ রেভল্যুশন ইন বাংলাদেশ’ (কমিউনিটি ক্লিনিক বাংলাদেশে স্বাস্থ্যবিপ্লব) নামের একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছে।
কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবার সুফল ভোগ করছেন গ্রামীণ জনপদের মানুষ। দিনে দিনে সম্প্রসারিত হচ্ছে কমিউনিটি ক্লিনিকের স্বাস্থ্যসেবার কার্যক্রম। ভবিষ্যতে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোই হবে গ্রামীণ জনপদের স্বাস্থ্যসেবার তথ্য ভাণ্ডার। সরকার গ্রামীণ জনপদের মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম সম্প্রসারণ করছে। কমিউনিটি ক্লিনিকের জন্য স্থানীয় পর্যায়ে ফান্ড সৃষ্টি করা হবে। স্বেচ্ছায় যারা দেবেন, তাদের কাছ থেকেই ফান্ডের টাকা গ্রহণ করা হবে। রোগীদের টাকা দিতে বাধ্য করা হবে না। রোগীদের কেউ দিতে চাইলে তাও গ্রহণ করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। জনগণকে সম্পৃক্ত করে যেকোনো উদ্যোগ গ্রহণ করলে তা সফল হবেই, এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ এ কমিউনিটি ক্লিনিক। কমিউনিটি ক্লিনিক এমন একটা উদ্ভাবনী শক্তি, যার মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া সম্ভব হয়েছে। এটা বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট অর্জন। এ অর্জনে দেশবাসী গর্বিত। -পিআইডি ফিচার