একাত্তরের মার্চ মাসে বাংলাদেশ ছিল উত্তাল। স্বাধীনতাকামী মানুষের আকাশ ভেদি স্লোগানে প্রকম্পিত ছিল। শেখ মুজিবের ডাকে পুলিশ, ইপিআর, সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবী থেকে শুরু করে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি তখন আনুগত্য প্রকাশ করে তাঁর নির্দেশ মেনে চলছিল। শুধু কর্মরত বাঙালি সেনারা তখনো আনুগত্য প্রকাশের পর্যায়ে ছিল না। তাদের কেউ কেউ পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা চালানোর পর। কেউ কেউ পাকিস্তান বাহিনীর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। বাঙালি সেনাদের অনেকে পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হন সে সময়েই। বাঙালি সৈনিকদের সমন্বয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট কী অবস্থায় বা পর্যায়ে ছিল ১৯৭১ সালে। কী অবস্থা হয়েছিল তাদের, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের দিকে তাকালে এই প্রশ্ন সামনে আসবেই। এই সৈনিকদের হাল-হকিকত কী দাঁড়িয়েছিল ১৯৭১ সালে সে নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনো কাজ হয়নি তেমন। ছিল যারা সহকর্মী; তারাই শত্রুতে পরিণত হয়েছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের কাছে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের শীর্ষ কর্তারা কেউ সারেন্ডার করেন, কেউ মারা পড়েন।
ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বাঙালির অংশগ্রহণ ছিল নামমাত্র। পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রতিষ্ঠার পরও ১৯৭০ সাল পর্যন্ত তাতে বাঙালির প্রতিনিধিত্ব ছিল নামমাত্র শতকরা ৫ ভাগ। ৯৫ ভাগ পাকিস্তানির পাশে ৫ ভাগ নস্যি যেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট বা প্রতিষ্ঠানে বাঙালিরা ছিল ছড়ানো-ছিটানো অবস্থায়। পুরোপুরি বাঙালি সৈনিকের গঠিত কোনো ইউনিট বা প্রতিষ্ঠানও ছিল না। একমাত্র পদাতিক বাহিনীর রেজিমেন্টগুলো ছিল পাকিস্তানিদের আঞ্চলিক বা প্রাদেশিক ভিত্তিতে। প্রাদেশিক ভিত্তিতে সৈনিক রিক্রুটমেন্ট বা নিয়োগ করা হতো। অঞ্চল ভিত্তিতেই নামকরণ করা হয় রেজিমেন্টগুলোর। একাত্তর সালেও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারটি পদাতিক রেজিমেন্ট ছিল। পাঞ্জাব রেজিমেন্ট, বেলুচ রেজিমেন্ট, ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট এবং ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট। এগুলোর আবার একাধিক ব্যাটালিয়ন ও ব্রিগেড ছিল। বাঙালিরা অন্য রেজিমেন্টগুলোতে কাজ করার সুযোগ পেতো তা নয়। বাঙালি রেজিমেন্টেরও শীর্ষ পদসহ অন্য পদগুলো বাকি তিন রেজিমেন্ট থেকে আসা সেনাদের দখল বা নিয়ন্ত্রণে থাকত। কুমিল্লার বুড়িচংয়ের মেজর জেনারেল গণি বা টাইগার গণি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে বাঙালি সৈনিক সমন্বয়ে গঠিত একমাত্র রেজিমেন্ট ছিল ইস্ট বেঙ্গল। যার ছিল মাত্র ৮ ব্যাটালিয়ন সৈনিক। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল ছিল নাম। এই ৮ ব্যাটালিয়নের মধ্যে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের লাহোর, করাচিতে ছিল তিনটি ব্যাটালিয়ন। আর পূর্ববাংলায় ৫টি। এই ৫টি ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত অধিনায়কদের মধ্যে দুজন ছিলেন বাঙালি। বাকি তিনজন পাকিস্তানি উর্দুভাষী। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল ছিল যশোরে। যার অধিনায়ক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। এবং দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল জয়দেবপুরে। অধিনায়ক বাঙালি লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাসুদুল হাসান খান। এই দুই রেজিমেন্টের দুই অধিনায়কই পাকিস্তানিদের কাছে বড় কোনো চাপ ছাড়াই আত্মসমর্পণ করেন। এই দুই ব্যাটালিয়ন সেনাদের কেউ পাকিস্তানিদের হাতে নিহত হলেও অধিকাংশই পালিয়ে আত্মরক্ষা করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে এককসংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে আওয়ামী লীগ এমন হিসাবটা পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের ধারণার বাইরে ছিল। ‘বাঙালির হাতে পাকিস্তানের শাসনভার যে দেওয়া যায় না’ এই মতে একাট্টা ছিল সামরিক জান্তারা। তাই তারা ‘পূর্ব পাকিস্তান’ জুড়ে পাকিস্তানি সেনা বহর সংখ্যা বাড়ানোতে মনোযোগ নিবদ্ধ করেছিল। ১৯৭১- এর ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানি সেনা ছিল বাংলাদেশে দশ থেকে বারো হাজার। ১৫ মার্চ থেকে এই সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে থাকে। সারা বাংলায় পাকিস্তানিদের মাত্র ৪টি ব্রিগেড ছিল। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের শক্তি ছিল ১৪তম ডিভিশনের কয়েকটি ব্যাটালিয়ন মাত্র।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। এ সময় বাংলাদেশে পাকিস্তানের সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য সংখ্যা ছিল প্রায় এক লাখ। এই বাহিনী ‘ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টার্সের’ অধীনে কুখ্যাত লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীর নেতৃত্বে ৫টি পদাতিক ডিভিশন ও ১টি ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের ছত্রচ্ছায়ায় ছিল। শুধু এক লাখ পাকিস্তানি সেনাই গণহত্যা, বর্বরতা, নৃশংসতাসহ যুদ্ধ করেনি, তাদের সহযোগী হিসেবে ছিল আরো বাহিনী। বাংলাদেশীয় দালাল, চাটুকার, মোসাহেবদের দিয়ে পাকিস্তান বাহিনী গঠন করেছিল এক লাখের বেশি আধা সামরিক বাহিনী সদস্য রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী। এছাড়াও ছিল পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে বাংলাদেশে বসবাসকারী তিন লক্ষাধিক অবাঙালি বিহারি মুসলমান। সব মিলিয়ে পাকিস্তানি সেনা সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল নিয়মিত বাহিনীর সামরিক আরো ১ লাখ সদস্য। মানবতাবিরোধী সবধরনের অপরাধের সঙ্গে এরা জড়িত ছিল।
অপরদিকে জুলাই-মার্চ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ৩ হাজার সেনা, রাইফেলসের ১২ হাজার সেনা এবং আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক ছিল মাত্র কয়েক হাজার। অস্ত্র বলতে ৩০৩ রাইফেল, সামান্য সংখ্যক হালকা মেশিনগান এবং নগণ্য ভারী মেশিনগান ও তিন ইঞ্চি মর্টার। পরে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনী মিলিয়ে কয়েক লাখ যোদ্ধা যুদ্ধ করেছিল। শেষে ভারতীয় সেনারা এসে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী গড়ে তোলাতে সেনা সংখ্যা কয়েক গুণ বাড়ে।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাকিস্তানে যে তিনটি রেজিমেন্ট ছিল, সেখান হতে অনেক মেজর, ক্যাপ্টেন পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। বাকিরা ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন। অনেক বাঙালি সেনা পাকিস্তানিদের হয়ে বাঙালি নির্বাণে নেমেছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রথম ব্যাটালিয়ন যারা ‘সিনিয়র টাইগার’ নামে পরিচিত ছিল তারা সব সেনা, অস্ত্র ও রসদসহ বাঙালি অধিনায়ক লে. কর্নেল রেজাউল জলিলের নেতৃত্বে যশোরের চৌগাছায় অবস্থান করছিল। তারা ২৪ মার্চ থেকেই বার্ষিক ফিল্ড এক্সারসাইজ উপলক্ষে সেখানে ছিলেন। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরুর খবর জানার পরও তারা নির্বিকার ছিল। দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গনের মুক্তিযুদ্ধের সেনা অধিনায়ক মেজর আবু উসমান চোধুরী দুই দফা পত্র পাঠান লে. কর্নেল জলিলকে। যাতে উল্লেখ করেন, ‘দেশ ও দেশের লোকের নিরাপত্তা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে বিপর্যস্ত। মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত, জ্ঞানী-গুণী ও ছাত্ররা হতাহত হচ্ছে। তাই এর বিরুদ্ধে আমি আমার ইপিআর বাহিনীকে নিয়ে বিদ্রোহ করেছি। বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছি। আর কে কে করছে জানি না। কিন্তু আপনি সিনিয়র, আপনার কাছে সৈন্য আছে, হাতিয়ার আছে, আপনি আসুন, অধিনায়কত্ব গ্রহণ করুন। আমরা সম্মিলিতভাবে এদের হনন করতে সক্ষম হব।’ প্রথম দফা চিঠিটি পেয়ে কোনো জবাব না দিলে পরদিন ২৮ মার্চ একই পত্র পাঠালে কর্নেল জলিল পত্রবাহককে ‘পাগলের প্রলাপ’ বলে হেসে উড়িয়ে দেন কোনো জবাব না দিয়ে। এমনকি এ বিষয় নিয়ে পুনরায় না আসার জন্য বার্তাবাহককে সতর্ক করে দেন।
কি করলেন এই কর্নেল, পরের দৃশ্যে দেখি তাকে। যশোর সেনানিবাসের পাকিস্তানি কমান্ডারের নির্দেশে কর্নেল জলিল ‘সিনিয়র টাইগার’দের নিয়ে সব অস্ত্রশস্ত্র ও যানবাহন নিয়ে ২৯ মার্চ যশোর ক্যান্টনমেন্ট পৌঁছেন এবং সব জমা দেন। পাকিস্তানি ব্রিগেড অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার সরদার আবদুর রহিম দুররানী অস্ত্রাগারের চাবি হস্তগত করেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিনিয়র টাইগারদের এর পরের পর্বের ইতিহাস অত্যন্ত করুণ ও মর্মান্তিক। টাইগার ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহমদ লিখেছেন ‘৩০ মার্চ সকাল ৯টার সময় যশোর সেনানিবাসে পাকিস্তানি বাহিনী প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপর অতর্কিতে তিন দিক থেকে আক্রমণ করে। এর আগে সকালে ব্রিগেডিয়ার দুররানী ব্যাটালিয়ন অফিসে যান এবং কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল জলিলকে বলেন যে, আমাদের ব্যাটালিয়নকে নিরস্ত্র করা হলো এবং অস্ত্রশস্ত্র জমা দিতে হবে। তারপর ব্রিগেডিয়ার আমাদের ব্যাটালিয়ন অস্ত্রাগারে অস্ত্রশস্ত্র জমা করে চাবিগুলো হস্তগত করেন।’ আর একই সময়ে পাকিস্তানি বাহিনী যশোরের পুলিশ লাইন ও ইপিআর সেক্টর সদরে বেপরোয়া আক্রমণ চালায়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদ থেকে পদত্যাগকারী ও মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডের উপ-অধিনায়ক আহমদ রেজা ‘একাত্তরের স্মৃতিচারণ’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৯৭১-এর আগস্টে জিয়া রৌমারীতে ১ম, ২য় ও ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের জওয়ানদের নিয়ে বাংলাদেশে সেনাবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড গঠন করেন, যা পরে তার নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে জেড ফোর্স হয়।
১৯ মার্চ জয়দেবপুরে পাকি সেনাবাহিনী গুলি করলে ২০ জনেরও বেশি হতাহত হয়। ঢাকা থেকে ব্রিগেডিয়ার জাহানদেব আরবারের সঙ্গে শতাধিক পাকিস্তানি অফিসার ও সেনার কনভয় জয়দেবপুরের দিকে যাচ্ছিল। খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিরস্ত্র করা হবে। জনতা পাকিস্তানিদের উপর মারমুখী হয়ে রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে। এতে ব্রিগেডিয়ার জাহানদেব অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন এবং জনতাকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন। বাঙালি মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী দুবার ফাঁকা গুলি করলেও শেষ পর্যন্ত এতে কয়েকজন হতাহত। অপরদিকে কর্নেল জলিলের অধীনস্থ রেজিমেন্ট পাকিস্তানি কমান্ডিং অফিসারের নির্দেশে যশোর সেনানিবাসে ফিরে যায় এবং সেখানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে ও হামলা চালায়। যার ফলে এক নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রায় নিঃশেষ হয়ে যায়। মাত্র এক দেড়শ সৈনিক কোনোমতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। তাদের সঙ্গে ছিলেন ক্যাপ্টেন হাফিজ। অবশ্য কর্নেল জলিল ইতিমধ্যে আত্মসমর্úণ করে বন্দিত্বের বিনিময়ে জীবন রক্ষা করতে সমর্থন হন। কর্নেল জলিল পঁচাত্তর- পরবর্তী সময়ে ক্রীড়া পরিষদের কর্মকর্তা ছিলেন দীর্ঘদিন।
২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল জয়দেবপুরে। অধিনায়ক বাঙালি লে. কর্নেল মাসুদের রেজিমেন্টটি ২২ মার্চ থেকেই এক ধরনের বিদ্রোহ করে। মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরীর মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার আবরারের বাঙালি নিরস্ত্রীকরণ প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। ২৫ ও ২৬ মার্চ ঢাকায় অপারেশন সার্চলাইট শুরুর পর তারা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে অবস্থান ছেড়ে সরে যায়। রেজিমেন্টের অপর দলটি মেজর সফিউল্লাহর অধীনে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে ছিল। তারই নেতৃত্বে সেনারা বিদ্রোহ করে। এমন পরিস্থিতিতে লে. কর্নেল মাসুদ স্ত্রী-পুত্র- কন্যাসহ সেনানিবাসে নিজগৃহে অবস্থান করছিলেন। তিনিও আত্মসমর্úণ করেন। পুরো ৯ মাস তার পরিবারটি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিল মেজর জিয়ার পরিবারসহ। অধীনস্থ রেজিমেন্টের বিদ্রোহের দায়িত্ব যে তাকে গ্রহণ করতে হবে তিনি তা উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। কিন্তু কেন সে প্রশ্নের জবাব মেলেনি। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল রংপুরে। যার অধিনায়ক ছিলেন পাকিস্তানি লে. কর্নেল ফজলুর রহমান। এখানে বাঙালি সেনারা সুবিধা করতে পারেনি। তারা পাকিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গণহত্যায় অংশও নিয়েছিল।
চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল কুমিল্লায়। যার অধিনায়ক ছিলেন লে. কর্নেল খিজির হায়াত খান পাঞ্জাবি। উপ-অধিনায়ক হিসেবে মেজর খালেদ মোশাররফ ২৪ মার্চ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই তাকে পাঠানো হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। সেখানে একটি কোম্পানি মেজর শাফায়েত জামিলের অধিনায়কত্বে অবস্থান করছিল। ২৭ মার্চ শাফায়াত জামিল অধিনায়ক খিজির হায়াত খানকে আটক করেন। এই দুটি কোম্পানি প্রথমেই বিদ্রোহ করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালায়। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল চট্টগ্রামে। পাঞ্জাবি লে. কর্নেল রশিদ জানজুয়া ছিলেন এর অধিনায়ক। তবে এই ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক ছিলেন বাঙালি মেজর জিয়াউর রহমান। এই বেঙ্গল ব্যাটালিয়নকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানোর জন্য ২৫ মার্চের আগেই আদেশ জারি করা ছিল। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সেনা একজন পাঞ্জাবি অফিসারের নেতৃত্বে এডভান্সড পার্টি বা অগ্রবর্তী দল হিসেবে পাকিস্তানের খাবিয়ান সেনানিবাসে চলে যায়। ব্যাটালিয়নের একটি কোম্পানিকে কর্নেল জানজুয়ার আদেশে ‘সোয়াত’ জাহাজ থেকে গোলাবারুদ খালাস করার জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে নিয়োজিত রাখা ছিল। অবশিষ্টাংশ লে. কর্নেল জানজুয়ার অধীনে ষোলশহর নামক স্থানে প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় পাকিস্তান পাড়ি দেওয়ার জন্য দিন গুনছিল।
কোনো ব্যাটালিয়নকে দেশের এক উইং থেকে অন্য উইংয়ে পাড়ি দেওয়ার প্রাক্কালে গাড়ি, অস্ত্রশস্ত্রসহ গোলাবারুদ ইত্যাদি জমা দিতে হয় নিয়মানুযায়ী, যা বদলি স্থানে যোগদানের পর পুনরায় পূরণ করা হয়। অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের ব্যাটালিয়নটির এই অবস্থা তখন। কেবল সৈনিকদের দৈনন্দিন প্রশিক্ষণের জন্য ন্যূনতম গাড়ি ও হাতিয়ার ছিল। এই ব্যাটালিয়নটি পুরোপুরি যুদ্ধোপযোগী ছিল না। সব মিলিয়ে রেজিমেন্টের প্রায় তিনশ বাঙালি তখন চট্টগ্রামে ছিল। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের রিক্রুটিং ট্রেনিং সেন্টারটি ছিল চট্টগ্রামের সেনানিবাসে। যার নাম ছিলো ‘ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার’ বা ইবিআরসি। একাত্তরের মার্চে এই সেন্টারে সব মিলিয়ে আড়াই হাজার সেনা ছিল। সেন্টার কমান্ড্যান্ট ছিলেন বাঙালি ব্রিগেডিয়ার এ আর মজুমদার। আর প্রধান প্রশিক্ষক কর্মকর্তা ছিলেন বাঙালি লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী। এ ছাড়া সেন্টারে বেশ কিছু বাঙালি অফিসার অবস্থান করছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ ২৪ মার্চ পাঞ্জাবি ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে নিয়ে হেলিকপ্টারে চড়ে চট্টগ্রাম যান। চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণভার প্রদান করেন আনসারীকে ব্রিগেডিয়ার মজুমদারের স্থলে। আর মজুমদার ২৫ মার্চ আটক হন এবং পুরো ৯ মাস বন্দি জীবন কাটান। ২৫ মার্চ রাতে চট্টগ্রামে বন্দি হন লে. কর্নেল এম আর চৌধুরী। তিনি পাকিস্তানিদের বিশ্বাস করেছিলেন। কিন্তু ২০ বালুচ রেজিমেন্টের সেনারা তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে সেই বিশ্বাসের জবাব দিয়েছিল। চট্টগ্রামে তখন পাকিস্তানি সেনা সংখ্যা ছিল মাত্র ৩শ। আর ইপিআর তথা রাইফেলসের বাঙালি সৈনিকই ছিল প্রায় দেড় হাজার।
৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের মাত্র ৩টি কোম্পানি ২৫ মার্চ ষোলশহরে অবস্থান করছিল। পাকিস্তানি ব্রিগেডিয়ার আনসারী রেজিমেন্টের অধিনায়ক জানজুয়াকে নির্দেশ দেন, যেকোনো মূল্যেই হোক সব অবরোধ পরিষ্কার করতে হবে। নির্দেশানুযায়ী জানজুয়া ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ষোলশহর হতে সেনানিবাস পর্যন্ত সব ব্যারিকেড সরানোর কাজে নিয়োগ করলেন। হাজার হাজার মানুষের বাধা সত্ত্বেও সেনারা ব্যারিকেড সরাতে বাধ্য হলো। রাত ৯টার মধ্যে তারা সব সরায়। এই ব্যাটালিয়নকে ছোট ছোট গ্রুপে বিভক্ত করে রাখার উদ্দেশ্যে এবং বাঙালি অফিসারদের সৈনিকদের কাছ হতে পৃথক করে রাখার, এমনকি সুযোগ মতো হত্যা করার উদ্দেশ্যে ব্রিগেডিয়ার আনসারী ও জানজুয়ারা পরিকল্পনা করে। তাই ২৫ মার্চ সন্ধ্যার পর ষোলশহর থেকে ব্যাটালিয়নের ‘সি’ কোম্পানিসহ মেজর মীর শওকতকে ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মেজর জিয়াকে চট্টগ্রাম বন্দরে রিপোর্ট করার জন্য বলা হয়। এই বাঙালি সেনারাই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সঙ্গে ইপিআর বাহিনী। এই ব্যাটালিয়নের সব সেনাকে একত্রিত করে অধিনায়কত্ব নিজ হাতে নিয়েছিলেন মেজর জিয়া। তারা পাকিস্তানি বেশ কিছু সেনাদের হত্যা করে। এই ব্যাটালিয়নটি চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলেছিল। তারা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রামকে ধরে রাখে। কালুরঘাটে হেরে গিয়ে পিছু হটে। এখানে ক্যাপ্টেন হারুন আহমদ চৌধুরী গুরুতর আহত অবস্থায় দুজন সহযোদ্ধার সহায়তায় পেছনে সরে আসেন। আর আহত অবস্থায় লে. শমসের মবিন চৌধুরী পাকিস্তানিদের হাতে ধরা দেন। তিনি পুরো ৯ মাস ক্যান্টনমেন্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। স্বাধীনতার পর তাকে জার্মান পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য।
মুক্তিযুদ্ধের নৌ-কমান্ডোর উপ-অধিনায়ক আহমদ রেজার মনে হয়েছে, ‘ইবিআরসির অধিকর্তা ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসার পর বন্দি হন। তখনকার অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তার সেই সময় ঢাকায় আসার কোনো যুক্তিই সুবিবেচিত মনে হয়নি।’ কিন্তু এমনটা হলো, সে নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর একদা ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট আহমদ রেজা। লিখেছেন, ‘দুটি বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিকর্তা ও ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের অধিকর্তা এই তিনজন কেন এমন বিবেচনাহীন হলেন? জাতির প্রতি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অপরাধ কি কেবল তাদের? ঢাকা সেনানিবাসে একক কোনো বাঙালি ইউনিট ছিল না। তাই ২৫ মার্চ বা তার পরবর্তী সময়ে সেখানে কোনো আক্রমণ, প্রতিরোধ বা প্রতিআক্রমণ ঘটেনি। ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনার অবস্থান ছিল দশ থেকে বারো হাজার। ২৫ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানিদের শক্তি বলতে ছিল ১৪তম ডিভিশনের কয়েকটি ব্যাটালিয়ন মাত্র। সারা দেশে পাকিস্তানিদের ৪টি ব্রিগেড ছিল। এর মধ্যে ঢাকায় ৫৭তম ব্রিগেড, যশোরে ১০৭তম ব্রিগেড, রংপুরে ২৩তম ব্রিগেড, কুমিল্লায় ৫৩তম ব্রিগেড। এই চার ব্রিগেডে যে সেনা ছিল তা তুলনায় বেশি নয়। পদাতিক ব্যাটালিয়ন ছির ১৫টি যার মধ্যে ১১টি পাকিস্তানি ও ৪টি ইস্ট বেঙ্গল, ১টি আরমার বা ট্যাংক রেজিমেন্ট, ১টি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, ৫টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি, ১টি এফ এফ ব্যাটারি বিমান বিধ্বংসী কামান, ২টি মর্টার ব্যাটারি (১২০ মি. মি. মর্টার)। এই রেজিমেন্টগুলো ৮টি ক্যান্টনমেন্টে অবস্থান করছিল।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ছিল ২২তম বেলুচ রেজিমেন্ট, ১টি এফ এফ ব্যাটালিয়ন, ১টি পাঞ্জাব ব্যাটালিয়ন ও ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ন (জয়দেবপুর) এবং ২টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি। চট্টগ্রামে ছিল ২০তম বেলুচ রেজিমেন্ট ও ৮ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অংশ। যশোরে ২৭তম বেলুচ রেজিমেন্ট, ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ২২তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং ১টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি। রাজশাহীতে ২৫তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। সৈয়দপুরে ২৬তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট ও ৩য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। রংপুরে ১টি আরমার (ট্যাংক) রেজিমেন্ট, ১টি মর্টার ব্যাটারি ও ৬ষ্ঠ বালুচ রেজিমেন্ট। সিলেটে ৩১তম পাঞ্জাব রেজিমেন্ট। কুমিল্লাতে ছিল ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ১টি কমান্ডো ব্যাটালিয়ন, ১টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ও ১টি মর্টার ব্যাটারি। ১৯৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝি হতে পুরো এপ্রিল পর্যন্ত সেনাসংখ্যা বাড়াতে থাকে পাকিস্তান। এই সময়ের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নবম এবং ষোড়শ ডিভিশন দুটিকে বাংলাদেশে আনা হয়। নবম ডিভিশনকে পাঠানো হয় যশোর এবং ষোড়শকে উত্তরবঙ্গ। চতুর্দশ ডিভিশন ঢাকা ও ময়মনসিংহ এলাকায় হত্যা, নির্যাতন, লুটপাট, ধর্ষণ কাজে নিয়োজিত থাকে।
১৫ এপ্রিলের পর সামরিক জান্তারা ৩৬ ও ৩৯ ডিভিশন দুটোকেও বাংলাদেশে নিয়ে আসে। এদের বিভিন্ন জেলা পর্যায়ে দায়িত্ব দেওয়া হয় সামরিক প্রশাসকের তত্ত্বাবধানে। সব মিলিয়ে পাকিস্তানি সেনাসংখ্যা পুরো ৯ মাসে দাঁড়িয়েছিল নিয়মিত সৈনিক ১ লাখ, রাজাকার, আলবদর, আলশামসসহ আরো প্রায় লাখ খানেক আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য। এরা বাংলাদেশে গণহত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী সব ধরনের অপরাধ চালিয়েছিল। অপরদিকে জুলাই পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা ৩ হাজার, ইপিআর সেনা ১২ হাজার এবং আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও ছাত্র স্বেচ্ছাসেবক ছিল মাত্র কয়েক হাজার। অস্ত্র বলতে ৩০৩ রাইফেল, সামান্য সংখ্যক হালকা মেশিনগান এবং নগণ্য ভারী মেশিনগান ও ৩ ইঞ্চি মর্টার। পরে এই সংখ্যা বাড়তে থাকে। নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনী এবং অন্যান্য বাহিনী মিলিয়ে কয়েক লাখ যোদ্ধা যুদ্ধ করেছিল। শেষে ভারতীয় সেনারা এসে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী গড়ে তোলায় সেনাসংখ্যা কয়েকগুণ বাড়ে।
ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের পাকিস্তানে যে তিনটি রেজিমেন্ট ছিল, সেখান হতে অনেক মেজর ক্যাপ্টেন পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এরা ১৯৭৪ সালে দেশে ফেরত আসেন। মুক্তিযুদ্ধে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলেও পরে প্রতিরোধ গড়েছিল স্থায়ীভাবে সর্বত্র।