ভেজালের শুরু কবে থেকে, কে প্রথম শুরু করেছিল তা আমার জানা নেই। তবে সচেতনতার অংশ হিসেবে আমি ভেজালবিরোধী অভিযানের কিছু নির্ভেজাল গল্প আজ বলছি আজ।
এক.
আমার পোস্টিং তখন এপিবিএন-৫ এ ঢাকার উত্তরায়। দায়িত্ব ছিল অপারেশন অফিসার হিসেবে। যেদিন মাদকদ্রব্য ও অন্যান্য কোনো অপারেশন থাকতো না, সেদিন করতাম ভেজালবিরোধী অভিযান। সঙ্গে থাকতো ঢাকা জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ এলাহি। সে আমার কাছের বন্ধুও বটে।
রাজধানীর দক্ষিণখানে একটি ওষুধ কারখানায় টার্গেট। দুই দিন আগেই গামছা আর ময়লা জামা পরে কারখানার শ্রমিক সেজে ঘটনার সত্যতা যাচাই করেছি আমি নিজে। আজ অপারেশন।
সঙ্গে বেশ কয়েকটি টিভি মিডিয়া। ভেতরে ঢুকলাম। দোতলা একটি ভবন। নিচে সুতা আর গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। উপরের তলায় ওষুধ কারখানা। ভেতরে ঢুকতেই বিশ্রী একটা গন্ধ নাকে ঢুকতেই বমির উদ্রেক হলো। সামলে নিলাম বমিকে।
কারখানার ভেতরে ওষুধ নিয়ে তাবৎ তামাশার সবকিছুই দেখলাম। না আছে টেস্টিং ল্যাব না আছে ফার্মাসিস্ট। ইন্টারেস্টিং বিষয় লক্ষ্য করলাম, যেখানে ওষুধ বানাচ্ছে সেখানে গিয়ে। বেশ কিছু নারী শ্রমিক ওষুধ বানাচ্ছেন। আবার কেউ প্যাকেট করছেন। কারও গায়ে কোনো অ্যাফ্রোন বা হাতে গ্লোভস কোনোটিই নেই। অনেকেই পিকপিক করে পান খাচ্ছেন। পুরাই একটা হরিঘোষের গোয়াল।
কাছে গিয়ে দেখলাম আটা-ময়দার সঙ্গে চিনি আর তিতা জাতীয় এক ধরনের ক্যামিকেল দিয়ে বানানো হচ্ছে- নাপা, সিটামল, এন্টাসিডসহ নাম না জানা অসংখ্য ওষুধ। জ্বর কাঁশির সিরাপ বানানো হচ্ছে গুড়ের তৈরি শরবত দিয়ে।
নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তৌহিদ এলাহি এবার ডাকলেন production ম্যানেজার সাহেবকে। প্যান্ট-শার্ট পরা স্মার্ট ভদ্রলোক। ‘এরকম করে দিনের পর দিন মানুষকে ঠকিয়ে ভেজাল ওষুধ বানানোর কারণ কী, মানুষের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন কেন?’ এরকম প্রশ্ন শুনে তার চুপ থাকার ভাব দেখে মনে হলো পদ্মা নদীর মাঝি উপন্যাসের গণেশের কথা। গনেশের মনের ক্রিয়াগুলো অত্যন্ত শ্লথ গতিতে সম্পন্ন হতো, এখন দেখছি এই লোক ও সেরকম গণেশ মার্কা। একটু পরে মুখ খুললেন। যা বললেন তাতে মনে হলো ভদ্রলোক ঔষধ শাস্ত্রের পঞ্চকোষ দিব্যি শেষ করেছেন।
অনেক ধানাইপানাই করেলন। কিন্তু এই কানকাটার কথায় কান দেয়ার সুযোগ নেই। বড় অংকের জরিমানা করা হলো, পাশাপাশি জেলও।
দুই.
‘কাপুড়ে বাবু’ কথাটার অর্থ বাহ্যিক সাজ। এই সাজের অন্যতম উপাদান প্রসাধন সামগ্রী। বর্তমানে বাজারে নকল প্রসাধনীর ছড়াছড়ি। নকল প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহারের ধকল অনেকেই জানলেও কেরানীগঞ্জে কিভাবে এই ভেজাল ও মানহীন কসমেটিকস বা প্রসাধন সামগ্রী তৈরি হচ্ছে সে ব্যাপারে অনেকেই জানেন না। চলুন যাওয়া যাক কেরানীগঞ্জে।
‘কসমেটিকস কারখানায় কাজ করেছি দুই বছর। এখন বেকার হয়ে বসে আছি। আপনার কারখানায় কাজ করতে চাই’ এই মর্মে আমার এক সোর্সের মাধ্যমে আগেই রেকি করে রেখেছিলাম ওই কারখানাটিকে। সবকিছু সেদিন দেখতে পারিনি। শুধু আঁচ করতে পেরেছিলাম যে, প্রসাধন তৈরির নামে কী ভয়াবহ জিনিস বানাচ্ছে এরা।
আমরা কারখানার ভেতরে ঢোকার আগেই টের পেয়ে যায় ভেজালিয়ারা। অনেকক্ষণ ধরে টরে টুক্কার পরে ফটক খোলা হলো। এতো পুলিশ আর এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দেখে কারখানা ব্যবস্থাপকের পুরাই থরহরি কম্প শুরু হয়ে গেছে। কারণ তাদের উৎপাদিত প্রতিটি পণ্যই ভেজাল। তারা দীর্ঘ দিন থেকে ভারত, ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের নামিদামি ব্র্যান্ডের নাম করে এসব প্রসাধন সামগ্রী উৎপাদন ও বাজারজাত করে আসছিল বলে স্বীকার করলেন তিনি।
দেখলাম ফেসওয়াশ, ক্রিম, লোশন ও স্ক্রাব তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে- চুনা পাউডার, বস্তাপচা ময়দা, নিম্নমানের হলুদের গুঁড়ো, কাঠের গুঁড়ো, গাম, গ্রিজ আর সঙ্গে বিষাক্ত কেমিক্যাল ও টেক্সটাইল রং। ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ব্র্যান্ড ওয়েলস হেলথ কেয়ারের অলিভ ওয়েল বানাচ্ছে সাক্ষাৎ সয়াবিন তেল দিয়ে। এসব দেখে অবাক হয়েছি। রাগে আর ক্ষোভে ভাবছিলাম এই আনাড়ি ভেজাইল্যা লোকগুলোর হাড়মাটি করে দেয়া উচিত।
সবকিছুতে শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর দোষ চাপিয়ে ক্ষান্ত হই আমরা। কিন্তু সমাজের মানুষ হিসেবে আমাদের প্রত্যেকের উচিত স্থানীয়ভাবে এই ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। মনে রাখতে হবে, ভেজাল কারবারিরা সবাই এক ঝাড়ের বাঁশ। এই বাঁশ গুলোকে চিরতরে উপড়ে ফেলতে হলে সবাইকে সচেতন হতে হবে, গড়ে তুলতে হবে দুর্বার প্রতিরোধ। আর না হলে ‘ভেজাল’ শব্দটিও একসময় সুকান্তের কবিতার মতো দখাঁটি জিনিষ’ এই কথাটা রেখো না আর চিত্তে, ‘ভেজাল’ নামটা খাঁটি কেবল আর সকলই মিথ্যে’এমন হয়ে যাবে।
লেখক: সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ঢাকা মহানগর পুলিশের জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখা।