আর্তমানবতার সেবক প্রয়াত মাদার তেরেসাকে আজ রবিবার সন্ত (সেইন্ট) হিসেবে ঘোষণা দেবে ভ্যাটিকানের রোমান ক্যাথলিক চার্চ। বিশ্বের ক্যাথলিক খ্রিষ্টানদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁকে সন্ত হিসেবে স্বীকৃতি দেবেন। এর মধ্য দিয়ে এই খেতাব পাওয়া ১০ হাজারের বেশি পুণ্যবান মানুষের দলে যুক্ত হবে তেরেসার নাম।
মাদার তেরেসাকে নিয়ে নিজের ভাবনা জানিয়েছেন বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। ভারতীয় দৈনিক আনন্দবাজারে প্রকাশিত তার ‘বিপন্ন বিস্ময়’ শিরোনামে লেখাটি ঢাকাটাইমসের পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-
“মাঝে মাঝে এক-এক জন কিম্ভূত লোক এসে হাজির হন, যাদের কাজই হল আমাদের নানা ভাবে অপ্রস্তুত করা, লজ্জা দেওয়া, অনুতাপ বা আত্মগ্লানিতে দগ্ধে মারা। এই সব লোক এসে আমাদের খুব গন্ডগোলে ফেলে দেন। আমরা ছেলেমেয়েদের কাছে মুখ দেখাতে পারি না। পাঁচ জনের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সংকোচ হয়, এমনকী পাছে নিজের মুখ দেখতে হয় সেই ভয়ে আয়না ছাড়াই আমরা চুল আঁচড়ে নিই।
বেশ তো ছিলাম আমরা বউ-বাচ্চা গৃহকোণটি নিয়ে। খুব ছোটখাটো সুখ-দুঃখ আমাদের, খুব ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জয়-পরাজয়। সামান্য আয় ব্যয় সঞ্চয়। বড় পৃথিবীটাকে ধরতে পারি না বলে আমরা আমাদের মতো জগৎটা ছোট করে নিই। আমাদের গুটিকয় প্রিয়জন মাত্র। আর তাদের দিতেই আমাদের সব ভালবাসা উজাড় হয়ে যায়। কাঙাল ভিখারিদের জন্য আমাদের টাকার সিকেটা বরাদ্দ থাকে। আহা গরিবদেরও তো একটু দেখতে হবে!
ম্যাসিডোনিয়ার এক জন রাঙা যুবককে বিয়ে করে তিনিও তো দিব্যি রাঙা রাঙা ছেলেপুলেদের মা হয়ে সংসারের নিজস্ব স্বর্গ রচনা করতে পারতেন। কে জানে কেন কুমারী কন্যাটির কাঁধে চাপল কোন ভূত। ঘুরে ঘুরে ধুলোটে এই পোড়া কলকাতাতেই এসে জুটতে হল তাকে! এলেন আমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারতে। উটপাখির মতো বালিতে মুখ গুঁজে নিজেকে ভুলিয়ে রেখেছিলাম আমরা, তিনি ভুলতে দিলেন কই! এরা কিছুতেই আমাকে বা আমাদের ভুলতে দেন না যে আমার একটা লড়াই ছিল, যেটা আমি লড়িনি। আমার ঠাকুর যখন আমাদের বলেন, ‘তুমি ঠিক ঠিক জেনো যে তুমি তোমার, তোমার নিজ পরিবারের, দশের এবং দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যতের জন্য দায়ী’, তখন ছ্যাঁকা খেয়ে চমকে উঠি। আবার নিজেকে বোঝাই, আহা, গরিবদের দুঃখমোচন, সে তো সরকারের কাজ! অনাথ আঁতুর রোগী গৃহহীনদের জন্য তো মিশনটিশন রয়েছে। আছে এনজিও, একশো দিনের কাজ, বিপিএল কার্ড। আর আমিই বা কোন বড়লোক, আমার সাধ্য কতটুকু? কিন্তু ভবী ভুলতে চায় না, যখন দেখি মা তেরেসা ফুটপাথে কুষ্ঠরোগীর ক্ষতে হাঁটু গেড়ে বসে প্রলেপ দিচ্ছেন। যার কেউ নেই এমন লক্ষ্মীছাড়া পথশিশুকে তুলে নিয়ে গিয়ে যাচ্ছেন তার অপ্রতুল আশ্রয়ে। বিমানযাত্রায় যেতে যেতে তার অনাথ শিশুদের জন্য সহযাত্রীদের কাছে ভিক্ষা করে নিচ্ছেন তাদের ভুক্তাবশেষ। আমার লড়াই লড়ছেন তিনি। আর তার কর্মকাণ্ডের মধ্যেই যেন নিহিত রয়েছে সেই পুরনো প্ররোচনা, যা আমাকে বলছে, ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং তক্ত্যোত্তিষ্ঠ পরন্তেপঃ।
কে যেন এক বার জিজ্ঞেস করেছিল তাকে, মা, যখন কুষ্ঠরোগীর ক্ষত পরিচর্যা করেন তখন কি আপনার একটুও ঘেন্না হয় না! মা তেরেসা মাথা নেড়ে বলেছিলেন, হয় না, আমি যে ওর মুখে আমার খ্রিস্টের আদল দেখতে পাই!
শোনো কথা!
আমরা কি চোখে কিছু কম দেখি? পাখি, রমণী, প্রজাপতি, টাইগার হিলের সূর্যোদয়, আরব সাগরে সূর্যাস্ত, মাধুরী দীক্ষিতের প্রখর মুখচ্ছবি, তাজমহল, আইফেল টাওয়ার, সবই তো এই পোড়া চোখে দেখতে পাই! কিন্তু দরিদ্র, অকিঞ্চন, বুড়ো, অশক্ত, অনাথ, আতুর, রোগী বা প্রান্তিকদের মুখে খ্রিস্টের আদল দেখতে পাই না তো!
ঠিক কথা, তিনি আসলে ছিলেন এক প্রচারক। তার সেবাধর্মের আবডালে তিনি বলতে চেয়েছিলেন এক ছুতোরের ছেলের কথা। ছুতোরের সেই লক্ষ্মীছাড়া ছেলে তার সংসারের খেলনাপাতি ছেড়ে এক দিন শুধু ভালবাসার টানে ঘর থেকে বাহির হয়ে পড়েছিলেন। ফলস্বরূপ নিজের ক্রুশ নিজেকেই বহন করে বধ্যভূমিতে নিয়ে যেতে হয়েছিল তাকে। ক্রুশে বিদ্ধ করে তাকে যারা মারল, তারা কত বড় ভুল যে করেছিল তা তারা নিজেরা জানলই না। যিশুকে হত্যা করতে গিয়ে তারাই তাকে ভয়ঙ্কর ভাবে জ্যান্ত করে দিয়েছিল, হত্যাকারীরা মরে গেছে কবেই, যিশু দুই হাজার বছর পার করেও দিব্যি বেঁচে আছেন যে! হাতের রক্তাক্ত ক্ষতস্থান দেখিয়ে তিনিই তো মিষ্টি হেসে বলতে পারেন, দিজ আর দি উন্ডস অব লাভ!
মাদার তেরেসা সেই প্রেমের ঠাকুরের কথাই তো বলতে চেয়েছেন তার কর্মকাণ্ডের ভিতর দিয়ে। পোকামাকড়, পিঁপড়ে বা কীটপতঙ্গের অধম হয়ে যে সব মানুষ পড়ে আছে মাঠেঘাটে ফুটপাথে, তাদের ধর্মই বা কী, তাদের আইডেন্টিটি বা কী, নাগরিকত্বই বা কোথাকার! পাসপোর্ট নেই। আধার কার্ড নেই। অনেকের বিপিএল কার্ডও তো নেই! জন্মানোর নথি নেই, মৃত্যুরও খতিয়ান খুঁজে পাওয়া যায় না। মা তাদের মাথায় তার হাতখানি রাখতে চেয়েছিলেন বলে কতই না অপরাধ হয়ে গেল তার।
সন্ত কাকে বলে আমি তা বাস্তবিকই জানি না। শুধু এইটুকু জানি কাউকে কাউকে মানুষ ঈশ্বরপুত্র বা ঈশ্বরকন্যা বলে পুজোটুজো করে। আর পুজো করার পিছনে কাজ করে তার পাটোয়ারি বুদ্ধি। যে বলে, উনি অত সব ত্যাগট্যাগ করেছিলেন, অত সব গরিবগুর্বোর সেবাটেবা করেছিলেন, ভিক্ষে করে করে এত বড় আশ্রম করেছিলেন, ও তো আর আমাদের মতো এলেবেলে লোকের কাজ নয়! এ সব ওই ভগবানের দূতেরাই পারেন। ঠিক কথা, কিন্তু সেই সঙ্গে যদি পাল্টা প্রশ্ন ধেয়ে আসে, কেন তুমি কি ঈশ্বরপুত্র নও? তুমিও কি নও ঈশ্বরকন্যা? তখন আমাদের মূক হওয়ার পালা!
কত দিন ঘুম নেই! দীর্ঘ সাতাশি বছরের ত্রুটিহীন সেবার কাজ। ক্লান্ত মাদার তেরেসা ৮৭ বছর ধরে ছিলেন ‘অবসর নাই তার, নাই তার শান্তির সময়।’১৯৯৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তেরেসা ঘুমিয়ে পড়লেন। আমি তার কাছে কখনও যাইনি। ‘মা’ বলে ডাকিওনি। আজকাল মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে তার সমাধির কাছে গিয়ে বসি। সমাধিফলকে হাত রেখে বলি, মা, জাগো! জেগে ওঠো! বড় ইচ্ছে করে তোমার খর্বকায় শরীরের স্নিগ্ধ ছায়ায়, তোমারই পিছু পিছু কলকাতার ধুলোটে পথে ঘুরে ঘুরে খুঁজে বেড়াই খ্রিস্টের মুখ। বড় ইচ্ছে করে।”