পর পর দুদিন দুটি বড় খবর। মিরপুরের রূপনগরে এ সময়ের জঙ্গি কথিত মেজর মুরাদ (অবসরপ্রাপ্ত মেজর মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম) খতম আর ৭১-এর জঙ্গি মীর কাসেমের ফাঁসি কার্যকর। দ্বিতীয়টি প্রথমটির চেয়ে বড়, তবে প্রথমটি বর্তমান প্রেক্ষাপটে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আর পরেরটি বাংলাদেশের মানুষের ইতিহাসের কাছে দায় শোধ।
অনেকে হয়তো প্রশ্ন তুলতে পারেন কেন দুটি ঘটনাকে একসঙ্গে দেখা হচ্ছে? আসলে একটু খতিয়ে দেখলে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, এখনকার জঙ্গি গোষ্ঠী আর ৭১-এর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির রাজনৈতিক মতাদর্শ এক। এবং তারা আসলে একই গোষ্ঠী যারা বাংলাদেশকে দেখতে চায় এক সাম্প্রদায়িক ভূখণ্ড হিসেবে।
সাম্প্রদায়িকতার সম্প্রসারিত রূপই জঙ্গিবাদ। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচারে এ পর্যন্ত ছয়জনের ফাঁসি হয়েছে। এবারও দেখলাম পাকিস্তান তার মতো করে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে যেটাকে খুব আমলে নেয়ার কিছু নেই বলেই মনে করছি। কিন্তু আশ্চর্য হই অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল যখন এই বিচারের বিরুদ্ধ বিবৃতি দেয়। মৃত্যুদণ্ড নিয়ে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার আপত্তি থাকলেও তাদের মানতে হবে বাংলাদেশের ভেতরে যুদ্ধাপরাধের এই বিচার ব্যাপক জনসমর্থন পেয়ে আসছে। আদালতের এক একটি রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে সেই দিনটিতে বলতে গেলে উৎসবে মেতে উঠে মুক্তিযোদ্ধা, প্রজন্ম একাত্তরসহ সব শ্রেণি পেশার মানুষ। সর্বশেষ মীর কাসেম আলির রায়ের সময়ও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাস্তায় ছুটে আসে মানুষ, তারা আনন্দ মিছিল করে, দেশাত্মবোধক গান গায়। রাজনৈতিক মতাদর্শে যার যেটুকু বিরোধ থাকুক না কেন, সবাই এক বাক্যে স্বীকার করেন এই বাংলাদেশে এমনটা সম্ভব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার কারণেই।
মীর কাসেমের ফাঁসির মাধ্যমে একটি পর্যায় পার করলো এই বিচারিক কার্যক্রম। জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের বড় অংশই এখন আর নেই। ফাঁসি না হলেও সর্বোচ্চ আদালতে যুদ্ধাপরাধ প্রমাণিত হয়েই মারা গেছে জামাতের গুরু, সাবেক আমির গোলাম আজম।
রাজনৈতিক কারণে, জামায়াতে ইসলামীর সাথে মিত্রতার কারণে বিএনপি প্রথম দিকে এই বিচারের বিরোধিতা করলেও এখন মৌন থাকছে। রাজনৈতিক মতাদর্শতায় ভিন্নতা থাকলেও এই একটি ইস্যুতে বাংলাদেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ। গত বছর ঢাকা ট্রিবিউনের এক জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৭৯ ভাগ মানুষ যুদ্ধাপরাধের বিচার অব্যাহত রাখার পক্ষে।
২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরঙ্কুশ বিজয়ের পেছনে যুদ্ধাপরাধের বিচার পুনরুজ্জীবিত করার ব্যাপারে তার দৃঢ় অঙ্গীকার বড় ভূমিকা রেখেছে। দেশের তরুণ সমাজ বড় ভূমিকা রেখেছে এ বিষয়ে জনমত তৈরিতে। বিদেশি সংস্থা আর দেশে যারা এই বিচারকে নিয়ে নানা কথা বলছেন, তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের মানুষের মরণপণ লড়াই ও পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ব্যাপক গণহত্যার বিষয়টি আজও সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করতে পারছেন না। পাকিস্তানি বাহিনী আর তাদের এদেশীয় দোসররা অনেকের ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়েছে, নির্মমভাবে হত্যার উৎসবে মেতেছিল তারা। শহীদ পরিবারগুলোর মর্মজ্বালা ও দুঃখ-বেদনা অনুধাবন করা খুব সহজ নয়। দশকের পর দশক প্রজন্ম একাত্তর দেখছে এসব অপরাধী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যারা এই দেশটি চায়নি তাদের মন্ত্রী বানিয়ে চরম অপমাণ করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে, একাত্তরের শহীদদের।
দেশের মানুষ দীর্ঘ সময় তৃষিত থেকেছে ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য। ধর্ষণ ও নির্যাতন শুধু নয়, পরাজয় নিশ্চিত জেনে এই রাজাকার, আল বদররা আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করে, শুরু করল নিষ্ঠুর বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড। এসব বুদ্ধিজীবীর মধ্যে অনেকেই ছিলেন ডাক্তার, শিল্পী, শিক্ষক ও লেখক। জঘন্য এসব অপরাধী চারদশকেরও বেশি সময় বিচার প্রক্রিয়া থেকে দূরে থাকতে পেরেছে, কারণ ১০৭৫ এর ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে দেশে এসেছিল তাদেরই সরকার। ১৯৭২ এ দেশে ফিরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই বিচারকাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ভয়াবহ ও নারকীয় হত্যাকাণ্ডের পর সেই প্রক্রিয়া থেমে যায়।
ন্যায় হতে বিযুক্ত হলে বিচারের অর্থ থাকে না। আজ বাংলাদেশ ন্যায় বিচার করছে। ন্যায়ের মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া জরুরি। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, যেখানে আইনের শাসন, ন্যায় বিচার বলবৎ রাখার দায় আমাদের সরকারের। সে কাজটি সরকার করছে। তাহলে অ্যামনেস্টি কেন এ বিষয়ে বিবৃতি দেয়? তারা কি জানে কী কষ্ট লালন করে চলেছে এইসব যুদ্ধাপরাধীর হাতে নিহত আর নির্যাতিতদের পরিবারগুলো?
বাংলাদেশের জন্মের সময় যত বড় মানবতাবিরোধী অপরাধ সংগঠিত হয়েছে, পৃথিবীর ইতিহাসে তা নজিরবিহীন। সেই অপরাধের বিচার হচ্ছে, কারণ মানুষ রায় দিয়েছে যে, এ বিচার হতেই হবে। এখানে যুদ্ধাপরাধের বিচার একটা সুষ্ঠু প্রক্রিয়ায় হচ্ছে। বিশেষ করে অপরাধীরা সব রকমের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ পেয়েছে, দীর্ঘ সময় পেয়েছে। দেশে বিদেশে বিপুল অর্থ খরচ করে প্রচারণা চালিয়েও যুদ্ধাপরাধীরা তাদের অপরাধ আড়াল করতে পারেনি। তার কারণ সত্য কখনো চাপা দিয়ে রাখা যায় না, তা বেরিয়ে আসবেই।
মীর কাসেম নিজামীদের অর্থবিত্ত, রাজনৈতিক ও সন্ত্রাসী শক্তি এবং আন্তর্জাতিক যোগাযোগ প্রশ্নাতীত। তবু্ও বিচার হয়েছে, হচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে, ভয়ংকর সব যুদ্ধাপরাধ হয়েছে এদেশে এবং এরা করেছে। এই সত্য বাংলার মানুষ জানে। সত্য অপরাধের বিচার হচ্ছে এবং হতেই থাকবে, যেখান থেকেই চাপ আসুক না কেন।