পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজ চলছে বেশ কয়েকটি ভাগে। নদী শাসন, মূল সেতু, সংযোগ সড়ক, সার্ভিস এরিয়া, নিরাপত্তা, তদারকি, জমি অধিগ্রহণ, নিরাপত্তা পরিবেশসহ মোট ১২টি প্যাকেজে চলছে কাজ।
তবে প্রধান আগ্রহ মূল সেতুর কাজ নিয়েই। সরকারি হিসাব বলছে মূল সেতুর ভৌত ও বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে চার ভাগের এক ভাগেরও বেশি, শতকরা হিসেবে ২৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মূল কাজ উদ্বোধনের পর গত ১০ মাসেই এইটুকু অগ্রগতি হয়েছে।
পরিকল্পনা অনুযায়ী মূল সেতুটির কাজ করতে হলে দুই বছরের তিন মাসের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে বাকি ৭১ দশমিক ৫০ শতাংশ কাজ।
সব মিলিয়ে ১২টি প্যাকেজে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা খরচ ধরা হয়েছে। এর মধ্যে মূল সেতুতে খরচ হবে ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ ৩০ হাজার ৬৮২ টাকা। এখন পর্যন্ত খরচ হয়েছে চার হাজার ৪১৪ কোটি টাকা।
সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের মধ্যে সবার ওপরে এই সেতু প্রকল্পটি। এটি নিয়ে শুরু থেকেই জল ঘোলা হয়েছে অনেক। অর্থায়ন নিয়ে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগে বিশ্বব্যাংক অধ্যায় শেষের পর সরকার নিজ টাকায় সেতু করছে। বাংলাদেশ এত বড় প্রকল্প কখনই নিজ টাকায় করার মত সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। দেশের সবচেয়ে বড় সেতুটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চালুর ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এই সময়সীমা অতিক্রম করবে না বলে একাধিকবার বলেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সেতু বিভাগের সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘মূল পদ্মা সেতুর কাজ অনেক অগ্রগতি হয়েছে। এখন নদীতে পানি বৃদ্ধি পেলেও কাজের কোনো সমস্যা হচ্ছে না।’
সরকারি হিসাবে দেখা যায়, ১২টি প্যাকেজের মধ্যে অন্তত দুটি প্যাকেজের দিক থেকে পিছিয়ে আছে। এর দুটিই সংযোগ সড়ক নির্মাণের বিষয়টি। পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়েছে জমি অধিগ্রহণ ও ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন কাজ।
প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘প্রত্যেকটা প্রকল্প আমাদের যে টাইমলাইন দেয়া আছে আমরা সেই মোতাবেক কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।’
মূল সেতুর কাজ কতটা এগিয়েছে?
চীনা প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেড এই কাজ পেয়েছে। সেতুর ওপরের অংশ নির্মাণ হচ্ছে চীনে। দেশে এনে এগুলো সংযোজন করা হবে। মূল সেতুর কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের ২৬ নভেম্বর। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর।
মূল সেতুর ২৪টি পাইলের নিচের অংশে ৭০ মিটার এবং তিনটি পাইলের সম্পূর্ণ ১২৮ মিটার পর্যন্ত ড্রাইভ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর ৩০ হাজার মিটার স্টিল পাইল ফেব্রিকেশনের মধ্যে ১৭ হাজার মিটারের কাজ শেষ হয়েছে।
পাইল নির্মাণ কাজে ব্যবহারের জন্য মোট এক লাখ ২৯ হাজার টন স্টিল প্লেটের মধ্যে এক লাখ টন স্টিল প্লেট সেতু এলাকায় পৌঁছেছে। চীনে সুপার স্ট্রাকচারের থ্রিডি অ্যাসেম্বলিং এর কাজ চলমান আছে। ১৫০ মিটার স্প্যানের একটি ট্রাস বোঝাই জাহাজ চীন থেকে মাওয়া পৌঁছেছে। দ্বিতীয় স্প্যানটি বাগেরহাটের মংলা বন্দরে পৌঁছেছে।
এরই মধ্যে মূল সেতুর আটটি টেস্ট পাইলের মধ্যে পাঁচটি, এবং ডায়াডাক্টের সব টেস্ট পাইলের কাজ শেষ হয়েছে। মূল সেতুর অ্যালাইনমেন্ট বরাবর ১৫০ মিটার প্রশস্ত করে চ্যানেল তৈরির কাজও শেষ হয়েছে।
নদী শাসন কতদূর
মূল সেতুর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটির একটি পেয়েছে চীনা কোম্পানি সিনো হাইড্রো লিমিটেড। মূল সেতুর পর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্যাকেজে ব্যয় হবে আট হাজার ৭০৭ কোটি ৮১ লাখ ৪১ হাজার ৪৪৬ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি।
এই কাজের অগ্রগতিও মূল সেতুর অগ্রগতির কাছাকাছি, প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। শতকরা হিসাবে অগ্রগতি ২৩ দশমিক ৬৪ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নদী শাসন কাজের বিভিন্ন সাইজের রক, স্টোনচিপস, বালি, সিমেন্ট ও অীন্যান্য নির্মাণ সামগ্রী সাইটে প্রক্রিয়াধীন আছে। ইতোমধ্যে জিও ব্যাগে এ বালি ভরার জন্য ও কংক্রিট ব্লক উৎপাদনের জন্য মেশিন স্থাপন শেষ হয়েছে। এক কোটি ৩৩ লাখ এক হাজার ২৪৮টি কংক্রিট ব্লকের মধ্যে ৩০ লাখ ব্লক কাস্টিং হয়েছে। দুই কোটি ১২ লাখ জিও ব্যাগের মধ্যে ১১ লাখ ব্যাগ নদীতে ফেলা হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে স্থায়ী ড্রেজিং এর কাজ চলছে। মাওয়া প্রান্তেও ৮০০ জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। মাওয়া প্রান্তে গত বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙনে তৈরি হওয়া সাত লাখ ঘনমিটারের দুইটি গর্তও ভরাট হয়েছে।
সবচেয়ে এগিয়ে সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এরিয়ার কাজ
তবে এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে মাওয়া সংযোগ সড়কের কাজ। এই সড়কের ৯৮ শতাংশ কাজই শেষ হয়েছে। গত ১১ জুলাই এই কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সামান্য পিছিয়ে আছে।
পদ্মার ওপারে জাজিরা সংযোগ সড়কের কাজও শেষ হয়নি। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর শুরু হওয়া এই কাজ শেষ হওয়ার কথা আছে ৭ অক্টোবর। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই কাজে অগ্রগতি হয়েছে ৭৬ শতাংশ।
সার্ভিস এরিয়া-২ এর কাজও গত ১১ জুলাই শেষ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ করা যায়নি এই কাজ। যদিও অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ। বাকি কাজও দ্রুত শেষ হবে বলে আশা করছে সরকার।
টোলপ্লাজা, পুলিশ স্টেশন ও ফায়ার স্টেশন নির্মাণ প্রায় শেষে পথে অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়।
অন্যান্য প্যাকেজ
প্রকৌশল সহায়তা ও নিরাপত্তা প্যাকেজে কাজ হয়েছে এখন পর্যন্ত ৫৮ শতাংশ। বাকি কাজ শেষ করতে আরও এক বছরেরও বেশি সময় আছে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে চলা এই প্যাকেজটি শেষ হওয়ার কথা আছে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর।
কনস্ট্রাকশন সুপারভিশন কনসালটেন্ট প্যাকেজ-১ এ অগ্রগতি হয়েছে ৭১ শতাংশ। এই কাজ শেষ হওয়ার কথা আছে ২০১৭ সালের ১৩ অক্টোবর। আর প্যাকেজ-২ এ অগ্রগতি ২৮ শতাংশ। পরিকল্পনা অনুযায়ী এই কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০১৮ সালের ১৩ নভেম্বর।
ভূমি অধিগ্রহণ বিষয়ে অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, তিন জেলায় মোট মোট দুই হাজার ১৬৬.২৪ হেক্টর জমির মধ্যে এক হাজার ৪৭১ হেক্টর অধিগ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে দখল বুঝে নেয়া হয়েছে এক হাজার ১৫১ হেক্টর।
পুনর্বাসন খাতে ৫৯০,৮৩ কোটি টাকা অতিরিক্ত সহায়তা বাবদ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারে মাঝে বিতরণ করা হয়েছে।
প্রকল্প পর্যায়ে প্লট বরাদ্দ কমিটি কর্তৃক সুপারিশকৃত দুই হাজার ২০৩টি প্লটের মধ্যে এক হাজার ৯৫০ টি প্লট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এদের মধ্যে ভূমিহীন (ক্ষতিগ্রস্ত) ৫৪৫টি পরিবারকে বিনামূল্যে প্লট দেয়া হয়েছে।
পরিবেশ রক্ষায় পদ্মা সেতুর উভয়পাশে এপ্রোচ রোড ও সার্ভিস এরিয়াগুলোতে বনায়নের জন্য এখন পর্যন্ত ৮০ হাজার ৮৮৬টি গাছ লাগানো হয়েছে।