‘কেন এত বেশি ভাড়া দিতে হবে তোমাকে? কদমতলী থেকে কাওরান বাজারের ভাড়া ২০ টাকা, কেন ৩৫ টাকা দিতে হবে?’ দিশারী পরিবহনের একটি বাসের কন্ডাক্টরের সঙ্গে উত্তেজিত বিতণ্ডা চলে আসলাম হোসেন নামের এক যাত্রীর। শুধু দিশারী পরিবহনে নয়, রাজধানীতে চলাচল করা প্রায় সব গণপরিবহনেই এই ভাড়া-নৈরাজ্য চলছে।
এদিকে সড়ক পরিবহনমন্ত্রী প্রায়ই বিভিন্ন সড়কে দৌড়ঝাঁপ করছেন পরিবহন-নৈরাজ্য ঠেকাতে; বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত ও পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করছে, কিন্তু ফল আসছে না কোনো।
নানা কায়দায় যাত্রীদের পকেট কেটে চলেছে বাসওয়ালারা। যাত্রীদের অসহায় আত্মসমর্পণ কিংবা নিস্ফল বিতন্ডা করা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
গ্যাসের দাম বাড়ার পর সিএনজিচালিত বাস-মিনিবাসের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করে বিআরটিএ। ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরীতে চলাচলকারী বাস-মিনিবাসের ভাড়া যাত্রীপ্রতি কিলোমিটারে নির্ধারণ করা হয় যথাক্রমে ১ টাকা ৭০ পয়সা এবং ১ টাকা ৬০ পয়সা। এ ছাড়া সর্বনিম্ন ভাড়া ৭ টাকা ও ৫ টাকা অপরিবর্তিত রাখা হয়। কিন্তু নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত নেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করছে অধিকাংশ যাত্রীরা।
সরকার দফায় দফায় ভাড়া বাড়ানোর পরও যাত্রীদের কাছ থেকে বাসওয়ালাদের অতিরিক্ত ভাড়া নেয়ার নৈরাজ্য থামছে না। রাজধানীতে বিভিন্ন রুটে বিভিন্ন পরিবহন একই দূরত্বে আদায় করছে ভিন্ন ভিন্ন ভাড়া। যার যেমন ইচ্ছা নির্ধারণ করছে ভাড়ার হার। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে কোনো কোনো পরিবহন ‘সিটিং’ কিংবা ‘কম স্টপেজ’ নাম দিয়ে ভাড়া আদায় করছে তিন-চার গুণ। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত যাত্রী ও বাসকর্মীদের মধ্যে বাগবিতন্ডা এমনকি মারামারির ঘটনা ঘটছে।
সরেজমিন চিত্র
বুধবার রাজধানীর মতিঝিল, পল্টন, প্রেসক্লাব, শাহবাগ, বাংলামটরসহ বেশ কিছু সড়কে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, প্রায় প্রতিটি গণপরিবহনেই যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। রাজধানীর ভেতরে ও আশপাশের জেলাগুলোতে চলাচলকারী প্রায় প্রতিটি বাস ও মিনিবাসেও একই চিত্র। বর্তমানে প্রথম তিন কিলোমিটারের ভাড়া মিনিবাসে ৫ টাকা ও বড় বাসে ৭ টাকা। কিন্তু বাস্তবে প্রকাশ্যে ছাপানো টিকিটের মাধ্যমেই আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত দুই গুণ অথবা তিন গুণ ভাড়া।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, রাজধানীর ৭০ ভাগ গণপরিবহন সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করছে ১০ টাকা। ২০ ভাগ গাড়ি আদায় করছে ১৫ থেকে ২০ টাকা। অর্থাৎ কেবল ১০ ভাগ গাড়ি নিয়ম অনুযায়ী ৫ বা ৭ টাকা সর্বনিম্ন ভাড়া আদায় করছে।
রাজধানীর গুলিস্তানে গিয়ে দেখা যায় ভাড়া-নৈরাজ্যের মহোৎসব। গুলিস্তান থেকে মুন্সীগঞ্জের ভাড়া ৪২ টাকা। কিন্তু কুসুমপুর পরিবহন আদায় করছে ৫০ টাকা, দিঘীরপাড় ট্রান্সপোর্ট পরিবহন আদায় করছে ৬০ টাকা এবং এম মল্লিক পরিবহন নিচ্ছে ৭০ টাকা।
গুলিস্তান থেকে নারায়ণগঞ্জের ভাড়া ২২ টাকা হলেও আনন্দ পরিবহন বাদে বাকি সব পরিবহনেই আদায় করা হচ্ছে অতিরিক্ত ভাড়া। হিমাচল আদায় করছে ৩৬ টাকা, যমুনা এক্সপ্রেস ৫০ টাকা।
গুলিস্তান থেকে মিরপুর-১২ পর্যন্ত ২২ টাকার ভাড়া স্বাধীন এক্সপ্রেসে নেয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। দিশারী পরিবহন কদমতলী থেকে চিড়িয়াখানা পর্যন্ত ৩৫ টাকার বদলে আদায় করছে ৭০ টাকা। রাজধানীর সায়েন্সল্যাব থেকে মৎস্যভবন পর্যন্ত ভাড়া ৭ টাকা। সেখানে তরঙ্গ প্লাস বাস নিচ্ছে প্রায় চার গুণ ২৫ টাকা ভাড়া। অথচ গুলিস্তান থেকে সায়েন্সল্যাব পর্যন্ত ইটিসিএল ভাড়া নিচ্ছে ১২ টাকা। তাও ন্যায্য ভাড়ার চেয়ে দুই টাকা বেশি।
২০১৫ সালের ৫ অক্টোবর রাজধানীতে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধে বিআরটিএর মনিটরিং টিম ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম পরিদর্শনে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি বাস-মিনিবাসে ভাড়ার তালিকা দৃশ্যমানভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত আদায়কারী পরিবহনের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। পুনর্নিধারিত ভাড়ার অতিরিক্ত কোনোভাবেই আদায় করা যাবে না।’ সড়কমন্ত্রীর সেই বক্তব্য থোড়াই কেয়ার করছে বাসওয়ালারা।
বিআরটিসির বাসেও নেয়া হয় অতিরিক্ত ভাড়া
সরকার মালিকাধীন বিআরটিসির বাসও থেমে নেই অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য থেকে। গুলিস্তান থেকে আরিচাঘাট পর্যন্ত ভাড়া ৬০ টাকা হলেও যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে ১০০ টাকা। এর আগে একই রুটে ভাড়া আদায় করা হতো ৮০ টাকা। সে সময় স্বয়ং সড়ক পরিবহনমন্ত্রী বিআরটিসির এক বাসকে শোকজ করেছিলেন। কিন্তু সড়কমন্ত্রীর সেই শোকজের পরও রাষ্ট্রায়ত্ত পরিবহন সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি অতিরিক্ত ভাড়া আদায় থেকে সরে না এসে উল্টো ভাড়া বাড়িয়ে ১০০ টাকা আদায় করছে।
এ বিষয়ে কথা হয় বিআরটিসির কন্ডাক্টর মাহফুলের সঙ্গে। বিআরটিসির এ বাসটি যাবে সাভারের নন্দন পার্ক পর্যন্ত। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, সরকারের নির্ধারিত ভাড়া আদায় করলে পোষায় না, তাই ১০-২০ টাকা বেশি রাখি যাত্রীদের কাছ থেকে। মতিঝিল থেকে সাভার পর্যন্ত ভাড়া নিচ্ছি ৬০ টাকা এবং নন্দন পার্ক ৮০ টাকা।’
অভিযানেও দমছে না নৈরাজ্য
গণপরিবহনে নানা অনিয়ম দমনে নানা সময় পুলিশের ট্রাফিক বিভাগসহ বিআরটিএ ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করলেও তাতে তেমন একটা কাজে আসছে না। সড়ক শৃঙ্খলার দায়িত্ব পালনকারী ট্রাফিক বিভাগের সঙ্গে কথা বললে তারা জানায়, প্রতিনিয়ত এই বিষয়ে অভিযান পরিচালনা করা হয়। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। মামলা দিলেও বাসওয়ালারা কিছু মনে করে না। অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করেই যাচ্ছে রাজধানীতে চলাচলকারী গণপরিবহন।
পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলেও এর সত্যতা মেলে। শিখর পরিবহনের কন্ডাক্টর হযরত আলী ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যাত্রাবাড়ী থেকে মিরপুরের ভাড়া ৩৫ টাকা নিচ্ছি। আমাদের এটা গেট লক পরিবহন। যাত্রাবাড়ী থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট থেকে মিরপুর- দুই ভাগে ভাড়া দিতে হয়। এই দুই গন্তব্যের মধ্যে যেখানেই নামা হোক ভাড়া দিতে হয় একই।
যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া কেন আদায় করছেন জানতে চাইলে কদমতলী থেকে চিড়িয়াখানাগামী দিশারী পরিবহনের কন্ডাক্টর আক্তার হোসেন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের এটা গেটলক সাভিস। যেখানেই নামেন মাঝখানে ফার্মগেট এবং চিড়িয়াখানার ভাড়া দিতে হয়। সে ক্ষেত্রে কদমতলী থেকে ফার্মগেট দিতে হবে ৩৫ টাকা এবং ফার্মগেট থেকে দিতে হবে ৩৫ টাকা।’ এ্ নিয়ে যাত্রীদের কোনো অভিযোগ নেই বলে দাবি করেন তিনি।
তার একটু বাদে যাত্রী আসলাম হোসেনের সঙ্গে বিতণ্ডায় জড়িয়ে যান কন্ডাক্টর আক্তার। পরে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসলাম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কদমতলী থেকে যেখানে ২০ টাকা ভাড়া সেখানে সে দাবি করছে ৩৫ টাকা। আমরা এদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছি। দেখার যেন কেউ নেই। গেটলক বলেও গুলিস্তান থেকে প্রেসক্লাব পর্যন্ত ছয়জন যাত্রী উঠিয়েছে গাড়ি থামিয়ে।’
যাত্রীদের কাছ থেকে বাসওয়ালাদের অতিরিক্ত ভাড়া আদায় প্রসঙ্গে কথা হয় শাহবাগ ট্রাফিক জোনের সার্জেন্ট আরিফুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘যদি কোনো যাত্রী আমাদের কাছে এসে অভিযোগ করে তখন তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হয়। প্রায় প্রতিদিন এ রকম অনেক অভিযোগ আসে, আমরাও ব্যবস্থা নিচ্ছি।’ যাত্রীরা সচেতন হলে এই সমস্যা ৯০ ভাগ কমে যাবে বলে মনে করেন এই সার্জেন্ট।
আরিফুল আরো জানান, রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ট্রাফিক বিভাগ থেকে ঝটিকা অভিযান পরিচালনা করা হয় পরিবহনে নৈরাজ্য ঠেকাতে।
গণপরিবহনে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি স্বীকার করে বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) পরিচালক (এনফোর্সমেন্ট) বিজয় ভূষণ পাল ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা বিআরটিএর পক্ষ থেকে প্রতিদিন মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করছি। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। যদি কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ দেয় সে ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।’