ঢাকার হেলথ ফার্মার সোহেল রানা ১০ বছর ধরে মোটরসাইকেল চালান। তার অভিযোগ, ঢাকা নগরের বেশিরভাগ পেট্রল পাম্প তেল কম দেয়। ওজনে চুরি এড়াতে তিনি এলেনবাড়ী ট্রাস্ট ফিলিং স্টেশন থেকে পেট্রল কেনেন। পরিবহনে তেল সরবরাহকারী বেশিরভাগ পাম্প মিটারে কারসাজির মাধ্যমে ওজনে কম তেল দিয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। এই জালিয়াতি প্রতিরোধে প্রশাসন একাধিকবার উদ্যোগ নিলেও মাঠ পর্যায়ে গিয়ে তা মুখ থুবড়ে পড়ছে। ফলে গ্রাহকদের লাখ লাখ টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, অকটেন, কেরোসিন, পেট্রল ও ডিজেলের অনুমোদিত এক হাজার ৫৬৬টি তেল পাম্প এবং অনুমোদনহীন ১০৩টি পাম্পের মধ্যে বেশির ভাগ পাম্প গ্রাহকদের ওজনে তেল কম ও ভেজাল বিক্রি করছে। প্রতিমাসে ৪৫ লিটার অকটেন এবং ডিজেল ২৮ লিটার ওজনে কম দিয়ে ২৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে পাম্প মালিকরা। এ হিসেবে বছরে গ্রাহকদের গচ্চা দিতে হচ্ছে প্রায় সোয়া তিন কোটি টাকা।
এদিকে জ্বালানি তেলের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে গঠিত কমিটির ১২টি সুপারিশ এখনো বাস্তবায়ন করতে পারেনি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশ পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা স্বীকার করে বলছেন, রাজধানী ঢাকায় ওজনে চুরির প্রবণতা কম। তবে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের ভোক্তারা বেশি ঠকছে। বিএসটিআই ১৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে এর মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ ১৬২টি পাম্প, ২৮টি পাম্পের মালিকের বিরুদ্ধে মামলা ও টাকা জরিমানা করেছে। তার পরও প্রতিনিয়তই পেট্রল পাম্পগুলোর মধ্যে গ্রাহক ঠকানোর প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
আইন অনুযায়ী, ওজনে তেল কম দিলে অনূর্ধ্ব ১০ হাজার টাকা জরিমানা করার কথা। আবার প্রতিটি অপরাধের জন্য অর্থদ-সহ ৩ বছরের কারাদ- বিধানের নিয়ম আছে। তবে দ- বাস্তবায়ন হচ্ছে না বলে গাড়ির মালিকরা জানিয়েছে। তবে বাংলাদেশ পেট্রলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) থেকে দাবি করা হয়, ইতিমধ্যে অনুমোদনহীন ১০৩টি পাম্প চিহ্নিত করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাস পর্যন্ত বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই) ৩০টি অভিযান পরিচালনা করে। এতে ১২৪টি পেট্রল পাম্পকে ১ কোটি ২ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। এই সময় মামলা করা হয়ে ২৮টি।
কল্যাণপুরের মেসার্স শাহিল ফিলিং স্টেশন ম্যানেজার মোজাম্মেল হক জানান, প্রতিদিন অকটেন, পেট্রল ও ডিজেল বিক্রি করি ১৫ থেকে ১৬ হাজার লিটার। এর মধ্যে ডিজেল বিক্রি করা হয়ে থাকে বেশি। আর বিএসটিআই বলছে শাহিল ফিলিং স্টেশন পাম্পপ্রতি ১০ লিটারে অকটেনে ৫০ মি.লি. তেল গ্রাহকদের কম দিচ্ছে। একইভাবে ডিজেলপ্রতি ১০ লিটারে ৫০ মি.লি. গ্রাহকদের কম দেওয়া হচ্ছে, যা প্রতিমাসে ডিজেল ২৮ লিটার ও অকটেন ৪৫ লিটার কম দেওয়া হচ্ছে। ডিজেলে ১৮ হাজার ২০০ টাকা এবং অকটেনে ৪ হাজার ৫০০ টাকা গ্রাহকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এই ঘটনায় বিএসটিআইয়ের ভ্রাম্যমাণ আদালত মামলা করেছে।
সাংবাদিক গোলাম মোস্তফা প্রায় ১৫ বছর ধরে মোটরসাইকেলে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করেন। তিনি বলেন, ‘কিছু দিন আগে আমাকে শেরাটন হোটেল সংলগ্ন পেট্রল পাম্প ঠকিয়েছে। আমার ইয়ামাহা মোটরবাইকে সাড়ে ৭ লিটার তেলের ট্যাঙ্কিতে ওরা ১২ লিটার তেল ভরেছে বলে দাবি করেছে। সেই সময় পেট্রল পাম্পের লোকজনের সঙ্গে তর্কবিতর্ক করেও কোনো লাভ হয়নি। তখন আমাকে আশপাশের কেউ সাপোর্টও দেয়নি। ’
রাজধানীর তেজগাঁও শিল্প এলাকার সিটি সিএনজি তেল পাম্প প্রতিনিয়ত ওজনে তেল কম দিচ্ছে। শুধু গ্রাহকদের অভিযোগ নয়, মান নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা বিএসটিআই কয়েকবার জরিমানা করেছে পাম্পটিকে। তবে বিএসটিআইর জরিমানার কথা অস্বীকার করে পাম্প কর্তৃপক্ষ। তেল কম দেওয়া প্রসঙ্গে পাম্পের ভারপ্রাপ্ত ম্যানেজার উত্তম বলেন, ‘আমরা কাউকে তেল কম দিই না। সব সময় আমরা সরকারি লোকের কাছে তেল বিক্রি করি। তেল কম দিলে আমাদের কাছে ক্রেতা আসত না।’
বিএসটিআইর তালিকা অনুযায়ী, ওজনে কম এবং ভেজাল দেওয়া ফিলিং স্টেশনগুলো হচ্ছেÑ মেসার্স রহমান ফিলিং স্টেশন, মেসার্স লতিফ অ্যান্ড সন্স ফিলিং স্টেশন, মেসার্স তাসিন সিএনজি ফিলিং স্টেশন, উত্তরা ফিলিং স্টেশন, শাহিল ফিলিং স্টেশন, পদ্মা অয়েল কোম্পানির অধীনে ঢাকার যাত্রাবাড়িতে অবস্থিত সাহানা ফুয়েল, বগুড়ায় অবস্থিত জীবিকা ফুয়েল সেন্টার, ত্রিশা এন্টারপ্রাইজ, এম. আর. ট্রেডার্স, মেঘনা অয়েল কোম্পানির অধীনে সরদার ফিলিং স্টেশন, হক ফিলিং স্টেশন, যমুনা অয়েল কোম্পানির অধীন গাইবান্ধায় অবস্থিত বাঁধন ফিলিং স্টেশন, লক্ষ্মীপুরে মতিন ট্রেডার্স ও নওগাঁর নিউ খন্দকার স্টোর।
বিএসটিআই মেট্রোলজি উইংয়ের জুলাই মাসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সারা দেশে ১৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করেছে। পাম্প পরিদর্শন করেছে ৫৪টি, পরিদর্শনকৃত ডিসপেনসিং ইউনিটের সংখ্যা ১৬২টি, ত্রুটিপূর্ণ পাম্প পাওয়া গেছে ১৮টি, মামলা করা হয়েছে ২৮টি, মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে ২৬টি, জরিমানা করা হয়েছে এক লাখ ২ হাজার টাকা।
২০১৩-১৪ অর্থবছরে ওজনে তেল কম দেওয়ার কারণে দেশব্যাপী তেল পাম্পগুলোর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ১১১টি। এছাড়া একই সময়ে ওজনে কম তেল দেওয়ার কারণে পাম্পগুলোকে জরিমানা গুনতে হয়েছে ৯ লাখ ১০ হাজার টাকা। জালিয়াত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি সমর্থন করলেন বাংলাদেশ পেট্রল পাম্প ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোহাম্মদ নাজমুল হক। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা চাই সরকার এগুলোর বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করুক।’
এ বিষয়ে বিএসটিআইর মহাপরিচালক ইকরামুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা নিয়মিতভাবে তেল পাম্পগুলোতে অভিযান পরিচালনা করছি, যাতে করে গ্রাহকরা হয়রানি না হয়। অনেক সময় যদি গ্রাহকরা আমাদের কাছে অভিযোগ দেন তবে আমরা তাৎক্ষণিকভাবে অভিযোগের ভিত্তিতে তেল পাম্পে অভিযান চালাই এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে জরিমানা করে থাকি ও আইনানুগ ব্যবস্থা নিই।’
পেট্রল পাম্পগুলোর গ্রাহক ঠকানোর প্রবণতা বৃদ্ধি প্রসঙ্গে ইকরামুল হক বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের মনোভাব আগে পরিবর্তন করতে হবে। তারা (তেল পাম্প) যেমন গ্রাহক ঠকানো বৃদ্ধি করছে তেমনিভাবে আমরাও জরিমানার মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছি। পেট্রল পাম্পগুলোতে অভিযান আরও কঠোর করার পরিকল্পনা রয়েছে।’
১২ দুফা সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি
জ্বালানি বিভাগের উদ্যোগে পেট্রল পাম্প ও জ্বালানি তেল বিক্রি তদারকিতে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি গঠিত হয়েছিল। কমিটির বৈঠকে জ্বালানি তেলের সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করতে ১২টি সুপারিশ করা হয়। এর মধ্যে আছে মেরিন বা বার্জ ডিলার নিয়োগে বিপিসির নীতিমালা অনুসরণ করা, ডিলারদের বিপণন কোম্পানি থেকে তেল উত্তোলনের হিসাব রাখা, তেল তোলার আগে কত পরিমাণ তেল ট্যাংকে মজুদ ছিল তার হিসাব রাখা, বার্জের ফ্লো মিটার বিএসটিআইর মাধ্যমে চেক করা। এছাড়া বৈঠকে কনডেনসেটের দাম পুনঃনির্ধারণ করাসহ বিভিন্ন কারিগরি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বাস্তবে সুপারিশগুলো সেভাবে অনুসরণ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ আছে। এ প্রসঙ্গে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আহসানুল জব্বার বলেন, আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে বিপিসিকে বলা হয়েছে। এছাড়া ওজনে কম ও ভেজাল তেল দেওয়া পাম্প মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ডিসিদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ১২ দফা সুপারিশ একে একে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে দাবি করলেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। তিনি ঢাকাটাইমসকে বলেন, অকটেন, কেরোসিন, পেট্রল ও ডিজেলের ওজনে কম দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনেক রকমের সুপারিশ আছে। এগুলো বাস্তবায়িত হলে কোনো সমস্যা আর থাকবে না।