প্রকাশ : ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:১৬:৫১আপডেট : ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১০:২০:১৪
পারিবারিক সন্ত্রাসের ভয়াবহ রূপ
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
ঈদের আগে পরে দেশে যে কয়টি হত্যার ঘটনা এসেছে গণমাধ্যমে তার বেশিরভাগই হয়েছে পারিবারিক বিরোধকে কেন্দ্র করে। এসব ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মা বা বাবা সন্তানকে, সন্তান বাবাকে, স্বামী স্ত্রীকে, চাচা ভাতিজাকে বা ভাতিজা চাচাকে, ভাই ভাইকে হত্যার অভিযোগ উঠেছে করেছে। গত একসপ্তাহে এ রকম অন্তত পাঁচটি পারিবারিক খুনের ঘটনা আলোড়ন তুলেছে। এই নৃশংসতার শিকার হচ্ছে শিশুরাও।
অপরাধ বিশ্লেষক ও মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে পরিবারিক বন্ধন ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি সহনশীলতার মাত্রা কমে যাচ্ছে, সামাজিক অস্থিরতার কারণে জীবনে বাড়ছে হতাশা, মানসিক বিষণ্নতা, আর্থিক দৈন্য। ফলে সমাজে বেড়ে চলেছে অপরাধও। এই অপরাধ এখন পরিবারে ঢুকে পড়েছে।
কিছু ঘটনা
গত ১৫ সেপ্টেম্বরের ঘটনা। নতুন মডেলের মোটরসাইকেল কিনে না দেয়ায় এক কিশোর তার মা ও বাবাকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার চেষ্টা করে। ফরিদপুর শহরের কমলাপুর ডিআইবি বটতলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। ওই তরুণের নাম ফারদিন হুদা মুগ্ধ। তার বাবা এ টি এম রফিকুল হুদা বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন। তার শরীরের প্রায় ৫০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
একইদিন চট্টগ্রামে মাকে বঁটি দিয়ে কুপিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে তারই নিজের ছেলের বিরুদ্ধে। অভিযুক্ত তরুণের নাম সুমিত চৌধুরী। এইচএসসি পরীক্ষায় ফল খারাপ হওয়ায় বড় ভাই তাকে বকাঝকা করায় ক্ষুব্ধ হয়ে মাকে কুপিয়ে হত্যার কথা পুলিশকে জানিয়েছেন সুমিত।
একইদিন চট্টগ্রামের হাটহাজারির মেখল ইউনিয়নের বটতল এলাকায় কোদালের কোপে প্রাণ হারান সৈয়দ মুসা মিয়া নামে একজন। এই ঘটনায় তারই ছেলে সৈয়দ শাকেরকে আটক করেছে পুলিশ।
পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে শাহরিয়ার আলম কাব্য নামে সাত বছরের সন্তানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। তাকে হত্যার অভিযোগে তার মা তসলিমাকে আটক করেছে পুলিশ।
১৯ সেপ্টেম্বর নড়াইলের লোহাগড়ার লুটিয়া গ্রামে খুন হন সরজিৎ ঘোষ। তারই ছোট ভাই অভিজিত ঘোষ তাকে হত্যা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পুলিশ জানিয়েছে, সরজিৎকে আটকের চেষ্টা চলছে।
গত ২২ আগস্ট হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার ওসমানপুর গ্রামে সাত মাসের শিশু নিপাকে হত্যা করা হয়। এই ঘটনায় আটক হন তার মা মিলন বেগম পালিয়ে গেছেন বাাব লিটন মিয়া।
পুলিশ বলছে, তাদের কাছে যত হত্যা মামলা হয় তার প্রায় অর্ধেকই ঘটে পারিবারিক বিরোধের জেরে। বাহিনীটির পরিসংখ্যান বলছে, পারিবারিক কলহের জেরে গত পাঁচ বছরে প্রায় ১০ হাজার হত্যার ঘটনা ঘটেছে। প্রতি বছরেই বাড়ছে এসব খুন।
পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (অপরাধ) হুমায়ুন কবির ঢাকাটাইমসকে বলেন, মানসিক সমস্যা ও সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ বা অনৈতিক সম্পর্কের জের অথবা ছোটখাট ঝগড়াঝাটি নিয়ে এসব হত্যার ঘটনা হবে।
পরিবারের মধ্যে খুনোখুনি কেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ ইহসান হাবিব ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের সমাজে মানুষের ‘ডিগ্রি অব টলারেন্স’ কমে গেছে। ধৈর্য্যসীমা অনেকটা নিচে নেমে গেছে। অল্পতে আমরা রেগে যাই। রিঅ্যাক্ট করি। এসব কারণে পারিবারিক অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই সমাজবিজ্ঞানী বলেন, ‘ভোগবাদী সমাজের কারণে এই অবস্থা তৈরি হয়েছে। আমরা এতোটা ভোগবিলাসী জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছি যে, পারিবারিক বন্ধন ভুলে গেছি। আমাদের সমাজে পারিবারিক কাঠামো থাকলেও তা নামমাত্র। কোনো ধরনের স্বাভাবিক বোঝাপড়া আমাদের মধ্যে নেই। ফলে বাবা-মা-সন্তানের মধ্যেও স্নেহের বন্ধন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। আর এসব আমরা চলচিত্র এবং সমাজ বাস্তবতা থেকে শিখছি। মানুষ তো অনুকরণ প্রিয়। আমরা অনুকরণ করতে ভালবাসি। অনুকরণের মাধ্যমে অনেক অপরাধ ঘটছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফারাহ দিবা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমাদের সমাজে শিল্পায়নের কারণে মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। চারপাশে নগরায়ণ হচ্ছে। মানুষের মধ্যে বিভিন্ন রকমের চাহিদা তৈরি হচ্ছে। যখন কারো চাহিদা অপূর্ণ থাকে তখন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। তার মধ্যে না পাওয়ার হতাশা তৈরি হয়। এই হাতাশা থেকেই অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে কেউ কেউ।’
ফারাহ দিবা বলেন, ‘আগে শহর কম ছিল। মানুষের মধ্যে তেমন চাওয়া পাওয়া ছিল না। এখন নগরায়ন হচ্ছে। এর ফলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আলাদা ‘চাহিদা’ তৈরি হচ্ছে। বিশ বছর আগে যে কিশোর-কিশোরী ছিল এখন সে বাবা-মা হচ্ছে। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে বাবা-মা হিসেবে সন্তানকে যেভাবে লালন-পালন করা দরকার সেটা কিন্ত এখন হচ্ছে না। আগে সন্তানরা কোনো অন্যায় করলে বাবা-মায়েরা পিটিয়ে শাসন করতো। কিন্তু এখন কি সেইভাবে করা সম্ভব? সম্ভব না। এখন অন্যভাবে তাদেরকে শাসন করতে হবে। সেই শিক্ষার অভাব আছে আমাদের মধ্যে।’
এক প্রশ্নের জবাবে এই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘আমাদের কমিউনিটিতে শ্রেণি-বিভেদ তৈরি হয়েছে। আমরা কমিউনিটি পালস বুঝি না। এই বিভেদ কমাতে হবে। একটা সময় সামাজিক অপরাধ বেশি ছিল। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নতি হওয়ায় সেই পরিস্থিতি এখন নেই। এই ধরনের অপরাধ এখন পরিবারে ঢুকে গেছে। ফলে পারিবারিক কলহ-বিভেদ-খুন বেড়ে গেছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘যেকোনো ধরনের হত্যাই হচ্ছে সমাজের অবক্ষয়ের একটি রূপ। এসব হত্যার জন্য আমাদের দেশের বিচার প্রক্রিয়াও কিছুটা দায়ী।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের বিচার প্রক্রিয়া অনেক দীর্ঘ। একটি ঘটনার বিচার প্রক্রিয়া শেষ হতে অনেক দিন পেরিয়ে যায়। ফলে অপরাধীদের নিস্তার পেতে সহজ হয়। এই প্রক্রিয়া আরও সহজ এবং স্বল্প সময়ে সম্পন্ন করতে পারলে অনেক অপরাধ কমে যেতো।’
তাহলে উপায়?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শাহ ইহসান হাবিব বলেন, ‘পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে হবে। এজন্য বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। চাহিদা এবং প্রাপ্তির মধ্যে যে ব্যবধান তা কমাতে হবে। ছোট বেলা থেকেই সন্তানকে নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মূল্যবোধ সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে।’
পারিবারিক সন্ত্রাসের সমস্যা থেকে উত্তরণে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ফারাহ দিবা বলেন, ‘যান্ত্রিক জীবনের ঘোরে পারিবারিক সম্প্রীতি এখন বিনষ্ট হওয়ার পথে। এই সম্পর্ক উন্নীত করতে হলে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন জরুরি। পরিবারের সদস্যদের ‘আন্ডারস্ট্যান্ডিং’ বাড়াতে হবে। আর নৈতিক শিক্ষা এবং সামাজিক মুল্যবোধের উপর জোর তো ছোটবেলা থেকেই দিতে হবে।’