রাজধানীতে কোনো ভাঙাচোরা গাড়ি চলবে না। বাসের আসনগুলো হতে হবে যাত্রীবান্ধব, আরামদায়ক- এমন ঘোষণা দিয়ে বছর দুয়েক আগে চালানো অভিযানের কোনো নমুনাই এখন আর সড়কে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোনো কোনো গণপরিবহনের বাহ্যিক আবরণ দেখে বাসেই চড়তে ইচ্ছা করে না যাত্রীদের। ভেতরের অবস্থাও তথৈবচ। অতিরিক্ত আসন, নোংরা, দুর্গন্ধময় পরিবেশের কারণে চলার পুরো সময়টাই দুঃসহ কাটে যাত্রীদের।
যাত্রাবাড়ী থেকে গাবতলীগামী আট নম্বর বাসের ১০টি পর্যবেক্ষণ করে সাতটির অবস্থাই পাওয়া গেছে সঙ্গীন। ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-১৩৩১, ঢাকা মেট্রো-জ-১৪-১৬০৩, ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২৭৭০ নম্বরের তিনটি বাসের অবস্থা সবচেয়ে করুণ্। এর কোনোটির জানলা ভাঙা, একটির পেছনের, একটির সামনের অংশের কাঁচ ভেঙে গেছে। সেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকে গাড়িতে। একটি পেছনের বাম্পার ভেঙে গেছে।
তানজিল পরিবহন ঢাকা মেট্রো-জ-১১-২৪৭৪, ইটিসি পরিবহন ঢাকা মেট্রো-জ-১১-০৯৩১ বাসগুলোর অবস্থাও দেখা গেছে প্রায় একই রকম। কোনোটি অতিরিক্ত কালো ধোঁয়া ছাড়ে, একটিকে আবার সড়কের পাশেই নষ্ট হয়ে যেতে দেখা গেলো।
এসব গাড়ির কোনোটিরই সংকেত বাতি নেই। ফলে সেটি কোন দিকে যাবে, চালক ব্রেক কষেছেন কি না, সেটি আগে থেকে বোঝার উপায় থাকে না। ফলে পেছনের গাড়ির ধাক্কা লাগার আশঙ্কা থেকেই যায় সব সময়।
এসব বাস ঠিকমত চলতেও পারে না। প্রায়ই বিচিত্র শব্দ করে চলে এগুলো। এর কোনোটিরই যে ফিটনেস নেই, সেটা বুঝতে পরীক্ষার দরকার পড়ে না।
এটি কোনো একটি রুটের বা একটি কোম্পানির বাসের সমস্যা নয়, রাজধানীর সব রুটেই চলে ভাঙাচোরা বাস, এগুলোর ভেতরের পরিবেশও একেবারেই বাজে। বাধ্য হয়ে কষ্ট করেই এগুলোতে চড়েন যাত্রীরা।
কথা হলো একজন যাত্রী শাহীনের সঙ্গে। তার বাসের জানলার কাঁচ ভাঙা থাকায় হালকা বৃষ্টিতেই ভিজে গেছেন তিনি। ক্ষোভের সঙ্গে তিনি বলেন, ‘বহু খাতেই উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু গনপরিবহনে উন্নতি নয়, দিনকে দিন পরিস্থিতি অবনতি হচ্ছে। সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ এই খাতে নেই এটা স্পষ্ট।
হিউম্যান হলারগুলোর অবস্থা আরও খারাপ। এর কোনো কোনোটি যে একেবারেই চলার অযোগ্য, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু না পুলিশ, না বিআরটিএ-কোনো সংস্থাকেই কার্যকর ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে গাড়ি আটকে মামলা দিলেও এসব গাড়ি চলে অবলীলায়।
অথচ ২০১৪ সালের নভেম্বরে সারাদেশে ফিটনেসহীন গাড়ির বিরুদ্ধে ঘটা করে অভিযানে নেমেছিল বিআরটিএ। সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তখন ঘোষণা দিয়েছিলেন, আগে যা হয়েছে তা হয়েছে, এখন থেকে আর কোনো গাড়ি চলতে দেয়া হবে না। এরপরও নানা সময় একই ধরনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তিনি। কিন্তু এসব হুঁশিয়ারির কোনো নমুনাই চোখে পড়ে না রাজধানীর সড়কে।
আসলে ফিটনেসহীন যানবাহনের বিরুদ্ধে অভিযান বরাবর একটি জটিল বিষয়। অভিযান শুরুর পর রাজধানীতে গাড়ি কমে গেলে যাত্রীরা যাতায়াতের ক্ষেত্রে ভোগান্তিতে পড়ে। তাই নানা সময়ই অভিযান শুরুর পর পর সরকার পিছিয়ে এসেছে। আর এটা বুঝে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী প্রতি বছর যানবাহনের ফিটনেস পরীক্ষা করাতে হয়। এখন পর্যন্ত চোখে দেখেই এই পরীক্ষা করা হয়। কিন্তু পরিবহন মালিকরা নানা কৌশলে ঘুষ দিয়ে এই সনদ জোগাড় করে নেন বলে অভিযোগ আছে। স্বয়ং সড়কমন্ত্রী এই তথ্য স্বীকার করেছেন নানা সময়।
যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথোরিটি (বিআরটিএ) বলছে বিপুল সংখ্যক গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের কেবল দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছেন। তাদের দিয়ে দুটি ভ্রাম্যমাণ আদালত চালিয়ে কুলিয়ে উঠা যায় না।
এক হিসাবে জানা যায়, বর্তমানে রাজধানীতে পাঁচ লক্ষাধিক যানবাহন চলাচল করে৷ এর মধ্যে প্রাইভেট কারের সংখ্যা দুই লাখের বেশি। বাকি তিন লাখের মধ্যে এক লাখেরও বেশি গাড়ির হাজারের ফিটনেস নিয়ে প্রশ্ন আছে।
বিআরটিএর নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘রাজধানীতে চলাচলকারী যানবাহনগুলোর প্রায় ৫০ শতাংশেরই ফিটনেস সনদ নেই। এগুলো ঢাকার পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। রাজধানীর যানজটেরও অন্যতম কারণ এসব যানবাহন।’
বিআরটিএর পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) নুরুল ইসলাম বলেন, বাস্তবতা তো অস্বীকার করতে পারব না। রাজধানীতে ফিটনেসহীন গাড়ি চলছে এবং সেটা বিপুল পরিমাণেই।’
বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) শেখ মো. মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, ‘আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। বিভিন্ন সময় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে জরিমানা করা হচ্ছে।’
পুলিশের দাবি, তাদের তৎপরতার কারণে ফিটনেসহীন গাড়ি চলাচল কমছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক পূর্ব বিভাগের উপ-কমিশনার মইনুল হাসান ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘ট্রাফিক পূর্ব বিভাগে প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০টি মামলা হয়। আমাদের তৎপরতার কারণে ফিটনেসহীন গাড়ি কমতে শুরু করেছে।’