সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে মৌখিকের পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় ক্ষুব্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদরা। তারা বলছেন, শিক্ষক নিয়োগে বর্তমান পদ্ধতিতে যে ত্রুটি রয়েছে সেগুলো দূর করতে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন। সরকার দলের অনুগত শিক্ষক নেতারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য চাপ না দিলেই শিক্ষক নিয়োগ স্বচ্ছ হবে। পাশাপাশি যোগ্যরা উঠে আসবে।
এই মতের অনুসারীরা বলছেন, লিখিত পরীক্ষা নিলেই যে ভালো শিক্ষক পাওয়া যাবে, সেটা নিশ্চিত নয়। কারণ, কাউকে নিয়োগ দিতে কারচুপির চেষ্টা করা হলে, এই পরীক্ষাতেও করা যাবে।
শিক্ষাবিদদের একটি অংশ অবশ্য মনে করেন, নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা নিলে পুরো প্রক্রিয়া তুলনামূলকভাবে স্বচ্ছ হবে। এতে অধিকতর যোগ্যরা উঠে আসবে। তবে যারা পরীক্ষা নেবেন, তাদের নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করতে না পারলে এই উদ্যোগও ভেস্তে যাবে।
গত বুধবার শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তদারক ও নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে একটি নির্দেশনা পাঠানো হয়। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মচারী-কর্মকর্তার পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও লিখিত পরীক্ষা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়। আবার অন্যান্য সরকারি চাকরির মতই নিয়োগের আগে পুলিশি প্রতিবেদন নেয়ার কথা বলা হয়। প্রার্থী কোনো রাষ্ট্রবিরোধী তৎপরতায় জড়িত কি না, তার বিরুদ্ধে মামলা মোকদ্দমা আছে কি না, এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই তা যাচাই বাছাই করা হয়।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে ইউজিসি সচিবকে পাঠানো নির্দেশনায় বলা হয়, ‘ইদানিং বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগের ক্ষেত্রে বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হচ্ছে। এ অনভিপ্রেত অবস্থার সমাধানকল্পে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে থেকে পাওয়া গোয়েন্দা বিভাগের গোপনীয় প্রতিবেদনে বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়ার লক্ষ্যে দুটি সুপারিশ করা হয়েছে। একটি হচ্ছে মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নিতে হবে। আরেকটি হচ্ছে নিয়োগের আগে পুলিশ ভেরিফিকেশন।’
গত কয়েক দশক ধরেই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠেছে। বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের অনুসারী শিক্ষক নেতারা তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নানা প্রক্রিয়া ও কৌশলে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিচ্ছেন বলে জোরালো অভিযোগ আছে। প্রার্থীদের যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক বা অন্য আনুগত্য অনেক সময় বড় হয়ে উঠেছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, শিক্ষক নিয়োগে কেবল মৌখিক পরীক্ষার বিধান থাকায় কারও পক্ষে তাদের পছন্দের প্রার্থীকে নিয়োগ দেয়া সহজ হয়েছে। নতুন পদ্ধতি চালু হলে লিখিত পরীক্ষায় ভালো করা ছাত্রকে মৌখিক পরীক্ষায় বাদ দেয়া কঠিন হবে।
শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ঢাকাটাইমসকে বলেছেন, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সবার মতামতের ভিত্তিতেই এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। এই পদ্ধতি চালু হলে উচ্চশিক্ষার জন্য তা ভালো হবে বলেও মনে করেন তিনি।
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার জারির পর পরই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। কেউ কেউ আবার টিপ্পনী কেটেছেন, এই পদ্ধতি চালু হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের জন্যও গাইড বই বের হবে কি না।
সরকারের সিদ্ধান্ত অন্যায় মনে করেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
সরকারি নির্দেশনা এবং তার সমালোচনা করে এই প্রতিক্রিয়ার বিষয়ে অবস্থান জানতে ঢাকাটাইমসের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই এমিরেটাস অধ্যাপক জানান, তিনিও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই নির্দেশনার পক্ষে নন। তিনি বলেন, ‘সরকার যেটা করতে যাচ্ছে সেটা আমার কাছে অন্যায় মনে হচ্ছে।’
কেন অন্যায় মনে হচ্ছে- জানতে চাইলে এই শিক্ষাবিদ বলেন, ‘একটি ছেলে যখন সবগুলো ‘একাডেমিক ডিসিপ্লিনে’ সর্বোচ্চ ফলাফল করে তখন তাকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়। তার আবার পরীক্ষা নেয়ার অর্থ হল তাকে অপদস্থ করা।’ তার ধারণা, শিক্ষকতা পেশায় নিরুৎসাহিত করার জন্যই এই প্রক্রিয়া চালুর চেষ্টা করা হচ্ছে।
তবে লিখিত পরীক্ষা নেয়ার বিষয়ে যতটা না, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর তার চেয়ে বেশি আপত্তি পুলিশ প্রতিবেদন নিয়ে। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগের সময় পুলিশ ভেরিফিকেশনের সিস্টেম ছিল। ওই সময় অনেক হয়রানি পোহাতে হতো শিক্ষকদের। নিয়োগে পেতে অনেক বিলম্ব হতো। এখন আবার সেই সিস্টেম চালু করা কতটুকু ন্যায়সঙ্গত তা প্রশ্নসাপেক্ষ বিষয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক আয়েশা বেগম ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘সরকারের এই নির্দেশনার কোনো মানে নেই। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ‘সুপ্রিম কোয়ালিটি’ সম্পন্ন শিক্ষার্থীদের নিয়োগ দেয়া হয়। একজন শিক্ষার্থীর সকল একাডেমিক রেকর্ড দেখে যে সবচেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন তাকেই নিয়োগ দেয়া হয়। এখন যদি একাডেমিক ফলাফলের উপর বিশ্বাস না থাকে তাহলে তো পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার উপরই আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে।’
লিখিত পরীক্ষাও নেয়া হয় কখনও কখনও
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক অবশ্য এখনই কোনো অবস্থান নিতে চাইছেন না। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা মৌখিক পরীক্ষার ভিত্তিতে নিয়োগ দেই। তবে এটা নির্ভর করে প্রার্থীর সংখ্যার ওপর। প্রার্থী বেশি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে লিখিত পরীক্ষার রেকর্ডও আছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় কী আছে, সেটা আমাদেরকে আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও জানানো হয়নি। জানালে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবো।’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম মনে করেন, লিখিত পরীক্ষা নেয়া যেতেই পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে মৌখিক পরীক্ষার পাশাপাশি লিখিত পরীক্ষা নেয়ার ব্যবস্থাও আছে। এটা নির্ভর করে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালার ওপর।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের এই জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের দেশেও তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হয় লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমেই। এসব পরীক্ষার পাশাপাশি প্রার্থীরা ক্লাস লেকচারেও অংশ নেন। এর মাধ্যমে উঠে আসা শিক্ষকরা বেশ ভালোও করছেন।’
তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত চাপিয়ে না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ছেড়ে দিলে ভালো হবে বলে মনে করেন এই শিক্ষাবিদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ কমিটির সদস্য সৌমিত্র শেখর রায় মনে করেন সরকারের নির্দেশনা অহেতুক। কারণ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা এমনিতেই হয়। তবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রার্থী কম সেখানে মৌখিক পরীক্ষা নেয়া হয়। এটি সরকারের গোচরেই নেই বলে মনে করছেন এই শিক্ষক।
সৎ উদ্দেশ্যের ওপর গুরুত্বারোপ
বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) উপাচার্য অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘শিক্ষা মন্ত্রণালয় কী করতে চায় সেটি পরিষ্কার থাকতে হবে। আমি বলতে পারি আমার এখানে শিক্ষক নিয়োগের পদ্ধতি বিশ্বমানের।এখন পর্যন্ত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কেউ প্রশ্ন করতে পারেনি।’
এক প্রশ্নের জবাবে বুয়েট উপাচার্য বলেন, ‘পরীক্ষা পদ্ধতি নয়, দরকার সৎ উদ্দেশ্য। উদ্দেশ্য যদি ভালো থাকে তাহলে তাহলে যেকোনো অবস্থা থেকেই ভাল কাজ করা যায়। আর যদি উদ্দেশ্য খারাপ থাকে তাহলে অনেক কঠিন নিয়ম-কানুনের মধ্যেও খারাপ কাজ করা যায়।’
বুয়েটের এই ত্বরিত প্রকৌশল বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘কেউ যদি চায় অনিয়ম করবে তাহলে লিখিত পরীক্ষা মধ্যেও অনিয়ম করতে পারে।’
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামও মনে করেন, সৎ উদ্দেশ্য না থাকলে লিখিত পরীক্ষাতেও অনিয়ম করা যায়। এই পরীক্ষা কমিটি যেন নিরপেক্ষ হয় সেটা নিশ্চিত করার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ কজন শিক্ষকের প্রতিক্রিয়া
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতিয়ারা নাসরিন শিক্ষক নিয়োগে লিখিত পরীক্ষা এবং পুলিশ ভেরিফিকেশনের পদ্ধতিকে কৌতুককর বলেছেন। তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এই অধ্যাপক লিখেন, ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ হবে লিখিত পরীক্ষার ভিত্তিতে! শিক্ষক নিয়োগ পদ্ধতিতে পরিবর্তন তো দরকারই। তবে দেখার কথা ছিল, শিক্ষক আদৌ পড়াতে পারবেন কিনা। সেটা বুঝে নেওয়া যায় তাকে পাবলিক লেকচার দিতে দিলে। বিষয়ে তার দখল বোঝা যায় গবেষণা কর্মের খতিয়ান দেখে।’
গীতিআরা নাসরিন লিখেন, ‘এবার পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক-পরীক্ষার তোতা-পাখী গাইড বেরুলো বোলে। পুলিশি পরীক্ষাও না কি হবে! উর্দি দেবেন না? রেজিমেন্টেড বাহিনীর তো চিহ্ন থাকা দরকার।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক সৈয়দ মাহফুজুল হক মারজান তার ফেসবুক পেজে মন্তব্য করেন, ‘এমপি থ্রি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নিয়োগ ভর্তি গাইড বের হতে আর বেশি দেরি নাই।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হাসান মাহমুদ ফয়সাল মন্তব্য করেন, ‘শুধু কি এমপি থ্রি? শিগগিরই প্রফেসরস আর ওরাকল বিশ্ববিদ্যালয় নিয়োগ সিরিজও বের হবে।’