গত দুই দিন ধরেই আসছে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংবাদ। এই প্রতিবেদন লেখা শুরু করার সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় বজ্রপাতে ১০ জনের মৃত্যুর খবর এসেছিল। আর লেখা শেষ করতে করতে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ১৫ জনে।
আগের দিনও দেশের বিভিন্ন এলাকায় এই দুর্যোগে মারা গেছে অন্তত ১০ জন। এরআগে ১৭ আগস্ট পঞ্চগড়ে বজ্রপাতে দুইজন নিহত হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বজ্রপাতে এক দিনে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় গত ১২ মে। সেদিন ৩৫ জনের মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ হয়েছিল।
গবেষকরা বলছেন, নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিলে বা সচেতন হলে বজ্রপাতে মৃত্যু কমানো যায়। যুক্তরাষ্ট্রে এ ধরনের উদ্যোগ কার্যকর হয়েছে এবং এই ধরনের মৃত্যু কমে এসেছে বহুলাংশে।
বাংলাদেশে প্রতিবছর বর্ষার আগে মার্চ থেকে মে মাসে কালবৈশাখীর সঙ্গে বজ্রপাতের ঘটনা ঘটে। আর বজ্রপাতের কারণে মারা যায় বহু মানুষ। কিন্তু বছরের এই সময়ে এত বজ্রপাত কখনও দেখা যায়নি।
বছরে পাঁচশরও বেশি মৃত্যু
আবহাওয়া অধিদপ্তরের রেকর্ড অনুযায়ী, গত ৫ বছরে (২০১১-২০১৫) সারা দেশে পাঁচ হাজার ৭৭২টি বজ্রপাত হয়। আর সাত বছরে মারা গেছে সাড়ে তিন হাজারেরও বেশি মানুষ।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আকাশে মেঘ হলে তার ২৫ থেকে ৭৫ হাজার ফুটের মধ্যে বজ্রপাতের ঘটনা বেশি ঘটে। এ এলাকায় তড়িৎ প্রবাহের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংঘর্ষ ঘটে। এখানে খাড়াভাবে যে বজ্রপাতের সৃষ্টি হয় তার তাপমাত্রা ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার ডিগ্রি ফারেনহাইট। বজ্রপাতের গতিও প্রতি সেকেন্ডে ৬০ হাজার মিটার বেগে নিচে বা ওপরের দিকে চলে যায়। ফলে এ পরিমাণ তাপসহ বজ্রপাত মানুষের দেহে আঘাত হানার সঙ্গে-সঙ্গেই মৃত্যু হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, একেকটি বজ্রপাতের সময় প্রায় ৬০০ মেগাভোল্ট বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়। বাসাবাড়িতে আমরা যে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছি তার মাত্রা মাত্র ২২০ ভোল্ট। একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য মাত্র ১১০ ভোল্ট বিদ্যুৎ যথেষ্ট।
কেন এত বজ্রপাত?
আবহাওয়াবিদেরা বলছেন, নদী শুকিয়ে যাওয়া, জলাভূমি ভরাট হওয়া আর গাছ ধ্বংস হওয়ায় দেশে তাপমাত্রা এক থেকে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। বর্ষা মৌসুম শেষ দিকে হলেও তাপমাত্রা বেশি হারে বাড়ছে। এতে এই সময়ে বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। আর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে ভেসে আসা আর্দ্র বায়ু আর উত্তরে হিমালয় থেকে আসা শুষ্ক বায়ুর মিলনে বজ্রঝড় হচ্ছে।
গবেষকেরা বলছেন, দেশের বেশির ভাগ এলাকায় মুঠোফোন ও বৈদ্যুতিক টাওয়ার রয়েছে। দেশের কৃষিতেও যন্ত্রের ব্যবহার বেড়েছে। তা ছাড়া, সন্ধ্যার পরে মানুষের ঘরের বাইরে অবস্থান বাড়ছে। আর বেশির ভাগ বজ্রপাতই হয় সন্ধ্যার দিকে। আকাশে সৃষ্টি হওয়া বজ্র মাটিতে কোনো ধাতব বস্তু পেলে তার দিকে আকর্ষিত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের শিক্ষক ইজাজুল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘স্থানীয় এবং বৈশ্বিক কিছু কারণ রয়েছে বজ্রপাত হওয়ার পেছনে। স্থানীয় কারণের মধ্যে রয়েছে- মানুষের মধ্যে অসচেতনতা, বড় গাছ-পালা না থাকা এবং সবক্ষেত্রে যন্ত্রের ব্যবহার বেড়ে যাওয়া। আর বৈশ্বিক কারণের মধ্যে অন্যতম কারণ হচ্ছে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া।’
ইজাজুল হক বলেন, প্রশান্ত মহাসাগরীয় বায়ুপ্রবাহের ভূমিকা আছে এ ক্ষেত্রে। মহাসাগরের পানির তাপমাত্রা বেড়ে বায়ুপ্রবাহে তা যুক্ত হয়ে ঝড়ের প্রকোপ বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। হাওর অঞ্চলে আর্দ্রতা বেশি হওয়া সে অঞ্চলে বজ্রপাত বেশি হওয়ার একটি কারণ হতে পারে।
করণীয় কী?
গত ছয় বছরে বজ্রপাতে মৃত্যুর ঘটনার মধ্যে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বেশির ভাগ মৃত্যুই হয়েছে উন্মুক্ত জায়গায়। ফসলের খেতে কাজ করতে গিয়ে বা নৌকায় থাকা অনেকে নিহত হয়েছেন। আবার মৃত ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছে শিশুরা। ঝড়-বৃষ্টি চলাকালে খেলার মাঠে তাদের মৃত্যু হয় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ বলছেন, উন্মুক্ত স্থানে, বিশেষ করে ফসলের খেতে বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে কৃষিতে বেশি মাত্রায় যন্ত্রাংশ ব্যবহারের একটি কারণ।
এ প্রসঙ্গে ইজাজুল হক বলেন, ‘যন্ত্রাংশ বজ্রকে আকর্ষণ বেশি করে। এসব মৃত্যুর কারণ যদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করা যায়, তবেই যন্ত্রাংশ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে এ মৃত্যুর সংযোগ খোঁজা সহজ হবে।’
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) আবু তালেব বলেন, বজ্রপাতে মৃত্যুর সংখ্যা কমিয়ে আনতে সচেতনতা দরকার। তিনি বলেন, ‘আশেপাশে যদি কোন উঁচু গাছ থাকে সেখান থেকে দূরে থাকা। টিনের ছাদ এড়িয়ে চলা। উপরে ছাদ আছে এমন জায়গায় চলে আসা।’ তিনি বলেন, ‘বজ্রপাতের সময় বিদ্যুতের খুঁটি ও টাওয়ার থেকে দূরে থাকতে হবে। তাছাড়া জলাশয় ও পুকুর থেকে দূরে থাকলে ভালো হয়।’
মেঘের আনাগোনা দেখে বজ্রপাতের সম্ভাবনা সম্পর্কে খানিকটা ধারণা করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ইজাজুল হক।
তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে যখন দেখা যায় বৃষ্টি হতে যাচ্ছে এবং মেঘ দ্রুত মুভমেন্ট (চলাচল) হচ্ছে তখন ইলেকট্রন সঞ্চিত হয় বেশি। তখনই সাধারণত আমরা বুঝতে পারবো। প্রাথমিক পর্যায়ে ঐ সময়ে বজ্রপাত বেশি হয়।’ তিনি বলেন, ‘এ সময় খোলা জায়গায় না থেকে যতটা সম্ভব ঘরের ভেতরে থাকা উচিত।’
যুক্তরাষ্ট্রের উদাহরণ দিয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘২০০৪ সালের দিতে দেশটিতে বছরে তিনশ মানুষ বজ্রপাতে মারা যেতো। সেই সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে পাঁচ জনে। মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও পূর্ব প্রস্তুতি নেয়ায় মৃত্যুর হার কমেছে।’ তিনি বলেন, ‘আমরাও যদি সচেতন ও বজ্রপাতের পূর্বলক্ষণ বুঝে প্রস্তুত থাকতে পারি তাহলে মৃত্যুর হার কমে যাবে।’
দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছে বজ্রপাত
প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে যে কয়টি ঘটনার নাম অন্তর্ভুক্ত আছে তাতে নেই বজ্রপাত। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) আবু তালেব ঢাকাটাইমসকে জানান, সম্প্রতি বজ্রপাতে মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা এতো বেশি বাড়ছে যে সরকার এটাকে দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার যে আইনটি রয়েছে সেটি সংশোধন করে বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হবে।’
দুর্যোগ হিসেবে স্বীকৃতি মিললে কী লাভ হবে-জানতে চাইলে আবু তালেব বলেন, ‘বজ্রপাতে মারা গেলে আগে ক্ষতিপূরণ দেয়ার রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু এখন কেউ মারা গেলে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার করে টাকা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’