প্রকাশ : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:১২:০৯আপডেট : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১৩:০৫:৫২
গুলশানে পথে পথে ভোগান্তি
মহিউদ্দিন মাহী, ঢাকাটাইমস
আহসান সবুজ থাকেন রাজধানীর বাড্ডায়। তার কর্মস্থল গুলশান-২-এর ৮৯ নম্বর সড়কে। এই সড়কের একটি বাসার মালিকের গাড়ি চালান তিনি। হলি আর্টিজান হামলার আগে তার কর্মস্থলে যেতে সময় লাগত ২০ থেকে ৩০ মিনিট। সকাল আটটায় তিনি বাড্ডার বাসা থেকে বের হতেন। নতুন বাজার হয়ে রিকশা অথবা বন্ধু পরিবহনের গাড়িতে গুলশান দুই নম্বর মোড়ে যেতেন। ওখান থেকে মিনিট পাঁচেকের পথ তার অফিস।
কিন্তু এখন সবুজকে অফিসের উদ্দেশে ভোর সাতটায় রওনা দিতে হয় বাসা থেকে। পৌঁছাতে পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যায়। কারণ নতুন বাজার থেকে কর্মস্থল ওই বাসা পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয় তাকে। এতে কাজ শুরুর আগেই এক প্রস্ত শরীরিক শ্রম রাস্তায় ঝরে যায় তার।
সবুজের এই ভোগান্তির কারণ গুলশানে নিয়ন্ত্রিত যানবাহন। এখন চাইলেই যখন-তখন বাস-টেম্পো-রিকশা মেলে না। নির্ধারিত কয়েকটি বাস আর কিছু রিকশা চলাচল করলেও সেগুলো পাওয়া সাধনার বিষয়।
গুলশানের এরশাদ পার্কের সামনে ৮ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় সবুজের। তিনি বলেন, ‘ভাই বড় লোকদের তো বেশি কষ্ট নেই। তারা প্রাইভেট গাড়িতে চলেন। কষ্ট তো খেটে খাওয়া মানুষদের। আমি গাড়ি চালাই। কিন্তু মালিকের বাসায় প্রতিদিন যেতে-আসতে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যায়। হলি আর্টিজানে হামলার আগে এই ভোগান্তি ছিল না। এখন কোনো বাস চলে না। রিকশা নেই। ঢাকার চাকা নামে যে গাড়ি চলে, সেটি ওই রুটে নেই। আর বিশেষ রঙের যে রিকশা তা খুব কম সময়ই পাওয়া যায়।’
বাস ও রিকশার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা
গত ১০ আগস্ট রাজধানীর কূটনৈতিক এলাকা গুলশান, বনানী, বারিধারা ও নিকেতনের নিরাপত্তার স্বার্থে চালু হয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ‘এসি সার্কুলার বাস সার্ভিস’, যার নাম ঢাকা চাকা, এবং বিশেষ রঙের রিকশা। কিন্তু এই উদ্যোগ প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ফলে ওই এলাকায় যাত্রী ভোগান্তি চরমে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে গাড়ি পাচ্ছেন না যাত্রীরা। রিকশার দেখা পাওয়াও ভার।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে ২০টি এসি বাস ও ৫০০টি হলুদ রঙের রিকশা নামানো হয় ওই কূটনৈতিক এলাকায়। দুটি রুটে চলছে ‘ঢাকা চাকা’নামের বাস। একটি হলো তেজগাঁও-গুলশান লিংক রোডের নাভানা মোড় থেকে শুরু হয়ে গুলশান শুটিং ক্লাব, গুলশান-১ ও রূপায়ন টাওয়ার হয়ে গুলশান-২ নম্বর। অন্য রুটটি বনানীর কাকলী মোড় থেকে শুরু হয়ে বনানী বাজার ও গুলশান-২ নম্বর হয়ে বারিধারার নতুন বাজার। বিশেষ এই বাসের ভাড়া ১৫ টাকা। ভ্রমণে আরামদায়ক হলেও এসব গাড়ি পেতে যাত্রীদের অপেক্ষা করতে হয়ে দীর্ঘ সময়।।
বৃহস্পতিবার গুলশান শুটিং ক্লাবের সামনে দেখা গেছে, নতুন ওই বাসে ওঠার জন্য যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন। ঘণ্টা খানেক অপক্ষোয়ও এ প্রতিবেদক সেখানে কোনো গাড়ি আসতে দেখননি। এরপর একটি গাড়ি এসে থামার সঙ্গে সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে বাসে ওঠার প্রতিযোগিতা শুরু করে যাত্রীদের। কিন্তু জায়গা নেই বলে অনেকেই উঠতে পারেননি। কেউ কেউ টিকিট ফিরিয়ে দিয়ে হেঁটে গন্তব্যে রওয়ানা দেন গন্তব্যে কিংবা অন্য কোনো মাধ্যমের তালাশ করেন।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ও গাড়িতে উঠতে না-পারা যাত্রীদের অনেককে বলতে শোনা গেছে- যাত্রীর সংখ্যার তুলনায় গাড়ি কম হয়েছে। নতুন গাড়িতে ওঠার লাইনে দাঁড়ালেও গাড়ি আসতে অনেক সময় লাগে। ততক্ষণে লাইন আরো দীর্ঘ হয়।
এই বাসের ভাড়া নিয়ে ক্ষোভ আছে যাত্রীদের। গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ গেলেও যা ভাড়া, বারিধারা গেলেও একই ভাড়া।
নিয়ম মানে না ঢাকা চাকা
রাস্তায় যানজট থাকলে নতুন এই বাস শুটিং ক্লাব পর্যন্ত না গিয়ে ১ নম্বর থেকেই যাত্রী নামিয়ে ফিরে যায় বলে অভিযোগ করেছেন যাত্রীদের অনেকেই।
লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা যাত্রী আরাফাত রহমান জানান, ‘অনেকটা শখ করেই নতুন এসি গাড়িতে ওঠার জন্য এখানে এসেছি। ৪০ মিনিট ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে আছি, কোনো গাড়ির দেখা মিলছে না। শুনেছি, রাস্তায় যানজট থাকায় এসব গাড়ি গুলশান-১ নম্বর থেকেই ঘুরে চলে যাচ্ছে। আর কিছু সময় অপেক্ষা করে দেখি, গাড়ি না এলে আজকের মতো চলে যাব।’
গুলশান-১ থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যাওয়ার খবর শুনে অনেকেই হেঁটেই গাড়িতে ওঠার জন্য রওয়ানা দেন সেখানে। জাবেদ রহমান নামের এক যাত্রীর অভিযোগ, ‘গুলশান শুটিং ক্লাব থেকে তেজগাঁও লিংক রোড পর্যন্ত যা ভাড়া, ২ নম্বরেও একই ভাড়া। এটা আমাদের জন্য একটু চাপ হয়ে যায়।’ এ রকম অভিযোগ অনেক যাত্রীর।
নিয়মিত যাত্রীরা জানান, গুলশান ২ নম্বর গোলচত্বর দিয়ে চারটি পরিবহন কোম্পানির বাস চলত। এখন আর এই বাসগুলো চলে না। গুলশান ২ নম্বর দিয়ে যাতায়াতের জন্য মধ্যবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষের ভরসা এখন রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশা। তবে রিকশা ও সিএনজিচালিত অটোরিকশার সংখ্যাও হাতে গোনা। তাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে আগের চেয়ে দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। কোনো সিএনজিচালিত অটোরিকশাই মিটারে চলে না। পাশাপাশি রিকশায় সরাসরি গুলশান ২ নম্বর থেকে রামপুরা, নতুনবাজার, বনানী এসব এলাকায় যাওয়া যায় না। কারণ কোনো রিকশা একবার গুলশান ২ নম্বর এলাকা থেকে বের হয়ে গেলে ওই রিকশা আর ঢুকতে দেয় না পুলিশ।
২ নম্বর গোলচত্বরে কথা হয় আব্দুর রহমান নামের এক যুবকের সঙ্গে। তিনি জানান, কালাচাঁদপুর থেকে ব্যক্তিগত একটি কাজে গোলচত্বর এসেছেন। সেখান থেকে রামপুরা যাবেন এক আত্মীয়ের বাসায়। মাহফুজুর বলেন, ‘বাস নেই, তাই সিএনজিচালিত অটোরিকশার জন্য অপেক্ষা করছি। তিন-চারটি অটোরিকশাচালকের সঙ্গে কথা বলেছি। কেউ মিটারে যেতে রাজি হননি।’
স্থানীয় একাধিক দোকানি বলেন, ২ নম্বর গোলচত্বর থেকে বন্ধু পরিবহনের বাসে রামপুরা হয়ে গুলিস্তান, ৬ নম্বর ও ৬/এ দুটি পরিবহনে বাসে কমলাপুর, বিহঙ্গ পরিবহনে নতুনবাজার, রবরব পরিবহনে গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বর যাওয়া যেত। জঙ্গি হামলার পর থেকে এই পরিবহনের বাসগুলো আর চলে না।
যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার (গুলশান জোন) নুসরাত জাহান মুক্তা ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘কাকলি হয়ে গুলশানে কোনো বাস ও হিউম্যান হলার চলতে দেওয়া হচ্ছে না। তাই ২ নম্বর গোলচত্বর দিয়ে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে বাসগুলো অন্য রুটে চলছে। নিরাপত্তার স্বার্থে এই সমস্যা মেনে নিতে হবে।’
১০০ টাকায় বৈধ হয় অবৈধ রিকশা
গুলশান এলাকায় চলাচলের জন্য ৫০০ রিকশাকে অনুমতি দিয়েছে সিটি করপোরেশন। হলুদ রঙের এসব রিকশারই কেবল গুলশানে যাত্রী পরিবহনের বৈধতা রয়েছে। এর বাইরে অন্য কোনো রিকশার গুলশান এলাকায় প্রবেশ অবৈধ। কিন্তু ওই দিন দেখা মিলেছে বেশ কিছু নম্বর ছাড়া রিকশাও। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এসব অবৈধ রিকশা প্রতিদিন ১০০ টাকা দিয়ে বৈধ হচ্ছে গুলশানে।
ইয়াকুব আলী নামের এক রিকশাচালক বলেন, ‘দাদা কী করুম। আমাদের তো রিকশা চলাইয়াই খেতে হয়্।
এভাবেই ১০০ টাকার বিনিময় অবৈধ রিকশা চলাচল করে কূটনৈতিক এলাকা গুলশানে।
অনেক সড়ক এখন বন্ধ
আর্টিজানে হামলার পর গুলশানে অনেক সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। ফলে ওই সব সড়কের কোনো বাসায় যেতে ঘুরতে হয় অনেকটা পথ। সংশ্লিষ্ট সড়কের বাসিন্দাদের এই ভোগান্তি চলছে আর্টিজান হামলার পর থেকে।
গুলশান-২-এর ৮৯ নম্বর সড়কের বাসিন্দা সবুর মিয়া। গুলশান-২ নম্বর মোড় থেকে তার বাসায় যেতে সময় লাগে মিনিট পাঁচেক। তিনি মোড় থেকে ৯০ নম্বর সড়ক দিয়ে বাসায় যেতেন। কিন্তু হলি আর্টিজানে হামলার পর ৯০ নম্বর সড়ক বন্ধ করে দেয়া হয়। এ কারণে তাকে বেশ কয়েকটি সড়ক ঘুরে যেতে হয় বাসায়। এতে কোনো কোনো সময় ঘণ্টা পার হয়ে যায় বাসায় যেতে।
রিকশাচালক আলামিন বলেন, বনানী যাওয়ার পথ, গুলশান-২ নম্বরের ৫০ নম্বর সড়ক, কালাচাঁদপুর যেতে বারিধারা ডিওএইচএসের সামনের সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। তাই এসব সড়কের আশপাশের এলাকায় সরাররি যাওয়া যায় না। এ ছাড়া ৫১ নম্বর ও ৯২ নম্বর সড়কও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এসব এলাকার বাসিন্দাদের ভোগান্তির শেষ নেই।