ঘটনাটি ১৮ সেপ্টেম্বরের। এলাকার সবচেয়ে প্রিয় মুখ কিশোরী নিতু মণ্ডল স্কুলে যাওয়ার পথে খুন হয় বখাটের হাতে। এই ঘটনার ঠিক ২৪ দিন আগে রাজধানীর উইলস লিটল ফ্লাওয়ার স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সুরাইয়া আক্তার রিসাকে স্কুলের সামনের ওভারব্রিজে কুপিয়ে আহত করে আরেক বখাটে, চার দিন পর ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় রিসা।
এভাবেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বখাটেদের হাতে খুন-নির্যাতনের শিকার হচ্ছে নারীরা।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, গত আট মাসে সারা দেশে বখাটেদের উৎপাতে যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে ১৬৯টি। এসব ঘটনায় আত্মহত্যা করেছে তিনজন নারী। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে তিনজন ছাত্রী।
শুধু তাই নয়, যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করায় পাঁচজন পুরুষকেও খুন করেছে বখাটেরা। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত হয়েছেন ৮২ নারী ও ১৬ জন পুরুষ। এসব ঘটনায় আঘাতের শিকার হয়েছেন ৫৭ জন পুরুষ। বখাটেদের উৎপাতে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়েছে চার ছাত্রীর।
এ পরিসংখ্যান শুধু পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের। দেশজুড়ে বখাটেদের উৎপাত আরও ভয়ংকর।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক নূর খান লিটন বলেন, ‘সব ঘটনা কিন্তু পত্রিকায় আসে না। আমরা পত্রিকার তথ্যগুলো সংরক্ষণ করি। এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য নারী নির্যাতন ও ছাত্রী নিপীড়নের ঘটনা। অনেক ঘটনা বাবা-মা আত্মসম্মানের ভয়ে প্রকাশ করেন না। সামাজিক অপবাদ শুনতে হবে- এই ভয়ে চেপে যায়।’
তিনি বলেন, ‘বখাটেপনার উৎপাত এখন অনেক বেড়ে গেছে। সমাজে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। অনেক ছাত্রী নীরবে-নিভৃতে এসব অত্যাচার সহ্য করছে।’
এক প্রশ্নের জবাবে নূর খান বলেন, ‘আমাদের সমাজে নৈতিক অবক্ষয় তৈরি হয়েছে। সমাজ থেকে এ ধরনের ব্যাধি দূর করতে হলে অপরাধীর কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। গণসচেতনতা তৈরি করতে হবে।’
আসকের তথ্যানুযায়ী, ২০১৫ সালে বখাটেদের মাধ্যমে ৩২০টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে প্রতিবাদ করায় খুন হয়েছে পাঁচজন নারী ও একজন পুরুষ। অপমান সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছে ১০ জন নারী।
কয়েক বছর আগে যৌন হয়রানি ও ইভটিজিংয়ের বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে এবং এ নিয়ে তখন সচেতনতামূলক প্রচারণাও হয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ইভটিজিংয়ের ঘটনায় মৃত্যুর খবর শোনা যায়নি। তবে স্কুলছাত্রী রিসা ও নিতুর মৃত্যুর পর প্রশ্ন উঠেছে ইভটিজিং কি আদৌ কমেছে? বাংলাদেশে এখনো এ ধরনের ঘটনা কতটা ব্যাপক?
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের কর্মকর্তা নূর খান বলেন, ‘ঘটনাগুলো থেমে থেমে ঘটছে। হয়রানির ধরনও ধীরে ধীরে পাল্টেছে। সমাজকে কুরে কুরে খাওয়ার মতো পরিস্থিতি হয়েছে।’
২০১০ সালের ২৪ মার্চ ঢাকার গুলশানে বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করায় মেয়ের সামনে মা-বাবাকে গুলি করে খুন করে এক বখাটে। হত্যাকাণ্ডের পর খুনি চিৎকার করে মেয়েটির উদ্দেশে বলে, ‘তোর বাপ-মায়েরে মাইরা ফেললাম। এবার একলা একলা থাক।’ যদিও ওই মুহূর্তে ইতি নামের মেয়েটি সেখানে ছিল না। বাবা-মাকে যখন গুলি করে বখাটে, তখন মেজ মেয়ে বীথি ও ছোট মেয়ে ইতি দৌড়ে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পায়।
এর আগে এই বখাটের উৎপাতে পড়ালেখা বন্ধ করে দিয়েছিল ইতি। কিন্তু তার পরও বাবা-মাকে বাঁচাতে পারেনি সে। বাবা সাদিকুর রহমান (৫৫) ছিলেন ব্যবসায়ী। মা রোমানা নার্গিস গৃহিণী। ছোট মেয়ে ইতিকে বিয়ে করার জন্য কথিত প্রেমিক রুবেল দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করে আসছিল।
বাংলাদেশে গত এক দশকে ইভটিজিং যেন সহনশীলতার মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। যার পরিণতিতে অনেক স্কুল-কলেজগামী মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। ইভটিজিংয়ের কারণে নারায়ণগঞ্জে চারুকলার ছাত্রী সিমি আত্মহত্যা করেছিলেন ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর। তৃষা হত্যার ঘটনা ঘটে গাইবান্ধায় ২০০২ সালের ১৭ জুলাই। দশ বছর বয়সী তৃষা স্কুল ছুটির পর যখন বাড়ি ফিরছিল, তখন তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় কয়েকটি যুবক তাদের যৌন লালসা মেটানোর জন্য তাকে তাড়া করে। মেয়েটি ছুটতে ছুটতে শেষ পর্যন্ত একটা পুকুরে লাফিয়ে পড়ে ডুবে মারা যায়।
২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি এক বখাটের হাতে রাস্তায় অপমানিত হওয়ার পর বাড়িতে ফিরে সিলিং ফ্যানে ওড়না বেঁধে আত্মহত্যা করে ঢাকার শ্যামলী আইডিয়াল টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণীর ছাত্রী নাসফিয়া আকন্দ পিংকি। সে মাত্র কয়েক দিন আগে বাড়ি ফিরছিল গর্বিত ছাত্রী হিসেবে দেশজুড়ে বিনামূল্যে স্কুল পাঠ্যবই বিতরণের কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত থেকে বই উপহার নিয়ে। এ রকম সামাজিক অপরাধের সর্বশেষ বলি হলো নিতু মণ্ডল।
পিংকি, সিমি, তৃষা- এরা কেউই স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথ বেছে নেয়নি। এদের কোনো না কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ হামলা করে, নিপীড়ন করে, যৌন হয়রানির উদ্দেশ্যে রীতিমতো তাড়া করে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিয়েছে। কেবল পথে সামান্য উত্ত্যক্ত করার ঘটনা এগুলো নয়। বাংলাদেশের আইনে এসব অপরাধের জন্য দণ্ডের বিধান আছে; কিন্তু সেসব আইনের প্রয়োগ নেই। ফলে অপরাধীরা উপযুক্ত শাস্তি পায় না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত আট বছরে সারা দেশে নারী নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ৩৮ হাজার ৪৯৮টি। এর মধ্যে যৌন নির্যাতনের ঘটনা ৫১৭টি, অপহরণের ঘটনা ১ হাজার ৫৪৫, উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছে ৩ হাজার ৭৮০ জন নারী। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছে ১৩৮ জন। এসব তথ্যও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে নেয়া। এর বাইরে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘এসব ঘটনা অনেক আগে থেকেই ঘটছে। ফাহিমা, মহিমা, তৃষা, পিংকিরা বছরের পর বছর জীবন দিচ্ছে, নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ঘাতকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় এ রকম ঘটনা বারবার ঘটছে।’
নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে ধারাবাহিক আন্দোলনের কথা তুলে ধরে মালেকা বানু বলেন, ‘আমাদের আন্দোলনের কারণেই হাইকোর্ট ইভটিজিংকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে শাস্তি দেয়ার বিধান রেখে বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। কিন্তু সেই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। সেই নির্দেশনানুযায়ী আইনও হয়নি। নেয়া হয়নি কোনো কার্যকর উদ্যোগ। ফলে অপরাধীরা ছাড় পেয়ে যাচ্ছে। তারা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটাচ্ছে।
মালেকা বানু বলেন, ‘অপরাধীরা যদি মনে করে যে বিচার হবে না তাহলে তো এগুলো চলবেই। এ ছাড়া আমাদের সমাজে সচেতনতা কম। সমাজকে সচেতন করতে হবে। পরিবারগুলো যেন মুখ খুলে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। পরিবার যদি মুখ খুলে আগে কলেজকে জানাত, তাহলে হয়তো রিসাকে জীবন দিতে হতো না। তাহলে হয়তো ওই ব্যক্তি আগেই গ্রেপ্তার হতে পারত। এ জন্য অভিভাবকদেরও সচেতন হতে হবে।’
তিনি বলেন, একটা সময় এ ধরনের ইভটিজিংয়ের ঘটনায় পরিবারের পক্ষ থেকে লুকিয়ে রাখার একটা প্রবণতা ছিল, তা অনেকটা কমে এলেও সচেতনতা সবার মধ্যে এখনো আসেনি।
২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্ট বিভাগ যৌন হয়রানি প্রতিরোধে একটি নির্দেশনামূলক রায় দেন। এই রায়ে মূলত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্রসহ সর্বস্তরে নারীর ওপর যৌন হয়রানিমূলক আচরণ প্রতিরোধে নির্দেশনা দেওয়া হয়। কেউ অশোভন আচরণের শিকার হলে কাছের থানায় বা দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তাকে জানাতে পারেন। অনলাইনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনে এবং মুঠোফোনের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হলে টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করার সুযোগ রয়েছে।
আবার দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার ইচ্ছায় কোনো মন্তব্য, অঙ্গভঙ্গি বা যেকোনো ধরনের কাজের শাস্তি এক বছর কারাদণ্ড বা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন অধ্যাদেশের ৭৬ ধারা অনুযায়ী, নারীদের উত্ত্যক্ত করার শাস্তি কমপক্ষে এক বছরের কারাদণ্ড অথবা দুই হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুযায়ী, যৌন কামনার উদ্দেশ্যে কোনো অঙ্গ স্পর্শ করলে বা শ্লীলতাহানি করলে সর্বোচ্চ ১০ বছর সাজা এবং সর্বনিম্ন তিন বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।
মালেকা বানু বলেন, ‘আমাদের দেশের অভিভাবকরা আইনি সহায়তা পারত পক্ষে না লাগলে নেয় না। আইন আছে, হাইকোর্টের নির্দেশনা আছে – কিন্তু এসবের বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ নেই। অপরাধীদের শুধু ধরলেই হবে না, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।