মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পলাতক শতাধিক আসামি গ্রেপ্তারে কোনো অগ্রগতি নেই। এদের মধ্যে ১৬ জনই দণ্ডিত, যাদের সবারই মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজনের বিদেশে প্রকাশ্যে আছেন। এই বিচার নিয়ে নানা অবমাননাকর বক্তব্যও দিচ্ছেন তারা। অন্য একজনের অবস্থান সম্পর্কেও কিছু তথ্য আছে। তবে বাকিরা কোথায় তা জানা নেই কারও।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় প্রথম সাজা পেয়েছেন যিনি, তিনিও পলাতক। তাদে দেশে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকরের ঘোষণা থাকলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি।
পলাতক ও দণ্ডিতদের ফিরিয়ে আনতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে উচ্চক্ষমতার দুটি সেল থাকলেও সেগুলো বলতে গেলে কিছুই করতে পারেনি। পুলিশ সদরদপ্তরের ডিআইজি বিনয়কৃষ্ণ বালার নেতৃত্বে গঠিত তদারকি কমিটি মাঝে মধ্যে বৈঠক করলেও পলাতক আসামিদেরকে গ্রেপ্তারে কোনো অগ্রগতি নেই। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) কামাল উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে তদারকি সেলও এখন আর কার্যকর নয়।
পলাতকদের বেশিরভাগই দেশে
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, পলাতকদের একটি অংশ দেশের বাইরে থাকলেও বেশিরভাগ দেশের ভেতরেই আত্মগোপনে আছেন। বিদেশে থাকা আসামিদের বিরুদ্ধে ইন্টাপোলের মাধ্যমে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি থাকলেও কাউকে দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি।
ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার অন্যতম সমন্বয়ক সানাউল হক ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আসামিদের গ্রেপ্তারের দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর। সব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাঠানো হয় আইজিপিকে। গ্রেপ্তারের বিষয় মনিটরিং করার জন্য ট্রাইব্যুনাল একটি অর্ডার দিয়েছিলেন যে কমপক্ষে একজন ডিআইজির নেতৃত্বে একটি মনিটারিং সেল করার জন্য। ডিআইজি বিনয়কুমার বালার নেতৃত্বে একটি সেল আছে। তারা মিটিং করেন। তবে আমরা এখনো পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো রেজাল্ট পাইনি। আজ পর্যন্ত দণ্ডপ্রাপ্ত বা দণ্ডপ্রাপ্ত ছাড়া গ্রেপ্তারি পরোয়ানাপ্রাপ্ত আসামি গ্রেপ্তার হয়নি।’
‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে আরও একটি কমিটি আছে। অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে গঠিত এ কমিটির মিটিংই হয় না। দুই একটি মিটিং হয়েছিল প্রথম দিকে। তারপর আর কোনো মিটিং হয়নি’- বলেন সানাউল হক।
তদন্ত সংস্থার গ্রেপ্তারের ক্ষমতা না থায় আক্ষেপ
আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করে সানাউল হক বলেন, ‘বিচারে অর্থ ব্যয় হচ্ছে। কিন্তু আসামিরা সাজাই যদি না খাটে তাহলে বিচারটা অর্থহীন হয়ে যায়।’ তিনি বলেন, ‘তদন্ত চলাকালে তদন্ত সংস্থার হাতে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা থাকলে পলাতক আসামির সংখ্যা এত বেশি হতো না।’
ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘আমরা পলাতক অবস্থায় বিচার করছি। পলাতক অবস্থায় বিচারে নৈতিক বিজয় হয় বটে কিন্তু সত্যিকার অর্থে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হয় না। আদালতও খুব একটা অ্যাপ্রিসিয়েট করে না।’
১৬ দণ্ডিত পলাতক
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর এ পর্যন্ত ২৬টি মামলার রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। সর্বশেষ গত ১০ আগস্ট যশোরের জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য সাখাওয়াত হোসেনসহ আট আসামির বিরুদ্ধে রায় ঘোষণা করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এ মামলায় শাখাওয়াত ও বিল্লাল হোসেন ছাড়া বাকি ছয় আসামি পলাতক রয়েছেন।
এ মামলার অন্য আসামিরা হলেন, ইব্রাহিম হোসাইন, শেখ মো. মজিবুর রহমান, এম এ আজিজ সরদার, আবদুল আজিজ সরদার, কাজী ওহিদুল ইসলাম ও আবদুল খালেক। এরা ছাড়াও সব মিলিয়ে মোট ১৬ জন দণ্ডিত পলাতক। এদের সবারই মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।
মানবতাবিরোধী অপরাধে প্রথম মৃত্যুদণ্ড সাজা হয় জামায়াতের সাবেক রোকন আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের। মামলার বিচারের শুরুতেই রাজধানীর উত্তরা থেকে তিনি পালিয়ে যান।
বুদ্ধিজীবী হত্যায় প্রথম সাজা হওয়া আলবদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান, চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের একজন আছেন যুক্তরাজ্যে, অপরজন যুক্তরাষ্ট্রে। তাদেরকে ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর এখন পর্যন্ত অনিশ্চিত। ছাড়া মৃত্যুদণ্ড পাওয়া ফরিদপুরের নগরকান্দার জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকার সুইডেনে চলে গেছেন বলে তথ্য আছে। এ ছাড়া পিরোজপুরের আবদুল জব্বার, নেত্রকোণার সৈয়দ মো. হাসান আলী, কিশোরগঞ্জের ক্যাপ্টেন (অব.) নাসিরউদ্দিন আহমেদ, গাজী আবদুল মান্নান, হাফিজ উদ্দিন ও আজহারুল ইসলামও লাপাত্তা।
পলাতক যে ৬৩ জনের বিচার চলছে
পলাতক আসামিদের মধ্যে ১১ জনই কক্সবাজারের। এরা হলেন, জালাল উদ্দিন ওরফে প্রকাশ জালাল, সাইফুল ওরফে প্রকাশ সাবুল, মমতাজ আহমেদ, হাবিবুর রহমান ওরফে হাবিব মুন্সি, মৌলভী আমজাদ আলী, আব্দুল মজিদ, আবদুস শুক্কুর, মৌলভী জালাল, আব্দুল আজিজ, জাকারিয়া সিকদার এবং রমিজ হাসান।
বাগেরহাট মোড়েলগঞ্জের ঘটনায় করা মামলার নয় আসামি খান আশরাফ আলী, সুলতান আলী খা, রুস্তম আলী মোল্লা, ইদ্রীস আলী মোল্লা, মকছেদ আলী দিদার, শেখ রফিকুল ইসলাম, মনিরুজ্জামান, হাশেম আলী, মোহাম্মদ আজাহারকে গ্রেপ্তারেও নির্দেশ পালন করা যায়নি।
গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার ছয় আসামি জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য আবু সালেহ মোহাম্মদ আজিজ মিয়া, রুহুল আমিন, আব্দুল লতিফ, আবু মুসলিম আলী, নাজমুল হুদা এবং আব্দুর রহিম মিয়াকেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ।
গাইবান্ধা সদর উপজেলার মানবতাবিরোধী অপরাধের আরেক মামলার পাঁচ আসামি আব্দুল জাব্বার মণ্ডল, জাছিজার রহমান, আব্দুল ওয়াহেদ মণ্ডল, মনতাজ আলী বেপারী, আজগর হোসেন খানকেও গ্রেপ্তার করা যায়নি।
এক মামলায় মৌলভীবাজারের ছয় আসামিও গ্রেপ্তার হননি এখনও। এরা হলেন, সামসুল হোসেন তরফদার, নেসার আলী, মোবারক মিয়া, আব্দুন নূর তালুকদার, আনিস মিয়া ও আব্দুল মুসাব্বির মিয়া।
ময়মনসিংহে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা মামলার চার আসামিও লাপাত্তা। এরা হলেন ফখরুজাজ্জামান, আব্দুস সাত্তার, খন্দকার গোলাম রব্বানী ও ওয়াজ আলী।
একই জেলায় করা আরেক মামলার চার আসামি খলিলুর রহমান, আবুল কালাম ওরফে সামুসুজ্জামান কালাম, মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ এবং আব্দুল মালেক আকন্দও পলাতক। ময়মনসিংহেরই এক জেলা মুক্তাগাছার চার আসামি বেলায়েত হোসেন, নাছির উদ্দিন, ইসমাইল এবং কাজী বদরুজ্জামানেরও কোনো পাত্তা নেই।
নেত্রকোনার চার আসামিও গ্রেপ্তার হননি বিচার চলাকালে। এরা হলেন শেখ আ. মজিদ ওরফে মজিদ মাওলানা, কবির খান, মো. নরুদ্দিন ওরফে লেংড়া আবন এবং সালাম বেগ। জেলারই আটপাড়ার আরেক মামলায় পলাতক আছেন দুই আসামি হেদায়েত উল্লাহ ওরফে আঞ্জু এবং এনায়েত উল্লাহ।
এ ছাড়া নোয়াখালীর আব্দুল কালাম ওরফে একেএম মনসুর, কিশোরগঞ্জের সৈয়দ হুসাইন ওরফে হোসেন, নীলফামারীর সৈয়দপুরের ইদ্রিস আলী সরদার, হবিগঞ্জের মো. লিয়াকত আলী, আমিনুল ইসলাম ওরফে রজব আলী, মৌলভীবাজারের বড়লেখার আব্দুল মতিন, এবং নেত্রকোনার দূর্গাপুরের খলিলুর রহমান পলাতক।
তদারকি সেল গঠনের সুফল মেলেনি
২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার আবেদনের পর পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদারকি সেল গঠন করে। ওই সেলের প্রধান ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (রাজনৈতিক) কামাল উদ্দিন আহমেদ। অন্যরা হলেন- পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি), পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই), প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তর (ডিজিএফআই), ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটরের কার্যালয় ও মানবতাবিরোধী অপরাধ তদন্ত সংস্থার প্রতিনিধি। এই কমিটি মাঝে মাঝে মিটিং করে। তবে গ্রেপ্তারের বিষয়ে কোনো অগ্রগতি নেই।
পলাতকদের ফিরিয়ে আনার কার্যক্রম তদারক করতে গত বছরের জুন মাসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল একটি কমিটি গঠন করার নির্দেশ দেয়। আদেশ অনুযায়ী, পুলিশ সদর দপ্তর ছয় সদস্যের একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির সভাপতি হলেন- পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি বিনয়কৃষ্ণ বালা ও সদস্য সচিব এআইজি মনিরুজ্জামান। অন্য সদস্যরা হলেন- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তা হেলাল উদ্দিন, সিটি এসবির একজন কর্মকর্তা, ডিএমপি ডিবির একজন কর্মকর্তা ও র্যাবের একজন কর্মকর্তা। এই সেলটি এখন আর বৈঠক করে না।