গ্রামের নাম কলসিন্দুর। বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার ভারত সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার একটি গ্রাম এটি। আগে কখনও এই গ্রামের নামও শুনিনি। এই গ্রামেরই নয়জন কিশোরীর কারণে গ্রামটির নাম এখন মানুষের মুখে মুখে। গত কয়েকদিন যাবৎ এই গ্রামেরই মেয়েগুরোকে নিয়ে নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দেশের পত্রিকাগুলো। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও তাদের প্রশংসার পঞ্চমুখ। কারণ প্রশংসিত হবার মতই কাজ করেছে তারা।
কলসিন্দুর গ্রামের ওই মেয়েগুলো এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন (এএফসি) অনুর্ধ্ধ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছে। টানা চার ম্যাচে জিতে এএফসির মূল পর্বে ওঠার যোগ্যতা অর্জন করেছে তারা। জ্বী, আমাদের মেয়েরা এখন আর শুধু কানামাছি, বৌচি আর পুতুল খেলা নিয়ে বসে নেই। তারা এখন পুরুষের মতই ক্রিকেট –ফুটবল খেলে বিজয় অর্জন করে খুশির জোয়ারে পুরো দেশের মানুষকে ভাসাচ্ছে।
সমস্যা হলো মেয়েরা যেভাবে এগিয়েছে, ছেলেরা সেভাবে এগোতে পারেনি। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, মেয়েরা ১০ গোল দেয় আর ছেলেরা ৫ গোল খায়। শুধু ফুটবল খেলাতেই নয়, বদলে যাওয়া পৃথিবীর সাথেও মানিয়ে চলতে গিয়েও পিছিয়ে আছে ছেলেরা। বিশ্বের অন্যান্য প্রান্তে মেয়েরা একা একাই চলাফেরা করছে, সাথে কোনো সঙ্গী-সাথীর দরকার হয় না। কিন্তু আমাদের মত অনুন্নত দেশে মেয়েদের সাথে কোনো অভিভাবক ছাড়া যে চলেই না। মেয়েদের একা পেলেই বিরক্ত করে কতিপয় নিম্ন শ্রেণির পুরুষ।
এমনি এক প্রেক্ষাপটে, এএফসি অনুর্ধ্ধ-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে যাওয়া মেয়েদের একা একা একটি গণপরিবহনে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া কতটা যৌক্তিক? বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে উঠে এসেছে, বাড়িতে যাওয়ার সময় তাদেরকে হয়রানির শিকার হতে হয়। পাশের সিটে বসে থাকা পুরুষরা তাদের উত্যক্ত করেছে। পথে যদি তাদের কোনো বিপদ হতো, তবে তার দায় কে নিতো? এমনিতেই তো আমাদের সমাজ মেয়েদের ঘরে বেঁধে রাখতে পছন্দ করে। তারওপর এরা এমন একটি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে এসেছে, যে গ্রামের নাম আমার মত অনেকেই আগে কখনও শুনেনি। ভাবুন তো, বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেলে, এই মেয়েগুলো গ্রামে ফিরতো কিভাবে?
তাদের কি দোষ এটাই যে, তারা পুরুষ নয়। আমি নিশ্চিত, এএফসি অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে যাওয়া এই খেলোয়াড়রা মেয়ে না হয়ে ছেলে হলে, তাদের প্রতি এতোটা অবহেলা করা হত না। পুরুষ শাষিত সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রয়েছে মেয়েদেরকে পিছিয়ে রাখার মন্ত্রণা। এই আভিশাপ থেকে রক্ষা পায়নি বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনও। তাদের কার্যকলাপ থেকেই তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে উঠেছে। যেহেতু তারা মেয়ে, তাই তাদেরকে একটি লোকাল বাসে বাড়িতে পাঠনো হলো, যে বাসটি পুরো রাস্তায় যাত্রী উঠাতে উঠাতে চলে গেছে। এটি শুধু নিরাপত্তার প্রশ্ন নয়, এর সাথে উঠে এসেছে বাফুফে নারী খেলোয়াড়দের কিভাবে দেখছে, তাদের কতটা সম্মান দিচ্ছে, সে বিষয়গুলোও ফুটে উঠেছে।
বাবা-মায়েরা এমনিতেই মেয়েদের সীমানার বাইরে পাঠাতে চায় না। এই মেয়েগুলো সাহস করে ঢাকায় গিয়ে তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিলো। কিন্তু, ফেরার সময় বাফুফে তাদের জন্য একটি পরিবহনের ব্যবস্থাও করতে পারলো না। কেন এই দায়িত্বহীনতা? বাফুফের কি সাধ্য ছিলো না তাদের জন্য আলাদা একটি পরিবহনের ব্যবস্থা করার? এখন সময় এসেছে এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার। তা না হলে, ভবিষ্যতে এর চেয়েও বড় কোনো সমস্যায় পড়তে পারে বাংলাদেশের নারী খেলোয়াড়রা।