বছর দুয়েক আগে ঈদুল ফিতরের সময় কুমিল্লার সাংবাদিক বাকিন রাব্বী এই ছবিটি দিয়ে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলেন। ছবিটি দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম। এই ছবি দেখে চমকে উঠলেও কয়েকদিন পর প্রথম আলোতে ছাপা হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের এই ছবিটি আমার অস্তিত্বেই প্রবল ধাক্কা দিয়েছে। আমি জানি, এমন হাজারটা উদাহরণ আপনাদের সবার চোখের সামনে প্রতিদিন ঘটছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসলে আমাদের ক্রমশ চরম অসামাজিক করে দিচ্ছে। প্রথম ছবিতে ঈদের ছুটিতে পাঁচ কাজিন একত্রিত হয়েছে। তারা সবাই একরুমে। যেভাবে শুয়ে বসে আছে, বোঝাই যাচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রবল ভাব-ভালোবাসা। কিন্তু ভালো করে দেখুন, কেউ কারো দিকে তাকিয়ে নেই। সবার চোখ হাতের ডিভাইসেÑস্মার্টফোন বা ট্যাবে। কেউ কারো ফেসের দিকে তাকাচ্ছে না, সবার নজর ফেসবুকে। আমি আঁতকে উঠেছি আমার ছেলেবেলার কথা ভেবে। আমার ছেলেবেলা কেটেছে গ্রামে।
আমার কাকা থাকতেন ঢাকায়। ঈদে বা গ্রীষ্মের ছুটিতে কাকা বাড়ি যেতেন, সঙ্গে থাকত আমার চাচাতো ভাইবোনেরা। সত্যি বলছি, আমরা সারা বছর সেই সময়টার জন্য অপেক্ষা করতাম। কাকা বাড়ি গেলে আমরা এক ধরনের স্বাধীনতা পেয়ে যেতাম। আমরা ভাইবোন, চাচাতো ভাইবোন আর আশপাশের প্রতিবেশী বন্ধু-বান্ধব মিলে বিশাল বাহিনী তৈরি হতো। সেই বাহিনী দিয়ে হেন কোনো কাজ নেই করতাম নাÑ দিনভর পুকুরে ডুবসাঁতার, গাছে চড়া, গোল্লাছুট, কারো গাছের ফল চুরি। আমাদের তৎপরতা চলতো গভীর রাত অবধি। পূর্ণিমার রাতে উঠানে পাটি বিছিয়ে শুয়ে আকাশের তারা গুনতে গুনতে রূপকথার গল্প শোনার সেই দিনগুলো সত্যিই অনেক আনন্দের ছিল। আর এখন একসঙ্গে বসে কেউ কারো দিকে তাকানোর ফুরসতই নেই। দ্বিতীয় ছবিটি দেখুন, আরো ভয়ংকর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডজনখানেক শিক্ষার্থী এক রুমে আছে, অথচ কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না। আপনি ভাবুন, আপনার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন বা হলজীবনের কথা। ১২ জন বন্ধু একসঙ্গে এক রুমে থাকলে কী ভয়ংকর আনন্দের ব্যাপার ঘটতো, ভাবতেই আমি শিহরিত হচ্ছি। আড্ডাবাজি, তাস খেলা, হইচই, গান-বাজনা, খুনসুটি, ঠাট্টা-মশকরা, মাঝেমধ্যে হাতাহাতি পর্যন্ত গড়ানোও অস্বাভাবিক নয়। এখন তার কোনো বালাই নেই। আমি নিশ্চিত, এই তরুণ-তরুণী-যুবকরা স্মার্ট ডিভাইসে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো ভার্চুয়াল বন্ধুর সঙ্গেই যোগাযোগ করছিল। কিন্তু আমার শঙ্কাটা হলো পাশের অ্যাকচুয়াল বন্ধুর চেয়ে দূরের বা কখনো কখনো অদেখা ভার্চুয়াল বন্ধুটাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল?
এইটুকু পড়ে কেউ ভাবতে পারেন, আমি বুঝি ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমবিরোধী মানুষ। কিন্তু আমার ফেসবুক একাউন্ট দেখলে যে কেউ বুঝবেন আমি মোটেই ফেসবুকবিরোধী নই, বরং আমি ফেসবুকে অন্য অনেকের চেয়ে বেশি সক্রিয়। সব বিষয়ে আমি আমার মতামত প্রকাশ করি। কিন্তু আপনার প্রথম ধারণাটাই সত্যি। আমি আসলে মনেপ্রাণে ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগের বিরোধী মানুষ। কয়েকদিন আগে যখন সরকার বাংলাদেশে ফেসবুকসহ সব সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বন্ধ করে দিয়েছিল, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম। অন্য অনেকে বিকল্প পথে ফেসবুক ব্যবহার করলেও আমার কোনো তাড়া ছিল না। বরং ফেসবুকবিহীন জীবনটা আমি খুব উপভোগ করেছি। আমার সহকর্মীদের অনেকের হাতেই তখন বই দেখেছি। এমনিতে সবার হাতে হাতে বই নয়, স্মার্ট ডিভাইস থাকে। যদি কোনোদিন এমন দিন আসে বিশ্বে কোনো ভার্চুয়াল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থাকবে না, আমার চেয়ে খুশি কেউ হবে না।
আমি জানি, তেমন সুখের দিন আর কখনোই আসবে না। যেহেতু ফেসবুকমুক্ত বিশ্ব গড়া সম্ভব নয়। তাই আমিও যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ফেসবুকে সক্রিয় থাকি। নইলে তো বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে হবে। আমরা বুঝতেই পারি না। ফেসবুক আমাদের মূল্যবান সময় কেড়ে নেয়, সুখ কেড়ে নেয়, স্বস্তি কেড়ে নেয়। মানুষের এখন বই পড়ার সময় নেই, গান শোনার সময় নেই, সিনেমা দেখার সময় নেই, বেড়াতে যাওয়ার সময় নেই; সারাক্ষণ স্মার্ট ডিভাইসের দিকে চোখ সবার। বেড়াতে গেলেও সামনে সমুদ্র রেখে ব্যস্ত সবাই সামাজিক যোগাযোগে। নিজের চোখে কেউ প্রকৃতি দেখে না, দেখে মোবাইল ক্যামেরার চোখে, চেক ইন দিতে হবে যে, ফেসবুকে একটা ভালো স্ট্যাটাস না দিলে সোশ্যাল স্ট্যাটাসই যে থাকে না।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের আরো বেশি অসামাজিক করে তুলেছে। কয়েকদিন আগে একজন ফোন করে বললেন, চইলা আসেন কিন্তু। আমি বিস্মিত হয়ে জবাব দিলাম, কোথায়? তিনি পাল্টা জবাব দিলেন, কেন ফেসবুকে ইভেন্ট খুলেছি দেখেননি। তার বিয়ের দাওয়াত দিচ্ছেন তিনি ফেসবুকে ইভেন্ট খুলে। সন্তান জন্মের আনন্দটা ভাগাভাগি করতেও ফেসবুক স্ট্যাটাসই ভরসা। অথচ আগে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বিয়ের দাওয়াত দেওয়া হতো। সশরীরে না গেলে সেটা দাওয়াত হিসেবেই গণ্য হতো না। সন্তান জন্মের খবরের সঙ্গে যেত মিষ্টির হাড়ি। এখন সবাই সব খবর ফেসবুকে জানিয়েই খালাস। পাশের রুম থেকে অসুস্থ মা ডাকলে সাড়া দেওয়ার সময় নেই। কিন্তু মা দিবসে মায়ের সঙ্গে একটা সেলফিসহ থরো থরো আবেগের একটা স্ট্যাটাস না দিলে মান থাকে না। ফেসবুকে মানুষ চেনা বড় দায়। বাস্তবে আপসকামী মানুষটিই ফেসবুকে তুমুল বিপ্লবী। চোখের সামনে প্রতিদিন কত অন্যায় হয়, আমরা ফিরেও তাকাই না। কিন্তু বাসায় ফিরে একটা স্ট্যাটাস ঝেড়ে দেই, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ হচ্ছে না বলে মূল্যবোধের ধসের স্লোগান দেই। ফেসবুক কখনো কখনো মানুষের ভেতরের কুকরটাকে বের করে আনে।
মুখে মুখে সুশীল, গণতন্ত্রের কথা বলি, পরমতসহিষ্ণুতার কথা বলি; কিন্তু মতে না মিললেই অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করি। প্রকাশ্যে কিছুটা সভ্য-ভব্য হলেও ইনবক্সে একেকজন অশ্লীলতার ডিপো। আর ফেক আইডি বানিয়ে পরিকল্পিতভাবে কারো বিরুদ্ধে লাগার উদাহরণও কম নয়। তবে সামাজিক মাধ্যমে সবচেয়ে ঝুঁকির মুখে থাকে নারীরা। বন্ধু হয়ে ঢুকে তারপর অশ্লীল ইঙ্গিত, অশ্লীল প্রস্তাব, ফেক আইডি থেকে অশ্লীল শব্দবাণ নারীদের জীবন দুঃসহ করে তোলে। এই সাইবার আক্রমণ থেকে মুক্ত নয় আমাদের তারকা ক্রিকেটাররাও। বোনের সঙ্গে ছবি পোস্ট করেও অশ্লীল আক্রমণের শিকার হওয়ার উদাহরণও ভূরি ভূরি। রাগ করে মাশরাফি তার পেজ সরিয়ে নিয়েছিলেন। ফেসবুকে পরিচয়, পরিচয় থেকে প্রেম, প্রেম থেকে পরিণয়ের অনেক উদাহরণ যেমন আছে; আছে অসংখ্য প্রতারণার গল্পও। প্রেমটাও কেমন খেলো হয়ে যাচ্ছে। দুদিনের চ্যাটিংয়ে গভীর প্রেমের দাবি অনেকের। আসলেই কি প্রেম? প্রেম কি এত সস্তা। অ্যাকচুয়াল প্রেমে একটুকু ছোঁয়ার শিহরণ অনেকে বয়ে বেড়ান জীবনভর। কিন্তু ভার্চুয়াল প্রেমে ছোয়াছুয়ির বালাই নেই। কিভাবে হয় প্রেম? ইনবক্স বা ফোনেই নাকি মিটে যায় সব চাহিদা। বিস্ময়কর।
তাহলে কি ফেসবুক পুরোটাই খারাপ? মোটেই না। ফেসবুকে অনেক অসাধারণ উদাহরণ আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে গোটা বিশ্ব এখন সত্যিই সবার হাতের মুঠোয়। বিশ্বের যে প্রান্তেই থাকুন আপনি, সংযুক্ত থাকবেন নিমিষেই। হারিয়ে যাওয়া কত বন্ধু ফিরে পাওয়া যায় ফেসবুকে। ফেসবুকে সামাজিক যোগাযোগের শক্তি ব্যবহার করে কত ভালো ভালো কাজ হচ্ছে প্রতিদিন। কারো রক্ত লাগবে? ফেসবুকে একটা স্ট্যাটাস দিলেই মিটে যায় সমস্যা। অসুস্থ কারো জন্য ফান্ড জোগাড়ের ভালো উপায় ফেসবুক। এখানেও অনেক প্রতারণা হয়, তবু অনেকের জীবন বাঁচিয়েছে ফেসবুক। দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো, অন্যায়ের প্রতিবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী মাধ্যম ফেসবুক। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এখন বিকল্প গণমাধ্যম হয়ে উঠছে। কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে খুব দ্রুত জনমত গড়ে ওঠে ফেসবুকে। কাদের মোল্লার লঘুদ-ের প্রতিবাদে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে উঠেছিল ফেসবুকের ইভেন্ট থেকে। কখনো কখনো মূলধারার গণমাধ্যমও প্রভাবিত হয় সামাজিক মাধ্যমে, কখনো কখনো অনুসরণ করে ফেসবুককে।
ভালো-মন্দ মিলিয়েই ফেসবুকÑ আমাদের প্রতিদিনকার ভার্চুয়াল জগৎ। বাংলাদেশেই এখন এক কোটি ৭০ লাখ মানুষ এই ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা। ২০ বছর আগে রিকশাওয়ালার হাতে মোবাইল, কাজের বুয়ার আঁচলে মোবাইল বলে মজা করা হতো। কিন্তু এখন সেটা বাস্তবতা। ফেসবুক নিয়ে এখন অনেক মজার গল্প চালু আছে। এক ভদ্রমহিলা তার বুয়াকে ফোন করে বকা দিলেন, তুমি এখনও এলে না কেন? কাজের বুয়া জবাব দিল, আমি তো আজ আসব না। আসবে যে না সেটা আগে বলোনি কেন? কেন ফেসবুকে তো স্ট্যাটাস দিয়েছি, আপনি দেখেননি। সাহেব তো কমেন্ট করেছে। আপনার ছেলে তো লাইক দিয়েছে। এই মজাও আর বেশিদিন করার টাইম পাওয়া যাবে না। সবার হাতে হাতে এখন মোবাইল। ফেসবুকের ভার্চুয়াল জগৎ টেনে নিচ্ছে সবাইকেই। ফেসবুককে এখন আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। তাই একে পরিচ্ছন্ন করে তোলা আমাদের সবার দায়িত্ব। ছদ্মনাম, ফেক আইডি, অশ্লীল সাইবার আক্রমণের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আর খেয়াল রাখতে হবে ফেসবুক যেন আমাদের সব সময় খেয়ে না ফেলে। ভালো একটি বই পড়ার জন্য, একটি সিনেমা দেখার জন্য, গান শোনার জন্যও যেন একটু সময় থাকে হাতে।
প্রকৃতির রূপ যেন আমরা দেখতে পাই আমাদের নিজের চোখে, শুধু ক্যামেরার চোখে নয়। ফাদার্স ডে, মাদার্স ডেতে স্ট্যাটাস না দিয়ে বয়স্ক বাবা-মায়ের জন্যও যেন একটু সময় রাখি। যেন খেয়াল রাখি সন্তানের দিকে। মাঝে মধ্যে যেন প্রিয়ার হাতে হাত রেখে অনুভব করি ভালোবাসার উষ্ণতা। প্রিয়তমাকে পাশে বসিয়ে রিকশার হুড ফেলে ভিজিই না হয় তুমুল বৃষ্টিতে। সম্পর্কটা যতই ভার্চুয়াল হোক, ভালোবাসাটা যেন অ্যাকচুয়ালই হয়।