সীমাবদ্ধ সুযোগ-সুবিধার মধ্যেও আমাদের মেয়েরা (অনূর্ধ্ব-১৬, ১৪) যেভাবে খেলছে তাতে দেশবাসীর সঙ্গে আমিও মুগ্ধ। অনেকেই আমার কাছে জানতে চান, এই সাফল্যের রহস্য কী? রহস্য আসলে কিছু না। আমরা তাদের খুব ক্লোজলি নার্সিং দিচ্ছি। আমি ওদের সময় দেই। সবচেয়ে বড় কথা মেয়ে ফুটবলাররা অনেক ডিসিপ্লিন। আমি অনেক কড়া অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে ওদের রাখি।
বিগত দিনগুলোতে জার্নালিস্টরা অনেক উল্টাপাল্টা করেছে। তাদের কেন ক্যাম্পে ঢুকতে দেওয়া হবে না। কেন ওদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হবে না ইত্যাদি। কিন্তু আমি অনড় ছিলাম এবং এখনো আছি। এগুলো করলে তো ডিসিপ্লিন থাকে না। দেখবেন, যখন প্রচ- রকম ডিসিপ্লিন থাকে তখনই রেজাল্ট ভালো হয়। আমি যে জিনিসগুলো ওদের বলতাম ওরা সেগুলো মনপ্রাণ দিয়ে করে। আমি ওদের প্রায়ই কাউন্সিলিং করি। তাদের বোঝাই, দেখো, ভালো খেললে বড় ফুটবলার হবে, ফ্যামিলিকে সাপোর্ট করতে পারবে, সুনাম হবে, ফাইন্যান্সিয়াল স্বাচ্ছন্দ্য আসবে। ওদের বাবা-মায়ের পরেই আমি ওদের পাশে থাকি। ওরাও এটা ফিল করে। তারা জানে, যেকোনো বিপদে আমি তাদের সঙ্গে তো আছিই। ফাইন্যান্সিং অনেক সাপোর্ট কিন্তু ওদের দেওয়া হয় না। আদর ভালোবাসাটাই ওদের কাছে অনেক বেশি।
সীমিত সুযোগ-সুবিধা নিয়েও গত দুই বছরে আমরা দুটো বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। সুযোগ-সুবিধা পেলে আমাদের মেয়েরা আরো ভালো ফল করতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। সুখের কথা হলো, বাফুফে সভাপতি আমার সঙ্গে কথা বলেছেন। উনি নিয়মিত খেলা দেখেছেন। তিনি আমাকে কথা দিয়েছেন, ওদের জন্য যত ধরনের সুযোগ-সুবিধা আছে ওদের দিবেন। আমাদের তো টার্গেট ২০২২ সালের বিশ্বকাপে খেলা। সালাউদ্দিন ভাই আমাদের বলেছেন, আগামী ৪ বছর ওদের কন্টিনিউয়াস ট্রেনিংয়ে রাখতে। আমাদের প্রধানত যা দরকার তা হলো, ট্রেনিং। অর্থের অভাবে আমরা তো কন্টিনিউয়াস ট্রেনিং করাতে পারি না। সেটা এখন হবে। যেভাবে নার্সিং করা দরকার সেভাবে হবে।
কষ্টের ব্যাপার হলো সরকার থেকে আমরা বিন্দুমাত্র সহযোগিতা পাচ্ছি না।
সরকার থেকে চার আনা পয়সাও দেওয়া হয় না ফুটবলকে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইজ ফুটবল একটা ব্যয়ব্যহুল খেলা। একটা টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে লাখ লাখ বা কোটি টাকা খরচ হয়। এই যে আপনারা দেখছেন, ঢাকায় যে টুর্নামেন্টটা করছি, এটার খরচ হচ্ছে সাড়ে তিন কোটি টাকা। অথচ এই সাড়ে তিন কোটি টাকা স্পন্সর থেকে জোগাড় করতে হয়। আপনারা জানেন, আমি গোটা পৃথিবীর সঙ্গে কাজ করি। সব দেশেই সরকারি পয়সায় ফুটবল টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হয়। এমনকি নেপালের মতো দেশেও। আপনি যদি ফুটবলারদের ভালো সাপোর্ট না দেন তাহলে তো ভালো কিছু আশা করতে পারেন না। ফুটবল তো দশ-বারটা দেশ খেলে না। ফুটবল খেলে ২১১টা দেশ। ২১১টা দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে আমাদের তো সেভাবে তৈরি হতে হবে।
কিন্তু তার জন্য তো টাকার দরকার। ফেডারেশন বিভিন্নভাবে সরকারকে জানিয়েছে, বারবার আবেদনও করেছে অর্থের জন্য। কিন্তু সরকার থেকে কোনোরকম অর্থ সাহায্য পাওয়া যাচ্ছে না। সরকারের উচিৎ সম্ভাবনাময় এ মেয়েদের পাশে এসে দাঁড়ানো। ফুটবল হচ্ছে পৃথিবীর এক নম্বর খেলা। সেটাকে তো সেভাবেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। অর্থের অভাবে নতুন ট্যালেন্ট হান্ট কর্মসূচি শুরু করতে পারছি না।
আমরা এই মেয়েদের পেয়েছিলাম ২০১২ সালে। একটা এনজিওর স্পন্সরের মাধ্যমে ট্যালেন্ট হান্ট শুরু করি তখন। সেখান থেকে এই মেয়েরা বেরিয়ে আসে। তারপর থেকেই ওদের বিভিন্নভাবে ট্রেনিং করাই। এরা একদিনে তৈরি হয়নি। শুধু ওদের নয়, ওদের বাবা-মাকেও কাউন্সিলিং করানো হয়েছে। যাতে করে ফ্যামিলির সাপোর্টটা থাকে। কারণ আপনারা জানেন এরা সব গ্রামের মেয়ে। শহরের নয়। গ্রামের বাবা-মায়েরা তো মেয়ের ১৫-১৬ বছর হলে বিয়ে দিয়ে দেয়। সেখান থেকে যদি আমরা ওদের উদ্ধার করতে না পারি তাহলে লক্ষে পৌঁছতে পারব না।
ক্যাম্পে থাকাকালীন আমরা তাদের ব্যালেন্স ডায়েট সরবরাহ করি। চার্ট অনুযায়ী তাদের খাবার দেওয়া হয়। তবে ক্যাম্পের বাইরে থাকলে সেটা মেইনটেন করা সম্ভব হয় না। যে কারণে আমাদের অনেক অসুবিধা হয়। পুষ্টির ঘাটতি দেখা দেয়। আবার সেটা আমাদের মেকআপ করতে হয়। এ জন্য দরকার লং ট্রেনিং। মান বার মাসের ক্যাম্প। ওদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধাটাও বাড়াতে চাই। এখন মাসিক কোনো টাকাকড়ি দিতে পারি না। কোনো টুর্নামেন্ট শেষ করে যখন ওরা বাড়ি যায় তখন ওদের একটা সম্মানী দিয়ে দেই। আমি মনে করি পর্যাপ্ত আর্থিক সুযোগ সুবিধা পাওয়া গেলে আমাদের মেয়েরা এশিয়া লেভেলে, এমনিক বিশ্ব লেভেলেও পৌঁছাতে পারবে।
মাহফুজা আক্তার কিরণ : বাফুফে সদস্য ও মহিলা উইংয়ের প্রধান