সান্ধ্য আইনের নামে ঘুষ-বাণিজ্য চট্টগ্রাম কারাগারে!
প্রকাশ : ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:২৯:২৪
সান্ধ্য আইনের নামে ঘুষ-বাণিজ্য চট্টগ্রাম কারাগারে!
ইব্রাহিম খলিল, ঢাকাটাইমস
আদালত দুপুরে জামিন আদেশ দেয়ার পর তার কপি নিয়ে স্বজনরা ছুটছেন কারাগারের দিকে। বিকেলেই আদেশটি পৌঁছে দিতে হবে কারাগারে। যেতে যেতে তারা বন্দি স্বজনের মুখটি কল্পনা করছেন। আদেশের কপি কারাগারে পৌঁছে দেয়ার পর মুক্তি মিলবে পরিবারের সদস্যটির। তাকে নিয়ে ফিরে যাবেন ঘরে।
কিন্তু বিকেলের দিকে কারাগারে আদেশ নিয়ে গিয়ে হতাশ হলেন তারা। জানতে পারলেন, শুধু আদেশ পৌঁছালে হবে না, সঙ্গে অর্থযোগ থাকবে হবে। তবেই আজ স্বজনের মুক্তি মিলবে। নইলে আরও এক রাত তাকে কাটাতে হবে কারাগারে।
না, এটা সরকারি কোনো নিয়ম নয়। কারাকোডেও এমন বিধান নেই। তবে চট্টগ্রাম কারাগারে সান্ধ্য আইনের নামে এভাবেই চলছে ঘুষ-বাণিজ্য। সূর্যাস্তের আগে মুক্তির আদেশ কারাগারে পৌঁছালেও ঘুষ না দিলে মুক্তি মেলে না বন্দির। আবার মুক্তির আদেশের সঙ্গে টাকা গুঁজে দিলে সূর্যাস্তের পরও মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
টাকা দিয়ে মুক্তি পাওয়া এবং টাকা না-দেওয়ায় মুক্তি না-পাওয়া একাধিক বন্দির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব তথ্য।
ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য গত মঙ্গলবার (৬ সেপ্টেম্বর) এই প্রতিবেদক সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে মাসুদ নামের এক বন্দির মুক্তির বিষয়ে কথা বলেন ডেপুটি জেলার জাহিদুল ইসলামের সঙ্গে। এ সময় ডেপুটি জেলার বলেন, এক হাজার টাকা দিলে ৩০ মিনিটের মধ্যে বন্দিকে জেল থেকে বের করে দেওয়া হবে।
পরে পরিচয় দিলে তিনি টাকাও নেননি, ওই বন্দির মুক্তিও দেননি। পরদিন সকালে মুক্তি পান মাসুদ।
মুক্তির পর মাসুদ জানান, গত ৬ সেপ্টেম্বর তার জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। ওই দিন বিকাল সাড়ে চারটার দিকে মুক্তির আদেশ কারাগারে পৌঁছালেও তার মুক্তি মেলেনি সেদিন।
মাসুদ বলেন, ‘মুক্তির আদেশের সঙ্গে এক হাজার টাকা জেলারের কাছে পৌঁছালে আমাকে এক দিন অতিরিক্ত জেল খাটতে হতো না।’ পরে টাকা না নেওয়ার বিষয়ে জানতে পেরে মাসুদ ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘জেলে এক দিন বেশি ছিলাম তাতে আমার কোনো দুঃখ থাকবে না, যদি সাধারণ মানুষ ঘুষখোরদের কবল থেকে মুক্তি পায়।’
মুক্তির পর বিজয় নামে এক বন্দি জানান, ৭ সেপ্টম্বর তার জামিন মঞ্জুর করেন আদালত। ওই দিন বিকেল চারটায় তার স্বজনরা জামিন আদেশ নিয়ে কারাগারে পৌঁছালেও ডেপুটি জেলার মুক্তি দিচ্ছিলেন না। এ সময় তারা কথা বলে এক হাজার টাকা দেয়ার পর এক ঘণ্টার মধ্যে মুক্তি পান তিনি।
গত ১৭ আগস্ট জেল থেকে মুক্তি পাওয়া রঞ্জন নামের একজন বলেন, ‘১৬ আগস্ট আমার জামিনে মুক্তি পাওয়াসংক্রান্ত কাগজপত্র কারাগারে পৌঁছায়। কিন্তু আমাকে ওই দিন কারাগার থেকে বের করার জন্য আমার পক্ষে কেউ টাকা দেননি বলে আমি বের হতে পারিনি।’
মাসুদ, বিজয়, রঞ্জনসহ আরও কয়েকজন জেলবাস করা ব্যক্তি আলাপকালে বলেন, কারাগারে ঘুষ ছাড়া স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ও কথা বলা যায় না। মেসের নামে নিজের টাকায় খেতে হয়, ঘুমাতে হয়। টাকা না দিলে বন্দিদের ওপর চলে নানা ধরনের নির্যাতন। এর মধ্যে বন্দি মুক্তির বিষয়ে চালু রয়েছে সান্ধ্য আইন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আদালতের জামিন আদেশ সকাল ১০টায় কারাগারে পৌঁছাতে পারলে ঘুষ ছাড়া বিকেলে বন্দির মুক্তি মেলে। বিকেলে গেলে মুক্তি মেলে পরের দিন। অথচ জেল কোডের ৯১৯ বিধিতে বলা আছে, মুক্তির আদেশ দানের পর (লক আপের পরে ছাড়া) সঙ্গে সঙ্গে মুক্তি দিতে হবে।
একই আইনের ৫৭৩ বিধিতে বলা আছে, লক আপ সময়ের পর কোনোভাবেই কোনো বন্দিকে মুক্তি দেয়া যাবে না। সূর্যাস্তকে লক আপের সময় হিসেবে বলা আছে জেল কোডের ৪৯৬ বিধিতে। আর এই দুই বিধির কোনোটাই মানছে না চট্টগ্রাম কারাগার কর্তৃপক্ষ।
কারা কর্তৃপক্ষের এই অনিয়ম ও অর্থ লোলুপতার কারণে জামিন পাওয়া বন্দিকে এক দিন অতিরিক্ত জেলে থাকতে হচ্ছে। অন্যদিকে ওই বন্দিকে পরদিন মুক্তি দেওয়ার আগ পর্যন্ত রাতের খাবার ও সকালের নাশতা ইত্যাদির খরচ দেখিয়ে সরকারি বরাদ্দ আত্মসাৎ করা হচ্ছে।
জেলকোড বিধি অমান্য ও সান্ধ্য আইনের নামে ঘুষ-বাণিজ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার ইকবাল কবির ঢাকাটাইমসকে বলেন, এ ধরনের অভিযোগের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ থাকলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে সূর্যাস্তের (লক আপে নেওয়ার) আগে মুক্তির আদেশ এলে বন্দি ওই দিনই ছেড়ে দেওয়ার নিয়ম আছে বলে স্বীকার করেন তিনি। এক দিন অতিরিক্ত বন্দি থাকলে সরকার ও বন্দি উভয়ই ক্ষতির সম্মুখীন হন বলে একমত পোষণ করেন ইকবাল কবির।
সিনিয়র জেল সুপার বলেন, জামিন আদেশ যাচাই-বাচাই করতে কারা কর্তৃপক্ষের সময় লাগে বিধায় বন্দিদের মুক্তি দিতে পরদিন পর্যন্ত সময় লেগে যায়। তবে এতে কোনো অনিয়ম-দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতা নেই বলে দাবি করেন তিনি।