গাজীপুরের টঙ্গী বিসিক শিল্প নগরীতে একটি প্যাকেজিং কারখানায় বয়লার বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন অন্তত ২৬ জন। আহত হয়েছেন প্রায় তিরিশ জন। হতাহত ও স্বজনদের আর্তনাদ-আহাজারিতে ভারী হয়েছে চারপাশ। ত্রিশজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছেন। পোশাক বা শিল্প কারখানায় আগুনে লাগার এবং শ্রমিক পোড়ার এ ঘটনা বিশ বছরের ধারাবাহিকতার ফলাফল।
গার্মেন্টস এবং অন্যান্য শিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অগ্নিকাণ্ডে শ্রমিকদের প্রাণহানির ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে আসছে বছরের পর বছর ধরে। পাশাপাশি ছোটবড় বিভিন্ন ফ্যাক্টরিতেও ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণহানি হয়েছে অসংখ্য মানুষের। যার সর্বশেষ ঘটনা আজকে টঙ্গিতে বয়লার বিস্ফোরণে এ পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যু। চলতি বছরেই ২১ মে ২০১৬ তারিখে নরসিংদীতে একটি পোশাক কারখানায় আগুন লেগে পাকিস্তানিসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। কয়েক মাস পরই এই দুর্ঘটনা ঘটলো টঙ্গিতে।
বিজিএমইএ, ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ (বিলস) ও বিভিন্ন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী- গত দুই দশকে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে আগুন লেগে প্রাণ দিয়েছেন সাড়ে পাঁচ শর বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে ২৪ নভেম্বর ২০১২ সালে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তাজরিন দুঘর্টনায় সর্বাধিক ১১২ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে।
এ ছাড়া ২০১০ সালে গার্মেন্ট-এ দুটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে গাজীপুর সদরের গরীব অ্যান্ড গরীব সোয়েটার ফ্যাক্টরিতে অগ্নিকাণ্ডে মারা যান ২১ জন শ্রমিক। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর আশুলিয়ায় হামীম গ্রুপের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে আগুনে পুড়ে ৩০ শ্রমিক মারা যান।
২০০৬ সালের ২৩ ফেব্রয়ারি চট্টগ্রামের কে টি এস অ্যাপারেলস মিলে আগুন ধরলে ৬৫ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। ওই বছরের ৯ ফেব্রয়ারি গাজীপুরের যমুনা স্পিনিং মিলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত হন ছয়জন। একই বছরের মার্চ মাসে সায়েম ফ্যাশন লিমিটেডে আগুনে তিন মহিলা শ্রমিক নিহত হন।
২০০৫ সালের ৭ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের গোদাইল সান নিটিং নামে একটি গার্মেন্ট কারখানায় আগুনে ২০ শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
২০০৪ সালের ডিসেম্বরে নরসিংদীর শিবপুরে গার্মেন্ট কারখানায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৮ শ্রমিক নিহত হন। ওই বছরের ৩ মে মিসকো সুপার মার্কেট কমপ্লেক্সের এক গার্মেন্টে আগুন লাগলে মারা যান ৯ শ্রমিক।
২০০১ সালের ৮ আগস্ট ঢাকার মিরপুরের মিকো সোয়েটার লিমিটেডে আগুন ধরার গুজবে ভিড়ে পায়ের নিচে চাপা পড়ে নিহত হন ২৪ গার্মেন্ট শ্রমিক। এর সপ্তাহখানেক আগে মিরপুরের কাফরুলে অগ্নিকাণ্ডে আরো ২৬ শ্রমিক প্রাণ হারান।
২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার লিমিটেড গার্মেন্ট-এ আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৫৩ শ্রমিক। একই বছর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে গ্লোব নিটিং ফ্যাশন লিমিটেড গার্মেন্টে কারখানায় মারা যান ১২ জন শ্রমিক।
এছাড়া ১৯৯৭ সবালে ঢাকার মিরপুরের তামান্না গার্মেন্ট মিরপুর মাজার রোডের রহমান অ্যান্ড রহমান অ্যাপারেলস কারখানায় অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত হন যথাক্রমে ২৭জন এবং ২২জন সেলাই শ্রমিক।
১৯৯৬ সালে ঢাকার তাহিদুল ফ্যাশনে ১৪ জন এবং সানটেক্স লিমিটিডের কারখানায় ১৪ জন আগুনে পুড়ে মারা যান।
১৯৯৫ সালে রাজধানীর ইব্রাহিমপুরের লুসাকা অ্যাপারেলসের কারখানায় নিহত হন ১০ জন গার্মেন্ট কর্মী।
এরআগে ১৯৯০ সালের ১৭ ডিসেম্বর সারেকা গার্মেন্টে আগুনে পুড়ে মারা যান ২৭ জন। কিন্তু কেন বার বার এমন দূর্ঘটনা ঘটছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন এর জন্য মূলত দায়ী দুর্বল অগ্নিনির্বাপন ব্যাবস্থাপনা এবং মালিক পক্ষের উদাসীনতা। তাই এর জন্য কি করা যেতে পারে সে প্রশ্নের উত্তরে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স-এর ঢাকা বিভাগের উপপরিচালক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক বলেন- “এটা একটা দুর্ঘটনা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যন্ত্রের অতিমাত্রায় ব্যাবহার বা সঠিক সংরক্ষণের অভাবে এ রকমটা ঘটতে পারে। তবে কারখানা যেমনই হোক, তাতে যদি দুর্ঘটনা রোধের পর্যাপ্ত সতর্কতার ব্যবস্থা থাকে এবং সঠিক অগ্নিনির্বাপনের ব্যাবস্থা যদি করা হয়, শ্রমিকদের যদি সঠিক ভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়, তাহলে দুর্ঘটনা ঘটলেও হতাহতের সংখ্যা নূন্যতম রাখা সম্ভব।”