প্রকাশ : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ০৮:৩৪:১৩আপডেট : ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৬ ১২:৫৮:৩৪
ছিলেন ভিক্ষুক, এখন তাদের তহবিলে দেড় কোটি টাকা
এস এ প্রিন্স, নীলফামারী
তাদের পেশা ছিল মানুষের দোয়ারে দোয়ারে ভিক্ষা করা। মাথার ওপর ছিল না কোনো ছাউনি। এখন তারা বিভিন্ন সুবিধাভোগী প্রকল্পের আওতায় রূপান্তরিত হয়েছেন কর্মী মানুষে। তারা সবাই এখন স্বাবলম্বীর পথে।
তারা এখন মুখ তুলে বলতে পারেন, ‘মুই আর ক্যানে ভিক্ষা করির যাওয়ং, মুই এখন আর খাবার চিন্তা করং না। চটের বস্তা দিয়ে চালা বানেয়া কী কষ্ট করে আছনু! ঝড়-বৃষ্টি আর শীতোত মোক আর চিন্তা করিবার নাগিবে না।’
‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের আওতায় ঘর পেয়ে খুশিতে অশ্রুসিক্ত হয়ে কথাগুলো বলছিলেন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার গাড়াগ্রাম ইউনিয়নের পুনর্বাসিত ভিক্ষুক বাচ্চনী বেওয়া (৫৫)। তার মতো পুনর্বাসিত হয়েছেন আরো ৯৮৮ জন। ‘একটি বাড়ি একটি খামার’ প্রকল্পের আওতায় ৯৫১ জন পুনর্বাসিতকে সদস্য করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মমুখী করে গড়ে তোলা হয়। মানুষের দোয়ারে দোয়ারে হাত পেতে জীবন চালানো মানুষগুলো সিদ্ধান্ত নেয় কর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের।
একটি বাড়ি একটি খামারের ঋণের টাকা দিয়ে গরু, ছাগল পালন ও ব্যবসা করে আজ তারা স্বাবলম্বীর পথে। তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বর্তমানে নিজস্ব সঞ্চয় ৪৬ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০ টাকা, কল্যাণ অনুদান ৪৫ লাখ ৬৪ হাজার ৮০০, আবর্তক তহবিল ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ৬২৩ টাকাসহ মোট তহবিল দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৬১ হাজার ২২৩ টাকা।
কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুনর্বাসিতদের সাফল্যের কথা শুনে সরেজমিনে দেখার জন্য আসেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ। তিনি পুনর্বাসনের কাহিনী শুনে সন্তোষ প্রকাশ করেন। এদের ঘর নির্মাণের প্রস্তাব পেশ করায় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প থেকে প্রথম পর্যায়ে ১০ জন পুনর্বাসিতকে ঘর নির্মাণের জন্য ৬০ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়। পুনর্বাসিত ১০ জনের ঘর নির্মাণকাজের পরিকল্পনা, ডিজাইন ও প্রাক্কলন মোতাবেক ঘর নির্মাণ শেষ হলে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের একটি দল তা পরিদর্শন করেন। পরে ২০১৫-২০১৬ অর্থবছরে তিন দফায় আরো ২৩২ জনের ঘর নির্মাণের জন্য ঘরপ্রতি ৭৫ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়।
বরাদ্দ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটি ঘর নির্মাণকাজ শুারু করে। জেলা প্রশাসন ও উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটি ঘর নির্মাণ বাস্তবায়ন করে।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম মেহেদী হাসান বলেন, উপজেলা টাস্কফোর্স কমিটির মাধ্যমে নির্মাণকাজ বাস্তবায়ন মনিটরিং করেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। পুনর্বাসিতরা ঘর পাওয়ায় তাদের সামাজিকভাবে মর্যাদা বেড়েছে। সফলভাবে ঘর নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ায় আগামী দিনে বাকি পুনর্বাসিতদের ঘরের জন্য বরাদ্দ পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’
সরেজমিনে দেখা যায়, আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের মাধ্যমে ঘর পেয়ে খুবই খুশি পুনর্বাসিতরা। পেছনের কষ্টের দিন ভুলে তারা এখন নতুন জীবনের স্বপ্ন দেখছেন।
বাহাগিলী ইউনিয়নের আলেমা বেগম বলেন, ‘ঝড়-বৃষ্টির দিনোত কী যে কষ্ট করি আছনু! ঘর পাওয়ায় আর কষ্ট করির নাগবে না।’
চাঁদখানা ইউনিয়নের আলিজোন বেওয়া বলেন, ‘সরকার থাকি ঘর পাওয়ায় মোক আর কষ্ট করির নাগবে না।ৎ
এত দিনে আল্লাহ তাদের দিকে ফিরে তাকিয়েছে বলে মনে করছেন রনচন্ডী ইউনিয়নের মহিলা। তিনি বলেন, ‘আল্ল¬াহ এবার হামার প্যাকে ঘুরে দেখছে। থাকার একটা ঘর হইছে।’
আলেমা, আলিজোন, মহিলা, বাচ্চানীর মতো ২৪২ জন পুনর্বাসিত ভিক্ষুক ঘর পাওয়ায় তাদের দুঃখ-দুর্দশার দিন শেষ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের অধীনে ৯৮৯ জন পুনর্বাসিতের মধ্যে ২৪২ জনকে ‘যার জমি আছে ঘর নেই তাদের নিজ জমিতে ঘর নির্মাণ’ প্রকল্প থেকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে উপজেলা প্রশাসন সূত্রে।
নীলফামারীর জেলা প্রশাসক জাকীর হোসেন কিশোরগঞ্জকে ভিক্ষুকমুক্ত করার প্রচেষ্টা ব্যতিক্রমী ও সাহসী উদ্যোগ বলে উল্লে¬খ করেন। তিনি বলেন, ‘এ চ্যালেজিং প্রকল্পটি সবার সহযোগিতায় স্বল্প সময়ের মধ্যে সফলতা পেয়েছে। স্থানীয়ভাবে এ মহতী কাজটি যেন সবাই মিলে করি যাতে সারা দেশে ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ হয়।’ ভিক্ষুক পুনর্বাসনের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী ও তার কার্যালয়ের সুদৃষ্টি থাকায় অবশিষ্ট পুনর্বাসিতদের ঘর নির্মাণ করে দেয়া সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তিনি।
সাবেক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমানের উদ্যোগে ২০১৪ সালের ৫ জুলাই আনুষ্ঠানিকভাবে নীলফামারীর কিশোরগঞ্জকে ভিক্ষুকমুক্ত উপজেলা ঘোষণা করা হয়।