শুক্রবার সকালে কক্সবাজারের ইনানী সমুদ্র সৈকতে এক হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় একজন মারা গেছেন, আহত হয়েছেন চারজন। বাংলাদেশের বিবেচনায় এটি কোনো বড় সংবাদ নয়। দুর্ঘটনা আমাদের দেশের নিত্য সংবাদ। শুক্রবারেই দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় ১৭ জন মারা গেছেন। প্রতিটি মৃত্যুই বেদনার, প্রতিটি মানুষের জীবনই মূল্যবান। তবু কক্সবাজারের হেলিকপ্টার দুর্ঘটনার খবর মুহূর্তেই সারা দেশের মানুষের এবং গণমাধ্যমের নজর কাড়ে। কারণ যে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়েছে, তাতে চড়ে ইনানীর হোটেল রয়েল টিউলিপে যান বাংলাদেশের সেরা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান। একটি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়ে অংশ নিতে কক্সবাজার যান সাকিব। তাকে নামিয়ে দিয়ে হেলিকপ্টারটি পাখা বন্ধ হওয়ার আগেই নতুন যাত্রী নিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে সমুদ্র সৈকতেই বিধ্বস্ত হয় মেঘনা অ্যাভিয়েশনের হেলিকপ্টারটি। এই দুর্ঘটনার সাথে সাকিব আল হাসানের সম্পৃক্ততার কারণেই দ্রুত তা সব গণমাধ্যমের শীর্ষ সংবাদে পরিণত হয়।
দুর্ঘটনার খবর পাওয়ার পর ফেসবুকে আমি স্ট্যাটাস দিই ‘সাকিব আল হাসানকে কক্সবাজারের ইনানীর রয়েল টিউলিপে নামিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে বিধ্বস্ত হয়েছে তাকে নিয়ে যাওয়া হেলিকপ্টারটি। দুর্ঘটনায় একজন মারা গেছেন। যিনি মারা গেছেন, তার জন্য গভীর শোক। তবে ‘বাংলাদেশের জান, সাকিব আল হাসান’ সুস্থ ও নিরাপদ আছেন। সৃষ্টিকর্তার প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা।’এই স্ট্যাটাস দিয়ে আমি দারুণ কিছু মিশ্র প্রতিক্রিয়া পেয়েছি। অনেকেই আমাকে সাংবাদিকতা শেখানো শুরু করেন। অনেকে সাকিবকেও অনেক পরামর্শ দেন। এই লেখা পর্যন্ত ৪০ জন মন্তব্য করেছেন। কয়েকটি মন্তব্য তুলে দিচ্ছি।
* আপনার পোস্টে শোক প্রকাশ করার স্টাইল দেখে আপনাকে খুব স্থুল ব্রেনের লোক মনে হচ্ছে। জীবন সবার সমান, সাকিব এমন কেউ আসে নাই যে তার জীবনের থেকে অন্য একজনের জীবনকে ছোট চোখে দেখা হবে, ‘গভীর শোক’ এরকম কথা বলছেন, কি এমন গভীর শোক দেখালেন আপনি? ব্যক্তি জীবন আর প্রফেশনাল জীবনের মানে বোঝেন?’
* ‘সাকিব আল হাসান দেশের কাছে যতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ও জান। ঠিক মহরুম ব্যক্তিটিও তার পরিবারের কাছে তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার পরিবারের কলিজার টুকরা জান। মহুরমের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও পরিবারের প্রতি সমবেদনা।’
* ‘এইসব আলগা গভীর শোক দেখানো আর মৃত মানুষকে নিয়ে উপহাস করা একই কথা। সাকিবের জন্য দালালির সীমা আছে।’
* ‘সাকিব আল হাসান মানেই কি বাংলাদেশ? বাংলাদেশে এখনও কত মুক্তিযোদ্ধা রিকশা চালাচ্ছে, কত মানুষ অনাহারে মরছে, কত মানুষের অপমৃত্যু হচ্ছে; আমরা কয়জন আহ্ করি। আর সাকিব না মরতেই হইচই। বাঁচা মরার মালিক তো আল্লাহ। তাহলে এত কেন? হায়রে বাংলাদেশ? মনে হচ্ছে গরিবের জীবন কোন জীবনই না?
* ‘এখন সাকিবের দায়িত্ব হচ্ছে যিনি মারা গেছেন, তাহার পরিবারকে আর্থিক সাহায্য করা।’
* ‘শুনেছি সাকিব নাকি নিজের এলাকার লোকদেরই খবর নেয় না (সত্য-মিথ্যা জানি না)। কথা সত্য হলে তার কাছ থেকে বেশি কিছু আশা করা ভুল।’
* ‘কিছু কিছু পত্রিকায় যেভাবে ‘অল্পের জন্য বেঁচে গেলেন সাকিব’ টাইপের খবর ছড়াচ্ছে, মনে হচ্ছে সাকিবকে নিয়েই যেন কপ্টারটা বিধ্বস্ত হয়েছে। পাগলের দল সাকিব তো ওই সময় কপ্টারেই ছিল না। যারা আহত/নিহত হয়েছে তাদের নিয়ে ভাব, খবর প্রচার কর।’
এই সব মন্তব্য পড়ে ক্ষুব্ধ হয়ে ছড়াকার মাহবুবুল আলম কবির লিখেছেন ‘বিভিন্নজনের মন্তব্য পড়ে মনে হচ্ছে- হেলিকপ্টারটা যাওয়ার পথেই দুর্ঘটনা ঘটলে আর কথা উঠত না।’
ফেসবুক যে একটা গভীর বিনোদন প্রতিদিনই তা টের পাই। মানুষ যে কতটা মহান হতে পারেন, তাও টের পাই। মহান না হলে কারো পক্ষে সাকিব আল হাসান আর নাম না জানা একজন ব্যক্তিকে এক পাল্লায় মাপা সম্ভব নয়। পরে অবশ্য মারা যাওয়া ব্যক্তির নাম জানতে পেরেছি। তার নাম শাহ আলম। তিনি একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থার হিসাব রক্ষক। সেই বিজ্ঞাপনী সংস্থার একটি শুটিংয়ে অংশ নিতেই সাকিব কক্সবাজার গিয়েছেন। হতভাগা শাহ আলম সাকিব আল হাসানকে নামিয়ে দিতেই কক্সবাজার গিয়েছিলেন। এটা ঠিক প্রতিটি মানুষের জীবনই অমূল্য। কারণ বিজ্ঞান অনেক কিছু দিলেও কাউকে জীবন দিতে পারে না। তাই মানব জনমের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু নেই। কিন্তু তারপরও কারো কারো জীবন অন্য অনেকের জীবনের চেয়ে অনেক বেশি মূল্যবান। দুর্ঘটনাকবলিত হেলিকপ্টারে সাকিব আল হাসান ছিলেন না, তাও দেশের সব গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছেন তিনি। ‘অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন সাকিব’ এই ছিল অধিকাংশ শিরোনাম। আল্লাহ না করুক, সাকিব আল হাসানের কিছু হলে সব পত্রিকার ব্যানার হেডলাইন হতো। আর আমি মারা গেলে সেটা পত্রিকার ১০ এর পাতার সিঙ্গেল কলাম খবর হবে। এটাই স্বাভাবিক। এটাই সাংবাদিকতা। যিনি মারা গেছেন, তিনি অবশ্যই তার পরিবারের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সাকিব আল হাসান গোটা জাতির ১৬ কোটি মানুষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। সাকিব আল হাসান ক্রিকেট বিশ্বে আমাদের মাথা উঁচু করেন। সবার জীবনই মূল্যবান। কিন্তু সমান মূল্যবান নয়। কর্মই মানুষকে আলাদা করে। মহামানব ফেসবুকাররা যতই বলুন সাকিব আল হাসান আর শাহ আলমের জীবন সমান মূল্যবান নয়। সাংবাদিকরা মহান নয়। তারা গণমানুষের কৌতূহলই মেটাবে, অল্প কয়েকজন মহামানবের কথা ভেবে সাকিব আর শাহ আলমকে এক পাল্লায় মাপবে না। এই দুর্ঘটনার পর সবার প্রথম প্রশ্ন ছিল, সাকিব ঠিক আছেন তো। অবশ্যই সাকিব অল্পের জন্য রক্ষা পেয়েছেন। কারণ তাকে নামিয়ে সেই স্টার্টেই ঢাকার পথে আকাশে উড়েছিল। তার মানে দুর্ঘটনার কয়েক মিনিট আগেও সাকিব সেই হেলিকপ্টারে ছিলেন। যান্ত্রিক ত্রুটিটা কয়েক মিনিট আগেও হতে পারতো। শাহ আলম মারা গেছেন, তার পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েও বলতে হয়, সাকিব আল হাসান নিরাপদ আছেন, এটা জেনেই সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
নিশ্চয়ই হেলিকপ্টারটির কোম্পানির ইন্সুরেন্স করা ছিল। নিশ্চয়ই সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞাপনী সংস্থা তাদের কর্মী শাহ আলমের পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। সাকিব আল হাসানও শাহ আলমের পাশে দাঁড়াতেই পারেন। কিন্তু সব কাজ ফেলে সাকিব ছুটে আসবেন, এতটা আশা করা ঠিক নয়। আর শাহ আলমের মৃত্যুর জন্য তো সাকিব আল হাসানের কোনো দায় নেই। শাহ আলম অবশ্যই সাকিবের পূর্ব পরিচিত। আগে না হোক এক হেলিকপ্টারে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যেতে যেতে নিশ্চয়ই পরিচয় হয়েছে। তাই শাহ আলমের প্রতি সাকিব আল হাসানের মমতা নিশ্চয়ই মহান ফেসবুকারদের চেয়ে বেশিই হবে। সাকিব শাহ আলমের পরিবারের জন্য কী করবেন, সেটা তার ব্যাপার। ব্যক্তি সাকিবের কাছে আমাদের অত প্রত্যাশা নেই। আমাদের ১৬ কোটি মানুষের প্রত্যাশা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসানের কাছে।
শেষ পর্যন্ত সাকিব আল হাসান ভালো আছেন, সুস্থ আছেন; এটাই সবার স্বস্তি। কারো মৃত্যুর গুজব ছড়ালে নাকি তার হায়াত বাড়ে। সাকিব আল হাসান আরও অনেকদিন বেঁচে থাকুন। ব্যাটিং-বোলিংয়ে মাতিয়ে তুলুন মাঠ। আমরা বারবার স্লোগান তুলবো ‘বাংলাদেশের জান, সাকিব আল হাসান’।