চারদিকে এখন ছড়িয়ে পড়েছে বাবার দেশে ফিরে আসার কথা। আজ দশ দিনের মতো হলো তিনি ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রয়েছেন। এসব নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন কাগজে অনেক কিছু লেখালেখি হচ্ছে; জল্পনা-কল্পনা হচ্ছে। কেউ বলছেন লন্ডনে অসফল চিকিৎসার সমাপ্তিতে তিনি ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশে এসেছেন। কেউ আবার বলছেন তিনি চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন কোনো এক বিশেষ কারণে। বাবা ফিরবার দু-একদিনের মধ্যেই এরকম নানা ধরনের কথা শুনতে পাই তাঁকে নিয়ে। এসব কথা তাঁর পরিবারের লোক হিসেবে আমরাও জানি না। কিছু কিছু কথার উৎপত্তি কোত্থেকে আমরা সেগুলো জানি, তারপরও অনেক কিছু শোনা যায় যেগুলো বুঝতে হয় সাংবাদিকদের মন থেকে বানানো। অন্ধকারে ঢিল ছুড়লে যেমন অনেক সময় দু-একটি শট জায়গা মতো গিয়ে পড়ে, যেন সে কারণেই অনেকে অনেক কথা বলেন এক চিলতে সত্য খুঁজে পাওয়ার আশায়।
এই ধরনের কথাগুলো আমরা তেমন খুব একটা গায়ে লাগাই না। এখন তো এসব নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নয়। এখন আমাদের একটিমাত্র উদ্দেশ্য : বাবাকে কোনো মতে বাসায় নিয়ে এসে তাঁর জীবনে কিছুটা স্থায়িত্ব ফিরিয়ে আনা, মান ফিরিয়ে দেওয়া। দুই-এক জায়গা থেকে এমনও শোনা যায় যে, বাবাকে মাত্র আর কটি মাস বেঁচে থাকার আশা দেওয়া হয়েছে; যদিও ডাক্তাররা আমাদেরকে সরাসরি তেমন কিছুই বলেননি। বলবার প্রয়োজনও নেই। একটি টার্মিনাল রোগ বলতে কি বোঝায় তা আমরা সবাই পরিষ্কারভাবে জানি। কিন্তু এ কথা যদি সত্য হয়েই থাকে, তাহলে এখন আমাদের কর্তব্য হবে বাবা যতদিনই বেঁচে থাকেন না কেন আমাদের মাঝে, তিনি যেন সম্মানের সঙ্গে মাথা উঁচু করে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। এর চেয়ে বেশি আশা আমরা করতে চাই না। চাওয়াটি আমাদের পক্ষে অবাস্তব হবে। দেশের সন্তান দেশের মাটি থেকেই আজ হোক কাল হোক বিদায় নেবেন- এটি আমরা যেমন চাই, তিনিও মনেপ্রাণে চান। এখানে কোনো ব্যর্থতা কিংবা বাধ্য হওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
এই কদিনের মধ্যে অনেকেই আমার কাছ থেকে তথ্য চেয়েছেন, মন্তব্য চেয়েছেন বাবার শারীরিক অবস্থা নিয়ে। বিশেষ করে মিডিয়া থেকে নানা বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি কিন্তু বেশিরভাগই অপরিচিত। অপরিচিতদের সঙ্গে আলাপ করে খেয়াল করি, তাদের মধ্যে সত্যিকার অর্থে বাবার শুভাকাক্সক্ষী বলতে হাতেগোনা খুব কম। অনেকে চান বাবার অসুস্থতার বিস্তারিত ঘটনা নিয়ে শুধুমাত্র তাদের প্রকাশনার কাটতি বাড়াতে কিংবা তাদের চ্যানেলের প্রচার বাড়াতে। এই উদ্দেশ্য পূরণ করতে এমনও কিছু মানুষ আছেন যারা প্রস্তুত একজন গুরুতর অসুস্থ ব্যক্তিকে খুঁজে বের করে হাসপাতালের বিছানার ধারে ক্যামেরা ও মাইক নিয়ে হাজির হতে। যে জায়গায় ডাক্তারদের কড়া আদেশ রয়েছে পরিবারের সবচেয়ে কাছের কয়েকজন ছাড়া কেউ যেন কাছে না যায়। জনগণের আতঙ্কজনক কৌতূহল মেটানোর পেছনে ছুটতে গিয়ে যেন তারা তাদের মানবতাবোধ ভুলে যান। এটিই হলো প্রকৃত অর্থে জনজীবনের একটি বিশাল অভিশাপ। কিন্তু একবার জনগণের মঞ্চে প্রকাশ্যে পা ফেললে এসব সহ্য করতে হয় এবং এসব ঘটনায় বাবা অনেক দিন থেকেই অভ্যস্ত।
সত্যি কথা বলতে গেলে আমাদের দেশের সাংবাদিকরা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের সাংবাদিকদের থেকে খুব একটি ভিন্ন নন। লন্ডনে থাকাকালীন একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়, যিনি জার্নালিজম পড়েন এবং তাঁর কাছ থেকে জানা যায় যেন নতুন সাংবাদিকদের গোড়া থেকেই শেখানো হয় ভালো খবর কোনো খবর নয়। তাই ঝাঁকে ঝাঁকে এখন মিডিয়ার লোকেরা জানতে চাইবেন বাবা কেমন আছেন, খুঁজে বের করতে চাইবেন তাঁকে আমরা কোথায় লুকিয়ে রেখেছি। এগুলো খুবই স্বাভাবিক। তবে সব পত্রিকাই যে এখানে খারাপ, সে কথাটি বলা আমার ঠিক হবে না। আমার পরিচিতদের মধ্যে মিডিয়াতে জড়িত অনেকেই আছেন যারা উদগ্রীব হয়ে আছেন বাবার কোনো তথ্য জানার জন্য। অথচ তাঁরা আমাদের এই অত্যন্ত ব্যক্তিগত পারিবারিক পরিস্থিতির ভেতরে না বলে উঁকি দিতে অনিচ্ছুক। তাদের পত্রিকাগুলোর কাটতি নির্ভর করে না একটি বয়স্ক মানুষের প্রাকৃতিক সূত্রে রোগ ধরবার কারণে।
এ কথাগুলো বললে অনেক সাধারণীকরণ করতে হলো আমাকে শুধুমাত্র বৃহত্তর বাস্তবতাটিকে তুলে ধরার জন্য। আরেকদিকে কদিন পরপর দেখি কোনো না কোনো পত্রিকা বাবার উপলক্ষে একটি বিশেষ ইস্যু বের করেন, যেখানে তাঁরা তাঁর রোগমুক্ত হয়ে ওঠার শুভকামনা করেন, বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদানের কথা উল্লেখ করেন। শারীরিক দুর্বলতার কারণে এগুলোর মধ্যে খুব কম লেখা বাবা পড়তে পারেন। বড়জোর এক ঝলক প্রচ্ছদটি দেখে নেন। তবু আমি জানি যে তিনি এটুকুতেই খুশি হন। যে মানুষ সারাজীবন লিখে গেছেন জনগণের জন্য, তাদের কাছ থেকে যে কোনো বয়সে সেটির স্বীকৃতি পাওয়াটা তার কাছে অমূল্য। এগুলো সেই ক্ষুদ্র অথবা হলুদ সাংবাদিকতা নয়, যার বিরুদ্ধে আমার অভিযোগ আছে। এটি ফেসবুকে একটি হুইলচেয়ারে বসে থাকা অসহায় মানুষের ছবি ছেড়ে দিয়ে সামান্য ‘লাইক’ দিয়ে তাঁর জীবনের সম্পূর্ণ কাজকে স্বীকার করা নয় কিংবা তাঁকে অপছন্দ হলে সেখানে কোন স্থূল মন্তব্য করা নয়।
বাস্তব কথাটি হলো, আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ার মারফতে আমরা সবাই এক ধরনের জনজীবন যাপন করি। তার কারণে এই নব-মিডিয়া এবং ইন্টারনেটের দরুন সাংবাদিকতার মান কমে গেছে। মানবতা কমে গেছে মানুষেরই এবং তাই চারদিকে আজ এই ধরনের কথার ছড়াছড়ি। তবে এখানে নয়। একটি পরিবারকে ব্যক্তিগতভাবে শোক মেনে নিতে দিন, এটিই আমার কামনা। নিজেদের ক্ষেত্রে আপনারাও এটিই কামনা করবেন আশা করি।