রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রিয় জলি ম্যাডামের অনাকাঙ্ক্ষিত আত্মহত্যার ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সকল সুস্থ মানুষের সত্যিকার অর্থে ভীষণ মন খারাপ। উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচিতি ছিল, কিন্তু নাগরিক স্বার্থপরতায় সেই পরিচিতি নিত্যদিনের যোগাযোগের রূপ নেয়নি।
উনার বিরুদ্ধে ভয়াবহ মিথ্যা প্রচারণা ছিল। সেই মিথ্যা প্রচারণায় প্রচারকের ভুমিকায় নারী-পুরুষের সমান অংশগ্রহণ ছিল। দিব্যদৃষ্টি না থাকলেও, ব্যক্তিগত যথাসম্ভব দূরদৃষ্টি দিয়ে সেই কালো প্রচারণা আমি বিশ্বাস করতাম না। যদিও টিপিক্যাল পুরুষ হিসেবে সেই রসালো গপ্পো অবিশ্বাস করতে আমারও কষ্ট কম হয়নি।
আমি গ্রাম্য সরলতায় সেই গপ্পো উড়িয়ে দিয়েছি। ঢাকা-সাভারের নিত্য ব্যস্ততায় এসব প্রসঙ্গ আবার ভুলে গেছি। গ্রাম হলে একটা কথা ছিল; শহরে কে কার মনে, মগজে উঁকি দেয়! বিশেষ করে প্রগতিশীল বিশ্ববিদ্যালয় সমাজে ব্যষ্টিক ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করাও অনেকক্ষেত্রে প্রাইভেসি লঙ্ঘনের পর্যায়ে পড়ে।
গ্রাম্য সরলতায় দুই একবার জিজ্ঞেস করে বিব্রত যেমন হয়েছি, বিব্রত করেছিও। খুব আপন না হলে কারো ভালোমন্দ বেশি জিজ্ঞেস করি না। আমাদের একজন সহকর্মী যে নিজেকে ‘মেরে’ ফেললেন, তার দায় কার? তিনি নিজেকে হত্যা করেছেন? নাকি তাঁকে কে বা কাহারা ঠেলে দিয়েছে? দায় কি তাঁর স্বামীর? তাঁর বিভাগের? নাকি এই পুরো সমাজের?
আমার এক শিক্ষক লিখেছিলেন, দায় পুরো সমাজের। আমি স্বভাবসুলভ সরলতায় বলেছি, পুরো সমাজ কেন দায়ী হবে? সব পুরুষ কি পরকীয়া করে? সব পুরুষ কি তাঁর জীবনসঙ্গীকে গায়ের জোরে বা মনের জোরে নিয়ন্ত্রণ করে? সব পুরুষ কি অত্যাচারী?
উত্তর সবগুলোর বেলাতেই ‘না’ হবে নিশ্চিতভাবেই। তবে ‘অধিকাংশ’ পুরুষের বেলায় উত্তর হ্যাঁ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে নিশ্চিত বলা যাবে না। যদিও একজন পুরুষ হিসেবে আত্মসমালোচনাতে থাকাই ভালো।
আমরা অনেকেই জানি, কে বা কারা আমাদের একজন শিক্ষককে আত্মহত্যার মত একটি অপ্রত্যাশিত দুঃখজনক প্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দিলেন। অথচ, দুয়েকটি ব্যতিক্রম বাদে কোথাও এই পরোক্ষ কিন্তু নিশ্চিত হত্যাকারীদের কথা কেউ বলছে না। কোন কোন ঘটনায় জলি ম্যাডাম নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন? সেই ঘটনায় কে বা কারা জড়িত ছিলেন? এই প্রশ্ন কেউ তুলছে না!
অনেকে জলি ম্যাডামকে ‘যোদ্ধা’ আখ্যা দিচ্ছেন। অনেকে আবার বলছেন, তাঁর আত্মহত্যা করা ঠিক হয়নি, ইত্যাদি ইত্যাদি। ঘুরে ফিরে 'ভিকটিম‘কেই সাবজেক্ট বানানো হচ্ছে। প্রগতি’ বড় রহস্যময় ডিসকোর্স। প্রগতির এই রহস্যময়তার জন্য আমাদের ‘প্রগতিশীল’ শিক্ষকদের দায়ই বেশি। পুরুষ শিক্ষকদের কেউ কেউ আছেন, ছাত্রদের পাত্তা না দিয়ে ছাত্রীদের নিয়ে ব্যস্ত থাকাকে প্রগতিশীলতা মনে করেন।
কেউ মনে করেন, বিয়ে না করে বহুগামিতা চর্চা করলে সেটা প্রগতিশীলতা (নারী- পুরুষ উভয়ের দিক থেকে); কেউ মনে করেন ‘বিবাহ’ নামের প্রতিষ্ঠান ভেঙে দিলে সমাজ ‘প্রগতিশীল’ হবে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ব্যাচের এক ছাত্রীর একটা লেখা পড়লাম। তিনি লিখেছেন, অত্যন্ত ‘প্রগতিশীল’ একজন ‘পুরুষ’ শিক্ষক মদ্যপ অবস্থায় পরীক্ষার হলে ঢুকে ‘প্রগতি’ প্রদর্শন করতে গিয়ে পরীক্ষার্থী ছাত্রীর কাঁধে ‘চুমু’ খেয়েছিলেন। হতভম্ব ছাত্রী বিচার চেয়ে উল্টো বিভাগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন।
এই ‘প্রগতিশীল’ কাজে সেই পুরুষ শিক্ষককে মদদ করেছিলেন তারই সহকর্মী এক ‘নারী’ শিক্ষক। এখানে প্রগতি কোথায়? একটি অফিস, প্রতিষ্ঠান বা বিভাগের একজন শিক্ষক কী রকম পরিবেশে থাকলে বা কাজ করলে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন!
এর আগে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার একজন শিক্ষক আত্মহত্যা করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আনিস স্যারও পাগল হয়ে বিভাগ থেকে বের হয়ে কুমিল্লায় গিয়ে কৃষিকাজকে বেছে নিয়েছিলেন। এসবের কারণ কী? যোগাযোগের বিভাগে এই যোগাযোগ বৈকল্য কেন? এই যোগাযোগ বৈকল্য কে বা কারা সৃষ্টি করে, সেটা বের করার কোন চেষ্টা শিক্ষিত সমাজে দেখি না।
পুলিশি তদন্ত দূরের কথা, মনোবৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান পর্যন্ত হয় না। অনুসন্ধান করা জরুরি। কারণ, এই ডিরেইল্ড সহকর্মীরা খুব বিপজ্জনক। মানসিক, শারীরিক এবং পারিবারিকভাবে সুস্থমানুষই কেবল ভালো শিক্ষক হতে পারে।