চল্লিশের দশকের শেষভাগে এসে চার্লি চ্যাপলিন ‘মঁসিয়ে ভের্দু’ (Monsieur Verdoux) তৈরি করলেন। এটা ছিল চ্যাপলিনের আটাত্তরতম ছবি। ১২ রিলের এই ছবির দৈর্ঘ্য ১১১৩২ ফিট। সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন আঙ্গিক, ভিন্ন অভিনয়ের ছবি ‘মঁসিয়ে ভের্দু’। আর এক চ্যাপলিন এলেন। অভিনব চ্যাপলিন, বিতর্কিত চ্যাপলিন। আক্রান্ত বলিষ্ঠ, নির্ভীক অন্য এক চ্যাপলিন। ১৯৪৭ সালের ১১ এপ্রিল নিউইয়র্ক শহরের ব্রডওয়ে থিয়েটারে ছবিটির প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকার রাষ্ট্র ও সমাজে অনেক পরিবর্তন দ্রুত ঘটেছে। একচেটিয়া পুঁজিবাদ আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের রূপ দিয়েছে। পুরনো সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো পতনের পথে। নয়া উপনিবেশবাদের প্রবক্তারূপে আমেরিকার আবির্ভাব। গোটা আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। রুজভেল্টীয় গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়েছে। সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের সঙ্গে বিরোধিতাই আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির লক্ষ্য। এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার জাতীয়তাবাদী ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ধারা রুদ্ধ করার দায়িত্ব এসে পড়ল আমেরিকার ধনতন্ত্রবাদের উপর এবং সাম্যবাদী শিবিরের সঙ্গে ঠা-া যুদ্ধ শুরু হলো। বার্লিন সংকট থেকে কোরিয়ার যুদ্ধ পর্যন্ত এই ঠা-া লড়াইয়ের যুগ প্রসারিত হলো ও আমেরিকার কমিউনিজম বিরোধিতা ‘ট্রুম্যাননীতির’ মাধ্যমে দেশে দেশে প্রযুক্ত হলো। কিন্তু এর সঙ্গে তাল রেখে দেশেও প্রতিক্রিয়া শুরু হলো। হলিউডের শিল্পীরা এই রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়ার অন্যতম প্রধান বলি হলেন। একদিকে হলিউডি শিল্পে যুদ্ধের বাজারের পরই মূলধনের একচেটিয়া কর্তৃত্ব দৃঢ় সুপ্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল। কিন্তু চল্লিশের দশকে হলিউডে শ্রমিক আন্দোলন দানা বাঁধছে। ওয়ার্নার ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে হলিউডের কলাকুশলীরা ধর্মঘট করছেন। এর আগে হলিউড কলাকুশলীদের সংগঠন বৃত্তি ও পেশা অনুযায়ী সংগঠিত হতো। রঙের মিস্ত্রি বা কাঠের মিস্ত্রিরা তাদের পেশার লোকদের নিয়ে আলাদাভাবে সংগঠন করতেন। এখন এরা একত্রিত হয়ে সামগ্রিকভাবে একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তার নাম ‘কনফারেন্স অফ স্টুডিও ইউনিয়ন’ (Conference of Studio Union A_ev SU)। এদের নেতার নাম ছিল রয় ব্রুয়ার। ১৯৪৫-৪৭ সালজুড়ে এই আন্দোলন অব্যাহত ছিল। আন্দোলনের মূল দাবি ছিল সম্মিলিত ইউনিয়নটিকে আইনসংগত স্বীকৃতি দেওয়া। মালিকরা অবশ্য ব্রুয়ারের ইউনিয়ন ছাড়া কাউকে স্বীকৃতি দিতে চায়নি। এদের জমায়েত ও অবস্থানের পর গু-ারা হাঙ্গামা করে এবং পরে পুলিশও পাঠানো হয়। গোটা আন্দোলনকে কমিউনিস্ট চক্রান্তের ফল হিসেবে দেখানো হয় এবং তারপরই হলিউডে রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন জোরদার হয়। এই প্রথম হলিউডে কারিগরদের আন্দোলন তীব্র সংগ্রামী রূপ নিল এবং স্ক্রিন রাইটার গিল্ড এই আন্দোলনকে মদত দিতে এগিয়ে এলো। সব হলিউডে এই আমেরিকাবিরোধী কার্যকলাপের আওতায় চ্যাপলিনও পড়েছিলেন। তিনি অবশ্য সরাসরিভাবে শ্রমিক আন্দোলনে যোগ দেননি বা হলিউডের অবাঞ্ছিত দশজনের স্বপক্ষে কোনো বিবৃতিও দেননি। শুধু আলভা বেসিকে তিনি গোপনে অর্থসাহায্য করেছিলেন। কিন্তু তার ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদী গণতন্ত্রের ধারণা ও একচেটিয়া পুঁজিবাদের বিরোধিতা প্রথম থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল ও উগ্র জাতীয়তাবাদীদের আক্রমণের লক্ষ্য হয়। প্রথমেই তাকে যৌন অপরাধমূলক মামলায় জড়ান হলো এবং নৈতিকতার দায়ে তাকে অভিযুক্ত করা হলো। এই মামলায় তাকে ‘কামুক, লম্পট কুত্তা’ বলা হলো এবং তিনি অবাঞ্ছিত পিতৃত্বের দায় এড়াচ্ছেন বলে অভিযোগ করা হলো। এই মামলা থেকে রেহাই পেলেও রাজনৈতিকভাবে তাকে আমেরিকার গণতান্ত্রিক আদর্শের শত্রু বলে তীব্র প্রচার চালানো হলো। চ্যাপলিনকে কমিটির সামনে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ডাকা হলো। তিনি নিজেকে কমিউনিস্টের পরিবর্তে শান্তিপ্রয়াসী বলে ঘোষণা করলেন এবং শেষ মুহূর্তে তাকে সাক্ষ্য দেওয়ার হাত থেকে রেহাই দেওয়া হলো। কিন্তু তার বিরুদ্ধে প্রচার চলতেই থাকল। হলিউড তথা আমেরিকা থেকে সরকার হ্যান আইসলারকে বহিষ্কার করার প্রতিবাদে চার্লি বিশ্বব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলেন। তিনি পাবলো পিকাসোকে এই প্রসঙ্গে চিঠি লিখলেন। ট্রুম্যানের বিপক্ষে গণতান্ত্রিক প্রার্থী হেনরি ওয়ালেসের স্বপক্ষে একটি জনসভায় চার্লির ভাষণ দেওয়ায় অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিল। তিনি ট্রুম্যানের সোভিয়েতবিরোধী নীতির প্রতিবাদস্বরূপ ওয়ালসকে সমর্থন করেন। ফলে তার বিরুদ্ধে রক্ষণশীল মতামত উত্তাল হয়ে উঠল। তার নৈতিকতা ও নাগরিকত্বের কথা নিয়ে প্রশ্ন উঠল। বিদেশি, ইহুদি, কমিউনিস্ট ইত্যাদি বলে ওয়েস্টব্রুগ পেগলার হাস্টের পত্রিকায় নানা সম্পাদকীয় লিখতে লাগলেন। সেনেটে হ্যারি কেইন চ্যাপলিনের আমেরিকায় বসবাস সম্পর্কে প্রশ্ন তুললেন এবং এই জাতীয় অভিযোগ উঠতেই লাগল। ৩০ সেপ্টেম্বর ১৯৫২ সালে সরকারি তরফ থেকে অ্যাটর্নি জেনারেল ম্যাকগ্রানারি চার্লিকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও আমেরিকাবিরোধী বলে ঘোষণা করেন এবং কৃতঘœতার অভিযোগ আনেন। চার্লি এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে কোনো সুস্পষ্ট রাজনীতি বা সংগঠনের সঙ্গে যোগ করছেন না। কিন্তু গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের স্বপক্ষে তিনি। একচেটিয়া পুঁজি ও সাংগঠনিক মানুষের বিকাশের বিরুদ্ধে তার লড়াই অন্তহীন ও আন্তরিক। ফলে শিল্পেও তার প্রতিক্রিয়া হলো তীব্রতর। আক্রমণ হলো সরাসরি, শ্রেণি ও সমাজ ব্যবস্থাকে তিনি চিহ্নিত করলেন সুস্পষ্টভাবে। যে ব্যবস্থায় আমেরিকায় জঙ্গি জাতীয়তাবাদ মাথা তুলে দাঁড়ায়, মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা থাকে না তার বিরুদ্ধে আক্রোশ প্রকাশ পেল ক্রুদ্ধ ও তীব্র রঙ্গে— I am not a super patriot. I think, super patriotism leads to Hitlerism and we have had our lesson from that. I assume that in a democracy one has at least right to have a public opinion.