মেজর জেনারেল এ কে মোহাম্মাদ আলী শিকদার পিএসসি (অব.)
২৭ অক্টোবর ২০১২, শনিবার। সপ্তাহ তিনেক হলো কানাডার ছোট, তবে মনোরম শহর সাসকাটুনে আছি। গত রাতে আমার মেয়ে ঈশিতার একজন ঘনিষ্ঠ বাঙালির বাসায় দাওয়াত খেয়ে আসার পর ঘুমাতে ঘুমাতে রাত প্রায় ১টা বেজে যায়। সকাল ১০টায় বিছানা থেকে উঠে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি উজ্জ্বল রোদ সাদা বরফের ওপর চিকচিক করছে। ফাহিমকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম তাপমাত্রা ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। মাইনাস সাত, এখানে বসবাসকারীদের জন্য ডালভাতের মতো স্বাভাবিক। এ কয়েক দিনের অভ্যাসে আমার কাছেও এখন মাইনাস ৭ ডিগ্রিকে তেমন ভয়াবহ মনে হয় না। যদিও বাংলাদেশে প্লাস ১০ ডিগ্রিতে তাপমাত্রা নেমে এলে প্রচ- কাঁপন ধরে যায়। এখানে এই আরেকটি সুবিধা, মোবাইল ফোনের অনলাইনে গেলে চলতি তাপমাত্রা দেখা যাবে, আগামী কয়েকদিনের পূর্বাভাসও পাওয়া যাবে।
ঈশিতা ইউনিভার্সিটি থেকে আজ দুপুরের আগেই ফিরে এলো। ফাহিমও বাইরে কোথাও গিয়েছিল এর মধ্যেই চলে এসেছে। ঈশিতা জানাল আজ দুপুরের খাবার বাইরে হবে, অর্থাৎ কোনো রেস্টুরেন্টে। আমরা প্রস্তুত হয়ে নিলাম। ঈশিতা আমাকে সাবধান বাণী শুনিয়ে গেল এই বলে যে, বাইরে রোদ হলেও বাতাস থাকার কারণে বেশ ঠা-া। আমি যেন গরম কাপড় সেভাবে পরে নিই। ৮ নম্বর স্ট্রিটের মলগুলোর পাশেই দুই-তিনটি ছোট ছোট রেস্টুরেন্ট। তার একটির নাম ‘ভিয়েতনামিজ রেস্টুরেন্ট’। গাড়ি পার্কিংয়ে রেখে আমরা ভিয়েতনামিজ রেস্টুরেন্টই ঢুকলাম। মেইন গেট দিয়ে প্রবেশের মুখেই একটা ছোট খালি স্পেস। এখানে দাঁড়িয়ে বাইরের ঠা-ার জন্য অতিরিক্ত কাপড়, জ্যাকেট ও মাথার টুপি খুলে, চুল ঠিক করে পরবর্তী দরজা দিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে গেলাম। ৮-১০টি টেবিল হবে মোট, প্রতিটি টেবিলের দুই পাশে চারটি করে চেয়ার। নিয়ম হলো প্রবেশ করেই নিজের ইচ্ছামতো টেবিলে গিয়ে বসা যাবে না। আমরা প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটি ভিয়েতনামী মেয়ে এসে জেনে নিল আমরা মোট কতজন লাঞ্চ করব। আবার একটু পরে এসেই আমাদেরকে একটা টেবিলে বসাল এবং চারজনের জন্য চারটি মেনু কার্ডই নিল। আমরা খাবারের অর্ডার দিলাম। খাবার আসতে একটু সময় লাগবে জানিয়ে দিল সার্ভিস প্রদানকারী মেয়েটি। কাউন্টারের টাকা পয়সার হিসাব, বিল তৈরি করা, খাবার পরিবেশন এবং খাবার শেষ হলে টেবিল পরিষ্কার, সবকিছুই সামলাচ্ছে মাত্র দুটি মেয়ে। দুজনই ভিয়েতনামী। আমাদের দেশে এমন একটা ব্যস্ত রেস্টুরেন্টে কমপক্ষে চার থেকে পাঁচজন লোক কাজ করত। করিৎকর্মা ও চটপটে দুটি ভিয়েতনামী মেয়ের কর্মদক্ষতা ও প্রশান্তমনে সব সময় হাসিমাখা মুখে যেভাবে কাস্টমারদের সার্ভিস দিয়ে যাচ্ছে, তা দেখে ভিয়েতনামের সাম্প্রতিক উন্নয়নের কথা মনে হলো। যে দেশের ছেলেমেয়েরা এভাবে পরিশ্রম করতে পারে তাদের উন্নতি না হয়ে পারে না। প্রায় ১১ বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ১৯৭৫ সালে স্বাধীন হয় ভিয়েতনাম। আমাদেরও পাঁচ বছর পর। ভিয়েতনাম এখন আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। ১৯৯২-৯৩ সালে কম্বোডিয়াতে আমি যখন জাতিসংঘের শান্তি মিশনে ছিলাম, তখন ভিয়েতনামের রাজপরিবারের একজন রাজকুমারীর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। পরিচয়ের সূত্র হলো, কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে ওই রাজকুমারীর একটি বাড়ি জাতিসংঘ ভাড়া নিয়েছিল যেখানে পুরো বাড়িটিই দেওয়া হয়েছিল জাতিসংঘের মিলিটারি পুলিশের অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য। আমি ছিলাম মিলিটারি পুলিশের প্রধান। আমার পদবী ছিল ফোর্স প্রভোস্ট মার্শাল। জাতিসংঘের সব সমারিক ও বেসামরিক সদস্যদের শৃঙ্খলা দেখভালের দায়িত্ব ছিল মিলিটারি পুলিশের। কম্বোডিয়ায় আমি ছিলাম প্রায় এক বছর। জাতিসংঘের পক্ষে ওই রাজকুমারীর বাড়িটি ভাড়া নেওয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা ছিল আমার। কারণ বাড়িটি আমার অফিসের জন্য উপযুক্তÑ এই সনদ না দিলে জাতিসংঘ তার বাড়িটি ওই সময়ে ভাড়া নিত না। তাছাড়া জাতিসংঘ ভাড়া না নিলে ওই বাড়ি অত বড় আকারের ডলারে ভাড়া হতো না। যার কারণে ভদ্রমহিলা বেশ কয়েকবার আমার অফিসে এসে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। শুধু তাই নয় দুই-তিনবার আমাকে ও আমার অফিসারদের ডিনার খাইয়েছেন। ভদ্রমহিলা উচ্চশিক্ষিত। ভিয়েতনামে এখন তাঁদের রাজত্ব নেই। পরিবার পরিজন নিয়ে স্থায়ীভাবে ফ্রান্সের প্যারিসে বসবাস করেন। গত শতকের আশির দশকের শেষের দিকে কমিউনিস্ট খেমাররুজ শাসকের উৎখাত করে ভিয়েতনামের সমর্থিত সরকার কম্বোডিয়া ক্ষমতা দখল করে। ওই সময়ে অনেক ভিয়েতনামের লোক এসে কম্বোডিয়ায় জায়গা-জমি ও বাড়িঘর কিনেছিল। এই রাজকুমারীও ওই সময়ে বাড়িটি কিনেছিলেন। যতবার তাঁর সঙ্গে কথা হয়েছে ততবারই তাঁর অত্যন্ত উঁচুমানের রুচির পরিচয় পেয়েছি। একই সঙ্গে তাঁর জ্ঞানের পরিধি দেখেও বিস্মিত হয়েছি। মুগ্ধ হয়ে ভিয়েতনামের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও মানুষের গল্প শুনেছি। ভিয়েতনামের রাজ পরিবারের ভালোমন্দ সব দিক অকপটে বলেছেন, গল্পের মতো করে। ফ্রান্সের দখলে বা ঔপনিবেশিক আমলে ভিয়েতনামের মানুষ কেমন ছিল তার বর্ণনা যেমন করেছেন, তেমনি ১৯৫৪ সালে বিশ্বখ্যাত ‘ডিয়েন বিয়েন ফু’ যুদ্ধে ফ্রান্স বাহিনীর শোচনীয় পরাজয়ের কাহিনি শুনিয়েছেন। পুরো ষাটের দশক ও সত্তরের দশকের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বিচার বোমাবর্ষণে কত মানুষ যে অঙ্গহানির শিকার হয়েছে তার করুণ ও হৃদয় বিদারক বিবরণ দিয়েছেন একজন দক্ষ সাহিত্যিকের মতো। তন্ময় হয়ে সব শুনেছি।
আমি তাঁকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেছি। পাকিস্তান দখলদার বাহিনী কি নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে বাংলাদেশে সে কথা বর্ণনা করেছি। তাঁর কাছে আমি অন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় খুব আগ্রহসহকারে জানতে চেয়েছিলাম। তা হলো ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যে সব ভিয়েতনামী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে তাঁদেরকে তাঁরা কিভাবে হ্যান্ডল করেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর। রাজকুমারী আবার গল্পের ঝুড়ি খুললেন, বড় রাজনৈতিক নেতা যারা দখলদার বাহিনীর সঙ্গে সহযোগিতা করেছিলেন তাঁদের প্রায় সবাই দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পালিয়ে আমেরিকা বা ফ্রান্সে চলে যান। স্বাধীন ভিয়েতনাম সরকার তাঁদের নাগরিকত্ব বাতিল করেছে স্থায়ীভাবে। স্বাধীন ভিয়েতনামে তারা আর ফিরে আসেননি। আর কিছু লোক দেশের ভেতরে ছিল তাদেরও নাগরিকত্ব বাতিল করে দেওয়া হয় এবং তাদের জীবদ্দশায় তারা আর কখনো নাগরিকত্ব ফিরে পাবে না। যারা দখলদার বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় ক্রিমিনাল অপরাধ করেছিল তাঁদের বিচার হয়েছে দ্রুত আদালতের মাধ্যমে। তবে বাংলাদেশের মতো রাজাকার, আলবদর বাহিনী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনামে গঠন করেনি। ভিয়েতনামের রাজকুমারীর সঙ্গে আমার এই আলাপচারিতা হয় ১৯৯২-৯৩ সালে। আজ প্রায় ২০ বছর পর যখন ভিয়েতনামের উন্নয়নের গতি ও মাত্রার দিকে তাকাই তখন আফসোস হয়। প্রায় ১১ বছরের দীর্ঘ যুদ্ধ এবং আমাদের থেকে ৪ বছর পরে স্বাধীন হয়ে তারা আজ আমাদের থেকে অনেক এগিয়ে। আজ সুদূর কানাডার একটি ভিয়েতনামী রেস্টুরেন্টে বসে ভিয়েতনামের উন্নতির কথা ভাবতে ভাবতে ২০ বছর আগে কম্বোডিয়ার নমপেনের এক রেস্টুরেন্টে বসে ওই রাজকুমারীর একটি কথা আমার মনে পড়ছে। রাজকুমারী বলেছিলেনÑ ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় তোমাদের দেশীয় লোক, যারা তোমাদের শত্রুদের সঙ্গে কলাবরেটর হিসেবে (রাজাকার/আলবদর) কাজ করেছে তাদেরকে তোমরা নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিয়ে এবং পুনরায় রাজনীতি করার সুযোগ দিয়ে দারুণ ভুল করেছ। তারা কোনোদিন তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের দর্শন বাস্তবায়ন হতে দিবে না। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধী নিজামী-মুজাহিদের মন্ত্রী হওয়া এবং বিএনপির কাঁধে চড়ে মুক্তিযুদ্ধের সব চেতনাকে ধ্বংস করার জন্য তাদের উঠেপড়ে লাগা দেখে মনে হয়েছে সেদিন রাজকুমারী কতই না সঠিক কথা বলেছিলেন। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই গরম স্যুপ, সবজি, রাইস নিয়ে হাজির হলো ভিয়েতনামী সার্ভিস গার্ল।
‘সব কিছু ছিক আছে?’ স্মিত হাসিমাখা মুখে জানতে চাইল সে। ‘ধন্যবাদ, সব কিছু ঠিক আছে’ জানাল ঈশিতা। প্রথম দেখাতেই খাবারগুলো খুব আকর্ষণীয় মনে হলো। খেতে খেতে মনে হলো রেস্টুরেন্টের সার্ভিস গার্লদের আন্তরিকতা শুধু লিপ সার্ভিস নয়, প্রকৃতপক্ষে খাবারের প্রতিটি আইটেমে তার প্রতিফলন আছে। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর তো কোনো কথা নেই। খাবারের স্বাদও আমাদের কাছে তেলে-ঝালে বাঙালি খাবারের মতোই মনে হলো। চাটনী এবং মরিচের আচার জাতীয় একটা রুচিবর্ধক আলাদাভাবে দিয়েছে। প্রথমে আমি ওগুলো নিতে চাইনি। ‘বাপি একবার নিয়ে দেখো’ বলল ঈশিতা। মেয়ের কথা না রাখলে পরে পস্তাতে হবে, তাই মরিচের আচার জাতীয় জিনিসটা এক চামচ নিই। খেয়ে দেখি সত্যিইÑখাবারে স্বাদ যেন দ্বিগুণ হয়ে গেল। আরও খানিকটা নিলাম। তৃপ্তিসহকারে খাওয়া শেষ হলো। বাসায় ফিরে এলাম প্রায় বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে।