বিরল থেকে বহু পুবে নিরাকমাখা গ্রাম রাজারামপুর। কার্তিকের সবুজ পোক্ত ধান মাসান্তে সোনালি হয়ে মাঠে মাঠে নুয়ে আছে। গেরুয়া আবাদ ভিড় করে দাঁড়িয়ে পড়েছে পাথার থেকে পাথারে। এ অঞ্চলের আদিবাসীরা ধানকাটার দিনকে নবান্ন বলে না, বলে নবান। আকাশ সংস্কৃতির সুলভ বিনোদনের সুবাদে নবান্নের মতো লোকজউৎসবও তেমন আর আমল পায় না। শহুরেরা স্টেজ বানিয়ে নগুরে কায়দায় নবান্ন উৎসব করে বটে কিন্তু তাতে প্রাণ থাকে না। অথচ এক যুগ আগেও গাঁওগ্রামে ধানকাটার মৌসুম এলে নবানের হিড়িক পড়ে যেত। নতুন ধানের উদ্বোধনে ধুম লাগত লোকজীবনে। আত্মীয়স্বজনের পারস্পরিক নিমন্ত্রণে কদর পেত পিঠা, পায়েস, চিঁড়া, মুড়ি। গাঁয়ের ছেলেমেয়েরা সদ্য ধানকাটা জমিতে চড়–ইভাতি করত।
দৃশ্যগুলো দ্রুত বদলে গেল। কালের হাওয়ায় গ্রামজীবনেও এখন পাল্টা ¯্রােত বইতে শুরু করেছে। অজ পাড়াগাঁতে পিঠাপুলির স্বাদ যেন ক্রমেই পানসে হয়ে আসছে। এখন শরবতের পরিবর্তে কোকাকোলা দেওয়া হয়। চা-বিস্কুট-চানাচুরের সঙ্গে কোন কোন বাড়িতে সম্ভব হলে ফাস্টফুডের ব্যবস্থা হয়ে থাকে। পরিবর্তনের শেষপাদে এসে একমাত্র আদিবাসীরাই জিইয়ে রেখেছে নবানের উৎসব। নবান তাদের জীবনে এখনো আনন্দের এক অনবদ্য আয়োজন। নবান দেখতে তাই ছুটে চলেছি আদিবাসীদের গ্রাম রাজারামপুরে।
বিরল থেকে পীচপথে মাইল আষ্টেক যাওয়ার পর হাতের ডানে মেঠোপথ। যতই গ্রামাঞ্চলে এগুচ্ছি ততই মায়াময় নিবিড়তা। একসময় পীচ ছেড়ে আমরা মেঠোপথে নেমে যাই। ঘন তুতগাছে ছাওয়া সুড়ঙ্গপথ। ছায়াবনে একেবেঁকে চলার পর ঘাসপথ। দুপাশে মনমাতানো ধানপাথার উথালিপাথালি করতে করতে অন্যগ্রামে গিয়ে ঠেকেছে। সবুজমাঠ আর আবাদি অঞ্চলের অলি বেয়ে আমরা আরো ছুটতে থাকি। তারপর দু-একটা করে সাইকেলসমেত বালিকার দেখা মেলে। এ রকম হদ্দগ্রামে এসে আশ্চর্য না হয়ে উপায় নেই। খোদ শহরে এ রকম দৃশ্য একদাগে সহ্য করা না গেলেও এখানে দৃশ্যটা মানানসই সাদামাটা। বালিকারা অবলীলায় সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরছে। বালিকাদের লাইন চলে গেলে পাউডার-মাখা এক রমণী আঁচল টেনে পেডেল মেরে আমাদেরকে অতিক্রম করে যায়। সেদিক থেকে চোখ রাখতে গিয়ে খানাখন্দকের কবলে পড়তে হলো। অতঃপর গর্ত বাঁচিয়ে তালমাতালে এগিয়ে গিয়ে দ্বিতীয় তুতবনের সবুজনলে ঢুকে যাই। সাইকেল-বালিকাদের ছবিগুলো ততক্ষণে মাথার ভেতর এলোমেলো হয়ে একসময় ঢেউয়ে ঢেউয়ে মিলিয়ে যায়। এ রকম একটানা তুতনলে চোখে ঘোর লাগে। চারদিকের কিছুই দেখা যায় না। পথের কিনার ধরে ধানিজমি গেরুয়া থেকে বাদামি হয়ে একসময় সুদূরে গিয়ে ঘন হয়ে আছে। ঢোলের আওয়াজ কানে লাগে। ক্রমেই দমাদম শব্দে দেখা মেলে মানুষের জটলা। পাথারের মধ্যে ছনকালী প্রাইমারি স্কুল। স্কুলের লাগোয়া দুটো ঝাপতোলা দোকান নিয়ে ঝুপড়িবাজার। স্কুলের খোলামাঠের সঙ্গে আবাদি-জমি জুড়ে উৎসব। আদিবাসী নারী-পুরুষেরা দুই লাইনে ঢোল করতল হারমনি নিয়ে গান ধরেছে :
আটোল পাতে গিলেই হামার লাতি
টেংরা মাছের ঝোল লেলায় রাতি।
রবিন মাড্ডি, স্বপন হেমরম গলায় ঢোল ঝুলিয়ে মাদলের সুরে দমাদম আওয়াজ তুলছে। বাজনা বুঝে আদিবাসী নারীরা পায়ে পায়ে নাচন তোলে। জনা পঞ্চাশেক আদিবাসীর সঙ্গে পুরো গ্রামবাসী তখন গানে গানে দুলে ওঠে। ভিড়ের মধ্যে টুডু মুরমু কেবল নিজমনে হারমনি বাজিয়ে চলে। নাচুনে এই মহিলাদের সাজগোজ দেখার মতো। তাঁরা লাল শাড়ি পরেছে এবং খোঁপায় জবাফুল গুঁজে রেখেছে। পুরুষরাও কম নয়। তাঁদের শার্টও মেয়েদের মতো লাল এবং একই কায়দায় মাথায় গামছা পেঁচিয়ে জবার জায়গায় পাখির পালক লাগানো আছে। শত শত গ্রাম্য নারী-পুরুষ ঢেউয়ে ঢেউয়ে একযোগে হৈ দিয়ে উঠছে। গান-বাজনা করতে করতেই তাঁরা একসময় ধানমাঠের দিকে এগিয়ে গেলে কুন্ড কিস্কু আলাদা উড়াল তোলে :
কুলি জাগো, আখড়া জাগো
জাগো রাজবংশী রাজ হো
চিরিবিটি চিরিবিটি পারবতী লো
কুলি জাগো আখড়া জাগো হো।
একসময় ধানকাটা শুরু করে তাঁরা। দুটো দল মাথায় মাথাল পরে নেয়। তারপর জমি ভাগ করে কাঁচি হাতে মাঠে নামে এবং গোগ্রাসে ধানকাটা শুরু করে। জমির চারপাশে শত শত নারী-পুরুষ ভিড় করে মজমা দেখে। গানে গানে চলতে থাকে ধানকাটা প্রতিযোগিতা। অভাব-অনটন আর আর্থ-সামাজিক টানাপোড়নে ক্রমেই কমে যাচ্ছে আদিবাসীদের জনগোষ্ঠী। পুরোপুরি খেটেল বলে নারী-পুরুষ সমান তালে খেটে এক সময় মাঠ আর মাটিতেই তাদের জীবিকা মিলত। যুগের হাওয়ার মহাজনরা যখন জমিদারি ছেড়ে দিল তখনো কিছুকাল বাপ-দাদার কর্ম ধরে ওরা মাটিতেই ছিল। কিন্তু আবাদি-মাটি ভাগে ভাগে চলে গেলে পরের জমিতে জোনখাটারও কায়দা থাকে না। আশ্বিন, কার্তিক ও অগ্রহায়ণ-তিন মাস কাজ থাকে না। আগে জমিতে আগাছা হতো, তখন আগাছা সাফ করে মজুরি মিলত। রাসায়নিক সার ব্যবহারের কারণে এখন আর আগাছা জন্মে না, ফলে কাজ থাকে না। অনেকটা অর্ধাহারেই বয়ে চলে তাদের জীবন।
আদিবাসীদের নবানের আনন্দ-দৃশ্য দেখতে দেখতে মন সাতক্ষীরার পরানদহের কথা মনে পড়ে। গত পয়লা অগ্রহায়ণে সেখানে গিয়েছিলাম। পয়লা অগ্রহায়ণ পরানদহের জন্য রঙিন একটা দিন ছিল। সকাল থেকেই গ্রামের কিষাণ-কিষাণীরা জড়ো হচ্ছিল পুবের পাথারে। সেখানে ধানক্ষেতের মধ্যে খানিক জায়গা ফাঁকা করে সামিয়ানা খাটানো হয়েছে। খুঁটির সঙ্গে মাইকের চোঙ টাঙ্গিয়ে সামিয়ানার নিচে কাঠের চেয়ার-টেবিল পেতে গান চলছে। আখতারুজ্জামান বয়াতি মাউথপিস হাতে নেচে নেচে গাইছে :
ও বাংলার কিষাণ ভাই
চলো আমরা ধান কাটিতে যাই।
নতুন ধানের চিঁড়া মুড়ি
ভালোবাসে বুড়াবুড়ি।।
নিজের বাঁধানো গানে আখতার সুর তুলে হেলেদুলে গান করেন। তিনিই দলের ওস্তাদ। গানের কলি ধরে সে খানিক এগিয়ে নিয়ে যায় তারপর লম্বা একটা টান দিয়ে ছেড়ে দেয়। সহগায়েনরা তখন সেই কলির দ্যোতনা তুলে কোরাসে গলা মেলায়। কোরাসের জনেরা গলামেলানোর পাশাপাশি সামিয়ানার তলে টেবিলে রাখা তবলা, হারমনি, বাঁশি একটানা বাজিয়ে চলে। তাদের মুখের কাছে স্ট্যান্ডে করে মাইক্রোফোন লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাত দিয়ে তালযন্ত্র বাজানোর পাশাপাশি এরা জায়গামতো একযোগে সুর তোলে। একজন আবার শেষ অন্তরায় নাকি সুরে দ্যোতনা দেয়। এইসব বাজ-বাজনার মধ্যে রহিমুদ্দি গলায় ঢোল ঝুলিয়ে দমাদম আওয়াজ তোলে। তারপর নাড়ার মাঠে ঘুরে ঘুরে তালে তাল রেখে পা মেলায়। নৃত্য করে। তাঁর কা-কীর্তিগুলো দেখার মতো। নাচতে নাচতেই সে দপ করে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে তারপর বিশেষ ভঙ্গিমা দিয়ে দর্শকদের কুর্নিশ করে তড়াং করে উঠে দাঁড়ায়। পরানদহের কৃষকরা হৈ তুলে কুর্নিশের জবাব দেয়। হৈ শুনে কিষাণ কিষাণীদের গাদাগাদি থেকে পোলাপানেরা দ্বিগুণ উৎসাহে চিৎকার করে ওঠে। সেসব আমুদে হৈ চিৎকারের উৎসাহ পেয়ে রহিমুদ্দি দ্বিগুন আহ্লাদে লাফাতে থাকে। যে মহিলারা এতক্ষণ দূরের জমির আইলে দাঁড়ানো ছিল তারাও এগিয়ে এসে মজমা জমায়। আখতার বয়াতির গান শেষ হয় না। রোদ গাঢ় হতে থাকে। মানুষের আগ্রহ কমে না। বহুদিন পর সহজাত আনন্দবোধে জেগে ওঠে পরানদহের পুরো পাথার। গানের ফাঁকে একদল কৃষক কাচি হাতে পাশের জমিতে নেমে ধান কাটতে আরম্ভ করে। গানে গানে তাদের ধান কাটা চলে। তারপর গানের সুরের সঙ্গে গেরুয়া আবাদের মৌ মৌ গন্ধে একাকার হয়ে যায় পরানদহের পাথার...। কৃষিদিবসকে পালন করতে গিয়ে পয়লা অগ্রহায়ণের এ দৃশ্যটি যেন বহু বছর পর ক্ষণিকের জন্য ফিরে আসে পরানদহে। এটি পরানদহের প্রকৃত চিত্র নয়।
পরানদহ গ্রামটা চ্যাপ্টা ধরনের। গ্রামের মাঝ দিয়ে খাল বয়ে গিয়ে একসময় ইছামতিতে পড়েছে। লোকে একে গ্রামের নাম ধরে ডাকে-পরানদহ খাল। খালকে অনুসরণ করতে গিয়ে গ্রামটা আর গোলগাল হয়ে থাকেনি বরং খালের দু পাড়কে ধরতে গিয়ে খানিকটা থেবড়া হয়ে গেছে। খালের ওপর সিমেন্টের পাকা ব্রিজ। ব্রিজ পার হলেই খালের বাতা বয়ে উত্তর-দক্ষিণে ছিমছাম বাজার। কয়েকটা ঝুপড়ি দোকান, চায়ের স্টল আর মাটিতে পাত পাতানো কাঁচাসবজির দোকান নিয়ে গেঁয়োবাজার। শহুরে বাজারের থেকে তফাৎ হলোÑএখানে ভালো কলা এবং মানকচু পাওয়া যায়। চায়ের দোকানে ভিড় বেশি। দিনের বেলাতেই স্টলে বিদ্যুৎবাতি জ্বলছে। ওদিকে পুরো রাস্তা ধরে গোধূলির নরম আলোতে বেচাকেনা করা মানুষের আনাগোনা। একটা ঝাপতোলা মনোহারী-মুদি দোকানের পায়ার সঙ্গে কাঠের পুরনো টেবিলে কাপ-পিরিচ রেখে একটা চ্যাংরা মতো ছোকরা কেরোসিনের স্টোভ বসিয়ে চা বানাচ্ছে। ক্যাশবাক্সের লাগোয়া জলচৌকির ওপর সাদাকালো টেলিভিশনে ছবি চলছে। পর পর পাতানো চার-পাঁচটা বেঞ্চে বসে কয়েক সারি গাওয়ালি গভীর মনোযোগে দোকানে বাংলাছবি দেখছে। পরানদহের এ পাশটার সঙ্গে পূর্বদিকের অংশকে মেলানো যায় না। শহরের হাওয়া এসে লেগেছে এখানে এবং উন্নতির এক পর্যায়ে এসে গ্রাম-শহরের মাঝামাঝি এটা আধখ্যাচড়া জনপদে পরিণত হয়েছে। মনে পড়ে গ্রামটাকে সবিস্তারে দেখতে দক্ষিণে গিয়েছিলাম। কাঁচাপথের কিনার ধরে রেনট্রি গাছের সারি। মাঝেমধ্যে ছোট-বড় খেঁজুরগাছ। ছোট গাছগুলো পাতা ছড়িয়ে পথেই ঝুলে গেছে। কাঁটা বাঁচিয়ে সাবধানে মোটর সাইকেল চালাতে হচ্ছে। ধু-ধু পাথারের দিগন্ত জুড়ে গেরুয়া আবাদ সোনার মতো হলুদ হয়ে আছে। কোথাও কোথাও খাঁজকাটা নিচু জমিতে বক পড়েছে। পাথারের মধ্যেও পুকুর আছে। মূল জনপদ ফেলে বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর দুই বৃদ্ধের সঙ্গে দেখা হয়। হাতের ইশারা দিতেই বৃদ্ধদ্বয় কাঁচি হাতে জমিন থেকে উঠে আসেন। বেশ কিছু আলাপ হয়। একসময় মকসেদ সরদার পুরনো দিনের কথা তোলেন। তারপর পাশের দাঁড়ানো ছবদেলকে সাক্ষী মেনে বলা শুরু করেন, ‘আগে গ্রামে অনেক ধরনের আনন্দ ছিল। আমরা সাগরভাসা যাত্রা করতাম। ধানকাটা হলে ফের জারী ও জরিনার পালাগান হতো।’ সবদেল আরো খানিক যোগ করেন-‘আগের মতো সেসব মান্যগণ্যও আর নাই। বেশিরভাগ পোলাপানই এখন ঝাঁউলি টাইপের। মুরব্বিদের কোনো মানাগুনা নাই; খালি টিভি ভিসিপি ওগা (ওসব) দেইখ্যা বেড়ায়। তাছাড়া এই যে গ্রাম দেখতিছেন, এয়িতো এখন আর গ্রাম নাই-গাঁজা হিরো থেকে সবটি নেশাপানি পাবেন এহানে।’ বৃদ্ধদের এ রকম খোলামেলা মন্তব্য শুনে মনটা ক্রমেই কালো হয়ে যায়। এ কী হচ্ছে গ্রামে! সত্যিই কি আমাদের স্বপ্নময় সহজ গ্রামগুলো বদলে গেছে? একটা দুর্ভাবনা মাথায় ওদেরকে বিদায় জানাই। তারপর ঘোর উত্তরের গোদাখালি গ্রামের গভীরে ঢুকে যাই।
বাংলাদেশের কৃষক সমাজের নিজস্ব একটি সংস্কৃতি আছে। কৃষিযুগের শুরু থেকে কৃষিকর্মের পরতে পরতে মিশে কৃষকদের জীবনাচারে যুক্ত হয়ে আছে এই সংস্কৃতি। প্রথম বীজ বপনের দিন এর উদ্বোধন হয়েছে। কৃষকদের চলন বলন, জীবনযাপন পদ্ধতি, বেঁচে থাকার সংগ্রাম, আনন্দ বেদনার প্রকাশনা, কথোপকথন, ভাষা, ভাব বিনিময়, মন মর্জি ইত্যাদি স্বতন্ত্রভাবে তিলে তিলে যোগ হয়ে হয়ে যুগের পরিক্রমায় তৈরি হয়েছে নতুন এক কৃষিসংস্কৃতি। চাষিদের লোকজ এই সংস্কৃতির সঙ্গে ভদ্রলোকদের সংস্কৃতি কিংবা অন্য কোনো পেশাগত সংস্কৃতিকে এনে মেলানো যায় না।
যে মানুষের কাছে আনন্দ বলতে পালাগান বড়জোর যাত্রাপালা সেই মানুষ হঠাৎ করেই আকর্ষণীয় এবং হালের ভিডিওর মুখোমুখি হচ্ছে। কিছুদিন পর হয়ত এটি খুব সাধারণ এক বিষয় হয়ে যাবে গ্রামীণ জীবনে। আধুনিকতার সঙ্গে গ্রামজীবনে যেমন নেমে আসছে নানা অপসংস্কৃতি তেমন গ্রামের মানুষেরা নিজেদের অজান্তেই হারাতে বসেছে লোক ঐতিহ্যের আদি সম্পদগুলো।
নিদেনপক্ষে গরুর গাড়ি কিংবা পাল্কির কথাই ধরা যাক। কয়েক বছর আগেও এগুলোর ব্যবহার ছিল। পাল্কি ছাড়া বিয়েই হতো না। চার বেহারার পাল্কি করে গ্রাম্যবধূ আসত বরের বাড়ি। ছইয়ের মধ্যে কাপড়ে ঘেরা ছাপা শাড়ি-পরা গ্রাম্যবধূ। ভাওয়াইয়া গানের সুরে দুলতে দুলতে চলেছে গরুর গাড়ি। কাজলচোখা গরুর গলায় পিতলের ঘণ্টা টুং টাং, টুং টাংÑএমন দৃশ্য আর চোখে পড়ে না। তখন মানুষের মনে সহজানন্দ ছিল। পরিবর্তনের ধকল শহর সহ্য করতে পারলেও গ্রাম পারে না। ফলে একসময়ের পাল্কিবাহক বেহারা কিংবা গারোয়ানেরা বাপ-দাদার জাতপেশা ছেড়ে কেউ এখন ভ্যান বায়; কেউবা পরের জমিতে জোন (কিষাণ) খাটে। গীত গজলের দিন নেই বুঝি। এমনকি যারা নবান্নের গান করত, নছিমন কিংবা কবিগান করত অথবা যারা বোহেমিয়ান বাউলবেশে গান করে বেড়াত এ গ্রাম ও গ্রাম, যারা বাঁদর কাঁধে করে বাড়ি বাড়ি খেলা দেখিয়ে দু’চার আনা পেতো তাঁরাও যেন সরে যাচ্ছে ভাগ বুঝে। একতারা, সারিন্দা, বাঁশি, জোয়ারি, করতালের জায়গায় চলে এসেছে ক্যাসেট প্লেয়ার। বাউলগান, বিয়ে বা ফসল কাটার গান ইত্যাদি কে শোনে অত ধৈর্য নিয়ে? গ্রাম যেন নীরবেই অন্তঃসারশূন্য হয়ে পড়ছে।
সহজ জীবনের খোঁজে আমরা তো গ্রামেই যেতে চাই। যন্ত্রের কবলে পড়ে গ্রাম কি যান্ত্রিক হয়ে যাবে! হয়ে যাবে হৃদয়হীন পাথুরে শহর! গ্রামজনেরা কি আর মাঠের গান ধরবে না! হাঁড়ি পেতে খেজুরের রস-তালপিঠা-গরুগাড়িতে নাইওর-পল্লীগানের সুর-সলতের আলোতে পুঁথিপাঠ-পিঠা পায়েস-কাঁথা বোনা-জাল বোনা-নৌকা করে হাটে যাওয়া-পাট পাকিয়ে দড়া-পান্তা ভাতে পেঁয়াজ-শুকনো মরিচ পুড়িয়ে টাকি মাছের ভর্তা-চোখজলা খাঁটি সরিষার তেল-খেজুর গুড়ে মুড়ি-হেসেলের পাড়ে বসে আগুন গরম তেলের পিঠে-হলুদ হলুদ আলুভাজি, কাদামেখে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফেরা-আরো কত কি। ভাবতে ভাবতে ঝাপসা হয়ে আসে পুরনো পরানদহ। রাজারামপুরে সূর্য ডোবে। উৎসবের তেজ কমে গেলে আদিবাসীরা দূরবর্তী হয়। তখন ঢিলে হাওয়ায় ভেসে আসে ঝুমের গান :
ভালাকে মাজে বাসাকে পিছে
ভালাকের বাসা নাহি মানায়
রাজা গারিব গৈই না
হায় হায়রে বাসাবাসি
নাহি মানায় হারিয়ে ডোমরে
ফেরার পথে কয়েকটা টেলিভিশনওয়ালা দোকান দেখি। কিন্তু সেসবে আর মন লাগে না। শহরের রাস্তা পেতে এখনো ৬ কিলোমিটার। কুয়াশার সঙ্গে জ্যোস্না নেমেছে। পাথারের ভেতর খাঁজকাটা পুকুরেও আলো পড়েছে। বিলের কিনার ধরে যাওয়ার সময় শেষবার রাজারামপুরের পাথার আমাকে স্পর্শ করে নেয়। সুদূরে চেয়ে মনে মনে বলি, আমরা তো গ্রামে ফেরার জন্যই অপেক্ষা করি।