কয়েকদিন গরমের পর আজ খুব হাওয়া দিয়েছে। সন্ধ্যার একটু পর অফিস থেকে ঘরে ফিরছিল জহরত। সোডিয়াম লাইটের আলোয় তার মুখটা দূর থেকে আবছা দেখা যাচ্ছে। এরকম করেই ফিরছিল আরো কয়েকজন। আগে প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকেরই নানান সময়ে দেখা হতো। জীবন ও সময় কাছের মানুষদের দূরে ঠেলে দেয়, দূরের মানুষদের কাছে আনে। তবু মাঝে মাঝে দেখা হয়, দূর থেকে দেখা। এলিফ্যান্ট রোডে তখন জ্যামে আটকে আছে আমানুদ্দিন ম-ল ওরফে আমান ডেভিডের ওরফে ডেভিডের গাড়ি। দেখলো সারাহ্ একজন পুরুষের সঙ্গে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সিঁড়ি দিয়ে নামছে। কী ঝলমলে দেখাচ্ছে তাকে! আমান চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। তেমন কিছু মনে হলো না। সময় তার নিজের অজান্তে অতীতের তীব্রতাও মুছে দিয়ে গেছে। যাকে ভালোবাসি, আমার সঙ্গে না থাকুক, সে যেখানেই যার সঙ্গে থাকুক, সে যেন সময় ভালো থাকেÑ এই বোধটাই তো ভালোবাসার বড় দিক। আমান এসবও জানে না। সে এটুকুই চেয়েছিল, সারাহ্ ভালো থাকুক; বুঝেছিল, তার মতো লোকের প্রতি তো আসলে সারাহ্র কোনো টান তৈরি হওয়ার কথা নয়। কার যে কেন কারো প্রতি টান তৈরি হয় এবং হয় নাÑ জগতের অনেক রহস্যের ভেতরে এই রহস্যটারও সামধান হয়নি। যেমন সারাহ্র যে টান তৈরি হয়েছিল জহরতের প্রতিÑ সেটা কোনো মায়া থেকে নাকি শারীরিক আকর্ষণ থেকেÑ সে সম্পর্কে সারাহ্ কোনোদিন নিশ্চিত হতে পারেনি। এবং একেবারে আজগুবি ছিল তার জীবনে জহরতের ব্যাপারটা।
অথচ একসময় জহরতের সঙ্গে তার নিজের ও জহরতের বাপ ডাক্তার আবু মুহম্মদ ইমরানের ব্যাপারগুলির নিষ্পত্তি প্রথমে হওয়া দরকারটা এমন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরও অনেক আগে আমান ডেভিডের ব্যাপারটাও ছিল আশ্চর্য এক সমস্যাÑ এই লোকটা দিনের পর দিন সারাহ্র পিছে লেগেছিল। লেগে থাকলেও যে সব হয় নাÑ অনেক মূল্য দিয়ে তাকে বুঝতে হয়েছিল। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ কোনোখানে একেবারে শুরুতেই চলে না। পঙ্গু লঙ্ঘয়েতে গিরিÑ একথায় যতই রোমাঞ্চ জাগুক, বাস্তবে সম্ভব হয় না। যার পা-ই নেই সে তো হাজার চেষ্টা করে সে ফুটবল খেলতে পারে না। আমান আগের কালের গুন্ডা হলে হয়তো প্রতিদিনই পথ আটকে দাঁড়াত; হঠাৎ একদিন ভয়ংকর কিছু ঘটাতে পারতো। তার বদলে, সে সারাহ্কে বলেছিল, ফোন করলে ফোনটা যাতে কেটে না দেয়, এটুকুই তার অনুরোধ। সারাহ্ চেয়েছিল তাকে মোবাইলে ব্লকই করে দিবে, পরে একটু ভেবে তার মনে হল অল্প করে হলেও লোকটার ক্ষমতা আছে, ক্ষমতা মানে ক্ষতি করার ক্ষমতা।
সারাহ্ বার বার তাই জহরতকে বলেছিল আবার নিজের ক্লাবে ফিরে যেতে, গিয়ে নিজের ক্ষমতা আর যোগাযোগগুলি পোক্ত করতে। জহরত পারেনি; আসলে চায়নি বলেই পারেনি। ক্লাব থেকে, খেলা থেকে অনেক বেদনা নিয়ে নীরবে সে চলে এসেছে, সেখানে তো আর যেতে পারে না। সারাহ্ বলেছিল,‘অহংকার করো না।’ সারাহ্কে সে বলেছে, ‘এটা অহংকারে কথা নয়, আত্মমর্যাদার কথা।’ সারাহ্ জানে যে, জহরত নিজেকে একেবারে হেলাফেলা করার মতো কেউ নয় বলেই মনে করে। ইংরেজিতে পড়েছে, কতটা ইংরেজি জানে সেটা নিশ্চিত না হলেও ক্রিকেটটা তো জানে। এছাড়া দেখতেও মন্দ নয়। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। বাপ ডাক্তার। কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য ভাবতে হয়নি; আর এখন সেই মানুষটাই একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে। জীবনটাকে কখনো তার কাছে অতল সমুদ্র হয়ে দেখা দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে এর কোথাও কোনো কিনারা নেই। সারাহ্র ব্যাপারে সে আসলে কী সিদ্ধান্ত নেবে বুঝতে উঠতে পারছে না। এমন হবে জানলে কোনোদিন সে এদিকে পাই বাড়াতো না। এমনিতে ওপরে ওপরে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জহরতে গায়ের রঙ ফর্সা। এজন্য চিন্তিত অবস্থায় তার মুখটা একটু লালাভ থাকে। এমনিতে বলিষ্ঠ শরীর। জহরত যাকে কিনা বলে, সুস্থ দেহে সুস্থ মন। ছিল, এখন নেই। তাও তার পেটা শরীরটা জামাকাপড় ফুঁড়েও যেকারো চোখে ধরা পড়ে। সেটা লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি হবে। বুকে পেশীর কপাট। বৃষস্কন্ধ বলতে যা বোঝায় জহরত তাই। ইদানীং পেটে কোমরে একটু চর্বি জমেছে। আসলে ক্রিকেটটা একেবারেই ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। পেশাদার খেলোড়ার না হোক, মহল্লার মাঠে তো প্রাকটিসটা করতেই পারতো। তখন আবার বাবা মনে করতো ছেলেটা বুঝি আবার গেল। ‘যে যাÑ সেটা তাকে হতে না দেয়ার জন্য সত্যিই বাঙালি বাবাদের ভূমিকা অসাধারণ!’ ক্রিকেট কোচ বলেছিল। জহরত বলেছিল, ‘আপনার নিজের ছেলে বেলায় সেটা মনে রাখবেন, তাহলেই হবে বস।’ এলাকার ছোট ভাইয়ের মাঝে মাঝেই ডাকে, কিন্তু যাওয়া হয় না। ক্রিকেটটা কী?Ñ জহরত জানে, মানে ভালোই শিখেছিল, কিন্তু বেশি শিখেছিল বলেই মুশকিল হয়েছে। স্কুলের পড়ার সময় থেকে ক্রিকেটটা যেমন শিখেছিল হাতে কলমে, তেমন পরে বইপত্র পড়েও। কলেজে পড়ার সময় নীলক্ষেতের পুরানো বইয়ের কারবারি জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, নজরুল, নূরুন্নবী,ফারুক, সজীবÑ সবার কাছে মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল, ক্রিকেটের ওপর কোনো বই আসলে তারা যেন ফোন করে। ক্রিকেট নিয়ে এত বইপত্র বাংলাদেশে খুব কম লোকের কাছেই আছে। সেই সঙ্গে ভিডিও দেখতো। সবমিলিয়ে নিজেকে ভালোই তৈরি করছিল। এত জেনে যাওয়ায় যে ঝামেলা হচ্ছিল জহরত তখনই টের পেয়েছে। ক্লাবের প্যাকটিসের সময় কোচের সঙ্গে, অন্য খোলয়াড়দের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয়ে তর্ক লেগে যেত। ফিল্ডিং সাজানো নিয়ে, কার পরে কাকে খেলতে নামাবে সেসব নিয়ে। আসলে ক্রিকেট তো একটা খেলা, খেলা মানেই ক্রিয়েটিভ ব্যাপার, খেলোয়াড় মানেই ক্রিয়েটিভ একটা লোক, সেই লোকের এত তত্ত্ব জানার দরকার নেই। একদিন সতীর্থ খেলোয়াড় তার কাঁধে হাত রেখে সবার থেকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘জহরত, তোমার ভালোর জন্য বলি, তোমার ওই পড়ালেখাটা একটু কমাও। ইফতিকে দেখ না, কী অসাধারণ স্কিল, সেটা তো লেখাপড়া করে হয়নি, কিন্তু খেলার বুদ্ধি, কত ট্রিকি দেখ, বল করার কূটকৌশল ওর চেয়ে কজন ভালো জানে। তুমি কেন খামোখা অলরাউন্ডার হতে চাইছি। ব্যাটিংয়ে ভালো করছো, সেটা নিয়ে থাকো না বাবা।’ জহরত বলে, ‘আমার থিওরি: অল অর নান, হলে সব হবে নইলে কিছুই হবে না।’ সতীর্থ খেলোয়াড় বলে, ‘তাহলে বাবা তোমার সর্বনাশই হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে এটা হয় না সবার। তোমার হবে না। জোর করো না। জোর করে ক্রিকেট হয় না। অ্যা ক্রিকেটার মাস্ট বি বনর্ড, তাকে তৈরি করা যায় না। তুমি আসলে থিওরির লোক। তুমি থিওরি নিয়ে থাকো।’ জহরত বলেছিল, ‘তাহলে আমি কদিন সময় নিই। ভালো করে ভেবে দেখি আমার আসলে কী করার দরকার।’ সতীর্থ খেলোয়াড় বলে, ‘নিতে পারো। কিন্তু ভাবনাটা ভালো করে ভেবে দেখো।’
জহরত সময় বেশি নেয়নি। এত সময় নেওয়ার তো কিছু নেই। একদিন ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, সে আর ক্লাবে খেলোয়াড় হিসেবে থাকবে না। তাকে ‘জাগো স্পোর্টিং ক্লাবে’র পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে অনুরোধ করতে হয়েছিল। সে রাজি হয়নি। এটা এক ধরনের ঠিক অপমানও না ঠিক কীÑ এটা ঠিক কী এর কোনো নামও দিতে পারেনি। তারপরও গায়ে লেগেছিল। সে ক্রিকেটার নাÑ এটা মানতেই পারছে না। জীবনে চাকরিবাকরির কথা কখনো ভাবেনি। তাদের চৌদ্দগুষ্ঠির কেউ ব্যবসাও করেনি। কিন্তু ক্রিকেটও তো খেলেনি। তাহলে কি ব্যবসাও তার কপালে নাইÑ এমনটা মনে করছিল সে। বাবা ডাক্তার। সরকারি হাসপাতালে ত্রিশ বছর হয়ে গেছে। এলাকাও একটি ক্লিনিকে বসেন। সবমিলিয়ে অবস্থা খারাপ না। একটি মেয়ে আর দুটো ছেলে নিয়ে একসময় খুব স্বস্তি পেতেন। জহরতের ক্রিকেট নিয়ে পাগলামিতে ভেতরে ভেতরে মুশড়ে পড়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল ছেলেও ডাক্তারি পড়–ক। বাড়ির বড় ছেলে। ডাক্তারিতে দুদুবার করে পরীক্ষা দিয়ে লিখিততেই পাশ করতে পারেনি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষা দেয়নি। কোনোমতে ঢাকা কলেজে ইংরেজিতে ভর্তি হয়েছিল বলে রক্ষা, নইলে হয়তো লেখাপড়াই আর হতো না।
জীবনের অনেকটা সময় এই খেলা নিয়েই কেটে গেছে। খেলা ছেড়ে দিয়ে কী করবে? একবার ভেবেছিল বাংলায় ক্রিকেট শেখার বই লিখবে কিনা। পরে মনে হয়েছে পাগলামি হবে। আবার ভেবেছিল পেশাদার কোচ হওয়ার জন্যই চেষ্টা করবে কিনা। অনেক দিনই তো ফার্স্ট ডিভিশানে খেলেছে। বাবা বলেছে,‘ ছেড়েছো যখন একেবারেই ছেড়ে দাও। কোনো কিছু ছেড়ে দিয়ে তার সুতা গায়ে লাগিয়ে রাখাটাও কিন্তু সর্বনাশ।’ তিনি জহরতকে সেই গল্পটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন: একটি পাখি খাঁচায় বন্দি ছিল। তার একটা পা খাঁচায় যে কাঠিটায় ওপর সে বসত, তার সঙ্গে সুতা দিয়ে বাঁধা থাকতো। কদিন চেষ্টা করে সে ওই বাঁধানো সুতার গোড়াটাকে ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে পাতলা করে আনলো। আর তক্কে তক্কে থাকলো, কোন ফাঁকে সে উড়াল দিতে পারে। একদিন সেই সুযোগ এলো। খাবার দিতে এসে দরজারটা লাগাতে ভুলে যাওয়া কাজের মেয়েটা যেই সরেছে ওমনি ফুড়–ৎ। তারপরতো অনেকক্ষণ উড়ে উড়ে সে একটা বনে পৌঁছালো, একটি গাছে ডালে বসল। কিন্তু সে খেয়াল করলো না কোন এক সময় সেই সুতো গাছের ডালে পেঁচিয়ে গেছে। বেচারি পাখি সেই গাছ থেকে আর নড়তে পারলো না। সেখানে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মারা গেল। সুতায় বাঁধানো কঙ্কাল হয়ে ঝুলে রইল গাছে। বাপ তাকে এই গল্পটা মনে করালে সে বলে, ‘যে পাখিটা খাঁচায় থাকার সময় ঠোঁটে ঠুকরিয়ে সুতোটা আলগা করেছিল, গাছে সুতোটা আটকে যাওয়ার সময় সেটা পারলো না?’ বাপের উত্তর ছিল, ‘সে না খেতে পেয়ে এত দুর্বল ছিল যে সেটাও করতে পারেনি। তুই গল্পটার মোরালটা না বুঝে তর্ক করছিস। তোর বস্তু মিলবে না, যেতে হবে বহুদূর যেতে হবে।’ জহরত বলেছিল, ‘আমি এত তাড়াতাড়ি বস্তু পেতে চাই না। বহুদূরই যেতে চাই।’
কেউ কেউ বলেছিল, কোনো একটা পলেটিক্যাল পার্টিতে জয়েন করতে। ক্রীড়া বিষয়ক কাজই করতো। পরে বলা তো যায় না সত্যিই একদিন পথ খুলে যেত। পলেটিক্স তো আসলে লম্বা পথ। বলা তো যায় না কুড়ি বছর কিছু না পেয়ে একবারে যখন সে মন্ত্রী হবে, তখনই অনেক কিছু পেয়ে যেতে পারে। জহরত দেখল সেটাও তার হবে না। কারণ তার জন্য যে ধৈর্য সহ্যের ¯œায়ু দরকার সেটা তার নেই। যে ¯œায়ু দিয়ে সে ক্রিকেট খেলতো সেই ¯œায়ু দিয়ে আসলে রাজনীতি হবে না। তারপরও লোকে বলে, যার হয় তার হয়, যার হয় না, তার কোনো কিছুতেই হয় না। জহরত সেটাও যে মানতো না তা না, মানতো। কিন্তু তার আসলে মনটাই আর কোনো কিছুতে লাগছিল না। জগতটা কেমন শূন্য হয়ে যাচ্ছিল। কোনো কিছু করার নেই। কারো কাছে যাওয়ার নেই। কোথাও যাওয়ার নেই। তার যে খাওয়া পরার সমস্যা হচ্ছে তা তো নয়। অনেকেরই খাওয়ার পরার সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা। তার সমস্যা আলাদা। খাওয়া-পরা-থাকার সমস্যা মিটে গেলে জগতের যে যে সমস্যাগুলি দেখা দেয়, সেগুলি অনেক বেশি জটিল এবং প্রায় অসমাধেয়। আবার এও ঠিক সমস্যা দেখে মিইয়ে গেলে তো চলে না। তাহলে আর মানুষ হিসেবে বেঁচে থেকে লাভ কী। জীবন যতক্ষণ সমস্যা ততক্ষণ।
জহরত বুঝতে পারে, আসলে যে দিকে যাচ্ছিল, অনেকটা এগিয়েছিল, সেদিকে থেকে ফিরে আর কোনো রাস্তা সে ঠিক করতে পারছিল না। ইংরেজিতে এম.এ করেছে। ক্রিকেটটা বোঝেÑ এই দুই দিয়েই নাকি বিশ্বজয় করা যায়। সাংবাদিকতা করতে পারে চাইলে। চাইলে টোফেল, আইএলটিস দিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। দেয়ার আর সো মেনি চয়েজেস, কিন্তু এর মধ্যে থেকে একটাও বেছে নেওয়া যাচ্ছে না। ওই সে অ্যানসিয়েন্ট মেরিনারের মতো: ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়ার বাট নট অ্যা ড্রপ টু ড্রিঙ্ক।
জীবনে এমন অবস্থায় কত লোককেই না পড়তে হয়। তবে যখন কোনো পথ পাওয়া যায় না, তখন নাকি একমাত্র কোনো নারী সেই পথহারাকে পথ দেখাতে পারে; তাকে এসে বলতে পারে,‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো?... আইস।’’ তখনই এই পৃথবী নাকি দুম করে সুন্দর হয়ে উঠবে, নারীকে মনে হবে সুন্দর, তার উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দ সুন্দর। ‘জীবনের অসহায় পরিস্থিতিতে নারীর পুতুল হয়ে যাও। তাহলে দেখবে সব সমস্যা মিটে গেছে।’ জহরতের হাসিও পায়। কোন লোক কী ভেবেছে, যে জীবনের শুরু থেকেই মনে করতো, একটি লোকের যখন কোনো সমস্যা আর নেই, তখন তাকে একমাত্র কোনো নারীই পারে বিপথে নিয়ে যেতে। এজন্য চীনা প্রবাদও আছে: যদি সম্ভবনাময় কোনো পুরুষকে শেষ করে দিতে চাও তো তাকে বিয়ে করিয়ে দেও। জহরত বলতো, ‘তাহলে জ্ঞান অর্জন করতে চীন দেশে গিয়ে মানুষের কী করে সর্বনাশ করা হয় তাই শেখানো হয়?’ ‘আরে না না, তাহলে শোনো, চীনা প্রবাদে বলে: যদি একদিনের জন্য সুখী হতে চাও তো মাছ ধরতে যাও; যদি একমাসের জন্য সুখী হতে চাও তো বিয়ে করো; আর যদি সারা জীবনের জন্য সুখী হতে চাও তো অসহায় কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করো। তারপর কত আছে: কাউকে ধরা মাছ খেতে দিলে তার পেট হয়তো একদিনের জন্য ভরবে, কিন্তু‘ তাকে মাছ ধরতে শিখিয়ে দিলে সারা জীবনের জন্য তার পেট ভরার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ক্লাবে এসব মজার মজার কথা হতো আড্ডার সময়। ক্লাবের ইয়াসিন ভাইকে তারা বলতো কোটেশান বিশেষজ্ঞ, কেউ বলতো কনফুসিয়াস। যে কোটোশানই দেন তিনি সব চীনা, এজন্যই কনফুসিয়াস। ‘নবী কইছিলেন জ্ঞান অর্জন করার জন্য চীনে যাও। আমরা কই চীনে নয়, ইয়াচিনে যাও, মানে, ইয়াসিন ভাইয়ের কাছে যাও।’ জহরতের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নামে। হায়রে স্মৃতি!
২. সারাবান তহুরা
সারাহ্র এতক্ষণ মাথা নিচু করেছিল। প্রিন্সিপালের কথা শুনে মুখ তুললো। ‘নাম: আবু জহরত ইমরান। পিতার নাম: ডাক্তার আবু মুহম্মদ ইমরান।’ এরপর বাকি তথ্যগুলিও একে একে পড়ে গেলেন। মহিলা এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। এমন ফর্সা, আর ততটাই কালো তার চুল আর ভ্রু। মনে হচ্ছিল যেন আলাদা করে কালি করানো। হয়তো সবই পেকে গেছে। গাঢ় কালো কলপে এমন কালো দেখাচ্ছে। কদিন পরে সারাবান তহুরার কাছে ঠিকই জানা গেল, জহরতের অনুমান ভুল ছিল না।
সারাবান তহুরা তাকে ফোন করায় সে ভীষণ অবাক হয়েছিল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি এখানে ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে জয়েন করতে চান, কিন্তু আপনি তো তেমন কোনো কাগজপত্র দেননি। তারওপর ফার্স্ট ডিভিশানে ওঠা একটা ক্রিকেট ক্লাবের সদস্য ছিলেন, নিজেও খেলেছেন, ছবিও দিয়েছেন সাবিক আল হাসান, তামিম ইকবাল, মশরাফি-মুশফিকের সঙ্গে। কিন্তু এসব তো আসলে আপনার প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণ নয়। আপনি যদি ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কোনো একটা ট্রেনিং করতেন বা কোনো কোর্স, তাহলে তো আপনার কথা আমাদের ভাবা অনেক সুবিধা হতো।’ মোট চারটা কপি সিভি দেওয়া হয়েছিল। প্রিন্সিপাল তার সিভিটা পড়ার সময় বাকিরাও সেটা দেখছেন। এর ভেতরে সারাহ্ বার বারই কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু প্রিন্সিপাল তাকে হাত দিয়ে ইশারা করছিলেন থামার জন্য।
প্রিন্সিপাল জানেন তরুণ ছেলেদের প্রতি সারাহ্র দুর্বলতা আছে। তাকে নিয়ে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে কিছু রটনাও আছে। যদিও কেউ এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। কিন্তু তার সহকর্মীরাই তাকে নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে অনেক কথা বলে। সারাহ্র বিয়ে হয়েছিল এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। লোকটা ফিলিপাইনে কী একটা ট্রেনিংয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। এক ফিলিপিনো মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সেখানেই থাকছে। সেসবই বলছিল সারাহ্। বলেছিল, ‘আমাকে সারাহ্ বললেই হবে। তহুরা নামটা কেমন ব্যাকডেইটেড মনে হয়। সারাহ্ই আমার ডাক নাম। সবাই সারা-ই বলে। সারা মানে নাকি খাঁটি। তহুরা মানে বিশুদ্ধ। তবে নামটা কিন্তু শারাবান, তালব্য শ, মানে শারাব থেকে, কিন্তু আমার এই শারাব কথটা ভালো লাগেনি। তাই শারাব-কে সারাবান করে নিয়েছি। এই আর কী। আসলে, আব্বু খুব সুফি সাহিত্য পড়তেন। জালাউদ্দিন রুমি, হাফিজ, ওমর খৈয়াম। খুব প্রিয় ছিল ফেরদৌসীর শাহনামা। মনিরউদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে বন্ধুত্বও ছিল। ইউসুফ চাচা প্রায়ই শাহনামা অনুবাদ করা নিয়ে তার যন্ত্রণার কথা বলতেন। তিনি বার বার তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তার কথা ছিল এর জন্য তিনি তার নিজের লেখা লিখতে পারছেন না। কিন্তু আব্বু বলতেন, আপনি দেখবেন, এটাই আপনাকে অমর করে রাখবে বাঙালিদের কাছে। বাংলাভাষায় এই কাজটা যুগ যুগ ধরে পড়া হবে। এটা একটা রাজকীয় কাজ, আপনি কি সেটা বুঝতে পারছেন না। এর প্রাপ্তিও রাজসিক। আব্বুর দুদিকে টান ছিলÑ একদিকে লালনের বাউলপন্থা, অন্য দিকে ফারসি সুফিবাদ। আবার খুব বুদ্ধেরও ভক্ত ছিলেন। আমি যদি বলতাম, তুমি এমন সবমিলে একটা খিচুড়ি কেন? আব্বু বলতেন, বাঙালি মানেই তো একটা খিচুড়ি। এজন্য এত মজার জাতি জগতে খুব কম আছে। লাতিনরাও আরেক খিচুড়ি। কিন্তু তাদের ভেতরে চলাটা ডালটা আলাদা করে এখনো ধরা যায়। কিন্তু বাঙালি এমনই খিচুড়ি যে একেবারেই ধরা যায় না। বাঙালি হল মিশানো জাত। জানের দিক, মনের দিক থেকে, প্রাণের দিকেও মিশানো। পাঠান, মোঙ্গল,শক, হুন এক দেহে হল লীন, আছে না কবিতায়। যেমন আমাকে তো দেখে অনেকে বলে, আমি কি শ্রীলঙ্কান নাকি। শুনেছিলাম আমাদের বংশ এসেছে ভারতের মাদ্রাজ থেকে। কী ব্যাপার আপনি কিছু নিচ্ছেন না যে।’
‘না নিচ্ছি তো।’ টিটেবিলে দুটো পিরিচে একটায় মিষ্টি দুটো রসগোল্লা আর একটা সন্দেশ। অন্যটায়
চানাচুর। চায়ের কাপটা ঢাকা দেওয়া আছে পিরিচ দিয়ে। জহরতের সারাহ্র কথ শুনতে ভালো লাগছিল না। মহিলা কেন যেচে তাকে ডাকলেন, সেটাও তো বুঝতে পারছে না। একবার ভাবে নিজেই বলে, আচ্ছা আমাকে কেন ডেকেছিলেন, সেটা কিন্তু বললেন না। কথাটা আবার জেগে ওঠে, বিস্কুটে কামড় দিয়ে। বি¯ু‹টে কামড় দিয়ে যে-ই বলতে যাবে ঠিক সেই সময় সারাহ্ নিজেই বলে, ‘আসলে আমি একটা কথা বলি। আপনি কি কোনো যোগাযোগ করেছিলেন কারো সঙ্গে। যদিও সার্কুলেশানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা ছিল কোনো রকম যোগাযোগ বা তদবিরের কোনো চেষ্টা করলে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু আসলে তো এটা আগে আগেই জানাজানি হয়। আমি যেটুকু বুঝতে পেরেছি চাকরিটা আপনার হবে না।’ বলে থামল সারাহ্। জহরতের কেন যেন মনে হল সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
‘আপনি কি হতাশ হচ্ছেন?’ সারাহ্ জিজ্ঞাসা করে।
জহরত বলে, ‘না, না, আমার ওসব হতাশাটতাশা আসে না। আপনি আসলে আমাকে কি এটা জানানোর জন্যই ডেকেছেন?’
সারাহ্ বলেন, ‘সরি আমি কিন্তু জানি না, আপনার সময় নষ্ট করে এখানে নিয়ে এলাম কিনা। আসলে আমি দেখলাম আপনার ঠিকানায় দেখলাম আমার বাসার একটা রোড পরেই আপনি থাকেন। আপনার মোবাইল নম্বারটাও চট করে মোবাইলে টুকে নিলাম। আসলে ভাবলাম, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করি। তাই...’
‘আমরা সঙ্গে আলাপ করে কী লাভ?’ জহরত একটু ম্লান হাসল।
‘সরি, আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন।’ সারাহ্র কণ্ঠও হতাশ শোনায়। সে বুঝতে পারে না আসলে কী বলবে। মূল ব্যাপারটা হল, তাকে সারাহ্র পছন্দ হয়েছে। আর ঠিক যেমন পুরুষকে দীর্ঘদিন ধরে চাইছিল তার প্রতিটি গুণ আছে জহরতের। আগের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টারের সঙ্গেও সারাহ্র একটা সম্পর্ক ছিল বলে কলেজে রটনা আছে। গণিতের(এখানে তো এটা কেউ বলে না বলে অঙ্কের টিচার) খুব ভালো টিচার বলে সারাহ্কে কলেজে কেউ কোনো ঝামেলা করে না। তাছাড়া গভার্নিংবডির মেম্বার আর এলাকার এম.পির সঙ্গে সারাহ্র যোগাযোগ সব সময় ভালো। গুলশানে থাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে দাপুটে শিল্পপতির মেয়েকে অঙ্ক শেখানো ছাড়া বাড়তি কোনো ইনকাম সে করে না। নিজে আলাদা বাসা ভাড়া করে একলা থাকে। একেবারেই একলা। ভাইরা তাদের বিশাল সাত তলা বাড়ির ছতলার দুটো ফ্ল্যাট তাকে দিয়েছে। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আসে। নিজের মেয়েটার সব খরচ ভাইরাই বহন করে। মেয়েটা পড়ে দার্জিলিংয়ের স্কুলে। এটা তার স্বামীর ইচ্ছা ছিল। মেয়েকে একেবারে ওয়েস্টার্ন না হলেও সেরকম কেতাকানুনে বড় করবে। সারাহ্ যদিও নিম রাজি ছিল। মেয়েটার মনে হয় ভালোই লাগে দার্জিলিংয়ে থাকতে। দেখতে দেখতে বড়ও হয়ে গেছে। আশ্চর্য মা-বাবার প্রতি তার মনে হয় তেমন টান নেই। বন্ধুর আর সেখানকার টিচারদের সে একেবারে আপন করে নিয়েছে।
জহরত বলে,‘আসলে আমি ঠিক বুঝতেও পারছি না, চাকরি করাটা আমার জন্য ঠিক হবে কিনা। আমি একোবরে হুট করে সিভিটা পাঠিয়েছিলাম। পত্রিকায় দেখে মনে হল পাঠিয়ে দেখি না। আমি তো জানি জীবন কঠিন। আরো কঠিন হল জীবনের কঠিন সময়ে কাউকে পাশে পাওয়াটা।’
সারাহ্ ঠিক এখানটায় কথা বলে ওঠে, ‘আমি ঠিক এটাই বলতে চাইছিলাম। আমি এমনিতে খুব একা থাকি। কথা বলার মতো মানুষ পাই না। আর মানুষকে তো বিশ্বাস করাটাও সহজ নয়। আপনার কথা শুনে ও দেখে মনে হল, আপনার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়।’
‘বিশ্বাস রেখে কী করবেন?’ জহরত একটু হাসে আর কথাটা বলতে বলতে চায়ের কাপের ওপর থেকে পিরিচটা নামিয়ে পাশে রাখে, তারপর পিরিচটায় কাপ বসায়। এসময় সারাহ্ তাকে আবার ভালো করে খেয়াল করে। দাড়ি কাটেনি। চুলও ঠিকমতো আঁচড়ানো না। টি-শার্টটা কোনো মতে গায়ে দিয়ে এসেছে। ওপরে লেখা ‘ডু ইট নাও।’ ছাইরঙের ওপরে সাদা রঙে লেখা।
জহরতের এরকম কথা লেখা টিশার্ট কয়েকটা আসে। ‘নাউ ইজ দ্য বেস্ট টাইম।’ ‘ইয়ু আর বর্ন টুডে।’ এমন আরো কী সব কথা লেখা। অচেনা নম্বার থেকে ফোন এলে সাধারণত আগে ধরত না। মাঠ থেকে বাড়ি ফিরেই ফোন বন্ধ করে দিত। খেলাধুলা ছেড়ে দেওয়ার দুটো কাজ করে এক সারাদিন ফোন খোলা থাকে, এমনকি ঘুমের সময়ও বন্ধ রাখে না; আর একটা হল যেসময় খোলা রাখে যেকোনো ফোন এলেই ধরে। এমনকি কোনো অচেনা নম্বার থেকে মিসড কল এলেও নিজেই রিং-ব্যাক করে। জহরত কোনো দিন খতিয়ে দেখেনি কেন তার এই পরিবর্তনটা হলো। আগে সে থাকতো একটা গ-িতে। কাজ কর্ম সবই ছিল সুনির্দিষ্ট। তার বাইরের কোনো কিছু নেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। যতই যে তার ওই নির্দিষ্ট গ-ি থেকে সরে গেছে, একটু একটু করে তার চারদিক শূন্য হতে শুরু করেছে। জহরত জানে না, এই যে কোনো কিছুর মধ্যে না থাকা, সেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ভাবেÑ দেখিই না, কোথায় কোন দিকে কত দূর তাকে নিয়ে যায় তার সময় এবং তার আশেপাশে চেনা বা অচেনা মানুষের। লেট ইট বি। যেমন এই যে সারাবান তহুরার ফোনটা, ফোনে তার কণ্ঠ এত আকর্ষণীয় মনে হয়, আর এত মায়াময় আর আন্তরিক, ‘আপনি কি আবু জহরত ইমরান বলছেন?’
‘জ্বি, বলছি।’
‘আমি সারাবান তহুরা।’
‘আপনি...?’
‘ভাইবা বোর্ডে আমি ছিলাম। প্রিন্সিপালের পাশে।’
জহরতে সঙ্গে সঙ্গে ওই দিনের বোর্ডের ছবিটা দেখে নেয়। হ্যাঁ, মহিলা লাল পাড় সাদা রঙের সূতির শাড়ি পরা। কালো মতোন, বয়কাট চুল। বিপুল স্বাস্থ্যবতী কিন্তু মোটেও মোটাসোটা বলা যাবে না। ক্লাবের তারাজু মোল্লা, বাগেরহাটে বাড়ি, এমন মেয়েদের বলত ‘সাঁইটেল’, ঠিক তাই। নামে মোল্লা, দুষ্টুমিতে এক নম্বার, অশ্লীলতা ছাড়া কথাই বলতে পারে না, যে মডেল গার্লের সঙ্গে সাঞ্জুকে নিয়ে স্ক্যান্ডেল হয়েছে তার নাম দিয়েছিল ‘‘উবর’’ মানে উন্নতবক্ষা রমণী। সারাহ্ যে বেশ স্বাস্থ্যবতী আর দোহারা গড়নটা বসে থাকা অবস্থায় বোঝা যাচ্ছিল। আজকে দরজা খুলে সামনে দাঁড়ানো সারাহ্কে দেখ গেল, দেখেই সাঞ্জুর ‘উবর’ শব্দটা মনে পড়লো। বাড়ির শাড়িটা একটু পাতলা। একেবারে সাদা, ভেতরের ব্লাউজও সাদা। হাতে বালা পরা, তাও সাদা। সবকিছুর ভেতরে একটা সাদা সাদা ব্যাপার আছে। পায়ের স্যান্ডেলের রঙও সাদা। এজন্য সারাহ্ আরেকটা নাম আছে কলেজে ‘সফেদ আপা’। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুবই আন্তরিক কিন্তু এমন একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা বলবে যে সবাই তাকে সমীহ করে চলে। সবাই জানে, সারাহ্ আসলে ক্ষমতাবান সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে। নিজের ঢোল কখনো পেটায় না। কখানো বলে না যে, আমি কাউকে পুছি না। আমি হ্যানত্যানÑ এসব নেই। তার সাদা পোষাক পরার পেছনে তেমন কোনো কারণ নেই, কেবল মনে হয়েছিল সাদা রঙের একটা অন্যরকম প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়ে। জহরতের যেকয়টা জানা জিনিস আছে, তার ভেতরে একটা হলো মাফিয়া ডনরা নাকি সাদা কাপড় পরে। জুতা থেকে চশমার ফ্রেম পর্যন্ত বলে সাদা থাকে।
হঠাৎ করে কথাটা মনে আসতেই সে সারাহ্কে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা আপনি সব সাদা পরেন কেন?’ সারাহ্ খুশি হয়, কারণ এতক্ষণে জহরত একটা কথা বলছে, কেবল তা-ই নয়, কথাটা তার প্রতি যে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে, বা তাকে সে একটু হলেও খেয়াল করছে, সেজন্য।
‘সাদা আমরা প্রিয় রঙ। তাছাড়া আমি সাদাসিধা মানুষ। এটা হল দুই। আর আমি খুব পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করি।’ বলে একটু তিনি একটু হাসেন। তারপরও নিজেই জানতে চান,‘আচ্ছা আমার বয়কাট চুল কি আপনার পছন্দ হয়?’
জহরত একটু মজা করতে ইচ্ছা করে এখন। ‘আমি যদি বলি হয় না, তাহলে আপনি কি লম্বা চুল রাখতে শুরু করবেন?’
‘করতেও তো পারি।’
‘আমরা আসলে মেয়েদের নিয়ে খুব একটা চিন্তা কাজ করে না। সারা জীবন খেলা নিয়ে ছিলাম। মেয়েদের নিয়ে ভাববার সময় আমার ছিল না। এখনো নেই। তাই মেয়েদের কী কী আমার পছন্দ আর অপছন্দ আমি এসব নিয়ে খুব একটা ভাবি না।’
‘এখন তো খেলা থেকে সরে এসেছেন। এখন কী নিয়ে ভাবনা?’
‘এখন ভাবনা একটাইÑ আমি আসলে কী করবো।’
সারাহ্ বলেন,‘তাহলে এক কাজ করুন।’ এমনভাবে বলে যেন সে সত্যিই জহরতের জন্য দারুণ কিছু একটা ভেবেও রেখেছে।
‘কী কাজ?’
‘বিয়ে করে ফেলুন। বড় লোক, বা যে বউ আপনাকে চালাতে পারবে।’
‘কেন বড়লোক দেখে বিয়ে করতে হবে?’
‘ওই যে কথায় বলে না, আপনি যদি গরীব হয়ে জন্মান সেজন্য আপনি দায়ী নন, কিন্তু আপনি যদি গরীব হয়ে মারা যান, তাহলে আপনিই একমাত্র দায়ী।’
জহরত কিছু বলতে যাচ্ছিল, সারাহ্ বলে, ‘শেষ হয়নিতো। কথাটা বিল গেটসের। এর প্যারোডি করে বানানো হয়েছে: আপনার বাপ যদি গরীব হয়, সেজন্য আপনি দায়ী নন, কিন্তু আপনার শ্বশুর যদি গরীব হয় সেজন্য আপনি দায়ী।’ বলে সারাহ্ একটু ফিক করে হাসে।
জহরতের হঠাৎ হাসি পায়। সারাহ্র কথার জন্য নয়। হঠাৎ প্রাণ খুলে হো হো করে হাসতে থাকে সে। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে। সারাহ্ প্রথমে ওর সঙ্গে তাল দেয়, কিন্তু পরে দেখে তার হাসি থামছেই না। সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে ওর হাসি দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে তার নিজের আবারও হাসি পায়। সেও আবার জহরতের সঙ্গে হাসতে থাকে। আরো কিছুক্ষণ চলে তাদের দুজনের একসঙ্গে এই হাসাহাসি। একসময় হাসতে হাসতে জহরত উঠে দাঁড়ায়। হাসতে হাসতে দরজার দিকে এগোয়। সারাহ্ কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জহরত তাকে টা টা দিতে দিতে কোনো মতে বলে, ‘অনেক মজা লাগলে। দেখা হবে। আসি।’
সারাহ্ ইচ্ছা হচ্ছিল সিঁড়ি ঘরের রেলিংয়ে এসে দাঁড়াতে। কিন্তু এটা আত্মীয়স্বজন এলে সে করে। জহরতের বেলায় করলে ঠিক মানাবে না। দরজা বন্ধ করে সে দরজার গায়েই হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটাকে তার এক ভালো লাগছে কেন? অনেক দিন এমন করে হঠাৎ অকারণ তার কাউকে এমন ভালো তো লাগেনি। কী কারণ? ছেলেটার ভেতরে অদ্ভুত একটা সরলতা আছেÑ সেজন্য? নাকি ছেলেটাকে অনেক সৎ আর এমন লোক বলে মনে হচ্ছে যার ওপর আস্থা রাখা যায়? সারাহ্র চোখ হঠাৎ ভিজে ওঠে। অনেক দূর থেকে একটা বেদনার হাওয়া তার বুকের ভেতরে ঝড় হয়ে শুরু হয়। সে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।
৩. জহরত
যা হয়েছে সবার, আমারও তা-ই। আমিও আমার মা এবং বাবা সম্পর্কে সবচেয়ে কম জানি। আশ্চর্য! যেখানে থেকে জন্মালাম, সেই উৎস সম্পর্কে সবচেয়ে কম জানাই কেবল নয়, সেটা যে জানার মতো কিছু তাই তো আমি জানি না। আমার বাবা ডাক্তার মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির কিছুদিন পর যুদ্ধ শুরু হয়। কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে না থাকলেও আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে দু নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং নেন। সেখানে তার একরকম বামপন্থী ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, কিন্তু তিনি দ্রুতই বুঝে যান যে, এটাতে গ্রহণ করা বা প্রয়োগ করার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত আমরা হয়ে উঠিনি। পরে তার সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডের কিছু লোকের পরিচয় হয়। বেশ একটা রোমাঞ্চ জেগেছিল তখন। অল্প দিন পরেই রোমাঞ্চের দইয়ে জল কাটতে শুরু করে। মার্কসবাদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অল্প, এবং ‘অল্প বিদ্যা যে ভয়ংকরী’ সেটা টের পেতে বেশি দিন লাগে নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর নতুন আরেক যুদ্ধ শুরু হয়। বাপকে বলা হয়েছিল তিনি যেন তাতে যোগ দেন বা অন্তরালে কাজ করেন। তিনি রাজি হননি। পরে তাকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয়। কারা সেটা দিয়েছিল তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। রাজনীতি এমন এক দাবা খেলা যে বার বার গুটি উলটে যায়, সাদা সৈন্য কালোর প্রথম সারিতে উঠে ক্ষমতাবান হয়ে সে রাজাকেই আক্রমণ এবং হত্যা করতে পারে। আমার ছোটভাইটা একটু রাজনীতি রাজনীতি করছিল। কয়েকটা বই পড়ে তার মনে হয়েছে রাজনীতি ঠিক না হলে সবই উলটে পালটে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ‘কোনো দিক থেকেই তো কম ছিল না রাশানরা, তারপরও পারল না তো।’ আব্বার কথায়, ‘অনেক ঘাপলা আছে। যা কৃত্রিম তা শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। রাশানদের মতো আধ্যাত্মিক জাতির কমিউনিস্ট হওয়া একেবারে মানায়নি।’ ছোটভাইটাকে বোঝালে বোঝে, আর সেটা বোঝে দ্রুত, আমার সমস্যা হল আমিও বুঝি কিন্তু দেরিতে। একারণে ক্রিকেটটা বেশি বুঝতে গিয়ে আমার যে নিজের সম্পর্কে বুঝ-জ্ঞানটাই ধাক্কা খেল, আর সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হল; তাতে তলে তলে অনেক কষ্ট পেলেও, আমি আসলে একটা কথা খুব ভালো করে বুঝেছিলাম যে, আমার সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। আর কোনো লোক আমার কোনো বিপত্তির জন্য দায়ী নয়Ñ এটাতে এক ধরনের শান্তি আছে, কিন্তু নিজের ওপরে সব নিয়ে আসা, তারপরও নিজেকে সবকিছুর জন্য দায়ী করার কষ্টটা অনেক বড়। আর আমি চাইছিলাম যখন সরে যাবো তো আর থাকবো ধারে কাছেও। কিন্তু পারিনি। একটু একটু করেই সরতে হয়েছে। এই যে দুম করে কিছু করতে না পারা সেটাই মনে হয় আমার সমস্ত সমস্যার উৎস। কিন্তু এটা কার কাছ থেকে আমার মা-বাবার কারো মধ্যে এই প্রবণতা কি নেই? না থাকলে আমার গুষ্টির কারো মধ্যে? নিয়তি বলে যে কথাটা সেটা নাকি ও বংশগতি বা জিনের ভেতরেই থাকে। সবার জিনের ভেতরে বা বংশগতির ভেতরেই থাকে একটা লোক কতটুকু সামর্থ্যবান হবে বা হবে না। তার কী কী অসুখ হতে পারে বা পারে না। আমি অবশ্য এসব বেশি দিন হলো জানিনি। আর জেনে আমার তো কোনো লাভও নেই।
আমি ভাবলাম আমার বাবার সঙ্গে এই নিয়ে একটু কথাবার্তা বলতে। তিনি তার হাসপাতাল, ক্লিনিক আর চেম্বর নিয়ে এত ব্যস্ত। আমি বুঝি না একজন ডাক্তার হয়েও মানুষের কী চাই তিনি বোঝেন না। পত্রিকায় পড়েছিলাম এক ডাক্তার তার স্ত্রীকে হত্যা করে সেটাকে আত্মহত্যা করে চালিয়েছিল। পরে লাশ কবর থেকে তুলে এনে আবার ময়নাতদন্তে বের হয় সেটা আত্মহত্যা নয়, হত্যা করা হয়েছিল। একজন ডাক্তার যে জীবন বাঁচাবে সে কী করে জীবন নেয়? আর এটা তো জগতে এবার দুবার ঘটেনি, বহুবার ঘটেছে। মজা করে কেউ বলে, ভগবান রাগ করলে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু ডাক্তার রাগ করলে ভগবানের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তাহলে তো ভগবান বরং ডাক্তারের চেয়ে দয়াময়। মূল ব্যাপার তো মানুষকে আর জীবনটাকে আর বেঁচে থাকাটাকে বোঝা। তার বদলে জীবনকে বোঝা করে তুললে তো মানুষ নিজই নিজের দম আটকে দিয়ে মারা যায়। আর সেই মারা তো শারীরিক মৃত্যু নয়। একজন ডাক্তার মানুষের শরীর যতটা বোঝেন, মন কি ততটা বুঝেন? মনের চেয়ে বড় হল জীবন। সেই জীবনের গভীরতায় কতটা কে যেতে পারে?
আমি আব্বাকে বলেছিলাম, ‘আপনি আমাকে আসলে কী করতে বলেন?’
‘আমি কী বলব। এখন তোমাকে আমার আর কিছু বলবার নেই। যখন বলেছিলাম, তখন কানে তোলোনি। দেখো, বিদেশে একটা ছেলে আঠারো বছর হওয়ার পর...’
‘বিদেশের কথা রাখেন। এটা বাংলাদেশ। সেখানে আঠারো বছর, এখানে আঠাশ না আটত্রিশ না কখনো আটচল্লিশ পার হয়ে যায় সেই বোধ বুদ্ধিতে যেতে। সেখানের সিস্টেম আলাদা। এখানে তো সিস্টেমই নাই।’
‘এত যদি বোঝ তাহলে নিজে নিজেরটা করে নিচ্ছ না কেন। আমি আমার নিজের জীবনটা করে নিয়েছি। তোমার জীবন তুমি কী করে করবে সেটা তোমার ব্যাপার। আমি যতটুকু তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল নিয়ে গেছি। এখন তুমি এম.এ পাম করেছে। আমার কথা না শুনে ক্রিকেট ক্রিকেট করেছো। তা-ই নিয়ে দিনরাত পার করেছো। সে-ই ক্রিকেট তোমাকে কী দিল? ঘোড়ার ডিম। ঘাড় ধাক্কা।’
কথাটা শুনে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমি একটা ষাঁড় হয়ে উঠি আর বাবা আমার সমানে লাল কাপড় ওড়ানো ম্যাটাডোর, সময়টা দুম করে হয়ে ওঠে লড়াইয়ের মাঠ। নাকি উলটোটা একটা অন্ধ ষাঁড় প্রচ- বেগে আমার ভেতরে দৌড়ে আসতে থাকে। আমার হাতে লাল কাপড়। কিন্তু আমি... আমি নিজেকে সামাল দিই। কারণ এছাড়া আমি আর কী করতে পারি। আমি এখন দুর্বল। দুর্বল ও প্রায় অর্থহীন হয়ে সবল ও অর্থবানের সঙ্গে লড়াই করা আত্মহত্যা ছাড়া কিছু নয়।
আমি দেখেছি, কোনো দিন একবারের জন্য, এক মুহূর্তের জন্য আমি আত্মহত্যার কথা ভাবতাম না। ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর এই আত্মহত্যার কথাটা বার বার আমার মাথায় ঘুরে ফিরে বেজে যাচ্ছে। সেটা ঠিক আমি নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে চাই সেজন্য না। আমি কেবল মনে করেছিলাম যেখানে আমার জীবনের পথ ছিল, সেখানে থেকে সরে আসার মানেই নিজেকে শেষ করে দেওয়া।
বাবার সেদিনের কথা ভেতরে, আমি টের পাই আমার সম্পর্কে একেবারে শুরু থেকে তার যে ধারণা তাতে এতটুকু কোনো বদল আসেনি। এজন্য আমি যে দায়ী, তাও আমি জানতাম। আমি আসলে কী-ই বা করতে পারতাম। বাবার কথা শুনলে আজকাল মনে হয়Ñ সত্যিই যেদিকে চোখ যায় চলে যাই। এমন কোনো জায়গা চলে যাই, যেখানে আমাকে কেউ চিনতে পারবে না। আমাকে নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা হবে না, কাউকে নিয়ে আমারও কোনো মাথা ব্যথা হবে না। আসলে আমার সে চলে যাওয়ার সাহসও নেই, সেই বাস্তবতাও নেই। হঠাৎ আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হয়, কেন মনে হয় তার কারণও তো আছে। হঠাৎ সারাহ্র কথাটা, ‘বিয়ে করে ফেলুন। বড় লোক, বা যে বউ আপনাকে চালাতে পারবে।’ এই কথার ভেতরের কথাটা কী। বাঙালির তো এক বিয়ে করা ছাড়া জীবনে আর কোনো গল্প নেই, অ্যাডভেঞ্চারও নেই। এখানকার সমস্ত কিছুতে সমস্যা যেন একটাইÑ বিয়ে। কে কাকে বিয়ে করবে? কীভাবে বিয়ে করবে? কেন করবে? এই নিয়ে সব কিছু ব্যস্ত। আমার মনে হয় এর ভেতরে সত্যও আছে, কিন্তু সেটাই পুরো সত্যি তো নয়। তারপর সারাহ্র কথাটা আমার মনে ভেতরে চট করে জেগে ওঠে। তার কাছে কি যাবো? আমি তো তার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মনে করেছিলাম, হ্যাঁ নিজে যদি আবারও যাক দেন তাহলে যাবো। কিন্তু সেই ডাক তো এল না। ঠিক কবে তার বাসায় গিয়েছিলাম? ভাইভাতে যাওয়ার দুদিন পর। তাহলে সেটা একসপ্তাহ আগে। তাহলে একসপ্তাহ যদি চলে যায়, তিনি তো মনে হয় আমার বিষয়টা আর মাথায় রাখেনি। আসলে বিয়ে করার ব্যাপার না। কদিন তিনি আমাকে আশ্রয় দিতে পারেন কিনা সেটা আমার জানা দরকার। এর ভেতরে আমি যদি চিন্তা ভাবনা করে কোনো কিছু একটা ঠিক করতে পারি তো হল, না হলে আমাকে নতুন কিছু একটা ভাবতে হবে। সেই নতুন কিছুটা কীÑ তাও তো আমি জানি না। কেউ বলে, জীবনে কোনো লক্ষ্যই থাকার দরকার নেই। পথই মানুষকে পথ দেখাবে। বরং জীবনে লক্ষ্য থাকার চেয়ে বিড়ম্বনা আর নেই। আমার তো সেই দশা, আমি তো আসলে কোনো লক্ষ্য শেষবধি ঠিক করতে পারিনি। পারিনি বলেই আমাকে এখন এই দশায় পড়তে হয়েছে। আমি জানি না আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। ‘একবার ভুল হয়ে গলে ঠিক করে নিতে অনেক সময় লাগে’Ñ এই সত্যটা আমার এখন বার বারই মনে হচ্ছে। আসলে শুরুতেইবা কী করতে পারতাম। শুরুতে তো কেউ শক্ত করে বাধা দেয়নি। একটা জিনিস আনন্দে থেকে নেশায় পরিণত হওয়া বা নেশা থেকে আনন্দ বা লক্ষ্যে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে আমি তো বুঝতে পারি না কোনখানটাকে আমি ঠিক ভুলের শুরু বলে ধরবো?
‘কাজটাকে সুখ করে নেওয়া, সুখটাকে কাজ করে নেওয়া’রও তো তত্ত্ব আছে। খেলাটাকে জীবন বলে মনে হতো। এই করে যে টাকা আসবে, বা বিখ্যাতটিখ্যাত হবো সেটা আসলেই ভাবিনি। সারাক্ষণ নতুন নতুনভাবে কোথায় বলটাকে কী করে পাঠানো যায়, আর বোলিংয়ের সময় তো একটাই লক্ষ্য আউট করা। এখন মনে হয় মানুষের কাজÑ একটা লক্ষ্যেই বোলিং করা। নাকি জীবনটা ব্যাটসম্যানের মতো? তোমার দিকে আবিরাম আসতে থাকবে সমস্যার একটার পর একটা বল, আর তোমাকে সেটা পাঠিয়ে দিতে হবে এমন জায়গা যেখান থেকে সেটা ফিরে আসার আগেই তুমি জায়গা বদল করে নিতে পারবে। ক্রিকেটে সেটা হয় বাইশগজ জায়গায় আর জীবনে সেটা কেবল সামনে দিকে যতদূর যাওয়া যায় ততদূর।
বয়স আমার যদিও ত্রিশের মধ্যে আছে। আসলে বাবা চাইছিলেনÑ আমি এখন নিজের মতো রোজগার করি। আর আমার ইচ্ছা ছিল ক্রিকেট নিয়ে নতুন কিছু ভাবার। আমি ক্রিকেটার হতে পারিনি কিন্তু একজন ভালো ট্রেইনার তো হতেই পারি। সেই মতো আমি নিজেকে তৈরি করছিলাম। কিন্তু আমি বুঝলাম আমাকে আসলে সরে যেতে হবে। রাগের মাথায় কোচকে এমন গালি দিলাম। কথাটা মনে পড়লেই লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চেয়েছিলাম। তিনিও ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটাকে খুব সিরিয়াসলি নেয়। মূল কারণ আমার সব ব্যাপারে প-িতি। পরে বুঝতে দেরি হয়নি সবাই চায় আমি সরে যাই। তখন কোচ আমাকে ঠান্ডা মাথায় সব কিছু ভাবতে বলে। আমি জানি তিনি নিজে আমার পক্ষে ছিলেন, সেটা তার উদারতা। আমি যদিও জানি না আমি সরে গেলে অন্যদের কী লাভ। কিন্তু আমার যে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, এবং তা এতটা তা আমি বুঝিনি। আমি সরে আসা মাত্র আমার জায়গায় আরেকজন লোক কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। জগতের কারো জন্য কোনো জায়গা খালি পড়ে থাকে না সেটা আরেকবার টের পাই।
এই ব্যাপারটাতেই আমার মু-ু ঘুরে গেল। আমি ভেতরে ভেতরে দিশাহারা হয়ে পড়লাম। তাহলে এখন আমার কী কাজ। সত্যি বলতে কী বিষয়টা আমাকে আসলে ক্লান্তও করে তোলে। একটা জিনিস নিয়ে বেশি ভাবলে সমস্যাও হতে পারে। কিন্তু আমি কিছুতেই মাথা থেকে সেটা দূর করতে পারছিলাম না। এবার ভাবি ক্রিকেটের ওপর বইগুলো নামিয়ে নিয়ে আসি। না হয় নাই আর ক্রিকেট জীবনে এল। আমি ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকি। পরে মনে হল, তাতে চিন্তাটা হয়তো আরো বেড়ে যেতে পারে। কোনোভাবেই চিন্তাটাকে চাগিয়ে দিলে বিপদে তো আমিই পড়বো।
আমার কখনোই কোনো খারাপ অভ্যাস ছিল না। সিগারেট খাইনা। মদ গাঁজা আরো যা যাÑ সেসবের তো প্রশ্নই ওঠে না। কখনোই মনে হয়নি এধরনের একটা নেশা থাকলে ভালো হতো। আসলে যখন টাকা পেয়েছি, বন্ধুদের খাইয়েছি, নয়তো দামি দামি সব বই কিনেছি ক্রিকেটের ওপর। একমাত্র মাকেই দেখতাম আমার এই বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে।
ও হ্যাঁ, মায়ের কথাটা বলা হয়নি। বাপের মতো আমরা আসলে যার যার মাকেও তেমন একটা চিনি। আর আমরা বাঙালিরা তো মাকে এমন একটা ভক্তির জায়গায় রেখে দিয়েছি যে তার আড়ালে মা যে আসলে একটা মানুষ, তারও যে নানান চাওয়া পাওয়া কামনাবাসনা থাকতে পারে, সেগুলি কখনোই আমাদের মাথায় আসে না। কেউ এটা সহজের ভাবতে পারে না মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ে এবং পরবর্তীকালে তাদের সেক্স করার ভেতর দিয়েই আমাদের জন্ম। অবশ্য এটা ভেবেও কি আর না ভেবেও কি। মা আমাকে একটা সাংঘাতিক কথা বলেছিলেন,‘‘জীবন ভক্তি দিয়ে চলে না, চলে ভয় দিয়ে।’’ আমিও দেখেছি এই ভয় আমার মাকে শেষ করে দিয়েছে। এখন শেষ করে দিচ্ছে আমাকে। আমার বাবার একবারে তরুণ বয়সে নাকি বেশ প্রেমিক প্রেমিক ভাব ছিল। বান্ধবীর ছিল বেশ। একটা গেলে আরেকটা আসতো। বাবা তো দেখতে বেশ সুর্দশন ছিল। তারওপর ডাক্তার। একবার তার ইচ্ছা হয়েছিল নায়ক হওয়ার। তখন কেবল ডাক্তারি পাশ করেছেন। ঢাকার একটা থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে কিছুদিন নাটক করাও চলল। এই সময় তার রোগী হয়ে আসেন এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সার্জান বলে কথা। গোপন জায়গায় অপারেশান। তরুণ তায় সুর্দশন ডাক্তার, দেখে তো অভিনেত্রীর পছন্দই করে ফেলেন। যে পরিচালক তাকে সিনেমায় এনেছিলেন ডাক্তারের চোখ দুটো বলে একেবারে অবিকল। ‘তাই তোমাকে দেখে বিকল হইয়া গেলাম।’ পরিচালক অনেক আগেই মারা গেছেন। ডাক্তারের যেখানে বাসা তার খুব কাছেই থাকেন ওই অভিনেত্রী। বললেন অবশ্যই তার বাসায় যেতে। কদিন গেলেন। রাজ্যের লোকজন সেখানে আসে। সবই প্রায় উচ্চশ্রেণির লোকজন। নামকরা লোকজন। যদিও ডাক্তারকে নিজের ওই ড্রইংরুমে বসিয়ে আলাপ করেছেন, কিন্তু ডাক্তারে বুঝতে বাকি থাকেনি যে তার এই বাড়িতে চলে জুয়ার আসর, মদ আর অন্যান্য নেশা, আর নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশা। কেউ কেউ বাইরের মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতেও আসে। একবার নেশা করে তিন জনপ্রিয় অভিনেত্রী তো ডাক্তারকে প্রায় ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এরপর থেকে ডাক্তার আর ওই বাসায় যায়নি। তরুন বয়সে ডাক্তারের জীবনের নীতি ছিল: ‘আমি যখন সামনে পা দিবো, তখন পেছনের পায়ের ছাপ মুছে ফেলবো।’ কোনোদিন তিনি নিজের স্কুল কলেজের, এমনকি মেডিকেল কলেজে আর যাননি, কোনো অনুষ্ঠানেও না, বন্ধুরা কত বলেছে রিইউনিয়নে, হ্যানত্যান অ্যাসোসিয়েশানের প্রোগ্রামে আসতে। যাননি। সেই ডাক্তার বিয়ে করেছিলেন অতি সাধারণস্য সাধারণ আমার মাকে।
মা এমন এক মানুষ যে ঘরে আছেন কিনা তাই টের পাওয়া যেত না। একেবারে নিঃশব্দে সব কাজ করতেন। কাউতে এক ফোঁটা বিরক্ত করতেন না। কিন্তু কখন কার কী লাগবে সেটা জানতেন। যা একটু আধটু কথাবার্তা বলতেন মোটামুটি আমার সঙ্গে। আমি তার বড় ছেলে। বাঙালি মায়েদের বড় ছেলের প্রতি বলে আলাদা টান থাকে। মাকে দেখতাম ঘরের কাজ শেষ হলে, বা শেষ করে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে বা সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে রবীন্দ্রনাথ পড়তে। আমি জীবনে অদ্ভুত মানুষ খুব যে দেখেছি তা তো নয়, আমার মা ছিলেন সত্যিই অদ্ভুত। ঘরের বউ টাকা জমিয়ে রবীন্দ্ররচনাবলী কিনে কিনা আমি কোনোদিন শুনিনি। তিনি বলতেন, রবীন্দ্রনাথ হল মন শান্ত ও ধ্যানস্থ করার জন্য। সত্যজিতের প্রায় সব ছবি দেখেছিলেন মা। আর কোনো সিনেমার প্রতি কোনো টান ছিল না। আমি মাঝে মাঝে এই সময়ের ভারতীয় বাংলা ছবির ডিভিডি নিয়ে তাকে দিয়েছি। নিজের ঘরে একটা টেলিভিশন আর একটা ডিভিডি প্লেয়ার ছিল মায়ের, সেগুলিও টাকা জমিয়ে কেনা। একটা ব্যাপার হলÑ মাকে বাবা তার রোজগারের পুরো টাকাটাই দিতেন। মা যা খরচ হতো সেটা বাদ দিয়ে মাস শেষে বেঁচে যাওয়া টাকা বাবাকে দিতেন। বাবা মাকে সেখান থেকে আবার কিছু টাকা দিতেন মায়ের নিজস্ব খরচের জন্য। ওই টাকা জমিয়ে আবার মা তার এইসব শখ মেটাতেন। বাড়িতে কেউ না থাকলে চুপ করে গান শুনতেন। সেই আদ্যিকালের কী সব রেকর্ড জোগাড় করে দিয়েছিলেন বাবা। আমি ঠিক জানি না, তবু মনে হয়, দুজনের মধ্যে নীরব একটা মায়া ছিল, প্রেম ছিলো কিনা বলা মুশকিল।
পুরোনো গ্রামোফোনও ছিল আমাদের বাসায়। নানার বাড়ি থেকে যে একটা জিনিস মা নিয়ে এসেছিলেন এটি ছিল সেই জিনিস। ও বলা হয়নি, মা আমার নানার একমাত্র সন্তান ছিলেন। একমাত্র সন্তান হলে কেউ কেউ এমন ব্যতিক্রম হয় আমার মা ছিলেন তাই। জগতের কোনো কিছু সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য ছিল না। আসলে ছোটবেলা থেকে কোনোদিন এতটুকু অভাবে ছিলেন না। না চাইতেই সব পেয়েছেন। মাকে কোনো দিন এতটুকু চেঁচিয়ে কথা বলতে শুনিনি।
মা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন আমরা কেউ বাসায় ছিলাম না। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে। মা সব সময় বলতেন, সুস্থ থাকতে থাকতেই মরে যেতে চাই। নিজের হাতে নিজের শৌচকর্ম যতদিন করতে পারি ততদিন অন্তত। কিন্তু এত আগে মা চলে যাবেন আমরা কেউ ভাবতে পারিনি। পরে টের পেয়েছিলাম মা আসলে নিজেকে একটি শান্ত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আর তা-ই তিনি করতে পেরেছিলেন। আমি কেবল রবীন্দ্ররচনাবলী শেষ খ-টিতে পেন্সিলে লেখা একটা লাইন পেয়েছিলাম, আজ এত বছর পর একটু একটু করে পড়ে এখানে এলাম। নিচে তারিখ লেখা আর কোনো কিছু নেই। মা কোনো ডায়েরি রেখে গিয়েছিলেন কিনা। সেটা খুঁজে দেখবার সময় আমাদের ছিল না। সময় তো কত কিছুর জন্যই থাকে না। মায়ের ডাইরি থাকলে আমার জন্য অন্তত লাভ হতো। কিন্তু আমি এ কথাই বা কাকে জিজ্ঞাসা করবো। নিজের মতো খুঁজে গেলে খুঁজেত পারি। এছাড়া ছোট ভাইকে বা বোনকে বলতে পরবো নাÑ আচ্ছা, মায়ের কোনো ডায়েরিটায়েরি আছে নাকি? বাবার কাছে তো জানতে চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অদ্ভুত! আমি বরং সবার সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে চাইতাম, কিন্তু ভাই বোন দুটোই কেমন যেন গুটানো ছিল নিজের ভেতরে। লোকজনের সঙ্গেও মেলামেশা করতে না। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। পড়ালেখা আর বাসাবাড়ি, ব্যাস। আর কোনো দিকে তাদের নজর ছিল না। বাপের তো এমনিতেই কারো সঙ্গে কথা বলার সময় নাই। তাই সবমিলিয়ে আমার কথা বলার লোক ছিল মা। মার ধাতটা আমি জানিÑ নিজে যেচে খুব একটা কথা বলতে চান না। কিন্তু যখন বলতেন, খুব আন্তরিকভাবে কথা বলতেন। মা চলে যাওয়ার পরে আর কারো কিছু শূন্য হয়েছে কিনা জানি না আমার ভুবনের একটা অংশ শূন্য হয়ে গেছে।
৪. সারাবান তহুরা
আমি সব সময় ব্যর্থ লোকদের এড়িয়ে চলি এবং ক্ষমতাবানদের পছন্দ করি। কিন্তু তাই বলে আমি আমান ডেভিডের মতো ক্ষমতাবানদের এড়িয়ে চলতে চাই। আমান নিজেও বলেছে, সে অশিক্ষত, মূর্খ, বাজে লোক, কেবল আমি চাইলে সে ভালো হয়ে যাবে। ভদ্র হয়ে যাবে। তারপরও আমি তাকে পাত্তা দেই না। সে বলেছে, আমার জন্য মরণ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আর ততদিন সে তার যে বউ আছে, তাকে ছাড়বে না। তার বৌ আমার কাছে এসেছিল, ‘আপা, আপনি কেবল শক্ত থাইকেন। ওর ওপরে ওপরেই যত চোটপাট। ওর খুব খারাপ লোক না। আপনার জন্য সে পাগল। জানেন না আপনার একটা ছবি সে শহরের নামী আর্টিস্ট দিয়ে আঁকিয়ে টানিয়ে রেখেছে।’ আমানের বৌটা অদ্ভুত। ভয় পায় আবার মায়াও করে। ওর বৌ আমাকে কথায় কথায় হঠাৎ বলেছিল, আমান বলে খুব সুখ দিতে পারে। ‘এজন্যই তারে ছাড়তে মন চায় না।’ অনেক পরে আমি আমানকে বলেছিলাম, চাইলে সে আমার কাছে মাঝে মাঝে আসতে পারে। আমার সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। সে আমার কথা শুনে ভয়ই পেয়েছিল। স্পষ্ট করে বলা আছে, তাকে আমার বিয়ে করা সম্ভব নয়। এই কথাটা আমি যেকোনো ক্ষমতাবানের মুখের ওপরই বলতে পারি।
আমি সব সময় ক্ষমতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যহত রাখি। জহতরকেও আমার ব্যর্থ মনে হলো। আবার মনে হলো চাইলে জহরতও ক্ষমতাবান হতে পারে। বয়স কম, সামনে পুরো সময়টা পড়ে আছে। ত্রিশও হয়নি, নতুন করে সব কিছু শুরু করাটা ওর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। ওর প্রতি কেমন একটা টান তৈরি হয়েছে কী সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না, সেটা মানসিক না শারীরিক? শারীরিক একটা তীব্র টান পুরুষ মানুষকে নিয়ে বোধ করলেও ইচ্ছা না জাগা পর্যন্ত আমি সেদিকে এগুই না। আর সেটা তো যেকোনো পুরুষ মানুষকে নিয়ে তৈরি হয় না। আমাদের এক আপা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি কবিতায় লিখেছিল: ‘‘জগতের সমস্ত পুরুষের প্রতিটি লোমকূপ আমি দশনখে পরীক্ষা করতে চাই/ যদি না পারি তো/ কে সত্যিকারের পুরুষ তা আমার কোনো দিনও জানা হবে না।’’ আমারও মতও অনেকটা এমনই। আমার সব সময় মনে হয়, আমি আমার ইচ্ছাগুলিকে চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর সেজন্য আমি নিজে পারতপক্ষে কোনো পুরুষমানুষের সঙ্গে একান্তে কথা পর্যন্ত বলি না। হ্যাঁ যাদের আমি জানতে চাই, তাদের তো নারী-পুরুষ ভেদ নেই। তার কেবল জানার জন্য, এর সঙ্গে জৈবিকতার বা দৈহিকক্ষুধার কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও আমার নামে নানান বদনাম আছে। আমি আসলে মাঝে মাঝে এমন করে বাসায় ডেকে নিয়ে এসে তাদের সঙ্গে কদিন ধরে আলাপ করি। আমি দেখেছি, তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, একটা পর্যায়ে তারা নিজেদের ভেতর থেকে খুলতে শুরু করে। তাছাড়া তারা কী খেতে পছন্দ করে সেটা আমি তাদের জন্য রান্না করি, বা ভালো কোনো হোটেল থেকে আনাই।
জহরত বলেছিল, ওর ফ্রাইড রাইসের গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ওর ক্ষুধা জেগে ওঠে। এরকম করে প্রায় সবাই তাদের প্রিয় খাবারের কথা বলে। আমি একটা জিনিস অপ্রতিরোধ্য সত্য বলে মানি যে, মানুষের হৃদয়ে যাওয়ার রাস্তা পেটের ভেতর দিয়ে গেছে। তাছাড়া ঢাকা শহরে আজকাল তো আর কেউ, অচেনা কেউ তো দূরের কথা, নিজের ঘরের মানুষই আর জানতে চায় না, কে কী খেতে পছন্দ করে। বলে না নিজেকে থেকে, আজ তোমার পছন্দের এটা রেঁধেছি। তুমি খুব পছন্দ করো তাই। আগে এসব ছিলÑ প্রিয় রান্না করে প্রিয় মানুষকে খাওয়ানো। আগে এমন কি যাদের সামর্থ্য কম, তারাও প্রিয় মানুষকে হঠাৎ করে তাদের প্রিয় রান্না করে অবাক করতো। সেইদিন এমন ‘না চাইতে বৃষ্টি’র মতো পছন্দের প্রিয় খাবার পেয়ে যার পর নাই আহ্লাদিত হতে হয়।
আসলে আমার যে মানুষের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়, তাদের তো বটেই, চেনা-অচেনা মানুষকে জানতে সব সময় ইচ্ছা করে। প্রবাদে বলে, কাউকে চিনতে হলে হয় তার সঙ্গে সফরে যাও, আমার সেটা সম্ভব নয়। আমি ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে পছন্দ করি না। কলেজ আর বাসা ছাড়া আমার আর কোনো জগত নেই। আমি আসলে কোথাও নিরাপদ বোধও করি না। আর ইদানীং যেভাবে গাড়িতে পেট্রেল বোমা মারা হচ্ছে! বাস-গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিছু হলেই ভাঙচুর, তাতে তো আমি কোনোভাবেই চাই না বাইরে বের হতে। তারওপর লাগাতার হরতাল। কেন লেগে আছেÑক্ষমতার জন্যই? লোকজনের কথা নাকিÑ ‘নামাতে না পারলে থামেন, থামাতে না পারলে নামেন।’ আমি কেবল জানি আজ হরতাল। দিনের পর দিন কলেজে ক্লাস নেই। একটা রিক্সা আমাকে গুলশানে নিয়ে যায়। একমাত্র ওই মেয়েটাকেই আমি পড়াচ্ছি। তাও অন্য স্কুলে পড়ে বলে। নিজের স্কুলের কাউকে আমি পড়াইনি, পড়াই না। কিন্তু এখনতো পড়ানো বন্ধ। কতদিন চলবে এসব। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশানজট ছিল, সেটি এখন স্কুল কলেজেও শুরু হয়ে যাবে কিনাÑ মনে মনে সেই আশঙ্কা করি। আমি এর বাইরে কোনো কিছু জানি না। পড়ার ভেতরে বইপত্র পড়ি। রাসেলের লেখা খুব ভালো লাগে। আমি একসময় মনে করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ দিয়ে নিজের জগৎ ভরিয়ে রাখবো। সেটা তাঁর গান দিয়ে পারলেও অন্য কিছু দিয়ে হচ্ছে না। অন্যরকম কিছু চাই। হ্যাঁ আমি মানি, রবীন্দ্রনাথ নিজের মতো আধুনিক। আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর প্রিয় মানুষ ছিলেন আহমদ রফিক। আমার খালাশাশুড়িকে তার কাছে কী একটা অসুখের সময় নিয়ে গেলে পর আলাপ। ডাক্তার মানুষ, এত বইপত্র পড়েন, তারওপরে কবি-লেখক, বিস্ময়কর। তার কাছে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্র সম্পার্কে প্রশ্ন করে জানতেন। নানান বইপত্র আনতেন। আমাকেও পড়তে বলতেন। কিন্তু যেই না সরকার বদল ঘটল, আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী পড়ে গেলে গ্যাঁড়াকলে, সেখান থেকে বাঁচতে তিনি ব্যবস্থা করলেন ফিলিপাইনে যেতে। তারপর তো যা হলো। আমি কয়েকটা দিন তো অন্ধকার দেখলাম। ধাতস্ত হতে মাস খানিক লেগেছিল। সেটা একটা মানুষ করতেই পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা নিজের পরাজয় বলে মনে হল। আমি পরাজিত ব্যর্থ মানুষ একেবারেই দেখতে পারি না। আর সেই আমি নিজেই পরাজিত হলাম?
অবশ্য এর মূলে একটা গভীর ব্যাপারও আছে। সেটা আমার নিজের জীবনে আমি জানি। হ্যাঁ, একথটা আমি এখনো কাউকে সহজে বলি না। আমার বাবাকে ফেলে আমার মা হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ জানতো না। কেউ কোনো দিন জানতে পারেনি তিনি কোথায় গেছেন। একেবারে রহস্যময় ব্যাপার। আব্বু সে সময় খুব মদ খেতে শুরু করেন। আব্বু প্রায়ই বলতেন, আমার মুখটা মায়ের ডুপ্লিকেইট কপি। মায়ের মতো আমার কটা চোখ। গায়ের রঙ কালো। পার্থক্য কেবল মা বলে পাতলাপুতলা ছিলেন, সে তুলনায় আমি দোহারা গড়নের। মা যখন আমাদের ছেড়ে উধাও হয়ে যায়, তখন আমার বয়স একেবারেই কম। মানে হয় তিন কি চার। মায়ের কোনো স্মৃতি আমার নেই। মায়ের কোনো ছবি আমার বাবা তার অ্যালবামে রাখেনি। নানাবাড়ি সেই সাতক্ষীরা। কোনো দিন সেখানে যাওয়া হয়নি আমার। মামারাও কোনে দিন আমার খোঁজ নিতে আসেননি। পরে বাবা তো আরেকটা বিয়ে করেন। এই মায়ের আগের ঘরের দুটো ছেলে ছিল। আমার বাবার ঘরে এসে তার আরো দুটো ছেলে হয়। তিনি আমাদের পাঁচভাইবোনকে একেবারে আপন সন্তানের মতো মানুষ করেছেন। তার নিজের একটা মেয়ে হল না বলে এই মায়ের একটা দুঃখ ছিল, আমাকে পেয়ে সেটাও ভুলেছিলেন। আমাকে বলতেন, আমি বলে তার মনের মতো মেয়ে হয়েছি।
আমি ছোটবেলা থেকে লক্ষ্মী মেয়ে ছিলাম। কারো কথার অবাধ্য হতাম না কখনো। বাইরে বাইরে আমি যত বাধ্য মেয়ে হয়ে উঠছিলাম, ভেতরে ভেতরে আমি ততটাই প্রচলিত সব কিছুর প্রতি অবাধ্য হয়ে উঠছিলাম। এমন সব অস্থিরতা আমার ভেতরে দেখা দিল। আমি সেটা বাইরের লোকজন আবার বুঝে ফেলবে, আমি সেটা চাইনি। খুব অল্প বয়সে এই মায়ের বড় ভাই, স্কুলে পড়াতেন, তাকেই বড় মামা বলে আমি জেনেছিলাম। ছুটিতে নানার বাড়ি, নানা তখন বেঁচে নেই বলে, মামাবাড়িই বলতাম, সেটাই ছিল আমার কাছে বেহেস্তের মতো। দোতলা, চারপাশে বাগান, কী খোলামেলা। দোতলার একটা কোনায় মামার ঘর। সেখানে দুটো বইয়ের র্যাকে গাদানো বইপত্র। মামা বলতেন, একটা র্যাক দেখিয়ে বলতেন, এই র্যাকের কোনো কিছু পড়বি না। ওই র্যাকটা থেকে যা খুশি পড়বে। আমি মামা যে র্যাকটা থেকে বইপত্র পড়তে নিষিধ করেছিলাম, সেখান থেকে সব বড়দের বইপত্র বের করে চুরি করে পড়তে শিখেছিলাম। নারীপুরুষের এমন সব কাহিনি! আমি একেবারে হা। পড়তে পড়তে এমন অস্থির লাগতো। ওইসব বই আর ম্যাগাজিনের ভেতরে খেলামেলা ছবিও থাকতো। কয়েকটা চুরি করে ঢাকা নিয়ে এসেছিলাম। লুকিয়ে পড়তাম। যত পড়তাম তত অস্থির লাগত। নেশার মতো টানতো ওই বই। তক্কে তক্কে থাকতাম রাজশাহী করে যাবে। আমের দিন এলে তো কথাই নেই। হৈ চৈ করে আমরা চারভাই আর আমি রাজশাহী যেতাম, মাও খুব মামাবাড়ি যেতে ভালোবাসতেন। আমার তো উদ্দেশ হল মামার ওই নিষিদ্ধ বইয়ের র্যাক। তারপর তো একদিন ধরা পড়ে যাই। মামা খুব করে বকবে মনে করছিলাম। কিন্তু মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বোঝালেন। কত কী বললেন। সময় হলে সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। এখন তোমার সময় আসেনি। যেদিন বড়ো হবে আমিই তোমাকে এইসব বই দিয়ে আসবো কেমন। বড় মামা ও মামী সংসার খুব সুখের ছিল। দুজনেই খুব হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত ছিলেন, এর কারণ তাদের শারীরিক সম্পর্ক বলে ভীষণ ভালো ছিল। মামার একটাই ছেলে। ইমনভাই। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হন। মামামামী বলে বুড়ো বয়সেও আগের মতোই সক্রিয় আছেন। তাদের ভালোবাসাবাসি শেষই হয় না। এসব শুনতাম নানানভাবে। মামীর বোনেরা, বোনের মেয়েদের আলাপ থেকে এসব কানে আসতো।
আমার সেই যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তাতো আর সহজের কাটল না। ডাক্তার লুৎফর রহমানের ‘শিষ্ঠাচার’ না কী একটা লেখায় ক্লাস সেভেনের দিকে পড়েছিলাম, ‘তরল চিন্তা একবার যার মাথায় ঢোকে তার আর রক্ষা নাই।’ আমার সত্যিই আর রক্ষা হয়নি, যদিও সেই সময়ের অস্থিরতা দূর করতেই আসলে অঙ্ক করাটাকে বেছে নিয়েছিলাম। দেখলাম একমাত্র অঙ্ক করার সময় আমি সব কিছু ভুলে যেতে পারি। এর ভেতরে যাকে বলে নিবিষ্ট হওয়া তাই হতে পারি। বলতে গেলে অঙ্কই আমাকে রক্ষা করে।
আব্বুর সাহিত্যপ্রীতি, আধ্যাত্মিকতা, সেটি ঠিক ধর্মীয় নয়, সুফিবাদী কিছুটা বৌদ্ধঘরানার, কিছুটা তান্ত্রিক। আসলে মা চলে যাওয়ার পর তিনি ধুমছে মদ খাওয়া শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে নিজেকে তুলে আনতে এই সুফিবাদে চলে এলেন। জীবনের অন্য এক নেশা আছে। জীবন সেখানে ডুবে যেতে পারে। মদে চুর হয়ে পড়ে থাকা জীবন কাউকে আসলে কিছুই দেয় না, বরং মদই তাকে খেতে শুরু করে।
আব্বু আমাকে তার জীবনের সবকিছুই বলেছিলেন। আমি তার প্রথম সন্তান। আমি তার রহস্যময় অন্তর্ধান ঘটানো মারাত্মক আকর্ষণীয় স্ত্রীর একমাত্র স্মৃতি। অনেক পারে আব্বু বুঝেছিলেন, তার স্ত্রীর হয়তো এমন কিছু হয়েছিল, যাতে তিনি আর স্বামীকে কিছু দিতে পারতেন না, বা এমন কোনো অসুখ, বাবার এই উপলব্ধি মায়ের প্রতি রাগকে দিনে দিনে কেবল একেবারে থিতিয়েই দেয়নি, অন্য এক চেহারায় তার আগের সবকিছুকে মুছে দিয়ে নতুন করে দিয়েছিল। বাবার কাছে শিখিছি, যেকোনো মানুষকেই একাপাশ দিয়ে দেখা বড়ই ভুল দেখা। মানুষকে দেখতে হবে সবদিক থেকে। যাকে বলে কিনা দশ দিক থেকে। ওপরে-নিচে কাছে-দূরে সব রকম দূরত্বে মানুষকে দেখতে হয়, দেখতে পাবে যদি তুমি কাউকে দেখতে চাও।
প্রত্যেকটা মানুষের অমিত সম্ভবনা আছে কিনা জানি না, কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষই দারুণ ইন্টারেস্টিংÑ এটা মানি। মানুষের ভেতরের মানুষটা যখন বেরিয়ে আসে তখন দেখা যায়, অন্যদের সঙ্গে তার প্রায় মিলে যেতে যেতেই এমন একটা জায়গা থাকে যে, সেখানে আর মিলে না, বা এমন একটা জায়গা থাকে তার পেছনে থাকে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা স্মৃতি প্রেক্ষাপট এবং একেবারই আলাদা বাস্তবতা। ফলে প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা আলাদা সত্য থাকাই স্বাভাবিক। মানুষের কোনো ধর্ম থাকারই কথা ছিল না, যদি মানুষ এভাবে নিজের সত্যগুলি নিজে চিনে নিতে পারতো। তখন বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার বদলে আরো শান্তি ফিরে আসতো, প্রত্যেকে প্রত্যেককে বুঝতোÑ অন্যেরও আমারই মতো আলাদা অনুভূতি, আলাদা দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেটাকে সম্মান না করলে আসলে পুরো মানুষটাকেই হেয় করা হয়।
আমি যখন দেখলাম জহরতের ভেতরে আলাদা মানুষ একটা জেগে উঠতে চাইছে, সে আসলে নির্ভরতার জায়গা খুঁজে, তাতে তাকে ব্যর্থ মনে হলেও একই সঙ্গে মনে হল ইন্টারেস্টিং। (এই ইন্টারেস্টিং শব্দটার বাংলা হয় আগ্রাহজাগানিয়া, নাকি চমকপ্রদ?) আমি এজন্য জহরতের ফোন নম্বরটা টুক করে তুলে নিয়েছিলাম। আর নিশ্চিত ছিলাম সে আমার ডাকে সাড়া দেবে। তারপরও মনে হচ্ছিল একধরনের জেদও তাকে পেয়ে বসতে পারে। সেই জেদ হল, আমি জগতের আর কাউকে চাই না। আমার পথ আমি নিজেই তৈরি করে নেব। কাউকে আমার লাগবে না। জহরতের যে সেটা ভেতরে ভেতরে পুরোটাই আছে আমি বুঝতে পারি। সে আমার সঙ্গে আলাপ করার সময় বলেছিল, সে সত্যিই জানে না জগতের তার প্রতি সত্যিই আগ্রহ আছে কজন মানুষের? কটা মানুষ তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতে চেয়েছে। কে তাকে ভালো করে চিনতে পারে? তার বাবা? যে মা তাকে জন্ম দিলেন, তিনি হয়তো তাকে ভালোবাসাতেন কিন্তু চিনতেন কি? কাউকে ভালোবাসলেই তাকে চেনা যাবেÑ তাতো নয়, বা কারো সঙ্গে চেনা থেকে জানা এবং জানা থেকে ভাব হবেÑ এই পরম্পরা তো সব সময় নাও মিলতে পারে। আর খুব বেশি হলে ভেতরের এই চেনা জানার ব্যাপারটা একজন ব্যক্তির সঙ্গেই আরেকজন ব্যক্তির হয়তো ঘটতে পারে। আমির সঙ্গে তুমির। অন্য সবার কাছেই ব্যক্তি যে মানুষটা সে আড়ালে পড়ে যায়। এজন্য কেউ মারা গেলে যে বড় স্মারকগ্রন্থ হয়, আমি দেখেছি, যেমন আমাদের স্কুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক মিল্লাত হোসেন তরফদার মারা গেলেন, তাকে নিয়ে একটা বিরাট বই প্রকাশিত হল, তাকে যে বাংলাদেশের এত সব বিখ্যাত ব্যক্তি চিনতেন তাই তো আমি বা আমরা তো জানতাম, কিন্তু তাকে নিয়ে যে এত লেখার বিষয় আছে সেটা জানতাম না। এদের অনেকেই তাকে নিয়ে লেখা লিখেছিলেন, কিন্তু আমি দেখলাম কেউ তার ভেতরের মানুষটাকে জানেন না। কেবল তার এক পুত্রের লেখাতে তার ভেতরে মানুষটাকে একটু পাওয়া গেল, কিন্তু তার কয়েকটা দিকের বা স্বভাবের লেশ মাত্রও পাও গেল না। তাকে প্রায় ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে প্রায় মহামানবের স্তরেই আরেকটু হলে প্রত্যেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। ছিলেন বিশাল ধনী, অপরিমত সম্পদ। এই লোকটিকে আমি চিনেছিলাম, জেনেছিলাম কিছুটা।
৫. মিল্লাত হোসেন তরফদার ও সারাহ্
প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি হজ্বে গেলেন। কদিন খুব আল্লাবিল্লা করলেন। বয়স তখন মাত্র পঞ্চাশ কিন্তু দেখলে পঁয়ত্রিশও মনে হবে না। বলিষ্ঠ শরীর। লম্বায় বাঙালিদের চেয়ে গড়ে বেশি, প্রায় পাঁচ ফুট আট নয়ের মতো। চওড়া পেটানো শরীর হওয়ায় লম্বাটা বোঝা যায় না। হজ্বের পর তিনি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হলেন। বিপুল বিত্তের কারণে পার্টি তাকে এম.পি ইলেকশানের টিকেটও দিল। তিনি পাশ করলেন। আমাদের স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি হলেন। রইলেন পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে আমাকে যে তিনি এতবার দেখতে চেয়েছেন, আমার সম্পর্কে এত কিছু জেনে নিয়েছেন, আমি তো কল্পনাও করিনি। তার পার্টি পরের নির্বাচনে হেরে যায়। তিনিও ভোটে হারেন। যদিও তার মতে, তাকে হারানো হয়েছে। দেশে তখন থমথমে অবস্থা। আমার মনে আছে নির্বাচনের ঠিক সন্ধ্যাবেলাটা মনে হচ্ছিল সমস্ত প্রকৃতি যেন থম মেরে আছে। রাস্তা ঘাটে কোনো গাড়ি নেই। লোকজনও দেখা যাচ্ছে না। এর ঠিক দুদিন পরে হঠাৎ তিনি আমাকে ফোন করলেন। আমি তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। এটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তাঁর মতো এত বড় মানুষ। শুনেছি এত ভালো মানুষ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বললেন! বললেন, ‘আমি একটা গাড়ি পাঠাচ্ছি। আপনি আশা করি কোনো আপত্তি করবেন না। আমার আপনার সঙ্গে একান্ত এবং অত্যন্ত জরুরি কথা আছে।’ আমাকে কোনো কথা বলারই সুযোগ দিলেন না। ‘দয়া করে কিছু জানতে চাইবেন না। শুধু চলে আসুন। এতটুকু বলতে পারি আপনাকে কোনো অসম্মান করা হবে না। তবে না যদি আসতে চান আমি যারপরনাই কষ্ট পাবো মনক্ষুণœ হবো।’ এত ভদ্র ও মার্জিতভাবে তিনি কথা বললেন, আর আমার ভেতরে জেগে উঠল মানুষকে জানার সেই অ্যাডভেঞ্চার। দেখিই না কী হয়, মানুষটা আসলে কেমন।
তিনি আমাকে যা বললেন, সত্যিই বিস্ময়কর। বলেছিলেন, ‘আমি এখন এক রকম ক্ষমতাহীন। কিন্তু ক্ষমতা কী জিনিস আমি জেনেছি। আমি এখন ক্ষমতা নয়, শান্তি চাই। আর এজন্য চাই আপনার সহযোগিতা।’ আমি বলেছিলাম, আমি তাকে কী ধরনের সহযোগিতা করতে পারি। যদিও আমি তার কথার ভেতরেই বুঝতে পেরেছিলাম, একজন স্বামী পরিত্যাক্তা যুবতী নারীর কাছে তিনি কী চান। তিনি বলেন, ‘আপনাকে আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মনে করি। আপনি স্কুলের একটি সভায় আপনি কী বলেছিলেন মনে আছে?’ আমার মনে পড়ে আমি আসলে সেদিন অনেক সাহস নিয়ে কথাগুলি বলেছিলাম। তখন আসলে ওই কথাগুলি এত বলতে ইচ্ছা করেছিল। অর্গলখুলে দিয়ে বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমাদের বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার জন্য মাত্র তিনটি জিনিস চাই, সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য আর সুস্থ-সবল মন। ভালো স্কুলই পারে সেই সুশিক্ষা দিতে, আর সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই প্রত্যেকটি এলাকাতে খেলার মাঠ এবং সুস্থ-সবল মানের জন্য চাই লাইব্রেরি। আমরা মনে করি আমাদের নতুন এমপি মহোদয় এই তিনটি যাতে আমাদের এলাকায় প্রতিটি স্কুলে নিশ্চিত করেন। এবং তাকে দেখে শিখে পুরো দেশের মানুষ এই তিনটি জিনিস প্রতিটি এলাকায় তাদের বাচ্চাদের জন্য নিশ্চিত করবেন।’
মিল্লাত সাহেব বলেন, ‘আপনাকে কিন্তু আমি দীর্ঘ দিন ধরে খেয়াল করছি। আপনাকে যতটুকু বাইরে থেকে জানা সম্ভব আমি জেনেছি।’
‘কী রকম?’
সদ্য ভোটে পরাজিত হওয়ার কোনো ছাপ তখন তার চেহারায় ছিল না। বরং একটা প্রশান্তিই দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল ভোটের ব্যাপারটা তিনি একেবারে ভুলে গেছেন। তিনি কিছুক্ষণ পর পর একটু একটু করে তার হাতে থাকা গ্লাস থেকে পানি খাচ্ছিলেন, সেটাতে কেবল বোঝা যাচ্ছিল ভোটে হারা নিয়ে তিনি যত না চিন্তিত, আমি তাকে কী বলি বা তিনি আমার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবেন বা আমাকে কী করে ট্রিট করবেন, সেটা নিয়েই তিনি বেশি চিন্তিত।
তিনি বললেন, ‘দুটো ব্যাপার বললেই আশা করি আপনি বুঝতে পারবেন। একটি হল আপনার মা আপনার খুব ছোটবেলায় আপনাদের পরিবার থেকে রহস্যময়ভাবে নিরুদ্দেশ হন। এবং আরেকটা হল আপনার স্বামী ফিলিপাইনি গিয়ে ট্রেনিংয়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ফিরে আসেননি।’
আমি দ্বিতীয়টাতে তেমন অবাক না হলেও প্রথমটাতে একটু চমকে উঠি। আমাকে তিনি চমকে দিয়েছেন সেটা তিনি উপভোগ না করেই একই স্বরে তিনি বলেন, ‘আপনি সব সময় সাদা রঙের সব কিছু ব্যবহার করেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপনি সাদা। আমার মনে হয় মানুষ হিসেবেও আপনি সাদা।’
আমি তখন ইচ্ছা করেই বলি, ‘আসলে আমার ভেতরটা এত কালো,এত অন্ধকার, সেটা আড়াল করার জন্যই আমি সাদা দেখাই নিজেকে। নিশ্চিয়ই আমি এমন একটা অশুভ কিছু যে, যাকে তার মা ছেড়ে চলে যায়, তার স্বামী ছেড়ে চলে যায়, এবং ভবিষ্যতেও সে যদি কারো সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সেও যে তাকে ছেড়ে চলে যাবে না, তাই বা কে বলতে পারে?’ আমি ইচ্ছা করে কথার ভেতরে আগাম ইঙ্গিতটা দিই। কারণ আমি জানি তিনি আমাকে নিয়ে কী ভাবছেন।
এতক্ষণ তার আমরা যে ঘরে কথা বলছিলাম সেখানে চারপাশে চারটা লোক ছিল। তিনি আমার কথা শুনে হাতের ইশারায় তাদের চলে যেতে বলে। এতে তার নেতাভাবটা বেশ দেখতে পাই। আমি এদিকে বলে যাচ্ছিলাম,‘আপনি জানেন মন ও শরীর আলাদাও হতে পারে পারে।’
‘মানে কী রকম?’
‘মানে অনেক সময়ইÑ মনের চাহিদা শরীর পূরণ করতে পারে না। শরীরের চাহিদা মন পূরণ করতে পারে না।’
তিনি জানতে চান, ‘আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না।।’
‘কী রকম করে সেটা হয়? একটা গল্প বললে বুঝতে পারবেন মনে হয়।’
তিনি বলেন,‘ লম্বা গল্প না ছোট?’
‘ছোট।’
‘আসলে আমার হাতে সময় অনেক থাকলেও সব কিছুর জন্য তো আমি একই রকম সময় ব্যয় করি না। আমার হাতে এই সময়টা পুরো আপনার জন্য। চাইলে আপনি আমাকে সমুদ্র সমান গল্প শোনাতে পারেন। গল্পের পর গল্প। ওই যে আরব্য রজনীর শেহেরজাদীর মতো।’
‘বাহ! তাহলে তো ভালো। আচ্ছা তাহলে আপনাকে কয়েকটা গল্প শোনাবো। এখন যেটা বলছি এটা ঘটেছিল ইজিপ্টে। আধুনিক যুগে। এক আমেরিকান মেয়ে মিশরে গিয়ে একটি পুরুষের দেখা পায়। তাদের প্রেম হয় এবং তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও হয়। যতটা ঘনিষ্ঠ নারীপুরুষ হতে পারে। তারপর মেয়েটি আবার আমেরিকা ফিরে যায়। কিন্তু এক অপ্রতিরোধ্য টানে মিশরীয় ওই পুরুষটি তাকে টানতে থাকে। সে আর থাকতে না পেরে আবারও মিশরে চলে আসে। সেই লোকটাকে সেদিনই পেতে চায়। লোকটি বলে, এজন্য তাকে একটা কাজ করতে হবে। বলাবাহুল্য লোকটি অত্যন্ত ধনী ছিল। ছিল বিপতœীক। বিশাল তার প্রসাদ। সেই প্রসাদের যে কক্ষে তারা আগের বার মিলিত হয়েছে, তার বদলে অন্য একটা কক্ষে তারা এবার মিলিত হবে। শর্ত একটিই কক্ষটি থাকবে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এবার তার সঙ্গে মিলনের সময় সেই কোনো কথা বলতে পারবে না, এমনকি শব্দ করতে পারবে না। লোকটিও একটি কথা বলবে না। এই হল আরেক শর্ত। মেয়েটি তাকে তখন পাওয়ার জন্য হন্যে। তার কোনো তরই সইছিল না। মেয়েটি তার অ্যাডভেঞ্চরে রাজি হয়। এক্ষুণি চাই। সে তাকে বলেছিল, মনে ও শরীরে সে ছাড়া আর কাউকে সে গ্রহণ করতে পারছে না। এজন্যই সে আমেরিকা থেকে চলে এসেছে। তো মেয়েটাকে সেই অন্ধকার কক্ষে রেখে আসা হয়। সেখানে একটি বিছানায় সে শুয়ে থাকবে। বলা হয় তাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর পুরুষটি কক্ষে প্রবেশ করে। মেয়েটি তাকে হাতের লাগালে পাওয়া মাত্র আর অপেক্ষা করতে পারে না। তার সঙ্গে উত্তাল মিলন শেষ হয়। মেয়েটা জীবনে এ সুখ আর কখনো পায়নি। তার সেই সুখের ভেতরে বাতি জ্বলে ওঠে। মেয়েটি দেখে এতক্ষণ যে লোকটির সঙ্গে সে ছিল সে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, মানে নিগ্রো। অথচ সে এতটুকু টের পায়নি। একই রকমের গায়ের গন্ধ ছিল। চুল, ঠোঁট, হাত, পা মানে শরীরের গড়ন প্রায় একই। কৃষ্ণাঙ্গটি বাতি জ্বলের ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রচালিতের মতো চলে যায়। আর কক্ষে প্রবেশ করে মিশরীয় ওই ধনী ব্যক্তি। মেয়েটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। লোকটি বলে, সে প্রমাণ কি পায়নি, যে ভালো না বেসেও চরম সুখ পাওয়া যায়।’
আমি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। তিনিও চুপ করে থাকেন, কেবল পানির গ্লাসে থাকা শেষাংশটুকু একবারে গলায় ঢেলে দেন। তাও মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে। কেবল তাই নয়, এমন করে গ্লাসের প্রান্তটা নিজের মুখের ওপরে ধরে রাখেন যেন একটি বিন্দুও সেখানে অবশিষ্ট না থাকে। আমি দেখি সেখানে দু ফোঁটা টুপ টুপ করে তার মুখের ভেতরে পড়ে। আমি পরে জানি, এটা এক বিশেষ ধরনের শরবত যা খেলে নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে রাখা যায়। কিন্তু এটা শরীরের কোনো কিছুর ওপরে চাপ তৈরি করে না। দক্ষিণভারতের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন এক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক নাকি এটা আবিষ্কার করেছেন।
‘তাহলে ফলাফল কী দাঁড়লো?’ তিনি বলে ওঠেন।
আমি বলি,‘আমি তো বললাম। আসলে আমার দ্বারা কারো সঙ্গে, মানে কোনো পুরুষের সঙ্গে বসবাস করা সম্ভব নয়। কিন্তু...’, বলে আমি একটু থামি।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘কিন্তু কী?
‘কিন্তু শারীরিক সুখ ভোগ করা সম্ভব।’ আমি চট করে কথাটা বলে ফেলি। তিনি বলেন, ‘তার মানে কী দাঁড়ায় সোজাসুজি বলছেন না কেন?’
আমি বুঝলাম তার ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। তিনি আমার দিকে একটা স্মিত হাসি দিয়ে তাকালেন। আমার জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি বলি, ‘সোজা কথায় বিয়ে করা সম্ভব নয়, কিন্তু বিছানায় যাওয়া সম্ভব।’ দেখি তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বললেন, ‘ডু ইয়্যু মিন ইট?’
আমি দ্বিধাহীন ভাবে বলি, ‘সার্টেইনলি।’
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তাহলে তাই হোক।’
অল্প কিছুক্ষণের ভেতরেই আমি টের পাই পুরুষ মানুষ সত্যিই ভয়ংকর জীব। অনেক দিন পর আবারও নতুন করে টের পেলাম। কিন্তু তিনিও টের পেলেন আমি রমণী কতটা ভয়ংকর। মন্তব্য করলেন,‘এ এমন এক খেলা, যেখানে দুজনকেই জিততে হয়। হারলে দুজনেই হারে। আমার মনে হয় আমরা কেউ কাউকে হারতে দেইনি।’
চৌষট্টি কলার তিনিও সব জানেন। আমিও কম জানি না। বার বার বললেন আজকে রাতটা থেকে যেতে। আমি বলি,‘শরীর নিয়ে আমার কোনো সংস্কার নেই। শরীর আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাড়ি ফেরাটা সামাজিক ব্যাপার যতটা না, তার চেয়েও বেশি আমার পারিবারিক ব্যাপার। রাতের বেলা আমি বাইরে থাকি না। কোথায় বেড়াতে গেলে কেবল থাকা। তাও সেটা আমার একমাত্র বান্ধবী অর্মা ওখানে। সে উত্তরাতে থাকে। তার লোকজন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল। আমি নিজেই ফিরেছি। ঘরের ভেতরেই থাকা বিশাল বাথটাবে সঙ্গম ও ¯œান দুটোই সেরে নেওয়া গিয়েছিল বলে বাসায় ফিরে কেবল খাওয়াটা বাকি ছিল। তিনি সেদিন রাতের বেলা আমাকে ফোনও করেন। অনেক কথা হয়। আমাকে নিয়ে দূরে কোথায় বেড়াতে যেতে চান। আমি চাইলেও বিদেশেও তার সঙ্গে যেতে পারি। আমি বলেছি, এসব কোনোটাই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি যেটা করতে পারি অর্মার বাসায় যাওয়ার নাম করে আপনার বাড়িতে টানা কয়েকদিন থাকতে পারি। কিন্তু এ ব্যাপারটা আর কেউ জানবে না। আজকে সত্যিই বোকামি-ই হয়ে গেল। আজই তাকে সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। আবার এও ঠিক সুযোগ না দিলে তিনি আমাকে আজ অন্তত ছাড়াতেন না। টের পেতে দেরি হয়নি যে, অনেকদিন ধরেই আমি তার চোখে বিঁধে আছি, সেই কাঁটাটা প্রথমে নামিয়ে দেওয়া দরকার। সেজন্য আমি তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে আমার ঠোঁট, জিভ, আঙুলের, নখের, হাতের তালুর ছাপ এমনভাবে রেখে এসেছি যে তিনি সেসব শরীর থেকে মুছে ফেলতে পারলেও মন থেকে কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবেন না। তাকে গ্রহণ করেছি ভেতরে, তাকে গিলেছি, পান করেছি; তাকে নিয়ে গেছি আমার অন্ত্রে, বৃহদান্ত্রে। আমাকে নিতে দিয়েছি দশদিক থেকে। দেখতে চেয়েছি, কত দিক থেকে শরীরের গহীনভেতরে ভ্রমণ তিনি করতে চান। কতটা পথ কতটা গভীরে কতভাবে তিনি যেতে চান। আমিও তার হাত ও ঠোঁটের অপ্রতিরোধ্য টান টের পাই। সেটা যতটা না একজন ভোগীলম্পটের তারচেয়ে বেশি একজন প্রেমিকের। আর সবকিছুর মূল ব্যাপার ছিল তার ভেতরের কথা জানা। তাকে জানা। তাও আমি পরের সাত দিন যে তার সঙ্গে নিবচ্ছিন্নভাবে সবকিছু ভাগ করে নিয়েছি, তাতে তিনি জীবনের প্রায় সব কিছু নিজের থেকে আমাকে জানিয়েছেন। ক্ষমতার কাছে নিজেকে শঁপে দেওয়ারও মনে হয় আলাদা নেশা আছে। কোনো রাজা যদি সামান্য পতিতা নারীকে ভোগ করে, তাতে ওই পতিতা নারীটি ভেতরে ভেতরে গর্বই বোধ করে। আমারও হয়তো মনে হয়েছে, আসলে তাই মনে হয়েছে, এই এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী একজনকে আমি দশনখে আমু-ুশিরনখ দেখে নিতে পেরেছিলাম। এবং সেটি জগতের কেউ জানে না।তিনি তার এমন স্বাভাবিক কর্ম বাদ দিয়ে সবকিছু বন্ধ করে ঘরে পড়েছিলেন। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে নির্বাচনে হেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সাবেক এম.পি মিল্লাত তফরদার। তিনি সেই পত্রিকা আমাকে দেখিয়ে হো হো করে হেসেছেন। আমাকে বলেছেন,‘এভাবে পত্রিকা আমাদের মিসরিডই করে গেল। মাঝে মাঝে অবশ্য মিসরিড করার দরকার আছে। কী বলেন? মহাসুখের সাগরে আমি ভেসে চলেছি, আর ওরা মনে করছে আমি দুঃখের সাগরে ডুবে তলিয়ে গেছি। তিন-চার দিন ঘর থেকে বের হচ্ছি না। আমাকে মোবাইল, ফোনে কোথায় পাওয়া যাচ্ছে না। হা হা হা! আশ্চর্য ব্যাপার তাই না। সত্য কত রহস্যময়, কত সামান্য জিনিসও কতটা গভীরে আড়ালে পড়ে থাকে সেটা তো এভাবে না জানলে আমি জানতাই না।’
তিনি একবারও আমাকে ‘তুমি’ করে বলেননি। আমিও বলেছি, আমাকে এর বিনিময়ে কোনো টাকাপয়সা দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। উপহারটুপহার দিলে সেগুলি আমি এখানেই ফেলে চলে যাবো। কারণ মনে রাখবেন আমি যা করেছি, আনন্দের সঙ্গে স্বেচ্ছায় করেছি। এবং আমার এই নিয়ে কোনো গ্লানি নেই। এতটুকু কোনো পাপবোধ নেই। তাছাড়া তিনি একাই আমাকে ভোগ করেননি, আমিও তাকে ােগ করেছি। আমরাও তাকে কিছু দেওয়া উচিত। একথায় তিনি আমার একটা আংটি চান। তখন আংটিটা বিছানার পাশের ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে রাখা ছিল। আমি তার হাতে আংটি পরিয়ে দিলে তিনি আমাকে আশ্লেষে প্রাণভরে অনেকক্ষণ চুমু খান। চুমু খেতে খেতে আমরা আবার চূড়ান্তের দিকে এগিয়ে যাই। এভাবে বার বার ঘুরে ফিরে নানান সময় আসে আর আমরা মেতে উঠি।
তিনি এক একটি দীর্ঘ মিলনাভিসার শেষে আমার পায়ের কাছে সেজদার মতো করে পড়ে ছিলেন। ‘সর্বেশ্বরীর বলে একটা শব্দ আছে। একটা আপনাকে না দেখলে তো আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। আপনি তো আমাকে একেবারে পৌরাণিক যুগে নিয়ে গেলেন।’
আমি বলি, ‘পৌরাণিক যুগেই নিয়ে যদি থাকি তো পৌরাণিক যুগের মতো আমি নিশ্চয়ই আপনার কাছে বরও চাইতে পারি। কি পারি না?’
‘নিশ্চয়ই। কী বর চান বলুন। আমি আলাদিনের দৈত্য না হলেও আমার সাধ্যে, ক্ষমতায় যেটুকু আছে আপনাকে আমি দিতে চাই।’’
‘সেটা আমার জন্য নয়। আমি শুধু বেশি না; মাত্র তিনটা বর চাই। সেগুলি কী কী আমি নিজেও জানি না। কিন্তু যখন যে সময় আমি সেই বর চাইবো আপনি কি আমাকে সেই বর দিতে পারবেন।’’
‘বললাম তো যেকোনো সময়।’
‘আমি সময় হলে চাইবো। হয়তো এক বারে চাইবো না। একটা শেষ হলে অনেক বিরতি দিয়ে আরেকটা। তবে এখন একটা জিনিস আমি চাই, সেটা হল আমাদের যে গোপানীয়তা সেটা আশাকরি বজায় থাকবে। আপনি স্মৃতি হিসেবে যে এত এত ফটো তুললেন, ভিডিও করলেনÑ সবই আপনার হেফাজতে থাকবে। এর একটা বিন্দুও জগতের কেউ জানবে না।’
আমি এসব বলেছিলাম, কারণ আমাদের একান্ত সময়গুলিতে আমি একের পর এক প্রশ্ন করে গেছি। তিনি তার প্রায় সবগুলির উত্তর দিয়েছেন। এর ভেতরে এদেশে কারা কারা কী কী কাজের জন্য দায়ী। ক্ষমতার চক্রে কী কী হয় সব আছে। আমি নিজে তার কাছ থেকে ফটো ও ভিডিও কপি করে নিয়েছি। আমার কাছেও এককপি থাকা দরকার। কারণ হাজার হলেও তিনি রাজনীতি করেন। রাজনীতি যারা করে আমি শেষ পর্যন্ত তাদের বিশ্বাস করি না। যদিও তাকে আমি অনেকটাই বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ অনেক যতেœ কিন্তু বিপুল বিক্রমে বাঘের শৈর্যবীর্য নিয়ে তিনি আমাকে সম্মান করেছেন। আমরা কেউ আসলে দুয়েকবারের জন্য কখনো মাঝে মাঝে সামান্য ক্লান্ত হলেও কখনোই আসলে হারিনি।
আমার একবার মাত্র এতদিন পরে মনে হল, তিনি বেঁচে থাকলে আমি তার কাছে জহরতকে পাঠাতে পারতাম। পরেই মনে হল এটাও স্বার্থ-আদায় হয়ে যায়। আর জহরতের জন্য কেন আমি এটা আসলে কারোর জন্যই করতে পারি না। এত বড় মুখ করে তাকে বলেছিলাম যে, কোনো কিছু দিয়ে আমি এর বিনিময় চাইবো না।
তিনি বিদেশে যাওয়ার আগে তার কাছে থাকা আমার সঙ্গে তোলা ফটোর অ্যালবাম আর ভিডিও করা ডিভিডিটা পাঠিয়ে ছিলেন। আমার সঙ্গে তার আমৃত্যু যোগাযোগ ছিল। বহুবার বলেছেন, এমন একটা আলাপ আমাদের হয়নি যেখানে তিন না বলে পারেনি যে, আমি চাইলেই তার বৌ হতে পারি। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমি একবারেই লোক হাসাতে পছন্দ করি না। আর আপনিও কি এই বয়সে লোক হাসাতে চান? তিনি বলেছেন, আমার এই একটা জিনিসের প্রতিই টান আছে। এছাড়া আমি কোনো রকম অন্যায় অবিচারের থেকে যতটা নিজেকে দূরে রাখা সম্ভব রেখেছি। একবার মন্ত্রী হওয়ারও সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি জানি তাহলেই আমার চূড়ান্ত সর্বনাশ হবে। লোকে বলে আমার তিনটা গুণ। আপনি বলুন তো দেখি আপনার কাছে আমার সেগুলো চোখে পড়েছে কিনা?’
আমি বলেছিলাম; শুনে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এক, আপনা অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, দুই যেকোনো নাজুক অবস্থার ভেতরেও পথ বের করার বুদ্ধি; তিন বিরোধীপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার সীমাহীন ক্ষমতা এবং চার, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট ইয়োর সেন্স অব ইরোটিসিজম অ্যান্ড পাওয়ার, ইয়্যু নো হোয়াট আই মিন। আপনি সবমিলিয়ে একটা পাওয়ার হাউস। আরো একটাই প্রধান দোষ আমি কিন্তু এটাকেও গুণ বলব, আপনার কোনো নেশা নেই এক নারীভোগ ছাড়া। কারণ আমরা ধারণা আপনি জীবনে কোনো নারীকে অপমান অসম্মান করেননি। হ্যাঁ, তারা আপনা ক্ষমতার জন্য ভয়ে সম্ভ্রমে বা অর্থের লোভে যা যাই বলি না কেন, আপনাকে সঙ্গ দিয়েছে, আপনি নিঃসন্দেহে তাদেরও খুশি করে দিয়েছেন। তিনি আমার কথা শুনে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। আমি জানতাম তার মনটা আসলে শিশুর মতো কোমল ও সরলও। ক্ষমতা তাকে এত কিছুর পরও কুটিল, শূন্য ও নির্জীব করতে পারেনি। আর আমি তার সঙ্গে এমন সময় পরিচিত হয়েছিলাম যখন তার রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায় শূন্যে নেমে গিয়েছিল। ফলে আমার তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাকে তিনি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। আমিও বলেছি, আপনাকে চাইলে আমি জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি। কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে কেবল বিয়ে দিয়েই জীবনযাপন করা যায় না। যেমন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দম্পতি আছে যারা কোনো কিছু নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে না। তাদের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোনো সম্পর্কই নেই, লোক দেখানো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছাড়া।
তিনি আমেরিকায় গিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পরে মারা না গেলে আমি হয়তো একদিন তারই স্ত্রী হয়েও যেতে পারতাম। কিন্তু নিয়তি তা হতে দিল না। হায় আমিও তাহলে নিয়তি মানি? তার মৃত্যুর খবরের এক সপ্তাহ পর জহরতের পরিচয় পাই। আমি জানি না সেও আমার আরেক নিয়তি হয়ে ওঠে কিনা।
৬. আবু মুহম্মদ ইমরান ও জহরত
তোমার বাবার কোনো স্বপ্নই তুমি পূরণ করতে পারোনি। পারার কথাও ছিল না। নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখো না কেন, জীবন তোমাকে কী দিয়েছিল আর তুমি জীবনকে কী দিলে। সবাই সফল হবে তা তো নয়। ব্যর্থতা সফলতার যমজ ভাই। আলো যেমন অন্ধকারের যমজ। তুমি সবচেয়ে সোজা ব্যাপারটা বুঝতে পারোনি। এজগত ক্ষমতাবানদের জগৎ। আর ক্ষমতার উৎস হলো অর্থ। অর্থই জীবনের অর্থ তৈরি করে দেয়। সেই অর্থের দিকে তোমার কোনোমাত্র নজর ছিল না। এজন্যই তোমাকে বোকা বলব। যে এই হাওয়ায় টাকা ওড়া জগতেও টাকা কামাতে পারে নাÑ তাকে আমি কোনোভাবেই বুদ্ধিমান বলতে রাজি নই। তুমি দেখে তোমার আসে পাশে তোমার বয়সী ছেলেদের; মেয়েদের পর্যন্ত দেখো। ঘরে তোমার নিজের ভাই বোন রয়েছেÑ তাদের তুমি দেখো। তাদের চেয়ে বয়সেই কেবল তুমি বড়ো, আর ওরা তোমার চেয়ে জ্ঞান বুদ্ধিতে সবদিকে এগিয়ে গেছে। ওরা এগিয়ে গেছে নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে, আর তুমি চাইছো ক্রিকেট দিয়ে দেশ জাতি উদ্ধার করতে। তুমি বলতে চাওÑ একবার ক্রিকেটে বাংলাদেশ যদি চ্যাম্পিয়ান হয় তাহলে জাতির আত্মবিশ্বাসটা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, ভাবা যায়? তুমি নিশ্চিয় জানো, এক রাজনৈতিক ঝামেলা আর দুর্নীতিটা না থাকলে আমরা কোথায় চলে যেতাম এতদিনে। আমাদের নেতাও নেই, নীতিও নেই। তুমি যেহেতু রাজনীতি করে জাতিকে কিছু দিতে পারবে না। তাই খেলাকে বেছে নিয়েছিলে। তুমি মজা করে বলতে, আসলে রাজনীতিও ক্লাব ফুটবলের মতো হওয়া দরকার। টাকার বিনিময়ে নেতারা কদিন এদলের হয়ে রাজনীতি করবে, কদিন অন্য দলের হয়ে রাজনীতি করবে। এতে করেই আসলে বোঝা যাবে কার কতটুকু দক্ষতা। তাতেই প্রমাণিত হবে কে আসলে সত্যিকারভাবে সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখাতে পারে, সত্যিকারে নেতা হতে পারে। ক্লাব ফুটবলের মতো নেতারা এই রকম বিভিন্ন দলের হয়ে রাজনীতি করেন না, কারণ এর মাধ্যমে তারা আসলে তাদের অক্ষমতাটা আড়াল করে রাখেন।
ক্রিকেটের ওপর পড়ালেখা করতে গিয়ে তুমি নাকি জীবনকেই ক্রিকেট মনে করো, আর ক্রিকেটকেই জীবন মনে করো। তোমাকে কেউ ক্রিকেট থেকে সারায়নি। তুমি নিজেরই নিজেকে সরাতে বাধ্য হয়েছো। কারণ তুমি প-িতি মারতে গিয়ে প্রতিপদে সবার জন্য বিব্রতরক পরিস্থিতি তৈরি করেছো। তারা যদিও তোমাকে তাদের সঙ্গে রেখেছিল। এত দিন ওদের হয়ে কাজ করলে ওরা তো তোমাকে চাইলেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে না। তাই দয়া করে তোমাকে কিছুদিন উপদেষ্টাও রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তুমি নিজেও বুঝতে পারলে সেখানেও তুমি কতটা অপাঙক্তেয়। তুমি চেয়েছিলে এমন এক ক্ষমতা অর্জন করতে যা আসলে কেউ দেখবে না, কেবল কাজের সময় তোমার কথা শুনে নির্দেশনা পেয়ে বুঝতে পারবে, কতটা ক্ষমতা আছে তোমার কথায়, তোমার নির্দেশনায়।
তুমি জানো ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’ এই কথাটা বেকেন বলেছিলেন স্প্যানিশ ও ভেনিসীয় বাহিনী কাছে মুসলমানদের পতনের পর। আর সেই পরাজয়ের পর থেকে যতদিন গেছে মুসলমানেরা জ্ঞানের সেই ক্ষমতার দিক থেকে দূরের সরে এসেছে। তোমার দেশে হাস্যকর ভাবে ‘নলেজ ইজ পাওয়ার--এর বাংলা করা হয়েছে ‘জ্ঞানই শক্তি’। অথচ হবে ‘জ্ঞানই ক্ষমতা’। ‘জ্ঞানই শক্তি’ রীতিমতো-যে অস্পষ্ট একটা কথাÑ কেউ কোনো দিন ভেবে দেখলে না? এই শক্তি কীসের শক্তি? ‘জ্ঞানই শক্তি’ হলে তা হয় ‘নলেজ ইজ এনার্জি’। এনার্জিটা শারীরিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত। জ্ঞান তো শারীরিক শক্তি বাড়ায় না। কিন্তু তুমি জ্ঞানকে জানছো এনার্জি হিসেবে। অথচ জ্ঞান যে ক্ষমতা বাড়ায়, যে চিন্তার ক্ষমতা বাড়ায়, যে চিন্তার জোরে মানুষ তার কঠিন জীবনের পথে এগুতে পারে, জ্ঞানের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত সব রকমের ক্ষমতা বাড়ানো যায়, সেই জ্ঞানের কথা আমরা কেউ ভালো করে কোনোদিন ভাবিনিÑ যেসময়টা সত্যিকার অর্থে আমাদের মগজে সেটা ঢুকতে পারার কথা ছিল। আর এখন তো জ্ঞান মানে ক্ষমতাও না, জ্ঞান মানে টাকা। অথচ টাকাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে যে জ্ঞান তা আমারা জানি না, তুমিও জানোনি। এতদিনে তুমি হন্যে হয়ে উঠছো নিজের একটা কিছু করার জন্য। কিন্তু তুমি জানো না, হয়তো তোমাকে ফের ক্রিকেটেই ফেরা লাগে কিনা। অবশ্য তুমি মনে করেছো কিছুদিন চেষ্টা করা যাক। যদি না পারি তো ফের ব্যাক টু দ্য প্যাভেলিয়ন। আর নইলে ফ্যা ফ্যা হয়ে রাস্তায় ঘোরো।
তুমি তো কোনোদিন বোহেমিয়ানও হতে পারবে না। একজন বোহেমিয়ান হওয়াও কঠিন ব্যাপার। তুমি জানো না তোমার বাবা তোমাকে বলেনি যে, তিনি এক মারাত্মক বোহেমিয়ানকে দেখেছিলেন। সাবদার সিদ্দিকী নামের ওই লোকটার জন্ম কলকাতায়। তিনি বলতেন, ‘এই সাবদার সিদ্দিকী ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় বাবা-মার কাছ থেকে এক নিজের নাম ছাড়া আর কোনো কিছুই সঙ্গে নিয়েই আসেনি।’ ঢাকার মতিঝিল থেকে আলিয়া মাদ্রাসা আর চানখারপুল থেকে শাহবাগ, খুব বেশি হলে এলিফ্যান্টরোড নিউমার্কেট ছিল তার ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। থাকতেন রাস্তায়। পরতেন চট মানে ছালা কেটে, দুপাশে দুই হাত গলিয়ে আর গলা গলিয়ে। কথা বলতেন নদীয়া-শান্তিপুরীর ভাষায়। আর চোস্ত ইংরেজিতে। অনেকটা সময় কেটেছে রাতের বেলা মতিঝিলের নির্মাণাধীন একটা ভবনের দোতলায়। সেখানে রাতে থাকতেন আর সকালের হাগামোতা করতেন পূর্বাণী হোটেলের টয়লেটে। একবার তাকে হোটেলের লোক আটকলে তিনি এমন ইংরেজি বলা শুরু করেন যে সবাই ভড়কে যায়। পঞ্চাশ সালের দিকে এক উকিলের ঘরে জন্ম। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় তারা বাবা-মা কলকাতা থেকে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে আসতে বাধ্য হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাবা-মা ও পরিবার আবার কলকাতায় ফিরে যায়। তিনি ফিরে না গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। পরে আবার নিজেও কিছুদিন কলকাতায় কাটিয়ে এলেও ১৯৭২ সালে তিনি চিরদিনের জন্য বাংলাদেশে চলে আসেন। একবার বর্ডারে তার পাসর্পোট চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আই ডোন্ট বিলিভ ইন পাসপোর্ট।’ তাকে বলা হয় যে, তাহলে তো আপনাকে জেলে ঢুকতে হবে। তখন তার উত্তর ছিল, ‘সারা পৃথিবীটাকেই তো আমার জেলখানা বলে মনে হয়, আপনারা আমাকে নতুন করে কোন জেলখানায় ঢোকাবেন।’ কোনোদিন তার পকেটে কোনো টাকাপয়সা থাকতো না। বন্ধুও কিছু জুটেছিল। এদের ভেতরে কয়েকজন ছিল টাকাওয়ালা বন্ধু। তাদের কারো কারো কাছে টাকা নিয়ে দিন চলতো। কোনো কোনো সময় কোথাও কোনো মেসে থাকতেন। দেখা যেত কারো কাছে কোনো টাকা নেই। তখন সকালে উঠে আর সাবদারকে পাওয়া যেতে না। আর দেখা যেত কারো একটা ঘড়ি নেই। একসময় বাজার করে ফিরল সাবদার সঙ্গে তরিতরকারি আরো মাছটাছ। ‘এই যে বঙ্গপুঙ্গবরা, উঠুন। উঠে এসবের ব্যবস্থা করুন।’ পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির ওই মানুষটা জগতের কোনো কিছুকে সামঝে চলতো না। রাস্তা ঘাটেও চলাচল ছিল ড্যাম কেয়ার। বলতেন, ‘মানুষকে কেয়ার করার কী আছে। বরং গাছকে কেয়ার করবো। মানুষের সঙ্গে বাড়ি খেলে সে সরে যাবে, বা পড়ে যাবে, কিন্তু গাছের সঙ্গে বাড়ি খেলে তো আমি পড়ে যাবো। প্রকৃতিকে কেয়ার করুন। নইলে আপনি পড়ে যাবেন। মানুষ মনে করেছে প্রকৃতির সঙ্গে টক্কর দিয়ে পারবে, আসলে তো পারবে না। মানুষের সঙ্গে আপোসের কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সমঝোতায় আসতেই হবে। নইলে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাবো।’ সারাক্ষণ মার্কস লেলিন, বিপ্লবÑ এসবের কথা। রাজনীতি ও সাহিত্যের কথা মুখে খৈয়ের মতো ফুটতো। ঢাকা শহরে যেখানে লাইব্রেরি ছিল আর যেখানে দেশিবিদেশি পত্রিকা থাকতো, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ল-ন থেকে আসাপত্রপত্রিকা, রাজ্যের ইংরেজি ম্যাগাজিন আর ইন্ডিয়ার কোনো ইংরেজি সপ্তাহিক, সব পড়া হয়ে যেত। বাংলা পত্রপত্রিকা তো একটাও বাদ যেত না। জগতের হেন বিষয় ছিল না যে যা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারতেন না। দর্শন থেকে পোষাকের ডিজাইন ফ্যাশান পর্যন্ত সব কিছু তার আগ্রহের বিষয়। চোখে গোল্লামার্কা চশমা। কাঁধ ছাপানো চুল। হো চি মিনের মতো দাড়িটা থুতনির নিচে ঝুঁটি বাঁধা। এছাড়া মুখে গালে খোঁচাখোঁচা দড়িগোঁফ। কোটরগত চোখ, গাল। ময়লা গা। গোসল নাই। কোনো যতœ নাই। খাওয়া দাওয়ার তো কোনো ঠিক নাই। মদ মিললে মদ, গাঁজা পেলে গাঁজা আরো কোনো নেশার সুযোগ পেলে করতেন। এর ভেতরে সিফিলিসও হয়। চানাচুর বা মুড়ি মাখানো সবার জন্য মাখানো হলে, তিনি নিজেরটা আলাদা করে বলতেন,‘আপনাদের কার কী অসুখ আছে, কে জানে? আমি আমার মতো এই টুক আলাদা করলাম।’ আসলে তার নিজের অসুখ যাতে কারো মধ্যে সংক্রামিত না হয় এজন্য এটা করা। কোনো রিক্সা করে শাহবাগ নেমেছে, রিক্সাওয়ালা ভাড়া চাইতে গেলে তাকে বলেছেন, ‘শোনো গত কয়েক বছরে আমি একটি টাকাও কামাই করিনি। তোমার যদি টাকার দরকার হয় তো ওইখানে আমার বন্ধুরা আছে, তাদের কাছে গিয়ে আমার নাম সাবদার সিদ্দিকী বলো। তারা তোমাকে ভাড়াটা দিয়ে দিবে। আর যদি না দেয়, তাহলে দয়া করে তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো না।’ Ñ এইভাবে তার দিন চলতো কোথাও গিয়ে চা বিস্কুট খেয়েও একই কথা। তার কাছে টাকা নাই দিবে কোথা থেকে। বন্ধুরা এলে তাদের থেকে যেন দাম নিয়ে নেয়। সেই সাবদারকে ১৯৮৪ সালের পর থেকে আর পাওয়া যায়নি। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে নাকি সে আবার কলকাতা চলে গেছে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।
তোমার বাবা মেডিকেল কলেজের ওখানে তাকে দেখেছেন। তার এক বন্ধু অদ্ভুত এক মানুষ দেখতে নিয়ে যাবে বলে তার কাছে নিয়ে গেছে। তোমার বাবা তারপর কিছুদিন তার পিছে পিছে কাটান। তার কাছে কবিতা শোনেন। সাহিত্য আর রাজনীতির কথা শোনেন। এরকম লোক দেখলে আগে তোমার বাবার ‘তুমি কি দেখেছো কভু/ জীবনের পরাজয়’ গানটা মনে পড়তো; কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতেন, সাবদারকে দেখে সেটা মনে করারই কোনো মানে নেই। সুযোগও ছিল না। মনে হত, ওই ছোট মানুষটা আকাশ ছোঁয়া পাথরের পাহাড়ের মতো অজেয়। কিছু দিয়ে তাকে বশ করা যায় না। তোমার বাবার চূড়ান্ত বোহেমিয়ানগিরি করা এই লোকটাকে দেখা ছিল। তুমি তো তার চোখে সেই ভবঘুরে হয়ে ওঠার সীমাও পার হতে পারো না। তাহলে তুমি কী করতে পারো? আসলে তো তুমি ভবঘুরে হয়ে উঠতে পারবে না। তুমি ছোটবেলা থেকে নিয়ম মেনে চলেছো। তোমার বাবা তোমাকে ছোটবেলায় ক্রিকেট ব্যাট বল উইকেট কিনে দিয়েছিলেন। বাড়ির সামনের ছোট একটা মাঠে সকাল বেলা তোমাকে নিয়ে গেছেন। তুমি আর তিনিই ছিলেন ক্রিকেট খেলার দুই প্রতিপক্ষ। আজ সত্যিকারভাবে তুমি ও তিনি জীবনের দুই দিকে। প্রতিপক্ষ না হলে তিনি তোমার পক্ষে নন। তোমার খুব জানতে ইচ্ছা করে তুমি যদি তার একমাত্র সন্তান হতে তাহলে তিনি কী তোমার প্রতি এমন উদাসীন হতে পারতেন? হয়তো পারতেন। কারণ তিনি মায়ের প্রতিও উদাসীন ছিলেন। তোমার বাকি দুটো ভাইবোনোর সঙ্গেও যে তার খুব খাতির ঘনিষ্ঠতা তাও তো নয়। তিনি আসলে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তিনি যে ধারার মধ্যে দিয়ে জীবনকে বইয়ে নিয়ে গেছেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তুমি এখন তোমার আগের জীবনের মূল খাত থেকে সরে এসে এমন একদিকে যেতে চাইছ যে, দিকটা সম্পার্কে তুমি আসলে কিছু জানো না। আর তুমি জানো না যে সারাবান তহুরাই-বা তোমাকে আসলে কোন দিকে নিয়ে যেতে চায়। তার সম্পর্কেও তুমি তেমন কী জানো? তোমার মানুষ সম্পর্কে জানার আগ্রহ কোনো কালেই তেমন ছিল না। সারাহ্ যেটার ঠিক উল্টো দিকে। তার নিজের জীবনের পেছনের পট কেবল শূন্যতা দিয়ে ভরা। সে হয়তো এজন্য সেটি নানান ভাবে পূর্ণ করে নিয়েছে। এই এলাকার ক্ষমতাবানসহ দেশের নানান ক্ষেত্রের ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তার রহস্যময় সম্পর্ক আছে বলে যে রটনা আছে, সেটি তাকে আসলে এক রকম রক্ষাও করে। সেই সঙ্গে তার নিজের যোগ্যতা অসাধারণ অঙ্ক করার ক্ষমতা। তোমাকে সে বলেছে, সে লজিক্যাল মিথ বা মিথিক্যাল লজিক দিয়ে চলে। তুমি এই কথা দুটোর মানেই খুঁজে পাওনি। মিস্টিক্যাল রিয়ালিজম বা রিয়ালিস্টিক মিস্টিসিজম নিয়ে তার দর্শন। এসব কথার কি মানে? তিনি ভোরে উঠে রবীন্দ্রনাথ পড়েন। পড়েন রাসেলের লেখা। এই দুজনকে পড়তে পারলেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মূল সুরটা নাকি বোঝা হয়ে যায়। তুমি এইসব তেমন বোঝো না। তুমি আসলে কী বুঝতে? ক্রিকেট? তা তো একটু বেশি বুঝতে। জীবনেরও আলাদা একটা খেলা আছে, সেটা তুমি ক্রিকেট ফুটবল যা খুশি ভেবে নিতে পারো। জীবন জীবনই তার সঙ্গে আর কোনো কিছুর মিল চলে না। সারাহ্ তোমাকে বলেছে, সে বই পড়ার চেয়ে বেশি পড়ে মানুষ। পড়ে চুপচাপ, কেউ যাতে টের না পায়। কেউ যদি টেরই পায় তাহলে তো সে তোমাকে পড়তেই দেবে না। পড়তে দিলেও সে এমন সব কা- করবে যে তাকে তোমার যতটা ঠিক পড়া হবে তারচেয়ে ভুল পড়া বেশি হবে। মানুষতে তো পড়ার ব্যাপার আছে আর পড়ার যে বইপত্র এই যেমন রবীন্দ্রনাথ-রাসেলÑ তাদের কি ঠিক করে পড়া হয়? যারা এখন মৃত, বরং জীবিতরা তাদের চেয়ে মৃত, আর তারা জীবিতদের চাইতেও জীবিত, অতিজীবিত। তিনি এই দুয়ের একটা মিশ্রিত বোধের মানুষ হতে চান। সারাহ্ রবীন্দ্রনাথের সাত্ত্বিকতা আর রাসেলের জ্ঞান, প্রেম, মানবতাবাদ ও জৈবকামনার একটা ভারসাম্য তৈরি করতে চান। তার কোনো সংস্কার নেই। কোনো কিছু নিয়েই নেই। শরীর নিয়ে তো নয়ই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি আধান্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়াবেন আর রাজ্যের লোকের সঙ্গে, বাছবিচারহীনভাবে মেলামেশা করবেন। তিনি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মেয়েদের নিয়ে তুমি কী ভাবো। তুমি উত্তরে বলেছিলেন, আসলে মেয়েরা যে আলাদা কোনো কিছু সেটাই তো তুমি খেয়াল করোনি। তোমার জীবন থেকে তারা ¯্রফে নাই হয়ে গিয়েছিল। এক মা ছাড়া তোমার সঙ্গে খুব কম মহিলা বা নারীর কথা হয়েছে। কথা মানে তো ভালো আছেন, দেখা হলে আলাপ, কোনো নারীর সঙ্গে কোনো দিন কোনো আলাপ হয়নি। তারা তোমার কাছে একটা শব্দমাত্র ছিল। তোমার জীবনে তাদের কোনো প্রয়োজন ছিল না। নারীর প্রতি টান বা কামনাবাসনা যাই বলা যাক না কেন, তুমি প্রায় কামহীন মানুষে পরিণত হয়ে গেছ। আসলে মনে হয় এই বিষয়টিই তোমার নেই। এমনকি তোমার ঘুমের ভেতরেও তারা আসে না। ক্লাস সেভেন এইটে পড়ার সময় মনে হয় এই সমস্যাটা হতো। কিন্তু সেটা সেটা তোমাকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। হয়তো তোমার সঙ্গটা ভালো ছিল। যাদের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে সেই যে বেড়ে ওঠা তারাও ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু বোঝেনি। সত্যি বলতে কি তোমার প্রজন্ম থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা নতুন জীবন পেয়েছে। তুমি চেয়েছিলে সেই নতুন জীবনের নদীতে ¯œান করতে। সেটা হতে হতেও হয়নি। আর সেখান থেকেই তোমার সমস্যা তৈরি হল। তুমি বুঝতেই পারোনি, এটা জ্ঞান-যুক্তি-চর্চার দেশ নয়। এটা হল, স্বভাববৈশিষ্ট্যে চলা মানুষের দেশ। তাও সেই স্বভাব একেবারে যে ‘অব্যবস্থায়পূর্ণ-ব্যবস্থা’ এখানে দীর্ঘদিন ধর বজায় রাখা হয়েছে সেটারই একেকটা প্রোডাক্ট একেকটা মানুষ। নিজের মতো খুব কম লোক এখানে কিছু হয়ে উঠতে পারে। আর যাদের মনে করা হয় তারা হয়ে উঠেছে, তারা ওই বজায় রাখা ব্যবস্থার ভেতরেই হয়ে ওঠে; সেটাকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার দিকে তারা যায় না। তারা কোনো ঝুঁকি নিতে যায় না, চায় না। কারণ তারা ভালো করে জানে এখানে ঝুঁকি নিলে জীবনটাকে ¯্রফে ফুকে দেওয়া হয়। এটাই হল এখানকার সত্য ও এখানকার বাস্তবতা। সারাহ্ বলে, জীবনকে সেটা কারো জীবনকে জীবন করে তোলার জন্য জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও তীব্র একটা প্রেম দরকার। সেটা কোনো বিষয়ের বা বস্তুপ্রেম নয়। নারীর জন্য পুরুষের প্রতি প্রেম, পুরুষের জন্য নারী- প্রেম। যেমন তোমার ক্রিকেট প্রেম ছিল, তা স্বাভাবিক হয়ে উঠত যদি তোমার নারীপ্রেম সঙ্গে থাকতো। কিন্তু তুমি নারীর কথা কখনো ভাবোইনি। এটাই বরং অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের প্রায় বেশির ভাগ কিশোর বয়স থেকে প্রেম নামে যা বোঝে তা তো একটা বায়বীয় ব্যাপার, নয়তো একেবারেই শরীরীটান। এটা তাদের আরেক সর্বনাশের দিকে নিয়ে যায়। প্রেম সম্পর্কে ধারণা ও সিদ্ধান্তই হল জীবন সম্পর্কে ধারণা ও সিদ্ধান্ত। কী বিশ্বাস করো না তুমি? এজন্যই আসলে তোমার নিজেকে নিয়ে তোমার এত সমস্যা। তোমার বিশ্বাস, তোমার আনন্দ, তোমার কর্ম, তোমার সৃষ্টিÑ কোনোটাকেই তুমি বুঝতে পারবে না যদি নারীর সঙ্গে না নিজেকে যোগ করো। এই যোগ মানে একবারে আত্মিকনৈতিকশারীরিক সংযোগ। তোমাকে দোষ দিয়ে কী লাভ। বেশিরভাগ লোকই এর থেকে দূরে। তাদের জানার গ-ির অনেক দূরে দূরে এর অবস্থান। ব্রিটিশরা যখন এদেশে এসেছিল তাদের নাকি মনে হয়েছিল, এখানে সব চিন্তাহীন মানুষের বাস। এরা এক কি লক্ষÑ তাতে কোনো কিছু আসে যায় না। গরুভেড়ার পাল যেমন। ইচ্ছা করলেই দখল করা যায়। কে যেন বলেছি ব্রিটিশরা এদেশের মানুষকে মনে করেছিল ইটের পাঁজা। অবশ্য এদেশের মানুষকে দোষ দিয়ে কী হবে। যেদেশে রাতে বীজ ছড়িয়ে দিলে দিনে গাছ গজিয়ে যায় সে দেশে কোন বোকাটা খাটতে যাবে। সে দেশের মানুষ চিন্তা কেন করবে? সাবদার সিদ্দিকী এজন্যই বলতো, চারদিকে গরু ভেড়া ছাগল মোষ, দেন হোয়াট ইজ ইয়োর প্রেবলেম? তোমার বাপের সঙ্গে তার একটি কথাই বিনিময় হয়েছিল, এই যে আপনি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন না, নিজের কোনো যতœ নেন না, এটা তো নিজেকে এরকম শেষ করে দেওয়া। সাবদারের উত্তর ছিল, ‘মানুষ তো শেষ হতেই আসে। এর শুরুটাই হয় জন্মের ভেতরে দিয়ে। জন্ম মানেই সঙ্গে মৃত্যুরও জন্ম। আর আমি না খেলেও আগামীকাল সূর্য উঠবে, আমি না নাইলে আগামীকাল সূর্য ডুববে।’ তোমার ভেতরে এই রকম একটা ভেতরগত ভবঘুরে আছে মনে হয়। আসলে যে লোক নিজেকে বাদ দিয়ে কোনো কিছু নিয়ে মেতে ওঠে এরা প্রত্যেকেই এক ধরনের ভবঘুরে মানুষ হয়ে ওঠে। তাদের কোনো ঘর থাকে না। এই তোমার কথা যদি কেউ জানে এবং লেখে সেই লোকটাও আসলে ঘরহীন মানুষ। তুমি জানো না, কিন্তু যারা জানে তার বুঝতে পারবে দারুণ ইন্টারেস্টিং উপন্যাস হতে পারে সাবদার সিদ্দিকীকে নিয়ে, কারণ তার সঙ্গে দাঙ্গাদেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশেটা এমনভাবে এসেছে যা আর কারো জীবনেই আসেনি। তিনি ‘ডেথ অব রিকার্ডো রাইসে’র ফারনান্দো পেসোয়ার মতো বিশ্বখ্যাত কবি না হলেও যে ভবঘুরে আমরা আমাদের জীবন থেকে খুঁজে নিতে পারি সে সাবদার হোক আর যেই হোক, তাদের সঙ্গে তোমারও কোথাও একটা মিল রয়েই গেছে। তাই না?
৭. গতিমুখ
মাথার ভেতর কে কথা বলে? সারাক্ষণ এত বক বক! এই স্বরটা বন্ধ করা দরকার, এর টুঁটিটা টিপে ধরা দরকার। জহতর বা সারাবান তহুরা হয়তো জানে যে শুরুতেই আসলে এ সুযোগটা তৈরি করে নিতে হয়। আর একবার সুযোগটা হারালে আর আসে না। এখন আসলে কাজের কথায় আসা যাক। অ্যাকশান না হলে তো উপন্যাসটাই শুরু হবে না, বা শুরু হলেও থেমে রইবে। ধরা যাক জাহাজ ডুবি হওয়ার পর একটি লোক সাঁতার দিয়ে যে উপকূলে পৌঁছাতে যাচ্ছিল সে দেখতে পেল পুরো উপকূলজুড়ে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। তখন তার কেমন মনে হবে? যার কোনো দিন জাহাজ ডুবি হয়নি, যে কোনোদিন এরকরম জ্বলন্ত উপকূল দেখেনি, তার কী করে সেটা বোঝা সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। আপনি পাঠক তো কল্পনাই করতে পারেন যদি এই রচনাটির এত দূর পর্যন্ত এসে থাকেন। কয়জনের সঙ্গে দেখা হল আপনার? জহরত, সারাবান তহুরা আর ডাক্তার আবু ইমরান। মিল্লাত সাহেবের কেবল একটা দিক দেখেছেন যে দিক আসলে কেউ দেখাতে চায়নি, কিন্তু সারাহ্র মতো তলে তলে অনেকেই সেটা জানে। তাই তার জানা জিনিসগুলি এখানে আর নাইবা বলা হল। কারণ তাকে নিয়ে ওই ঢাউস স্মারকগ্রন্থে চাইলে সবাই সেসব পড়তে পারবে। তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রচ- গরমের দিন গামছা পরে বসে আছেন রাতের বেলা। অপেক্ষা করছেন মেয়েটা কখন আসবে। এই দৃশ্য তো সেখানে পাওয়া যাবে না। আমাদের সারাবান তহুরা অবশ্য সেটি দেখেছে। তিনি ওই বিশেষ সময়ে বরাবরই গামছা পেঁচিয়ে রাখতেন কোমরে। কারণ তাতে ঘামমোছাটা যেমন হতো, পরে আরামও হতো। আর সহজেই খোলা ও পরাও যেত। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একজন মানুষ যে ক্রিকেট নিয়ে জীবন পার করবে বলে মনে করেছিল, সে হঠাৎ এসে দেখলো ক্রিকেট নিয়ে জানার আগ্রহ তাকে এ সম্পর্কে যত জ্ঞানী করে তুলছে, ততই সে অন্য সবার সঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, অন্যরা তাকে আর নিতে পারছে না। এই নিতে না পারার জন্য আসলে অন্যরা তো দায়ি নয়, সে নিজেই দায়ি। কোনো অভিমান থেকে নয়, যখন কোনো কিছু একটা জায়গায় খাপ খায় না, সেটিকে তো সরে যেতেই হয়। বা খসেও যেতে হয়। তো সেজন্য সে খসে গেছে। আমরা কী করলাম, তার খসে যাওয়াটাকে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে দেখতে চাইলাম সেখানে আসলে সে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সেখানে সে তাকে নিয়ে যাওয়া হল একটি চাকরির ভাইভা বোর্ডে, সেখানে তার সঙ্গে দেখা করানো হল, বা তাকে দেখলে সারাবান তহুরা নামের এক নারী, যার জীবন খুব স্বাভাবিক নয়। আসলে এখানে তো আপাতভাবে কোনো স্বাভাবিক লোক তো নেই। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে সেই প্রিন্সিপাল আছেন, তাও খুবই অল্প সময়ের জন্য, তাকে আমরা স্বাভাবিকই বলতে পারি। আসলে জহরতকে যে সেই প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হবে না এটা তাকে দিয়ে বলানো। সারাহ্ চেয়েছিল তাকে কোথায় একটা ব্যবস্থা করতে। সেই চেষ্টাই আসলে সে এখানো করতে চায়। তার যে তিনটা বর পাওয়া হয়েছিল, সেখানে একটা বর সে জহরতকে কোনো একটা কাজে ঢুকিয়ে দিতে পারলে খুশি হতো। জহরতের বয়স এখানো ত্রিশ হয়ে যায়নি। এখনো তার সরকারি চাকরির বয়স আছে। এটা তাকে নতুন করে বার বার মনে করবে সারাবান তহুরা। অন্য দিকে তার বাবার ভূমিকা এবং আশঙ্কা ছিল ছেলে না জানি ভবঘুরে লোকে পরিণত হয়ে যায়। তার চোখের সামনে ঢাকা শহরের সবচেয়ে ইন্টেলেকচুয়াল ভবঘুরেদের একজন সাবদার সিদ্দিকীর নমুনা ছিল। একজন সাবদার সিদ্দিকী হওয়াও তো কঠিন। তার পুত্রকে নিয়ে তার নিজের আর কোনো পরিকল্পনা নেই। একটা পর্যায়ে সবকিছুকেই ছেড়ে দিতে হয়, তিনি তার আগে থেকে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আরো বেশি নিজের কাজের ভেতরে ডুবে যেতে চাইছেন। জহরতের ভাইবোন দুটোকে আমরা এখানো দৃশ্যপটে আনিনি। মনে হয় না আনার দরকার পড়েব। কারণ তারা অনেকটা স্বাভাবিক চরিত্র অন্তত এই উপন্যাসের তাদের তেমন কোনো সংকটে পড়তে হয়নি। পরবর্তীকালে তাদের জীবনে প্রেম এলে বা তারা জীবিকায় যদি সংকটে পড়ে, জীবনের গভীর কোনো প্রশ্ন যদি তারাও বোধ করেÑ তাহলে হয়তো তারাও আমাদের লেখার বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
৮. সারাহ্ , জহরত এবং আমান ডেভিড
জহরত আর সারাবান তহুরা আগে মুখোমুখি দুটো সোফায় বসে থেকে কথা বলতো। ‘অতএব চিহ্নে’র মতো সারাহ্র বসার ঘরে মুখোমুখি দুটো সেফার মাঝখানে লম্বা তিনজনের মতো বসতে পারে সোফাটা। তার সামনে একটা টিটেবিল। এখন তারা ট্রিপল সেই সোফায় বসে। এই তো সেদিন জহরত এসে সিঙ্গেল ওই সোফাটা, যেটাতে বসলে মাঝে টিটেবিল আর তার পাশে তিনজনের বসার মতো সোফা রেখে, অন্য দিকে যে সিঙ্গেল সোফাটা ছিল, যাতে বসতো সারাহ্, তাতে মুখোমুখি হতো। বেশ দূরত্বে চলত কথাবার্তা। সেই মুখোমুখি বসতে মনের ভেতরেই একটা অস্বস্তি থেকে নিজের অজান্তেই জহরত ওই ট্রিপল সোফাটায় বসে, তখন কি একবারও ভেবেছিল যে সারাহ্ এসে সেই সোফায় তার পাশে অবলীলায় বসে পড়বে? একথায় সে কথায় তার বাহুতে আঙুলের খোঁচা দেবে বা তার ঊরু স্পর্শ করবে, কখনো ঊরুতে হাত রেখে আর হাত সরাবেই না? এবং কখন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে যাবে, সেটাও সে খেয়াল করেনি। আর যখন খেয়াল করতে যাচ্ছিল ততক্ষণে সারাহ্ তার আগের গম্ভীরভাবওয়ালা কথাবার্তা থেকে সরে গিয়ে নতুন একটা মানুষ হয়ে উঠবে। জহরত তাকে বলবেও যে,‘আপনি তো গিরগিটির মতো। এত রঙ বদলাতে পারেন।’
সারাহ হেসে গড়িয়ে বলে, ‘আমি তো তোমাকে ধোঁকা দিতে চাই না, রঙ খেলিয়ে কাছে টানতে চাই।’ বলে এমন হাসিতে ভেঙে পড়বে যেভাবে আর কখনো সে তাকে হাসতে দেখেনি। সারাহ্কে এই প্রথম তার ছেনাল ছেনালও মনে হবে। জহরত নিজেও তো একটা ঢ্যামনা হয়ে গেছে।
‘তুমি কী খেতে পছন্দ করো।’
‘আমি আসলে যেকোনো কিছুই খাই। আলাদা করে আমার তেমন পছন্দ নেই। কেন বলেন তো?’
‘আজকে রাতে তুমি আমার সঙ্গে খাবে।’
‘এখন কটা বাজে?’
‘কেন তোমার কোনো কাজ আছে।’
সারাহ্ আগেরমতো সাদা শাড়ি পরা। হাতে সাদা বালা। কানে সাদা দুল। গলায় সাদা মালা। সাদা ব্লাউজের ভেতরে থাকা সাদা ব্রার স্ট্রাইপ আর ধারগুলোও স্পষ্ট ছিল সেদিন বেশি। পুরো ঘরটা যেন অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল। জহরত কীসের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছিল। মৃদু ঝাঝালো। কোথা থেকে অসছে সেই গন্ধ। এই গন্ধ তার একেবারেই অপরিচিত। একবার সে বলেওছে,‘কীসের যেন একটা গন্ধ আসছে?’
‘কই আমি তো পাচ্ছি না। আচ্ছা আমার মুখ থেকে আসছে না তো। দেখো তো।’ বলে সারাহ্ জহরতের খুব কাছে ঘেঁষে মুখ এগিয়ে নিয়ে যায়। চোখ বন্ধ।
‘কী হলো, দেখো।’
‘দেখলাম তো, কোনো গন্ধ নাই।’
সারাহ্ কিছুক্ষণ জহরতের মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে হাঁ করে থাকে। তারপর ভেতরে ভেতরে দমে গিয়েও স্বাভাবিকভাবে আবার সোফায় বসে পড়ে। জহরত যে একেবারে বুঝতে পারেনি, তাতে তো না। কিন্তু তার কোনো রকমের ইচ্ছা হয় না।
সারাহ্ বসেই বলে, ‘আমি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করেছি।’
‘বাসায়?’
‘না, চেম্বারে।’
‘কী নিয়ে?’
‘ভুয়া জিনিস নিয়ে।’
‘এখন তো তিনি আর অপারেশান করেন না। তার জুনিয়াররা করে। সার্জানদের সময় তো অল্প সময়। অল্প সময়েই যা কামানোর কামিয়ে নিতে হয়। আমার বাপ মনে হয় ভালোই কামানো কামিয়ে ছিল।’
জহরত আলাপগুলিও কোনো সময় প্রেম ভালোবাসা জীবনের তৃপ্তি অতৃপ্তির দিকে নিয়ে যেতে চায় না। তার ঘুরে ফিরে একটাই কথা কী করবে সে। কী করবে তা জানে না, কেবল জানে সে আত্মহত্যা করতে পারবে না। সেটা পারবে না, এই কারণে নয় যে আত্মহত্যা করলে পাপ হবে। বরং সেটা করার কোনো মানেই পায় না।
সারাহ্ বলেছিল, ‘তাহলে একটাই কাজ করা যায়।’
‘কী সেটা?’
‘অপেক্ষা করা, কিন্তু এমন একটা কাজ করা যা তোমার কোনো কাজে আসুক বা না আসুক, সেই কাজটা চালিয়ে যাওয়া আর তখন একটা জিনিসই মনে রাখা যেÑ লেট ইট বি। বি রিয়ালিস্টিক বাট প্ল্যান ফর দ্য মিরাকেল।’
‘আপনি মিরাকেলে বিশ্বাস করেন।’
‘কেন করব না? জীবনটাই তো মিরাকেল। জন্ম থেকে এর শুরু। তাই না। আমি তো এদেশে না জন্মে আফ্রিকার গহীন কোনো বনেও জন্মাতে পারতাম বা জন্মাতে পারতাম আমেরিকায় বা ব্রাজিলে।’
‘এই দেশে জন্মে কী আপনি খুশি?’
‘একেক সময় একেক রকম মনে হয়। ঠিক বুঝতে পারি না। তবে কী জানো যেখানেই থাকি ফিজিক্যালি যদি ও.কে থাকি, অসুখবিসুখমুক্ত থাকতে পারিÑ তাহলেই আমি খুশি।’
জহরত আগে কখনো বলেনি। সেদিন বলে, ‘আচ্ছা, আমান ডেভিডের ব্যাপারটা কী?’
সারাহ্ ভেতরে একটু চমকে ওঠে। যদিও সে চমকে ওঠাটা আড়াল করতে পারে। সারাহ্ জানে তার সবচেয়ে বড় গুণের একটা হলো, সে তার সব রকম অনুভূতি চাইলেই আড়াল করতে পারে। আবার সময় মতো রাগের অভিনয় করতে পারে। কান্নার অভিনয়ও করতে পারে। এই অভিনয়ের সময় সে আবার ভেতরে ভেতরে হাসে। আমান ডেভিড তাকে মাত্র একবারই ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক ভয় দেখিয়েছিল। এসিড মারবে। এই করবে, সেই করবে। কিন্তু কেবল কথাই। সারাহ্ ভেতরে ভেতরে ঠিক বুঝতে পেরেছিল, তার মুখটা, তার শরীরটা আমানের চোখে যত শান্তি দেয় জগতের আর কোনো কিছু দেয় না। সারা ঘরে সারাহ্র নানান করমে ছবি বাঁধানো। Íেদিন পর সে প্রতম বুঝতে পারে, একদিন দিলারা আপা আর তার বর তাকে কেন দলে বলে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, আর প্রচুর ছবি তুলেছিল। দিলারা আপাকে পরে জিজ্ঞাসা করে জানে, ঢাকা শহরের আমান ডেভিডের কয়েকটা বাড়ি। তারই একটা একটা বাড়িতে তারা ভাড়া থাকে। তাদের একরকম বাধ্য করেছিল লোকটা। ওই সময় তাদের খুব টানাটানি চলছিল। মাসের ভাড়া দিতে দেরি হচ্ছিল বলে আমান তাকে দেখা করতে বলে। নিজের ভাড়াটের বেলায় এসব বদান্যতা নাকি ছিল। ভাড়া মওকুফ করতো, লোন দিত, কারো বিপদে গাড়ি লাগলে গাড়িও দিত। দিলারার স্বামী সেই টানাটানির কথাটা বলতে, আমান তাকে মোটা টাকা দিতে চায়, শর্ত একটাই কয়েকদিন কয়েকটা আলাদা জায়গা গিয়ে সারাবান তহুরার যত পারে তত ছবি তুলে আনতে হবে।
লোকটা সত্যিই অদ্ভুত। আর আমান ওই ধরে নিয়েই কেবল দেখতে চেয়েছিল আমি কতটা তাকে ফেরাতে পারি। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরেছিল, আমি মোটেও কোনো সস্তা মেয়ে নই। আমি কোনো ভয়ের কাছে নত হই না। আমার সেদিনের প্রত্যাখ্যানে সে আসলে হারেতোনিই বরং রীতিমতো জিতেছে। কী সব কা- করেছিল সেদিন ডেভিড। সবলোকজনকে ভাগিয়ে দিয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, সে এখন যা যা বলবে সব ঠিক মতো মেনে নিলে তার কোনো সমস্যা হবে না। কী করতে হবে তাকে বাধ্য হয়ে শরীর দিতে হবে? সারাহ্ ঝাঁজের সঙ্গে জানতে চেয়েছিল।
‘শরীর দিতে হবে না, শরীর মাপতে দিতে হবে।’
‘মানে কী?’
‘মানে কিছু না। গজ ফিতা দিয়ে মাপতে হবে আমার ঘাড় থেকে পায়ের এই কাফমাসল পর্যন্ত’।
‘এতে কী হবে?’
এই কাজটা সারাহ্ করতে পারবে কিনা সারাহ্কে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল। সারাহ্ও টের পেয়েছিল একাজটা তাকে কারিয়েই ছাড়বে। তাই সারাহ্ সব সময় যা করে দ্রুত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বা তাল মেলানো তাই করেছিল।
নিজে উলঙ্গ হলে একটা গজ ফিতা দিয়ে দর্জির মতো মাপিয়েছিল নিজের গলা, বুক স্বাভাবিক অবস্থায়, ফোলানো অবস্থায়, কোমর, পাছা, ঊরু, জঙ্গা। দেয়ালের দিকে পেছন ফিরে এই মাপ সে নিতে বাধ্য করেছিল। তারপর মেপেছিল সারাহ্কে। তার আগে বলেছিল, ‘কী মনে হলো?’
‘কী আর মনে হবে সব ঠিক আছে।’
‘তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়?’
‘সেটা তো আমি জানি না।’
‘কিন্তু আমাকে তো জানা লাগবে। আমি আপনাকে মাপতে চাই।’
‘কীভাবে?’
‘আমাকে আপনি যেভাবে মাপলেন।’
সে সারাহ্কেও কাপড় খুলতে বলে। সে রাজি হয় না। তখন ডেভিডের কী যেন হয়, সে শক্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে গজ ফিতা। গায়ে একটা সুতো নেই। সারাহ্ দেখছিল একেবারে নিখুঁত শরীর আমান ডেভিডের। পুরুষ মানুষের শরীর ঠিক যা হওয়ার তাই। ঘরের মধ্যে একটা থমথমে পরিবেশ। এই সময় জানালা দিয়ে তাকিয়েছিল। সকাল থেকেই সেদিন আকাশ মেঘলা। পর্দা টানানো ছিল। তারপরও বাইরে যে ধুমছে বৃষ্টি নেমেছে সেটা টের পাওয়া গিয়েছিল। ঘরের ভেতরে ততটা জমাট বাঁধতে থাকে আরেক মেঘ। ‘কী হলো?’ হঠাৎ সারাহ্ই জানতে চায়। ডেভিড কোনো উত্তর দেয় না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। থমথমে মুখ। সারাহ্রা মনে হয়, যেমনটা তার হয়, দেখাই যাক না বলে একে একে সব কাপড় খুলে ফেলে।
‘হলো?’ কৌতুক নিয়ে বলে। ডেভিড তখন মূর্তি থেকে প্রাণ পায়।
‘সোজা হয়ে দাঁড়াবেন?’সে কোনো কথা না বলে সারাহ্কে মাপতে থাকে।
সারাহ্ বলে, ‘তুমি তো মাস্তান শুনেছিলাম এখন দেখছি দর্জিও।’
মাপা শেষ হলে ঘষ ঘস করে একটা কাগজে কী কী লিখে রাখে। তারপর সারাহ্র দিকে ফিরে বলে,‘কাপড় চোপ পড়ে নিন। আমার গাড়ি এসে নামিয়ে দিয়ে আসবে।’
‘গাড়ি লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।’
এরপর থেকে নতুন একটা উৎপাত শুরু হয়। প্রায় কদিন পর পর নানান রকমের কাপড়চোপড় আসতে থাকে। আসে ব্রা, প্যান্টি, জিনসের প্যান্ট, টিশার্ট, গেঞ্জি, শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ। কত রকমের কসমেটিক্স। সারাহ্ কখনো ডেভিডকে ফোন করেনি, কিন্তু কদিন চলার আর আর সহ্য করতে না পেরে তাকে ফোন করে।
‘এসবের মানে কী?’
‘আপনাকে আমি একেকদিন একেক পোষাকে দেখতে চাই।’
‘মানে কী? আমি কি জিনসের প্যান্ট পরে বের হব। কখনোই না।’
‘তা কেন? আপনি বাসার ভেতরে পড়বেন আমি আপনাকে দেখতে যাবো।’
‘এসব খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!’
‘দেখুন আমি আপনাকে যা খুশি করতে পারি।’
এবার সারাহ্ চিৎকার করে ওঠে, ‘তো আসো, এসে যা খুশি করে যাও। আমি কি তোমার দাসি বান্দি নাকি। তোমার যা খুশি কী করতে চাও। ডু ইয়্যু ওয়ান্ট টু রেইপ মী? দেন কাম অন। কাম হেয়ার অ্যান্ড ফাক মি অফ!’ প্রচ- জোরে চিৎকার করে উঠে মোবাইলাটা কেটে দিয়ে, বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে সে। আশ্চর্যজনকভাবে ডেভিড আর কোনো দিন তাকে কোনো কিছু বলেনি। কেবল একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, ‘আমি অপেক্ষা করছি।’
৯. সারাহ্ ও আখ্যানের অভিমুখ
এসবের কোনো কিছুই কাউকে বলা যায় না। জহরতকেও না। জহরতকে আসলে তার আর মাপার কিছু নেই। তবু উত্তরে বলে, ‘ডেভিড কদিন জ্বালাতন করেছিল।’ সারাহ্ দেখল তার সেই ইঞ্জিনিয়ার স্বামী, ডেভিড, মিল্লাত, জহরতÑ এই চার জনকে তার নানান ভাবে দেখা হয়েছে। একদিন রাতের বিছানায় শুয়ে এঁদের কথা ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়, হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে, তার জন্য তেমন কেউ অপেক্ষা করছে। যে সত্যিকারে পুরুষ। আসলে কাকে বলে সত্যিকারের পুরুষ? যে তার ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর মতো তাকে ছেড়ে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাবে না; ডেভিডের মতো দখলদারিত্ব চাইবে না; কেবল বাসনার ব্যাকুলতা থেকে তাকে ভোগ করবে না মিল্লাতের মতো; আর জহরতের মতো অনুভূতিহীন হয়ে থাকবে না। তাহলে কেমন হবে সেই পুরুষ?
আমার এই আখ্যানের শুরু থেকে জহরতকে এক দ্বিধাময় সময়ের ভেতরে দেখেছি। জহরতকেতই চাইলে আমরা সারাহ্র দিকে ঠেলে দিতে পারতাম। সারাহ্ তো তাকে তার দিকে টেনেই এনেছিল। কিন্তু জহরত সাড়াহীন। আসলে মানুষ অনেক রকম হয়। কিন্তু কামনাবসনাহীন হয় সেটা সত্যিই জানাছিল না। হয়তো অনেক লোক চিরকুমার থেকে যায় একারণেও। অব্যবহৃত থেকে যেতে যেতে সে একেবারেই এর প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হয়তো আসলে তার ক্ষেত্রে ওই হরমনের নিঃসরণই হয় না। নারীর প্রতি কোনো বোধই তার কাজ করে না। কিন্তু এটা তো একধরনের প্রতিবন্ধী দশাও নাকি? আসলে আমরা মানুষ নামের রহস্য খুঁজতেই নানান আখ্যানের জন্ম হয়। আখ্যান লেখা হয়। বিজ্ঞান কত না সূত্র বের করেছে, কিন্তু মানুষকে বিজ্ঞান দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়নি। মানুষকে আসলে কী দিয়ে ধরা যায়, তা তো আমরা ঠিক জানি না। কত জ্ঞান কত কিছু মানুষকে বোঝার জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু যখন আর বোঝা যাচ্ছেই না, তখন মানুষকে কয়েকটা দিকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে। সেটা হল মানুষকে বানানো হচ্ছে অর্থবিত্তখ্যাতিলোভী ভোগসর্বস্ব জীব। এই জগতের তাবৎ আখ্যানকাররা জানেন যে বিশ্বের একটি বৈদ্যুতিক মাধ্যমের ঘোষণাই ছিল জগতে আর কোনো গ্রেটই ম্যান তারা হতে দিবে না। নেলসন ম্যান্ডেলাই শেষ। এর পর আর কেউ নেই। মিডিয়া কাউকে আর মহাত্মা বানাবে না। এখন মিডিয়া তৈরি করছে অসংখ্য স্বপ্লস্থায়ী বিখ্যাত মানুষ। যারা ফেনার মতো এসে, ফেনার মতো বিলীন হয়ে যায়। এখনকার আখ্যানের কাজও তাই মহাত্মাদের নিয়ে নয়। এইসব ফেনার মতো এসে ফেনার মতো মিশে যাওয়া মানুষকে নিয়ে। আমাদের এই আখ্যানের সবাই একেবারে মানবিক দুর্বলতারও ত্চ্ছু জিনিস নিয়ে ব্যস্ত। আর এটাই তাদের বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়া। তাদের বাঁচা বা মরে যাওয়া নিয়ে আসলে কোনো আক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। যদিও আমরা দাগিয়ে দিতে পারি না, তাদের ভেতরকার সবকিছু আমরা তুলে ধরতে পেরেছি। বেশিরভাগই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। আবছা আলোয় যতটা দেখা গেছে তার বেশি তো তাদের আমরা দেখাতে পারিনি বলেই আমরা শেষে এমন একটা ঘটনা দেখি, যা নিয়ে আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আদতে এই আখ্যানে কাউকে নায়ক বানানোর চেষ্টা হয়তো কিছুটা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটি ব্যর্থ হয়েছে, কারণ মানুষের এখন আর নায়ক হওয়ার ক্ষমতা নেই (কেবল ব্লুফিল্মের নায়ক ছাড়া বা বাৎসায়নের কামসূত্রে আসন বিন্যাস দেখানোতে উল্লিখিত হওয়ার নায়ক ছাড়া)। বরং ভিলেন হওয়ার কিছুটা ক্ষমতা এখনো বাকি আছে। যেমন আমান ডেভিড হতে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরও তাকে আমরা ভিলেন হতেও দেখলাম না। জহরতকে তো আমরা কোনো দিকেও যেতে দেখলাম না। যে মানুষ আকাক্সক্ষাশূন্য হয়ে যায়, হয়তো সে সবকিছু থেকেই শূন্য হয়ে যায়। জহরতে বাপটা মানুষ না যন্ত্র সেটা বোঝা মুশকিল। এর চেয়ে তার মা অনেকটাই জীবন্ত। যদিও এই আখ্যানে তার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। জহরত মনে করেছিল, যে একদিন কেন্দ্রে চলে আসবে তার ক্রিকেট খেলার দক্ষতা ও এর সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞানের ভেতর দিয়ে, কিন্তু তার বদলে সে আসলে কেন্দ্রে পৌঁছানো তো দূরের কথা সে তার নিজের বৃত্তেরই বাইরে চলে গেছে যে,সে আর কোনো বৃত্তেই প্রবেশ করতে পারবে না।
তবে আমাদের এখান যে সারাবান তহুরাকে হাজির করেছিলাম। তাকে অনেকটা সাহিত্যের চরিত্র বলা যেতে পারে। এমন নারী সচরাচর আমরা দেখি না। যদিও তাদের অস্তিত্ব আছে, সেটা আমাদের জানাশোনার অনেক দূরে পড়ে থাকে। সেও কি নায়িকা হয়ে উঠতে চেয়েছিল? সে তার জীবনের নতুন একটা মাত্রা দিতে চেয়েছিল কোনো একটা পুরুষের ভেতর দিয়ে। পুরুষের প্রতি কোনোভাবেই সে কোনো আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারছিল না। তার স্বামী তাকে চায়নি, কিন্তু সেও তো স্বামীকে তেমন করে চায়নি। আর যারা তাকে চেয়েছিল তাদের প্রতি তার কোনো আগ্রহই জাগেনি, এক ধরনের যান্ত্রিকতা ছাড়া। আর যাকে সে নিজের আয়ত্তে চাইল, মনে করেছিল তাকে সে ভুলিয়েভালিয়ে নিজের মতো তৈরি করে নিতে পারবে, তার কোনো সত্তা আত্মা বলে কিছু আছে কিনা কে জানে, হয়তো কোনো সাহসই নেই পুরুষ হয়ে ওঠার। তবে সে একেবারেই বোকার হদ্দ তা তো নয়। সে আসলে অনেক কিছুই খেয়াল করে কিন্তু নারী তার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। তারচেয়ে জরুরি ছিল তার একটি পরিচয় বা আইডেন্টিটি তৈরি করা। কিন্তু কী সে পরিচয় সেটা সে জানে না।
আখ্যান যেভাবে যতটুকু এগিয়েছিল, তাতে কারো আর কোনো আকাক্সক্ষার নেই, প্রতীক্ষা নেই, অপেক্ষা নেই। সারাহ্ অন্তত জানে যে চারটি পুরুষকে দেখা হয়েছে। আর কত রকম হতে পারে মানুষ? ছয়শো কোটি মানুষ ছয়শো কোটি রকমের কিন্তু তাদের পার্থক্য বেশি হয়ে একটি বিন্দুর বেশি নয়। মানুষ ওই বিন্দু জন্যই একটাই আরেকজন মানুষের চেয়ে আলাদা হয়ে যায় যে, তাকে আর কোনো জালে ছাঁচে বেঁধে ফেলা যায় না। সেই রকম জালে ছাঁচে বাইরে সারাহ্ এখন নিজের মতোই দিন কাটাচ্ছিল। তার অফিস মনে যে স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ায়, সেখানকার এক সহকর্মীর কথায় সে একটা ফেসবুক খুলে ছিল। কিন্তু সেখানে সে তেমন কোনো মজা পায়নি। ফলে খুলে সে কোনো রকম ফেসবুকিং করে না। লাইক দেওয়া, ফটো শেয়ার করা, বা ফটো অ্যাড করা, ভিডিও শেয়ার করা এসব জানে না। বাসায় কম্পিউটার তার কাজে লাগে খবরের কাগজ পড়তে। নানান রকমের তথ্য জোগাড় করতে, ক্লাসে বাচ্চাদের চমরপ্রদ কিছু দেওয়ার জন্য নেট থেকে সে অনেক কিছু মাঝে মাঝে ডাউনলোড করে। করে প্রিন্ট আউট নেয়। অনেক কিছু ফেলেও দেয়। যতটা স্ক্রিনে পড়ে ভালো লেগেছিল, পরে দেখে প্রিন্ট আউট নিয়ে আর তত ভালো লাগছে না। তারপরও ওই খোঁজা ও নতুন তথ্য নিয়ে তার দিন কাটছিল ফেসবুকের কথা সে ভুলেও গিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে খুলে ছিল মনে পড়লো একদিন বিকালে ডোরবেল বেজে ওঠার পর।
০. শূন্য থেকে হঠাৎ আরেকজন
সারাহ্ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ইউসোবিওকে সে চিনতেই পারছে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। কত কত যুগের ওপার থেকে কণ্ঠস্বরটা এলো?
‘সারাহ্! আমি!’ মনে হচ্ছিল এই স্বরটা এমন এক অতলে তলিয়ে গিয়েছিল যে আর কোনো দিন এ স্বর শোনার কথা নয়। মহাশূন্যের কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিল এই স্বর।
সারাহ্দের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকতো ওরা। কোনো মতে দিন চালাত ওর মা। বাপ ছিল একটা আস্ত ভবঘুরে। মা একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াত। ছেলেটাকে ভালো করে মনেও নেই। মীরজাহান? বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার হলে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে বেইলিরোডের একটা রেস্টুরেন্টে বসেছিল। সেদিন বলেছিল আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে,‘তোমাকে তো পুরো ইউসোবিও-র মতো লাগছে।’ মীরজাহানই তো। মীরজাহানের সেদিন পছন্দ হয়েছিল সারাহ্র এই কথাটা। ক্লাস নাইনে নিজের নাম থেকে সে ‘বিশ্বাস’ শব্দটি ফেলে দিয়েছিল। তারপর থেকে রাতরাতি সে অন্য ছেলেতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কাগজে নয়,‘বিশ্বাস’টা বুকেই থাক।
বন্দরটিলা থেকে যে রাস্তাটা তাদের বাড়ির দিকে গেছে এক বিকাল বেলা সেদিক দিয়ে না এসে সে অন্য পথ দিয়ে হেঁটে আসছিল, একা। দূর থেকে তাকিয়ে ছিল ছেলেটি। সারাহ্র কখনো আগে এমন অস্বস্তি হয়নি। ছেলেটা কেমন একটা অসহায় বেচারি মুখ নিয়ে তার আসার এবং তার সামনে দিয়ে চলে যাওয়াটা দেখেছিল। দুপাশে গাছপালার শাখাপ্রশাখা এসে একটা টানেলের মতো সেই পথটার ওই জায়গা একটু সরলরেখার মতো। সারাহ্ দূরে গিয়েও মনে হল ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে পেছনে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা নেই। আশ্চর্য! তারপর থেকে ওই পথে আরো অনেকবার গিয়েছে। কিন্তু ছেলেটির দেখা পায়নি। একদিন এমন একা যখন আসছিল সে পিছন থেকে বলে, ‘এই একটু শুনবে?’
সারাহ্ একটু চমকে উঠে পিছনে তাকায়।
‘তুমি কে? কী নাম তোমার?’
‘আমার নাম মীরজাহান!’
‘তোমার নাম?’
‘সারাহ্। পুরো নাম সারাবান তহুরা।’
এইটুকু কথা হয়েছিল। বহুদিন আর তাকে দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ করে হাজির হয়ে সে তাকে ভীষণ অবাক করেছিল। এরপর আবার উধাও।
জীবনের কত কিছু একের পর এক ঘটে চললো। এই তো গতদিন পর্যন্ত সারাহ্ নতুন একটা কিছু ঘটাতে চলেছিল। পারেনি। তারপর সে ঠিক করলে আজ থেকে সে তার ভেতরের সমস্ত ফণা গুটিয়ে ফেলবে। সারাহ্ তার নিজেকে সাপের না মানুষের জীবনযাপন করতো জানে না। সাপ একটাই ফণা তুলতে পারে। মানুষের ফণা অগণতি! একই মানুষ কত রকমের সাপ হয়ে উঠতে পারে সারাহ্ কেন, কেউ জানে না। সাপের স্বভাবের মানুষদের কখনোই আগে থেকে চেনাও যায় না।
আজ এত বছর পর মীরজাহান! সেই পুরোনো কথাটাই বলল, ‘আমার নাম মীরজাহান। এসেছি তোমার দ্বারে।’
শব্দটা এমন দ্বিধা সংকোচ আর লজ্জা নিয়ে বলছে যেন এই নামের ভেতরে রাজ্যের লজ্জা মিশে আছে। আর তাতে আছেই। সেই ছোটবেলায় দুইবার দেখা এবং অনেকদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর আজ এত এত বছর পর সেই মানুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যার অস্তিত্ব আছে কিনা নেই সেটা ভাবা তো দূরের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল তা নয়, মাঝে মাঝে চকিতে মনেও পড়তো। কিন্তু আসলে তো মীরজাহানকে মনে রাখার কোনো কারণও নেই।
সারাহ্কে বহুবার বহু ছেলে ছোটবেলা থেকে স্কুলে পড়ার সময় কি কলেজে পড়ার সময় এমনকি বিশ্বাবিদ্যালয় পড়ার সময় কত না ভাবে ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তোমার নামটা? আপনার নামটা?’ ছোটবড় কত রকম ছেলে। মেয়েরাও। সে চোখে পড়ার মতো মেয়ে ছিল না। কেবল তার সুন্দর গড়ন আর লম্বা চুল ছাড়া। যে চুল সে তার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী চলে যাওয়ার পর আর বড় করেনি। বিধবাদের মতো সাদা কাপড় পরে পরে দিন কাটিয়েছে। নিজেকে তৈরি করেছে কোনো এক পুরুষের জন্য, যে একদিন এসে তার সমস্ত অপেক্ষার ইতি টেনে দিবে। তারপরও সে মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওঠেনি। তা না হলে সে কেন জীবনের নানান সময়ে ঠিকমতো পা ফেরতে পারেনি। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের একটা ভেতরের জীবন থাকেÑ সেখানে সে ছাড়ার আর কেউ ঢোকার অনুমতি পায় না। সেই নজের জগতের কোথাও তো সে টের পায়নি মীরজাহান নামে কেউ একজন আছে। যে তার জন্য অপেক্ষা করেছে। নিজের জীবনেও নানান ওঠা-নামার ভেতরে দিয়ে, বেশ কয়েটা কয়েকটা সম্পর্কের ভেতরে দিয়ে তাকেও জীবনের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে। ঠিকটা বেছে নিতে হলে বার বার ভুল হয়Ñ এই মতো যে তার ভুল হয়েছে তা তো নয়। কারোরই একইভাবে ভুল হয় না। ভুল মানুষের জন্য অপেক্ষা করে নাকি মানুষ ভুলের জন্য অপেক্ষা করে? যেটা সুযোগ নয়, তাতে ভুল ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ তো সব সময় সৌভাগ্যও নয়। কারণ আজ যে সৌভাগ্য আগামীকাল বা কিছু দিন পর সেটাই ভয়াবহ দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
‘সব কথা তো আর একদিনে বলা যাবে না।... কিছুটা সময় নেবে। যদি আপনি শুনতে চান।’ সে যতবারই ‘তুমি’ বলতে চেয়েছে ততবারই ‘আপনি’ বের হয়ে গেছে। কারণ সে যেখানে কাজ করে সেখানে ঝাড়–দার থেকে সর্বোচ্চ পদে থাকা সবাইকেই ‘আপনি’ বলে। তুমি বলবার লোক তার বলতে গেলে কেউ নেই। বন্ধু যারা ছিল তাদের সঙ্গে বছরের পর বছর দেখা হয় না। সবাই বিচ্ছিন্ন।
পরে বলেছিল মীরজাহান,‘আমি কেবল তোমার নামটাই মনে রেখেছিলাম। আর কিছু না। আমি জানি কেবল এই নামটাই আমাকে তোমার সামনে নিয়ে আসবে। কিন্তু কীভাবে সেটা আমি জানি না। অনেকেই বলে কম্পিউটার সভ্যতার মহত্তম আবিষ্কার, কিন্তু সেই মহত্তম আবিষ্কারের আরেক আবিষ্কার হল সোশ্যালনেটওয়ার্ক ফেসবুক। এটা চালু হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন আমি তোমার নাম লিখিছি। কিন্তু এই নামে কোনো দিন কাউকে পাইনি। নামটাই ছিল তোমাকে খোঁজার এক এবং একমাত্র সূত্র আর কিছু না।
‘সত্যিই আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।’ সারাহ্ অনেকক্ষণ দুহাতে মুখ ঢেকে বসেছিল। সে মুখ তুলতেই পারছিল না। প্রচ- এক আনন্দ আর একই সঙ্গে গভীর এক লজ্জা তাকে মুখ তুলতে দিচ্ছিল না।
মীরজাহান বলে, ‘কী হলো। এভাবে বসে আছো কেন? মুখ তোলো।’ একক্ষণে তার মুখে ‘তুমি’ এলো।
‘আমি আজ আর এই মুখ তোমার সামনে তুলতে পারবো না। তুমি আজকে এসো। আগামীকাল তুমি যখন ইচ্ছা আমাকে তোমার কাছে ডেকে নিতে পারো। আমি তৈরি থাকবো।’ সারাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে আমার মোবাইল থেকে তোমার মোবাইলে একটা কল করো। আমার নাম্বারটা পাবে। আগামী কোনো এক সময় আমাকে তোমার খুঁজে পাওয়া গল্প শুনবো।’
‘তবে তাই হবে।’
মীরজাহান সারাহ্র দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই ঘর থেকে বের হয়। দরজাটা খুলে বন্ধ করার আগ পর্যন্ত সারাহ্কে সেভাবেই বসে থাকতে দেখে। তার মুখে একটা হাসির রেখা ভেসে ওঠে। জীবনের আরেকটি নতুন আখ্যানের দিকে সে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পা ফেলে ফেলে সে নামতে থাকে।#
আবছা আলোয় দেখা কয়েকটি মুখ
হামীম কামরুল হক
১. জহরত
কয়েকদিন গরমের পর আজ খুব হাওয়া দিয়েছে। সন্ধ্যার একটু পর অফিস থেকে ঘরে ফিরছিল জহরত। সোডিয়াম লাইটের আলোয় তার মুখটা দূর থেকে আবছা দেখা যাচ্ছে। এরকম করেই ফিরছিল আরো কয়েকজন। আগে প্রায় প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকেরই নানান সময়ে দেখা হতো। জীবন ও সময় কাছের মানুষদের দূরে ঠেলে দেয়, দূরের মানুষদের কাছে আনে। তবু মাঝে মাঝে দেখা হয়, দূর থেকে দেখা। এলিফ্যান্ট রোডে তখন জ্যামে আটকে আছে আমানুদ্দিন ম-ল ওরফে আমান ডেভিডের ওরফে ডেভিডের গাড়ি। দেখলো সারাহ্ একজন পুরুষের সঙ্গে মাল্টিপ্ল্যান সেন্টারের সিঁড়ি দিয়ে নামছে। কী ঝলমলে দেখাচ্ছে তাকে! আমান চোখ সরিয়ে সামনে তাকালো। তেমন কিছু মনে হলো না। সময় তার নিজের অজান্তে অতীতের তীব্রতাও মুছে দিয়ে গেছে। যাকে ভালোবাসি, আমার সঙ্গে না থাকুক, সে যেখানেই যার সঙ্গে থাকুক, সে যেন সময় ভালো থাকেÑ এই বোধটাই তো ভালোবাসার বড় দিক। আমান এসবও জানে না। সে এটুকুই চেয়েছিল, সারাহ্ ভালো থাকুক; বুঝেছিল, তার মতো লোকের প্রতি তো আসলে সারাহ্র কোনো টান তৈরি হওয়ার কথা নয়। কার যে কেন কারো প্রতি টান তৈরি হয় এবং হয় নাÑ জগতের অনেক রহস্যের ভেতরে এই রহস্যটারও সামধান হয়নি। যেমন সারাহ্র যে টান তৈরি হয়েছিল জহরতের প্রতিÑ সেটা কোনো মায়া থেকে নাকি শারীরিক আকর্ষণ থেকেÑ সে সম্পর্কে সারাহ্ কোনোদিন নিশ্চিত হতে পারেনি। এবং একেবারে আজগুবি ছিল তার জীবনে জহরতের ব্যাপারটা।
অথচ একসময় জহরতের সঙ্গে তার নিজের ও জহরতের বাপ ডাক্তার আবু মুহম্মদ ইমরানের ব্যাপারগুলির নিষ্পত্তি প্রথমে হওয়া দরকারটা এমন বড় হয়ে দেখা দিয়েছিল। এরও অনেক আগে আমান ডেভিডের ব্যাপারটাও ছিল আশ্চর্য এক সমস্যাÑ এই লোকটা দিনের পর দিন সারাহ্র পিছে লেগেছিল। লেগে থাকলেও যে সব হয় নাÑ অনেক মূল্য দিয়ে তাকে বুঝতে হয়েছিল। ‘একবার না পারিলে দেখ শতবার’ কোনোখানে একেবারে শুরুতেই চলে না। পঙ্গু লঙ্ঘয়েতে গিরিÑ একথায় যতই রোমাঞ্চ জাগুক, বাস্তবে সম্ভব হয় না। যার পা-ই নেই সে তো হাজার চেষ্টা করে সে ফুটবল খেলতে পারে না। আমান আগের কালের গুন্ডা হলে হয়তো প্রতিদিনই পথ আটকে দাঁড়াত; হঠাৎ একদিন ভয়ংকর কিছু ঘটাতে পারতো। তার বদলে, সে সারাহ্কে বলেছিল, ফোন করলে ফোনটা যাতে কেটে না দেয়, এটুকুই তার অনুরোধ। সারাহ্ চেয়েছিল তাকে মোবাইলে ব্লকই করে দিবে, পরে একটু ভেবে তার মনে হল অল্প করে হলেও লোকটার ক্ষমতা আছে, ক্ষমতা মানে ক্ষতি করার ক্ষমতা।
সারাহ্ বার বার তাই জহরতকে বলেছিল আবার নিজের ক্লাবে ফিরে যেতে, গিয়ে নিজের ক্ষমতা আর যোগাযোগগুলি পোক্ত করতে। জহরত পারেনি; আসলে চায়নি বলেই পারেনি। ক্লাব থেকে, খেলা থেকে অনেক বেদনা নিয়ে নীরবে সে চলে এসেছে, সেখানে তো আর যেতে পারে না। সারাহ্ বলেছিল,‘অহংকার করো না।’ সারাহ্কে সে বলেছে, ‘এটা অহংকারে কথা নয়, আত্মমর্যাদার কথা।’ সারাহ্ জানে যে, জহরত নিজেকে একেবারে হেলাফেলা করার মতো কেউ নয় বলেই মনে করে। ইংরেজিতে পড়েছে, কতটা ইংরেজি জানে সেটা নিশ্চিত না হলেও ক্রিকেটটা তো জানে। এছাড়া দেখতেও মন্দ নয়। ঢাকায় নিজেদের বাড়ি। বাপ ডাক্তার। কোনোদিন কোনো কিছুর জন্য ভাবতে হয়নি; আর এখন সেই মানুষটাই একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে। জীবনটাকে কখনো তার কাছে অতল সমুদ্র হয়ে দেখা দেয়নি। এখন মনে হচ্ছে এর কোথাও কোনো কিনারা নেই। সারাহ্র ব্যাপারে সে আসলে কী সিদ্ধান্ত নেবে বুঝতে উঠতে পারছে না। এমন হবে জানলে কোনোদিন সে এদিকে পাই বাড়াতো না। এমনিতে ওপরে ওপরে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। জহরতে গায়ের রঙ ফর্সা। এজন্য চিন্তিত অবস্থায় তার মুখটা একটু লালাভ থাকে। এমনিতে বলিষ্ঠ শরীর। জহরত যাকে কিনা বলে, সুস্থ দেহে সুস্থ মন। ছিল, এখন নেই। তাও তার পেটা শরীরটা জামাকাপড় ফুঁড়েও যেকারো চোখে ধরা পড়ে। সেটা লম্বায় পাঁচ ফুট সাত ইঞ্চি হবে। বুকে পেশীর কপাট। বৃষস্কন্ধ বলতে যা বোঝায় জহরত তাই। ইদানীং পেটে কোমরে একটু চর্বি জমেছে। আসলে ক্রিকেটটা একেবারেই ছেড়ে দেওয়াটা ঠিক হয়নি। পেশাদার খেলোড়ার না হোক, মহল্লার মাঠে তো প্রাকটিসটা করতেই পারতো। তখন আবার বাবা মনে করতো ছেলেটা বুঝি আবার গেল। ‘যে যাÑ সেটা তাকে হতে না দেয়ার জন্য সত্যিই বাঙালি বাবাদের ভূমিকা অসাধারণ!’ ক্রিকেট কোচ বলেছিল। জহরত বলেছিল, ‘আপনার নিজের ছেলে বেলায় সেটা মনে রাখবেন, তাহলেই হবে বস।’ এলাকার ছোট ভাইয়ের মাঝে মাঝেই ডাকে, কিন্তু যাওয়া হয় না। ক্রিকেটটা কী?Ñ জহরত জানে, মানে ভালোই শিখেছিল, কিন্তু বেশি শিখেছিল বলেই মুশকিল হয়েছে। স্কুলের পড়ার সময় থেকে ক্রিকেটটা যেমন শিখেছিল হাতে কলমে, তেমন পরে বইপত্র পড়েও। কলেজে পড়ার সময় নীলক্ষেতের পুরানো বইয়ের কারবারি জাহাঙ্গীর, শাহজাহান, নজরুল, নূরুন্নবী,ফারুক, সজীবÑ সবার কাছে মোবাইল নম্বর দেওয়া ছিল, ক্রিকেটের ওপর কোনো বই আসলে তারা যেন ফোন করে। ক্রিকেট নিয়ে এত বইপত্র বাংলাদেশে খুব কম লোকের কাছেই আছে। সেই সঙ্গে ভিডিও দেখতো। সবমিলিয়ে নিজেকে ভালোই তৈরি করছিল। এত জেনে যাওয়ায় যে ঝামেলা হচ্ছিল জহরত তখনই টের পেয়েছে। ক্লাবের প্যাকটিসের সময় কোচের সঙ্গে, অন্য খোলয়াড়দের সঙ্গে কোনো কোনো বিষয়ে তর্ক লেগে যেত। ফিল্ডিং সাজানো নিয়ে, কার পরে কাকে খেলতে নামাবে সেসব নিয়ে। আসলে ক্রিকেট তো একটা খেলা, খেলা মানেই ক্রিয়েটিভ ব্যাপার, খেলোয়াড় মানেই ক্রিয়েটিভ একটা লোক, সেই লোকের এত তত্ত্ব জানার দরকার নেই। একদিন সতীর্থ খেলোয়াড় তার কাঁধে হাত রেখে সবার থেকে একটু আড়ালে নিয়ে গিয়ে বলেছিল, ‘জহরত, তোমার ভালোর জন্য বলি, তোমার ওই পড়ালেখাটা একটু কমাও। ইফতিকে দেখ না, কী অসাধারণ স্কিল, সেটা তো লেখাপড়া করে হয়নি, কিন্তু খেলার বুদ্ধি, কত ট্রিকি দেখ, বল করার কূটকৌশল ওর চেয়ে কজন ভালো জানে। তুমি কেন খামোখা অলরাউন্ডার হতে চাইছি। ব্যাটিংয়ে ভালো করছো, সেটা নিয়ে থাকো না বাবা।’ জহরত বলে, ‘আমার থিওরি: অল অর নান, হলে সব হবে নইলে কিছুই হবে না।’ সতীর্থ খেলোয়াড় বলে, ‘তাহলে বাবা তোমার সর্বনাশই হবে। বাংলাদেশের মতো দেশে এটা হয় না সবার। তোমার হবে না। জোর করো না। জোর করে ক্রিকেট হয় না। অ্যা ক্রিকেটার মাস্ট বি বনর্ড, তাকে তৈরি করা যায় না। তুমি আসলে থিওরির লোক। তুমি থিওরি নিয়ে থাকো।’ জহরত বলেছিল, ‘তাহলে আমি কদিন সময় নিই। ভালো করে ভেবে দেখি আমার আসলে কী করার দরকার।’ সতীর্থ খেলোয়াড় বলে, ‘নিতে পারো। কিন্তু ভাবনাটা ভালো করে ভেবে দেখো।’
জহরত সময় বেশি নেয়নি। এত সময় নেওয়ার তো কিছু নেই। একদিন ফোন করে জানিয়ে দিয়েছিল, সে আর ক্লাবে খেলোয়াড় হিসেবে থাকবে না। তাকে ‘জাগো স্পোর্টিং ক্লাবে’র পরামর্শক হিসেবে কাজ করতে অনুরোধ করতে হয়েছিল। সে রাজি হয়নি। এটা এক ধরনের ঠিক অপমানও না ঠিক কীÑ এটা ঠিক কী এর কোনো নামও দিতে পারেনি। তারপরও গায়ে লেগেছিল। সে ক্রিকেটার নাÑ এটা মানতেই পারছে না। জীবনে চাকরিবাকরির কথা কখনো ভাবেনি। তাদের চৌদ্দগুষ্ঠির কেউ ব্যবসাও করেনি। কিন্তু ক্রিকেটও তো খেলেনি। তাহলে কি ব্যবসাও তার কপালে নাইÑ এমনটা মনে করছিল সে। বাবা ডাক্তার। সরকারি হাসপাতালে ত্রিশ বছর হয়ে গেছে। এলাকাও একটি ক্লিনিকে বসেন। সবমিলিয়ে অবস্থা খারাপ না। একটি মেয়ে আর দুটো ছেলে নিয়ে একসময় খুব স্বস্তি পেতেন। জহরতের ক্রিকেট নিয়ে পাগলামিতে ভেতরে ভেতরে মুশড়ে পড়েছিলেন। ইচ্ছা ছিল ছেলেও ডাক্তারি পড়–ক। বাড়ির বড় ছেলে। ডাক্তারিতে দুদুবার করে পরীক্ষা দিয়ে লিখিততেই পাশ করতে পারেনি। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েও ভর্তি পরীক্ষা দেয়নি। কোনোমতে ঢাকা কলেজে ইংরেজিতে ভর্তি হয়েছিল বলে রক্ষা, নইলে হয়তো লেখাপড়াই আর হতো না।
জীবনের অনেকটা সময় এই খেলা নিয়েই কেটে গেছে। খেলা ছেড়ে দিয়ে কী করবে? একবার ভেবেছিল বাংলায় ক্রিকেট শেখার বই লিখবে কিনা। পরে মনে হয়েছে পাগলামি হবে। আবার ভেবেছিল পেশাদার কোচ হওয়ার জন্যই চেষ্টা করবে কিনা। অনেক দিনই তো ফার্স্ট ডিভিশানে খেলেছে। বাবা বলেছে,‘ ছেড়েছো যখন একেবারেই ছেড়ে দাও। কোনো কিছু ছেড়ে দিয়ে তার সুতা গায়ে লাগিয়ে রাখাটাও কিন্তু সর্বনাশ।’ তিনি জহরতকে সেই গল্পটা মনে করিয়ে দিয়েছিলেন: একটি পাখি খাঁচায় বন্দি ছিল। তার একটা পা খাঁচায় যে কাঠিটায় ওপর সে বসত, তার সঙ্গে সুতা দিয়ে বাঁধা থাকতো। কদিন চেষ্টা করে সে ওই বাঁধানো সুতার গোড়াটাকে ঠোঁট দিয়ে ঠুকরে পাতলা করে আনলো। আর তক্কে তক্কে থাকলো, কোন ফাঁকে সে উড়াল দিতে পারে। একদিন সেই সুযোগ এলো। খাবার দিতে এসে দরজারটা লাগাতে ভুলে যাওয়া কাজের মেয়েটা যেই সরেছে ওমনি ফুড়–ৎ। তারপরতো অনেকক্ষণ উড়ে উড়ে সে একটা বনে পৌঁছালো, একটি গাছে ডালে বসল। কিন্তু সে খেয়াল করলো না কোন এক সময় সেই সুতো গাছের ডালে পেঁচিয়ে গেছে। বেচারি পাখি সেই গাছ থেকে আর নড়তে পারলো না। সেখানে না খেতে পেয়ে শুকিয়ে মারা গেল। সুতায় বাঁধানো কঙ্কাল হয়ে ঝুলে রইল গাছে। বাপ তাকে এই গল্পটা মনে করালে সে বলে, ‘যে পাখিটা খাঁচায় থাকার সময় ঠোঁটে ঠুকরিয়ে সুতোটা আলগা করেছিল, গাছে সুতোটা আটকে যাওয়ার সময় সেটা পারলো না?’ বাপের উত্তর ছিল, ‘সে না খেতে পেয়ে এত দুর্বল ছিল যে সেটাও করতে পারেনি। তুই গল্পটার মোরালটা না বুঝে তর্ক করছিস। তোর বস্তু মিলবে না, যেতে হবে বহুদূর যেতে হবে।’ জহরত বলেছিল, ‘আমি এত তাড়াতাড়ি বস্তু পেতে চাই না। বহুদূরই যেতে চাই।’
কেউ কেউ বলেছিল, কোনো একটা পলেটিক্যাল পার্টিতে জয়েন করতে। ক্রীড়া বিষয়ক কাজই করতো। পরে বলা তো যায় না সত্যিই একদিন পথ খুলে যেত। পলেটিক্স তো আসলে লম্বা পথ। বলা তো যায় না কুড়ি বছর কিছু না পেয়ে একবারে যখন সে মন্ত্রী হবে, তখনই অনেক কিছু পেয়ে যেতে পারে। জহরত দেখল সেটাও তার হবে না। কারণ তার জন্য যে ধৈর্য সহ্যের ¯œায়ু দরকার সেটা তার নেই। যে ¯œায়ু দিয়ে সে ক্রিকেট খেলতো সেই ¯œায়ু দিয়ে আসলে রাজনীতি হবে না। তারপরও লোকে বলে, যার হয় তার হয়, যার হয় না, তার কোনো কিছুতেই হয় না। জহরত সেটাও যে মানতো না তা না, মানতো। কিন্তু তার আসলে মনটাই আর কোনো কিছুতে লাগছিল না। জগতটা কেমন শূন্য হয়ে যাচ্ছিল। কোনো কিছু করার নেই। কারো কাছে যাওয়ার নেই। কোথাও যাওয়ার নেই। তার যে খাওয়া পরার সমস্যা হচ্ছে তা তো নয়। অনেকেরই খাওয়ার পরার সমস্যা সবচেয়ে বড় সমস্যা। তার সমস্যা আলাদা। খাওয়া-পরা-থাকার সমস্যা মিটে গেলে জগতের যে যে সমস্যাগুলি দেখা দেয়, সেগুলি অনেক বেশি জটিল এবং প্রায় অসমাধেয়। আবার এও ঠিক সমস্যা দেখে মিইয়ে গেলে তো চলে না। তাহলে আর মানুষ হিসেবে বেঁচে থেকে লাভ কী। জীবন যতক্ষণ সমস্যা ততক্ষণ।
জহরত বুঝতে পারে, আসলে যে দিকে যাচ্ছিল, অনেকটা এগিয়েছিল, সেদিকে থেকে ফিরে আর কোনো রাস্তা সে ঠিক করতে পারছিল না। ইংরেজিতে এম.এ করেছে। ক্রিকেটটা বোঝেÑ এই দুই দিয়েই নাকি বিশ্বজয় করা যায়। সাংবাদিকতা করতে পারে চাইলে। চাইলে টোফেল, আইএলটিস দিয়ে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে। দেয়ার আর সো মেনি চয়েজেস, কিন্তু এর মধ্যে থেকে একটাও বেছে নেওয়া যাচ্ছে না। ওই সে অ্যানসিয়েন্ট মেরিনারের মতো: ওয়াটার ওয়াটার এভরিহোয়ার বাট নট অ্যা ড্রপ টু ড্রিঙ্ক।
জীবনে এমন অবস্থায় কত লোককেই না পড়তে হয়। তবে যখন কোনো পথ পাওয়া যায় না, তখন নাকি একমাত্র কোনো নারী সেই পথহারাকে পথ দেখাতে পারে; তাকে এসে বলতে পারে,‘পথিক তুমি পথ হারাইয়াছো?... আইস।’’ তখনই এই পৃথবী নাকি দুম করে সুন্দর হয়ে উঠবে, নারীকে মনে হবে সুন্দর, তার উচ্চারণ করা প্রতিটি শব্দ সুন্দর। ‘জীবনের অসহায় পরিস্থিতিতে নারীর পুতুল হয়ে যাও। তাহলে দেখবে সব সমস্যা মিটে গেছে।’ জহরতের হাসিও পায়। কোন লোক কী ভেবেছে, যে জীবনের শুরু থেকেই মনে করতো, একটি লোকের যখন কোনো সমস্যা আর নেই, তখন তাকে একমাত্র কোনো নারীই পারে বিপথে নিয়ে যেতে। এজন্য চীনা প্রবাদও আছে: যদি সম্ভবনাময় কোনো পুরুষকে শেষ করে দিতে চাও তো তাকে বিয়ে করিয়ে দেও। জহরত বলতো, ‘তাহলে জ্ঞান অর্জন করতে চীন দেশে গিয়ে মানুষের কী করে সর্বনাশ করা হয় তাই শেখানো হয়?’ ‘আরে না না, তাহলে শোনো, চীনা প্রবাদে বলে: যদি একদিনের জন্য সুখী হতে চাও তো মাছ ধরতে যাও; যদি একমাসের জন্য সুখী হতে চাও তো বিয়ে করো; আর যদি সারা জীবনের জন্য সুখী হতে চাও তো অসহায় কোনো ব্যক্তিকে সাহায্য করো। তারপর কত আছে: কাউকে ধরা মাছ খেতে দিলে তার পেট হয়তো একদিনের জন্য ভরবে, কিন্তু‘ তাকে মাছ ধরতে শিখিয়ে দিলে সারা জীবনের জন্য তার পেট ভরার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। ক্লাবে এসব মজার মজার কথা হতো আড্ডার সময়। ক্লাবের ইয়াসিন ভাইকে তারা বলতো কোটেশান বিশেষজ্ঞ, কেউ বলতো কনফুসিয়াস। যে কোটোশানই দেন তিনি সব চীনা, এজন্যই কনফুসিয়াস। ‘নবী কইছিলেন জ্ঞান অর্জন করার জন্য চীনে যাও। আমরা কই চীনে নয়, ইয়াচিনে যাও, মানে, ইয়াসিন ভাইয়ের কাছে যাও।’ জহরতের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। বুক থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস নামে। হায়রে স্মৃতি!
২. সারাবান তহুরা
সারাহ্র এতক্ষণ মাথা নিচু করেছিল। প্রিন্সিপালের কথা শুনে মুখ তুললো। ‘নাম: আবু জহরত ইমরান। পিতার নাম: ডাক্তার আবু মুহম্মদ ইমরান।’ এরপর বাকি তথ্যগুলিও একে একে পড়ে গেলেন। মহিলা এই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। এমন ফর্সা, আর ততটাই কালো তার চুল আর ভ্রু। মনে হচ্ছিল যেন আলাদা করে কালি করানো। হয়তো সবই পেকে গেছে। গাঢ় কালো কলপে এমন কালো দেখাচ্ছে। কদিন পরে সারাবান তহুরার কাছে ঠিকই জানা গেল, জহরতের অনুমান ভুল ছিল না।
সারাবান তহুরা তাকে ফোন করায় সে ভীষণ অবাক হয়েছিল। প্রিন্সিপাল ম্যাডাম তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আপনি এখানে ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে জয়েন করতে চান, কিন্তু আপনি তো তেমন কোনো কাগজপত্র দেননি। তারওপর ফার্স্ট ডিভিশানে ওঠা একটা ক্রিকেট ক্লাবের সদস্য ছিলেন, নিজেও খেলেছেন, ছবিও দিয়েছেন সাবিক আল হাসান, তামিম ইকবাল, মশরাফি-মুশফিকের সঙ্গে। কিন্তু এসব তো আসলে আপনার প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণ নয়। আপনি যদি ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টর হিসেবে কোনো একটা ট্রেনিং করতেন বা কোনো কোর্স, তাহলে তো আপনার কথা আমাদের ভাবা অনেক সুবিধা হতো।’ মোট চারটা কপি সিভি দেওয়া হয়েছিল। প্রিন্সিপাল তার সিভিটা পড়ার সময় বাকিরাও সেটা দেখছেন। এর ভেতরে সারাহ্ বার বারই কিছু বলতে চাইছিলেন, কিন্তু প্রিন্সিপাল তাকে হাত দিয়ে ইশারা করছিলেন থামার জন্য।
প্রিন্সিপাল জানেন তরুণ ছেলেদের প্রতি সারাহ্র দুর্বলতা আছে। তাকে নিয়ে কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে কিছু রটনাও আছে। যদিও কেউ এ নিয়ে কোনো অভিযোগ করেনি। কিন্তু তার সহকর্মীরাই তাকে নিয়ে রসিয়ে রসিয়ে অনেক কথা বলে। সারাহ্র বিয়ে হয়েছিল এক ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। লোকটা ফিলিপাইনে কী একটা ট্রেনিংয়ে গিয়ে আর ফেরেনি। এক ফিলিপিনো মেয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সেখানেই থাকছে। সেসবই বলছিল সারাহ্। বলেছিল, ‘আমাকে সারাহ্ বললেই হবে। তহুরা নামটা কেমন ব্যাকডেইটেড মনে হয়। সারাহ্ই আমার ডাক নাম। সবাই সারা-ই বলে। সারা মানে নাকি খাঁটি। তহুরা মানে বিশুদ্ধ। তবে নামটা কিন্তু শারাবান, তালব্য শ, মানে শারাব থেকে, কিন্তু আমার এই শারাব কথটা ভালো লাগেনি। তাই শারাব-কে সারাবান করে নিয়েছি। এই আর কী। আসলে, আব্বু খুব সুফি সাহিত্য পড়তেন। জালাউদ্দিন রুমি, হাফিজ, ওমর খৈয়াম। খুব প্রিয় ছিল ফেরদৌসীর শাহনামা। মনিরউদ্দীন ইউসুফের সঙ্গে বন্ধুত্বও ছিল। ইউসুফ চাচা প্রায়ই শাহনামা অনুবাদ করা নিয়ে তার যন্ত্রণার কথা বলতেন। তিনি বার বার তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। তার কথা ছিল এর জন্য তিনি তার নিজের লেখা লিখতে পারছেন না। কিন্তু আব্বু বলতেন, আপনি দেখবেন, এটাই আপনাকে অমর করে রাখবে বাঙালিদের কাছে। বাংলাভাষায় এই কাজটা যুগ যুগ ধরে পড়া হবে। এটা একটা রাজকীয় কাজ, আপনি কি সেটা বুঝতে পারছেন না। এর প্রাপ্তিও রাজসিক। আব্বুর দুদিকে টান ছিলÑ একদিকে লালনের বাউলপন্থা, অন্য দিকে ফারসি সুফিবাদ। আবার খুব বুদ্ধেরও ভক্ত ছিলেন। আমি যদি বলতাম, তুমি এমন সবমিলে একটা খিচুড়ি কেন? আব্বু বলতেন, বাঙালি মানেই তো একটা খিচুড়ি। এজন্য এত মজার জাতি জগতে খুব কম আছে। লাতিনরাও আরেক খিচুড়ি। কিন্তু তাদের ভেতরে চলাটা ডালটা আলাদা করে এখনো ধরা যায়। কিন্তু বাঙালি এমনই খিচুড়ি যে একেবারেই ধরা যায় না। বাঙালি হল মিশানো জাত। জানের দিক, মনের দিক থেকে, প্রাণের দিকেও মিশানো। পাঠান, মোঙ্গল,শক, হুন এক দেহে হল লীন, আছে না কবিতায়। যেমন আমাকে তো দেখে অনেকে বলে, আমি কি শ্রীলঙ্কান নাকি। শুনেছিলাম আমাদের বংশ এসেছে ভারতের মাদ্রাজ থেকে। কী ব্যাপার আপনি কিছু নিচ্ছেন না যে।’
‘না নিচ্ছি তো।’ টিটেবিলে দুটো পিরিচে একটায় মিষ্টি দুটো রসগোল্লা আর একটা সন্দেশ। অন্যটায়
চানাচুর। চায়ের কাপটা ঢাকা দেওয়া আছে পিরিচ দিয়ে। জহরতের সারাহ্র কথ শুনতে ভালো লাগছিল না। মহিলা কেন যেচে তাকে ডাকলেন, সেটাও তো বুঝতে পারছে না। একবার ভাবে নিজেই বলে, আচ্ছা আমাকে কেন ডেকেছিলেন, সেটা কিন্তু বললেন না। কথাটা আবার জেগে ওঠে, বিস্কুটে কামড় দিয়ে। বি¯ু‹টে কামড় দিয়ে যে-ই বলতে যাবে ঠিক সেই সময় সারাহ্ নিজেই বলে, ‘আসলে আমি একটা কথা বলি। আপনি কি কোনো যোগাযোগ করেছিলেন কারো সঙ্গে। যদিও সার্কুলেশানে স্পষ্ট করে উল্লেখ করা ছিল কোনো রকম যোগাযোগ বা তদবিরের কোনো চেষ্টা করলে প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল বলে গণ্য হবে। কিন্তু আসলে তো এটা আগে আগেই জানাজানি হয়। আমি যেটুকু বুঝতে পেরেছি চাকরিটা আপনার হবে না।’ বলে থামল সারাহ্। জহরতের কেন যেন মনে হল সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
‘আপনি কি হতাশ হচ্ছেন?’ সারাহ্ জিজ্ঞাসা করে।
জহরত বলে, ‘না, না, আমার ওসব হতাশাটতাশা আসে না। আপনি আসলে আমাকে কি এটা জানানোর জন্যই ডেকেছেন?’
সারাহ্ বলেন, ‘সরি আমি কিন্তু জানি না, আপনার সময় নষ্ট করে এখানে নিয়ে এলাম কিনা। আসলে আমি দেখলাম আপনার ঠিকানায় দেখলাম আমার বাসার একটা রোড পরেই আপনি থাকেন। আপনার মোবাইল নম্বারটাও চট করে মোবাইলে টুকে নিলাম। আসলে ভাবলাম, আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করি। তাই...’
‘আমরা সঙ্গে আলাপ করে কী লাভ?’ জহরত একটু ম্লান হাসল।
‘সরি, আপনি মনে হয় বিরক্ত হচ্ছেন।’ সারাহ্র কণ্ঠও হতাশ শোনায়। সে বুঝতে পারে না আসলে কী বলবে। মূল ব্যাপারটা হল, তাকে সারাহ্র পছন্দ হয়েছে। আর ঠিক যেমন পুরুষকে দীর্ঘদিন ধরে চাইছিল তার প্রতিটি গুণ আছে জহরতের। আগের ফিজিক্যাল ইন্সট্রাক্টারের সঙ্গেও সারাহ্র একটা সম্পর্ক ছিল বলে কলেজে রটনা আছে। গণিতের(এখানে তো এটা কেউ বলে না বলে অঙ্কের টিচার) খুব ভালো টিচার বলে সারাহ্কে কলেজে কেউ কোনো ঝামেলা করে না। তাছাড়া গভার্নিংবডির মেম্বার আর এলাকার এম.পির সঙ্গে সারাহ্র যোগাযোগ সব সময় ভালো। গুলশানে থাকা বাংলাদেশের সবচেয়ে দাপুটে শিল্পপতির মেয়েকে অঙ্ক শেখানো ছাড়া বাড়তি কোনো ইনকাম সে করে না। নিজে আলাদা বাসা ভাড়া করে একলা থাকে। একেবারেই একলা। ভাইরা তাদের বিশাল সাত তলা বাড়ির ছতলার দুটো ফ্ল্যাট তাকে দিয়েছে। সেখান থেকে মোটা অঙ্কের টাকা আসে। নিজের মেয়েটার সব খরচ ভাইরাই বহন করে। মেয়েটা পড়ে দার্জিলিংয়ের স্কুলে। এটা তার স্বামীর ইচ্ছা ছিল। মেয়েকে একেবারে ওয়েস্টার্ন না হলেও সেরকম কেতাকানুনে বড় করবে। সারাহ্ যদিও নিম রাজি ছিল। মেয়েটার মনে হয় ভালোই লাগে দার্জিলিংয়ে থাকতে। দেখতে দেখতে বড়ও হয়ে গেছে। আশ্চর্য মা-বাবার প্রতি তার মনে হয় তেমন টান নেই। বন্ধুর আর সেখানকার টিচারদের সে একেবারে আপন করে নিয়েছে।
জহরত বলে,‘আসলে আমি ঠিক বুঝতেও পারছি না, চাকরি করাটা আমার জন্য ঠিক হবে কিনা। আমি একোবরে হুট করে সিভিটা পাঠিয়েছিলাম। পত্রিকায় দেখে মনে হল পাঠিয়ে দেখি না। আমি তো জানি জীবন কঠিন। আরো কঠিন হল জীবনের কঠিন সময়ে কাউকে পাশে পাওয়াটা।’
সারাহ্ ঠিক এখানটায় কথা বলে ওঠে, ‘আমি ঠিক এটাই বলতে চাইছিলাম। আমি এমনিতে খুব একা থাকি। কথা বলার মতো মানুষ পাই না। আর মানুষকে তো বিশ্বাস করাটাও সহজ নয়। আপনার কথা শুনে ও দেখে মনে হল, আপনার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়।’
‘বিশ্বাস রেখে কী করবেন?’ জহরত একটু হাসে আর কথাটা বলতে বলতে চায়ের কাপের ওপর থেকে পিরিচটা নামিয়ে পাশে রাখে, তারপর পিরিচটায় কাপ বসায়। এসময় সারাহ্ তাকে আবার ভালো করে খেয়াল করে। দাড়ি কাটেনি। চুলও ঠিকমতো আঁচড়ানো না। টি-শার্টটা কোনো মতে গায়ে দিয়ে এসেছে। ওপরে লেখা ‘ডু ইট নাও।’ ছাইরঙের ওপরে সাদা রঙে লেখা।
জহরতের এরকম কথা লেখা টিশার্ট কয়েকটা আসে। ‘নাউ ইজ দ্য বেস্ট টাইম।’ ‘ইয়ু আর বর্ন টুডে।’ এমন আরো কী সব কথা লেখা। অচেনা নম্বার থেকে ফোন এলে সাধারণত আগে ধরত না। মাঠ থেকে বাড়ি ফিরেই ফোন বন্ধ করে দিত। খেলাধুলা ছেড়ে দেওয়ার দুটো কাজ করে এক সারাদিন ফোন খোলা থাকে, এমনকি ঘুমের সময়ও বন্ধ রাখে না; আর একটা হল যেসময় খোলা রাখে যেকোনো ফোন এলেই ধরে। এমনকি কোনো অচেনা নম্বার থেকে মিসড কল এলেও নিজেই রিং-ব্যাক করে। জহরত কোনো দিন খতিয়ে দেখেনি কেন তার এই পরিবর্তনটা হলো। আগে সে থাকতো একটা গ-িতে। কাজ কর্ম সবই ছিল সুনির্দিষ্ট। তার বাইরের কোনো কিছু নেওয়ার কোনো দরকার ছিল না। যতই যে তার ওই নির্দিষ্ট গ-ি থেকে সরে গেছে, একটু একটু করে তার চারদিক শূন্য হতে শুরু করেছে। জহরত জানে না, এই যে কোনো কিছুর মধ্যে না থাকা, সেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ভাবেÑ দেখিই না, কোথায় কোন দিকে কত দূর তাকে নিয়ে যায় তার সময় এবং তার আশেপাশে চেনা বা অচেনা মানুষের। লেট ইট বি। যেমন এই যে সারাবান তহুরার ফোনটা, ফোনে তার কণ্ঠ এত আকর্ষণীয় মনে হয়, আর এত মায়াময় আর আন্তরিক, ‘আপনি কি আবু জহরত ইমরান বলছেন?’
‘জ্বি, বলছি।’
‘আমি সারাবান তহুরা।’
‘আপনি...?’
‘ভাইবা বোর্ডে আমি ছিলাম। প্রিন্সিপালের পাশে।’
জহরতে সঙ্গে সঙ্গে ওই দিনের বোর্ডের ছবিটা দেখে নেয়। হ্যাঁ, মহিলা লাল পাড় সাদা রঙের সূতির শাড়ি পরা। কালো মতোন, বয়কাট চুল। বিপুল স্বাস্থ্যবতী কিন্তু মোটেও মোটাসোটা বলা যাবে না। ক্লাবের তারাজু মোল্লা, বাগেরহাটে বাড়ি, এমন মেয়েদের বলত ‘সাঁইটেল’, ঠিক তাই। নামে মোল্লা, দুষ্টুমিতে এক নম্বার, অশ্লীলতা ছাড়া কথাই বলতে পারে না, যে মডেল গার্লের সঙ্গে সাঞ্জুকে নিয়ে স্ক্যান্ডেল হয়েছে তার নাম দিয়েছিল ‘‘উবর’’ মানে উন্নতবক্ষা রমণী। সারাহ্ যে বেশ স্বাস্থ্যবতী আর দোহারা গড়নটা বসে থাকা অবস্থায় বোঝা যাচ্ছিল। আজকে দরজা খুলে সামনে দাঁড়ানো সারাহ্কে দেখ গেল, দেখেই সাঞ্জুর ‘উবর’ শব্দটা মনে পড়লো। বাড়ির শাড়িটা একটু পাতলা। একেবারে সাদা, ভেতরের ব্লাউজও সাদা। হাতে বালা পরা, তাও সাদা। সবকিছুর ভেতরে একটা সাদা সাদা ব্যাপার আছে। পায়ের স্যান্ডেলের রঙও সাদা। এজন্য সারাহ্ আরেকটা নাম আছে কলেজে ‘সফেদ আপা’। ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে খুবই আন্তরিক কিন্তু এমন একটা ব্যক্তিত্ব নিয়ে কথা বলবে যে সবাই তাকে সমীহ করে চলে। সবাই জানে, সারাহ্ আসলে ক্ষমতাবান সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলে। নিজের ঢোল কখনো পেটায় না। কখানো বলে না যে, আমি কাউকে পুছি না। আমি হ্যানত্যানÑ এসব নেই। তার সাদা পোষাক পরার পেছনে তেমন কোনো কারণ নেই, কেবল মনে হয়েছিল সাদা রঙের একটা অন্যরকম প্রভাব মানুষের মধ্যে পড়ে। জহরতের যেকয়টা জানা জিনিস আছে, তার ভেতরে একটা হলো মাফিয়া ডনরা নাকি সাদা কাপড় পরে। জুতা থেকে চশমার ফ্রেম পর্যন্ত বলে সাদা থাকে।
হঠাৎ করে কথাটা মনে আসতেই সে সারাহ্কে প্রশ্ন করে, ‘আচ্ছা আপনি সব সাদা পরেন কেন?’ সারাহ্ খুশি হয়, কারণ এতক্ষণে জহরত একটা কথা বলছে, কেবল তা-ই নয়, কথাটা তার প্রতি যে একটা আগ্রহ তৈরি হয়েছে, বা তাকে সে একটু হলেও খেয়াল করছে, সেজন্য।
‘সাদা আমরা প্রিয় রঙ। তাছাড়া আমি সাদাসিধা মানুষ। এটা হল দুই। আর আমি খুব পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করি।’ বলে একটু তিনি একটু হাসেন। তারপরও নিজেই জানতে চান,‘আচ্ছা আমার বয়কাট চুল কি আপনার পছন্দ হয়?’
জহরত একটু মজা করতে ইচ্ছা করে এখন। ‘আমি যদি বলি হয় না, তাহলে আপনি কি লম্বা চুল রাখতে শুরু করবেন?’
‘করতেও তো পারি।’
‘আমরা আসলে মেয়েদের নিয়ে খুব একটা চিন্তা কাজ করে না। সারা জীবন খেলা নিয়ে ছিলাম। মেয়েদের নিয়ে ভাববার সময় আমার ছিল না। এখনো নেই। তাই মেয়েদের কী কী আমার পছন্দ আর অপছন্দ আমি এসব নিয়ে খুব একটা ভাবি না।’
‘এখন তো খেলা থেকে সরে এসেছেন। এখন কী নিয়ে ভাবনা?’
‘এখন ভাবনা একটাইÑ আমি আসলে কী করবো।’
সারাহ্ বলেন,‘তাহলে এক কাজ করুন।’ এমনভাবে বলে যেন সে সত্যিই জহরতের জন্য দারুণ কিছু একটা ভেবেও রেখেছে।
‘কী কাজ?’
‘বিয়ে করে ফেলুন। বড় লোক, বা যে বউ আপনাকে চালাতে পারবে।’
‘কেন বড়লোক দেখে বিয়ে করতে হবে?’
‘ওই যে কথায় বলে না, আপনি যদি গরীব হয়ে জন্মান সেজন্য আপনি দায়ী নন, কিন্তু আপনি যদি গরীব হয়ে মারা যান, তাহলে আপনিই একমাত্র দায়ী।’
জহরত কিছু বলতে যাচ্ছিল, সারাহ্ বলে, ‘শেষ হয়নিতো। কথাটা বিল গেটসের। এর প্যারোডি করে বানানো হয়েছে: আপনার বাপ যদি গরীব হয়, সেজন্য আপনি দায়ী নন, কিন্তু আপনার শ্বশুর যদি গরীব হয় সেজন্য আপনি দায়ী।’ বলে সারাহ্ একটু ফিক করে হাসে।
জহরতের হঠাৎ হাসি পায়। সারাহ্র কথার জন্য নয়। হঠাৎ প্রাণ খুলে হো হো করে হাসতে থাকে সে। হাসতে হাসতে চোখে পানি চলে আসে। সারাহ্ প্রথমে ওর সঙ্গে তাল দেয়, কিন্তু পরে দেখে তার হাসি থামছেই না। সারাহ্ ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। চেয়ে চেয়ে ওর হাসি দেখতে থাকে। দেখতে দেখতে তার নিজের আবারও হাসি পায়। সেও আবার জহরতের সঙ্গে হাসতে থাকে। আরো কিছুক্ষণ চলে তাদের দুজনের একসঙ্গে এই হাসাহাসি। একসময় হাসতে হাসতে জহরত উঠে দাঁড়ায়। হাসতে হাসতে দরজার দিকে এগোয়। সারাহ্ কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারে না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জহরত তাকে টা টা দিতে দিতে কোনো মতে বলে, ‘অনেক মজা লাগলে। দেখা হবে। আসি।’
সারাহ্ ইচ্ছা হচ্ছিল সিঁড়ি ঘরের রেলিংয়ে এসে দাঁড়াতে। কিন্তু এটা আত্মীয়স্বজন এলে সে করে। জহরতের বেলায় করলে ঠিক মানাবে না। দরজা বন্ধ করে সে দরজার গায়েই হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেটাকে তার এক ভালো লাগছে কেন? অনেক দিন এমন করে হঠাৎ অকারণ তার কাউকে এমন ভালো তো লাগেনি। কী কারণ? ছেলেটার ভেতরে অদ্ভুত একটা সরলতা আছেÑ সেজন্য? নাকি ছেলেটাকে অনেক সৎ আর এমন লোক বলে মনে হচ্ছে যার ওপর আস্থা রাখা যায়? সারাহ্র চোখ হঠাৎ ভিজে ওঠে। অনেক দূর থেকে একটা বেদনার হাওয়া তার বুকের ভেতরে ঝড় হয়ে শুরু হয়। সে মুখ ঢেকে কাঁদতে থাকে।
৩. জহরত
যা হয়েছে সবার, আমারও তা-ই। আমিও আমার মা এবং বাবা সম্পর্কে সবচেয়ে কম জানি। আশ্চর্য! যেখানে থেকে জন্মালাম, সেই উৎস সম্পর্কে সবচেয়ে কম জানাই কেবল নয়, সেটা যে জানার মতো কিছু তাই তো আমি জানি না। আমার বাবা ডাক্তার মানুষ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ভর্তির কিছুদিন পর যুদ্ধ শুরু হয়। কোনো দিন কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে না থাকলেও আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে দু নম্বর সেক্টরে ট্রেনিং নেন। সেখানে তার একরকম বামপন্থী ভাবধারার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, কিন্তু তিনি দ্রুতই বুঝে যান যে, এটাতে গ্রহণ করা বা প্রয়োগ করার মতো যথেষ্ট শিক্ষিত আমরা হয়ে উঠিনি। পরে তার সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডের কিছু লোকের পরিচয় হয়। বেশ একটা রোমাঞ্চ জেগেছিল তখন। অল্প দিন পরেই রোমাঞ্চের দইয়ে জল কাটতে শুরু করে। মার্কসবাদ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান অল্প, এবং ‘অল্প বিদ্যা যে ভয়ংকরী’ সেটা টের পেতে বেশি দিন লাগে নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পর নতুন আরেক যুদ্ধ শুরু হয়। বাপকে বলা হয়েছিল তিনি যেন তাতে যোগ দেন বা অন্তরালে কাজ করেন। তিনি রাজি হননি। পরে তাকে খুনের হুমকিও দেওয়া হয়। কারা সেটা দিয়েছিল তিনি নিশ্চিত হতে পারেননি। রাজনীতি এমন এক দাবা খেলা যে বার বার গুটি উলটে যায়, সাদা সৈন্য কালোর প্রথম সারিতে উঠে ক্ষমতাবান হয়ে সে রাজাকেই আক্রমণ এবং হত্যা করতে পারে। আমার ছোটভাইটা একটু রাজনীতি রাজনীতি করছিল। কয়েকটা বই পড়ে তার মনে হয়েছে রাজনীতি ঠিক না হলে সবই উলটে পালটে যায়। সোভিয়েত ইউনিয়ন যার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। ‘কোনো দিক থেকেই তো কম ছিল না রাশানরা, তারপরও পারল না তো।’ আব্বার কথায়, ‘অনেক ঘাপলা আছে। যা কৃত্রিম তা শেষ পর্যন্ত ভেঙে যায়। রাশানদের মতো আধ্যাত্মিক জাতির কমিউনিস্ট হওয়া একেবারে মানায়নি।’ ছোটভাইটাকে বোঝালে বোঝে, আর সেটা বোঝে দ্রুত, আমার সমস্যা হল আমিও বুঝি কিন্তু দেরিতে। একারণে ক্রিকেটটা বেশি বুঝতে গিয়ে আমার যে নিজের সম্পর্কে বুঝ-জ্ঞানটাই ধাক্কা খেল, আর সেটা থেকে বেরিয়ে আসতে হল; তাতে তলে তলে অনেক কষ্ট পেলেও, আমি আসলে একটা কথা খুব ভালো করে বুঝেছিলাম যে, আমার সব কিছুর জন্য আমিই দায়ী। আর কোনো লোক আমার কোনো বিপত্তির জন্য দায়ী নয়Ñ এটাতে এক ধরনের শান্তি আছে, কিন্তু নিজের ওপরে সব নিয়ে আসা, তারপরও নিজেকে সবকিছুর জন্য দায়ী করার কষ্টটা অনেক বড়। আর আমি চাইছিলাম যখন সরে যাবো তো আর থাকবো ধারে কাছেও। কিন্তু পারিনি। একটু একটু করেই সরতে হয়েছে। এই যে দুম করে কিছু করতে না পারা সেটাই মনে হয় আমার সমস্ত সমস্যার উৎস। কিন্তু এটা কার কাছ থেকে আমার মা-বাবার কারো মধ্যে এই প্রবণতা কি নেই? না থাকলে আমার গুষ্টির কারো মধ্যে? নিয়তি বলে যে কথাটা সেটা নাকি ও বংশগতি বা জিনের ভেতরেই থাকে। সবার জিনের ভেতরে বা বংশগতির ভেতরেই থাকে একটা লোক কতটুকু সামর্থ্যবান হবে বা হবে না। তার কী কী অসুখ হতে পারে বা পারে না। আমি অবশ্য এসব বেশি দিন হলো জানিনি। আর জেনে আমার তো কোনো লাভও নেই।
আমি ভাবলাম আমার বাবার সঙ্গে এই নিয়ে একটু কথাবার্তা বলতে। তিনি তার হাসপাতাল, ক্লিনিক আর চেম্বর নিয়ে এত ব্যস্ত। আমি বুঝি না একজন ডাক্তার হয়েও মানুষের কী চাই তিনি বোঝেন না। পত্রিকায় পড়েছিলাম এক ডাক্তার তার স্ত্রীকে হত্যা করে সেটাকে আত্মহত্যা করে চালিয়েছিল। পরে লাশ কবর থেকে তুলে এনে আবার ময়নাতদন্তে বের হয় সেটা আত্মহত্যা নয়, হত্যা করা হয়েছিল। একজন ডাক্তার যে জীবন বাঁচাবে সে কী করে জীবন নেয়? আর এটা তো জগতে এবার দুবার ঘটেনি, বহুবার ঘটেছে। মজা করে কেউ বলে, ভগবান রাগ করলে ডাক্তারের কাছে পাঠিয়ে দেয়, কিন্তু ডাক্তার রাগ করলে ভগবানের কাছে পাঠিয়ে দেয়। তাহলে তো ভগবান বরং ডাক্তারের চেয়ে দয়াময়। মূল ব্যাপার তো মানুষকে আর জীবনটাকে আর বেঁচে থাকাটাকে বোঝা। তার বদলে জীবনকে বোঝা করে তুললে তো মানুষ নিজই নিজের দম আটকে দিয়ে মারা যায়। আর সেই মারা তো শারীরিক মৃত্যু নয়। একজন ডাক্তার মানুষের শরীর যতটা বোঝেন, মন কি ততটা বুঝেন? মনের চেয়ে বড় হল জীবন। সেই জীবনের গভীরতায় কতটা কে যেতে পারে?
আমি আব্বাকে বলেছিলাম, ‘আপনি আমাকে আসলে কী করতে বলেন?’
‘আমি কী বলব। এখন তোমাকে আমার আর কিছু বলবার নেই। যখন বলেছিলাম, তখন কানে তোলোনি। দেখো, বিদেশে একটা ছেলে আঠারো বছর হওয়ার পর...’
‘বিদেশের কথা রাখেন। এটা বাংলাদেশ। সেখানে আঠারো বছর, এখানে আঠাশ না আটত্রিশ না কখনো আটচল্লিশ পার হয়ে যায় সেই বোধ বুদ্ধিতে যেতে। সেখানের সিস্টেম আলাদা। এখানে তো সিস্টেমই নাই।’
‘এত যদি বোঝ তাহলে নিজে নিজেরটা করে নিচ্ছ না কেন। আমি আমার নিজের জীবনটা করে নিয়েছি। তোমার জীবন তুমি কী করে করবে সেটা তোমার ব্যাপার। আমি যতটুকু তোমাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল নিয়ে গেছি। এখন তুমি এম.এ পাম করেছে। আমার কথা না শুনে ক্রিকেট ক্রিকেট করেছো। তা-ই নিয়ে দিনরাত পার করেছো। সে-ই ক্রিকেট তোমাকে কী দিল? ঘোড়ার ডিম। ঘাড় ধাক্কা।’
কথাটা শুনে পা থেকে মাথা পর্যন্ত আমি একটা ষাঁড় হয়ে উঠি আর বাবা আমার সমানে লাল কাপড় ওড়ানো ম্যাটাডোর, সময়টা দুম করে হয়ে ওঠে লড়াইয়ের মাঠ। নাকি উলটোটা একটা অন্ধ ষাঁড় প্রচ- বেগে আমার ভেতরে দৌড়ে আসতে থাকে। আমার হাতে লাল কাপড়। কিন্তু আমি... আমি নিজেকে সামাল দিই। কারণ এছাড়া আমি আর কী করতে পারি। আমি এখন দুর্বল। দুর্বল ও প্রায় অর্থহীন হয়ে সবল ও অর্থবানের সঙ্গে লড়াই করা আত্মহত্যা ছাড়া কিছু নয়।
আমি দেখেছি, কোনো দিন একবারের জন্য, এক মুহূর্তের জন্য আমি আত্মহত্যার কথা ভাবতাম না। ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার পর এই আত্মহত্যার কথাটা বার বার আমার মাথায় ঘুরে ফিরে বেজে যাচ্ছে। সেটা ঠিক আমি নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে চাই সেজন্য না। আমি কেবল মনে করেছিলাম যেখানে আমার জীবনের পথ ছিল, সেখানে থেকে সরে আসার মানেই নিজেকে শেষ করে দেওয়া।
বাবার সেদিনের কথা ভেতরে, আমি টের পাই আমার সম্পর্কে একেবারে শুরু থেকে তার যে ধারণা তাতে এতটুকু কোনো বদল আসেনি। এজন্য আমি যে দায়ী, তাও আমি জানতাম। আমি আসলে কী-ই বা করতে পারতাম। বাবার কথা শুনলে আজকাল মনে হয়Ñ সত্যিই যেদিকে চোখ যায় চলে যাই। এমন কোনো জায়গা চলে যাই, যেখানে আমাকে কেউ চিনতে পারবে না। আমাকে নিয়ে কারো কোনো মাথা ব্যথা হবে না, কাউকে নিয়ে আমারও কোনো মাথা ব্যথা হবে না। আসলে আমার সে চলে যাওয়ার সাহসও নেই, সেই বাস্তবতাও নেই। হঠাৎ আমার মাথায় বিদ্যুৎ চমকের মতো একটা কথা মনে হয়, কেন মনে হয় তার কারণও তো আছে। হঠাৎ সারাহ্র কথাটা, ‘বিয়ে করে ফেলুন। বড় লোক, বা যে বউ আপনাকে চালাতে পারবে।’ এই কথার ভেতরের কথাটা কী। বাঙালির তো এক বিয়ে করা ছাড়া জীবনে আর কোনো গল্প নেই, অ্যাডভেঞ্চারও নেই। এখানকার সমস্ত কিছুতে সমস্যা যেন একটাইÑ বিয়ে। কে কাকে বিয়ে করবে? কীভাবে বিয়ে করবে? কেন করবে? এই নিয়ে সব কিছু ব্যস্ত। আমার মনে হয় এর ভেতরে সত্যও আছে, কিন্তু সেটাই পুরো সত্যি তো নয়। তারপর সারাহ্র কথাটা আমার মনে ভেতরে চট করে জেগে ওঠে। তার কাছে কি যাবো? আমি তো তার বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মনে করেছিলাম, হ্যাঁ নিজে যদি আবারও যাক দেন তাহলে যাবো। কিন্তু সেই ডাক তো এল না। ঠিক কবে তার বাসায় গিয়েছিলাম? ভাইভাতে যাওয়ার দুদিন পর। তাহলে সেটা একসপ্তাহ আগে। তাহলে একসপ্তাহ যদি চলে যায়, তিনি তো মনে হয় আমার বিষয়টা আর মাথায় রাখেনি। আসলে বিয়ে করার ব্যাপার না। কদিন তিনি আমাকে আশ্রয় দিতে পারেন কিনা সেটা আমার জানা দরকার। এর ভেতরে আমি যদি চিন্তা ভাবনা করে কোনো কিছু একটা ঠিক করতে পারি তো হল, না হলে আমাকে নতুন কিছু একটা ভাবতে হবে। সেই নতুন কিছুটা কীÑ তাও তো আমি জানি না। কেউ বলে, জীবনে কোনো লক্ষ্যই থাকার দরকার নেই। পথই মানুষকে পথ দেখাবে। বরং জীবনে লক্ষ্য থাকার চেয়ে বিড়ম্বনা আর নেই। আমার তো সেই দশা, আমি তো আসলে কোনো লক্ষ্য শেষবধি ঠিক করতে পারিনি। পারিনি বলেই আমাকে এখন এই দশায় পড়তে হয়েছে। আমি জানি না আমার জন্য কী অপেক্ষা করছে। ‘একবার ভুল হয়ে গলে ঠিক করে নিতে অনেক সময় লাগে’Ñ এই সত্যটা আমার এখন বার বারই মনে হচ্ছে। আসলে শুরুতেইবা কী করতে পারতাম। শুরুতে তো কেউ শক্ত করে বাধা দেয়নি। একটা জিনিস আনন্দে থেকে নেশায় পরিণত হওয়া বা নেশা থেকে আনন্দ বা লক্ষ্যে পরিণত হওয়ার ব্যাপারে আমি তো বুঝতে পারি না কোনখানটাকে আমি ঠিক ভুলের শুরু বলে ধরবো?
‘কাজটাকে সুখ করে নেওয়া, সুখটাকে কাজ করে নেওয়া’রও তো তত্ত্ব আছে। খেলাটাকে জীবন বলে মনে হতো। এই করে যে টাকা আসবে, বা বিখ্যাতটিখ্যাত হবো সেটা আসলেই ভাবিনি। সারাক্ষণ নতুন নতুনভাবে কোথায় বলটাকে কী করে পাঠানো যায়, আর বোলিংয়ের সময় তো একটাই লক্ষ্য আউট করা। এখন মনে হয় মানুষের কাজÑ একটা লক্ষ্যেই বোলিং করা। নাকি জীবনটা ব্যাটসম্যানের মতো? তোমার দিকে আবিরাম আসতে থাকবে সমস্যার একটার পর একটা বল, আর তোমাকে সেটা পাঠিয়ে দিতে হবে এমন জায়গা যেখান থেকে সেটা ফিরে আসার আগেই তুমি জায়গা বদল করে নিতে পারবে। ক্রিকেটে সেটা হয় বাইশগজ জায়গায় আর জীবনে সেটা কেবল সামনে দিকে যতদূর যাওয়া যায় ততদূর।
বয়স আমার যদিও ত্রিশের মধ্যে আছে। আসলে বাবা চাইছিলেনÑ আমি এখন নিজের মতো রোজগার করি। আর আমার ইচ্ছা ছিল ক্রিকেট নিয়ে নতুন কিছু ভাবার। আমি ক্রিকেটার হতে পারিনি কিন্তু একজন ভালো ট্রেইনার তো হতেই পারি। সেই মতো আমি নিজেকে তৈরি করছিলাম। কিন্তু আমি বুঝলাম আমাকে আসলে সরে যেতে হবে। রাগের মাথায় কোচকে এমন গালি দিলাম। কথাটা মনে পড়লেই লজ্জায় আমার মরে যেতে ইচ্ছা করে। আমি সঙ্গে সঙ্গেই ক্ষমা চেয়েছিলাম। তিনিও ক্ষমা করেছিলেন, কিন্তু কর্তৃপক্ষ এটাকে খুব সিরিয়াসলি নেয়। মূল কারণ আমার সব ব্যাপারে প-িতি। পরে বুঝতে দেরি হয়নি সবাই চায় আমি সরে যাই। তখন কোচ আমাকে ঠান্ডা মাথায় সব কিছু ভাবতে বলে। আমি জানি তিনি নিজে আমার পক্ষে ছিলেন, সেটা তার উদারতা। আমি যদিও জানি না আমি সরে গেলে অন্যদের কী লাভ। কিন্তু আমার যে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে, এবং তা এতটা তা আমি বুঝিনি। আমি সরে আসা মাত্র আমার জায়গায় আরেকজন লোক কাজ করতে শুরু করে দিয়েছে। জগতের কারো জন্য কোনো জায়গা খালি পড়ে থাকে না সেটা আরেকবার টের পাই।
এই ব্যাপারটাতেই আমার মু-ু ঘুরে গেল। আমি ভেতরে ভেতরে দিশাহারা হয়ে পড়লাম। তাহলে এখন আমার কী কাজ। সত্যি বলতে কী বিষয়টা আমাকে আসলে ক্লান্তও করে তোলে। একটা জিনিস নিয়ে বেশি ভাবলে সমস্যাও হতে পারে। কিন্তু আমি কিছুতেই মাথা থেকে সেটা দূর করতে পারছিলাম না। এবার ভাবি ক্রিকেটের ওপর বইগুলো নামিয়ে নিয়ে আসি। না হয় নাই আর ক্রিকেট জীবনে এল। আমি ক্রিকেটের সঙ্গেই থাকি। পরে মনে হল, তাতে চিন্তাটা হয়তো আরো বেড়ে যেতে পারে। কোনোভাবেই চিন্তাটাকে চাগিয়ে দিলে বিপদে তো আমিই পড়বো।
আমার কখনোই কোনো খারাপ অভ্যাস ছিল না। সিগারেট খাইনা। মদ গাঁজা আরো যা যাÑ সেসবের তো প্রশ্নই ওঠে না। কখনোই মনে হয়নি এধরনের একটা নেশা থাকলে ভালো হতো। আসলে যখন টাকা পেয়েছি, বন্ধুদের খাইয়েছি, নয়তো দামি দামি সব বই কিনেছি ক্রিকেটের ওপর। একমাত্র মাকেই দেখতাম আমার এই বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে।
ও হ্যাঁ, মায়ের কথাটা বলা হয়নি। বাপের মতো আমরা আসলে যার যার মাকেও তেমন একটা চিনি। আর আমরা বাঙালিরা তো মাকে এমন একটা ভক্তির জায়গায় রেখে দিয়েছি যে তার আড়ালে মা যে আসলে একটা মানুষ, তারও যে নানান চাওয়া পাওয়া কামনাবাসনা থাকতে পারে, সেগুলি কখনোই আমাদের মাথায় আসে না। কেউ এটা সহজের ভাবতে পারে না মায়ের সঙ্গে বাবার বিয়ে এবং পরবর্তীকালে তাদের সেক্স করার ভেতর দিয়েই আমাদের জন্ম। অবশ্য এটা ভেবেও কি আর না ভেবেও কি। মা আমাকে একটা সাংঘাতিক কথা বলেছিলেন,‘‘জীবন ভক্তি দিয়ে চলে না, চলে ভয় দিয়ে।’’ আমিও দেখেছি এই ভয় আমার মাকে শেষ করে দিয়েছে। এখন শেষ করে দিচ্ছে আমাকে। আমার বাবার একবারে তরুণ বয়সে নাকি বেশ প্রেমিক প্রেমিক ভাব ছিল। বান্ধবীর ছিল বেশ। একটা গেলে আরেকটা আসতো। বাবা তো দেখতে বেশ সুর্দশন ছিল। তারওপর ডাক্তার। একবার তার ইচ্ছা হয়েছিল নায়ক হওয়ার। তখন কেবল ডাক্তারি পাশ করেছেন। ঢাকার একটা থিয়েটার গ্রুপের সঙ্গে কিছুদিন নাটক করাও চলল। এই সময় তার রোগী হয়ে আসেন এক চলচ্চিত্র অভিনেত্রী। সার্জান বলে কথা। গোপন জায়গায় অপারেশান। তরুণ তায় সুর্দশন ডাক্তার, দেখে তো অভিনেত্রীর পছন্দই করে ফেলেন। যে পরিচালক তাকে সিনেমায় এনেছিলেন ডাক্তারের চোখ দুটো বলে একেবারে অবিকল। ‘তাই তোমাকে দেখে বিকল হইয়া গেলাম।’ পরিচালক অনেক আগেই মারা গেছেন। ডাক্তারের যেখানে বাসা তার খুব কাছেই থাকেন ওই অভিনেত্রী। বললেন অবশ্যই তার বাসায় যেতে। কদিন গেলেন। রাজ্যের লোকজন সেখানে আসে। সবই প্রায় উচ্চশ্রেণির লোকজন। নামকরা লোকজন। যদিও ডাক্তারকে নিজের ওই ড্রইংরুমে বসিয়ে আলাপ করেছেন, কিন্তু ডাক্তারে বুঝতে বাকি থাকেনি যে তার এই বাড়িতে চলে জুয়ার আসর, মদ আর অন্যান্য নেশা, আর নারীপুরুষের অবাধ মেলামেশা। কেউ কেউ বাইরের মেয়েমানুষ নিয়ে ফুর্তি করতেও আসে। একবার নেশা করে তিন জনপ্রিয় অভিনেত্রী তো ডাক্তারকে প্রায় ধরে ভেতরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল। এরপর থেকে ডাক্তার আর ওই বাসায় যায়নি। তরুন বয়সে ডাক্তারের জীবনের নীতি ছিল: ‘আমি যখন সামনে পা দিবো, তখন পেছনের পায়ের ছাপ মুছে ফেলবো।’ কোনোদিন তিনি নিজের স্কুল কলেজের, এমনকি মেডিকেল কলেজে আর যাননি, কোনো অনুষ্ঠানেও না, বন্ধুরা কত বলেছে রিইউনিয়নে, হ্যানত্যান অ্যাসোসিয়েশানের প্রোগ্রামে আসতে। যাননি। সেই ডাক্তার বিয়ে করেছিলেন অতি সাধারণস্য সাধারণ আমার মাকে।
মা এমন এক মানুষ যে ঘরে আছেন কিনা তাই টের পাওয়া যেত না। একেবারে নিঃশব্দে সব কাজ করতেন। কাউতে এক ফোঁটা বিরক্ত করতেন না। কিন্তু কখন কার কী লাগবে সেটা জানতেন। যা একটু আধটু কথাবার্তা বলতেন মোটামুটি আমার সঙ্গে। আমি তার বড় ছেলে। বাঙালি মায়েদের বড় ছেলের প্রতি বলে আলাদা টান থাকে। মাকে দেখতাম ঘরের কাজ শেষ হলে, বা শেষ করে সবাই ঘুম থেকে ওঠার আগে বা সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পরে রবীন্দ্রনাথ পড়তে। আমি জীবনে অদ্ভুত মানুষ খুব যে দেখেছি তা তো নয়, আমার মা ছিলেন সত্যিই অদ্ভুত। ঘরের বউ টাকা জমিয়ে রবীন্দ্ররচনাবলী কিনে কিনা আমি কোনোদিন শুনিনি। তিনি বলতেন, রবীন্দ্রনাথ হল মন শান্ত ও ধ্যানস্থ করার জন্য। সত্যজিতের প্রায় সব ছবি দেখেছিলেন মা। আর কোনো সিনেমার প্রতি কোনো টান ছিল না। আমি মাঝে মাঝে এই সময়ের ভারতীয় বাংলা ছবির ডিভিডি নিয়ে তাকে দিয়েছি। নিজের ঘরে একটা টেলিভিশন আর একটা ডিভিডি প্লেয়ার ছিল মায়ের, সেগুলিও টাকা জমিয়ে কেনা। একটা ব্যাপার হলÑ মাকে বাবা তার রোজগারের পুরো টাকাটাই দিতেন। মা যা খরচ হতো সেটা বাদ দিয়ে মাস শেষে বেঁচে যাওয়া টাকা বাবাকে দিতেন। বাবা মাকে সেখান থেকে আবার কিছু টাকা দিতেন মায়ের নিজস্ব খরচের জন্য। ওই টাকা জমিয়ে আবার মা তার এইসব শখ মেটাতেন। বাড়িতে কেউ না থাকলে চুপ করে গান শুনতেন। সেই আদ্যিকালের কী সব রেকর্ড জোগাড় করে দিয়েছিলেন বাবা। আমি ঠিক জানি না, তবু মনে হয়, দুজনের মধ্যে নীরব একটা মায়া ছিল, প্রেম ছিলো কিনা বলা মুশকিল।
পুরোনো গ্রামোফোনও ছিল আমাদের বাসায়। নানার বাড়ি থেকে যে একটা জিনিস মা নিয়ে এসেছিলেন এটি ছিল সেই জিনিস। ও বলা হয়নি, মা আমার নানার একমাত্র সন্তান ছিলেন। একমাত্র সন্তান হলে কেউ কেউ এমন ব্যতিক্রম হয় আমার মা ছিলেন তাই। জগতের কোনো কিছু সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য ছিল না। আসলে ছোটবেলা থেকে কোনোদিন এতটুকু অভাবে ছিলেন না। না চাইতেই সব পেয়েছেন। মাকে কোনো দিন এতটুকু চেঁচিয়ে কথা বলতে শুনিনি।
মা যেদিন মারা গেলেন, সেদিন আমরা কেউ বাসায় ছিলাম না। মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে। মা সব সময় বলতেন, সুস্থ থাকতে থাকতেই মরে যেতে চাই। নিজের হাতে নিজের শৌচকর্ম যতদিন করতে পারি ততদিন অন্তত। কিন্তু এত আগে মা চলে যাবেন আমরা কেউ ভাবতে পারিনি। পরে টের পেয়েছিলাম মা আসলে নিজেকে একটি শান্ত মৃত্যুর দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। আর তা-ই তিনি করতে পেরেছিলেন। আমি কেবল রবীন্দ্ররচনাবলী শেষ খ-টিতে পেন্সিলে লেখা একটা লাইন পেয়েছিলাম, আজ এত বছর পর একটু একটু করে পড়ে এখানে এলাম। নিচে তারিখ লেখা আর কোনো কিছু নেই। মা কোনো ডায়েরি রেখে গিয়েছিলেন কিনা। সেটা খুঁজে দেখবার সময় আমাদের ছিল না। সময় তো কত কিছুর জন্যই থাকে না। মায়ের ডাইরি থাকলে আমার জন্য অন্তত লাভ হতো। কিন্তু আমি এ কথাই বা কাকে জিজ্ঞাসা করবো। নিজের মতো খুঁজে গেলে খুঁজেত পারি। এছাড়া ছোট ভাইকে বা বোনকে বলতে পরবো নাÑ আচ্ছা, মায়ের কোনো ডায়েরিটায়েরি আছে নাকি? বাবার কাছে তো জানতে চাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। অদ্ভুত! আমি বরং সবার সঙ্গে মিশতে, কথা বলতে চাইতাম, কিন্তু ভাই বোন দুটোই কেমন যেন গুটানো ছিল নিজের ভেতরে। লোকজনের সঙ্গেও মেলামেশা করতে না। নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। পড়ালেখা আর বাসাবাড়ি, ব্যাস। আর কোনো দিকে তাদের নজর ছিল না। বাপের তো এমনিতেই কারো সঙ্গে কথা বলার সময় নাই। তাই সবমিলিয়ে আমার কথা বলার লোক ছিল মা। মার ধাতটা আমি জানিÑ নিজে যেচে খুব একটা কথা বলতে চান না। কিন্তু যখন বলতেন, খুব আন্তরিকভাবে কথা বলতেন। মা চলে যাওয়ার পরে আর কারো কিছু শূন্য হয়েছে কিনা জানি না আমার ভুবনের একটা অংশ শূন্য হয়ে গেছে।
৪. সারাবান তহুরা
আমি সব সময় ব্যর্থ লোকদের এড়িয়ে চলি এবং ক্ষমতাবানদের পছন্দ করি। কিন্তু তাই বলে আমি আমান ডেভিডের মতো ক্ষমতাবানদের এড়িয়ে চলতে চাই। আমান নিজেও বলেছে, সে অশিক্ষত, মূর্খ, বাজে লোক, কেবল আমি চাইলে সে ভালো হয়ে যাবে। ভদ্র হয়ে যাবে। তারপরও আমি তাকে পাত্তা দেই না। সে বলেছে, আমার জন্য মরণ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে। আর ততদিন সে তার যে বউ আছে, তাকে ছাড়বে না। তার বৌ আমার কাছে এসেছিল, ‘আপা, আপনি কেবল শক্ত থাইকেন। ওর ওপরে ওপরেই যত চোটপাট। ওর খুব খারাপ লোক না। আপনার জন্য সে পাগল। জানেন না আপনার একটা ছবি সে শহরের নামী আর্টিস্ট দিয়ে আঁকিয়ে টানিয়ে রেখেছে।’ আমানের বৌটা অদ্ভুত। ভয় পায় আবার মায়াও করে। ওর বৌ আমাকে কথায় কথায় হঠাৎ বলেছিল, আমান বলে খুব সুখ দিতে পারে। ‘এজন্যই তারে ছাড়তে মন চায় না।’ অনেক পরে আমি আমানকে বলেছিলাম, চাইলে সে আমার কাছে মাঝে মাঝে আসতে পারে। আমার সঙ্গে সময় কাটাতে পারে। সে আমার কথা শুনে ভয়ই পেয়েছিল। স্পষ্ট করে বলা আছে, তাকে আমার বিয়ে করা সম্ভব নয়। এই কথাটা আমি যেকোনো ক্ষমতাবানের মুখের ওপরই বলতে পারি।
আমি সব সময় ক্ষমতার সঙ্গে আমার যোগাযোগ অব্যহত রাখি। জহতরকেও আমার ব্যর্থ মনে হলো। আবার মনে হলো চাইলে জহরতও ক্ষমতাবান হতে পারে। বয়স কম, সামনে পুরো সময়টা পড়ে আছে। ত্রিশও হয়নি, নতুন করে সব কিছু শুরু করাটা ওর জন্য কোনো ব্যাপারই নয়। ওর প্রতি কেমন একটা টান তৈরি হয়েছে কী সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারি না, সেটা মানসিক না শারীরিক? শারীরিক একটা তীব্র টান পুরুষ মানুষকে নিয়ে বোধ করলেও ইচ্ছা না জাগা পর্যন্ত আমি সেদিকে এগুই না। আর সেটা তো যেকোনো পুরুষ মানুষকে নিয়ে তৈরি হয় না। আমাদের এক আপা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় একটি কবিতায় লিখেছিল: ‘‘জগতের সমস্ত পুরুষের প্রতিটি লোমকূপ আমি দশনখে পরীক্ষা করতে চাই/ যদি না পারি তো/ কে সত্যিকারের পুরুষ তা আমার কোনো দিনও জানা হবে না।’’ আমারও মতও অনেকটা এমনই। আমার সব সময় মনে হয়, আমি আমার ইচ্ছাগুলিকে চাইলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। আর সেজন্য আমি নিজে পারতপক্ষে কোনো পুরুষমানুষের সঙ্গে একান্তে কথা পর্যন্ত বলি না। হ্যাঁ যাদের আমি জানতে চাই, তাদের তো নারী-পুরুষ ভেদ নেই। তার কেবল জানার জন্য, এর সঙ্গে জৈবিকতার বা দৈহিকক্ষুধার কোনো সম্পর্ক নেই। যদিও আমার নামে নানান বদনাম আছে। আমি আসলে মাঝে মাঝে এমন করে বাসায় ডেকে নিয়ে এসে তাদের সঙ্গে কদিন ধরে আলাপ করি। আমি দেখেছি, তাদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে, একটা পর্যায়ে তারা নিজেদের ভেতর থেকে খুলতে শুরু করে। তাছাড়া তারা কী খেতে পছন্দ করে সেটা আমি তাদের জন্য রান্না করি, বা ভালো কোনো হোটেল থেকে আনাই।
জহরত বলেছিল, ওর ফ্রাইড রাইসের গন্ধ পেলে সঙ্গে সঙ্গে ওর ক্ষুধা জেগে ওঠে। এরকম করে প্রায় সবাই তাদের প্রিয় খাবারের কথা বলে। আমি একটা জিনিস অপ্রতিরোধ্য সত্য বলে মানি যে, মানুষের হৃদয়ে যাওয়ার রাস্তা পেটের ভেতর দিয়ে গেছে। তাছাড়া ঢাকা শহরে আজকাল তো আর কেউ, অচেনা কেউ তো দূরের কথা, নিজের ঘরের মানুষই আর জানতে চায় না, কে কী খেতে পছন্দ করে। বলে না নিজেকে থেকে, আজ তোমার পছন্দের এটা রেঁধেছি। তুমি খুব পছন্দ করো তাই। আগে এসব ছিলÑ প্রিয় রান্না করে প্রিয় মানুষকে খাওয়ানো। আগে এমন কি যাদের সামর্থ্য কম, তারাও প্রিয় মানুষকে হঠাৎ করে তাদের প্রিয় রান্না করে অবাক করতো। সেইদিন এমন ‘না চাইতে বৃষ্টি’র মতো পছন্দের প্রিয় খাবার পেয়ে যার পর নাই আহ্লাদিত হতে হয়।
আসলে আমার যে মানুষের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়, তাদের তো বটেই, চেনা-অচেনা মানুষকে জানতে সব সময় ইচ্ছা করে। প্রবাদে বলে, কাউকে চিনতে হলে হয় তার সঙ্গে সফরে যাও, আমার সেটা সম্ভব নয়। আমি ঘর ছেড়ে বাইরে যেতে পছন্দ করি না। কলেজ আর বাসা ছাড়া আমার আর কোনো জগত নেই। আমি আসলে কোথাও নিরাপদ বোধও করি না। আর ইদানীং যেভাবে গাড়িতে পেট্রেল বোমা মারা হচ্ছে! বাস-গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, কিছু হলেই ভাঙচুর, তাতে তো আমি কোনোভাবেই চাই না বাইরে বের হতে। তারওপর লাগাতার হরতাল। কেন লেগে আছেÑক্ষমতার জন্যই? লোকজনের কথা নাকিÑ ‘নামাতে না পারলে থামেন, থামাতে না পারলে নামেন।’ আমি কেবল জানি আজ হরতাল। দিনের পর দিন কলেজে ক্লাস নেই। একটা রিক্সা আমাকে গুলশানে নিয়ে যায়। একমাত্র ওই মেয়েটাকেই আমি পড়াচ্ছি। তাও অন্য স্কুলে পড়ে বলে। নিজের স্কুলের কাউকে আমি পড়াইনি, পড়াই না। কিন্তু এখনতো পড়ানো বন্ধ। কতদিন চলবে এসব। আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশানজট ছিল, সেটি এখন স্কুল কলেজেও শুরু হয়ে যাবে কিনাÑ মনে মনে সেই আশঙ্কা করি। আমি এর বাইরে কোনো কিছু জানি না। পড়ার ভেতরে বইপত্র পড়ি। রাসেলের লেখা খুব ভালো লাগে। আমি একসময় মনে করেছিলাম, রবীন্দ্রনাথ দিয়ে নিজের জগৎ ভরিয়ে রাখবো। সেটা তাঁর গান দিয়ে পারলেও অন্য কিছু দিয়ে হচ্ছে না। অন্যরকম কিছু চাই। হ্যাঁ আমি মানি, রবীন্দ্রনাথ নিজের মতো আধুনিক। আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর প্রিয় মানুষ ছিলেন আহমদ রফিক। আমার খালাশাশুড়িকে তার কাছে কী একটা অসুখের সময় নিয়ে গেলে পর আলাপ। ডাক্তার মানুষ, এত বইপত্র পড়েন, তারওপরে কবি-লেখক, বিস্ময়কর। তার কাছে তিনি প্রায়ই রবীন্দ্র সম্পার্কে প্রশ্ন করে জানতেন। নানান বইপত্র আনতেন। আমাকেও পড়তে বলতেন। কিন্তু যেই না সরকার বদল ঘটল, আমার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী পড়ে গেলে গ্যাঁড়াকলে, সেখান থেকে বাঁচতে তিনি ব্যবস্থা করলেন ফিলিপাইনে যেতে। তারপর তো যা হলো। আমি কয়েকটা দিন তো অন্ধকার দেখলাম। ধাতস্ত হতে মাস খানিক লেগেছিল। সেটা একটা মানুষ করতেই পারে। কিন্তু আমার কাছে এটা নিজের পরাজয় বলে মনে হল। আমি পরাজিত ব্যর্থ মানুষ একেবারেই দেখতে পারি না। আর সেই আমি নিজেই পরাজিত হলাম?
অবশ্য এর মূলে একটা গভীর ব্যাপারও আছে। সেটা আমার নিজের জীবনে আমি জানি। হ্যাঁ, একথটা আমি এখনো কাউকে সহজে বলি না। আমার বাবাকে ফেলে আমার মা হঠাৎ একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। কেউ জানতো না। কেউ কোনো দিন জানতে পারেনি তিনি কোথায় গেছেন। একেবারে রহস্যময় ব্যাপার। আব্বু সে সময় খুব মদ খেতে শুরু করেন। আব্বু প্রায়ই বলতেন, আমার মুখটা মায়ের ডুপ্লিকেইট কপি। মায়ের মতো আমার কটা চোখ। গায়ের রঙ কালো। পার্থক্য কেবল মা বলে পাতলাপুতলা ছিলেন, সে তুলনায় আমি দোহারা গড়নের। মা যখন আমাদের ছেড়ে উধাও হয়ে যায়, তখন আমার বয়স একেবারেই কম। মানে হয় তিন কি চার। মায়ের কোনো স্মৃতি আমার নেই। মায়ের কোনো ছবি আমার বাবা তার অ্যালবামে রাখেনি। নানাবাড়ি সেই সাতক্ষীরা। কোনো দিন সেখানে যাওয়া হয়নি আমার। মামারাও কোনে দিন আমার খোঁজ নিতে আসেননি। পরে বাবা তো আরেকটা বিয়ে করেন। এই মায়ের আগের ঘরের দুটো ছেলে ছিল। আমার বাবার ঘরে এসে তার আরো দুটো ছেলে হয়। তিনি আমাদের পাঁচভাইবোনকে একেবারে আপন সন্তানের মতো মানুষ করেছেন। তার নিজের একটা মেয়ে হল না বলে এই মায়ের একটা দুঃখ ছিল, আমাকে পেয়ে সেটাও ভুলেছিলেন। আমাকে বলতেন, আমি বলে তার মনের মতো মেয়ে হয়েছি।
আমি ছোটবেলা থেকে লক্ষ্মী মেয়ে ছিলাম। কারো কথার অবাধ্য হতাম না কখনো। বাইরে বাইরে আমি যত বাধ্য মেয়ে হয়ে উঠছিলাম, ভেতরে ভেতরে আমি ততটাই প্রচলিত সব কিছুর প্রতি অবাধ্য হয়ে উঠছিলাম। এমন সব অস্থিরতা আমার ভেতরে দেখা দিল। আমি সেটা বাইরের লোকজন আবার বুঝে ফেলবে, আমি সেটা চাইনি। খুব অল্প বয়সে এই মায়ের বড় ভাই, স্কুলে পড়াতেন, তাকেই বড় মামা বলে আমি জেনেছিলাম। ছুটিতে নানার বাড়ি, নানা তখন বেঁচে নেই বলে, মামাবাড়িই বলতাম, সেটাই ছিল আমার কাছে বেহেস্তের মতো। দোতলা, চারপাশে বাগান, কী খোলামেলা। দোতলার একটা কোনায় মামার ঘর। সেখানে দুটো বইয়ের র্যাকে গাদানো বইপত্র। মামা বলতেন, একটা র্যাক দেখিয়ে বলতেন, এই র্যাকের কোনো কিছু পড়বি না। ওই র্যাকটা থেকে যা খুশি পড়বে। আমি মামা যে র্যাকটা থেকে বইপত্র পড়তে নিষিধ করেছিলাম, সেখান থেকে সব বড়দের বইপত্র বের করে চুরি করে পড়তে শিখেছিলাম। নারীপুরুষের এমন সব কাহিনি! আমি একেবারে হা। পড়তে পড়তে এমন অস্থির লাগতো। ওইসব বই আর ম্যাগাজিনের ভেতরে খেলামেলা ছবিও থাকতো। কয়েকটা চুরি করে ঢাকা নিয়ে এসেছিলাম। লুকিয়ে পড়তাম। যত পড়তাম তত অস্থির লাগত। নেশার মতো টানতো ওই বই। তক্কে তক্কে থাকতাম রাজশাহী করে যাবে। আমের দিন এলে তো কথাই নেই। হৈ চৈ করে আমরা চারভাই আর আমি রাজশাহী যেতাম, মাও খুব মামাবাড়ি যেতে ভালোবাসতেন। আমার তো উদ্দেশ হল মামার ওই নিষিদ্ধ বইয়ের র্যাক। তারপর তো একদিন ধরা পড়ে যাই। মামা খুব করে বকবে মনে করছিলাম। কিন্তু মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বোঝালেন। কত কী বললেন। সময় হলে সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়। এখন তোমার সময় আসেনি। যেদিন বড়ো হবে আমিই তোমাকে এইসব বই দিয়ে আসবো কেমন। বড় মামা ও মামী সংসার খুব সুখের ছিল। দুজনেই খুব হাসিখুশি আর প্রাণবন্ত ছিলেন, এর কারণ তাদের শারীরিক সম্পর্ক বলে ভীষণ ভালো ছিল। মামার একটাই ছেলে। ইমনভাই। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হন। মামামামী বলে বুড়ো বয়সেও আগের মতোই সক্রিয় আছেন। তাদের ভালোবাসাবাসি শেষই হয় না। এসব শুনতাম নানানভাবে। মামীর বোনেরা, বোনের মেয়েদের আলাপ থেকে এসব কানে আসতো।
আমার সেই যে অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল তাতো আর সহজের কাটল না। ডাক্তার লুৎফর রহমানের ‘শিষ্ঠাচার’ না কী একটা লেখায় ক্লাস সেভেনের দিকে পড়েছিলাম, ‘তরল চিন্তা একবার যার মাথায় ঢোকে তার আর রক্ষা নাই।’ আমার সত্যিই আর রক্ষা হয়নি, যদিও সেই সময়ের অস্থিরতা দূর করতেই আসলে অঙ্ক করাটাকে বেছে নিয়েছিলাম। দেখলাম একমাত্র অঙ্ক করার সময় আমি সব কিছু ভুলে যেতে পারি। এর ভেতরে যাকে বলে নিবিষ্ট হওয়া তাই হতে পারি। বলতে গেলে অঙ্কই আমাকে রক্ষা করে।
আব্বুর সাহিত্যপ্রীতি, আধ্যাত্মিকতা, সেটি ঠিক ধর্মীয় নয়, সুফিবাদী কিছুটা বৌদ্ধঘরানার, কিছুটা তান্ত্রিক। আসলে মা চলে যাওয়ার পর তিনি ধুমছে মদ খাওয়া শুরু করেছিলেন, সেখান থেকে নিজেকে তুলে আনতে এই সুফিবাদে চলে এলেন। জীবনের অন্য এক নেশা আছে। জীবন সেখানে ডুবে যেতে পারে। মদে চুর হয়ে পড়ে থাকা জীবন কাউকে আসলে কিছুই দেয় না, বরং মদই তাকে খেতে শুরু করে।
আব্বু আমাকে তার জীবনের সবকিছুই বলেছিলেন। আমি তার প্রথম সন্তান। আমি তার রহস্যময় অন্তর্ধান ঘটানো মারাত্মক আকর্ষণীয় স্ত্রীর একমাত্র স্মৃতি। অনেক পারে আব্বু বুঝেছিলেন, তার স্ত্রীর হয়তো এমন কিছু হয়েছিল, যাতে তিনি আর স্বামীকে কিছু দিতে পারতেন না, বা এমন কোনো অসুখ, বাবার এই উপলব্ধি মায়ের প্রতি রাগকে দিনে দিনে কেবল একেবারে থিতিয়েই দেয়নি, অন্য এক চেহারায় তার আগের সবকিছুকে মুছে দিয়ে নতুন করে দিয়েছিল। বাবার কাছে শিখিছি, যেকোনো মানুষকেই একাপাশ দিয়ে দেখা বড়ই ভুল দেখা। মানুষকে দেখতে হবে সবদিক থেকে। যাকে বলে কিনা দশ দিক থেকে। ওপরে-নিচে কাছে-দূরে সব রকম দূরত্বে মানুষকে দেখতে হয়, দেখতে পাবে যদি তুমি কাউকে দেখতে চাও।
প্রত্যেকটা মানুষের অমিত সম্ভবনা আছে কিনা জানি না, কিন্তু প্রত্যেকটা মানুষই দারুণ ইন্টারেস্টিংÑ এটা মানি। মানুষের ভেতরের মানুষটা যখন বেরিয়ে আসে তখন দেখা যায়, অন্যদের সঙ্গে তার প্রায় মিলে যেতে যেতেই এমন একটা জায়গা থাকে যে, সেখানে আর মিলে না, বা এমন একটা জায়গা থাকে তার পেছনে থাকে প্রত্যেকের আলাদা আলাদা স্মৃতি প্রেক্ষাপট এবং একেবারই আলাদা বাস্তবতা। ফলে প্রত্যেকটা মানুষের আলাদা আলাদা সত্য থাকাই স্বাভাবিক। মানুষের কোনো ধর্ম থাকারই কথা ছিল না, যদি মানুষ এভাবে নিজের সত্যগুলি নিজে চিনে নিতে পারতো। তখন বিশৃঙ্খলা দেখা দেওয়ার বদলে আরো শান্তি ফিরে আসতো, প্রত্যেকে প্রত্যেককে বুঝতোÑ অন্যেরও আমারই মতো আলাদা অনুভূতি, আলাদা দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গি আছে। সেটাকে সম্মান না করলে আসলে পুরো মানুষটাকেই হেয় করা হয়।
আমি যখন দেখলাম জহরতের ভেতরে আলাদা মানুষ একটা জেগে উঠতে চাইছে, সে আসলে নির্ভরতার জায়গা খুঁজে, তাতে তাকে ব্যর্থ মনে হলেও একই সঙ্গে মনে হল ইন্টারেস্টিং। (এই ইন্টারেস্টিং শব্দটার বাংলা হয় আগ্রাহজাগানিয়া, নাকি চমকপ্রদ?) আমি এজন্য জহরতের ফোন নম্বরটা টুক করে তুলে নিয়েছিলাম। আর নিশ্চিত ছিলাম সে আমার ডাকে সাড়া দেবে। তারপরও মনে হচ্ছিল একধরনের জেদও তাকে পেয়ে বসতে পারে। সেই জেদ হল, আমি জগতের আর কাউকে চাই না। আমার পথ আমি নিজেই তৈরি করে নেব। কাউকে আমার লাগবে না। জহরতের যে সেটা ভেতরে ভেতরে পুরোটাই আছে আমি বুঝতে পারি। সে আমার সঙ্গে আলাপ করার সময় বলেছিল, সে সত্যিই জানে না জগতের তার প্রতি সত্যিই আগ্রহ আছে কজন মানুষের? কটা মানুষ তাকে ঘনিষ্ঠভাবে জানতে চেয়েছে। কে তাকে ভালো করে চিনতে পারে? তার বাবা? যে মা তাকে জন্ম দিলেন, তিনি হয়তো তাকে ভালোবাসাতেন কিন্তু চিনতেন কি? কাউকে ভালোবাসলেই তাকে চেনা যাবেÑ তাতো নয়, বা কারো সঙ্গে চেনা থেকে জানা এবং জানা থেকে ভাব হবেÑ এই পরম্পরা তো সব সময় নাও মিলতে পারে। আর খুব বেশি হলে ভেতরের এই চেনা জানার ব্যাপারটা একজন ব্যক্তির সঙ্গেই আরেকজন ব্যক্তির হয়তো ঘটতে পারে। আমির সঙ্গে তুমির। অন্য সবার কাছেই ব্যক্তি যে মানুষটা সে আড়ালে পড়ে যায়। এজন্য কেউ মারা গেলে যে বড় স্মারকগ্রন্থ হয়, আমি দেখেছি, যেমন আমাদের স্কুলের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক মিল্লাত হোসেন তরফদার মারা গেলেন, তাকে নিয়ে একটা বিরাট বই প্রকাশিত হল, তাকে যে বাংলাদেশের এত সব বিখ্যাত ব্যক্তি চিনতেন তাই তো আমি বা আমরা তো জানতাম, কিন্তু তাকে নিয়ে যে এত লেখার বিষয় আছে সেটা জানতাম না। এদের অনেকেই তাকে নিয়ে লেখা লিখেছিলেন, কিন্তু আমি দেখলাম কেউ তার ভেতরের মানুষটাকে জানেন না। কেবল তার এক পুত্রের লেখাতে তার ভেতরে মানুষটাকে একটু পাওয়া গেল, কিন্তু তার কয়েকটা দিকের বা স্বভাবের লেশ মাত্রও পাও গেল না। তাকে প্রায় ভুলত্রুটির ঊর্ধ্বে প্রায় মহামানবের স্তরেই আরেকটু হলে প্রত্যেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল। ছিলেন বিশাল ধনী, অপরিমত সম্পদ। এই লোকটিকে আমি চিনেছিলাম, জেনেছিলাম কিছুটা।
৫. মিল্লাত হোসেন তরফদার ও সারাহ্
প্রথম স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তিনি হজ্বে গেলেন। কদিন খুব আল্লাবিল্লা করলেন। বয়স তখন মাত্র পঞ্চাশ কিন্তু দেখলে পঁয়ত্রিশও মনে হবে না। বলিষ্ঠ শরীর। লম্বায় বাঙালিদের চেয়ে গড়ে বেশি, প্রায় পাঁচ ফুট আট নয়ের মতো। চওড়া পেটানো শরীর হওয়ায় লম্বাটা বোঝা যায় না। হজ্বের পর তিনি রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত হলেন। বিপুল বিত্তের কারণে পার্টি তাকে এম.পি ইলেকশানের টিকেটও দিল। তিনি পাশ করলেন। আমাদের স্কুল অ্যান্ড কলেজের সভাপতি হলেন। রইলেন পাঁচ বছর। এই পাঁচ বছরে আমাকে যে তিনি এতবার দেখতে চেয়েছেন, আমার সম্পর্কে এত কিছু জেনে নিয়েছেন, আমি তো কল্পনাও করিনি। তার পার্টি পরের নির্বাচনে হেরে যায়। তিনিও ভোটে হারেন। যদিও তার মতে, তাকে হারানো হয়েছে। দেশে তখন থমথমে অবস্থা। আমার মনে আছে নির্বাচনের ঠিক সন্ধ্যাবেলাটা মনে হচ্ছিল সমস্ত প্রকৃতি যেন থম মেরে আছে। রাস্তা ঘাটে কোনো গাড়ি নেই। লোকজনও দেখা যাচ্ছে না। এর ঠিক দুদিন পরে হঠাৎ তিনি আমাকে ফোন করলেন। আমি তো একেবারে আকাশ থেকে পড়লাম। এটা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। তাঁর মতো এত বড় মানুষ। শুনেছি এত ভালো মানুষ আমার সঙ্গে এভাবে কথা বললেন! বললেন, ‘আমি একটা গাড়ি পাঠাচ্ছি। আপনি আশা করি কোনো আপত্তি করবেন না। আমার আপনার সঙ্গে একান্ত এবং অত্যন্ত জরুরি কথা আছে।’ আমাকে কোনো কথা বলারই সুযোগ দিলেন না। ‘দয়া করে কিছু জানতে চাইবেন না। শুধু চলে আসুন। এতটুকু বলতে পারি আপনাকে কোনো অসম্মান করা হবে না। তবে না যদি আসতে চান আমি যারপরনাই কষ্ট পাবো মনক্ষুণœ হবো।’ এত ভদ্র ও মার্জিতভাবে তিনি কথা বললেন, আর আমার ভেতরে জেগে উঠল মানুষকে জানার সেই অ্যাডভেঞ্চার। দেখিই না কী হয়, মানুষটা আসলে কেমন।
তিনি আমাকে যা বললেন, সত্যিই বিস্ময়কর। বলেছিলেন, ‘আমি এখন এক রকম ক্ষমতাহীন। কিন্তু ক্ষমতা কী জিনিস আমি জেনেছি। আমি এখন ক্ষমতা নয়, শান্তি চাই। আর এজন্য চাই আপনার সহযোগিতা।’ আমি বলেছিলাম, আমি তাকে কী ধরনের সহযোগিতা করতে পারি। যদিও আমি তার কথার ভেতরেই বুঝতে পেরেছিলাম, একজন স্বামী পরিত্যাক্তা যুবতী নারীর কাছে তিনি কী চান। তিনি বলেন, ‘আপনাকে আমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতী মনে করি। আপনি স্কুলের একটি সভায় আপনি কী বলেছিলেন মনে আছে?’ আমার মনে পড়ে আমি আসলে সেদিন অনেক সাহস নিয়ে কথাগুলি বলেছিলাম। তখন আসলে ওই কথাগুলি এত বলতে ইচ্ছা করেছিল। অর্গলখুলে দিয়ে বলেছিলাম। বলেছিলাম, ‘আমাদের বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার জন্য মাত্র তিনটি জিনিস চাই, সুশিক্ষা, সুস্বাস্থ্য আর সুস্থ-সবল মন। ভালো স্কুলই পারে সেই সুশিক্ষা দিতে, আর সুস্বাস্থ্যের জন্য চাই প্রত্যেকটি এলাকাতে খেলার মাঠ এবং সুস্থ-সবল মানের জন্য চাই লাইব্রেরি। আমরা মনে করি আমাদের নতুন এমপি মহোদয় এই তিনটি যাতে আমাদের এলাকায় প্রতিটি স্কুলে নিশ্চিত করেন। এবং তাকে দেখে শিখে পুরো দেশের মানুষ এই তিনটি জিনিস প্রতিটি এলাকায় তাদের বাচ্চাদের জন্য নিশ্চিত করবেন।’
মিল্লাত সাহেব বলেন, ‘আপনাকে কিন্তু আমি দীর্ঘ দিন ধরে খেয়াল করছি। আপনাকে যতটুকু বাইরে থেকে জানা সম্ভব আমি জেনেছি।’
‘কী রকম?’
সদ্য ভোটে পরাজিত হওয়ার কোনো ছাপ তখন তার চেহারায় ছিল না। বরং একটা প্রশান্তিই দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল ভোটের ব্যাপারটা তিনি একেবারে ভুলে গেছেন। তিনি কিছুক্ষণ পর পর একটু একটু করে তার হাতে থাকা গ্লাস থেকে পানি খাচ্ছিলেন, সেটাতে কেবল বোঝা যাচ্ছিল ভোটে হারা নিয়ে তিনি যত না চিন্তিত, আমি তাকে কী বলি বা তিনি আমার সঙ্গে কী ধরনের আচরণ করবেন বা আমাকে কী করে ট্রিট করবেন, সেটা নিয়েই তিনি বেশি চিন্তিত।
তিনি বললেন, ‘দুটো ব্যাপার বললেই আশা করি আপনি বুঝতে পারবেন। একটি হল আপনার মা আপনার খুব ছোটবেলায় আপনাদের পরিবার থেকে রহস্যময়ভাবে নিরুদ্দেশ হন। এবং আরেকটা হল আপনার স্বামী ফিলিপাইনি গিয়ে ট্রেনিংয়ের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও ফিরে আসেননি।’
আমি দ্বিতীয়টাতে তেমন অবাক না হলেও প্রথমটাতে একটু চমকে উঠি। আমাকে তিনি চমকে দিয়েছেন সেটা তিনি উপভোগ না করেই একই স্বরে তিনি বলেন, ‘আপনি সব সময় সাদা রঙের সব কিছু ব্যবহার করেন। পা থেকে মাথা পর্যন্ত আপনি সাদা। আমার মনে হয় মানুষ হিসেবেও আপনি সাদা।’
আমি তখন ইচ্ছা করেই বলি, ‘আসলে আমার ভেতরটা এত কালো,এত অন্ধকার, সেটা আড়াল করার জন্যই আমি সাদা দেখাই নিজেকে। নিশ্চিয়ই আমি এমন একটা অশুভ কিছু যে, যাকে তার মা ছেড়ে চলে যায়, তার স্বামী ছেড়ে চলে যায়, এবং ভবিষ্যতেও সে যদি কারো সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে সেও যে তাকে ছেড়ে চলে যাবে না, তাই বা কে বলতে পারে?’ আমি ইচ্ছা করে কথার ভেতরে আগাম ইঙ্গিতটা দিই। কারণ আমি জানি তিনি আমাকে নিয়ে কী ভাবছেন।
এতক্ষণ তার আমরা যে ঘরে কথা বলছিলাম সেখানে চারপাশে চারটা লোক ছিল। তিনি আমার কথা শুনে হাতের ইশারায় তাদের চলে যেতে বলে। এতে তার নেতাভাবটা বেশ দেখতে পাই। আমি এদিকে বলে যাচ্ছিলাম,‘আপনি জানেন মন ও শরীর আলাদাও হতে পারে পারে।’
‘মানে কী রকম?’
‘মানে অনেক সময়ইÑ মনের চাহিদা শরীর পূরণ করতে পারে না। শরীরের চাহিদা মন পূরণ করতে পারে না।’
তিনি জানতে চান, ‘আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না।।’
‘কী রকম করে সেটা হয়? একটা গল্প বললে বুঝতে পারবেন মনে হয়।’
তিনি বলেন,‘ লম্বা গল্প না ছোট?’
‘ছোট।’
‘আসলে আমার হাতে সময় অনেক থাকলেও সব কিছুর জন্য তো আমি একই রকম সময় ব্যয় করি না। আমার হাতে এই সময়টা পুরো আপনার জন্য। চাইলে আপনি আমাকে সমুদ্র সমান গল্প শোনাতে পারেন। গল্পের পর গল্প। ওই যে আরব্য রজনীর শেহেরজাদীর মতো।’
‘বাহ! তাহলে তো ভালো। আচ্ছা তাহলে আপনাকে কয়েকটা গল্প শোনাবো। এখন যেটা বলছি এটা ঘটেছিল ইজিপ্টে। আধুনিক যুগে। এক আমেরিকান মেয়ে মিশরে গিয়ে একটি পুরুষের দেখা পায়। তাদের প্রেম হয় এবং তাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও হয়। যতটা ঘনিষ্ঠ নারীপুরুষ হতে পারে। তারপর মেয়েটি আবার আমেরিকা ফিরে যায়। কিন্তু এক অপ্রতিরোধ্য টানে মিশরীয় ওই পুরুষটি তাকে টানতে থাকে। সে আর থাকতে না পেরে আবারও মিশরে চলে আসে। সেই লোকটাকে সেদিনই পেতে চায়। লোকটি বলে, এজন্য তাকে একটা কাজ করতে হবে। বলাবাহুল্য লোকটি অত্যন্ত ধনী ছিল। ছিল বিপতœীক। বিশাল তার প্রসাদ। সেই প্রসাদের যে কক্ষে তারা আগের বার মিলিত হয়েছে, তার বদলে অন্য একটা কক্ষে তারা এবার মিলিত হবে। শর্ত একটিই কক্ষটি থাকবে একেবারে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এবার তার সঙ্গে মিলনের সময় সেই কোনো কথা বলতে পারবে না, এমনকি শব্দ করতে পারবে না। লোকটিও একটি কথা বলবে না। এই হল আরেক শর্ত। মেয়েটি তাকে তখন পাওয়ার জন্য হন্যে। তার কোনো তরই সইছিল না। মেয়েটি তার অ্যাডভেঞ্চরে রাজি হয়। এক্ষুণি চাই। সে তাকে বলেছিল, মনে ও শরীরে সে ছাড়া আর কাউকে সে গ্রহণ করতে পারছে না। এজন্যই সে আমেরিকা থেকে চলে এসেছে। তো মেয়েটাকে সেই অন্ধকার কক্ষে রেখে আসা হয়। সেখানে একটি বিছানায় সে শুয়ে থাকবে। বলা হয় তাকে একটু অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকে। তারপর পুরুষটি কক্ষে প্রবেশ করে। মেয়েটি তাকে হাতের লাগালে পাওয়া মাত্র আর অপেক্ষা করতে পারে না। তার সঙ্গে উত্তাল মিলন শেষ হয়। মেয়েটা জীবনে এ সুখ আর কখনো পায়নি। তার সেই সুখের ভেতরে বাতি জ্বলে ওঠে। মেয়েটি দেখে এতক্ষণ যে লোকটির সঙ্গে সে ছিল সে একজন কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ, মানে নিগ্রো। অথচ সে এতটুকু টের পায়নি। একই রকমের গায়ের গন্ধ ছিল। চুল, ঠোঁট, হাত, পা মানে শরীরের গড়ন প্রায় একই। কৃষ্ণাঙ্গটি বাতি জ্বলের ওঠার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রচালিতের মতো চলে যায়। আর কক্ষে প্রবেশ করে মিশরীয় ওই ধনী ব্যক্তি। মেয়েটি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। লোকটি বলে, সে প্রমাণ কি পায়নি, যে ভালো না বেসেও চরম সুখ পাওয়া যায়।’
আমি বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। তিনিও চুপ করে থাকেন, কেবল পানির গ্লাসে থাকা শেষাংশটুকু একবারে গলায় ঢেলে দেন। তাও মাথা পেছনের দিকে হেলিয়ে। কেবল তাই নয়, এমন করে গ্লাসের প্রান্তটা নিজের মুখের ওপরে ধরে রাখেন যেন একটি বিন্দুও সেখানে অবশিষ্ট না থাকে। আমি দেখি সেখানে দু ফোঁটা টুপ টুপ করে তার মুখের ভেতরে পড়ে। আমি পরে জানি, এটা এক বিশেষ ধরনের শরবত যা খেলে নিজেকে অনেকক্ষণ ধরে রাখা যায়। কিন্তু এটা শরীরের কোনো কিছুর ওপরে চাপ তৈরি করে না। দক্ষিণভারতের এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন এক আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক নাকি এটা আবিষ্কার করেছেন।
‘তাহলে ফলাফল কী দাঁড়লো?’ তিনি বলে ওঠেন।
আমি বলি,‘আমি তো বললাম। আসলে আমার দ্বারা কারো সঙ্গে, মানে কোনো পুরুষের সঙ্গে বসবাস করা সম্ভব নয়। কিন্তু...’, বলে আমি একটু থামি।
তিনি সঙ্গে সঙ্গে বলেন, ‘কিন্তু কী?
‘কিন্তু শারীরিক সুখ ভোগ করা সম্ভব।’ আমি চট করে কথাটা বলে ফেলি। তিনি বলেন, ‘তার মানে কী দাঁড়ায় সোজাসুজি বলছেন না কেন?’
আমি বুঝলাম তার ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে। তিনি আমার দিকে একটা স্মিত হাসি দিয়ে তাকালেন। আমার জবাব শোনার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। আমি বলি, ‘সোজা কথায় বিয়ে করা সম্ভব নয়, কিন্তু বিছানায় যাওয়া সম্ভব।’ দেখি তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বললেন, ‘ডু ইয়্যু মিন ইট?’
আমি দ্বিধাহীন ভাবে বলি, ‘সার্টেইনলি।’
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘তাহলে তাই হোক।’
অল্প কিছুক্ষণের ভেতরেই আমি টের পাই পুরুষ মানুষ সত্যিই ভয়ংকর জীব। অনেক দিন পর আবারও নতুন করে টের পেলাম। কিন্তু তিনিও টের পেলেন আমি রমণী কতটা ভয়ংকর। মন্তব্য করলেন,‘এ এমন এক খেলা, যেখানে দুজনকেই জিততে হয়। হারলে দুজনেই হারে। আমার মনে হয় আমরা কেউ কাউকে হারতে দেইনি।’
চৌষট্টি কলার তিনিও সব জানেন। আমিও কম জানি না। বার বার বললেন আজকে রাতটা থেকে যেতে। আমি বলি,‘শরীর নিয়ে আমার কোনো সংস্কার নেই। শরীর আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বাড়ি ফেরাটা সামাজিক ব্যাপার যতটা না, তার চেয়েও বেশি আমার পারিবারিক ব্যাপার। রাতের বেলা আমি বাইরে থাকি না। কোথায় বেড়াতে গেলে কেবল থাকা। তাও সেটা আমার একমাত্র বান্ধবী অর্মা ওখানে। সে উত্তরাতে থাকে। তার লোকজন আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসতে চেয়েছিল। আমি নিজেই ফিরেছি। ঘরের ভেতরেই থাকা বিশাল বাথটাবে সঙ্গম ও ¯œান দুটোই সেরে নেওয়া গিয়েছিল বলে বাসায় ফিরে কেবল খাওয়াটা বাকি ছিল। তিনি সেদিন রাতের বেলা আমাকে ফোনও করেন। অনেক কথা হয়। আমাকে নিয়ে দূরে কোথায় বেড়াতে যেতে চান। আমি চাইলেও বিদেশেও তার সঙ্গে যেতে পারি। আমি বলেছি, এসব কোনোটাই আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমি যেটা করতে পারি অর্মার বাসায় যাওয়ার নাম করে আপনার বাড়িতে টানা কয়েকদিন থাকতে পারি। কিন্তু এ ব্যাপারটা আর কেউ জানবে না। আজকে সত্যিই বোকামি-ই হয়ে গেল। আজই তাকে সুযোগ দেওয়া ঠিক হয়নি। আবার এও ঠিক সুযোগ না দিলে তিনি আমাকে আজ অন্তত ছাড়াতেন না। টের পেতে দেরি হয়নি যে, অনেকদিন ধরেই আমি তার চোখে বিঁধে আছি, সেই কাঁটাটা প্রথমে নামিয়ে দেওয়া দরকার। সেজন্য আমি তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপে আমার ঠোঁট, জিভ, আঙুলের, নখের, হাতের তালুর ছাপ এমনভাবে রেখে এসেছি যে তিনি সেসব শরীর থেকে মুছে ফেলতে পারলেও মন থেকে কোনো দিন মুছে ফেলতে পারবেন না। তাকে গ্রহণ করেছি ভেতরে, তাকে গিলেছি, পান করেছি; তাকে নিয়ে গেছি আমার অন্ত্রে, বৃহদান্ত্রে। আমাকে নিতে দিয়েছি দশদিক থেকে। দেখতে চেয়েছি, কত দিক থেকে শরীরের গহীনভেতরে ভ্রমণ তিনি করতে চান। কতটা পথ কতটা গভীরে কতভাবে তিনি যেতে চান। আমিও তার হাত ও ঠোঁটের অপ্রতিরোধ্য টান টের পাই। সেটা যতটা না একজন ভোগীলম্পটের তারচেয়ে বেশি একজন প্রেমিকের। আর সবকিছুর মূল ব্যাপার ছিল তার ভেতরের কথা জানা। তাকে জানা। তাও আমি পরের সাত দিন যে তার সঙ্গে নিবচ্ছিন্নভাবে সবকিছু ভাগ করে নিয়েছি, তাতে তিনি জীবনের প্রায় সব কিছু নিজের থেকে আমাকে জানিয়েছেন। ক্ষমতার কাছে নিজেকে শঁপে দেওয়ারও মনে হয় আলাদা নেশা আছে। কোনো রাজা যদি সামান্য পতিতা নারীকে ভোগ করে, তাতে ওই পতিতা নারীটি ভেতরে ভেতরে গর্বই বোধ করে। আমারও হয়তো মনে হয়েছে, আসলে তাই মনে হয়েছে, এই এলাকার সবচেয়ে ক্ষমতাশালী একজনকে আমি দশনখে আমু-ুশিরনখ দেখে নিতে পেরেছিলাম। এবং সেটি জগতের কেউ জানে না।তিনি তার এমন স্বাভাবিক কর্ম বাদ দিয়ে সবকিছু বন্ধ করে ঘরে পড়েছিলেন। পত্রিকায় ছাপা হয়েছে নির্বাচনে হেরে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত সাবেক এম.পি মিল্লাত তফরদার। তিনি সেই পত্রিকা আমাকে দেখিয়ে হো হো করে হেসেছেন। আমাকে বলেছেন,‘এভাবে পত্রিকা আমাদের মিসরিডই করে গেল। মাঝে মাঝে অবশ্য মিসরিড করার দরকার আছে। কী বলেন? মহাসুখের সাগরে আমি ভেসে চলেছি, আর ওরা মনে করছে আমি দুঃখের সাগরে ডুবে তলিয়ে গেছি। তিন-চার দিন ঘর থেকে বের হচ্ছি না। আমাকে মোবাইল, ফোনে কোথায় পাওয়া যাচ্ছে না। হা হা হা! আশ্চর্য ব্যাপার তাই না। সত্য কত রহস্যময়, কত সামান্য জিনিসও কতটা গভীরে আড়ালে পড়ে থাকে সেটা তো এভাবে না জানলে আমি জানতাই না।’
তিনি একবারও আমাকে ‘তুমি’ করে বলেননি। আমিও বলেছি, আমাকে এর বিনিময়ে কোনো টাকাপয়সা দেওয়ার তো কোনো প্রশ্নই ওঠে না। উপহারটুপহার দিলে সেগুলি আমি এখানেই ফেলে চলে যাবো। কারণ মনে রাখবেন আমি যা করেছি, আনন্দের সঙ্গে স্বেচ্ছায় করেছি। এবং আমার এই নিয়ে কোনো গ্লানি নেই। এতটুকু কোনো পাপবোধ নেই। তাছাড়া তিনি একাই আমাকে ভোগ করেননি, আমিও তাকে ােগ করেছি। আমরাও তাকে কিছু দেওয়া উচিত। একথায় তিনি আমার একটা আংটি চান। তখন আংটিটা বিছানার পাশের ড্রেসিং টেবিলের ওপর খুলে রাখা ছিল। আমি তার হাতে আংটি পরিয়ে দিলে তিনি আমাকে আশ্লেষে প্রাণভরে অনেকক্ষণ চুমু খান। চুমু খেতে খেতে আমরা আবার চূড়ান্তের দিকে এগিয়ে যাই। এভাবে বার বার ঘুরে ফিরে নানান সময় আসে আর আমরা মেতে উঠি।
তিনি এক একটি দীর্ঘ মিলনাভিসার শেষে আমার পায়ের কাছে সেজদার মতো করে পড়ে ছিলেন। ‘সর্বেশ্বরীর বলে একটা শব্দ আছে। একটা আপনাকে না দেখলে তো আমি বিশ্বাসই করতে পারতাম না। আপনি তো আমাকে একেবারে পৌরাণিক যুগে নিয়ে গেলেন।’
আমি বলি, ‘পৌরাণিক যুগেই নিয়ে যদি থাকি তো পৌরাণিক যুগের মতো আমি নিশ্চয়ই আপনার কাছে বরও চাইতে পারি। কি পারি না?’
‘নিশ্চয়ই। কী বর চান বলুন। আমি আলাদিনের দৈত্য না হলেও আমার সাধ্যে, ক্ষমতায় যেটুকু আছে আপনাকে আমি দিতে চাই।’’
‘সেটা আমার জন্য নয়। আমি শুধু বেশি না; মাত্র তিনটা বর চাই। সেগুলি কী কী আমি নিজেও জানি না। কিন্তু যখন যে সময় আমি সেই বর চাইবো আপনি কি আমাকে সেই বর দিতে পারবেন।’’
‘বললাম তো যেকোনো সময়।’
‘আমি সময় হলে চাইবো। হয়তো এক বারে চাইবো না। একটা শেষ হলে অনেক বিরতি দিয়ে আরেকটা। তবে এখন একটা জিনিস আমি চাই, সেটা হল আমাদের যে গোপানীয়তা সেটা আশাকরি বজায় থাকবে। আপনি স্মৃতি হিসেবে যে এত এত ফটো তুললেন, ভিডিও করলেনÑ সবই আপনার হেফাজতে থাকবে। এর একটা বিন্দুও জগতের কেউ জানবে না।’
আমি এসব বলেছিলাম, কারণ আমাদের একান্ত সময়গুলিতে আমি একের পর এক প্রশ্ন করে গেছি। তিনি তার প্রায় সবগুলির উত্তর দিয়েছেন। এর ভেতরে এদেশে কারা কারা কী কী কাজের জন্য দায়ী। ক্ষমতার চক্রে কী কী হয় সব আছে। আমি নিজে তার কাছ থেকে ফটো ও ভিডিও কপি করে নিয়েছি। আমার কাছেও এককপি থাকা দরকার। কারণ হাজার হলেও তিনি রাজনীতি করেন। রাজনীতি যারা করে আমি শেষ পর্যন্ত তাদের বিশ্বাস করি না। যদিও তাকে আমি অনেকটাই বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ অনেক যতেœ কিন্তু বিপুল বিক্রমে বাঘের শৈর্যবীর্য নিয়ে তিনি আমাকে সম্মান করেছেন। আমরা কেউ আসলে দুয়েকবারের জন্য কখনো মাঝে মাঝে সামান্য ক্লান্ত হলেও কখনোই আসলে হারিনি।
আমার একবার মাত্র এতদিন পরে মনে হল, তিনি বেঁচে থাকলে আমি তার কাছে জহরতকে পাঠাতে পারতাম। পরেই মনে হল এটাও স্বার্থ-আদায় হয়ে যায়। আর জহরতের জন্য কেন আমি এটা আসলে কারোর জন্যই করতে পারি না। এত বড় মুখ করে তাকে বলেছিলাম যে, কোনো কিছু দিয়ে আমি এর বিনিময় চাইবো না।
তিনি বিদেশে যাওয়ার আগে তার কাছে থাকা আমার সঙ্গে তোলা ফটোর অ্যালবাম আর ভিডিও করা ডিভিডিটা পাঠিয়ে ছিলেন। আমার সঙ্গে তার আমৃত্যু যোগাযোগ ছিল। বহুবার বলেছেন, এমন একটা আলাপ আমাদের হয়নি যেখানে তিন না বলে পারেনি যে, আমি চাইলেই তার বৌ হতে পারি। কিন্তু আমি বলেছিলাম আমি একবারেই লোক হাসাতে পছন্দ করি না। আর আপনিও কি এই বয়সে লোক হাসাতে চান? তিনি বলেছেন, আমার এই একটা জিনিসের প্রতিই টান আছে। এছাড়া আমি কোনো রকম অন্যায় অবিচারের থেকে যতটা নিজেকে দূরে রাখা সম্ভব রেখেছি। একবার মন্ত্রী হওয়ারও সুযোগ ছিল। কিন্তু আমি জানি তাহলেই আমার চূড়ান্ত সর্বনাশ হবে। লোকে বলে আমার তিনটা গুণ। আপনি বলুন তো দেখি আপনার কাছে আমার সেগুলো চোখে পড়েছে কিনা?’
আমি বলেছিলাম; শুনে তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন। এক, আপনা অসাধারণ স্মৃতিশক্তি, দুই যেকোনো নাজুক অবস্থার ভেতরেও পথ বের করার বুদ্ধি; তিন বিরোধীপক্ষের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার সীমাহীন ক্ষমতা এবং চার, লাস্ট বাট নট দ্য লিস্ট ইয়োর সেন্স অব ইরোটিসিজম অ্যান্ড পাওয়ার, ইয়্যু নো হোয়াট আই মিন। আপনি সবমিলিয়ে একটা পাওয়ার হাউস। আরো একটাই প্রধান দোষ আমি কিন্তু এটাকেও গুণ বলব, আপনার কোনো নেশা নেই এক নারীভোগ ছাড়া। কারণ আমরা ধারণা আপনি জীবনে কোনো নারীকে অপমান অসম্মান করেননি। হ্যাঁ, তারা আপনা ক্ষমতার জন্য ভয়ে সম্ভ্রমে বা অর্থের লোভে যা যাই বলি না কেন, আপনাকে সঙ্গ দিয়েছে, আপনি নিঃসন্দেহে তাদেরও খুশি করে দিয়েছেন। তিনি আমার কথা শুনে নিঃশব্দে কাঁদছিলেন। আমি জানতাম তার মনটা আসলে শিশুর মতো কোমল ও সরলও। ক্ষমতা তাকে এত কিছুর পরও কুটিল, শূন্য ও নির্জীব করতে পারেনি। আর আমি তার সঙ্গে এমন সময় পরিচিত হয়েছিলাম যখন তার রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রায় শূন্যে নেমে গিয়েছিল। ফলে আমার তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাকে তিনি খুবই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছিলেন। আমিও বলেছি, আপনাকে চাইলে আমি জীবনের সঙ্গে মিলিয়ে নিতে পারি। কিন্তু এক মানুষের সঙ্গে কেবল বিয়ে দিয়েই জীবনযাপন করা যায় না। যেমন হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ দম্পতি আছে যারা কোনো কিছু নিজেদের মধ্যে শেয়ার করে না। তাদের মধ্যে প্রকৃত অর্থে কোনো সম্পর্কই নেই, লোক দেখানো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক ছাড়া।
তিনি আমেরিকায় গিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় আহত হয়ে পরে মারা না গেলে আমি হয়তো একদিন তারই স্ত্রী হয়েও যেতে পারতাম। কিন্তু নিয়তি তা হতে দিল না। হায় আমিও তাহলে নিয়তি মানি? তার মৃত্যুর খবরের এক সপ্তাহ পর জহরতের পরিচয় পাই। আমি জানি না সেও আমার আরেক নিয়তি হয়ে ওঠে কিনা।
৬. আবু মুহম্মদ ইমরান ও জহরত
তোমার বাবার কোনো স্বপ্নই তুমি পূরণ করতে পারোনি। পারার কথাও ছিল না। নিজের জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখো না কেন, জীবন তোমাকে কী দিয়েছিল আর তুমি জীবনকে কী দিলে। সবাই সফল হবে তা তো নয়। ব্যর্থতা সফলতার যমজ ভাই। আলো যেমন অন্ধকারের যমজ। তুমি সবচেয়ে সোজা ব্যাপারটা বুঝতে পারোনি। এজগত ক্ষমতাবানদের জগৎ। আর ক্ষমতার উৎস হলো অর্থ। অর্থই জীবনের অর্থ তৈরি করে দেয়। সেই অর্থের দিকে তোমার কোনোমাত্র নজর ছিল না। এজন্যই তোমাকে বোকা বলব। যে এই হাওয়ায় টাকা ওড়া জগতেও টাকা কামাতে পারে নাÑ তাকে আমি কোনোভাবেই বুদ্ধিমান বলতে রাজি নই। তুমি দেখে তোমার আসে পাশে তোমার বয়সী ছেলেদের; মেয়েদের পর্যন্ত দেখো। ঘরে তোমার নিজের ভাই বোন রয়েছেÑ তাদের তুমি দেখো। তাদের চেয়ে বয়সেই কেবল তুমি বড়ো, আর ওরা তোমার চেয়ে জ্ঞান বুদ্ধিতে সবদিকে এগিয়ে গেছে। ওরা এগিয়ে গেছে নিজেদের ভবিষ্যতের দিকে, আর তুমি চাইছো ক্রিকেট দিয়ে দেশ জাতি উদ্ধার করতে। তুমি বলতে চাওÑ একবার ক্রিকেটে বাংলাদেশ যদি চ্যাম্পিয়ান হয় তাহলে জাতির আত্মবিশ্বাসটা কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে, ভাবা যায়? তুমি নিশ্চিয় জানো, এক রাজনৈতিক ঝামেলা আর দুর্নীতিটা না থাকলে আমরা কোথায় চলে যেতাম এতদিনে। আমাদের নেতাও নেই, নীতিও নেই। তুমি যেহেতু রাজনীতি করে জাতিকে কিছু দিতে পারবে না। তাই খেলাকে বেছে নিয়েছিলে। তুমি মজা করে বলতে, আসলে রাজনীতিও ক্লাব ফুটবলের মতো হওয়া দরকার। টাকার বিনিময়ে নেতারা কদিন এদলের হয়ে রাজনীতি করবে, কদিন অন্য দলের হয়ে রাজনীতি করবে। এতে করেই আসলে বোঝা যাবে কার কতটুকু দক্ষতা। তাতেই প্রমাণিত হবে কে আসলে সত্যিকারভাবে সাংগঠনিক ক্ষমতা দেখাতে পারে, সত্যিকারে নেতা হতে পারে। ক্লাব ফুটবলের মতো নেতারা এই রকম বিভিন্ন দলের হয়ে রাজনীতি করেন না, কারণ এর মাধ্যমে তারা আসলে তাদের অক্ষমতাটা আড়াল করে রাখেন।
ক্রিকেটের ওপর পড়ালেখা করতে গিয়ে তুমি নাকি জীবনকেই ক্রিকেট মনে করো, আর ক্রিকেটকেই জীবন মনে করো। তোমাকে কেউ ক্রিকেট থেকে সারায়নি। তুমি নিজেরই নিজেকে সরাতে বাধ্য হয়েছো। কারণ তুমি প-িতি মারতে গিয়ে প্রতিপদে সবার জন্য বিব্রতরক পরিস্থিতি তৈরি করেছো। তারা যদিও তোমাকে তাদের সঙ্গে রেখেছিল। এত দিন ওদের হয়ে কাজ করলে ওরা তো তোমাকে চাইলেই ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিতে পারে না। তাই দয়া করে তোমাকে কিছুদিন উপদেষ্টাও রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু তুমি নিজেও বুঝতে পারলে সেখানেও তুমি কতটা অপাঙক্তেয়। তুমি চেয়েছিলে এমন এক ক্ষমতা অর্জন করতে যা আসলে কেউ দেখবে না, কেবল কাজের সময় তোমার কথা শুনে নির্দেশনা পেয়ে বুঝতে পারবে, কতটা ক্ষমতা আছে তোমার কথায়, তোমার নির্দেশনায়।
তুমি জানো ‘নলেজ ইজ পাওয়ার’ এই কথাটা বেকেন বলেছিলেন স্প্যানিশ ও ভেনিসীয় বাহিনী কাছে মুসলমানদের পতনের পর। আর সেই পরাজয়ের পর থেকে যতদিন গেছে মুসলমানেরা জ্ঞানের সেই ক্ষমতার দিক থেকে দূরের সরে এসেছে। তোমার দেশে হাস্যকর ভাবে ‘নলেজ ইজ পাওয়ার--এর বাংলা করা হয়েছে ‘জ্ঞানই শক্তি’। অথচ হবে ‘জ্ঞানই ক্ষমতা’। ‘জ্ঞানই শক্তি’ রীতিমতো-যে অস্পষ্ট একটা কথাÑ কেউ কোনো দিন ভেবে দেখলে না? এই শক্তি কীসের শক্তি? ‘জ্ঞানই শক্তি’ হলে তা হয় ‘নলেজ ইজ এনার্জি’। এনার্জিটা শারীরিক শক্তির সঙ্গে যুক্ত। জ্ঞান তো শারীরিক শক্তি বাড়ায় না। কিন্তু তুমি জ্ঞানকে জানছো এনার্জি হিসেবে। অথচ জ্ঞান যে ক্ষমতা বাড়ায়, যে চিন্তার ক্ষমতা বাড়ায়, যে চিন্তার জোরে মানুষ তার কঠিন জীবনের পথে এগুতে পারে, জ্ঞানের মাধ্যমে যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিগত সব রকমের ক্ষমতা বাড়ানো যায়, সেই জ্ঞানের কথা আমরা কেউ ভালো করে কোনোদিন ভাবিনিÑ যেসময়টা সত্যিকার অর্থে আমাদের মগজে সেটা ঢুকতে পারার কথা ছিল। আর এখন তো জ্ঞান মানে ক্ষমতাও না, জ্ঞান মানে টাকা। অথচ টাকাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে যে জ্ঞান তা আমারা জানি না, তুমিও জানোনি। এতদিনে তুমি হন্যে হয়ে উঠছো নিজের একটা কিছু করার জন্য। কিন্তু তুমি জানো না, হয়তো তোমাকে ফের ক্রিকেটেই ফেরা লাগে কিনা। অবশ্য তুমি মনে করেছো কিছুদিন চেষ্টা করা যাক। যদি না পারি তো ফের ব্যাক টু দ্য প্যাভেলিয়ন। আর নইলে ফ্যা ফ্যা হয়ে রাস্তায় ঘোরো।
তুমি তো কোনোদিন বোহেমিয়ানও হতে পারবে না। একজন বোহেমিয়ান হওয়াও কঠিন ব্যাপার। তুমি জানো না তোমার বাবা তোমাকে বলেনি যে, তিনি এক মারাত্মক বোহেমিয়ানকে দেখেছিলেন। সাবদার সিদ্দিকী নামের ওই লোকটার জন্ম কলকাতায়। তিনি বলতেন, ‘এই সাবদার সিদ্দিকী ঘরে ছেড়ে বেরিয়ে আসার সময় বাবা-মার কাছ থেকে এক নিজের নাম ছাড়া আর কোনো কিছুই সঙ্গে নিয়েই আসেনি।’ ঢাকার মতিঝিল থেকে আলিয়া মাদ্রাসা আর চানখারপুল থেকে শাহবাগ, খুব বেশি হলে এলিফ্যান্টরোড নিউমার্কেট ছিল তার ঘুরে বেড়ানোর জায়গা। থাকতেন রাস্তায়। পরতেন চট মানে ছালা কেটে, দুপাশে দুই হাত গলিয়ে আর গলা গলিয়ে। কথা বলতেন নদীয়া-শান্তিপুরীর ভাষায়। আর চোস্ত ইংরেজিতে। অনেকটা সময় কেটেছে রাতের বেলা মতিঝিলের নির্মাণাধীন একটা ভবনের দোতলায়। সেখানে রাতে থাকতেন আর সকালের হাগামোতা করতেন পূর্বাণী হোটেলের টয়লেটে। একবার তাকে হোটেলের লোক আটকলে তিনি এমন ইংরেজি বলা শুরু করেন যে সবাই ভড়কে যায়। পঞ্চাশ সালের দিকে এক উকিলের ঘরে জন্ম। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার সময় তারা বাবা-মা কলকাতা থেকে সেই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানে আসতে বাধ্য হন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে বাবা-মা ও পরিবার আবার কলকাতায় ফিরে যায়। তিনি ফিরে না গিয়ে যুদ্ধে যোগ দেন। পরে আবার নিজেও কিছুদিন কলকাতায় কাটিয়ে এলেও ১৯৭২ সালে তিনি চিরদিনের জন্য বাংলাদেশে চলে আসেন। একবার বর্ডারে তার পাসর্পোট চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘আই ডোন্ট বিলিভ ইন পাসপোর্ট।’ তাকে বলা হয় যে, তাহলে তো আপনাকে জেলে ঢুকতে হবে। তখন তার উত্তর ছিল, ‘সারা পৃথিবীটাকেই তো আমার জেলখানা বলে মনে হয়, আপনারা আমাকে নতুন করে কোন জেলখানায় ঢোকাবেন।’ কোনোদিন তার পকেটে কোনো টাকাপয়সা থাকতো না। বন্ধুও কিছু জুটেছিল। এদের ভেতরে কয়েকজন ছিল টাকাওয়ালা বন্ধু। তাদের কারো কারো কাছে টাকা নিয়ে দিন চলতো। কোনো কোনো সময় কোথাও কোনো মেসে থাকতেন। দেখা যেত কারো কাছে কোনো টাকা নেই। তখন সকালে উঠে আর সাবদারকে পাওয়া যেতে না। আর দেখা যেত কারো একটা ঘড়ি নেই। একসময় বাজার করে ফিরল সাবদার সঙ্গে তরিতরকারি আরো মাছটাছ। ‘এই যে বঙ্গপুঙ্গবরা, উঠুন। উঠে এসবের ব্যবস্থা করুন।’ পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির ওই মানুষটা জগতের কোনো কিছুকে সামঝে চলতো না। রাস্তা ঘাটেও চলাচল ছিল ড্যাম কেয়ার। বলতেন, ‘মানুষকে কেয়ার করার কী আছে। বরং গাছকে কেয়ার করবো। মানুষের সঙ্গে বাড়ি খেলে সে সরে যাবে, বা পড়ে যাবে, কিন্তু গাছের সঙ্গে বাড়ি খেলে তো আমি পড়ে যাবো। প্রকৃতিকে কেয়ার করুন। নইলে আপনি পড়ে যাবেন। মানুষ মনে করেছে প্রকৃতির সঙ্গে টক্কর দিয়ে পারবে, আসলে তো পারবে না। মানুষের সঙ্গে আপোসের কিছু নেই। কিন্তু প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সমঝোতায় আসতেই হবে। নইলে আমরা বিলুপ্ত হয়ে যাবো।’ সারাক্ষণ মার্কস লেলিন, বিপ্লবÑ এসবের কথা। রাজনীতি ও সাহিত্যের কথা মুখে খৈয়ের মতো ফুটতো। ঢাকা শহরে যেখানে লাইব্রেরি ছিল আর যেখানে দেশিবিদেশি পত্রিকা থাকতো, নিউ ইয়র্ক টাইমস, ল-ন থেকে আসাপত্রপত্রিকা, রাজ্যের ইংরেজি ম্যাগাজিন আর ইন্ডিয়ার কোনো ইংরেজি সপ্তাহিক, সব পড়া হয়ে যেত। বাংলা পত্রপত্রিকা তো একটাও বাদ যেত না। জগতের হেন বিষয় ছিল না যে যা নিয়ে তিনি কথা বলতে পারতেন না। দর্শন থেকে পোষাকের ডিজাইন ফ্যাশান পর্যন্ত সব কিছু তার আগ্রহের বিষয়। চোখে গোল্লামার্কা চশমা। কাঁধ ছাপানো চুল। হো চি মিনের মতো দাড়িটা থুতনির নিচে ঝুঁটি বাঁধা। এছাড়া মুখে গালে খোঁচাখোঁচা দড়িগোঁফ। কোটরগত চোখ, গাল। ময়লা গা। গোসল নাই। কোনো যতœ নাই। খাওয়া দাওয়ার তো কোনো ঠিক নাই। মদ মিললে মদ, গাঁজা পেলে গাঁজা আরো কোনো নেশার সুযোগ পেলে করতেন। এর ভেতরে সিফিলিসও হয়। চানাচুর বা মুড়ি মাখানো সবার জন্য মাখানো হলে, তিনি নিজেরটা আলাদা করে বলতেন,‘আপনাদের কার কী অসুখ আছে, কে জানে? আমি আমার মতো এই টুক আলাদা করলাম।’ আসলে তার নিজের অসুখ যাতে কারো মধ্যে সংক্রামিত না হয় এজন্য এটা করা। কোনো রিক্সা করে শাহবাগ নেমেছে, রিক্সাওয়ালা ভাড়া চাইতে গেলে তাকে বলেছেন, ‘শোনো গত কয়েক বছরে আমি একটি টাকাও কামাই করিনি। তোমার যদি টাকার দরকার হয় তো ওইখানে আমার বন্ধুরা আছে, তাদের কাছে গিয়ে আমার নাম সাবদার সিদ্দিকী বলো। তারা তোমাকে ভাড়াটা দিয়ে দিবে। আর যদি না দেয়, তাহলে দয়া করে তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করো না।’ Ñ এইভাবে তার দিন চলতো কোথাও গিয়ে চা বিস্কুট খেয়েও একই কথা। তার কাছে টাকা নাই দিবে কোথা থেকে। বন্ধুরা এলে তাদের থেকে যেন দাম নিয়ে নেয়। সেই সাবদারকে ১৯৮৪ সালের পর থেকে আর পাওয়া যায়নি। সে বেঁচে আছে না মরে গেছে নাকি সে আবার কলকাতা চলে গেছে তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না।
তোমার বাবা মেডিকেল কলেজের ওখানে তাকে দেখেছেন। তার এক বন্ধু অদ্ভুত এক মানুষ দেখতে নিয়ে যাবে বলে তার কাছে নিয়ে গেছে। তোমার বাবা তারপর কিছুদিন তার পিছে পিছে কাটান। তার কাছে কবিতা শোনেন। সাহিত্য আর রাজনীতির কথা শোনেন। এরকম লোক দেখলে আগে তোমার বাবার ‘তুমি কি দেখেছো কভু/ জীবনের পরাজয়’ গানটা মনে পড়তো; কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতেন, সাবদারকে দেখে সেটা মনে করারই কোনো মানে নেই। সুযোগও ছিল না। মনে হত, ওই ছোট মানুষটা আকাশ ছোঁয়া পাথরের পাহাড়ের মতো অজেয়। কিছু দিয়ে তাকে বশ করা যায় না। তোমার বাবার চূড়ান্ত বোহেমিয়ানগিরি করা এই লোকটাকে দেখা ছিল। তুমি তো তার চোখে সেই ভবঘুরে হয়ে ওঠার সীমাও পার হতে পারো না। তাহলে তুমি কী করতে পারো? আসলে তো তুমি ভবঘুরে হয়ে উঠতে পারবে না। তুমি ছোটবেলা থেকে নিয়ম মেনে চলেছো। তোমার বাবা তোমাকে ছোটবেলায় ক্রিকেট ব্যাট বল উইকেট কিনে দিয়েছিলেন। বাড়ির সামনের ছোট একটা মাঠে সকাল বেলা তোমাকে নিয়ে গেছেন। তুমি আর তিনিই ছিলেন ক্রিকেট খেলার দুই প্রতিপক্ষ। আজ সত্যিকারভাবে তুমি ও তিনি জীবনের দুই দিকে। প্রতিপক্ষ না হলে তিনি তোমার পক্ষে নন। তোমার খুব জানতে ইচ্ছা করে তুমি যদি তার একমাত্র সন্তান হতে তাহলে তিনি কী তোমার প্রতি এমন উদাসীন হতে পারতেন? হয়তো পারতেন। কারণ তিনি মায়ের প্রতিও উদাসীন ছিলেন। তোমার বাকি দুটো ভাইবোনোর সঙ্গেও যে তার খুব খাতির ঘনিষ্ঠতা তাও তো নয়। তিনি আসলে নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তিনি যে ধারার মধ্যে দিয়ে জীবনকে বইয়ে নিয়ে গেছেন সেখান থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব ছিল না। তুমি এখন তোমার আগের জীবনের মূল খাত থেকে সরে এসে এমন একদিকে যেতে চাইছ যে, দিকটা সম্পার্কে তুমি আসলে কিছু জানো না। আর তুমি জানো না যে সারাবান তহুরাই-বা তোমাকে আসলে কোন দিকে নিয়ে যেতে চায়। তার সম্পর্কেও তুমি তেমন কী জানো? তোমার মানুষ সম্পর্কে জানার আগ্রহ কোনো কালেই তেমন ছিল না। সারাহ্ যেটার ঠিক উল্টো দিকে। তার নিজের জীবনের পেছনের পট কেবল শূন্যতা দিয়ে ভরা। সে হয়তো এজন্য সেটি নানান ভাবে পূর্ণ করে নিয়েছে। এই এলাকার ক্ষমতাবানসহ দেশের নানান ক্ষেত্রের ক্ষমতাবানদের সঙ্গে তার রহস্যময় সম্পর্ক আছে বলে যে রটনা আছে, সেটি তাকে আসলে এক রকম রক্ষাও করে। সেই সঙ্গে তার নিজের যোগ্যতা অসাধারণ অঙ্ক করার ক্ষমতা। তোমাকে সে বলেছে, সে লজিক্যাল মিথ বা মিথিক্যাল লজিক দিয়ে চলে। তুমি এই কথা দুটোর মানেই খুঁজে পাওনি। মিস্টিক্যাল রিয়ালিজম বা রিয়ালিস্টিক মিস্টিসিজম নিয়ে তার দর্শন। এসব কথার কি মানে? তিনি ভোরে উঠে রবীন্দ্রনাথ পড়েন। পড়েন রাসেলের লেখা। এই দুজনকে পড়তে পারলেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মূল সুরটা নাকি বোঝা হয়ে যায়। তুমি এইসব তেমন বোঝো না। তুমি আসলে কী বুঝতে? ক্রিকেট? তা তো একটু বেশি বুঝতে। জীবনেরও আলাদা একটা খেলা আছে, সেটা তুমি ক্রিকেট ফুটবল যা খুশি ভেবে নিতে পারো। জীবন জীবনই তার সঙ্গে আর কোনো কিছুর মিল চলে না। সারাহ্ তোমাকে বলেছে, সে বই পড়ার চেয়ে বেশি পড়ে মানুষ। পড়ে চুপচাপ, কেউ যাতে টের না পায়। কেউ যদি টেরই পায় তাহলে তো সে তোমাকে পড়তেই দেবে না। পড়তে দিলেও সে এমন সব কা- করবে যে তাকে তোমার যতটা ঠিক পড়া হবে তারচেয়ে ভুল পড়া বেশি হবে। মানুষতে তো পড়ার ব্যাপার আছে আর পড়ার যে বইপত্র এই যেমন রবীন্দ্রনাথ-রাসেলÑ তাদের কি ঠিক করে পড়া হয়? যারা এখন মৃত, বরং জীবিতরা তাদের চেয়ে মৃত, আর তারা জীবিতদের চাইতেও জীবিত, অতিজীবিত। তিনি এই দুয়ের একটা মিশ্রিত বোধের মানুষ হতে চান। সারাহ্ রবীন্দ্রনাথের সাত্ত্বিকতা আর রাসেলের জ্ঞান, প্রেম, মানবতাবাদ ও জৈবকামনার একটা ভারসাম্য তৈরি করতে চান। তার কোনো সংস্কার নেই। কোনো কিছু নিয়েই নেই। শরীর নিয়ে তো নয়ই, কিন্তু তার মানে এই নয় যে, তিনি আধান্যাংটা হয়ে ঘুরে বেড়াবেন আর রাজ্যের লোকের সঙ্গে, বাছবিচারহীনভাবে মেলামেশা করবেন। তিনি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, মেয়েদের নিয়ে তুমি কী ভাবো। তুমি উত্তরে বলেছিলেন, আসলে মেয়েরা যে আলাদা কোনো কিছু সেটাই তো তুমি খেয়াল করোনি। তোমার জীবন থেকে তারা ¯্রফে নাই হয়ে গিয়েছিল। এক মা ছাড়া তোমার সঙ্গে খুব কম মহিলা বা নারীর কথা হয়েছে। কথা মানে তো ভালো আছেন, দেখা হলে আলাপ, কোনো নারীর সঙ্গে কোনো দিন কোনো আলাপ হয়নি। তারা তোমার কাছে একটা শব্দমাত্র ছিল। তোমার জীবনে তাদের কোনো প্রয়োজন ছিল না। নারীর প্রতি টান বা কামনাবাসনা যাই বলা যাক না কেন, তুমি প্রায় কামহীন মানুষে পরিণত হয়ে গেছ। আসলে মনে হয় এই বিষয়টিই তোমার নেই। এমনকি তোমার ঘুমের ভেতরেও তারা আসে না। ক্লাস সেভেন এইটে পড়ার সময় মনে হয় এই সমস্যাটা হতো। কিন্তু সেটা সেটা তোমাকে বিপর্যস্ত করতে পারেনি। হয়তো তোমার সঙ্গটা ভালো ছিল। যাদের সঙ্গে ক্রিকেট নিয়ে সেই যে বেড়ে ওঠা তারাও ক্রিকেট ছাড়া আর কিছু বোঝেনি। সত্যি বলতে কি তোমার প্রজন্ম থেকেই বাংলাদেশের ক্রিকেট একটা নতুন জীবন পেয়েছে। তুমি চেয়েছিলে সেই নতুন জীবনের নদীতে ¯œান করতে। সেটা হতে হতেও হয়নি। আর সেখান থেকেই তোমার সমস্যা তৈরি হল। তুমি বুঝতেই পারোনি, এটা জ্ঞান-যুক্তি-চর্চার দেশ নয়। এটা হল, স্বভাববৈশিষ্ট্যে চলা মানুষের দেশ। তাও সেই স্বভাব একেবারে যে ‘অব্যবস্থায়পূর্ণ-ব্যবস্থা’ এখানে দীর্ঘদিন ধর বজায় রাখা হয়েছে সেটারই একেকটা প্রোডাক্ট একেকটা মানুষ। নিজের মতো খুব কম লোক এখানে কিছু হয়ে উঠতে পারে। আর যাদের মনে করা হয় তারা হয়ে উঠেছে, তারা ওই বজায় রাখা ব্যবস্থার ভেতরেই হয়ে ওঠে; সেটাকে ভেঙে নতুন করে গড়ে তোলার দিকে তারা যায় না। তারা কোনো ঝুঁকি নিতে যায় না, চায় না। কারণ তারা ভালো করে জানে এখানে ঝুঁকি নিলে জীবনটাকে ¯্রফে ফুকে দেওয়া হয়। এটাই হল এখানকার সত্য ও এখানকার বাস্তবতা। সারাহ্ বলে, জীবনকে সেটা কারো জীবনকে জীবন করে তোলার জন্য জীবনের কোনো একটা পর্যায়ে অল্প সময়ের জন্য হলেও তীব্র একটা প্রেম দরকার। সেটা কোনো বিষয়ের বা বস্তুপ্রেম নয়। নারীর জন্য পুরুষের প্রতি প্রেম, পুরুষের জন্য নারী- প্রেম। যেমন তোমার ক্রিকেট প্রেম ছিল, তা স্বাভাবিক হয়ে উঠত যদি তোমার নারীপ্রেম সঙ্গে থাকতো। কিন্তু তুমি নারীর কথা কখনো ভাবোইনি। এটাই বরং অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের প্রায় বেশির ভাগ কিশোর বয়স থেকে প্রেম নামে যা বোঝে তা তো একটা বায়বীয় ব্যাপার, নয়তো একেবারেই শরীরীটান। এটা তাদের আরেক সর্বনাশের দিকে নিয়ে যায়। প্রেম সম্পর্কে ধারণা ও সিদ্ধান্তই হল জীবন সম্পর্কে ধারণা ও সিদ্ধান্ত। কী বিশ্বাস করো না তুমি? এজন্যই আসলে তোমার নিজেকে নিয়ে তোমার এত সমস্যা। তোমার বিশ্বাস, তোমার আনন্দ, তোমার কর্ম, তোমার সৃষ্টিÑ কোনোটাকেই তুমি বুঝতে পারবে না যদি নারীর সঙ্গে না নিজেকে যোগ করো। এই যোগ মানে একবারে আত্মিকনৈতিকশারীরিক সংযোগ। তোমাকে দোষ দিয়ে কী লাভ। বেশিরভাগ লোকই এর থেকে দূরে। তাদের জানার গ-ির অনেক দূরে দূরে এর অবস্থান। ব্রিটিশরা যখন এদেশে এসেছিল তাদের নাকি মনে হয়েছিল, এখানে সব চিন্তাহীন মানুষের বাস। এরা এক কি লক্ষÑ তাতে কোনো কিছু আসে যায় না। গরুভেড়ার পাল যেমন। ইচ্ছা করলেই দখল করা যায়। কে যেন বলেছি ব্রিটিশরা এদেশের মানুষকে মনে করেছিল ইটের পাঁজা। অবশ্য এদেশের মানুষকে দোষ দিয়ে কী হবে। যেদেশে রাতে বীজ ছড়িয়ে দিলে দিনে গাছ গজিয়ে যায় সে দেশে কোন বোকাটা খাটতে যাবে। সে দেশের মানুষ চিন্তা কেন করবে? সাবদার সিদ্দিকী এজন্যই বলতো, চারদিকে গরু ভেড়া ছাগল মোষ, দেন হোয়াট ইজ ইয়োর প্রেবলেম? তোমার বাপের সঙ্গে তার একটি কথাই বিনিময় হয়েছিল, এই যে আপনি ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করেন না, নিজের কোনো যতœ নেন না, এটা তো নিজেকে এরকম শেষ করে দেওয়া। সাবদারের উত্তর ছিল, ‘মানুষ তো শেষ হতেই আসে। এর শুরুটাই হয় জন্মের ভেতরে দিয়ে। জন্ম মানেই সঙ্গে মৃত্যুরও জন্ম। আর আমি না খেলেও আগামীকাল সূর্য উঠবে, আমি না নাইলে আগামীকাল সূর্য ডুববে।’ তোমার ভেতরে এই রকম একটা ভেতরগত ভবঘুরে আছে মনে হয়। আসলে যে লোক নিজেকে বাদ দিয়ে কোনো কিছু নিয়ে মেতে ওঠে এরা প্রত্যেকেই এক ধরনের ভবঘুরে মানুষ হয়ে ওঠে। তাদের কোনো ঘর থাকে না। এই তোমার কথা যদি কেউ জানে এবং লেখে সেই লোকটাও আসলে ঘরহীন মানুষ। তুমি জানো না, কিন্তু যারা জানে তার বুঝতে পারবে দারুণ ইন্টারেস্টিং উপন্যাস হতে পারে সাবদার সিদ্দিকীকে নিয়ে, কারণ তার সঙ্গে দাঙ্গাদেশভাগ ও মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধপরবর্তী বাংলাদেশেটা এমনভাবে এসেছে যা আর কারো জীবনেই আসেনি। তিনি ‘ডেথ অব রিকার্ডো রাইসে’র ফারনান্দো পেসোয়ার মতো বিশ্বখ্যাত কবি না হলেও যে ভবঘুরে আমরা আমাদের জীবন থেকে খুঁজে নিতে পারি সে সাবদার হোক আর যেই হোক, তাদের সঙ্গে তোমারও কোথাও একটা মিল রয়েই গেছে। তাই না?
৭. গতিমুখ
মাথার ভেতর কে কথা বলে? সারাক্ষণ এত বক বক! এই স্বরটা বন্ধ করা দরকার, এর টুঁটিটা টিপে ধরা দরকার। জহতর বা সারাবান তহুরা হয়তো জানে যে শুরুতেই আসলে এ সুযোগটা তৈরি করে নিতে হয়। আর একবার সুযোগটা হারালে আর আসে না। এখন আসলে কাজের কথায় আসা যাক। অ্যাকশান না হলে তো উপন্যাসটাই শুরু হবে না, বা শুরু হলেও থেমে রইবে। ধরা যাক জাহাজ ডুবি হওয়ার পর একটি লোক সাঁতার দিয়ে যে উপকূলে পৌঁছাতে যাচ্ছিল সে দেখতে পেল পুরো উপকূলজুড়ে দাউ দাউ আগুন জ্বলছে। তখন তার কেমন মনে হবে? যার কোনো দিন জাহাজ ডুবি হয়নি, যে কোনোদিন এরকরম জ্বলন্ত উপকূল দেখেনি, তার কী করে সেটা বোঝা সম্ভব? হ্যাঁ সম্ভব। আপনি পাঠক তো কল্পনাই করতে পারেন যদি এই রচনাটির এত দূর পর্যন্ত এসে থাকেন। কয়জনের সঙ্গে দেখা হল আপনার? জহরত, সারাবান তহুরা আর ডাক্তার আবু ইমরান। মিল্লাত সাহেবের কেবল একটা দিক দেখেছেন যে দিক আসলে কেউ দেখাতে চায়নি, কিন্তু সারাহ্র মতো তলে তলে অনেকেই সেটা জানে। তাই তার জানা জিনিসগুলি এখানে আর নাইবা বলা হল। কারণ তাকে নিয়ে ওই ঢাউস স্মারকগ্রন্থে চাইলে সবাই সেসব পড়তে পারবে। তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে প্রচ- গরমের দিন গামছা পরে বসে আছেন রাতের বেলা। অপেক্ষা করছেন মেয়েটা কখন আসবে। এই দৃশ্য তো সেখানে পাওয়া যাবে না। আমাদের সারাবান তহুরা অবশ্য সেটি দেখেছে। তিনি ওই বিশেষ সময়ে বরাবরই গামছা পেঁচিয়ে রাখতেন কোমরে। কারণ তাতে ঘামমোছাটা যেমন হতো, পরে আরামও হতো। আর সহজেই খোলা ও পরাও যেত। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি, একজন মানুষ যে ক্রিকেট নিয়ে জীবন পার করবে বলে মনে করেছিল, সে হঠাৎ এসে দেখলো ক্রিকেট নিয়ে জানার আগ্রহ তাকে এ সম্পর্কে যত জ্ঞানী করে তুলছে, ততই সে অন্য সবার সঙ্গে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, অন্যরা তাকে আর নিতে পারছে না। এই নিতে না পারার জন্য আসলে অন্যরা তো দায়ি নয়, সে নিজেই দায়ি। কোনো অভিমান থেকে নয়, যখন কোনো কিছু একটা জায়গায় খাপ খায় না, সেটিকে তো সরে যেতেই হয়। বা খসেও যেতে হয়। তো সেজন্য সে খসে গেছে। আমরা কী করলাম, তার খসে যাওয়াটাকে অন্যদিকে নিয়ে গিয়ে দেখতে চাইলাম সেখানে আসলে সে কতটা খাপ খাইয়ে নিতে পারে। সেখানে সে তাকে নিয়ে যাওয়া হল একটি চাকরির ভাইভা বোর্ডে, সেখানে তার সঙ্গে দেখা করানো হল, বা তাকে দেখলে সারাবান তহুরা নামের এক নারী, যার জীবন খুব স্বাভাবিক নয়। আসলে এখানে তো আপাতভাবে কোনো স্বাভাবিক লোক তো নেই। পার্শ্বচরিত্র হিসেবে সেই প্রিন্সিপাল আছেন, তাও খুবই অল্প সময়ের জন্য, তাকে আমরা স্বাভাবিকই বলতে পারি। আসলে জহরতকে যে সেই প্রতিষ্ঠানে নেওয়া হবে না এটা তাকে দিয়ে বলানো। সারাহ্ চেয়েছিল তাকে কোথায় একটা ব্যবস্থা করতে। সেই চেষ্টাই আসলে সে এখানো করতে চায়। তার যে তিনটা বর পাওয়া হয়েছিল, সেখানে একটা বর সে জহরতকে কোনো একটা কাজে ঢুকিয়ে দিতে পারলে খুশি হতো। জহরতের বয়স এখানো ত্রিশ হয়ে যায়নি। এখনো তার সরকারি চাকরির বয়স আছে। এটা তাকে নতুন করে বার বার মনে করবে সারাবান তহুরা। অন্য দিকে তার বাবার ভূমিকা এবং আশঙ্কা ছিল ছেলে না জানি ভবঘুরে লোকে পরিণত হয়ে যায়। তার চোখের সামনে ঢাকা শহরের সবচেয়ে ইন্টেলেকচুয়াল ভবঘুরেদের একজন সাবদার সিদ্দিকীর নমুনা ছিল। একজন সাবদার সিদ্দিকী হওয়াও তো কঠিন। তার পুত্রকে নিয়ে তার নিজের আর কোনো পরিকল্পনা নেই। একটা পর্যায়ে সবকিছুকেই ছেড়ে দিতে হয়, তিনি তার আগে থেকে তাদের ছেড়ে দিয়েছেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি আরো বেশি নিজের কাজের ভেতরে ডুবে যেতে চাইছেন। জহরতের ভাইবোন দুটোকে আমরা এখানো দৃশ্যপটে আনিনি। মনে হয় না আনার দরকার পড়েব। কারণ তারা অনেকটা স্বাভাবিক চরিত্র অন্তত এই উপন্যাসের তাদের তেমন কোনো সংকটে পড়তে হয়নি। পরবর্তীকালে তাদের জীবনে প্রেম এলে বা তারা জীবিকায় যদি সংকটে পড়ে, জীবনের গভীর কোনো প্রশ্ন যদি তারাও বোধ করেÑ তাহলে হয়তো তারাও আমাদের লেখার বিষয় হয়ে উঠতে পারে।
৮. সারাহ্ , জহরত এবং আমান ডেভিড
জহরত আর সারাবান তহুরা আগে মুখোমুখি দুটো সোফায় বসে থেকে কথা বলতো। ‘অতএব চিহ্নে’র মতো সারাহ্র বসার ঘরে মুখোমুখি দুটো সেফার মাঝখানে লম্বা তিনজনের মতো বসতে পারে সোফাটা। তার সামনে একটা টিটেবিল। এখন তারা ট্রিপল সেই সোফায় বসে। এই তো সেদিন জহরত এসে সিঙ্গেল ওই সোফাটা, যেটাতে বসলে মাঝে টিটেবিল আর তার পাশে তিনজনের বসার মতো সোফা রেখে, অন্য দিকে যে সিঙ্গেল সোফাটা ছিল, যাতে বসতো সারাহ্, তাতে মুখোমুখি হতো। বেশ দূরত্বে চলত কথাবার্তা। সেই মুখোমুখি বসতে মনের ভেতরেই একটা অস্বস্তি থেকে নিজের অজান্তেই জহরত ওই ট্রিপল সোফাটায় বসে, তখন কি একবারও ভেবেছিল যে সারাহ্ এসে সেই সোফায় তার পাশে অবলীলায় বসে পড়বে? একথায় সে কথায় তার বাহুতে আঙুলের খোঁচা দেবে বা তার ঊরু স্পর্শ করবে, কখনো ঊরুতে হাত রেখে আর হাত সরাবেই না? এবং কখন ‘আপনি’ থেকে ‘তুমি’তে নেমে যাবে, সেটাও সে খেয়াল করেনি। আর যখন খেয়াল করতে যাচ্ছিল ততক্ষণে সারাহ্ তার আগের গম্ভীরভাবওয়ালা কথাবার্তা থেকে সরে গিয়ে নতুন একটা মানুষ হয়ে উঠবে। জহরত তাকে বলবেও যে,‘আপনি তো গিরগিটির মতো। এত রঙ বদলাতে পারেন।’
সারাহ হেসে গড়িয়ে বলে, ‘আমি তো তোমাকে ধোঁকা দিতে চাই না, রঙ খেলিয়ে কাছে টানতে চাই।’ বলে এমন হাসিতে ভেঙে পড়বে যেভাবে আর কখনো সে তাকে হাসতে দেখেনি। সারাহ্কে এই প্রথম তার ছেনাল ছেনালও মনে হবে। জহরত নিজেও তো একটা ঢ্যামনা হয়ে গেছে।
‘তুমি কী খেতে পছন্দ করো।’
‘আমি আসলে যেকোনো কিছুই খাই। আলাদা করে আমার তেমন পছন্দ নেই। কেন বলেন তো?’
‘আজকে রাতে তুমি আমার সঙ্গে খাবে।’
‘এখন কটা বাজে?’
‘কেন তোমার কোনো কাজ আছে।’
সারাহ্ আগেরমতো সাদা শাড়ি পরা। হাতে সাদা বালা। কানে সাদা দুল। গলায় সাদা মালা। সাদা ব্লাউজের ভেতরে থাকা সাদা ব্রার স্ট্রাইপ আর ধারগুলোও স্পষ্ট ছিল সেদিন বেশি। পুরো ঘরটা যেন অন্য রকম হয়ে গিয়েছিল। জহরত কীসের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছিল। মৃদু ঝাঝালো। কোথা থেকে অসছে সেই গন্ধ। এই গন্ধ তার একেবারেই অপরিচিত। একবার সে বলেওছে,‘কীসের যেন একটা গন্ধ আসছে?’
‘কই আমি তো পাচ্ছি না। আচ্ছা আমার মুখ থেকে আসছে না তো। দেখো তো।’ বলে সারাহ্ জহরতের খুব কাছে ঘেঁষে মুখ এগিয়ে নিয়ে যায়। চোখ বন্ধ।
‘কী হলো, দেখো।’
‘দেখলাম তো, কোনো গন্ধ নাই।’
সারাহ্ কিছুক্ষণ জহরতের মুখের খুব কাছে মুখ নিয়ে হাঁ করে থাকে। তারপর ভেতরে ভেতরে দমে গিয়েও স্বাভাবিকভাবে আবার সোফায় বসে পড়ে। জহরত যে একেবারে বুঝতে পারেনি, তাতে তো না। কিন্তু তার কোনো রকমের ইচ্ছা হয় না।
সারাহ্ বসেই বলে, ‘আমি তোমার বাবার সঙ্গে দেখা করেছি।’
‘বাসায়?’
‘না, চেম্বারে।’
‘কী নিয়ে?’
‘ভুয়া জিনিস নিয়ে।’
‘এখন তো তিনি আর অপারেশান করেন না। তার জুনিয়াররা করে। সার্জানদের সময় তো অল্প সময়। অল্প সময়েই যা কামানোর কামিয়ে নিতে হয়। আমার বাপ মনে হয় ভালোই কামানো কামিয়ে ছিল।’
জহরত আলাপগুলিও কোনো সময় প্রেম ভালোবাসা জীবনের তৃপ্তি অতৃপ্তির দিকে নিয়ে যেতে চায় না। তার ঘুরে ফিরে একটাই কথা কী করবে সে। কী করবে তা জানে না, কেবল জানে সে আত্মহত্যা করতে পারবে না। সেটা পারবে না, এই কারণে নয় যে আত্মহত্যা করলে পাপ হবে। বরং সেটা করার কোনো মানেই পায় না।
সারাহ্ বলেছিল, ‘তাহলে একটাই কাজ করা যায়।’
‘কী সেটা?’
‘অপেক্ষা করা, কিন্তু এমন একটা কাজ করা যা তোমার কোনো কাজে আসুক বা না আসুক, সেই কাজটা চালিয়ে যাওয়া আর তখন একটা জিনিসই মনে রাখা যেÑ লেট ইট বি। বি রিয়ালিস্টিক বাট প্ল্যান ফর দ্য মিরাকেল।’
‘আপনি মিরাকেলে বিশ্বাস করেন।’
‘কেন করব না? জীবনটাই তো মিরাকেল। জন্ম থেকে এর শুরু। তাই না। আমি তো এদেশে না জন্মে আফ্রিকার গহীন কোনো বনেও জন্মাতে পারতাম বা জন্মাতে পারতাম আমেরিকায় বা ব্রাজিলে।’
‘এই দেশে জন্মে কী আপনি খুশি?’
‘একেক সময় একেক রকম মনে হয়। ঠিক বুঝতে পারি না। তবে কী জানো যেখানেই থাকি ফিজিক্যালি যদি ও.কে থাকি, অসুখবিসুখমুক্ত থাকতে পারিÑ তাহলেই আমি খুশি।’
জহরত আগে কখনো বলেনি। সেদিন বলে, ‘আচ্ছা, আমান ডেভিডের ব্যাপারটা কী?’
সারাহ্ ভেতরে একটু চমকে ওঠে। যদিও সে চমকে ওঠাটা আড়াল করতে পারে। সারাহ্ জানে তার সবচেয়ে বড় গুণের একটা হলো, সে তার সব রকম অনুভূতি চাইলেই আড়াল করতে পারে। আবার সময় মতো রাগের অভিনয় করতে পারে। কান্নার অভিনয়ও করতে পারে। এই অভিনয়ের সময় সে আবার ভেতরে ভেতরে হাসে। আমান ডেভিড তাকে মাত্র একবারই ধরে নিয়ে গিয়েছিল। অনেক ভয় দেখিয়েছিল। এসিড মারবে। এই করবে, সেই করবে। কিন্তু কেবল কথাই। সারাহ্ ভেতরে ভেতরে ঠিক বুঝতে পেরেছিল, তার মুখটা, তার শরীরটা আমানের চোখে যত শান্তি দেয় জগতের আর কোনো কিছু দেয় না। সারা ঘরে সারাহ্র নানান করমে ছবি বাঁধানো। Íেদিন পর সে প্রতম বুঝতে পারে, একদিন দিলারা আপা আর তার বর তাকে কেন দলে বলে বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিল, আর প্রচুর ছবি তুলেছিল। দিলারা আপাকে পরে জিজ্ঞাসা করে জানে, ঢাকা শহরের আমান ডেভিডের কয়েকটা বাড়ি। তারই একটা একটা বাড়িতে তারা ভাড়া থাকে। তাদের একরকম বাধ্য করেছিল লোকটা। ওই সময় তাদের খুব টানাটানি চলছিল। মাসের ভাড়া দিতে দেরি হচ্ছিল বলে আমান তাকে দেখা করতে বলে। নিজের ভাড়াটের বেলায় এসব বদান্যতা নাকি ছিল। ভাড়া মওকুফ করতো, লোন দিত, কারো বিপদে গাড়ি লাগলে গাড়িও দিত। দিলারার স্বামী সেই টানাটানির কথাটা বলতে, আমান তাকে মোটা টাকা দিতে চায়, শর্ত একটাই কয়েকদিন কয়েকটা আলাদা জায়গা গিয়ে সারাবান তহুরার যত পারে তত ছবি তুলে আনতে হবে।
লোকটা সত্যিই অদ্ভুত। আর আমান ওই ধরে নিয়েই কেবল দেখতে চেয়েছিল আমি কতটা তাকে ফেরাতে পারি। সে তার বন্ধুদের সঙ্গে বাজি ধরেছিল, আমি মোটেও কোনো সস্তা মেয়ে নই। আমি কোনো ভয়ের কাছে নত হই না। আমার সেদিনের প্রত্যাখ্যানে সে আসলে হারেতোনিই বরং রীতিমতো জিতেছে। কী সব কা- করেছিল সেদিন ডেভিড। সবলোকজনকে ভাগিয়ে দিয়ে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, সে এখন যা যা বলবে সব ঠিক মতো মেনে নিলে তার কোনো সমস্যা হবে না। কী করতে হবে তাকে বাধ্য হয়ে শরীর দিতে হবে? সারাহ্ ঝাঁজের সঙ্গে জানতে চেয়েছিল।
‘শরীর দিতে হবে না, শরীর মাপতে দিতে হবে।’
‘মানে কী?’
‘মানে কিছু না। গজ ফিতা দিয়ে মাপতে হবে আমার ঘাড় থেকে পায়ের এই কাফমাসল পর্যন্ত’।
‘এতে কী হবে?’
এই কাজটা সারাহ্ করতে পারবে কিনা সারাহ্কে শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেছিল। সারাহ্ও টের পেয়েছিল একাজটা তাকে কারিয়েই ছাড়বে। তাই সারাহ্ সব সময় যা করে দ্রুত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানো বা তাল মেলানো তাই করেছিল।
নিজে উলঙ্গ হলে একটা গজ ফিতা দিয়ে দর্জির মতো মাপিয়েছিল নিজের গলা, বুক স্বাভাবিক অবস্থায়, ফোলানো অবস্থায়, কোমর, পাছা, ঊরু, জঙ্গা। দেয়ালের দিকে পেছন ফিরে এই মাপ সে নিতে বাধ্য করেছিল। তারপর মেপেছিল সারাহ্কে। তার আগে বলেছিল, ‘কী মনে হলো?’
‘কী আর মনে হবে সব ঠিক আছে।’
‘তাহলে আপনার সমস্যা কোথায়?’
‘সেটা তো আমি জানি না।’
‘কিন্তু আমাকে তো জানা লাগবে। আমি আপনাকে মাপতে চাই।’
‘কীভাবে?’
‘আমাকে আপনি যেভাবে মাপলেন।’
সে সারাহ্কেও কাপড় খুলতে বলে। সে রাজি হয় না। তখন ডেভিডের কী যেন হয়, সে শক্ত হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হাতে গজ ফিতা। গায়ে একটা সুতো নেই। সারাহ্ দেখছিল একেবারে নিখুঁত শরীর আমান ডেভিডের। পুরুষ মানুষের শরীর ঠিক যা হওয়ার তাই। ঘরের মধ্যে একটা থমথমে পরিবেশ। এই সময় জানালা দিয়ে তাকিয়েছিল। সকাল থেকেই সেদিন আকাশ মেঘলা। পর্দা টানানো ছিল। তারপরও বাইরে যে ধুমছে বৃষ্টি নেমেছে সেটা টের পাওয়া গিয়েছিল। ঘরের ভেতরে ততটা জমাট বাঁধতে থাকে আরেক মেঘ। ‘কী হলো?’ হঠাৎ সারাহ্ই জানতে চায়। ডেভিড কোনো উত্তর দেয় না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকে। থমথমে মুখ। সারাহ্রা মনে হয়, যেমনটা তার হয়, দেখাই যাক না বলে একে একে সব কাপড় খুলে ফেলে।
‘হলো?’ কৌতুক নিয়ে বলে। ডেভিড তখন মূর্তি থেকে প্রাণ পায়।
‘সোজা হয়ে দাঁড়াবেন?’সে কোনো কথা না বলে সারাহ্কে মাপতে থাকে।
সারাহ্ বলে, ‘তুমি তো মাস্তান শুনেছিলাম এখন দেখছি দর্জিও।’
মাপা শেষ হলে ঘষ ঘস করে একটা কাগজে কী কী লিখে রাখে। তারপর সারাহ্র দিকে ফিরে বলে,‘কাপড় চোপ পড়ে নিন। আমার গাড়ি এসে নামিয়ে দিয়ে আসবে।’
‘গাড়ি লাগবে না। আমি একাই যেতে পারবো।’
এরপর থেকে নতুন একটা উৎপাত শুরু হয়। প্রায় কদিন পর পর নানান রকমের কাপড়চোপড় আসতে থাকে। আসে ব্রা, প্যান্টি, জিনসের প্যান্ট, টিশার্ট, গেঞ্জি, শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ। কত রকমের কসমেটিক্স। সারাহ্ কখনো ডেভিডকে ফোন করেনি, কিন্তু কদিন চলার আর আর সহ্য করতে না পেরে তাকে ফোন করে।
‘এসবের মানে কী?’
‘আপনাকে আমি একেকদিন একেক পোষাকে দেখতে চাই।’
‘মানে কী? আমি কি জিনসের প্যান্ট পরে বের হব। কখনোই না।’
‘তা কেন? আপনি বাসার ভেতরে পড়বেন আমি আপনাকে দেখতে যাবো।’
‘এসব খুব বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!’
‘দেখুন আমি আপনাকে যা খুশি করতে পারি।’
এবার সারাহ্ চিৎকার করে ওঠে, ‘তো আসো, এসে যা খুশি করে যাও। আমি কি তোমার দাসি বান্দি নাকি। তোমার যা খুশি কী করতে চাও। ডু ইয়্যু ওয়ান্ট টু রেইপ মী? দেন কাম অন। কাম হেয়ার অ্যান্ড ফাক মি অফ!’ প্রচ- জোরে চিৎকার করে উঠে মোবাইলাটা কেটে দিয়ে, বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে সে। আশ্চর্যজনকভাবে ডেভিড আর কোনো দিন তাকে কোনো কিছু বলেনি। কেবল একটা মেসেজ পাঠিয়েছিল, ‘আমি অপেক্ষা করছি।’
৯. সারাহ্ ও আখ্যানের অভিমুখ
এসবের কোনো কিছুই কাউকে বলা যায় না। জহরতকেও না। জহরতকে আসলে তার আর মাপার কিছু নেই। তবু উত্তরে বলে, ‘ডেভিড কদিন জ্বালাতন করেছিল।’ সারাহ্ দেখল তার সেই ইঞ্জিনিয়ার স্বামী, ডেভিড, মিল্লাত, জহরতÑ এই চার জনকে তার নানান ভাবে দেখা হয়েছে। একদিন রাতের বিছানায় শুয়ে এঁদের কথা ভাবতে ভাবতে তার মনে হয়, হয়তো অন্য কোথাও, অন্য কোনোখানে, তার জন্য তেমন কেউ অপেক্ষা করছে। যে সত্যিকারে পুরুষ। আসলে কাকে বলে সত্যিকারের পুরুষ? যে তার ইঞ্জিনিয়ার স্বামীর মতো তাকে ছেড়ে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাবে না; ডেভিডের মতো দখলদারিত্ব চাইবে না; কেবল বাসনার ব্যাকুলতা থেকে তাকে ভোগ করবে না মিল্লাতের মতো; আর জহরতের মতো অনুভূতিহীন হয়ে থাকবে না। তাহলে কেমন হবে সেই পুরুষ?
আমার এই আখ্যানের শুরু থেকে জহরতকে এক দ্বিধাময় সময়ের ভেতরে দেখেছি। জহরতকেতই চাইলে আমরা সারাহ্র দিকে ঠেলে দিতে পারতাম। সারাহ্ তো তাকে তার দিকে টেনেই এনেছিল। কিন্তু জহরত সাড়াহীন। আসলে মানুষ অনেক রকম হয়। কিন্তু কামনাবসনাহীন হয় সেটা সত্যিই জানাছিল না। হয়তো অনেক লোক চিরকুমার থেকে যায় একারণেও। অব্যবহৃত থেকে যেতে যেতে সে একেবারেই এর প্রতি সব আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। হয়তো আসলে তার ক্ষেত্রে ওই হরমনের নিঃসরণই হয় না। নারীর প্রতি কোনো বোধই তার কাজ করে না। কিন্তু এটা তো একধরনের প্রতিবন্ধী দশাও নাকি? আসলে আমরা মানুষ নামের রহস্য খুঁজতেই নানান আখ্যানের জন্ম হয়। আখ্যান লেখা হয়। বিজ্ঞান কত না সূত্র বের করেছে, কিন্তু মানুষকে বিজ্ঞান দিয়েও ব্যাখ্যা করা যায়নি। মানুষকে আসলে কী দিয়ে ধরা যায়, তা তো আমরা ঠিক জানি না। কত জ্ঞান কত কিছু মানুষকে বোঝার জন্য তৈরি হয়েছে। কিন্তু যখন আর বোঝা যাচ্ছেই না, তখন মানুষকে কয়েকটা দিকে ঠেলে ফেলে দেওয়ার চেষ্টাও হচ্ছে। সেটা হল মানুষকে বানানো হচ্ছে অর্থবিত্তখ্যাতিলোভী ভোগসর্বস্ব জীব। এই জগতের তাবৎ আখ্যানকাররা জানেন যে বিশ্বের একটি বৈদ্যুতিক মাধ্যমের ঘোষণাই ছিল জগতে আর কোনো গ্রেটই ম্যান তারা হতে দিবে না। নেলসন ম্যান্ডেলাই শেষ। এর পর আর কেউ নেই। মিডিয়া কাউকে আর মহাত্মা বানাবে না। এখন মিডিয়া তৈরি করছে অসংখ্য স্বপ্লস্থায়ী বিখ্যাত মানুষ। যারা ফেনার মতো এসে, ফেনার মতো বিলীন হয়ে যায়। এখনকার আখ্যানের কাজও তাই মহাত্মাদের নিয়ে নয়। এইসব ফেনার মতো এসে ফেনার মতো মিশে যাওয়া মানুষকে নিয়ে। আমাদের এই আখ্যানের সবাই একেবারে মানবিক দুর্বলতারও ত্চ্ছু জিনিস নিয়ে ব্যস্ত। আর এটাই তাদের বেঁচে থাকা ও মরে যাওয়া। তাদের বাঁচা বা মরে যাওয়া নিয়ে আসলে কোনো আক্ষেপ আছে বলে মনে হয় না। যদিও আমরা দাগিয়ে দিতে পারি না, তাদের ভেতরকার সবকিছু আমরা তুলে ধরতে পেরেছি। বেশিরভাগই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। আবছা আলোয় যতটা দেখা গেছে তার বেশি তো তাদের আমরা দেখাতে পারিনি বলেই আমরা শেষে এমন একটা ঘটনা দেখি, যা নিয়ে আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।
আদতে এই আখ্যানে কাউকে নায়ক বানানোর চেষ্টা হয়তো কিছুটা করা হয়েছিল, কিন্তু সেটি ব্যর্থ হয়েছে, কারণ মানুষের এখন আর নায়ক হওয়ার ক্ষমতা নেই (কেবল ব্লুফিল্মের নায়ক ছাড়া বা বাৎসায়নের কামসূত্রে আসন বিন্যাস দেখানোতে উল্লিখিত হওয়ার নায়ক ছাড়া)। বরং ভিলেন হওয়ার কিছুটা ক্ষমতা এখনো বাকি আছে। যেমন আমান ডেভিড হতে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরও তাকে আমরা ভিলেন হতেও দেখলাম না। জহরতকে তো আমরা কোনো দিকেও যেতে দেখলাম না। যে মানুষ আকাক্সক্ষাশূন্য হয়ে যায়, হয়তো সে সবকিছু থেকেই শূন্য হয়ে যায়। জহরতে বাপটা মানুষ না যন্ত্র সেটা বোঝা মুশকিল। এর চেয়ে তার মা অনেকটাই জীবন্ত। যদিও এই আখ্যানে তার তেমন কোনো ভূমিকা নেই। জহরত মনে করেছিল, যে একদিন কেন্দ্রে চলে আসবে তার ক্রিকেট খেলার দক্ষতা ও এর সম্পর্কে অর্জিত জ্ঞানের ভেতর দিয়ে, কিন্তু তার বদলে সে আসলে কেন্দ্রে পৌঁছানো তো দূরের কথা সে তার নিজের বৃত্তেরই বাইরে চলে গেছে যে,সে আর কোনো বৃত্তেই প্রবেশ করতে পারবে না।
তবে আমাদের এখান যে সারাবান তহুরাকে হাজির করেছিলাম। তাকে অনেকটা সাহিত্যের চরিত্র বলা যেতে পারে। এমন নারী সচরাচর আমরা দেখি না। যদিও তাদের অস্তিত্ব আছে, সেটা আমাদের জানাশোনার অনেক দূরে পড়ে থাকে। সেও কি নায়িকা হয়ে উঠতে চেয়েছিল? সে তার জীবনের নতুন একটা মাত্রা দিতে চেয়েছিল কোনো একটা পুরুষের ভেতর দিয়ে। পুরুষের প্রতি কোনোভাবেই সে কোনো আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারছিল না। তার স্বামী তাকে চায়নি, কিন্তু সেও তো স্বামীকে তেমন করে চায়নি। আর যারা তাকে চেয়েছিল তাদের প্রতি তার কোনো আগ্রহই জাগেনি, এক ধরনের যান্ত্রিকতা ছাড়া। আর যাকে সে নিজের আয়ত্তে চাইল, মনে করেছিল তাকে সে ভুলিয়েভালিয়ে নিজের মতো তৈরি করে নিতে পারবে, তার কোনো সত্তা আত্মা বলে কিছু আছে কিনা কে জানে, হয়তো কোনো সাহসই নেই পুরুষ হয়ে ওঠার। তবে সে একেবারেই বোকার হদ্দ তা তো নয়। সে আসলে অনেক কিছুই খেয়াল করে কিন্তু নারী তার জীবনের কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। তারচেয়ে জরুরি ছিল তার একটি পরিচয় বা আইডেন্টিটি তৈরি করা। কিন্তু কী সে পরিচয় সেটা সে জানে না।
আখ্যান যেভাবে যতটুকু এগিয়েছিল, তাতে কারো আর কোনো আকাক্সক্ষার নেই, প্রতীক্ষা নেই, অপেক্ষা নেই। সারাহ্ অন্তত জানে যে চারটি পুরুষকে দেখা হয়েছে। আর কত রকম হতে পারে মানুষ? ছয়শো কোটি মানুষ ছয়শো কোটি রকমের কিন্তু তাদের পার্থক্য বেশি হয়ে একটি বিন্দুর বেশি নয়। মানুষ ওই বিন্দু জন্যই একটাই আরেকজন মানুষের চেয়ে আলাদা হয়ে যায় যে, তাকে আর কোনো জালে ছাঁচে বেঁধে ফেলা যায় না। সেই রকম জালে ছাঁচে বাইরে সারাহ্ এখন নিজের মতোই দিন কাটাচ্ছিল। তার অফিস মনে যে স্কুল অ্যান্ড কলেজে পড়ায়, সেখানকার এক সহকর্মীর কথায় সে একটা ফেসবুক খুলে ছিল। কিন্তু সেখানে সে তেমন কোনো মজা পায়নি। ফলে খুলে সে কোনো রকম ফেসবুকিং করে না। লাইক দেওয়া, ফটো শেয়ার করা, বা ফটো অ্যাড করা, ভিডিও শেয়ার করা এসব জানে না। বাসায় কম্পিউটার তার কাজে লাগে খবরের কাগজ পড়তে। নানান রকমের তথ্য জোগাড় করতে, ক্লাসে বাচ্চাদের চমরপ্রদ কিছু দেওয়ার জন্য নেট থেকে সে অনেক কিছু মাঝে মাঝে ডাউনলোড করে। করে প্রিন্ট আউট নেয়। অনেক কিছু ফেলেও দেয়। যতটা স্ক্রিনে পড়ে ভালো লেগেছিল, পরে দেখে প্রিন্ট আউট নিয়ে আর তত ভালো লাগছে না। তারপরও ওই খোঁজা ও নতুন তথ্য নিয়ে তার দিন কাটছিল ফেসবুকের কথা সে ভুলেও গিয়েছিল। কিন্তু সেটা যে খুলে ছিল মনে পড়লো একদিন বিকালে ডোরবেল বেজে ওঠার পর।
০. শূন্য থেকে হঠাৎ আরেকজন
সারাহ্ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে থাকে। তার ইউসোবিওকে সে চিনতেই পারছে কিন্তু বিশ্বাস করতে পারছে না। বিশ্বাস করতে পারছে না নিজের চোখকে। কত কত যুগের ওপার থেকে কণ্ঠস্বরটা এলো?
‘সারাহ্! আমি!’ মনে হচ্ছিল এই স্বরটা এমন এক অতলে তলিয়ে গিয়েছিল যে আর কোনো দিন এ স্বর শোনার কথা নয়। মহাশূন্যের কোথাও উধাও হয়ে গিয়েছিল এই স্বর।
সারাহ্দের পাশের বাড়িতে ভাড়া থাকতো ওরা। কোনো মতে দিন চালাত ওর মা। বাপ ছিল একটা আস্ত ভবঘুরে। মা একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়াত। ছেলেটাকে ভালো করে মনেও নেই। মীরজাহান? বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার হলে তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তাকে নিয়ে বেইলিরোডের একটা রেস্টুরেন্টে বসেছিল। সেদিন বলেছিল আর কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে,‘তোমাকে তো পুরো ইউসোবিও-র মতো লাগছে।’ মীরজাহানই তো। মীরজাহানের সেদিন পছন্দ হয়েছিল সারাহ্র এই কথাটা। ক্লাস নাইনে নিজের নাম থেকে সে ‘বিশ্বাস’ শব্দটি ফেলে দিয়েছিল। তারপর থেকে রাতরাতি সে অন্য ছেলেতে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। কাগজে নয়,‘বিশ্বাস’টা বুকেই থাক।
বন্দরটিলা থেকে যে রাস্তাটা তাদের বাড়ির দিকে গেছে এক বিকাল বেলা সেদিক দিয়ে না এসে সে অন্য পথ দিয়ে হেঁটে আসছিল, একা। দূর থেকে তাকিয়ে ছিল ছেলেটি। সারাহ্র কখনো আগে এমন অস্বস্তি হয়নি। ছেলেটা কেমন একটা অসহায় বেচারি মুখ নিয়ে তার আসার এবং তার সামনে দিয়ে চলে যাওয়াটা দেখেছিল। দুপাশে গাছপালার শাখাপ্রশাখা এসে একটা টানেলের মতো সেই পথটার ওই জায়গা একটু সরলরেখার মতো। সারাহ্ দূরে গিয়েও মনে হল ছেলেটি তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে পেছনে তাকিয়ে দেখে ছেলেটা নেই। আশ্চর্য! তারপর থেকে ওই পথে আরো অনেকবার গিয়েছে। কিন্তু ছেলেটির দেখা পায়নি। একদিন এমন একা যখন আসছিল সে পিছন থেকে বলে, ‘এই একটু শুনবে?’
সারাহ্ একটু চমকে উঠে পিছনে তাকায়।
‘তুমি কে? কী নাম তোমার?’
‘আমার নাম মীরজাহান!’
‘তোমার নাম?’
‘সারাহ্। পুরো নাম সারাবান তহুরা।’
এইটুকু কথা হয়েছিল। বহুদিন আর তাকে দেখেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে হঠাৎ করে হাজির হয়ে সে তাকে ভীষণ অবাক করেছিল। এরপর আবার উধাও।
জীবনের কত কিছু একের পর এক ঘটে চললো। এই তো গতদিন পর্যন্ত সারাহ্ নতুন একটা কিছু ঘটাতে চলেছিল। পারেনি। তারপর সে ঠিক করলে আজ থেকে সে তার ভেতরের সমস্ত ফণা গুটিয়ে ফেলবে। সারাহ্ তার নিজেকে সাপের না মানুষের জীবনযাপন করতো জানে না। সাপ একটাই ফণা তুলতে পারে। মানুষের ফণা অগণতি! একই মানুষ কত রকমের সাপ হয়ে উঠতে পারে সারাহ্ কেন, কেউ জানে না। সাপের স্বভাবের মানুষদের কখনোই আগে থেকে চেনাও যায় না।
আজ এত বছর পর মীরজাহান! সেই পুরোনো কথাটাই বলল, ‘আমার নাম মীরজাহান। এসেছি তোমার দ্বারে।’
শব্দটা এমন দ্বিধা সংকোচ আর লজ্জা নিয়ে বলছে যেন এই নামের ভেতরে রাজ্যের লজ্জা মিশে আছে। আর তাতে আছেই। সেই ছোটবেলায় দুইবার দেখা এবং অনেকদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর আজ এত এত বছর পর সেই মানুষ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, যার অস্তিত্ব আছে কিনা নেই সেটা ভাবা তো দূরের কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিল তা নয়, মাঝে মাঝে চকিতে মনেও পড়তো। কিন্তু আসলে তো মীরজাহানকে মনে রাখার কোনো কারণও নেই।
সারাহ্কে বহুবার বহু ছেলে ছোটবেলা থেকে স্কুলে পড়ার সময় কি কলেজে পড়ার সময় এমনকি বিশ্বাবিদ্যালয় পড়ার সময় কত না ভাবে ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করেছে, ‘তোমার নামটা? আপনার নামটা?’ ছোটবড় কত রকম ছেলে। মেয়েরাও। সে চোখে পড়ার মতো মেয়ে ছিল না। কেবল তার সুন্দর গড়ন আর লম্বা চুল ছাড়া। যে চুল সে তার ইঞ্জিনিয়ার স্বামী চলে যাওয়ার পর আর বড় করেনি। বিধবাদের মতো সাদা কাপড় পরে পরে দিন কাটিয়েছে। নিজেকে তৈরি করেছে কোনো এক পুরুষের জন্য, যে একদিন এসে তার সমস্ত অপেক্ষার ইতি টেনে দিবে। তারপরও সে মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওঠেনি। তা না হলে সে কেন জীবনের নানান সময়ে ঠিকমতো পা ফেরতে পারেনি। আসলে প্রত্যেকটা মানুষের একটা ভেতরের জীবন থাকেÑ সেখানে সে ছাড়ার আর কেউ ঢোকার অনুমতি পায় না। সেই নজের জগতের কোথাও তো সে টের পায়নি মীরজাহান নামে কেউ একজন আছে। যে তার জন্য অপেক্ষা করেছে। নিজের জীবনেও নানান ওঠা-নামার ভেতরে দিয়ে, বেশ কয়েটা কয়েকটা সম্পর্কের ভেতরে দিয়ে তাকেও জীবনের পথ পাড়ি দিয়ে আসতে হয়েছে। ঠিকটা বেছে নিতে হলে বার বার ভুল হয়Ñ এই মতো যে তার ভুল হয়েছে তা তো নয়। কারোরই একইভাবে ভুল হয় না। ভুল মানুষের জন্য অপেক্ষা করে নাকি মানুষ ভুলের জন্য অপেক্ষা করে? যেটা সুযোগ নয়, তাতে ভুল ওৎ পেতে থাকে। সুযোগ তো সব সময় সৌভাগ্যও নয়। কারণ আজ যে সৌভাগ্য আগামীকাল বা কিছু দিন পর সেটাই ভয়াবহ দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
‘সব কথা তো আর একদিনে বলা যাবে না।... কিছুটা সময় নেবে। যদি আপনি শুনতে চান।’ সে যতবারই ‘তুমি’ বলতে চেয়েছে ততবারই ‘আপনি’ বের হয়ে গেছে। কারণ সে যেখানে কাজ করে সেখানে ঝাড়–দার থেকে সর্বোচ্চ পদে থাকা সবাইকেই ‘আপনি’ বলে। তুমি বলবার লোক তার বলতে গেলে কেউ নেই। বন্ধু যারা ছিল তাদের সঙ্গে বছরের পর বছর দেখা হয় না। সবাই বিচ্ছিন্ন।
পরে বলেছিল মীরজাহান,‘আমি কেবল তোমার নামটাই মনে রেখেছিলাম। আর কিছু না। আমি জানি কেবল এই নামটাই আমাকে তোমার সামনে নিয়ে আসবে। কিন্তু কীভাবে সেটা আমি জানি না। অনেকেই বলে কম্পিউটার সভ্যতার মহত্তম আবিষ্কার, কিন্তু সেই মহত্তম আবিষ্কারের আরেক আবিষ্কার হল সোশ্যালনেটওয়ার্ক ফেসবুক। এটা চালু হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন আমি তোমার নাম লিখিছি। কিন্তু এই নামে কোনো দিন কাউকে পাইনি। নামটাই ছিল তোমাকে খোঁজার এক এবং একমাত্র সূত্র আর কিছু না।
‘সত্যিই আমি বিশ্বাসই করতে পারছি না।’ সারাহ্ অনেকক্ষণ দুহাতে মুখ ঢেকে বসেছিল। সে মুখ তুলতেই পারছিল না। প্রচ- এক আনন্দ আর একই সঙ্গে গভীর এক লজ্জা তাকে মুখ তুলতে দিচ্ছিল না।
মীরজাহান বলে, ‘কী হলো। এভাবে বসে আছো কেন? মুখ তোলো।’ একক্ষণে তার মুখে ‘তুমি’ এলো।
‘আমি আজ আর এই মুখ তোমার সামনে তুলতে পারবো না। তুমি আজকে এসো। আগামীকাল তুমি যখন ইচ্ছা আমাকে তোমার কাছে ডেকে নিতে পারো। আমি তৈরি থাকবো।’ সারাহ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে আমার মোবাইল থেকে তোমার মোবাইলে একটা কল করো। আমার নাম্বারটা পাবে। আগামী কোনো এক সময় আমাকে তোমার খুঁজে পাওয়া গল্প শুনবো।’
‘তবে তাই হবে।’
মীরজাহান সারাহ্র দিকে তাকিয়ে তাকিয়েই ঘর থেকে বের হয়। দরজাটা খুলে বন্ধ করার আগ পর্যন্ত সারাহ্কে সেভাবেই বসে থাকতে দেখে। তার মুখে একটা হাসির রেখা ভেসে ওঠে। জীবনের আরেকটি নতুন আখ্যানের দিকে সে এগিয়ে যায়। সিঁড়ির প্রতিটি ধাপে পা ফেলে ফেলে সে নামতে থাকে।