সকাল থেকেই মনটা খুব ফুরফুরে বনানীর। আজ ঈদ! আগে থেকেই নিজেকে সাজাবার জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছে সে। তীব্র গরমের পর এই বর্ষায় বনানী নীলপরী সাজতে চায়। নীল! তার প্রিয় রং। তার ওপরে ঈদ এসেছে বর্ষায়, তাই মনটাও এক অদ্ভুত রংয়ের খেলায় মেতেছে। স্নান সেরে গুনগুন করে গান করতে করতে আয়নার সামনে দাঁড়াল। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে এই গানটাই বারবার কেন মনে আসছে তার!
ওদিকে ঘরের বাইরে থেকে কে যে সমানে ডেকেই চলেছে! খুব বিরক্ত নিয়েই আলগোছে দরজাটা খুলে দিল বনানী। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ। ঈদ আর বর্ষা সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত আবেশে আছে সে। কিছুতেই এই আবেশটাকে নষ্ট হতে দিতে রাজি নয়। কোনো কারণেই তার এই ফুরফুরে মুডটাকে নষ্ট হতে দিতে ও রাজি নয়। কতদিনের স্বপ্ন সে শাড়ি পরবে! নিজের ইচ্ছায় মনের মতো সাজবে।
বনানীর মা-বাবা খুবই কড়া প্রকৃতির মানুষ। কলেজ জীবনটা বলতে গেলে উপভোগই করতে পারেনি। একে তো পড়াশোনার চাপ তার ওপর বাবা-মায়ের কঠিন শাষণ। এত নিষেধাজ্ঞার মাঝে বেড়ে ওঠা যে জীবন সেই জীবনটা নিমিষেই স্বাধীন হয়ে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সঙ্গে সঙ্গেই! কী ভীষণ অবাক করে দিয়ে মা হঠাৎ ঘোষণা দিয়ে দিলেন তুমি বড় হয়েছ। এখন থেকে তুমিই নিজেকে সামলাবে। এই কথায়ই কী বনানীর সেদিন মাথা ঘুরে গিয়েছিল?
মায়ের এই ঘোষণায় রাতারাতি যেন বড় হয়ে গেল বনানী। না মনে খুব শঙ্কা ছিল বাবা কী বলেন! বাবাও কিছু বলেননি। বনানীর ঘরের ফোনে কেউ আড়ি পাতেনি। বনানীর চিঠি এসেছে সেটাও কেউ খুলে দেখেনি। ডায়েরি সে যেভাবে রেখেছিল দিনশেষে তেমনই পেয়েছে। কী বই পড়ছে কেউ দেখেনি। গান শোনা নিয়ে কোনো বিধিনিষেধ নেই। প্রতিদিনই এমন হরেক রকম চমকের উপহার পেয়েছে সে! আর প্রতিদিনই তার মনে হয়েছে সে স্বাধীন। সে বড় হয়ে গেছে। কী আশ্চর্য সেই সুখানুভূতি সে কেবল বনানীই জানে!
এবারের ঈদটাও তাই তার কাছে একটি স্বাধীন ঈদ! ঈদ মানেই আনন্দ আর এবার যোগ হয়েছে একরাশ স্বাধীনতা। বনানী দরোজা খুলে একটু ভেবে নিল। কেউ নিশ্চয়ই ঘরে আসবে। না তার ধারণা ভুল। কেউ এলো না। তাকে কেউ ডাকছেও না। সবই ভুল! তাহলে মাথাটা ব্যথা করছে এই জন্য ভুল শুনছে?
আপন ভুবনে ফিরে এসে সাজতে শুরু করল। নীল শাড়ির সঙ্গে সাদা ব্লাউজ ওর কাছে ভালো মনে হলো। সাজ শেষ করেই মনে হলো কি যেন বাকি থেকে গেল! কিছুতেই মনে করতে না পেরে মাকে বলেই স্মৃতির বাসার পথে যাত্রা শুরু করল। বাইরের জগৎ অনেকদিনই একটু একটু করে একাকি দেখছে সে। ইদানীং আরো সহজভাবে, স্বাধীনভাবে। সব কিছুই কেন জানি খুবই ভালো লাগে তার। আজও সারা দিন কাটাবে বন্ধু স্মৃতির বাসায়। স্মৃতি ওর খুব কাছের বন্ধু। সেই স্কুল-কলেজ তারপর এই বিশ্ববিদ্যালয়ে। দুই বছর হলো স্মৃতির বিয়ে হয়েছে। কিন্তু আজো বন্ধুত্বটা অটুট রেখেছে দুজনেই ।
এই তো সেদিনের কথা। দুইজন এক সঙ্গে কতই না মধুর সময় কাটিয়েছে! এই সব সুখের দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতেই পৌঁছে গেল স্মৃতির বাসায়। গাড়িটা হঠাৎ ব্রেক করায় এই গভীর স্মৃতিচারণে ভাটা পড়ল।
বনানী গাড়ি থেকে নামতে উদ্যত হতেই মাথাটা আবার যেন একটু ঝিমঝিম করে উঠল। সামান্য এই মাথা ঝিমঝিম করে ওঠায় তার কিছুই যায় আসে না। আগেও এ রকম হয়েছে বহুবার। তখন তার এ সব দেখার জন্য মা-বাবা দুজনেই ব্যাকুল হয়ে থাকত। তারাই ব্যস্ত হয়ে বনানীকে ঘরে আগলে রাখত। কি কি সব চিকিৎসা দিত। বনানী এসব কিছুই জানে না। শুধু অনুভব করত মা তার পাশে, বাবা তার পাশে। আর সে নিঝুম কোনো দ্বীপ থেকে একদিন হঠাৎ যেন ঘুরে আসত। আজ তাই আর কাউকেই কিছু জানায় না। একটু ব্যথা বা মাথা ঘুরে ওঠায় তার আজকাল কিছুই যায় আসে না ।
ঝলমলে নীলপরীর মতো বনানীর আবির্ভাবে স্মৃতির চোখেমুখে এক আকাশ আনন্দের বন্যা প্রবাহিত হয়ে গেল। বনানী আর স্মৃতি ছুটে গেল আনন্দের স্রোতে স্মৃতির ছোট্ট ব্যালকনিতে। ওখানে দাঁড়িয়েই তারা ঈদের আনন্দটা ছুঁয়ে দেখবে। কিন্তু বনানীর মাথা ঝিমঝিমটা ক্রমশ বাড়ছে কেন? কয়দিন ঘুম হয়নি বলে নাকি অন্য কিছু? ধীরে ধীরে মাথার ব্যথাটা এতটাই বেড়ে চলল যে, খাবার সময় বনানী সব লজ্জা ভয় কাটিয়ে স্মৃতিকে বলেই ফেলল, ‘আমি যাই আর সহ্য করতে পারছি না।’
প্রিয় বন্ধুর এমন হঠাৎ চলে যাওয়ার কথা মেনে নিল না স্মৃতি। জোর করে সবার সঙ্গে খাবার টেবিলে এনে বসাতেই একদলা বমি বনানীর পাকস্থলি থেকে যেন টেবিলে সুসজ্জিত খাবারে এসে পড়বে বলে মনে হলো। অনেক কষ্টে সেটা চেপে ধরে বনানী এক রকম অভদ্রতা করেই স্মৃতির বাসা থেকে বের হয়ে এলো। সারা পথ আর তার কোনো কিছুই ভাবার সুযোগ পেল না। কেবল মাথা ব্যথা আর এক ধরনের অব্যক্ত যন্ত্রণা তাকে অসহ্য কষ্ট দিতে লাগল। গাড়িটা বাসার সামনে দাঁড়াতেই কোনোমতে টলতে টলতে তার নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় শুয়ে পড়ল। এ এক অবিশ্বাস্য যন্ত্রণা? সকালে তো ভালোই ছিল। কি হলো? আর কিছুই মনে করতে পারল না বনানী। ঝাপসা চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল কারা যেন দূর থেকে তাকে ডেকেই চলেছে! উচ্চস্বরে কারা যেন একই সুরে কেঁদেই চলেছে!
স্মৃতি ছুটে এসেছে বনানীদের বাসায়। বনানীর মা উচ্চস্বরে কাঁদছেন। বাবা একদিকে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। নিথর বনানী নীলপরী সেজে তার বিছানায়। বনানী জানল না, তার মাথার ভেতরে দীর্ঘদিন ধরে বাস করা টিউমারটি তার জন্য বহন করে এনেছে চির মুক্তির বার্তা!