অদ্ভুত সব নিয়মরীতি। কথিত উন্নত দুনিয়ায় কত কিছু যে হয়!
আমরা বন্ধুরা মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম সন্ধ্যায়, বার্সেলোনায়, রাম্বলায়। কলম্বাসের বিশালমূর্তি আসমানের আকাক্সক্ষা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাকিয়ে থাকা যায় না বেশি সময়। দেখার কেবল আনন্দ আছে তা নয়, বিরক্তিও আছে হে!
জাপানের হামাদা তাদাহিশা, কোরিয়ার বোয়িংগিল ওহ, রোমানিয়ার রোজি, চায়নার সিয়ংহো, কম্বোডিয়ার মানাভি আর আমি। সবে ৬ জন মেট্রো করে চলে গেলাম ড্রাসানেসে বিচ দেখতে। কিন্তু পৌঁছলাম বন্দরে। সেটা মন্দ হয়নি।
সন্ধ্যা হয় হয়। এই সময় ৮টা বাজলেও সূর্যের তেজ মেটে না। কিন্তু আমাদের ক্ষুধার তেজ বাড়তে থাকে। ফলে ভাবলাম ডিনারটা সেরে নেওয়াই ভালো হবে। মানাভির কথা অনুযায়ী যে রেস্টুরেন্টে বসলাম সেটা রীতিমতো ডাকাত। সার্ভিসের যে অবস্থা ঢাকায় হলে মেজাজ খারাপ হতো। কিন্তু এখানে মেজাজ ধরে রাখাই উত্তম। তারপরও ডেকে বললাম দু-তিনবার খাবারটা দিয়ে দিতে। কেননা আমরা একটু ঘুরে দেখতে চাই আশপাশ। কেবল খাবারের পেছনে এমন স্বর্ণালি সন্ধ্যাটা মাটি করার কোনো মানে হয় না।
খাবারের দাম জেনে মনে হলো ইউরোপের যেকোনো দেশের চেয়ে দাম বেশি। তাপাও রেস্টুরেন্ট, রাস্তায়, কিন্তু দাম দেখে মনে হয় ফাইভ স্টারে খাচ্ছি। তা খাবারের দাম যাই হোক এক গ্লাস বিয়ারের দাম দেখে তো আচানক! ১০ ইউরো দিয়ে এক গ্লাস বিয়ার ইউরোপ, আমেরিকায় কোত্থাও খাইনি এখনো। খেতে হলো বার্সেলোনায়, বাট, বেশ ভালো। আমাদের চায়নার বন্ধুটি নিল সাংগ্রিয়া। সে রীতিমতো হতাশ। চেখে দেখলাম নিজেও। আপনার ঠোঁটমুখ খিঁচে আসবে অভ্যাস না থাকলে। বিটার অ্যান্ড সাওয়ার, দামেও তেমন। বাট ইটস পপুলার ড্রিংকস হিয়ার। অসম্ভব চমৎকার রং। রংয়ের প্রতি বাসনা গেল না আমার। কী লাল টিপ কালো শাড়ি, কালো টিপ লাল শাড়ি বা হলুদ বেগুনি আলতা।
খেয়েদেয়ে আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছি, ছবি তুলছি। ভূমধ্যসাগরের তীরে বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে নিশ্চয়ই খারাপ লাগার কথা না। সেবার ২০০৫-এ গিয়েছিলাম তিউনিশিয়ায়। মানে কার্তেজে। সেটাও ভূমধ্যসাগরের তীরে। ইয়াসমিন বিচ। বড়ই সৌন্দর্য। সুন্দরীদের আনাগোনায় বেশ প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে বিচ। ছিলাম এভরোয়েস হোটেলে। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও ছিলেন সে হোটেলে। বিচসংলগ্ন হোটেল। সাদা সাদা বালির সঙ্গে সাদা শরীরগুলো মিশে গিয়ে স্ফটিকময়তা তৈরি করে। আপনার মনও চনমনে হয়ে উঠবে। চনমনে কেবল সুন্দরীদের নয়, যে কারো জন্য, বিশেষ কেরে প্রেমিক প্রেমিকা, ভ্রমণপিপাসুদের জন্য চমৎকার তিউনিশের ইয়াসমিন বিচ। ইয়াসমিন বিচে ঘুরতে গিয়ে নিজেরে খুব নাদান মনে হইছিল। আপনি একা, বন্ধুবিহীন, স্বজনবিহীন, পরিবারবিহীন সৌন্দর্যের আঁচে গেলে মন তিক্ত হয়ে ওঠে। গাছেদের বাগানে একা একা আলাদা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছেদের মতো নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে হয়। বেদনা একা বহন করা যায়, কিন্তু আনন্দানুভূতি শেয়ার করতে হয়। নইলে মন তিক্ত হয়ে ওঠে। ভূমধ্যসাগরের জল হাতে নিয়ে মনে হয়েছিল জল ছুঁড়ে মারি কোথাও, কারো দিকে। কিন্তু একা জলকেলি হয় না মনের মতো। পাশে কেউ নেই। অগত্যা নিঃসঙ্গতা পিঠে করে বয়ে নিয়ে চলতে হয়! এবার বার্সেলোনায় অন্তত সঙ্গী আছে। ঠা-া ঝিরঝির হাওয়া বইছে। বাতিগুলো জ্বলে উঠছে। আর তীরে বিশাল বিশাল জাহাজ, স্পিডবোট। পাশের দালানগুলো আলোর বাতি নিয়ে জ্বলে উঠছে ঝিলমিল ভূমধ্যসাগরের পানিতে। আমরা ছবি তুলছি, কথা বলছি, খানিক এগিয়ে ব্রিজের ওপর ছবি তুলছি। একে অপরকে তুলছি, অন্যকে ডাক দিয়ে সবাই একসঙ্গে তুলছি। মানুষ সম্ভবত ছবি খুব পছন্দ করে। যেমন নিজেরটা করে, অন্যেরটাও মনে হয় কম পছন্দ করে না। এই কারণেই কিনা ছবিসমেত নায়ক-নায়িকা-সেলিব্রেটিদের সারা দুনিয়াতেই ভিউকার্ডের বিশাল বাজার আছে। ফেসবুকেও যে লেখার চেয়ে ছবিতে লাইক বেশি পড়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের জগত! বিড়ম্বনাও কম নয় এই জগতে। ব্রিজ পার হয়ে অদূরে শপিংমলে ঢুকলাম ঘুরতে, দেখতে। কোনো কেনাকাটা নয় একদম। কাচের মলে আমাদের মুখগুলো খ- খ- ভেসে উঠছে। মানুষের সম্ভবত স্বতন্ত্র ও একক মুখ বলতে কিছু নেই! দুনিয়ার খ- খ- সব মুখ এক হয়ে বিশাল হা করে আছে!
শত শত মানুষ। ঘুরছে, ছবি তুলছে, চুমু খাচ্ছে, বসে থাকছে, বুক ভরে বাতাস নিচ্ছে। উদ্দাম। গরিব দেশের অবস্থা যেমন শুকনা, মানুষের মুখগুলোও সেরকম উদ্যমহীন। ইউরোপ আমেরিকায় গরিবানা আছে বাট উদ্দামতার কমতি নেই। আমোদের সংগ্রাম করতে করতেই জীবন চলে যায়, ইউরোপে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, স্বাস্থ্যর জন্য সেরকম সংগ্রাম করতে হয় না যে। সৌভাগ্য নিয়ে যে সময়ে কোনো শিশু ইউরোপে, আমেরিকায় জন্মে, ঠিক তার উল্টো, দুর্ভাগ্য নিয়ে একই সময়ে আফ্রিকায়, এশিয়ায় জন্মে নতুন প্রাণ। কী যে নির্মম নিয়তি প্রাণের! একই প্রাণের কত খ- খ- বিচিত্র রূপ। আমরা হাঁটছি আর দেখিছি, খ- খ- হয়ে অখ- দৃশ্যগুলো কাচের দালানে ধাক্কা খেয়ে জলে ভেসে উঠছে, কাচে ভেসে উঠছে। যত্তসব মজার মজার মানুষ, মানুষের মুখ আর অভিব্যক্তি। মুখেদের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার নেশা বটে। কত যে এক্সপ্রেসন। শত সহস্র মুখের অভিব্যক্তি, কত যে বৈচিত্র্যময়! জগত কত যে রকমের!
মজার কা-! না, রীতিমতো ভয়ংকর। বলছিলাম রীতিনীতির কথা। এই বার্সেলোনায় পিকপকেটিং রীতিমতো নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কেউ যেকোনো সময় আক্রান্ত হতে পারেন। যে কারণে অনেকেই দামি ফোনসেট, টাকা-পয়সা নিয়ে বের হন না। এটা আফ্রিকায়, এশিয়ায় হতে পারে এমনটা আমরা ধরেই নেই। কিন্তু ইউরোপেও, ল্যাটিন আমেরিকাতেও কমন ব্যাপার। নিউইয়র্কের কথা সবাই তো জানি। নাইরোবিতে, ঘানায় এরকম ভীতিকর অবস্থার মুখে পড়তে হয়েছে কতবার। কয়েকজন একসঙ্গে ছাড়া তো নাইরোবিতে বেরই হতাম না। মানুষের ভয়। এবার মেক্সিকোতে গিয়েও একই অবস্থা। হোটেলে টাকা-পয়সা ফোন রেখে বের হতাম মেক্সিকো সিটির রাস্তায়। বার্সেলোনাতেও এই রকম ভয়! প্যারিসেও ভয় যায়নি মন থেকে। এই আবজাবের দুনিয়ায় সব শহরের রীতিনীতি প্রায় একই রকমের! কিন্তু বলি, কানাডায়, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, এমনকি নেপাল, ইন্ডিয়ায় ছিনতাইকারীর অতটা ভয় আসেনি মনে। তাই বলে কী ছিনতাই নেই, আছে। মেট্রো শহরগুলো তুলসি ধোয়া পাতা নয়।
আমরা ফিরে আসছি। মেট্রোতে উঠব উঠব। তো হুট করেই দুজন ছিনতাইকারী জাপানি বন্ধুটির পা আটকে দিল উঠার সময়। আর অন্য ছিনতাইকারী হামাদার পকেট থেকে মানিব্যাগ তুলে নিল হাতে। হামাদাও নাছোড়বান্দা। ছিনতাইকারীর হাতে ঘুষি মারল খসে। মানিব্যাগটি ট্রেনের মধ্যে নিচে পড়ে গেল, হামাদাও পড়ে গেল। দেখলাম দুজন স্মার্ট ইয়ং ছিনতাইকারী। ঘটনাটি মুহূর্তের মধ্যেই ঘটল কোনো কিছু বোঝার আগেই। আচানক!
বার্সেলোনা ধানমন্ডি নয়। কিন্তু ধানমন্ডির চেয়ে কম নয়। ফারুক ওয়াসিফের ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মোবাইল, টাকা পয়সা খোয়ানোর খবর জানলাম ফেসবুকে। পরের খবরটি সুমন রহমানের। এলাকা ধানমন্ডি। অভিজাত এলাকা বটে! মডেল থানাও আছে সেখানে। ভাবলাম, ধানমন্ডির ছিনতাইকারীর সঙ্গে বার্সেলোনার ছিনতাইকাররীদের কোনো যোগসাজশ আছে কিনা। তারা উভয়পক্ষই তো আরবান! এরা যে সবসময় আরবান পুওর তা কিন্তু নয়। ঢাকায় তো শুনি বড় লোকের পোলারা, এমপি, মন্ত্রীর পোলারা ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত। কেবল ছিনতাই কেন, চুরি-ডাকাতি খুন-খারাবিও করে শুনি। ভাড়াও কাটে, হায়! আর এখন তো খুন গুম ধর্ষণ চাঁদাবাজি প্রাত্যহিকতায় রূপ নিয়েছে ঢাকায়। দেশ এগিয়ে চলছে!
হ্যাঁ, অদ্ভুত নিয়মরীতি। এখানে ছিনতাইকারীরা ধরা পড়লে তেমন কোনো বিচার-আচার হয় না। তিনশ ইউরোর নিচে ছিনতাই করে ধরা পড়লে পুলিশ অফিসে সামান্য জরিমানা দিয়ে তারা পার পেয়ে যায়। তিনশ ইউরোর বেশি হলে খানিক ঝামেলা পোহাতে হয়। ঢাকার সঙ্গে বার্সেলোনার বড় পার্থক্য এখানেই। পাবলিকের হাতে মার তো আছেই, ছিনতাইকারীদের জেল-জরিমানা হরহামেশা ব্যাপার। শুধু তা কেন, কয়েক বছর আগে তো ছিনতাইকারীদের পুড়িয়ে মারার, পিটিয়ে মারার হিড়িক পড়ছিল ঢাকায়। ধানমন্ডির ১৩ নম্বরে থানার কয়েক হাত দূরে এক ছিনতাইকারীকে সিএনজিতে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল চোখের সামনে। কিচ্ছু করতে পারিনি সেদিন। অসহায়, নিজের মুখে নিজের পায়ে লাত্থি মারারও জো নেই আমাদের। পুড়িয়ে মারা যে কী ভয়াবহ দৃশ্য! অথচ দেখেন, এই বার্সেলোনার সোসাইটি কত ছিনতাইকারী ফ্রেন্ডলি। এই ফ্রেন্ডলি সোসাইটিতে ঢাকার ছিনতাইকারীরা যোগ দিলে কত ভালো হয়। বেচারারা কেন যে কবি লেখক সাংবাদিক শিক্ষকদের টার্গেট করে!
সামান্য ছিনতাই! সামান্য বললে কম বলা হয়। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে মরতে হয়েছে এমন ঘটনা তো আছেই আমাদের। তবে গুম-খুনের সমাজে অসামান্য কায়দায় আরবান ছিনতাই অতি সামান্যই বটে!
দুনিয়ায় কত যে আজব কা-, আজব নিয়মরীতি!
২.
শিল্প সাহিত্যের স্পেনে এখন নতুনদের জন্য কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে
বার্সেলোনা টেকনোলজি ইউনিভার্সিটির জর্দি গিরোনোর হোস্টেল থেকে বের হয়ে মিনিট পাঁচেকের হাঁটা পথ, কাছেই পালাও রিয়েল মের্টেরা স্টেশন। চেপে বসলাম ট্রেনে। আজ আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন ফিলিপাইনের আল আলেগ্রে, বাংলাদেশের রেজা সেলিম। হামাদা, বয়িংগিল, সিয়াংহো, মানাভি তো আছেই। রেজা সেলিমের সঙ্গে দেখা কয়েক বছর পর। দেশে যোগাযোগ হয়ে ওঠে না। নগরের ব্যস্ততা অনেক কিছুর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কগুলোও কেড়ে নিয়েছে। আরবান লাইফে সম্পর্কের মর্যাদা কদাচিৎ মেলে। ভাঙন যে কেবল আরবানে তাও নয়, এখন তো গ্রামেও একই অবস্থা। সোসাইটির যে হারমোনির কথা আমরা বলি গর্ব করে তা উবে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। আমরা কী টের পাচ্ছি? স্যানটাস এস্টাসিওতে মেট্রো চেঞ্জ করে ডিয়াঙ্গল গিয়ে নামলাম। উদ্দেশ্য কাসা মিলা দেখা। স্টোন দ্বারা তৈরি প্রাচীন প্রাসাদ। এই প্রাসাদের ডিজাইনার গাউদি। তাকে নিয়ে মিউজিয়ামও বলা যায় এটিকে। শত বছরেরও আগে এটি করেছিলেন গাউদি। সেখানে তিনি থাকতেনও। ইউনেস্কো ঘোষিত ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত এটি। নন্দিত আর্কিটেক্ট গাউদি। শিল্পিত ডিজাইন। হাজার হাজার দর্শক প্রতিদিন এটি ভিজিট করতে আসেন। ১৫ ইউরো টিকিট। তো পৌঁছে দেখলাম হাতে সময় এক ঘন্টাও নেই। ৮টায় বন্ধ হয়ে যাবে। রিসেপশন থেকে দায়িত্বরত মেয়েটি জানালো সময় কম, অল্প সময়ে অনেক কিছু দেখা যাবে না। কিন্তু চায়নার বন্ধুটি দেখবেই। তিনি কাজ করেন ইউনেস্কো হেডকোয়ার্টারে। প্যারিসে। আমি আল আলেগ্রে আর সেলিম ভাই গেলাম না। ভাবলাম ঘুরে দেখি আশপাশ। সময় নিয়ে এসে দেখা যাবে এই হচ্ছে আমাদের প্ল্যান।
তো আমরা লাগোয়া সুভ্যেনির শপ লা প্যাডেরাতে ঢুকলাম। নানা ধরনের স্যুভেনির। এটা লাইব্রেরি না, তবু কিছু বইপত্র আছে। স্প্যানিশে। হুট করে দেখি, জর্জ অরওয়েল। না, অ্যানিমেল ফার্ম বা নাইনটিন এইটি ফোর না। বইয়ের নাম ‘হোমেজ টু কাটালুনিয়া’। নাইনটিন এইটি ফোর নামে আরো একজন খ্যাতিমান লেখকের বই আছে। হারুকি মুরাকামির। সেবারে মিডিয়া বিষয়ে একটি কনফারেন্সে আলোচক হিসেবে দাওয়াত পেয়েছি টোকিওতে। কনফারেন্স শেষে দু-চারদিন সাধারণত হামাদার বাসাতেই থাকি আমি। টোকিও নগরে বন্ধু হামাদাসহ ঘুরছি। ঢুকলাম লাইব্রেরিতে। ২০১০ সালের দিকে হবে। কোনো ইংরেজি বই পাইনি। এই সমস্যা কেবল টোকিওতে নয়। ইংরেজিতে অনূদিত বই পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে এমনকি ইউরোপেও। প্যারিসেই বলেন বা ব্রাসেলসে, মাদ্রিদ বা মেক্সিকো সিটি, সিউল ইত্যাদিতে কদাচিৎ পাওয়া যায় সেসব দেশের সাহিত্যের বইগুলো। ফিকশন যদি দু-একটা মিলেও কবিতার বই পাওয়া ভার। তো, তারাতা বলল (হামাদার ডাক নাম তারাতা) মুরাকামির সর্বশেষ প্রকাশিত নতুন বই নাইনটিন এইটি ফোর। পরে আমি ওয়াশিংটন থেকে মুরাকামির বইটি কিনি। আমার পছন্দের লেখক। তাকে প্রসঙ্গ করে সম্ভবত কবিতাও লিখেছিলাম। বেশ জনপ্রিয় লেখক তিনি। আমাদের নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদ মৃত্যুর আগে মুরাকামি নিয়ে লিখছিলেন প্রসঙ্গক্রমে তার কোনো এক লেখায়। মুরাকামির দু-একটা অনুবাদও বাংলায় চোখে পড়েছে সাময়িকীর পাতায়। অনুবাদ ভালো লাগেনি। মুরাকামি এখন লেকচার দিয়ে বেড়ান দেশে দেশে। ডাকসাইটে লেখক। যেকোনো এয়ারপোর্টে দোকানগুলোতে বেস্ট সেলিং বুক হিসেবে মুরাকামি পাচ্ছেন আপনি। বেশ কয়বার নোবেল পেতে পেতে ফসকে যাচ্ছে। বেচারা!
দোকানে খুব ভিড় নেই। কেউ কেউ ঘুরে দেখছে জিনিসপত্র। যেমনটি অমরা দেখছি, দাম দেখছি, কোনো কিছু পছন্দ হচ্ছে না তেমন। কিনবই বা কী। মনে হলো দু-একটা নোটখাতা কিনি। নোটখাতা, লাইটার ও কলমের প্রতি আমার তীব্র টান আছে। সুযোগ পেলেই কিনে ফেলি। কিন্তু জর্জ অরওয়েল উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে ভাবতে লাগলাম আন্দা লুসিয়ার কথা। মহান কবি গার্সিয়া লোরকার কথা। লোরকা তো সেই কবেই পড়েছি। গেল কয়বছর আগে আবার সাজ্জাদ শরিফের অনুবাদে বের হয়েছে লোরকার কবিতা। আটকুঠুরি একটা অনুষ্ঠানও করেছিল সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে, ঢাকায়। সেখানে গিয়েছিলাম। বইটি কিনেছি, পড়েছিও। অনুবাদ মন্দ হয়নি। কিছু কবিতার বেশ ভালো অনুবাদ আছে।
মাথায় তখন আন্দালুসিয়া, কর্দোভা আর লোরকা। তো ভাবলাম, এবার ঘুরে যাব। বেশ কয়বার স্পেনে এলেও মাদ্রিদের বাইরে যাওয়া হয় না। এবার আন্দালুসিয়া পেয়ে বসেছে। ভাবলাম, দোকানিকে কিছু জিগাই। ক্যাশে যে মেয়েটি বসে আছে তাকেই জিজ্ঞাস করি কিভাবে যেতে হয়, কতদূর পথ ইত্যাদি। সম্বোধন করে ওর সঙ্গে আলাপ তুললাম। দেখলাম, সেও কথা বলতে আগ্রহী। সে এক টুকরা কাগজ বের করে লিখছে, আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমাদের মানে আমি আর রেজা সেলিম। আমি বললাম যে আন্দালুসিয়ায় যেতে চাই লোরকার সঙ্গে দেখা করতে। সে জানাল তার বাবার বাড়ি আন্দালুসিয়ায়, মায়ের কাটালুনিয়ায়, সে জন্মেছে বার্সেলোনায়, ভাই থাকে মাদ্রিদ ইত্যাদি। সঙ্গে সঙ্গে জানিয়ে দিচ্ছে কিভাবে ট্রেনে করে যাওয়া যায়, ৮০০ কিলোমিটার হবে বার্সেলোনা থেকে। হাইস্পিড ট্রেনে ঘন্টা চারেক সময় লাগবে। আরো জানাল যে, খাবারের জন্যও আন্দালুসিয়া বিখ্যাত। সাদা কাগজের মতো আন্তরিক মেয়েটির প্রাণভরা হাসি মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিল।
মেয়েটি কী করে আমি জানতে চাইলাম। হুট করে আপনি কারো সম্পর্কে জানতে চাইতে পারেন না ইউরোপে, বিশেষ করে প্রাইভেসি অধিকার সেখানে গুরুত্বপূর্ণ। পড়াশোনা কী, পার্টটাইম চাকরি করেন কি না এসব প্রশ্ন করা প্রাইভেসি লঙ্ঘনের শামিল। কিন্তু ওর আন্তরিকতা ও উচ্ছলতা দেখে মনে হচ্ছে আলাপে আপত্তি নেই তার। তো আমাদের আলাপ চলছে। রেজা সেলিম অনুমতি নিয়ে আইফোন দিয়ে ক্লিক করছেন।
ওর নাম রোসিও জানাল। শিল্পী। ছবি আঁকে। ইলাস্ট্রেশন করে। আর্টে গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি নিয়েছি শপিং স্টোরে। রোসিও জানাল, ইলাস্ট্রেশনের জব পাওয়া অত সহজ না এখানে। বুঝলাম অর্থনৈতিক মন্দা স্পেনের মাথা খারাপ করে দিয়েছিল একটু বেশিই। কাটিয়ে উঠতে চাইলেও এখনো তো বেকারত্বের হার ২৬ শতাংশ। শিল্পসাহিত্যের ইতিহাসে স্পেনের কদর থাকলেও এখন নতুনদের জন্য জব কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এখানকার মানুষজন একটু পেশানেট, আন্তরিক। মাইগ্রেশন নিয়ে ঝামেলা আছে। মরক্কো থেকে যখন-তখন চলে আসে। কিছুদিন আগে এ নিয়ে তো হাঙ্গামাও হয়েছিল। খোদ ইউরোপের অপরাপর দেশগুলোতে রাইট উয়িং সরকারগুলো অভিবাসনের বিপক্ষে। কিন্তু জগতের ইতিহাস পাল্টে দেওয়া তো যায় না। মানুষের সভ্যতার ইতিহাস অভিবাসন দিয়েই শুরু। সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে মানুষ একদিন ঠিকই ঠিকানা খুঁজে পায়, যদিও কত কত মানুষ সমুদ্রেই শেষ আশ্রয় নেয়।
কথা বলছি, রোসিও এঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কোথায় কী, হাসছে। পিকাসো মিউজিয়াম খুব দূরে নয় জানাল সে। পিকাসোকেও দেখে যেতে চাই। অদ্ভুত কিছু বিষয় আছে আমার। যেমন কবরখানা ঘুরে দেখা। কবরখানা তো প্রাণের সমাহার। কবর দেখতে যে খুব ভালো লাগে তেমন নয়, কিন্তু কবরে শায়িত শত শত প্রাণপ্রাচুর্যের মানুষ, শত মনীষা। এদের দেখতে গেলে মন ভার ভার হয়, জগতের-জীবনের বিচিত্র রূপ ও সংস্কারের কথা মনে আসে। প্যারিসের প্যালেসেসে গিয়ে তো রীতিমতো ভিমরি খাওয়ার অবস্থা। বিশাল। অ্যাপোলিনিয়র থেকে শুরু করে জিম মরিসন। কত সহগ্র মনীষা শুয়ে আছেন নীরবে। গেল মাসে লন্ডন গিয়ে বানহিল ফিল্ডস বারিয়্যেল গ্রাউন্ডে ঘুরে দেখলাম কবরে শায়িত প্রিয় কবি উইলিয়াম ব্লেক, সঙ্গে তার স্ত্রী ক্যাথরিন সোফিয়া। সম্ভবত অতীতের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক ভবিষ্যতের চাইতেও গভীর।
রোসিও তার ওয়েবসাইট জানিয়ে মন্তব্য করতে বলল। আমিও ভিজিটিং কার্ড দিয়ে বললাম যে, আমার নেক্সট বইয়ের কভার তার দ্বারা ডিজাইন করাতে চাই। সে সম্মতি জানিয়ে হাসল।
সাদা পৃষ্ঠার মতো হাসির উচ্ছ্বাস চোখের আড়ালে রেখে মনে মনে আনন্দ নিয়ে বেরিয়ে আসলাম লা পেডরেরা থেকে। রোসিরা নিশ্চয়ই আরো অনেক বড় হবে। জগতের বহুরূপ ইলাস্ট্রেশনের সঙ্গে রোসিরও জীবন ইলাস্ট্রেশনময়, শিল্পিত হবে। ততদিনেও জীবনের জন্য জীবন হারিয়ে আমাদের সংগ্রাম চলবেই!
৩.
তারা নোবেল একাডেমির সঙ্গে রীতিমতো দফারফা করতে চায়
কথা হচ্ছিল লিউনার্দোর সঙ্গে। বার্সেলোনা টেক ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসেই তার অফিস, একটি মেম্বারশিপভিত্তিক সংগঠনের পরিচালক। এনজিওর অফিস বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে এটা সহজ নয়, অন্তত আমরা ভাবতে পারি না। বাংলাদেশে এনজিওরা ভুঁইফোড় আকারে হাজির করেছে নিজেদের। সমাজে মর্যাদা কিছুমাত্র আছে বলে মনে হয় না ওদের। কর্পোরেট বিশ্বায়নের কালে নিজেদের মত ও পথ অনুয়ায়ী কাজ করতে পারা সোজা নয়। অবশ্য সমাজের আগাগোড়া নেই যেখানে, সেখানে কেবল এনজিও কেন, সাহিত্য সংস্কৃতি, মিডিয়া, ব্যবসা, সরকার, অ-সরকার সবকিছুর অবস্থাই তো জগাখিচুড়ি। কথায় কথায় লিউনার্দো জানাল যে, বার্সেলোনাকে বলা হয় সাহিত্যসংস্কৃতির সিটি। সিটিতে অনেক জায়গাতেই সাহিত্যের আড্ডা হয়, বিভিন্ন হোটেল রেস্টুরেন্ট পার্ককে ঘিরে এসব আড্ডায় কবি লেখক সাহিত্যিকরা আসেন। বললাম, আমি এমন কিছুই খুঁজছি এবং তার সাহায্য পেলে জায়গাগুলো ঘুরে দেখতে চাই। ইউরোপের অনেক দেশেই এটা একটা সমস্যা যদি ভাষাটা আপনার জানা না থাকে। ফ্রেঞ্চ বলেন আর স্প্যানিশ বলেন কোনোটাই জানা নেই আমার। এ নিয়ে বিপত্তি কম নয়, বিপদে পড়তে হয় মাঝেমধ্যেই। ওরা আবার ইংরেজি-টিংরেজি পাত্তা দেয় না। তো অগত্যা ভরসা করতে হয় চেনাজানা লোকদের উপর। সেটা সবসময় ভরসার হয় না। সাহিত্য নিয়ে তো আর সবার মাতামাতি নেই!
লিউনার্দো জানাল যে, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের অদূরেই একটি পাবলিশিং হাউজ আছে, বিখ্যাত হাউজ যারা মূলত লেখালেখি প্রমোট করে, কিন্তু এটা ব্যবসার আওতায়। ইউরোপ আমেরিকায় এমনটি পাওয়া কঠিন কিছু নয়। সাহিত্যকে প্রমোট করার জন্য বহু প্রফেশনাল লবিহাউজ, লবিস্ট, প্রকাশনা আছে। এটা নোবেল প্রাইজ উইনার হোক, বুকার হোক বা বেস্ট সেলার হোক, তারা এটি করে থাকে ওই লেখকদের জন্যও। নোবেল একাডেমির সঙ্গে তো রীতিমতো দফারফা করতে চায়। সাহিত্য বাজারের অংশ এইটা মানতে না চাইলেও সাহিত্য এখন সত্যিই বাজারের অংশ। বাজারই যেন সাহিত্যের, শিল্পের নিয়তি। বাজার অবশ্য আমাদেরও আছে। তবে এখানে ভালো লেখকদেরকেই প্রমোট করে লবিস্টরা, আমাদের এখানে হয় তৃতীয় শ্রেণির লেখকদের প্রমোশন। প্রফেশনাল প্রকাশনা বা লবিস্ট না থাকলেও আমাদের দেশে প্রথম আলো, প্রথমা, বেঙ্গল ইত্যাদি মুখ চিনে অনেকেরই লেখাজোখা বাজারজাত করে। শুধু তা কেন, এখন তো বাঙালি সংস্কৃতির ধারকবাহক হয়ে উঠতেছে বেঙ্গল। বৈশাখী মেলা থেকে শুরু করে উচ্চাঙ্গ সংগীতের আসর জমানো তাদেরই কাজ। আমাদের সংস্কৃতিপাড়া ওদের হাতেই সঁপে দিয়েছে কূলমান! তবে সবার উদ্দেশ্য কিন্তু একই রকমের, ব্যবসা করা। তো আমাদের প্রকাশনা শিল্পটাই দাঁড়াল না। চকচক করলেই তো সোনা হয় না। রংচং বইয়ের ঢং দেখে চোখ জ্বলে আমার। যা তা অবস্থা, বইমেলা এলেই সেটা বোঝা যায়। প্রকাশনা ব্যবসা আছে, আরো নানা ফন্দি ফিকিরের সঙ্গে এটাও আছে; যে কারণে বহু আবর্জনা আর বাজে লেখককে প্রমোট করতে তো চোখের সামনেই দেখছি আমাদের দেশে। এসবের জন্য পুরস্কার প্রদানের হিড়িকও কম নয়। কিন্তু বাইরে বাজে লেখক নেই তেমন নয়, কিন্তু বাজে লেখা প্রমোট কম করা হয়। বা করলেও সেগুলো আখেরে ফল পায় না। লিউনার্দো জানাল যে ইউকের একটি প্রকাশনার সঙ্গে কাজ করে এমন একজন লবিস্ট ভদ্রমহিলা সাহিত্যকে বাজারি করার কাজ করেন বার্সেলোনার প্রকাশনাটির সঙ্গে।
বাংলা একাডেমির ‘হে উৎসব’ ওরকম পরিকল্পনার অংশ কি না! ডেইলি স্টার তো আছেই। তাহমিমা আনামকে প্রমোট করার পেছনেও তো কাজ করছে প্রকাশনা সংস্থা। দৈনিকটিও কম করেনি। সেটি অন্য কথা, তবে প্রমোট করতেই পারে, দোষের কিছু নয়। বাংলাদেশে ইংরেজি লেখকদের প্রমোট করা, দু-চারজনকে বেছে নেয়া বাজারি সাহিত্যের জন্য খুবই দরকারি। গেল বছর হুট করে জানলাম, প্রবাসী বাঙালি একজন লেখককে বই প্রকাশের আগেই নামিদামি একটি প্রকাশনা কোম্পানির পেছনে খরচ হয়েছে লাখ পনেরো টাকা। বইটি প্রকাশ হয়েছে বটে, দেখেছিও। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত!
আমি বলছিলাম গার্সিয়া লোরকার কথা। আন্দালুসিয়ার কথা, কর্দোবার কথা। কর্দোবা আন্দালুসিয়ার কাছাকাছি। আন্দালুসিয়ায় যেতে, মানে বার্সেলোনা থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূর, যেতে যদিও ঘন্টা চারেক সময়। মুশকিল হচ্ছে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে না। এটা একটা সমস্যা, যদি টিকিট আগে না কাটেন তো কপালে দুর্ভোগ আছে। তিনগুণ বেশি দামেও টিকিট পাওয়া ভার! মুশকিলে পড়ে আছি।
তো অগত্যা পিকাসো মিউজিয়াম যেতে চাই। ক্যাটালুনিয়া থেকে খুব দূরে নয়, হাঁটা দূরত্ব। আমার আগ্রহ ছিল ওখানে গিয়েই ডিনার সারব। কিন্তু রোমানিয়ার রোজি জানাল আশপাশে রেস্টুরেন্ট নেই, কেবল জুতার দোকান। হুম, এখানে জুতা আর কাপড়ের দোকানগুলোই মনে হয় বাজার দখল করে আছে। এইচ অ্যান্ড এম এর বিশাল বিশাল বিল্ডিং। রানা প্লাজা বিপর্যের পেছনে ওদের দায় তো কম নয়। তো মিউজিয়াম ঘিরে জুতার দোকান আমার একটু বেখাপ্পা লাগল। মনে পড়ে গেল ‘রেপ অব দ্য লক’র কথা। আলেক্সান্ডার পোপ ভালোই রসিক ছিলেন। রীতিমতো একটা সামান্য বিষয় নিয়ে মহাকাব্য লিখে ফেললেন। চুল নিয়ে মহাকাব্য বিশ্বসাহিত্যে দ্বিতীয়টা আছে বলে জানা নেই। কিন্তু ‘রেপ অব দ্য লক’ তো আর ‘প্যারাডাইজ লস্ট’ বা ‘মেঘনাদ বধ’ নয়, এটা মক এপিক। তো ওখানের বৈসাদৃশ্য বোঝানোর জন্য বাইবেলের পাশে জুতোর উদাহরণ ছিল। মকারিই বটে। পিকাসো মিউজিয়ামের পাশে জুতার দোকান, মকারিই মনে হলো।
মশকরা এমন আরো আরো অনেক হয়। সব তো লেখায় ওঠে আসে না। এখন ফিল্ম হয়, ভিডিও হয়, নাটক সিনেমা কতকিছু হয়। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিংয়ের যুগ বলে কথা। ভিডিও জনপ্রিয় বিষয়, ফান ভিডিও যেমন।
ক্যাটালুনিয়া স্টেশনে নেমে বের হতেই বিশাল গ্রাউন্ড, বিশাল বিশাল বিল্ডিং দাঁড়িয়ে আছে। ফোয়ারার জলগুলো উপরে ওঠে নিচে নেমে যাচ্ছে চূর্ণচূর্ণ জলের কণা ছড়িয়ে। তার পাশে অনেক ম্যূরাল। এখানে চোখ মেলে দেওয়া ছাড়া কাজ কি! বুক ভরে বাতাস নিন। তো দেখলাম চারজন তরুণী হুট করে এসে অভিনয় শুরু করে দিচ্ছে, হালকা নাচের ভঙিমা। ক্যামেরাম্যান ছেলেটাকে দেখে নাদান মনে হলো। আমাদের ওখানেও নাদান লোকের সংখ্যাও কম নয় আর। নাটকের নামে দেশটায় যা হচ্ছে আজকাল, আল্লাহ মালুম! সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনেরও একই অবস্থা। যার যা খুশি, নাটক সিনেমা প্রকাশনা তৈরিতে নেমে পড়ছে, ব্যাঙের ছাতার মতো টেলিভিশনের যেমন অভাব নেই, ডকুমেন্টারি আর ফিল্ম মেকিংয়ের জন্য ডিরেক্টর আর অভিনেতা-অভিনেত্রীরও অভাব নেই। কিছু একটা লিখলেই স্ক্রিপ্ট হয়ে যায়, কয়েকজন মিলেমিশে ভিডিও করে টিভিতে জমা দিয়ে দিলেই প্রচারও হয়ে যায়। কী-ই বা করবে আর। গুম, খুন আর ইয়াবা, পুলিশ র্যাব আর সরকারের উৎপাতে এইগুলা করতে পারাও কম কথা নয়। জীবন-জীবিকা তো চালাতে হবে গুম-খুনের আগ পর্যন্ত।
এগিয়ে গিয়ে জিগাইলাম তারা কোনো নাটক তৈরি করছে কিনা। সে বলল যে, একটা ফান ভিডিও তৈরি করতে মাঠে নেমেছে তারা। মেয়েরাও বলল যে, তারা ফান ভিডিও করছে। অঙ্গভঙ্গি, ভঙ্গিমা দেখেই তাই মনে হয়েছিল।
লিউনার্দোর মেল করার কথা আমাকে ডিটেল জানিয়ে কোথায় শিল্প সাহিত্যের আখড়া। কিন্তু কই? দেখলাম রোসিওর মেইল। ভাবছি রোসিওকে বলি পিকাসোতে যেতে। নিদেনপক্ষে পিকাসোকে ঘিরে যদি লেখক কবি শিল্পীদের সঙ্গে দেখা হয় তাইলে মন্দ হয় না! একা যেতে ভালো লাগে না কোথাও।
৪.
নারীঘটিত আনন্দ-বেদনা, উত্থান-পতনে ঘিরেছিল তার সারাটা জীবন
শেষ পযর্ন্ত পিকাসো মিউজিয়ামে যাব বলেই পণ করেছি। হোস্টেলে রিসিপশনে মিরেইয়াকে জিজ্ঞাস করলাম মিউজিয়ামের লোকেশন। রোসিও আমাকে আগেই মিউজিয়ামের কথা বলেছিল যে, এটা জউমিতে, মন্টগাদায়। তো কথা বলছি মিরেইয়ার সঙ্গে। নানা কথা, কোথায় যাওয়া যায়, কালচারাল হাব কোথায়, শিল্পী লেখকরা কোথায় আড্ডা দেয় বা দেয় কিনা, গ্রানাদায় কী করে লোরকাকে দেখতে যাওয়া যায় এসব। সে জানাল যে, তার বাড়ি গ্রানাদায়। এটি কাকতালীয়। রোসিও বলছিল যে, তার বাবার বাড়ি আন্দালুসিয়ায়, মিরেইয়া জানাল গ্রানাদায়। ট্যুরিজমে গ্রাজুয়েশন শেষ করে চাকরি নিয়েছে এই কোম্পানিতে। মানে বিশ্ববিদ্যালয়ের যে হোস্টেলে উঠেছি এটি মূলত রেসা নামে একটি কোম্পানির, যাদের এই টেক ইউনিভার্সিটির সঙ্গে চুক্তি আছে। স্টুডেন্টরা যেমন থাকতে পারে এখানে, অন্যরাও এখানে থাকতে পারে। তুলনামূলকভাবে ভাড়াটা একটু কম। যদিও এখানকার ভাড়া নির্ভর করে সিজনের উপর। আমাদের ওখানেও তাই। কক্সবাজার সারা বছর খালি পড়ে থাকে, অল্প ভাড়ায় আপনি থাকতে পারবেন, কিন্তু শীতকালে ভাড়া হয়ে যায় কয়েকগুণ বেশি। এটা কেবল বার্সেলোনা বা ব্রাসেলস বা নিউইয়র্কেই নয়, লন্ডনে, সিউলেও তেমনটিই দেখছি। গত মার্চে সিউলে এক হোটেল বুক করতে গিয়ে দেখি শনি, রোববারে তাদের ভাড়া বেশি অন্যান্য দিনের তুলনায়। কারণ তখন অনেক ব্যবসায়ী, প্রেমিক-প্রেমিকা, কাপলরা বেড়াতে আসে। ভাড়াটা বাড়িয়ে দেয় একটু।
মেট্রোয় চেপে বসলাম আমরা কয়েকজন, এক ধরনের টিম ভাব হয়ে গেছে আমাদের মধ্যে। তো, পাশেই দেখা রোহিণীর সঙ্গে। গতকাল এসেছে, চলে যাবে আগামীকাল। বম্বে থাকে সে। জানাল, মিউজিয়ামে যেতে তারও আপত্তি নেই।
নেমে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম। যেতে যেতে ছবি তুলছি। বার্সেলোনার রাস্তাঘাট বড় বড়। বিশাল বিশাল গ্রাউন্ড। সবুজের সমারোহ তো আছেই। প্রচুর গাছপালা। শহরটি একটু হিলি। হাঁটতে একটু কষ্ট হয় বৈকি! এখানে মন ভরে আকাশ দেখা যায়, বিশাল আকাশ; বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। ঢাকার মতো ধুলা, ধোঁয়া, ট্রাফিক জ্যাম নেই। কিন্তু মানুষ কম না দেখছি। প্রচুর ট্যুরিস্ট তো আছেই। হাঁটছি মিউজিয়ামের দিকে। এক ধরনের এক্সাইটমেন্ট তো কাজ করছেই। বড় বড় শিল্পীদের কাছাকাছি গেলে কেমন যেন হালকা লাগে নিজেকে, জগতের ভারও মনে হয় কমে যায় অনেকটা। অন্তত এতটুকু সান্ত¡না আছে যে, পিকাসোকে দেখে যাওয়া হচ্ছে। গার্সিয়া লোরকা, আপনি শান্তিতে ঘুমান গ্রানাদায়, কোনো এক সময় নিশ্চয়ই দেখা হয়ে যাবে।
মিউজিয়ামে যেতে হয় তুলনামূলকভাবে বেশ সরু পথে। তো আমরা টিকিট কাটলাম ১১ ইউরো দিয়ে প্রত্যেকে। সঙ্গে কিছু নেওয়া যাবে না। তবে মোবাইল থাকতে পারে সঙ্গে, কিন্তু ছবি তোলা নিষেধ। মনটা দমে গেল খানিক। ভাবছিলাম ছবি তুলব। সে গোড়াতেই মাটি। আমরা দোতলায় উঠছি। ছবি দেখছি। ছবির নাম, সাল তারিখসহ লেখা। কখন ডোনেট করা হয়েছে মিউজিয়ামে তারও হদিস আছে। পিকাসোর শৈশব ও কৈশোরের ছবিগুলো প্রথমেই চোখে পড়বে আপনার। অনেক কক্ষ, একেকটা কক্ষে একেক কালপর্বের ছবি। বেশির ভাগ ছবি দেখছি ১৯৭০ সালের দিকে পিকাসো ডোনেট করেছেন মিউজিয়ামে। ছোটবেলাতেই তিনি বড়বেলার কারিশমা দেখিয়েছিলেন ছবি আঁকায়। গ্রেট ট্যালেন্ট হলে যা হয়! মহাত্মা ছাড়া তো আর এমনটি হয় না! আমাদের কাজী নজরুলও তেমন মহাত্মাই ছিলেন। ছোটবেলাতেই বড় বেলার মাজেজা দেখাতে পেরেছিলেন। এস এম সুলতানও তো কম ছিলেন না।
ছবি দেখছি। হুট করে ভাবলাম কথা বলি একটু। প্রতিটি রুমে একজন করে পাহারায় আছে, মানে দায়িত্বে আছে। তারা খেয়াল রাখে কে কী করে। ছবি তোলা তো নিষেধ। একটি বড় ছবির সামনে দাঁড়িয়েছি। ছবিটি হচ্ছে অন্নপ্রাসনের, লোরকার বোন লোলা ছবিতে, এগিয়ে এসে মেরিনা বলল। আমি পরিচয় দিয়ে জিগালাম সে কবে থেকে এখানে কাজ করছে। মেরিনা জানাল, মাস তিনেক, হিস্ট্রি অব আর্টস-এ গ্রাজুয়েশন করে অগত্যা এই চাকরিতে ঢুকেছে। আমি বললাম, এটা তো মজার চাকরি, কত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়, কত না দেশের, কত না রকমের মানুষ। ভালোই তো। মনে হলো খুব একটা পছন্দের না, কোনোমতে কেটে যাচ্ছে তার এই জবে। সুযোগ পেলেই বদলে ফেলবে। আমি বললাম যে, ছবি কী কোনোমতেই তোলা যায় না? সে মিস্টি হাসি দিয়ে না-সূচক জবাব দিল। মনে হলো তাদের অগোচরে কেউ যদি তোলেই ফেলে তো ফেলে আর কি। মনে একটু হালকা সাহস নিলাম। কিন্তু যেভাবে রুমে রুমে চোখে চোখে রাখে দেখে ফেললে তো বিপত্তি, শরমেরও বিষয়। কিন্তু নিষেধ মানা কী সম্ভব পিকাসো মিউজিয়ামে এসে। আমি মোবাইলে নোট নিচ্ছি কিছু কিছু চিত্রকলা দেখে। তো হুট করে ক্লিক মারলাম। নিষেধ অমান্য করার কী যে স্বস্তি, কী যে শান্তি!
অনেক চিত্র। জানা গেল ৪২৫০টির মতো চিত্র আছে এই মিউজিয়ামে। পিকাসোর নবিস ছবিগুলো এখানেই পাওয়া যায়, যখন সবে বালকমাত্র তিনি। এই চিত্রগুলো মূলত ওয়েল অন ওয়াটার, অয়েল অন ক্যানভাস। পাখি নিয়ে, বাড়িঘর নিয়ে, সমুদ্র ও প্রকৃতি নিয়ে ইত্যাদি। রুমে রুমে সাজানো চিত্রগুলো কালপর্ব বিবেচনা করে দেখলে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা, রং ও কাজের পরিবর্তন স্পষ্টতই চোখে পড়বে। কখনো কেবল রেখা, কখনো রঙের বাহুল্য, কখনো ব্লু, সাদা-কালো-লালের মিশ্রণ ইত্যাদি। তার সিরামিকসের কাজগুলো দারুণ। সিরামিকসে ৪২টি চিত্র। পিকাসোর মৃত্যুর পর তার স্ত্রী জেকলিন সেগুলো মিউজিয়ামে ডোনেট করে দেন।
১৯০১ থেকে ১৯০৪ সাল ছিল পিকাসোর ব্লু পিরিয়ড, ১৯০৫-১৯০৬ রোজ পিরিয়ড। ১৯০১ সালে প্যারিস যাত্রার পর তার চিত্রে রঙের পর্ব বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই পর্বের চিত্রগুলো রাখা আছে ৮ নম্বর কক্ষে, প্রথমে ঢুকেই নজরে ১৮৯০-১৮৯৫ সালের চিত্র। ১ থেকে ১৬টি কক্ষে এবং বি১, বি২ তে চিত্রকর্মগুলো রাখা। ১৬ নম্বর কক্ষে ও বি২ তে তার সিরামিকসের কাজ। এন হচ্ছে নিউ ক্ল্যাসিক্যাল হল। বি১ জউমি সাবার্টেস গ্যালারি। ৯, ১০, ১১ নম্বরে ১৯১৭ সালে বার্সেলোনায় আঁকা চিত্রগুলো। এইভাবে কালপর্বে রাখা।
পিকাসোর নিজের সেল্ফ পোর্ট্রেট আছে। আরো অনেকের পোর্ট্রেট আছে। যেমন বেনেডেটা বিয়ানকন, সেবাস্টিয়া জুনিয়েন্ট, রেমন রিভেনটস প্রমুখের। বিশালাকৃতির পোর্ট্রেট। পিকাসোর স্ত্রী জেকলিনের একটা চমৎকার চিত্র আছে। সাদা-কালো। হালকা লাল আছে কোণায়। দুই ধরনের অভিব্যক্তি সেখানে। সাদা অংশটা বেশি আর কালোটা কম। বিষয়টা এমন যে, জেকলিনের ভালোমন্দ গুণাগুণ এখানে রূপায়িত করেছেন শিল্পী। শুধু জেকলিন কেন, মানুষের ভালোমন্দ রূপের চিত্রায়ণই এটি। নারীদের নিয়ে আরো ছবি আছে। পোর্ট্রেট আছে। একটা পর্বে দেখলাম অনেকটা ডার্কনেস চিত্রগুলোয়। নারীদের চিত্রগুলো দু-একটা ছাড়া খুব ব্রাইট না। ফিমেল ন্যুড পেইন্টিং ছাড়াও দু-একটা হরর টাইপের চিত্র দেখলাম। যেমন : ‘দ্য ডেড নিউ বর্ন বেবি’, ‘এট দ্য সাইড অব এ ডেড ম্যান’ ইত্যাদি। সবচেয়ে মজা লাগছে কেবল ফ্রেমের উপর আঁকা চিত্রকর্মটি। মনে হতে পারে এখান থেকে ছবিটি সরিয়ে রাখা হয়েছে সাময়িকভাবে, শুধু ফ্রেমটা পড়ে আছে। মজার বিশাল ফ্রেম। নারীদের উপর তার চিত্র কম নয়। ‘উইম্যান রেসিস্টিং দ্য এমব্রেস অব ম্যান’ নামে ছবিতে মেয়েটি পুরুষটি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাইছে। ‘দ্য কিস’ নামে ছবিটিও দারুণ। এগুলো ১৯০০ সালে আঁকা। এ ধরনের আরো ছবি আছে। অবশ্য পিকাসোর ব্যক্তিজীবনে প্রেম ও নারীদের বাহুল্য ছিল বেশ। নানা অভিজ্ঞতা ও প্রেম-অপ্রেমে তিনি সারাটা জীবনই কাটিয়েছেন। নারীঘটিত আনন্দ-বেদনা, উত্থান-পতন ঘিরেছিল তার সারাটা জীবন। শিল্পীর জীবন বলে কথা!
মিউজিয়ামটি ১৯৬৩ সালে শুরু হয়। পিকাসোর ঘনিষ্ঠ বাল্যবন্ধু জউমি সাবার্টেস মিউজিয়ামটির উদ্যোগ নেন। ১৯৩৫ সালে তিনি পিকাসোর পারসোনাল সেক্রেটারি হয়েছিলেন। অন্য অনেকের সহযোগিতায় মধ্য পঞ্চাশে সাবার্টেস মিউজিয়ামের প্রকল্পটি হাতে নিয়েছিলেন। ব্যক্তির উদ্যোগে জগতের মহান কীর্তি হয়ে থাকে। প্রতিষ্ঠান টিকে থাকে মর্যাদা নিয়ে, শিল্প ও সৌন্দর্যের অভিব্যক্তি নিয়ে। আর আমরা প্রতিষ্ঠান ভাঙ্গি। প্রতিষ্ঠান তো পারছিই না তৈরি করতে, যেগুলো ছিল সেগুলোও রাজনৈতিক হানাহানি আর ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে বিনাশ করে ফেলি। আমাদের শিল্পীদের নিয়ে, কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে জাদুঘর কই? আহমদ শরীফ, আহমদ ছফা, হুমায়ুন আজাদ মাপের মানুষ সহসা তো জন্মাবে না। জয়নুল আবেদীন, এস এম সুলতান যুগে যুগে আসে না যে। জসীম উদদীনের ওপর তো কিছু করি নি আমরা। শামসুর রাহমান ভালোমন্দ মিলিয়ে কম তো লিখেননি। জীবিত অবস্থায় অসম্ভব সৌভাগ্যবান ছিলেন তিনি। মৃত্যুর কয়বছরের মাথায় আমরা সবই যেন ভুলে যাচ্ছি। হুমায়ূন আহমেদের কীর্তি ও কৃতিত্বও তো কম নয়। এমন আরো বহু নাম আছে। আমরা নিজেদের মর্যাদা দিতে জানি না। হন্যে হয়ে পাগলা কুত্তার মতো ছুটছি তো ছুটছিই। লোল পড়া জিহবা আকাশ পাতাল ছুঁয়ে যাচ্ছে, তবু আমাদের লোভের সীমানা দিগন্ত ছুঁয়ে দেখছে না। আপন মানুষকে, আপন জাতির মহিমাকে মর্যাদা দিতে না জানলে অপরে এসে গরিমা দিবে না নিশ্চয়ই। আপন মহিমা ও কীর্তিকে তুলে ধরা আমাদের বড় কাজ যে। কিন্তু আমরা সেগুলো কদাচিৎ ভাবি। তাইলে জাতি কিসের উপর টিকে থাকবে? আওয়ামী লীগ-বিএনপির মহড়ার উপর জাতি চিরদিন টিকে থাকে না হে!
পিকাসো মিউজিয়ামের আরেকটা বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এক সঙ্গে রক্ষিত আছে ৫৭টি চিত্র, যেগুলোতে ভেলাজকোয়েজের লাস মেনিয়াস-এ শিল্পীর ব্যক্তিগত বিশ্লেষণ ও মূল্যায়ন রয়েছে। এগুলো একটা সিরিজ চিত্র। পিকাসো একমাত্র এই ছবিগুলোই সিরিজ এঁকেছিলেন। একটার পর একটা ছবি। দীর্ঘক্ষণ তো আর এক ছবি দেখা যায় না, আপনি চাইলেও। দর্শনার্থী অনেক। ফলে আপনাকে এগিয়ে গিয়ে অন্য চিত্রে চোখ-মন রাখতে হবে। বিভিন্ন সময়ের ছবি। করুনা, মালাগা, বার্সেলোনা, মাদ্রিদ, হর্টে দে সান্ট জোয়ান-এ আঁকা চিত্রগুলো তার সলিড একাডেমিক ট্যালেন্সিকে ফুটিয়ে তোলে। তাছাড়া প্যারিসের পিকাসোর ভ্রমণ নতুন মাত্রা দেয় তার চিত্রগুলোয়। ফরাসী শিল্পের নন্দনতত্ত্ব আর বার্সেলোনার মন ও ভঙ্গির মিশ্রণ আলাদা রীতি তৈরি করে চিত্রকলার জগতে। শিল্পের জগতে আঁভা গার্দে মানে ভ্যানগার্ড একটি পরীক্ষামূলক রীতি, যাতে ১৯০০ সালে প্রথম প্যারিস ভ্রমণের পর ঝুঁকে পড়েন শিল্পী। সেই আঁভা গার্দে আন্দোলনের ভাব ও রীতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও শিল্পের সংস্কার গার্সিয়া লোরকাতেও হাজির। আর ফরাসি শিল্পের নন্দনতত্ত্ব পিকাসো, লোরকা কেন সারা দুনিয়াতেই শিল্পসাহিত্যে চিত্রকলায় বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
ছবি দেখে কী হয়! চিত্রকলা! কী আশ্চর্য অনুভূতিময় বিষয়। রং ও রেখায় আঁকা চিত্রগুলোয় কত না মমতা মাখা, বেদনা মাখা, কত না সময়ের দাগ, রাত্রির কালো, দিনের আলো, জীবনের হতাশা, বিষাদ-আনন্দ-গান মিশে আছে। কত না জীবনের অভিব্যক্তি ফুটে আছে চিত্রকলায়। শব্দ নেই কোনো, বাক্য নেই অথচ ভাব আছে, আবেগ আছে, রূপ আছে, বহু রূপের। দেখার আনন্দ আছে, ভাবনার বিস্তার আছে। শিল্পের এই মহান কায়দায় জীবন কত যে রকমের ফুটে ওঠে। শিল্পের এই কানুনের সঙ্গে বারবার জীবন নিজে পরাজিত হয়ে জয়ের আনন্দ পায়।
কবিতাও ছবি। কবিতাও চিত্র, চিহ্নে ভরপুর, শব্দ, বাক্য দিয়ে সাজানো অভিব্যক্তির কী আশ্চর্য প্রকাশ কবিতায়। হয়ত চিত্রকলার চেযে আরো দুরূহ, হয়ত বা না। কিন্তু প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত শব্দমালা নিয়ে কবিকে কাজ করতে হয়। ব্যবহার্য জিনিসকে নতুন করে, নতুনের মতো শিল্পে রূপ দেওয়া তাই হয়ত একটু কঠিন। রঙের সঙ্গে শব্দের এতটুকু ব্যবধান কবিতাকে, সাহিত্যকে মহত্তম শিল্পরূপ আকারে হাজির করেছে।
বেরিয়ে আসার সময় মেরিনাকে আর দেখিনি। দেখার ইচ্ছাও হয়নি। প্রবেশ ও বাইর হওয়ার পথও আলাদা। আলাদা আলাদা পথের শিল্প তবু অন্বয়ী, দূরান্বয়ী হয়েও। ছবি তোলা এখন আর নিষেধ নেই। বের হওয়ার পথে তাই মিউজিয়ামের বাইরের দেয়ালের ছবি তুললাম। এটি হয়ত কোনো অর্থ বহন করে না, কিন্তু পিকাসোর ছাপ নিয়ে, মর্ম নিয়ে যা বেঁচে আছে তার অর্থ কম কিসে।
দেখা শেষ হয় না, চোখ চলে আসে দূরে, মন গেঁথে থাকে। শিল্পের সৌন্দর্যের ক্লান্তি অনেক। মনে যে কত রকমের প্রতিক্রিয়া তৈরি করে। মন ভার হয়, হালকা হয়, অবসাদ আস্তে সব মিলিয়ে একটা ঘোরের মধ্যে নিয়ে যায় শিল্প। এই ঘোরগ্রস্ততাই হয়ত শিল্পীর জীবনের মহান শক্তি, যা অন্তরের গভীর মায়া ও প্রত্যয়কে, ব্যক্তির শোচনা ও হরষকে, ভাব ও প্রতিজ্ঞাকে নৈর্ব্যক্তিক করে তোলে। শিল্প যে কারণে মানবজাতির চিরঅন্বয়, চিরসুন্দরতা।
পিকাসো মিউজিয়াম থেকে বের হচ্ছি ছবি তুলতে তুলতে। মিউজিয়ামের বাইরে ছবি তোলা নিষেধ নয়, কিন্তু দুধের স্বাদ তো ঘোলে মিটে না। অগত্যা নেমে আসছি দ্রুত। ক্ষুধা পেয়েছে সবার। নামার আগেই সিঁড়িতে পায়ে ব্যথা পেয়েছে রোহিণী। তার জন্য অপেক্ষা করা অবশ্য কর্তব্য টিমের সদস্য হিসেবে; তাকে তো আর ফেলে যাওয়া যায় না। আমরা কেউ কেউ নিচতলায় পিকাসোকে নিয়ে স্যুভেনির শপে ঢুকলাম। অনেক বইপত্র, স্যুভেনির। পিকাসোর ওপর বই, পিকাসোর চিত্রকর্মগুলো নিয়ে সুন্দর সুন্দর দামী বই, পোস্ট কার্ড, ভিউ কার্ড, গ্লাস, খেলনা ইত্যাদি উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখলাম, কিনলাম না।
ফটো তোলা মিউজিয়ামে নিষেধ হলেও ফটো তোলা চিত্রগুলোর ব্যবসাই তো দেখছি নিচে। মৃত পিকাসোকে নিয়ে ব্যবসা তো জীবিত পিকাসোর চেয়ে বেশিই দেখছি। কম হয় না। ওই যে জীবনানন্দ দাশ বলেছিলেন যে কেঁচো, কৃমি খুঁড়ে খুঁড়ে অধ্যাপকরা বেঁচে থাকে। বড় টিপপনি কেটেছিলেন তিনি। পিকাসোকে খুঁড়ে খুঁড়ে ব্যবসা মন্দ না! জগতের রীতিই এমন। তাদাহিশা ও বয়িংগিল স্যুভেনির কিনল। রেজা সেলিম ঢুকে বেরিয়ে গিয়ে গলির মুখে দাঁড়িয়েছেন। এর মধ্যে রোহিণীর পা-টা ঠিকঠাক হচ্ছে মোটামুটি। বললাম, এবার চলা যাক সামনে। এগিয়ে এসে কেউ প্রস্তাব রাখল সামনে কিছুদূর হাঁটলেই বিচ, ওখানে গিয়েই না হয় ডিনার করা যাবে, কেউ জানাল এখানেই আশপাশ রেস্টুরেন্টে ডিনার সারতে। অগত্যা আমরা খুব বেশি দূর না হেঁটে পাশের একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলাম। রোহিণীর পা ব্যথাটাও আমাদের বিবেচনায় আছে। বেচারা বেশিদূর হাঁটতে পারবে না। উচ্চতা মনে হয় সাড়ে চার ফুট, ওজনও তার কাছাকাছি! শরীরের ভার দুই পা বহন না করারই কথা। তো আমরা নারভিয়ন নামে একটা রেস্টুরেন্টের দোতলায় উঠছি। ওখান থেকে কটমটে মেজাজে ওয়েট্রেস জিজ্ঞাস করল যে, আমাদের অ্যাডভান্স বুকিং আছে কিনা। অ্যাডভান্স বুকিং আমাদের থাকার কথা না। আমরা গিয়ে বসছি। তো আবার মেজাজ কিছুটা তিরিক্কি করে জানাল যে, বিয়ার ১৪ ইউরো, আর সাধারণ খাবার ২৫ ইউরো। ঘটনা কি? দেখলাম লোকজনের ভিড় বাড়ছে। ব্যস্ত সন্ধ্যায় মেজাজ ওর তিরিক্কি হওয়ারই কথা। এমনিতে কিন্তু বার্সেলোনাবাসীকে ভালোই দেখলাম, অনেক সহজ, সাবলীল। প্যারিসে এটা কম দেখছি। প্যারিস লেস ফ্রেন্ডলি মনে হয়েছে আমার কাছে। এ নিয়ে ওয়াশিংটনে গুগল কনফারেন্সকালীন প্যারিসের একজন পরিচিতা তো বলেই বসল যে আমার ধারণা ঠিক না। হয়ত। তবে অনেক অনেক বার গিয়েছি প্যারিস। বিশেষ করে ওইসিডির সঙ্গে পলিসি ইস্যুতে কাজ করতে গিয়ে প্রতি বছরেই দু-তিনবার যেতে হয়। ভাষা না জানায় তেমন কোনো বন্ধু জুটেনি। দু-চারজন পরিচিত আছে, মন্দ না। দেখাও তো কালেভদ্রে হয়। তো বার্সেলোনায় যাদের সঙ্গে কথা হয়েছে ওদের চমৎকার মনে হয়েছে। অনেকে ইংরেজিও জানে। ট্যুরিস্ট সামলাতে হয় কিনা।
দাম শুনে আর ওয়েট্রেসের ব্যস্ত মেজাজ দেখে ওখানে খেতে ইচ্ছে করল না আমাদের কারোরই। দাম চড়া হওয়ার কারণ ভিন্ন। আজ ফ্লেমিংকো অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষ ধরনের নাচগান। আমাদের অঞ্চলে বিশেষ করে ভারতে যেটাকে কথক বলা হয়, এই টাইপের। ছোট জায়গায় ফ্লেমিংকো কিভাবে হবে আমার মাথায় ধরল না। আমি ফ্লেমিংকো উপভোগ করেছি আমেরিকায়, ওয়াশিংটন ডিসিতে। মিলেনিয়াম স্টেজে। এটা খুব বেশি দূরে নয় জগতের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে। বারাক ওবামা নিশ্চয়ই ফ্লেমিংকো দেখেছেন, শুনেছেন, উপভোগ করেছেন পরিবার-পরিজন বন্ধুস্বজন, কূটকৌশলীসহ। মিলেনিয়াম স্টেজ মানে বিশাল বড় স্টেজ। বিশাল লম্বা জায়গা। শত শত মানুষ দাঁড়িয়ে সেটা দেখতে পারে। এক কথায় চমৎকার লেগেছিল। শিল্পীরা গান গায়, আর সঙ্গে নাচ হয়। আমি দেখছিলাম কেবল পায়ের জুতার শব্দ কী করে চমৎকার বাদ্য হতে পারে। গান তো আছেই। সেই অসম্ভব অনুভূতি মনে হলে আজও তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতে হয়। তো আমার ফ্লেমিংকো না দেখলেও হবে; অন্যরাও দেখছি আগ্রহী না। আমরা নিচে নেমে বসলাম একই রেস্টুরেন্টে। পাকিস্তানি ওয়েটার এসে জানাল কোনো ড্রিংক লাগবে কিনা। আলবত। দেখলাম ওখানে ক্যাপিরিনহা আছে। চমৎকার ড্রিংকস। নামটাও অদ্ভুত সুন্দর। আমি খেয়েছিলাম রিও ডি জেনিরোতে, ব্রাজিলে। প্রচুর লেবু, আইস আর চিনি দিয়ে তৈরি। একটু কড়া করে তৈরি করলে দু-তিন গ্লাস আপনাকে কাবু করে দিতে পারে। তো আমরা ক্যাপিরিনহায় যাচ্ছি। পাশাপাশি ফুডের সঙ্গে ইনবিল্ট চারটা বিয়ার পাওয়া গেল। আমরা এমন একটা ডিশ পছন্দ করলাম যাতে ৬ জনের হয়ে যায়। অনেক ভ্যারাইটি এক সঙ্গে খাওয়া যাবে এই সুযোগে। পাকিস্তানি ওয়েটার, নাম মাহমুদ, জানাল যে এটি বেশ ভালো ডিশ। বার্সেলোনায় ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্ট কম, কিন্তু পাকিস্তানিদের রমরমা রেস্টুরেন্ট ব্যবসা। বাংলাদেশি রেস্টুরেন্ট নেই বললেই চলে। আমি জিজ্ঞাস করেছিলাম রাম্বলায় এক বাংলাদেশি স্টেশনারী শপের লোকটাকে। কিন্তু মাদ্রিদে বাংলাদেশি রেস্টুরেন্টে খেয়েছি এর আগে। সেদিন ছিল মহাউৎসবের সময়। স্পেন ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ জিতেছে ফুটবলে। বোঝেনই তো, কী হতে পারে উৎসব। এবার স্পেন কী খুব ভালো করবে। আল্লাহ মালুম! ফ্লাবিয়া আসছে আর্জেন্টিনা থেকে। বললাম, বাংলাদেশ তো বিশ্বকাপ ফুটবলের সময় ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় দুভাগ হয়ে যায়, জানও দিয়ে দিতে পারে এমনকি। শুনে তো তার চোখ ছানাবড়া। দেখলাম, সে আর্জেন্টিনা নিয়ে আশাবাদী নয়। মেসি থাকলেও জানাল সে, মেসির জন্য দরকার টিম। বার্সা আর আর্জেন্টিনা এক নয়।
আমরা ক্যাপিরনিহায় আছি, উপরে ফ্লেমিংকো আছে। ছেলেমেয়েরা আসছে, ঢুকছে, জড়িয়ে ধরছে, চুমু খাচ্ছে। আমাদের কানে নাচের শব্দ আর গলার সুর ভেসে আসছে। চোখগুলো চারপাশের কা- দেখছে, মজা পাচ্ছে, কিন্তু ফ্লেমিংকোর আওয়াজ ভালো লাগছে না।
একটু সময় নিয়ে ডিনার সারলাম, অনেকটা ইউরোপীয় কায়দায়। ওরা খাবারের জন্য বাঁচে, বেশি সময় ধরে খায়, আমরা বাঁচার জন্য খাই, তো হুড়মুড় করে উঠতে হয়, কাজে নামতে হয়। দু-একটা স্যুভেনির শপে ঢুকলাম। মাশাল্লাহ, দাম মাথাচড়া। বিশেষ করে বিশ্বকাপ সামনে রেখে এফসি বার্সেলোনা মানে বার্সেলানা ফুটবল ক্লাব অফিসিয়ালি বল, টি-শার্ট ছেড়েছে বাজারে। একটা টি-শার্টের দাম ১০০ ইউরো, বলের দাম কমপক্ষে ৩০ ইউরো। বাইরের দোকানগুলোতে খানিক কম, কিন্তু বার্সেলোনা স্টেডিয়াম শপে দেখলাম যা তা দাম। বার্সেলোনা স্টেডিয়াম, সে আরেক কা-। সবটাই তো দখল করে আছে কাতার এয়ারওয়েজ, অফিসিয়াল স্পন্সর। সবকিছুতেই কাতার। ব্যবসা বটে। আমার পছন্দের এযারওয়েজ। সার্ভিস বেশ ভালো। আমাকে প্রায়শ বিজনেস ক্লাস দিয়ে দেয় কমপ্লিমেন্টারি হিসেবে। ইকোনমিক ক্লাসের টিকিট কাটলেও এবারও বার্সেলোনায় বিজনেস ক্লাসে চলে আসলাম, খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে আরাম আয়েশে। টি-শার্ট আর বল নিয়ে ফিরছি। অমিয় বলেছিল, বল নিয়ে যেতে তার জন্য। আবেগ ও মমতার কাছে অর্থের তেমন কোনো মূল্য থাকে না।
পথে পথে মানুষের ভিড়। পথের পাশে খোলামেলা রেস্টুরেন্টে বসে শত শত মানুষ বিয়ার খাচ্ছে, সিগারেট ফুঁকছে, সাংগ্রিয়া নিচ্ছে, ডিনার করছে। কত না সোহাগ আর নৈকট্যের উদ্দীপনায় ভালোবেসে আছে প্রেমিক-প্রেমিকা, বন্ধু ও স্বজনেরা পরস্পর। ভালোই লাগে আমার মানুষ দেখতে। হাঁটতে হাঁটতে দেখছি সার্কাসে নেমেছে তিনজন ইয়ং ছেলে। তাদের ঘিরে আছে যেন আরো তিনশ জন। সার্কাস বললে ভুল হবে, শারীরিক কসরত। জিমন্যাস্টিক বলা যায়। চমৎকার। শরীরকে দুমড়ে মুচড়েও যে মানুষদের আনন্দ দেওয়া যায়। এ আর নতুন কি! এই শরীর একদিন সত্যিই দুমড়ে-মুচড়ে নাই হয়ে যাবে, স্বাভাবিক, তবুও যে অবাক লাগে। দেহ ব্যবহার করেই, মানে দেহের শক্তি ও শৌকর্য, সৌন্দর্য ব্যবহার করেই তো জগৎ চলছে। সেটা কী রিকশাওয়ালা বা খেলাধুলা, কী দেহ ব্যবসা, পণ্যাপণ্য বা বম্বে ফিল্ম, সবকিছুই!
আমরা জউমি স্টেশনের দিকে এগিয়ে চলছি। রোহিণী পাশেই একটা হোস্টেলে উঠেছে। বেশ শান্তশিষ্ট মেয়ে। এরোটিক্স নামে একটা প্রকল্পে কাজ করেছে বম্বেতে। এখন ফাঁকা। ইন্টারনেটে বা অনলাইনে নারীদের কিভাবে হেনস্তা হতে হয় এই বিষয় নিয়ে ছিল এরোটিক্স প্রকল্প। মেট্রো স্টেশনের কাছে রোহিণীকে বিদায় জানাতে হলো। একা যেতে পারবে তো আমরা জিগালাম তাকে। বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে বলল যে, খুব কাছেই তার হোস্টেল। মিউজিয়াম পেছনে ফেলে পিকাসোকে রেখে আমরা চলে এসেছি খানিকটা দূর। এবার রোহিণীকে একা রেখে আমরা স্টেশনের দিকে চলে যাচ্ছি। এভাবে আমাদের কত কত চেনা মুখ সুদূরে হারিয়ে যাওয়া ট্রেনের মতো হারিয়ে যায়, দূরে চলে যায়, কত সহস্র মুখের সঙ্গে কোনোদিন দেখা হয় না আর, যেমন ফিরে পাওয়া যায় না ফেলে আসা শৈশব, পেছনের জীবন। কিছু মুখ, কিছু মায়া ও স্মৃতি তবু বেঁচে থাকে। পিকাসোর কিছু চিত্র মায়া হয়ে গেঁথে রইল মনে, মেরিনা, মিরেইয়া, রোসি ও রোহিণীরাও বেঁচে থাকবে সংগোপনে।