সম্ভবত ১৯৮৯ সালের কথা। নাট্যবিশেষজ্ঞ সাঈদ আহমদ তখন টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান করতেন ‘বিশ্বনাটক’ শিরোনামে। চমৎকার সব নাটক আর নাট্যকারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন তিনি। আমি ছিলাম ওই অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক। একদিন ওই অনুষ্ঠানে তিনি আলোচনা করলেন অ্যাবসার্ড নাটক নিয়ে। তাঁর কাছ থেকেই জানলাম অ্যাবসার্ড শব্দটির আভিধানিক অর্থ উদ্ভট, হাস্যকর, অসম্ভব, অবিশ্বাস্য, অযৌক্তিক ইত্যাদি; তবে অ্যাবসার্ড নাটক এসব আভিধানিক শব্দের চেয়ে অধিকতর অর্থময়। সেদিন তিনি দর্শককে পরিচয় করিয়ে দিলেন স্যামুয়েলে বেকেটের সঙ্গে, আর উপহার দিলেন নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের পরিবেশনায় ‘ওয়েটিং ফর গডো।’ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে দেখলাম। দেখার পরও ঘোর কাটল না, স্রেফ হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। সেই প্রথম অ্যাবসার্ড নাটকের সঙ্গে আমার পরিচয়, বেকেটের নামও সেই প্রথম শুনলাম। এরপর দীর্ঘকালীন প্রেম। সত্যি কথা বলতে কি, প্রথমবার টেলিভিশনে দেখে নাটকটি ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। তখন আমি কেবল কুড়ি বছর বয়সে পা দেয়া তরুণ, কলেজের পড়া শেষ করে বিশ্ববিদ্যালেয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য অপেক্ষারত, ছোটবেলা থেকে বই পড়ার নেশা থাকলেও ঠিক এই ধরনের জটিল সাহিত্যের সঙ্গে পরিচয় ছিল না। সেজ ভাই ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র। তাঁকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম বেকেট আর ‘ওয়েটিং ফর গডো’র কথা, টিভিতে দেখে যে ঠিক বুঝতে পারিনি সেটাও বললাম। তিনি তাঁর বুকশেলফ থেকে বইটি বের করে বললেন, ‘নে পড়ে দ্যাখ।’ এমনিতেই অ্যাসার্ড নাটক, তার ওপর ইংরেজিতে লেখা, মাথামু-ু কিছু বুঝলাম বলে মনে হলো না। তবে আগেই টিভিতে নাটকটি দেখার কারণে এবং সাঈদ আহমদের চমৎকার আলোচনা শোনার কারণে, পড়ে সবটা না বুঝলেও খানিকটা ধারণা করতে পারছিলাম কী আছে ওটাতে! সাঈদ আহমদ এমন অসামান্য প্রাজ্ঞ আর বিদ্বান ছিলেন, আর তাঁর উপস্থাপনার ভেতরে এমন এক প্রাঞ্জল বৈদগ্ধ ছিল যে, অতি জটিল বিষয়ও তাঁর কথন-নৈপুণ্যে অনেকখানি বোধগম্য হয়ে উঠত। ইংরেজি পড়েও বিষয়টি ঠিক পরিষ্কার হয়নিÑ ভাইয়াকে এ-কথা বললে পরদিন কবীর চৌধুরীর অনুবাদে বাংলাটাও এনে দিলেন তিনি। এবার খানিকটা বোধগম্য হলো, আর আমি অ্যাবসার্ড নাটকের প্রেমে পড়ে গেলাম। মহানগর পাঠাগার, পাবলিক লাইব্রেরি আর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের লাইব্রেরিতে কেবলই অ্যাবসার্ড নাটকের বই খুঁজি। পেয়েও গেলাম অনেক কিছু। বেকেট তো রইলেনই সঙ্গে, প্রায় সার্বক্ষণিক সঙ্গী হয়ে, ধীরে ধীরে পরিচয় ঘটল অ্যাবসার্ড নাটকের অন্য দিকপাল ইউজিন ইয়োনেস্কো, আর্থার অ্যাডামোভ, জ্য জেঁনে, হ্যারল্ড পিন্টারের সঙ্গেও। এর বছর তিনেক পর, আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি, অ্যাবসার্ড নাটক নিয়ে লিখে ফেললাম বিশাল এক প্রবন্ধ। ধারাবাহিকভাবে সেটা ছাপা হলো ইত্তেফাকের সাহিত্য সাময়িকীতে, পাঁচ পর্বে। কী সাহস! আমার বন্ধুরা, যারা ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র ছিল তাদের পাঠ্য ছিল এই নাটক, তাদেরকে পড়াতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদগ্ধ শিক্ষকরা, আর আমি কী না পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে ওই বিষয়ে লিখে ফেললাম পাঁচ পর্বের ধারাবাহিক! তাও প্রকাশিত হলো তখনকার সর্বাধিক প্রচারিত শীর্ষ দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে! ভাবলে এখনো ভয় লাগে। যাহোক, ওই কয়েক বছর ধরে অ্যাবসার্ডিটি, অ্যাবসার্ড নাটক, অ্যাবসার্ড সাহিত্যধারা আমাকে এমনভাবে বুঁদ করে রেখেছিল এবং এত বেশি পড়ে ফেলেছিলাম যে, না লেখা পর্যন্ত বিষয়টি থেকে মুক্তি পাচ্ছিলাম না। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে কেন এত ঘোরগ্রস্ত ছিলাম? কী আছে ওতে? কেনই বা ওই সময়টিকে অ্যাবসার্ড সময় বলে মনে হতো?
২
কী আছে? এটা তো সংক্ষেপে বলা কঠিন, তবু এটুকু বলা যায়Ñ অ্যাবসার্ড নাটক পাঠক-দর্শককে অচেনা-অজানা ভিন্ন এক জগতে পরিভ্রমণ করায়, অথচ মনে হয় ওটা আমাদেরই প্রতিদিনের যাপিত জীবন। প্রতিটি অ্যাবসার্ড নাটকের প্রেক্ষিত ও চরিত্রাবলী বিচিত্র ও অদ্ভুত। নাটকের পটভূমি, স্থান, কাল, পাত্র সবই অতিশয় রহস্যময়, একইসঙ্গে পরিচিত ও অচেনা, এখানে সময় থেমে যায়, কথা ফুরিয়ে যায়, চরিত্রগুলো বারবার একই শব্দ-বাক্য উচ্চারণ করে, কিন্তু যত কথাই বলুক পরস্পরের কাছে তারা অচেনা ও দুর্বোধ্যই রয়ে যায়। এসব নাটকে কিছুই ঘটে না, চরিত্রগুলোর নির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া যায় নাÑ যেন তারা পুরো মানবজাতিরই প্রতিনিধি, যেন তাদের কোনো ব্যক্তিগত আইডেন্টিটি নেই। আর তাই পাঠক-দর্শক ওই চরিত্রগুলোর ক্লান্তি-হাহাকার-দুঃখ-কষ্ট-বেদনা-পরাজয়-বিষণœতা-বিচ্ছিন্নতা-নিঃসঙ্গতা-বিপন্নতা-অসহায়ত্ব ইত্যাদির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করে ফেলে। বিশেষ করে যদি বেকেটের কথা বলি, তাহলে বলা যায়Ñ তাঁর সৃষ্ট প্রায় সকল চরিত্রই জীবনের দুর্বহ ভার বহনে ক্লান্ত, পারস্পরিক অর্থবহ সংযোগে ব্যর্থ। তারা যেন আমাদেরকে জানিয়ে দেয়Ñ নিস্পৃহ, নিষ্ক্রিয়, নৈরাশ্যবাদী অথবা কর্মতৎপর, আশাবাদীÑ মানুষ যেমনই হোক না কেন, সবার জন্যই নির্ধারিত হয়ে আছে অবক্ষয় ও শূন্যতা। এই চরিত্রগুলো নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, বিযুক্ত ও বিপন্ন, বিষণœ, নৈরাশ্যবাদী, আত্মধ্বংসকারী, দুঃস্বপ্ন ও বিভীষিকায় আক্রান্ত, যন্ত্রণাদগ্ধ, ব্যর্থ, পরাজিত; তাদের সবকিছু জুড়ে অর্থহীনতা, তাদের সব প্রয়াস তুচ্ছ, অকিঞ্চিৎকর, এমনকি পরস্পরের সঙ্গে ইতিবাচক যোগাযোগ স্থাপনেও অক্ষম তারা; তাদের ভাষা শুধু শূন্যগর্ভ স্লোগান, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, ক্লিশে, পচে যাওয়া অর্থহীন শব্দাবলীর সমষ্টি মাত্র; তাদের জীবনও ক্লিশে আক্রান্ত, হাস্যকর, অবান্তর, উদ্ভট; তাদের মানবিক অস্তিত্ব নিষ্ফল, লজ্জাকর, ব্যর্থ। পৃথিবীর সমস্ত সমস্যার সমাধান হয়ে গেলেও তারা তীব্র বেদনার সঙ্গে আবিষ্কার করেÑ মৃত্যু জীবনকে নিরর্থক করে দেয়। আর অ্যাবসার্ডিটির মূল কথা এটিই।
৩
কেন এই ধরনের সাহিত্য নিয়ে আমি ঘোরগ্রস্ত ছিলাম, সেটি এখন খানিকটা বুঝতে পারি। দেশ-কাল-সমাজ-সময় যদি গভীর কোনো নৈরাশ্যের ভেতরে পতিত হয় তখন সেই দেশের, সেই সময়ের কোনো লেখক এ ধরনের সাহিত্য রচনা করতে পারেন কিংবা একজন পাঠক এ ধরনের রচনার প্রতি আকৃষ্ট হতে পারেন। আমরা কি সেরকম নৈরাশ্যপীড়িত-অন্ধকার সময়ের ভেতর দিয়ে বড় হয়ে উঠছিলাম? হ্যাঁ, তাই। এ বিষয়ে একটু পরে বলি। তার আগে অ্যাবসার্ড নাট্যধারার উন্মেষকাল নিয়ে দু-চারটে কথা বলা যাক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ইউরোপসহ পশ্চিমা বিশ্বের অন্যান্য দেশের মানুষ যখন দাঁড়াল এক চূড়ান্ত অবক্ষয়ের সামনে, চারদিকে ধ্বংসযজ্ঞ, মানবতার নির্মম পদদলন; মূল্যবোধ বলতে বা আশাবাদী হওয়ার মতো কোথাও আর কিছুই নেই; বেঁচে থাকাটাই যখন এক বেদনাদায়ক, ক্লান্তিকর, গ্লানিময় অভিজ্ঞতা আর অস্তিত্ব যখন হয়ে উঠছে এক ভীষণ অর্থহীন বিষয় তখন অস্তিত্ববাদী দর্শনের ব্যাপক বিস্তার লাভের সঙ্গে সঙ্গে নাট্যসাহিত্যে এলো এক নতুন ফর্ম, যা পরবর্তীকালে পরিচিতি পেলো অ্যাবসার্ড নাটক হিসেবে। বলতে গেলে, অস্তিত্ববাদী দর্শন আর অ্যাবসার্ড নাটক প্রায় যমজ ভাই। একে অপরের পরিপূরক। আর তাই অস্তিত্ববাদী লেখকদেরও অ্যাবসার্ডিটি নিয়ে কথা বলতে দেখা যায়। যেমন, জাঁ পল সার্ত্র বলছেনÑ ‘পৃথিবীতে কোনো সর্বজনীন নৈতিক মূল্যবোধ নেই। মানুষ মূলত একটি উদ্দেশ্যহীন পৃথিবীর মধ্যে পতিত যা পরিণামে তার অস্তিত্বকেই অর্থহীন করে তোলে, আর এ থেকেই অ্যাবসার্ডটির জন্ম।’ আর আলবেয়ার কাম্যুর মতেÑ ‘মানুষের সঙ্গে তার জীবনের আর জীবনের সঙ্গে তার পরিপার্শ্বের বিচ্ছিন্নতার অনুভূতিই অ্যাবসার্ডটি’ অথবা ‘মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা, স্বপ্ন-ভালোবাসা, চেষ্টা-চরিত্র এবং অর্থহীন পৃথিবীÑ যে অর্থহীনতার মধ্যে তাকে ঠেলে দেয়া হয়Ñ এ দুয়ের ব্যবধান থেকেই অ্যাবসার্ডিটির জন্ম নেয়।’ কাম্যুই প্রথমবারের মতো ১৯৪২ সালে প্রকাশিত তাঁর মীথ অব সিসিফাস গ্রন্থে এই অভিধাটি ব্যবহার করেন, যদিও নাটকের ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে এর ব্যবহার শুরু হয় প্রখ্যাত নাট্য সমালোচক মার্টিন এসলিনের থিয়েটার অব দ্য অ্যাবসার্ড (১৯৬১) বেরুনোর পর।
যে-কোনো যুদ্ধের পর একটি দেশে যে মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে, যে হতভম্ব সময়ের ভেতর দিয়ে মানুষের জীবন প্রবাহিত হয়, সেটি সাহিত্যে রূপায়ণের জন্য ইউরোপের লেখকরা বেছে নিয়েছিলেন এইসব বিশেষ ফর্ম। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কাফকার রচনায়, আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কাম্যুর উপন্যাসে, কিংবা বেকেট ও তাঁর সহযাত্রীদের নিপুণ-কুশলী কলমে নির্মিত হয়েছিল এই অভিনব রূপের নাটক। বাংলাদেশও মুক্তিযুদ্ধের পর প্রায় দু-দশক ধরে পার করেছে এক ভীষণ বিহ্বল সময়। কেমন সময় ছিল সেটি?
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সুমহান ত্যাগ ও বীরত্বের গৌরবে উজ্জ্বল, একটি শোষণহীন মানবিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার প্রত্যয়ে ভাস্বর। অথচ যে বিশাল স্বপ্ন নিয়ে এই জাতি অংশ নিয়েছিল অসম্ভব এক যুদ্ধে তা যে পূরণ হওয়ার নয় সেটা বোঝা গিয়েছিল অল্প কিছুদিন পরই। ফলে আশা ও স্বপ্ন পরিণত হয় নৈরাশ্য ও দুঃস্বপ্নে। আকাশ-সমান স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গের বেদনা, অন্তসারশূন্য রাজনীতি, বিশৃঙ্খলা, নেতৃত্বের ব্যর্থতা, শাসকগোষ্ঠীর সীমাহীন দুর্নীতি ও বর্বরতা, রক্তাক্ত যুদ্ধজয়ের পরও প্রিয় স্বদেশভূমিতে বিতর্কিত রক্তপাত, হতাশা, মূল্যবোধের অবক্ষয়, হাহাকার, ক্ষুধা, একাত্তরের ঘাতকদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, দুর্ভিক্ষ, একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করে গণতন্ত্রের আনুষ্ঠানিক মৃত্যু ঘোষণা, সর্বোপরি স্বাধীনতা প্রাপ্তির মাত্র চার বছরের মাথায় স্বাধীনতার প্রধান স্থপতি ও জাতির পিতার মর্মান্তিক হত্যাকা-Ñ ইত্যাদি সংখ্যাহীন নেতিবাচক ঘটনা ঘটেছিল স্বাধীনতা প্রাপ্তির চার বছরের মধ্যেই। আর তারপর, যে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল সেই সামরিক জান্তাই ভিন্ন রূপ নিয়ে দখল করল এই দেশ। ক্ষমতার মসনদে সদম্ভ প্রত্যাবর্তন ঘটল একাত্তরের ঘাতকদের। ঘাতকরা উঠল ক্ষমতার উচ্চ শিখরে, সামরিক বাহিনীতে চলল ক্যু-পাল্টা ক্যু, পরিণামে নির্বিচার হত্যাকা-, সংবিধান গেল পাল্টে, ফিরে আসতে শুরু করল পাকিস্তানপন্থা নতুন রূপে, নতুন নাম নিয়ে। গণতন্ত্র নির্বাসিত হলো, নির্বাসনে গেল মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত সকল অর্জনও। স্বাধীনতার মাত্র দশ বছরের মাথায় দেখা গেলÑ মুক্তিযুদ্ধের প্রায় সকল নায়ক নিহত! বঙ্গবন্ধুসহ জাতীয় চার নেতা, মুক্তিযুদ্ধের চারজন সেক্টর কমান্ডারসহ আরো বহু মুক্তিযোদ্ধা নিহত হয়েছেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ এই কয়েক বছরের মধ্যেই। আর তারপর ক্ষমতায় এলেন এক অতি ধুরন্ধর জেনারেল। এসে মুক্তিযুদ্ধকে প্রায় ঝেঁটিয়ে বিদায় করলেন তিনি। আদেশ জারি করলেনÑ ‘তাঁর’ এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাজকর্মের কোনো সমালোচনা করা যাবে না, করলে এই শাস্তি ওই শাস্তি ইত্যাদি। শুধু তাই নয়Ñ একসঙ্গে পাঁচজনের বেশি জমায়েতও করা যাবে না, করলে দেখামাত্র গুলি করা হবে! সামরিক শাসনের নামে এমনই এক বীভৎস, ভয়ংকর, পৈশাচিক শাসন চেপে বসেছিল সারা জাতির বুকের ওপর। মাঝে মধ্যে সো-কলড গণতন্ত্রের ছদ্মবেশ ধারণ করলেও ওই মহামানবের কল্যাণে আমাদের কৈশোর কেটেছে এমনই সব বিচিত্র নিষেধাজ্ঞায়। শুধু তো তাই নয়, ওই পবিত্র বয়সেই আমরা দেখেছিলামÑ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে অবিশ্বাস-দ্বন্দ্ব-সন্দেহ। কেউ কারো ওপরে আস্থা রাখতে পারছে না, কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারছে না, দেয়ালেরও কান আছে ভেবে কথা বলছে ফিসফিসিয়ে। আমরা দেখেছিÑ আলোর ইশারাবিহীন অতল অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে স্বদেশ, কোথাও কোনো সম্ভাবনা থাকছে না, চারদিকে কেবল গভীর অন্ধকার, কেবল অনিশ্চয়তা, কেবল হতাশা। দেখেছিÑ প্রতিবাদী মিছিলে উঠে যাচ্ছে সামরিক ট্রাক; দেখেছি মৃত্যু, মৃত্যু, অজস্র অপমৃত্যু; দেখেছি প্রাচীন রাজনীতিবিদরা তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা বিসর্জন দিয়ে লুটিয়ে পড়ছেন সামরিক প্রভুর কদর্য পায়ে; কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রকম্পিত হচ্ছে অস্ত্রের ঝনঝনানিতে; ছাত্রনেতাদের চারপাশে উড়ছে টাকা আর ক্ষমতা, আর তার লোভে পড়ে আজকের বিপ্লবী কালকেই হয়ে যাচ্ছে প্রভুর চামচা; টাকা এবং টাকাই হয়ে উঠছে সবকিছুর একমাত্র নিয়ামক শক্তি, কোনো নীতিবোধ বা মূল্যবোধ আর চালকের আসনে থাকছে না, রাষ্ট্রই উৎসাহিত করছে অসৎ হতে, আদর্শহীন হতে, নীতিহীন হতে, তাই রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি অফিসের পিওন-দারোয়ান পর্যন্ত অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করাটাকে প্রায় বৈধ কাজ বলে ধরে নিয়েছে, আর এভাবেই দুর্নীতিকে দেয়া হচ্ছে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ; সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যাচ্ছে যখন-তখন, লেখক-শিল্পী-সংবাদকর্মীরা নিগৃহীত হচ্ছেন অহরহ, আর এ-সব কিছুর মধ্যে দিয়ে ধূমায়িত হচ্ছে ক্ষোভ।
এটা সত্য যে, সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে দল-মত ভুলে, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের ঊর্ধ্বে উঠে, সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ব্যানারে সামরিক শাসন বিরোধী সংঘবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল আমাদের সময়ের তরুণরা। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া, ভালো লাগা না-লাগা, প্রেম-প্রণয়-বন্ধুত্ব ইত্যাদির চেয়ে বড় হয়ে উঠেছিল ‘বিশ্ববেহায়া’র কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার দায়। এই প্রতিরোধই একদিন তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য করে, তবু এক গভীর বিষাদ ও নৈরাশ্যবোধ যে আমাদের ভেতরে প্রোথিত হয়ে গিয়েছিল, অস্বীকার করা যাবে না।
৪
শুরু করেছিলাম স্যামুয়েল বেকেট আর তাঁর ওয়েটিং ফর গডো প্রসঙ্গ দিয়ে, আবার সেই প্রসঙ্গেই ফিরি। বেকেট আমার প্রিয় লেখকদের একজন। শুধু লেখা নয়, তাঁর অদ্ভুত-খ্যাপাটে ব্যক্তিচরিত্রও আমাকে ভীষণ ভাবায়। কী রকম? যেমন তাঁর সঠিক জন্মতারিখটি নিয়ে যে বিতর্ক আছে তিনি নিজে সেই বিতর্কের অবসান ঘটাননি, নিজে কখনো জন্মদিন পালনও করেননি। ১৯০৬ সালের ‘সম্ভবত’ ১৩ এপ্রিল ডাবলিনের কাছে ফক্সরক্স-এ জন্মগ্রহণ করেন তিনি। আবার তাঁকে একবার ‘মানসিক ভারসাম্যহীনতা’র অভিযোগে অযোগ্য ঘোষণা করে চাকরিচ্যুত করেন ডাবলিনের একটি কলেজের কর্তৃপক্ষ। অথচ তিনি ছিলেন দারুণ মেধাবী এক মানুষ, ১৯২৭ সালে আধুনিক সাহিত্যে (ফরাসী ও ইতালিয়ান সাহিত্য) ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে ডিস্টিংশন মেডেল জয় করেছিলেন এবং প্যারিসে এসে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন। সেখান থেকে নিজের জন্মভূমি ডাবলিনে ফিরে এসে ওই কলেজে ফরাসী ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ১৯৩১ সালে, আর তার পরের বছরই তাঁর বিরুদ্ধে ওই মানসিক ভারসাম্যহীনতার অভিযোগ! তিনি চলে গেলেন লন্ডনে, সেখান থেকে ১৯৩৭ সালে প্যারিসে ফিরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি ফরাসী প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে গোপন আন্দোলনের সদস্যদের সঙ্গে মিশে এক বিপজ্জনক জীবনযাপন বেছে নেন। এই সামান্য তথ্যগুলোই জানিয়ে দেয়, তাঁর কৈশোর কেটেছে প্রথম মহাযুদ্ধের সময়, আর তারুণ্য-যৌবন কেটেছে প্রথম যুদ্ধ-পরবর্তী বিহ্বলতা আর দ্বিতীয় যুদ্ধের পূর্ববর্তী টালমাটাল উত্তেজনার ভেতর দিয়ে। আর যখন তিনি ত্রিশোর্ধ্ব যুবক তখনই শুরু হয়েছে সেই মরণঘাতী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই প্রতিবেশের ভেতর দিয়ে জীবন পার করে আসা একজন মানুষের কাছ থেকে নৈরাশ্য ছাড়া আর কী-ই বা আশা করা যায়?
মানুষ হিসেবে বেকেট ছিলেন অন্তর্মুখিন, স্পর্শকাতর, অনুভূতিপ্রবণ, প্রচার-প্রত্যাশাহীন, নির্জনতাপ্রিয় এবং উদার। সাংবাদিকদের সযতেœ এড়িয়ে চলতেন, নিজের লেখা বা অন্যের লেখা বা সাহিত্যের কোনোকিছু নিয়ে কাউকে কখনো তিনি কিছু বলেছেন বলে শোনা যায়নি। নিজের লেখা সম্বন্ধে এতটা চুপ থাকতেও দেখা যায়নি আর কোনো লেখককে কোনোদিন। তাঁর প্রচারবিমুখতা ছিল অবাক করার মতো। এ প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৬৯ সালে যখন তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেয়ার কথা উঠল তিনি তখন নানা মহলে ধরাধরি করেছিলেন যেন সেটি তাঁকে না দেয়া হয়। পুরস্কার থেকে রেহাই পেলেন না তিনি, তবে পুরস্কার গ্রহণ করতে হাজিরও হলেন না সুইডিশ একাডেমিতে। তাঁর মৃত্যুসংবাদও আমাদেরকে তাঁর অদ্ভুত আচরণের কথা মনে করিয়ে দেয়। ১৯৮৯ সালের ২২ ডিসেম্বর তিনি মারা যাওয়ার চারদিন পর, যখন তিনি সমাহিত হয়েছেন, ২৬ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যুসংবাদ জনসমক্ষে প্রচার করা হয়Ñ কারণ ও রকমই তাঁর ইচ্ছে ছিল!
স্যামুয়েল বেকেট তাঁর দীর্ঘ ৮৩ বছর জীবনে, যার মধ্যে সাহিত্যজীবন পঞ্চাশ বছরেরও বেশি, খুব বেশি লেখেননি। সারা জীবনে তিনি ছোট-বড়-মাঝারি মিলিয়ে সাকুল্যে ডজনখানেক নাটক, আধ ডজন উপন্যাস, কিছু ছোট গল্প আর নগণ্য সংখ্যক কবিতা লিখেছেন। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ মোর প্রিকস দ্যান কিকস প্রকাশিত হয় ১৯৩৪ সালে। তারপর থেকে ৩৮-এ মারফি, ৪২-এ ওয়াট, ৫১-এ মলয়, ম্যালনি ডাইস এবং দ্য আননেমেবল প্রকাশিত হয়। ওয়েটিং ফর গডো তাঁর প্রথম নাটক, প্রকাশিত হয় ১৯৫২ সালে। প্রথম নাটকই তাঁকে বিপুল খ্যাতি এনে দেয়। এরপর আরও কিছু নাটক লেখেন তিনি, যেমনÑ এন্ডগেম, ক্র্যাপস লাস্ট টেপ, অল দ্যাট ফল, এমবার্স, হ্যাপি ডেজ, প্লে, ক্যাসক্যান্ডো, নট আই ইত্যাদি।
বেকেট ভাষা ও আঙ্গিক নিয়ে সারা জীবন পরীক্ষা নিরীক্ষা-করেছেন। দ্য আননেমেবল উপন্যাসে তিনি প্যারাগ্রাফ বর্জন করেছিলেন, হাউ ইট ইজ-এ সর্বপ্রকার যতিচিহ্ন বর্জন করেছিলেন, সর্বশেষ উপন্যাস স্টারিংস স্টিল মাত্র দু হাজার শব্দের! তার স্বল্পতম দৈর্ঘ্যরে নাটক ব্রেথ মাত্র আধ মিনিটের এবং নাটকে কোনো সংলাপ নেই।
এবার ‘ওয়েটিং ফর গডো’র কথা বলি। নাটকটির চরিত্র মাত্র পাঁচটি। এর মধ্যে দুটো প্রধান চরিত্রÑ ভøাডিমির আর এস্ট্রাগন। বেকেটের প্রায় সকল চরিত্রের মতোই, যেমনটি আগেই বলেছি, এরাও জীবনের দুর্বহ ভার বহনে ক্লান্ত, নিঃসঙ্গ, বিচ্ছিন্ন, বিযুক্ত ও বিপন্ন; বিষণœ, নৈরাশ্যবাদী, আত্মধ্বংসকারী; দুঃস্বপ্ন ও বিভীষিকায় আক্রান্ত; যন্ত্রণাদগ্ধ, ব্যর্থ, পরাজিত।
এই নাটকে আসলে কিছুই ঘটে না, কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত, টানাপোড়েন, চরিত্রের বিকাশ, ঘটনার ধারাবাহিকতা বা অগ্রসরতা চোখে পড়ে না। চরিত্রগুলোও অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করে না। নাটকের শুরুতে আমরা দেখতে পাই ভøাডিমির ও এস্ট্রাগন একটি ধূসর প্রান্তরে কোনো এক মিঃ গডোর জন্য অপেক্ষা করছে, নাটকের শেষেও তাই। মাঝখানের সময়ের ব্যবধান মাত্র একদিনের, অথচ এই এতটুকু সময় পার করতে তাদের এত বেশি কষ্ট করতে হয় যে, মনে হয় অনন্তকাল ধরে তারা অপেক্ষা করে আছে। পরপর দুদিন তারা অপেক্ষা করে কিন্তু গডো দুদিনই খবর পাঠান যে, তিনি আজ আসতে পারছেন নাÑ কালকে নিশ্চয়ই আসবেন! তাদের এই অনন্ত অপেক্ষা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। পুরো নাটকটি পড়লে মনে হয়Ñ তারা চিরদিনই অপেক্ষায় ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। কোনোদিনই তাদের এই অপেক্ষার অবসান হবে না এবং গডো কোনোদিনই আসবেন না।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে গডোর জন্য তারা অপেক্ষা করে, তাকে তারা চেনে না, কোনোদিন দেখেওনি। তবে তারা বিশ্বাস করে, গডো এলে তাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, পৃথিবী তাদেরকে যে ক্লেদাক্ত জীবন উপহার দিয়েছে তা থেকে তারা মুক্তি পাবে। কীভাবে সেটি হবে তা অবশ্য তারা জানে না, তাঁর কাছে প্রত্যাশাটা কী তা-ও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়, এমনকি তারা এ-ও নিশ্চিত নয় যে, তিনি আদৌ আসবেন কী না! তবু, গডোর জন্য অপেক্ষা করতে তারা বাধ্য, কারণ এর সঙ্গে তাদের জীবন-মৃত্যুর প্রশ্ন জড়িত। পুরো নাটকে নিষ্ফল ও অর্থহীন প্রতীক্ষার যন্ত্রণা, হাহাকার, অসহায়ত্ব, হতাশা, অর্থহীনতা, অনিশ্চয়তা, বিস্ময়কর বিস্মৃতি, ভাষার মাধ্যমে অর্থবহ ও কার্যকর যোগাযোগ স্থাপনের দুরূহতা, দুর্বিষহ পৌনঃপুনিকতা, জীবনের জটিল ও দুর্বহ ভার, প্রগাঢ় ক্লান্তি ইত্যাদি ছড়িয়ে আছে আর এ সবকিছু তাদেরকে নিক্ষিপ্ত করে প্রগাঢ় যন্ত্রণা আর গভীর দুঃস্বপ্নের ভেতরে।
গডোর পুরো ব্যাপারটি জুড়ে বিভ্রম ও বিভ্রান্তি জড়ানো। যার জন্য এত প্রতীক্ষা সে যে কে, দেখতে কেমন, জীবনে তার ভূমিকা কী, সে এলে কীভাবে কতটুকু বদলে যাবে জীবন এর কোনো কিছুরই উত্তর নেই নাটকে, শুধু ইঙ্গিত আছেÑ আমরা সবাই তো কিছু-না-কিছুর জন্য, কারো-না-কারো জন্য অপেক্ষা করি, ভাবি সে এলে জীবনটা পাল্টে যাবে! এ রকম অপেক্ষা কি এখনো করছি না আমরা?
৫
এই সময়ে দাঁড়িয়ে কেন বলছি এই নাটকের কথা? কারণ এখন আমরাও পার করছি ভীষণ এক অ্যাবসার্ড সময়। চারপাশে তাকিয়ে দেখুন, যা-কিছু ঘটে চলেছে, সেগুলো কি কোনো স্বাভাবিক সময়ের ঘটনা? মাসের পর মাস হরতাল-অবরোধ চলছে, মানুষ পুড়ে মরছে পেট্রল বোমায়, মানুষ গুম হচ্ছে, অপহৃত হচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে, তাদেরকে আর ফিরে পাওয়া যাচ্ছে না, আর ‘ভুলক্রমে’ কারো সন্ধান পাওয়া গেলে রাষ্ট্র স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে না, বরং তাকে নিয়ে চলছে অবিরাম-অমানবিক মশকরা। উৎসবে নারীরা নিগৃহীত হচ্ছে, আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রধান সেটাকে জাস্টিফাই করছেন কতিপয় তরুণের ‘দুষ্টুমি’ হিসেবে! বাসে ধর্ষণ হচ্ছে, গাড়িতে ধর্ষণ হচ্ছে, নৌকায় ধর্ষণ হচ্ছে, ঘরে-বাইরে সর্বত্র ধর্ষণের মহোৎসব চলছে যেন। গার্মেন্টে আগুন লেগে পুড়ে মরছে শত শত শ্রমিক, গার্মেন্টস-ভবন ধসে চাপা পড়ে মরছে সহস্র শ্রমিক, আর তাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে সুরম্য অট্টালিকা গড়ছেন মালিক পক্ষ। যখন-তখন খুন হয়ে যাচ্ছে মানুষ, বইমেলা থেকে বেরিয়ে জনাকীর্ণ রাস্তায় খুন হচ্ছেন লেখক, বাড়ি সামনের গলিতে এসে ব্লগারদের কুপিয়ে মেরে ফেলা হচ্ছে। ভাগ্যান্বেষণে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বিদেশে যেতে গিয়ে সাগরেই ভাসছে মানুষ, কোনো দেশ তাদের নিতে চাইছে না, এমনকি নিজের দেশও নয়, যেন তারা দেশহীন মানুষ, বিদেশের গভীর জঙ্গলে আবিষ্কুত হচ্ছে গণকবর, আমাদেরই কোনো স্বজন হয়ত সেখানে নির্মম নিপীড়নে নিহত হয়ে শুয়ে আছেন। এত এত ঘটনা অথচ কোথাও কোনো টু শব্দ নেই। রাষ্ট্র নির্বিকার, সরকার নির্বিকার, সমাজের মুখর অংশটি অর্থাৎ লেখক-বুদ্ধিজীবীরাও নির্বিকার। যেন কোথাও কিছু ঘটছে না। অ্যাবসার্ড মনে হয় না আপনাদের কাছে, প্রিয় পাঠক? নাকি মনে হয় ‘সুবাতাস’ বইছে দেশজুড়ে?
হাসান আজিজুল হক ‘সাক্ষাৎকার’ শিরোনামে এক অদ্ভুত গল্প লিখেছিলেন অনেকদিন আগে। যে ‘লোকটা গত শতাব্দীর কায়দামাফিক সূর্যাস্ত দেখছিল’ আর ‘তার চোখে ফুটে উঠেছিল তন্ময় কল্পনা’ তাকে ধরে নিয়ে যায় কতিপয় অচেনা লোক, তাকে ‘রহমান সাহেব’ সম্বোধনে শুরু হয় জেরা, যদিও তার নাম রহমান নয়, হুমায়ুন কাদির। তারা ঠিক কী জানতে চায় পুরো গল্পে তা পরিষ্কার হয় না, বোঝা যায় তারা তার কাছ থেকে একটি স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করছে, কিন্তু কিসের স্বীকারোক্তি তা-ও বোঝা যায় না, বরং তাদের মুখে শোনা যায়Ñ
বুঝতে পারছি আপনি কিছুই স্বীকার করতে চান না। তাতে কিছুই এসে যায় না অবিশ্যি। কারণ আমরা সবই জানি, কাজেই আর কিছু জানার নেই। কারণ আমরা কিছুই জানি না, অতএব আর কিছুই জানার নেই।
এ রকম পরস্পরবিরোধী কথাবার্তা আর রহস্যময় আচার আচরণ পাঠককে বিমূঢ় করে তোলে। মনে হয়, যেন কোনো অ্যাবসার্ড নাটকের মহড়া চলছে (গল্পটি লেখাও হয়েছে অ্যাবসার্ড নাটকের ফর্মে)। পারম্পর্যহীন কথাবার্তার আরেকটি উদাহরণ তুলে দেওয়া যাকÑ
আমরা নিজেরা নিজেরা একতা আইনশৃঙ্খলা, দাঁড়িয়ে বসে বা মাটিতে শুয়ে যদি তা কোনোদিন দেখিয়ে দিতে পারি একসঙ্গে একসঙ্গে যে যেখানে আছে ঠিকঠাক পরিকল্পনা ঘাসে ভিটামিন জনকল্যাণ বন্যা প্লাবন মহামারী বাঁধ দাও লবণ ঠেকাও যতরকম চালবাজি রকবাজি ঠকবাজি নিলামবাজি জোতদারি মুনাফাখোরি খুন জখম রাহাজানি ভাবনাচিন্তা জাতীয় প্রেস দুই আর দুইয়ে চার আর সাতে ষোলো যার ফলে ছেষট্টি মোট নিশো তেত্রিশ কোটি দেশি বিদেশি চাল গম আটা সব মিলিয়ে সব।
হুমায়ুন কাদির এসব কথাবার্তা-জিজ্ঞাসাবাদ-আচার-আচরণ কোনোকিছুরই অর্থ উদ্ধার করতে পারে না, পারি না আমরাও। অবশেষে অজানা অপরাধে হুমায়ুন কাদিরের মৃত্যুদ- হয় এবং দ- কার্যকর করার আগে তাকে দু-মিনিট ভাববার সুযোগ দিলে সে ভাবেÑ
অনেককাল আগে একবার সবুজ ঘাসের মধ্যে শুইয়া আকাশের দিকে চাহিয়াছিলাম। উহার এক প্রান্ত হইতে অন্য প্রান্ত দেখা গিয়াছিল, উহা হালকা নীল ছিল। পরে উহা চুম্বনের দাগের মতো মিলাইয়া যায়। ইহার পর মানুষের জগতে ফিরিয়া আসিÑ তাহাতে নোনা টক গন্ধ আছে এবং আক্রোশ ও ঘৃণা রহিয়াছে এবং ভালোবাসা ও মমতা রহিয়াছে। মানুষের জীবনে কোথায় অন্ধকার তাহার সন্ধান করিতে গিয়া আমি ঘন নীল একটি ট্যাবলেটের সন্ধান পাইÑ মানুষ যে সামাজিক, সে নিজের ইতিহাস জানিতে চাহিয়াছে, তাহাতে সর্বদাই অন্ধকার নর্তনকুর্দন করিতেছে। তবু আমি মানুষেরই কাছে প্রার্থনা জানাইবÑ কারণ মানুষই মানুষের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া থাকেÑ যদিও ওই দাগ দেখা যায় না। অসংখ্যবার সঙ্গম করিয়াও যেমন আমি নারীতে ওই দাগ কখনো দেখি নাই। কোথাও কিছু পাই না বলিয়াই বাধ্য হইয়া আমি শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছেই প্রার্থনা ও আবেদন জানাইব। ইতিমধ্যে সব কিছু চমৎকার ঘটিয়াছে। অবশ্য অনেক কিছুই বাকিও রহিয়া গেল কারণ কিছুই শেষ হইবার নহে।
আমরা যে অ্যাবসার্ডিটির ভেতরে বাস করি, বিনা কারণে, অজানা অপরাধে আমাদের মৃত্যুদ- হয়ে যায়, আমাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়, স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয় কিন্তু আমরা বুঝেই উঠতে পারি না যে, আমাদের কাছে আসলে কী জানতে চাওয়া হচ্ছেÑ তার একটি প্রতীকী উপস্থাপন রয়েছে এই গল্পে। মৃত্যুমুহূর্তেও কোথাও কিছু পাইনি বলে আমরা মানুষের কাছেই প্রার্থনা ও আবেদন জানাই, কারণ মানুষই মানুষের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া থাকে।
এখন কি সেই প্রার্থনা জানাবার সুযোগটিও আর অবশিষ্ট আছে? এখনো কি মানুষই মানুষের গা ঘেঁষিয়া বসিয়া থাকে? এখনো কি একজনের আর্তচিৎকার, বাঁচবার আকুলতা-মাখা তীব্র আর্তচিৎকার অন্য কারো কানে পৌঁছায়? পৌঁছালেও কি কেউ সাড়া দেয়? কেউ কি পাল্টা চিৎকার দিয়ে বলেÑ মানুষকে বাঁচতে দিন, সম্মানজনক জীবন দিন? আর কেউ বলুক না বলুক, আমি বলে যাব। বলব, এই মৃত্যুউপত্যকা আমার দেশ না। এই দেশের জন্য লক্ষ্য মানুষ প্রাণ দেয়নি। রাষ্ট্রকে মানবিক হতেই হবে, মানুষকে মানুষের মর্যাদা দিতে হবে, মানুষকে বাঁচতে দিতে হবে। অন্য দশটা দেশের সঙ্গে তুলনা দিয়ে লাভ নেই, কোনো দেশই এত প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হয়নি। এই দেশে সেই শহীদদের উত্তরসুরিদের এতটা দুর্ভোগ প্রাপ্য নয়। হ্যাঁ, এইসব বলে যাব আমি। যদি মরতে হয়, তবু বলব।
গডোর জন্য অনন্ত অপেক্ষায় থাকতে থাকতে, তিনি আসবেন না জেনে, একসময় ভøাডিমির একটা কথা বলে, ‘আমরা সেইন্ট নই, কিন্তু আমরা আমাদের অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করেছি। কজন লোক এইটুকু বলতে পারে?’ হ্যাঁ, সান্ত¡না ওটুকুই, তৃপ্তিও। আমরা কেউ সেইন্ট নই, কিন্তু জীবনের কাছ থেকে কিছুই পাওয়ার নেই জেনেও, জীবনটা নিছক অর্থহীন একটা ব্যাপার জেনেও, আমরা আমাদের কাজটুকু করে যাই।
ওদের মতো আমিও, যদি কিছু না-ও পাওয়া যায়, তবু সবসময় আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করে যাব।