ভাতের থালা ও পানির জগ মাটিতে নামিয়ে রাখে আবুর মা। ঝাঁকড়া আমগাছটার নিচু শাখায় এসে বসে কালো ও ধূসর রং মেশানো একটা দাঁড়কাক। ভারিক্কি গলায় ডাকে, ‘ক্ব . . .।’ সঙ্গে সঙ্গে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায় না আবুর মা। কিছু সময় তাকিয়ে থাকে ওটার দিকে। তারপর যেন নিজের অজান্তেই বলে, ‘ধুজ্জাহ’। কোনো ভ্রƒক্ষেপ নেই কাকটার। আবার ডাকে, ‘ক্বা . . .।’ বিরক্তিটা এবার ওর চোখেমুখে ফুটে ওঠে। জফির শেখকে বলে, ‘কাউয়াডারে খেদান তো আবুর বাপ।’ কোনো ভাবান্তর দেখা দেয় না ওর ভেতর। বলে, ‘কাউয়া কি দোষ করল?’ আবুর মা একটু কাতর স্বরে বলে, ‘অলক্ষুইন্যা জাতের কাউয়া এইডা।’ একটু যেন ভাবে জফির শেখ। গামছাটা দড়ির মতো পেঁচিয়ে ঘষে ঘষে পিঠ চুলকায়। বলে, ‘লক্ষুইন্যা কাউয়া একটা দেখাইতে পারবা আবুর মা?’
চৈত্র মাসের তের তারিখ। আঙ্গুলের কর গোনে হিসাব করে জফির শেখ, ‘আর চাইর দিন বাকি’। মাথা থেকে গামছা খুলে মুখ মুছে। রোদে পোড়া শরীর মোছে। নতুন গামছা থেকে লাল রং বেরিয়ে হাতের তালু লালচে দেখায়। মনে মনে বিড়বিড় করে, ‘শালার পুতের পাক্কা রং!’
জগ থেকে পানি ঢেলে হাত ধোয় জফির শেখ। আধখানা গামছার টুকরোয় বাঁধা ভাতের থালার উপর থেকে প্ল¬াস্টিকের ঢাকনা সরায়। আউশ ধানের মোটা চালের ভাতগুলো ঝকমক করে উঠে। পাতের পাশে মাছের একটা টুকরোর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা লাল মরিচের ঝোল ক্ষুধা উসকে জিভে জল এনে দেয়। ঢোক গিলে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি খাইয়া আইছ তো আবুর মা?’ চুপ করে থাকে সে। শুকনো কয়টা আমপাতা কুড়িয়ে ঘাসের উপর বিছিয়ে পাছা পেতে বসে। আবার বলে জফির শেখ, ‘তুমারে না কয়দিন কইছি ভাত আনোনের আগে খাইয়া লইবা। ফিরা যাইয়া খাইবা কুন সময়।’ আবার ডেকে উঠে দাঁড়কাকটা, ‘ক্বা . . .।’ এবার কিছুটা বিরক্তি আসে জফির শেখের। হাত দিয়ে ঢিল ছোঁড়ার ভঙ্গি করে। মুখে বলে, ‘হুঁশ, হুঁশ।’ আরেকটা নিচু ডালে সরে বসে কাকটা। আবার ডাকে, ‘ক্ব . . .।’ এবার রাগ উঠে যায় ওর মাথায়। ধোয়া হাতের কথা ভুলে মাটির একটা ঢেলা কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারে। ঘাড় কাৎ করে নির্বিকারভাবে ওটার চলে যাওয়া দেখে কাকটা। ও যেন নিশ্চিত জানে যে জফির শেখের ছোঁড়া ঢিল ওর গায়ে লাগবে না কখনো। আরেকটা ঢিল কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারে। মুখে বলে, ‘গেলি শালার কাউয়া।’ বিপরীত প্রতিক্রিয়া দেখায় এবার আবুর মা, ‘থাউক, কাউয়া খেদান লাগব না, ভাত খান।’ আবার হাত ধুয়ে ভাতের থালা টেনে বসে জফির শেখ। গাছের ডাল থেকে এবার মাটিতে নেমে আসে কাকটা। গম্ভীর স্বরে ডাকে, ‘ক্ব . . .।’ ওরা গায়ে মাখে না ওর কর্কশ চিৎকার। ভাত খাওয়া প্রায় শেষ হলে আবুুর মা বলে, ‘ব্যাংকের মেনিজার আইছিল।’ ‘কুনডা?’ ‘ধলা লাম্বাডা।’ ‘অইডা আবার মেনিজার অইল কবে। হালায় তো পিয়ন।’ ‘সব্বেই তো নিজেরে মেনিজার কয়।’ ‘কি দিছো?’ ‘আছিল না তো কিছু। দুই আলি ডিম দিয়া বিদায় করছি। আবার আইব কইয়া গেছে। আপনেরে ঘরে থাকতে কইছে।’ ‘হ, এই চৈত মাসে জামির কাম ফালাইয়া হের লাইগ্যা ঘরে বইয়া থাকি।’ বিজ্ঞের মতো ধীরপায়ে কিছুটা এগিয়ে আসে কাকটা। ঘাড় উঁচু করে ডাকে, ‘ক্বা. . .।’ মেজাজটা আর ধরে রাখতে পারে না জফির শেখ। ভাতের থালাটা ছুঁড়ে মারে কাকটার দিকে। মাটি থেকে একটু উপরে লাফিয়ে উঠে আবার মাটিতে নেমে বসে কাকটা। ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে ছড়ানো ভাতগুলো আস্তে ধীরে খুঁটে খুঁটে খায়। কোনো তাড়া নেই ওর, অন্ন যোগানোর দায় নেই, দেনা-পাওনার বালাই নেই, ঘাড়ের পেছনে দাঁড়ানো নেই কোনো ব্যাংকের ‘মেনিজার’। শুধু ক্বা ক্বা আউড়ে দিব্যি চলে যায়। কিছু সময়ের জন্য একটু দার্শনিক হয়ে উঠে জফির শেখ। এই ক্ব বা ক্বা ধ্বনিটা ওদের নেই, যাদের আছে, অন্যের সম্পদে ভাগ বসানোই ওদের কাজ। কাকটাই বা আর কি দোষ করল?
ভাতের থালাটা কুড়িয়ে আনে আবুর মা। ‘কাউয়ার লগে রাগ কইরা লাভ কি।’ বাঁদিকে কাৎ হয়ে পেছন ফিরে হাত ধোয় জফির শেখ। পেটের জ্বালা নেভায় শরীরে কিছুটা আয়েশী আমেজ। বলে, ‘তুমি না কইলা অলক্ষুইন্যা কাউয়া।’ চুপ করে থাকে আবুর মা। মনে মনে ভাবে, ‘খামাকা কথা বাড়াইয়া লাভ কি?’ জগ থেকে সামান্য পানি ঢেলে পে¬টটা ধুয়ে গামছায় বেঁধে নেয় আবার। জগের বাকি পানিটুকু খায়। লেপ্টে বসা থেকে উঠতে গিয়ে কিছুটা বেআব্রু হয়ে পড়ে। ফিক করে হেসে উঠে জফির শেখ। এর পর ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে আবুর মা দেখে ওদের ছোট মেয়েটা দৌড়ে আসছে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়কাকটার কথা মনে পড়ে। কোনো দুঃসংবাদ না তো! মেয়েটা এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, ‘বাজান, পিয়ন জেডা আইছে। তাড়াতাড়ি যাইতে কইছে তুমারে। ভাইয়ে ট্যাকা পাডাইছে।’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে জফির শেখ। মনে মনে ভাবে, ‘চাইর দিন বাকি এহনো। ট্যাকাগুলা ফালাইয়া মেনিজারের মুখে জুতার বারি মারুম একটা কাইল। হালার পুতে আমার বাড়ি নিলাম দিব!’ আবুর মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘ডিম কয় আলি দিছিলা কইছিলা?’ অবাক হয় আবুর মা। ‘দুই আলি।’ মাথা চুলকে বলে জফির শেখ, ‘ফালানি গেল।’ আবুর মা বলে, ‘এমনেও কয়ডা ফালানি যাইব। কুইচ্চা মুরগিডার নিচের থাইক্যা তুইল্যা দিছি।’ ডিমের কথা ভুলে মেয়েটাকে তাগাদা দেয় জফির শেখ, ‘দৌড়াইয়া যা তো মা, তোর জেডারে ক একটু বইতে। ভাত কয়ডা খালি খাইলাম। দৌড়াইতে পারুম না।’ আবুর মা বলে, ‘মাইয়াডা দৌড়াইয়া আইল খালি।’ ওদের কথা না শুনে উল্টো দৌড়াতে থাকে মেয়েটা। চৈত্রের রোদে ওর কালো চোখমুখ বেগুনি হয়ে উঠেছে। আবার ওই দাঁড়কাকটার কথা মনে পড়ে আবুর মার। জফির শেখকে জিজ্ঞেস করে, ‘কাউয়াডা গেল কই, দেখি না যে।’ গাছের ফাঁকফোকরে খুঁজে দেখার চেষ্টা করে জফির শেখ। কোথাও ওটাকে না পেয়ে নিজেই ডেকে উঠে, ‘ক্ব . . .।’ অবাক হয় আবুর মা, ‘কই, কই, কাউয়াডা কই? দেখি না যে!’ গাছের ওপাশে যেয়ে মুখ ঘুরিয়ে আবার ডেকে উঠে জফির শেখ, ‘ক্বা . . .।’