অক্টোবর মাস তখনো শীতটা জোরেশোরে নামেনি। হেমন্তের শুরু প্রায়। মনে পড়ে বছর বিশ-পঁচিশ আগে সেপ্টেম্বর মাসেই শীতশীত অনুভব হতো আগস্ট মাসের গ্রীষ্মকালীন ‘ওবোন’ তথা বোন উৎসবের পরপরই। সকালবেলা উত্তর দিক থেকে প্রবাহিত হিমেল হাওয়ায় বেশ শীত অনুভূত হতো। এখন প্রকৃতি বদলে গেছে অক্টোবর মাসেও তেমন শীত পড়ে না। অথচ শীতপ্রধান দেশ জাপানে হেমন্তের শুরু থেকেই শীত নামার কথা।
গত বছরের (২০১৪) অক্টোবর মাসের ৮ তারিখ পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা তিনজনÑআমার স্ত্রী নোরিকো, মেয়ে টিনা ও আমি ‘ইজুমো তাইশা’ দেখার জন্য রওয়ানা দিলাম সকালবেলা ৮টায়। আমার অনেক বছরের স্বপ্ন জাপানের দুটি প্রাচীন ধর্মীয় উপাসনালয় দেখার একটি সবচেয়ে প্রাচীন ও গুরুত্বপূর্ণ শিন্তোও ধর্মীয় মহামন্দির ‘ইজুমো তাইশা’ অন্যটি রাজকীয় বংশধরদের ‘ইসে জিনগু’ মন্দির দেখার। এবার দেখে এলাম ইজুমো তাইশা, অদূর ভবিষ্যতে ‘ইসে জিনগু’ দেখার পরিকল্পনা রয়েছে। দুটোই জাপানের সুবিখ্যাত সাংস্কৃতিক সম্পদ। অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সম্পদও বটে।
জাপানকে আমরা শান্তিবাদী বৌদ্ধরাষ্ট্র হিসেবে জানি প্রকৃতপক্ষে সেটা সত্যি নয়। জাপানের নিজস্ব ধর্ম হচ্ছে ‘শিন্তোও’ যার অর্থ হচ্ছে ‘ঈশ্বরের পথ’, বৌদ্ধধর্ম ষষ্ঠ শতকে কোরিয়া থেকে জাপানে এসে অভূতপূর্ব মর্যাদার সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখনো শিন্তোও ধর্মীয় অনুসারীই জাপানে অধিক। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা। এই দেশে বহু বৌদ্ধমন্দির বিদ্যমান থাকলেও এক লক্ষের অধিক রয়েছে ছোটবড় শিন্তোও ধর্মীয় জিনজা বা মন্দির। জিনজার কয়েকগুণ বড় স্থাপনাকে বলা হয়ে থাকে তাইশা। যেমন ইজুমো তাইশা।
৮ তারিখ সকালে বেরিয়ে ট্রেনে চেপে চলে গেলাম এক ঘণ্টার মধ্যে হানেদা বিমানবন্দরে। বর্তমানে এটা টোকিও ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট নামে পরিচিত। জাপানের প্রথম বিমানবন্দর হিসেবে ১৯৩০ সালে নির্মিত হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে নারিতা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে নতুন একটি উন্মুক্ত হলে পরে হানেদা অভ্যন্তরীণ বিমান ওঠানামার জন্য নির্ধারিত হয়। তবে সম্প্রতি একে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। নির্দিষ্ট কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিমানের ওঠানামা ছাড়া অধিকাংশ সময়ে অভ্যন্তরীণ বিমানগুলোই ওঠানামা করে। নয়নাভিরাম হানেদা এখন জাপান তো বটেই বিশ্বের পঞ্চম ব্যস্ততম বিমানবন্দর। বছরে ৬০ মিলিয়ন যাত্রী ব্যবহার করছেন হানেদাকে। এখানে দুটি উইং একটি অভ্যন্তরীণ অন্যটি আন্তর্জাতিক।
অভ্যন্তরীণ উইংয়ের টিকিট কাউন্টারে এসে স্কাইমার্ক বিমান কোম্পানির ই-টিকিট দেখালে পরে সুন্দরী দুটি মেয়ে কর্মী কম্পিউটারে খোঁজাখুঁজি করে বলল, আপনাদের ফ্লাইট তো হানেদা নয়। নারিতা এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাই করতে হবে। ৯টা ৩৫ মিনিটে আপনাদের ফ্লাইট য়োনাগো বিমানবন্দরের দিকে যাওয়ার কথা, তাই না?
আমার স্ত্রী তো অবাক! আমরাও। আরে তাহলে পরিবর্তিত ই-টিকিট আরেকটি এসেছিল কী! হায়! ব্যস্ততার কারণে সেটা দেখা হয়নি। হয়ত টেবিলের বইপত্রিকার আড়ালে কোথাও লুকিয়ে আছে। কী করা তাহলে?
অন্য আরেকটি মেয়ে বললো, র্যাপিড ট্রেনে গিয়েও নারিতায় ফ্লাইট ধরা কঠিন। এখন দ্বিতীয় ফ্লাইট আছে সেটা হানেদা থেকে উড়বে দুপুর পৌনে একটার দিকে।
যাত্রাতেই এই অপ্রত্যাশিত ঘটনা। স্ত্রী যে কোম্পানি থেকে টিকিট কেটেছিল সেখানকার অফিসারকে ফোন করল। কিন্তু ভদ্রলোকের আজকে ছুটি। তবে তিনি ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন পরবর্তী বিমানে জানালেন। আমরা আশ্বস্ত হলাম। এখন সময় কাটাতে হবে।
সঙ্গে আমাদের হালকা ব্যাগ তিনজনের তিনটি। কারণ থাকবো মাত্র একটি রাত হোটেলে। বিমানবন্দরের সাজানো-গোছানো চোখ জুড়ানো দোকানপাটে ঘোরাঘুরি করে টুকটাক এটাসেটা কিনে ১২টার দিকে দুপুরের ভোজন সেরে নিলাম।
সাড়ে ১২টার সময় আমরা কাউন্টারে গেলাম। স্কাই মার্কের ছোট্ট বিমানবহর কিন্তু যাত্রীতে ঠাসা দেখতে পেলাম একটি কম্পিউটারের পর্দায়। একেবারে শেষের দিকে তিনটি সিটের ব্যবস্থা হলো। আমরা বিমানে চড়ে বসলাম। দেড়টার দিকে বিমান রানওয়ে থেকে উড়াল দিল আকাশে। দিনটি ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। ঘন নীল আকাশের মেঘের ওপরে বিমান উঠে স্থির হয়ে চলতে শুরু করল। পাইলট জানালেন, আবহাওয়া পরিষ্কার। বৃষ্টিবাদলার সম্ভাবনা নেই। হানেদা থেকে য়োনাগো বিমানবন্দরে ৫৮৫ কিলোমিটার বা ৩৬৪ মাইল এক ঘণ্টা পনের মিনিটে চলে যাওয়া যাবে।
য়োনাগো বিমানবন্দর হচ্ছে তোত্তোরি-প্রিফেকচারে অবস্থিত সমুদ্রসংলগ্ন। আমরা যাব পার্শ¦বর্তী শিমানে-প্রিফেকচারে। এই প্রিফেকচারে বিমানবন্দর নেই। বিমানে কফি সার্ভিস দেয়া হলো। পান করতে করতে আর মেঘের বিচিত্র রং-রূপ দেখতে দেখতে সোয়া ঘণ্টা কীভাবে চলে গেল টেরই পেলাম না।
সমুদ্রের তীর থেকে রানওয়ে তৈরি ফলে আমার মনে হলো বিমানটি যেন সমুদ্র থেকে পিচঢালা কালো রানওয়েতে উঠল। ছিমছাম সুন্দর ছোট্ট বিমানবন্দরটি। বেরিয়েই দেখতে পেলাম প্রবেশপথে সারি সারি বাস দাঁড়িয়ে। জাপানের দূরপাল্লার বাসগুলো এত সুন্দর ও আরামদায়ক যে নিমিষে ঘুম পেয়ে যায়।
বাসে চড়ে আধঘণ্টার মধ্যেই চলে এলাম শিমানে প্রিফেকচারের রাজধানী মাৎসুয়ে শহরে। এটা খুবই বিখ্যাত একটি শহর। হোটেল ঠিক করা ছিল। তোকিউইন হোটেলের ৬তলার একটি ডাবল বেডের রুম। বেশ বড়। কিন্তু বিছানা ঠিক তিনটি। কাচের বড় জানালা দিয়ে শহরটাকে দেখা যায়। শহরের হৃদয়জুড়ে বয়ে চলেছে কয়েকটি নদী। হোটেলের জানালা থেকে যে বড় নদীটি খুব সুন্দর ধীরলয়ে বয়ে চলেছে তার নাম হিইইকাওয়া।
রুমে ঢুকেই ব্যাগ থেকে কাপড়-চোপড় বের করে রেখে, টয়লেট সেরে, হাতমুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়লাম শহরে ঘুরতে। বেড়াতেই তো আসা। হোটেলে নিচে শহর পর্যটনের ছোট্ট বাস দাঁড়িয়ে আছে। সস্তা ভাড়ায় তিন ঘণ্টার মতো শহরের বিখ্যাত জায়গাগুলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবে। আবার ইচ্ছে করলে টাউন বাসে চেপেও ঘোরা যাবে।
শিমানে-প্রিফেকচারে রয়েছে অনেক বিখ্যাত পর্যটনকেন্দ্র যেমন, ইজুমো তাইশা, ইওয়ামি গিনযান ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার, রিউগেনজি মাবু মিনে টানেল, হাউজ অব দি কুমাগাই ফ্যামেলি, ফরমার কাওয়াশিমা রেসিডেন্স, শিমানে মিউজিয়াম অব এনসেন্ট ইজুমো, তেযেন মিউজিয়াম, দি ইজুমো মিউজিয়াম অব কিল্ট আর্ট, আর্কেওলজিক্যাল মিউজিয়াম অব কোজিদানি, মাৎসুয়ে ক্যাসল, নুকে ইয়াশিকি (সামুরাই রেসিডেন্স), লাফকাডিও হার্নস ফরমার রেসিডেন্স, লাফকাডিও হার্ন মেমোরিয়াল মিউজিয়াম, মেইমেই-এন টি রুম, মাৎসুয়ে হিস্ট্রি মিউজিয়াম, হোরিকাওয়া সাইটসিয়িং বোট, গেসশোজি টেম্পল, শিমানে আর্ট মিউজিয়াম, লেক শিনজি প্লেজার ক্রুইজ, কিয়োহাশি রিভার বোট জার্নি, ইউউশিয়েন জাপানিজ গার্ডেন, মাৎসুয়ে ভোগেল পার্ক, আদাচি মিউজিয়াম অব আর্ট, ইয়াসুগি-নুশি এন্টারটেইনমেন্ট হল ইত্যাদি। সবচে জনপ্রিয় হচ্ছে ইজুমো তাইশা মহামন্দির, ইতিহাসখ্যাত মাৎসুয়ে ক্যাসল বা দুর্গ, লাফকাডিও হার্নস ফরমার রেসিডেন্স এবং লাফকাডিও হার্ন মেমোরিয়াল মিউজিয়াম। সম্প্রতি এটাকে সরকার রাষ্ট্রীয় সম্পদ হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। ফলে এখন যেমনভাবে আছে তার চেয়েও আরও আকর্ষণীয় করে তুলবে কর্তৃপক্ষ ক্রমশ সেই পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। সরকার ঐতিহাসিক স্থান ও প্রতœনিদর্শনকে অত্যন্ত মূল্যবান সাংস্কৃতিক সম্পদ হিসেবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকেই গুরুত্ব দিয়ে আসছে। কারণ লাভজনক পর্যটন ব্যবসার অন্যতম উপাদানই হচ্ছে ঐতিহাসিক নিদর্শনসমূহ। জাপানি নাগরিক তো বটেই, বিদেশি পর্যটকদের জন্যও রয়েছে ভ্রমণ ও পর্যটন প্রতিষ্ঠানগুলোর বিভিন্ন পরিকল্পনা ও আয়োজন। এতে করে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী ব্যবসাসমূহ যেমন পরিচালিত হচ্ছে আবার বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জিত হচ্ছে। প্রতিবছরই বিভিন্ন জাতীয় ছুটির সময় জাপানিদের ঢল নামে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে।
আর জাপানি পর্যটনকেন্দ্রগুলো এতই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত নয়নাভিরাম এবং আনন্দদায়ক এমনটি অন্যদেশে আছে কিনা সন্দেহ জাগায়। অভিজাত বংশের পরিত্যক্ত ঐতিহ্যবাহী বাড়িঘরগুলোকেও জাপানিরা যেরকম শৈল্পিক রুচিবোধ দিয়ে সুসজ্জিত করে রাখে তার তুলনা খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।
মাৎসুয়ে ক্যাসল্কে ‘ব্ল্যাক ক্যাসল্’ বা ‘প্লাভার ক্যাসল্’ও বলা হয়ে থাকে। পরে এই দুর্গের ইতিহাস বলছি তার আগে যেখানে প্রথম নামলাম বাস থেকে তার কথা বলি। বাস থেকে দেখতে পেলাম অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্য। শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে চলেছে একটি স্বচ্ছজলের খাল কিন্তু জাপানিরা খালকেই ‘কাওয়া/গাওয়া’ বা নদী বলে থাকেন। এই অগভীর খালটির নাম কিয়োহাশি-গাওয়া। নদীটির দুপাশে রাস্তা এবং দোকানপাট ও নতুন-পুরনো ঐতিহ্যবাহী বাড়িঘর। বিশেষ ধরনের নৌকোতে চড়ে নদীবিহার করছেন পর্যটকরা। নদীর পাড় ধরেই বাসে করে মাৎসুয়েজোও বাসস্টেশনের সামনে নেমে বাসকে বিদায় দিলাম। বাসটি তাইশোও যুগের (১৯১২-২৪) নকশাসম্বলিত দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি আরামদায়ক। চালক ছিলেন একজন নারী। দুর্গসংলগ্ন পরিখা যার নাম ‘হোরিকাওয়া’ মানে ‘হোরি নদী’ তার পশ্চিম পাড়ে রয়েছে বিশ্ববিখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক লাফকাডিও হার্ন (১৮৫০-১৯০৪) এর একদা বসতবাড়ি এবং স্মৃতিজাদুঘর। এই স্থানটি মাৎসুয়ে-সিটির ওকুদানি-চো নামক স্থানে অবস্থিত। সারিসারি চমৎকার সব পুরনো-নতুনে মেশানো অনুচ্চ কাঠের ও ইটের তৈরি বাড়িঘর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাস্তার পাশে ঝাউ, ম্যাপল, সাকুরাসহ নানা বৃক্ষের গাঢ় সবুজে আচ্ছাদিত নিরিবিলি এই জায়গাটিতে মধ্যযুগে ছিল সামুরাই কর্মকর্তাদের সারিবদ্ধ বসতবাড়ি। এখনো কিছু বাড়ি রয়ে গেছে সেই আমলের যা দেখার জন্য ইতিহাসপ্রিয় মানুষের আগ্রহের শেষ নেই! আমিও তাদেরই একজন। স্বপ্ন ছিল সামুরাইদের বাড়িঘর কেমন ছিল দেখার, এবার এখানেই দেখা হয়ে গেল হার্নের প্রাক্তন বাড়ির কাছেই ‘বুকে ইয়াশিকি’।
যেহেতু হার্ন মেইজি যুগে (১৮৬৮-১৯১২) জাপানে এসে বসত গেড়েছিলেন তখনও এই অঞ্চলটি মধ্যযুগ তথা এদো যুগের (১৬০৩-১৮৬৮) মতোই ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ব্যাপক পরিবর্তন হতে থাকে। অতীতকে মূল্যায়িত করেই লেখক হার্নের বাড়িটিকে সেভাবেই সজ্জিত করে রাখা হয়েছে। এমনভাবে রাখা হয়েছে যেন, যেকোনো মুহূর্তে তাঁর আবির্ভাব হতে পারে! তাঁর বাড়িটির পাশাপাশি আরেকটি বাড়িতে নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিজাদুঘর।
বাঙালি পাঠক লাফকাডিও হার্ন সম্পর্কে কতখানি জানেন জানা নেই তথাপি এখানে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। আমি যখন জাপানে আসি ১৯৮৪ সালে জাপানি ভাষা ও সংস্কৃতির ছাত্র হিসেবে তখন আমার ভাষাশিক্ষিকা আশিহারা কিয়োকো আমাদেরকে হার্নের ইতিহাস বলেছিলেন। তখন হার্নের ইংরেজিতে লিখিত ‘এষরসঢ়ংবং ড়ভ টহভধসরষরধৎ ঔধঢ়ধহ’ গ্রন্থটি কিনে পড়েছিলাম অজানা পুরনো রূপকথাময় জাপানকে জানার জন্য। জাপানি সংস্কৃতিকে তিনি যেভাবে পশ্চিমা বিশ্বকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তার তুলনা মেলা ভার! তিনি বিখ্যাত হয়ে আছেন তাঁর লিখিত এবং অনূদিত গ্রন্থসমূহ দ্বারা যেগুলো প্রাচীন জাপানের কুসংস্কার, ভূতপ্রেত, রূপকথা, লোকগল্প এবং কিংবদন্তির কাহিনিগুলো বিধৃত। সম্ভবত পশ্চিমা বিশ্ব তাঁর মাধ্যমেই প্রথম জাপানের প্রামীণ লোকসাহিত্যকে জানতে সক্ষম হয়।
এহেন হার্ন ছিলেন প্রথম জীবনে একজন ভাগ্যবিড়ম্বিত পুরুষ। তিনি ২৭ জুন ১৮৫০ সালে গ্রিক-আইরিশ দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন গ্রিসের ইতিহাসখ্যাত আইওনিয়ান দ্বীপপুঞ্জের অন্যতম লেফকাদা দ্বীপে। এই লেফকাদা দ্বীপের নামানুসারে তাঁর নাম রাখা হয় লাফকাডিও। প্রকৃতপক্ষে তাঁর নামটি ব্যাপটিস্ট খ্রিস্টিয় অনুসারে দীর্ঘ একটি নাম : চধঃৎরপশ খবভপধফরড় কধংংরসধঃর ঈযধৎষবং ঐবধৎহ. তাঁর পিতার নাম চার্লস বুশ হার্ন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ শাসনাধীন আইওয়ান দ্বীপপুঞ্জের উচ্চপদস্থ শল্যবিদ সার্জন-মেজর। মাতা ছিলেন রোসা অ্যান্থনিও কিসিমাতিস গ্রিসের অভিজাত কাইতেরান বংশোদ্ভূত।
শিশুকাল থেকেই পারিবারিকভাবে তাঁর যৌবনের উত্থানপর্ব পর্যন্ত তাঁকে নানা বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হয়। পিতামাতা বিচ্ছিন্নভাবে গ্রিস, ওয়েস্টইন্ডিজ এবং আয়ারল্যান্ডে জীবন কাটান। পরিশেষে অভিভাবকের যখন বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে হার্ন তখন মাত্র ৬ বছর বয়সী এবং বাধ্য হয়ে আয়ারল্যান্ডে পিতার কাকিমা তথা দাদিমা সারাহ্ ব্রেনানের আশ্রয়ে যান। অভিজাত এবং বিধবা ব্রেনান তাঁকে প্রতিপালন করেন। দাদিমার সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারে তিনি বিখ্যাতসব গ্রন্থের পাশাপাশি গ্রিক পুরাণগুলোও পড়ে ফেলার দারুণ সুযোগ লাভ করেন। সেখানে ১৬ বছরের মাথায় হার্ন এক অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় তাঁর একটি চোখের দৃষ্টি হারিয়ে ফেলেন। এই ঘটনার এক বছর পর তাঁর পিতার মৃত্যু ঘটলে তাঁর দাদিমার সম্পত্তি বিলুপ্ত হয়। হার্ন স্কুল থেকে বিতাড়িত হন। তারপর দাদিমার প্রাক্তন নারী গৃহকর্মীর বাড়িতে আশ্রয় নেন লন্ডন মহানগরের পূর্বপ্রান্তে। কিন্তু সেই নারী গৃহকর্মী এবং তাঁর স্বামীর তেমন উপার্জন ছিল না হার্নকে প্রতিপালনের। ফলে উপায়ন্তর না দেখে হার্ন ১৯ বছর বয়সে আমেরিকা পাড়ি দেন। আমেরিকার ওহিও রাজ্যের চিনচিনাটি শহরে দাদিমার স্বামীর এক আত্মীয় হেনরি হার্ন মলিনাক্স এর বোনের বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিন্তু সেখানেও তিনি বেশিদিন থাকতে পারেননি কারণ উক্ত দম্পতি আদৌ সচ্ছল ছিলেন না। মলিনাক্সের বোন-জামাই থমাস কুলিনান হার্নকে ৫টি ডলার দিয়ে নিজের ভাগ্য নির্ধারণে লড়াই করার জন্য বলেন। হার্ন তখন পূর্ণ যুবক। গৃহহীন হয়ে কিছুদিন দিনমজুদের জন্য নির্ধারিত বস্তিপ্রায় কলোনিতে বসবাস করেন। একদিন হঠাৎ করেই একজন ইংরেজ মুদ্রক এবং পত্রিকার কলামিস্ট হেনরি ওয়াটকিন যিনি ছিলেন সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শী তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। তিনি তাঁকে তাঁর মুদ্রণ ব্যবসায়ে কাজ দেন। হার্ন সেখানে এটা-সেটা কাজ করে জীবন নির্বাহ করেন। ওয়াটকিন তাঁর গ্রন্থাগার থেকে হার্নকে দামি দামি গ্রন্থাদি পাঠ করার সুযোগ দেন। বিশেষ করে উইটোপিয়ান সোস্যালিস্ট ফ্রাঙ্কোয়িস মারিয়ে চার্লস ফোরিয়ার, উইলিয়াম হেপওয়ার্থ ডিক্সন, জন হামফ্রে নোয়েজ প্রমুখের গ্রন্থাদি উল্লেখযোগ্য। ওয়াটকিন তাঁকে ‘রেইভান’ ডাকনাম দিয়েছিলেন যা তাঁর মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। রেইভান হচ্ছে মার্কিন কবি এডগার এলান পোর একটি বর্ণনাত্মক কবিতার চরিত্র দাঁড়কাক।
হার্ন নিয়মিত চিনচিনাটি নগর গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়তেন। সেসময় এই গ্রন্থাগারে ৫০,০০০ গ্রন্থাদি ছিল। সমৃদ্ধ এই গ্রন্থাগারে বিস্তর সাহিত্যবিষয়ক বই পড়ার সুযোগ পান। তাঁর যখন ২১ বছর বয়স ১৮৭১ সালে একটি চিঠি পান তাতে ছিল দাদিমার মৃত্যুসংবাদ।
হার্নের বয়স যখন ২৪ তিনি সাংবাদিকতা শুরু করেন দি ডেইলি চিনচিনাটি ইনকুইরার পত্রিকায়। সৃজনশীল স্বাধীনতার সুযোগে তিনি এই প্রচারবহুল পত্রিকায় স্থানীয় ভয়ঙ্কর খুনাখুনির ঘটনাগুলোকে রোমাঞ্চকর অনুভূতি মিশিয়ে লিখতেন। পাশাপাশি আরও লিখতেন অনগ্রসর মানুষদের স্পর্শকাতর চিন্তা-ভাবনা, দাবি-দাওয়া-সমস্যাদি নিয়ে। যে কারণে তিনি এই পত্রিকার শীর্ষ এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাংবাদিক হিসেবে দারুণ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৮৭৪ সালে তাঁর একটি খুনের কাহিনি ‘টেনিয়ার্ড মার্ডার’ ধারাবাহিকভাবে একনাগাড়ে কয়েকটি মাসের জন্য আলোড়ন সৃষ্টি করে এবং পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। ফলে কর্তৃপক্ষ তাঁর পারিশ্রমিক সাপ্তাহিক ১০ ডলার থেকে ২৫ ডলার বাড়িয়ে দেয়। আমেরিকার সুবিখ্যাত অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দি লাইব্রেরি অব আমেরিকা বিগত ২০০ বছরের ‘আমেরিকান ট্রু ক্রাইম’ নামক একটি স্মারকসংকলন প্রকাশ করে ২০০৮ সালে হার্নের লিখিত একটি খুনের প্রতিবেদন তাতে সংযুক্ত হয়। পত্রিকায় সাংবাদিকতার সুবাদে তিনি বিদেশি সাহিত্য অনুবাদের দিকেও ঝুঁকে পড়তে থাকেন। অভূতপূর্ব অনুবাদের কারণে তাঁর সাহিত্যমেধা দ্রুত স্বীকৃতি লাভ করে।
১৮৭২ সালে তিনি আরও একটি অনন্য কাজ করেন। সেটি হলো ফ্রান্সে জন্ম আমেরিকায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হেনরি ফ্রাঙ্কোয়িস ফার্নি নামক এক তরুণ চিত্রকর যিনি পরবর্তীকালে চিত্রশিল্পী হিসেবে প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে যৌথভাবে ৮ পৃষ্ঠার নকশাসম্বলিত সাপ্তাহিক কাগজ ‘ইয়া গিগলাম্পজ’ প্রকাশ করে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেন। এতে সাহিত্য, শিল্পকলা এবং বিদ্রƒপাত্মক রচনা ও অঙ্কনচিত্র বা কার্টুন থাকত। মাত্র ৯ সপ্তাহে ৯টি সংখ্যার আয়ু নিয়ে জন্ম এই পত্রিকাটির সবকয়টি সংখ্যা নিয়ে চিনচিনাটি পাবলিক লাইব্রেরি একটি সংকলন প্রকাশ করে ১৯৮৩ সালে। কাগজটি প্রসঙ্গে চিনচিনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংলিশ ও জার্নালিজম বিভাগের অধ্যাপক, গবেষক এবং সাংবাদিক জন খ্রিস্টোফার হিউজেস তাঁর লিখিত ‘ণব এরমষধসঢ়ু ধহফ ঃযব অঢ়ঢ়ৎবহঃরপবংযরঢ় ড়ভ খধভপধফরড় ঐবধৎহ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন, ণবধৎং নবভড়ৎব খধভপধফরড় ঢ়ৎড়ফঁপব ঃযব ঔধঢ়ধহবংব পড়ষষপঃরড়হং ড়ভ ফবংপৎরঢ়ঃরাব ংশবঃপযবং, বংংধুং, ভড়ষশ ঃধষবং ধহফ মযড়ংঃ ংঃড়ৎরবং ভড়ৎ যিরপয যব রং শহড়হি ধহফ ৎবঢ়ঁঃবফ ধং সরহড়ৎ সধহ ড়ভ ষবঃঃবৎং, যব ংঢ়বহঃ ধনড়ঁঃ ংরী ুবধৎং (১৮৭২-১৮৭৮) ধং ধ ভঁষষঃরসব লড়ঁৎহধষরংঃ রহ ঈরহপরহহধঃর. ওঃ ধিং ফঁৎরহম যরং ধঢ়ঢ়ৎবহঃরপবংযরঢ় ঃযধঃ ঐবধৎহ বীঢ়বৎরসবহঃবফ রিঃয ঃযব ংঃুষব ধহফ ঃযবসব বারফবহঃ রহ যরং ষধঃবৎ, সড়ৎব সধঃঁৎব ৎিরঃরহম. চবৎযধঢ়ং ঃযব সড়ংঃ ভধংপরহধঃরহম ংঁংঃধরহবফ ঢ়ৎড়লবপঃ রং ঁহফবৎঃড়ড়শ ধিং ধং বফরঃড়ৎ ড়ভ ঃযব ংযড়ৎঃ-ষরাবফ রষষঁংঃৎধঃবফ পড়সরপ বিবশষু ণব এরমষধসঢ়ু. ঞযব ঢ়ঁনষরপধঃরড়হ ষধংঃবফ ড়হষু হরহব বিবশং, নঁঃ ধভভড়ৎফবফ ঐবধৎহ ঃযব ড়ঢ়ঢ়ড়ৎঃঁহরঃু ঃড় ড়িৎশ রিঃয যিধঃ যব পধষষবফ ঃযব “ঋৎবহপব ংপযড়ড়ষ ড়ভ ংবহংধঃরড়হ.”
২৩ বছর বয়সে হার্ন এলেথিয়া ফোলি নামে ২০ বছরের একটি নিগ্রো মেয়েকে বিয়ে করেন। কিন্তু এই বিয়ে টিকেনি কারণ তখন আমেরিকাতে খ্রিস্টানদের জন্য ভিন্ন প্রবংশের নরনারীকে বিবাহ করার বিরুদ্ধে আইন বলবৎ ছিল (অহঃর-সরংপবমবহধঃরড়হ ষধংি). তাঁর বিবাহের সংবাদ পেয়ে স্থানীয় ক্রিস্টান পাদ্র্রী পত্রিকার কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ করেন। তাছাড়া তাঁর স্বসম্পাদিত ইয়া গিগপাম্পজ কাগজে রাজনীতিকদের উপহাস ও বিদ্রƒপ করে লেখা ও কার্টুনের কারণে স্থানীয় রাজনীতিকরা তাঁর ওপর ক্ষ্যাপা ছিলেন, তারাও এই সুযোগ হাতছাড়া না করে তাঁর অবৈধ বিবাহের সমালোচনা করতে থাকেন। এতে ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে চাকরি থেকে খারিজ করে দেয় সম্পাদক হার্নকে। হার্ন তাতে ভ্রƒক্ষেপ না করে দ্রুত চিনচিনাটি ইনকুইরারের প্রতিপক্ষ ‘দি চিনচিনাটি কর্মাশিয়াল’ পত্রিকায় যোগ দেন। তখন তাঁর লেখার গুণে উক্ত পত্রিকার প্রচারসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে যায়। উপায় না দেখে ইনকুইরারের সম্পাদক তাঁকে লোভনীয় বেতনের প্রস্তাব দিয়ে ফিরে আসার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু একদা অপদস্ত হওয়ার কারণে হার্ন সেই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। ১৮৭৭ সালে হার্ন ও ফোলি বিবাহবিচ্ছেদ ঘটান। পরে অবশ্য ফোলি আবার বিয়ে করেন ১৮৮০ সালে।
হোলির সঙ্গে বিচ্ছেদ হার্নের তরুণ মননে গভীর রেখা সৃষ্টি করে। যে অক্লান্ত মনে তিনি পত্রিকায় প্রতিবেদন লিখেছেন সেই উচ্ছলতা হারিয়ে ফেলেন। তবে কিছুদিন চিনচিনাটির সবচে উঁচু গির্জা, ভবনাদির চূড়া পরিষ্কার ও মেরামতকারী স্টীপলজ্যাক হিসেবে খ্যাত জোসেফ রোডরিগুয়েজ ওয়েস্টনকে নিয়ে প্রতিবেদন লেখেন আধেক ভয়ানক, আধেক কমিক জাতীয় বর্ণনা দিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতার আলোকে। এছাড়াও আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময়কার চিনচিনাটির অনগ্রসর কৃষ্ণাঙ্গদের দুঃখ-দুর্দশা-সমস্যা-বৈষম্য নিয়েও লেখালেখি করেন। গৃহযুদ্ধ চলাকালীন কৃষ্ণাঙ্গদের গীত গান নিয়েও তিনি প্রতিবেদন লিখেন। তারপর খ্যাতিমান ফরাসি কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক, সাংবাদিক এবং শিল্প-সাহিত্যের সমালোচক পিয়েরে জুলেস থিয়েফিল গোটিয়ার রচনাসমূহ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদের কাজে মগ্ন হয়ে পড়েন এবং ক্রমশ চিনচিনাটির পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে অসমর্থ হয়ে পড়েন। প্রাক্তন মালিক ওয়াটকিনকে একটি চিঠিকে তাঁর মানসিক অবস্থার কথা জানিয়ে চিনচিনাটি ছেড়ে দিয়ে লুজিয়ানা প্রদেশের নিউওরলিয়েন্সে চলে যাওয়ার বাসনা জানান। সেই মোতাবেক ওয়াকটিন ও চিনচিনাটি কমার্শিয়াল পত্রিকার প্রকাশক মুরাট হালস্টেড-এর সহযোগিতায় নিউওরলিয়েন্সের দিকে যাত্রা করেন হার্ন।
হার্ন নিউওরলিয়েন্সে প্রায় এক দশক অবস্থান করেন। ১৮৭৮ সালে দি সিটি আইটেম এবং পরে দি টামইস ডেমোক্রেট পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। চার পৃষ্ঠার পত্রিকা আইটেমের চরিত্রকে দ্রুত নাটকীয়ভাবে বদলে দেয় হার্নের উপসম্পাদকীয়। এই পত্রিকায় তিনি বার্তা সম্পাদক হিসেবে যোগ দেন। পত্রিকাটিতে প্রকাশ করতে থাকেন মার্কিন কবি ও লেখক ফান্সিস ব্রেট হার্ট, ফরাসি লেখক ও প্রকৃতিবাদী এমিল জোলা প্রমুখের বিখ্যাত গ্রন্থাদির আলোচনা। তখনকার নিউইয়র্ক থেকে প্রকাশিত প্রভাবশালী সাপ্তাহিক ‘হারপারস’ কাগজেও তিনি সংক্ষিপ্ত বিষয়াদি লিখতে থাকেন। তাঁর লেখায় বৌদ্ধধর্ম, সংস্কৃত সাহিত্যেরও আবির্ভাব ঘটতে থাকে। এখানে তিনি আরও একটি উল্লেখযোগ্য কাজ করেন। নিউওরলিয়েন্সের নাগরিকদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানাবিধ চিত্র তুলে ধরতে থাকেন কাঠখোদাই চিত্রে। কিন্তু বেশিদিন সেটা করতে পারেননি তাঁর চোখে বিরূপ প্রভাব পড়ার কারণে। কিন্তু তাঁর এই কার্টুন জাতীয় কাজটি দক্ষিণাঞ্চলীয় পত্রিকার ইতিহাসে এই প্রথম আইটেম পত্রিকাকে জনপ্রিয়তা যেমন এনে দেয়, প্রচারসংখ্যার শীর্ষেও নিয়ে যায়।
১৮৮১ সালের দিকে হার্ন দি টাইমস ডেমোক্রেট পত্রিকায় ফ্রান্স ও স্পেনীয় পত্রিকার সংবাদ ইংরেজিতে অনুবাদ করা শুরু করেন। পাশাপাশি সম্পাদকীয়, উপসম্পাদকীয়, শিল্প-সংস্কৃতির পর্যালোচনা। একই সঙ্গে বিখ্যাত ফরাসি লেখকদের রচনাও ইংরেজিতে অনুবাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন। লেখকরা যথাক্রমে জেরার ডি নার্ভেল, আনাতোলে ফ্রাঙ্ক, পিয়েরে লোটি, মিল্টন ব্রোনার প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। মিল্টন ব্রোনার হার্নের লেখার স্টাইলকে প্রভাবিত করেছিলেন।
নিউওরলিয়েন্সে থাকার সময় তিনি বহু লেখা লিখেছেন। বহু রচনা তাঁর হারিয়েও গেছে সংগ্রহের অভাবে। শহরের লুজিয়ানা ক্রিয়োল জনসংখ্যা যারা বহিরাগত জাতি-গোষ্ঠীর বশংবদ, আফ্রিকান ডিয়াসপোরা কৃষ্ণাঙ্গদের ভুদু লোকসংগীত সম্পর্কিত প্রতিবেদনসমূহ তাঁর অসামান্য মূল্যবান রচনা বলে বিবেচিত। বহু প্রশংসিত রচনা তাঁর প্রকাশিত হয়েছে প্রভাবশালী জাতীয় কাগজ হারপারস, স্ক্রাইবনার্স ম্যাগাজিনে, এগুলোতে উঠে এসেছে স্থানীয় স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ছাড়াও ঔপনিবেশিক যুগে আগত বহিরাগতদের সংগীত, সাহিত্য ও সংস্কৃতির চালচিত্র। লুজিয়ানা সংক্রান্ত তাঁর কয়েকটি গ্রন্থ ও রচনা যথাক্রমেÑ এড়সনড় ুযèনবং : খরঃঃষব ফরপঃরড়হধৎু ড়ভ ঈৎবড়ষব ঢ়ৎড়াবৎনং (১৮৮৫), খধ ঈঁরংরহব ঈৎল্কড়ষব (১৮৮৫), ঈযরঃধ : অ গবসড়ৎু ড়ভ খধংঃ ওংষধহফ (১৮৮৯), ১৮৫৬ খধংঃ ওংষধহফ যঁৎৎরপধহব ইত্যাদি। হারপারস ইউকলি ম্যাগাজিনে প্রবাসী ফিলিপিনোদের নিয়েও একাধিক প্রতিবেদন লিখেছেন। ২০০১ সালে লেখক স্টার এস ফ্রেডেরিক প্রকাশ করেছেন হার্ন রচিত অনেক রচনার একটি মূল্যবান সংকলন : ওহাবহঃরহম ঘবি ঙৎষবধহং : ডৎরঃরহমং ড়ভ খধভপধফরড় ঐবধৎহ.
১৮৮৭ সালে হারপারস ম্যাগাজিনের সংবাদদাতা হিসেবে হার্ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দ্বীপপুঞ্জে যান। সেখানকার ক্যারিবিয়ান সাগরের মার্টিনিক দ্বীপ-শহরে ছিলেন দু-বছর। সেখানকার দ্বীপাঞ্চলীয় মানুষদের নানাবিধ জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির খবর ও প্রতিবেদন তিনি লিখে পাঠিয়েছেন হারপারস পত্রিকায়। সেগুলোরই গ্রন্থিত রূপ হচ্ছেÑঞড়ি ণবধৎং রহ ঃযব ঋৎবহপয ডবংঃ ওহফরবং এবং ণড়ঁসধ, ঞযব ঝঃড়ৎু ড়ভ ধ ডবংঃ-ওহফরধহ ঝষধাব. দুটো অসামান্য গ্রন্থই ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
এবং ১৮৯০ সালেই হারপারসের প্রতিনিধি হিসেবে জাপানে আগমন করেন। কিন্তু কোনো এক ঘটনার কারণে তাঁর নিয়োগ বাতিল হয়ে যায়। এর আগে আমেরিকায় পরিচিত হওয়া জাপানি রাজনীতিবিদ এবং মেইজি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হাত্তোরি ইচিজোও নামক এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে। সেই কর্মকর্তারই এক সুপারিশক্রমে জুলাই মাসে শিমানে-প্রিফেকচারের উচ্চ বিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষার শিক্ষক হিসেবে নিয়োগপত্র পান। পরের মাস আগস্টে তিনি শিমানে-প্রিফেকচারের মাৎসুয়ে শহরে এসে পৌঁছেন। এখানেই তিনি খুঁজে তাঁর গন্তব্যস্থলÑশান্তিময় গৃহ এবং সুখী পরিবার। তাঁর নতুন কাজে অশেষ অনুপ্ররেণা জোগায় সম্পূর্ণ ভিন্ন এক আবিষ্কার জাপানি সংস্কৃতি। পশ্চিম জাপানে অবস্থিত জাপান সাগরসংলগ্ন দ্বীপ শিমানে-প্রিফেকচারে এসেই তিনি সবুজ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং স্থানীয় মানুষজনের অমায়িক ব্যবহার দেখে দারুণ মুগ্ধ হয়ে পড়েন।
মাৎসুয়ে শহরে তিনি প্রায় দেড় বছর অবস্থানকালে পরিচিত হন স্থানীয় উচ্চপদস্থ সামুরাই কোইজুমি পরিবারের কন্যা কোইজুমি সেৎসুর সঙ্গে। হার্ন তখন ৪০ বছর বয়সী। তাঁরা একে অপরের ঘনিষ্ঠ হতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে এসে ভাঙাভাঙা জাপানি ভাষায় দুজন দুজনকে তাঁদের অনুভূতি বোঝাতে সমর্থ হন। তারপর হার্নের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মাৎসুয়ের মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক এবং শিক্ষাবিদ নিশিদা ছেনতারোওর সহযোগিতায় ১৮৯১ সালের জানুয়ারি মাসে দুজনে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এটা ছিল জাপানে ১৯১ নম্বর আন্তর্জাতিক বিবাহ। শিমানে-প্রিফেকচারে প্রচ- শীত এবং বরফ পড়ার কারণে তিনি অনিচ্ছা সত্ত্বেও দক্ষিণের তুলনামূলক উষ্ণ আবহাওয়ার কুমামোতো-প্রিফেকচারের হাইস্কুলে ইংরেজির শিক্ষক হিসেবে চাকরি নেন। এখানে দু বছর চাকরি করার সময় তাঁর প্রথম সন্তান কোইজুমি কাজুও জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৩ সালে।
১৮৯৪ সালে দক্ষিণ জাপানের হিয়োগো-প্রিফেকচারের রাজধানী কোবের প্রকাশিত সংবাদপত্র জাপান ক্রনিকলে চাকরি নিয়ে কোবে বন্দরনগরে চলে যান। এখানে বছর দুই কাজ করার পর ১৮৯৬ সালে টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯০৪ সালে বিখ্যাত ওয়াসেদা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের প্রভাষক হিসেবে যোগদানের আমন্ত্রণ লাভ করেন। ১৯০৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী ও তিন পুত্র সন্তান যথাক্রমে কোইজুমি কাজুও, ইনাগাকি ইয়াও এবং কোইজুমি কিয়োশি এবং একমাত্র কন্যা কোইজুমি সুজুকোকে রেখে যান।
লাফকাডিও হার্ন রচিত অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থÑ ঝড়সব ঈযরহবংব এযড়ংঃং (১৮৮৭), ঙঁঃ ড়ভ ঃযব ঊধংঃ (১৮৯৫), কড়শড়ৎড় (১৮৯৬), এষবধহরহমং রহ ইঁফফযধ-ঋরবষফং (১৮৯৭), ঊীড়ঃরপং ধহফ জবঃৎড়ংঢ়বপঃরাবং (১৮৯৮), ওহ এযড়ংঃষু ঔধঢ়ধহ (১৮৯৯), ঝযধফড়রিহমং (১৯০০), অ ঔধঢ়ধহবংব গরংপবষষধহু (১৯০১), কড়ঃঃড় (১৯০২), কধিরফধহ (১৯০৪), ঔধঢ়ধহ : অহ অঃঃবসঢ়ঃ ধঃ ওহঃবৎঢ়ৎবঃধঃরড়হ (১৯০৪), ঞযব জড়সধহপব ড়ভ ঃযব গরষশু ডধু ধহফ ড়ঃযবৎ ংঃঁফরবং ধহফ ংঃড়ৎরবং (১৯০৫). তাছাড়া চিরিমেনহোন বা হাতে তৈরি ওয়াশি পেপারে মুদ্রিত গ্রন্থ যথাক্রমেÑ ঞযব নড়ু যিড় ফৎবি পধঃং (১৮৯৮), ঞযব এড়নষরহ ঝঢ়রফবৎ) (১৮৯৯), ঞযব ড়ষফ ড়িসধহ যিড় ষড়ংঃ যবৎ ফঁসঢ়ষরহম (১৯০২), ঈযরহ ঈযরহ কড়নধশধসধ (১৯০৩). ঞযব ঋড়ঁহঃধরহ ড়ভ ণড়ঁঃয (১৯২২). এছাড়াও মেইজি যুগের খ্যাতিমান প্রকাশক হাসেগাওয়া তাকেজিরোও সম্পাদিত ইংরেজি জাপানের রূপকথা সিরিজ গ্রন্থে লাফকাডিও হার্নের অনূদিত ৫টি রূপকথার গল্প অন্তর্ভুক্ত আছে।
হার্নকে নিয়ে এই পর্যন্ত তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্রসহ জাপানি ও বিখ্যাত বিদেশি লেখকরা অনেক গ্রন্থ লিখেছেন যেমন নোগুচি য়োনেজিরোও, ইবহ ঐবপযঃ, ঔড়যহ ঊৎংশরহব, গধষপড়ষস ঈড়ষিবু প্রমুখ। তাঁর জীবনালেখ্য নিয়ে জাতীয় এনএইচকে টিভি নাটক নির্মাণ করেছে। তাঁর কধিরফধহ গল্প নিয়ে নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। তাঁর জীবনের ওপর আলোকচিত্র প্রদর্শনীও অনুষ্ঠিত হয়েছে।
হার্ন আজকে জাপানে এক কিংবদন্তি। কেউ কেউ মনে করেন হার্ন জাপানের মায়ার মোহে পড়েছিলেন যেমন প্রসিদ্ধ জাপানতত্ত্ববিদ টোকিও ইম্পেরিয়াল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বাসিল হাল চ্যাম্বারলিন। কিন্তু তুলনামূলক সাহিত্য গবেষক হিরাকাওয়া সুকেহিরো এই মতকে অস্বীকার করে বলেন, হার্ন জাপানকে ভালোবেসে উষ্ণহৃদয়ে জাপানকে এঁকেছেন। এই মতই সত্যি বলে মনে হয়, কারণ একজন মানুষ যদি কোনো দেশকে অন্তর দিয়ে ভালোই না বাসবেন তাহলে এত এত গ্রন্থ লিখবেন কেন? আর মায়ার মোহে যদি কেউ পড়ে থাকেন তাও সত্যি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই কি জাপানি সংস্কৃতির মোহে মোহগ্রস্ত হননি? পাঁচবার এই দেশ ভ্রমণ এবং মৃত্যুপূর্বে পুনরায় এইদেশে আসার ইচ্ছে ব্যক্ত করেছিলেন তাঁর জাপানি ভক্ত মাদাম কোওরা তোমির কাছে।
হেমন্তের আভাস বৃক্ষে বৃক্ষে, বনের মাথায় মেপল বৃক্ষের পাতাগুলো ঈষৎ লালচে রং ধরেছে। বিকেলের সোনালি রোদ এসে পড়েছে মাৎসুয়ে দুর্গের ওপর। তারই পাশে লাফকাডিও হার্নের পরিত্যক্ত বাড়ি এবং স্মৃতিজাদুঘর আলোয় আলোকিত। তাঁর বাড়ির প্রবেশমুখের সামনে একটি স্মারক ভাস্কর্য স্থাপন করা হয়েছে। পাথরের টাইলস এবং কাঠের তৈরি বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই দুচোখ জুড়িয়ে গেল। ছোট ছোট তিন-চারটি কক্ষের বাড়িটি কী ছিমছাম পরিপাটি! বাড়িটির পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দুটি জাপানি রীতির বাগান। ঘরের মধ্যে টেবিল, চেয়ারসহ ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র রাখা আছে।
অনুরূপ তাঁর স্মৃতি জাদুঘরটিও। অজস্র ছবিসহ তাঁর লিখিত গ্রন্থাদি, পা-ুলিপি, কলম, ব্যবহৃত জিনিসপত্র কত কি সাজিয়ে রাখা হয়েছে অতিযতেœর সঙ্গে। ৩০ মিনিট ঘুরে ঘুরে দেখে কেবল মুগ্ধই হয়ে গেলাম! মনে মনে কষ্ট পেলাম এই ভেবে যে, বাংলাদেশে কোনো লেখকেরই কী স্মৃতিজাদুঘর গড়ে উঠেছে? গড়ে উঠে থাকলেও এমন নিখুঁত শৈল্পিক সৌন্দর্যে নিশ্চয়ই সজ্জিত নয়!
হার্নের বাড়ির কাছেই দেখতে গেলাম ‘বুকে ইয়াশিকি’ তথা সামুরাই হাউজ। অসাধারণ ছবির মতো বাড়িটি! বেশ বড় প্রাঙ্গণে একাধিক ছোট ছোট কক্ষবিশিষ্ট ২৭০ বছরের পুরনো সামুরাই বাড়িটির বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে অতীতে ব্যবহৃত দৈনন্দিন জীবনযাত্রার জিনিসপত্র, পোশাক, কাগজের বাতি এবং কাঠের নকশাসম্বলিত তোরণ বা বাক্স পেটরা। আরও আকর্ষণীয় হচ্ছে দুজন সামুরাইয়ের মডেল, সবুজ বাগান এবং একটি কুয়া। নিরিবিলি শান্ত পরিবেশে অতীতের জাপান যেন জীবন্ত হয়ে আছে এখানে, ইচ্ছে করছিল কিছুদিন বাস করতে এই বাড়িটিতে! জীবনে সামুরাইদের বাড়ি দেখার স্বপ্ন পূরণ হলো।
বুকে ইয়াশিকি থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে গেলাম মাৎসুয়ে দুর্গ দেখতে। বিপুল জায়গার মধ্যে উঁচু টিলার ওপর পাথরের তৈরি কালো টাইলস, পাথর আর কাঠের তৈরি দুর্গটি দ্বিতীয় বৃহৎ ও তৃতীয় উঁচু প্রায় ৩০ মিটার এবং ৬ষ্ঠ প্রাচীন দুর্গ দেশের মোট ১২টি প্রতœদুর্গের মধ্যে। এটা নির্মাণ করতে ৫ বছর সময় লেগেছে (১৬০৭-১৬১১) সামুরাই শাসক য়োশিহারু হোরিয়ের আমলে। দুর্গটি চারটি অংশে বিভক্ত ৫তলাবিশিষ্ট। খুবই মজবুত এবং যেকোনো যুদ্ধে যাতে আত্মরক্ষা করা যায় এমনভাবে নির্মিত। বন্দুক রাখার ছিদ্র, পাথর ছুঁড়ে মারার ছিত্র, শত্রুর গতিবিধি লক্ষ্য করার ছিদ্রসহ নানা ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। জাপানের প্রাচীন মোমোয়ামা স্থাপত্য রীতিতে নির্মিত এই মাৎসুয়ে ক্যাসলটি।
ভেতরে প্রবেশ করে কাঠের তৈরি বড় বড় গম্ভীর থাম ও সিঁড়ি দেখে থমকে দাঁড়াতেই হলো। অনুজ্জ্বল আলোর কারণে স্পষ্টভাবে দেখা যায় না কিছুই। কোনো কক্ষ নেই। প্রতিটি তলাই একটি কক্ষ। পিরামিডের মতো ছোট হয়ে উপরের দিকে উঠেছে দুর্গটি। এখানে-সেখানে কাঠের আলমিরা, অস্ত্র রাখার বাক্স, বিভিন্ন হাতিয়ার, তৈজষপত্র, পোশাক, বর্ম, তাইকো বা ঢাক ইত্যাদি সংরক্ষিত আছে। পালিশ করা কাঠের মেঝে এবং সিঁড়ি দেখে অনুমান করতে কষ্ট হয় না কত নিখুঁতভাবে কাজ করেছেন কারিগররা। চারতলা পর্যন্ত জানালা নেই, যা আছে বিভিন্ন ছিদ্র। ৫তলায় উঠে ছোট্ট আলোকিত কক্ষে দাঁড়ালাম। চারদিকই খোলা জানালার মতো। প্রচ- বাতাস। জানালা দিয়ে সমস্ত শহরটি দেখা যায়। মাৎসুয়ে শহরটি আধুনিক উঁচু ভবনাদিতে ভরে উঠছে যদিও সবুজের সমারোহ ঈর্ষাজনক।
দুর্গ থেকে বেরিয়ে নামলাম খোলা প্রাঙ্গণে যেখানে অজস্র সাকুরা বৃক্ষের সমাহার। এপ্রিল মাসে সাকুরা ফুলে সাদা হয়ে যায় মাৎসুয়ে দুর্গটি। অনুষ্ঠিত হয় বৃক্ষের তলে ঐতিহ্যবাহী হানামি বা সাকুরা ফেস্টিভেল। লোকে-লোকারণ্য হয়ে ওঠে পুরো জায়গাটি।
দুর্গ ছেড়ে বেরিয়ে আসতেই নজরে পড়ল একটি খোলা প্রাঙ্গণে কিসের যেন উৎসবের আয়োজন। অসংখ্য কাগজের বাতি সাজানো হচ্ছে। সন্ধ্যাপ্রায় সমাগত। দারুণ লাগছিল রঙিন ছবিআঁকা বাতিগুলো। প্রবেশমুখের খোলা প্রাঙ্গণে দেখতে পেলাম এই দুর্গের প্রতিষ্ঠাতা সামুরাই হোশিহারু হোরিয়ের স্মারক ভাস্কর্য। একজন বেটেখাটো তরুণ সামুরাই-যোদ্ধার পোশাকে সজ্জিত হয়ে মাৎসুয়ে দুর্গের ইতিহাস বলে যাচ্ছেন। নাম জিজ্ঞেস করলে বললেন কাতোও। নাট্যমঞ্চের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এনএইচকে টিভিসহ একাধিক টিভি চ্যানেল ও পত্রিকায় তাঁর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে। আমরা তাঁর সঙ্গে কয়েকটি স্মারক ছবি তুললাম।
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। চারদিকে আলো জ্বলে উঠেছে। আলোয় আলোকিত দুর্গটির আরেক রূপ ঝলসে উঠল। শহরটিও আলো ঝলোমল হয়ে উঠতে শুরু করেছে। শহরের মধ্যে প্রবাহিত হিইইকাওয়া নদীর তীরে একটি ঐতিহ্যবাহী ছোট্ট কিন্তু বিখ্যাত জাপানি পানশালায় গেলাম। এই নদী থেকে ধৃত মাছ, শামুক এবং লতাগুল্মের সুস্বাদু কাচা শাশিমিসহ একাধিক খাদ্য খেলাম স্থানীয় নিহোনশুউ মদের সঙ্গে। রাত দশটার দেকে ফিরে এলাম হোটেলে।
পরের দিন সকালবেলা হোটেল থেকে বেরোবার সময় এক অপ্রত্যাশিত কা- ঘটলো। হোটেলের কাউন্টারের পাশে রক্ষিত পত্রিকা ও ম্যাগাজিনের স্যান্ডে দৃষ্টি যেতে একটি ম্যাগাজিন হাতে তুলে নিলাম। ম্যাগাজিনটির নাম ‘চোওতো মাৎসুয়ে’Ñমাৎসুয়ে শহরের পৌর তথ্যবিষয়ক প্রকাশনা। কয়েকটি পাতা উল্টাতেই একটি পৃষ্ঠাব্যাপী কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ছবিসহ একটি লেখা মুদ্রিত দেখে থমকে গেলাম! সঙ্গে সঙ্গে প্রায় সাড়ে ৪০০ ইয়েন দিয়ে কিনে নিলাম। পরে পড়ে দেখলাম ফিচারটি লিখেছেন একজন গবেষক নিশিজিমা তারোও শিমানে-প্রিফেকচারে জন্ম হোরি ইচিরোও নামক একজন স্বনামধন্য আমেরিকা প্রবাসী আলোকচিত্রগ্রাহক ১৯২১-২২ সালের দিকে যখন আমেরিকায় রবীন্দ্রনাথ ভ্রমণ করছিলেন তখন কবির এই ছবিটি তুলেছিলেন সেই তথ্যই এখানে রবীন্দ্রনাথের জাপানের সম্পর্কসহ লেখা হয়েছে। আমার জাপান-রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কের দলিলপত্রাদির সংগ্রহে এটাও সংযুক্ত হলো।
যে মূল উদ্দেশ্য নিয়ে এখানে আসা ‘ইজুমো তাইশা’ শিন্তোও মহামন্দির দেখা সেটা পূরণ হলো। প্রাতঃরাশ সেরে ছুটলাম মাৎসুয়ে রেল স্টেশনে। ইজুমো নামে একটা স্টেশন আছে সেখানে গিয়ে পৌঁছাতে হবে এবং বাস দিয়ে যেতে হবে মন্দিরে।
দ্রুতগামী ট্রেনে চড়ে ইজুমো স্টেশনে এসে নামলাম প্রায় ৩০ মিনিট পর। বেশ বড় স্টেশনটি খুবই সুন্দর। স্টেশন সংলগ্ন সিটি ট্যুরিস্ট অফিসে গিয়ে কীভাবে যেতে হবে জিজ্ঞেস করল আমার স্ত্রী। দুটি মেয়ে প্রচারপত্র দিয়ে বলল, স্টেশন চত্বরে বাস আছে ইজুমো মন্দির যাওয়ার। মিনিট ১৫-২০ মিনিট লাগবে।
স্টেশন চত্বরে বাস পেলাম। তাতে চড়ে ১৫ মিনিটে গিয়েই পৌঁছালাম ইজুমো তাইশা মন্দিরের প্রবেশমুখে। শিমানে তথা ইজুমো অঞ্চলটি সুদূর প্রাচীনকাল থেকেই বহু জাপানি মিথ তথা পুরাণের জন্মস্থান এবং কামি-গামি নো ফুরুসাতো অর্থাৎ দেব-দেবতার আবাসভূমি হিসেবে ইতিহাসে খ্যাত। চলন্ত বাসের জানালা থেকেই দেখতে পেলাম কাঠের তৈরি বিশাল নিরাভরণ তোরণ যার নাম ‘তোরিই’ মূলত ভারতীয় সংস্কৃতি ভাষার ‘তোরাণা’ থেকে গৃহীত বলে জানা যায়। তোরণের ডান পাশেই খাঁড়া পাথুরে স্তম্ভে খোদাইকৃত কানজি অক্ষরে লিখিত : ইজুমো তাইশা। জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন শিন্তোও ধর্মীয় মহামন্দির। জাপানি মানসের তিনটি আত্মার অন্যতম এটি। আর বাকি দুটি হলো শিন্তোও ধর্মেরই ইসে জিনগু বা ইসে মহামন্দির যা মিয়ে-প্রিফেকচারে অবস্থিত মূলত জাপানের রাজকীয় পরিবারের মন্দির এবং টোকিওতে অবস্থিত ইয়াসুকুনি জিনজা মন্দির।
বহু বছরের স্বপ্ন পূরণ হলো। আলোকিত হয়ে উঠল মন। কী চমৎকার বিস্তীর্ণ সবুজের মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে সাজানো মন্দিরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। প্রধান প্রবেশপথের তোরণ থেকে দীর্ঘ পথ হেঁটে মোট তিনটি তোরণ পেরিয়ে মন্দির প্রকল্পে যেতে হয়। পাথরে তৈরি প্রশস্ত এই পথটির নাম শিনমোন-দোওরি স্ট্রিট। এই তিনটি তোরণের মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে সেইদামারি, প্রধান প্রবেশপথের তোরণ। তার ডানপাশে রয়েছে ছোট্ট একটি মন্দিরসদৃশ স্থাপত্য এর নাম হারায়ে-নো-ইয়াশিরো যার অর্থ শুচিশুদ্ধকরণ মন্দিরের ভেতরে যে অদৃশ্য দেবতা রয়েছেন তিনি আগতদের মন ও দেহ বিশুদ্ধ করে দেন। সেইদামারি এই প্রধান তোরণ থেকেই মাথা নত করে জাপানিরা ভক্তিভরে মন্দিরে প্রার্থনা করতে যান। দ্বিতীয় তোরণের নাম হচ্ছে মাৎসু নো সানদোও অর্থাৎ জাপানি ঝাউবৃক্ষ দ্বারা শোভিত প্রবেশপথÑতার বাঁ পাশেই রয়েছে তেমজিুইয়া হাত ধুয়ে পরিষ্কার হওয়ার জলাধার। তৃতীয় তোরণটি হচ্ছে হাইদেন অর্থাৎ উপাসনা গৃহের প্রবেশ তোরণ। এই উপসনা গৃহে প্রার্থনা ও নিবেদনকৃত অনুষ্ঠানাদি হয়ে থাকে। শিন্তোও ধর্মীয় অনুসারীরা ইজুমো তাইশার প্রধান দেবতা ওকুনিনুশি-নো-কামিকে উপাসনা করেন। এই দেবতা হচ্ছেন সুখ-সমৃদ্ধি, ধনসম্পদ এবং ‘এন মুসুবি’ বা ‘পরস্পরের সঙ্গে ভাগ্যবন্ধন’ অর্থাৎ শুভবিবাহের দেবতা।
হাইদেন উপাসনা গৃহের সম্মুখভাগে রয়েছে ‘কাগুরাদেন’ বা ‘শুচিশুদ্ধ নৃত্যগৃহ’ তার প্রবেশপথের ওপর ঝোলানো খড়ের মোটা দড়ি দিয়ে প্যাঁচানো ঝালর বিশেষ যার নাম শিমেনাওয়া। এখানে শিন্তোও রীতির উপাসনা এবং বিবাহ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
হাইদেনের পেছনে রয়েছে মূল মন্দির যাকে বলা হয় হোনদেন, দেবতা এখানেই অধিষ্ঠিত আছেন অদৃশ্য অবস্থায়। শিন্তোও ধর্মের মনুষ্যকল্পিত দেবতাদের কোনো মূর্তি স্থাপন করা হয় না। নির্দিষ্ট কোনো ধর্মগ্রন্থও নেই। মূলমন্দিরের উচ্চতা ২৪ মিটার। জাপানের সবচেয়ে উঁচু কাঠের মন্দির। তবে হোনদেন তথা মূল মন্দিরের কাছেই প্রাচীন মন্দিরের কতক স্তম্ভ আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রাচীন মন্দিরটির উচ্চতা বর্তমানটির চেয়ে দ্বিগুণ ৪৮ মিটার ছিল বলে গবেষকরা ধারণা করছেন এবং মন্দিরটি কেমন ছিল তার একটি প্রতিরূপ শিমানে মিউজিয়াম অব এশেন্ট ইজুমো জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে।
ইজুমো তাইশা মন্দির প্রকল্পটি বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত। নিরিবিলি শান্ত, পাখির সুমধুর কুজন, মৃদুমন্দ বাতাসে সাকুরা বৃক্ষরাজির দোলদোলানি, রৌদ্রপ্রাণ আলোছায়ার ঝরনাধারা দ্বারা আবিষ্ট পরিবেশ যে কাউকেই বিমুগ্ধ করবে! আত্মা যদি কলস হয় তাহলে নিমিষে শান্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে। এখানে পা দিতেই আমার বুকের মধ্যে রবীন্দ্রসংগীতের সেই গানটি গুঞ্জন করে উঠছিল : ‘তোমারই ঝরনাতলার নির্জনে/মাটির এই কলস আমার/ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে!’ কোলাহল, বিশৃঙ্খলা, আবর্জনা যেমন নেই, ধাতব শব্দাদি বা গাড়ির হর্নও এখানে শোনা যায় না। এককথায় দারুণ এক মানসিক শান্তি ও স্বস্তিতে এককার হয়ে যাওয়া যায় ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় পরিবেশের সঙ্গে। শুধু ইজুমো তাইশা বলেই নয়, জাপানের প্রতিটি মন্দির, পর্যটন কেন্দ্রই অত্যন্ত সুন্দর এবং শান্ত।
ইজুমো যে কারণে সবচেয়ে বেশি খ্যাত তা হলো প্রতি বছর অক্টোবর মাসে এখানে সারা জাপানের শিন্তোও দেবতারা যাদেরকে বলা হয় ইয়াওয়োরোযু-নো-কামি এসে সম্মিলিত হন। ১০ তারিখ থেকে ১৮ তারিখ পর্যন্ত দেবতারা মন্দিরের পশ্চিম দিকে অবস্থিত ইনাসা-নো-হানা সমুদ্র তীরে সভা করেন নতুন বছরের বিষয়াদি নিয়ে যাকে বলা হয় কামুহাকারি। অক্টোবর মাসের ১০ তারিখ হচ্ছে কামি মুকায়ে সাই অর্থাৎ অভ্যর্থনানুষ্ঠান। আগুন জ্বালিয়ে শিন্তোও পুরোহিতরা দেবতাদের স্বাগত জানান। ১১-১৭ তারিখ পর্যন্ত চলে একটানা কামি আরি সাই অর্থাৎ শিন্তোও রীতি অনুসারে দেবতাদের পরিতৃপ্ত করার নানা বিনোদনানুষ্ঠান। ১৮ তারিখ তারা সাদে সাই অর্থাৎ দেবতাদের বিদায় জানানোর অনুষ্ঠান। যে কারণে অক্টোবর মাস হচ্ছে শিমানে-প্রিফেকচারকে বাদ দিয়ে কানিনাশি ৎসুকি অর্থাৎ দেবতাহীন মাস বিপরীতে শিমানে-প্রিফেকচারে অক্টোবর মাসকে কামিআরি ৎসুকি অর্থাৎ দেবতাময় মাস হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে।
এই মন্দিরের আরও একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে হোনদেন তথা মূল মন্দিরটি ৬০ বছর অন্তর অন্তর পুনর্নির্মাণ করা হয় ৫ বছর লাগিয়ে। ব্যয় করা হয় বিপুল অর্থ। সর্বশেষ পুনর্নির্মাণ করা হয়েছে ২০১৩ সালে। পুনর্নির্মাণের পর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান হয়ে থাকে জাঁকজমকরূপে। এই রীতিটিকে বলা হয়ে থাকে সেনগু।
উপরোক্ত দুটি বড় অনুষ্ঠানের সময় দূর-দূরান্ত থেকে প্রচুর জাপানি ইজুমো তাইশা মন্দিরে এসে ভিড় করেন দেবতাদের আশীর্বাদ পাওয়া আর মানসিক আনন্দ লাভের জন্য। আর দুদিন পর গেলে আমরাও সেই অনুষ্ঠানাদি উপভোগ করতে পারতাম।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পুরো প্রকল্প ঘুরে ঘুরে দেখে, প্রার্থনা করে এবং নয়নাভিরাম প্রতœসম্পদে সমৃদ্ধ জাদুঘরে ইতিহাসের রহস্যের রসে জারিত হয়ে উৎফুল্লচিত্তে ফেরার পথ ধরলাম। উল্লেখ্য, এই সময় একটি বিশেষ প্রদর্শনী চলছিল ঐতিহ্যবাহী জাপানি তলোয়ারের। বিভিন্ন যুগের ভূমিপুত্র সামন্ত প্রভু, সামুরাই যোদ্ধা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিরা যেসব তলোয়ার ব্যবহার করতেন তারই দুর্লভ প্রদর্শনী। চকচক করা ধারাল ছোট এবং বড় বিশেষ করে দেড় মিটার পর্যন্ত দীর্ঘ তলোয়ার দেখে অভিভূত না হয়ে পারিনি! দেড় মিটার তলোয়ার কীভাবে সামুরাই-যোদ্ধারা চালাতেন ভেবে আশ্চর্য হয়েছি! প্রাচীন ও মধ্যযুগে জাপানিরা যে কী অসামান্য প্রযুক্তির গুণে এসব ধাতব তলোয়ার তৈরি করেছেন তা স্বচক্ষে না দেখলে বিশ্বাস করা সম্ভব ছিল না!
মন্দির থেকে বেরিয়ে জাপানি ঐতিহ্যবাহী পণ্যসামগ্রীর দোকানে কিছু সময় কাটিয়ে বাসে চড়ে বসলাম এবং যতদূর দেখা যায় পেছনে ফিরে নয়নাভিরাম মন্দিরটির দৃশ্য দেখতে দেখতে অনুভব করলাম চোখের কোণে জমে উঠেছে দুফোঁটা তপ্তজল আর বুকের ভেতরে হৃদয় নামক সবুজ পাতায় মৃদু হাহাকারের কম্পন, জানি না কেন।