খোকনমনা হাতে একটা পেইন্টিং নিয়ে বসে আছে। নিজেই এঁকেছিল সেটি। কে এই মহিলা যিনি এতসব পেইন্টিংয়ের মধ্যে এটিকেই দেয়াল থেকে উঠিয়ে তার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, এই চিত্রটি সব সময় তোমার কাছে রেখে দিও। এই কিছুক্ষণ আগেই সেই ছবিটি দেয়ালে সেঁটে ছিল। দেখে এসেছিল এই পেইন্টিংটা সত্যিই সুন্দর যা এতদিন কেউ তাকে দেখিয়ে দেয়নি। ছবিটি দেখে খোকনমনা সেই কথাটিই ভাবছিল। ছবিটিতে আকাশে এক ফালি ঈদের চাঁদ ঝলমল করছে যার পাশে তারারা মিটমিট করছে। ছবিটির এক পাশে ছোট্ট একটি শিশু আকাশি রঙের পোশাকে তার মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশি রঙের শাড়িতে শিশুটিকে পাশে নিয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়িয়ে তার ছোট খোকনকে ঈদ আসছে এই বার্তাটি জানাতে ব্যস্ত তিনি। ছবিটি দেখে মনে হচ্ছে এক আকাশ ভরা ঈদ পৃথিবীকে উপহার দিতে এসেছে চাঁদটি। খোকনমনা ভাবে এই দেশে আজও প্রতিটি শিশু তার মায়ের কোলে আকাশের চাঁদ দেখে বড় হয়।
আর্টিস্ট খোকনমনার মিষ্টি একটা নাম আছে। আব্বু আদর করে ফিফিন রেখেছে। সে এখন কলেজে পড়ে। এখন সে ছবি আঁকে না। ছোট্ট বেলায় এঁকেছে। নার্সারি পড়ার সময় থেকে ড্রয়িং শিখেছে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত শিখতে যেত। একটা নাম করা ড্রয়িং কালচার সেন্টারে শিখত সে। স্কুল থেকে ফিরলে আম্মুর সঙ্গে প্রতিদিন বিকেল বেলা ড্রয়িং শিখতে যেত। সে নিয়মমাফিক ড্রয়িং শিখছে এবং সেখানে গেলে তার ভালোই লাগত। প্রচুর স্টুডেন্ট ছিল। দু-একজন স্কুলের পরিচিতরাও এসেছে। তখন না বুঝলেও এখন তার মনে হচ্ছে হয়ত বা তখন সে কঠোর অধ্যবসায় করেছে যার ফলে আজ এই আর্ট এক্সিবিশন। ড্রয়িং সেন্টারে নিয়ম মতো পরীক্ষা দিতে হয়েছে। পাস করতে হয়েছে আবার কখনো চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা হয়েছে। বাইরের কোনো কোনো সংস্থা বা সংগঠন থেকে তাদের প্রতিযোগিতায় ডেকেছে। বিভিন্ন অতিথি প্রতিযোগীদের সঙ্গে তখন তাকে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছে। তখন সারাক্ষণ তার সঙ্গে লেগে থেকে ড্রয়িং এবং পেইন্টিং করেছে। এর জন্য দেশি-বিদেশি বহু কালার তাকে সংগ্রহ করে দেওয়া হতো। পাশাপাশি স্কুলে পরীক্ষা থাকলে তো কথাই নেই। যখন স্কুলের পরীক্ষার মধ্যদিয়ে ড্রয়িং কালচার সেন্টারের কাজ ছিল তখন সত্যিই খোকনমনাকে খুব পরিশ্রম করতে হয়েছে। সে সময় যেন তার আম্মুর পরীক্ষা থাকত। খাওয়া দাওয়া ভুলে ছেলেকে নিয়েই ব্যস্ত। আব্বু ঠাট্টা করে বলতেন মায়ের পরীক্ষা না ছেলের পরীক্ষা। প্রতিযোগিতায় কে ফার্স্ট হবে আম্মু না খোকনমনা।
ফিফিনদের ড্রয়িং কালচার সেন্টারটি ছিল দোতলায়। জুনিয়র গ্রুপ দোতলায় আর সিনিয়র গ্রুপ একতলায়। ফিফিন প্রথমে দোতলায় ক্লাস করত। আম্মু বা আব্বু যার সঙ্গে আসত উনারা রুমেই দেয়াল ঘেঁষে চার পাশে সোফায় বসতেন। বাচ্চারা মাঝে ফ্লোরিং করত। ফিফিনরা যখন সিনিয়র গ্রুপে এলো তখন একতলায় বসত। প্রত্যেকের জন্য আলাদা ড্রয়িং ডেস্ক ছিল। আর গার্জিয়ানদের জন্য দুটো রুম ছিল, পুরুষদের একটা ও মহিলাদের একটা। বেশিরভাগ সময় ফিফিনকে আম্মু নিয়ে যেত। তবে আব্বুও নিয়ে গেছে। আর আব্বু-আম্মু যখন এক সঙ্গে যেত তখন তার খুব আনন্দ হতো। সে যখন ক্লাস সিক্সে পড়ত তখন তার ড্রয়িং সেন্টারের ফাইনাল পরীক্ষা হয়। খুব ভালো করেছিল। যে কয়জন এক্সিলেন্ট হয়েছে তার মধ্যে খোকনমনা একজন। তেল রং, জল রং সব আঁকাই তার ভালো ছিল। বিভিন্ন সময়ের প্রতিযোগিতায় সে পুরস্কারও পেয়েছে। সে সবই একটি শোকেসে সাজানো আছে।
ফিফিনের এখনও মনে পড়ে সে যখন পঞ্চম শ্রেণিতে জেএসসি পরীক্ষার প্রিপারেশন নিচ্ছিল ঠিক তখন তাদের প্রতিযোগিতার সিলেকশন রাউন্ড। সবাই ছবি এঁকে জমা দিচ্ছিল ড্রয়িং কালচার সেন্টারে। কিন্তু জেএসসি পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য তার নতুন করে ড্রয়িংশিট তৈরি করার সময় নেই। এর জন্য তার নিজের খুব কষ্ট হচ্ছিল। সে হয়ত অন্য বন্ধুদের থেকে পিছিয়ে থাকছে। তখন তার আম্মু আকাশে ঈদের চাঁদ উঠেছে এমন একটি পূর্বের আঁকা ছবি স্কুলে জমা করে দিয়েছিল। তার সৌভাগ্য যে ছবিটি সিলেক্ট হয়ে যায় সেই প্রতিযোগিতার জন্য। এরপর পরীক্ষা হয়ে গেলে ফাইনাল প্রতিযোগিতার দিনও চলে আসে। ছবিটিতে মা আকাশি রঙের একটা ফুটফুটে শাড়ি পরে আছে। আর ছোট্ট খোকাটি মার পাশে আকাশি রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আকাশের দিকে বাড়িয়ে দেওয়া হাত অনুসরণ করে ঈদের চাঁদ দেখতে ব্যস্ত। সে ছবিটির নামকরণ করেছিল এক আকাশ ভরা ঈদ।
নার্সারি থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সে পড়ালেখার পাশাপাশি বহু আর্ট করেছে। নার্সারি থেকে কেজি পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিন যেতে হতো। সপ্তাহে ৫ দিন আর্ট স্কুল করতে হয়েছে। তারপর যখন ড্রয়িংয়ে থার্ড সেমিস্টার পাস করল এরপর থেকে সপ্তাহে দুদিন যেত। স্কুলের সাপ্তাহিক ছুটির দুটি দিনেই সে আম্মুর সঙ্গে যেত। এক ঘণ্টা দুদিন আর ৩০ মিনিট দুদিন পেইন্ট করত। নিজেদের ইচ্ছে মতো আঁকত। একটি ফুল বা একটি গাছ আবার দুটি মানুষ বা দুটি নৌকা, যেকোনো একটি প্রাণী যেমনÑ হাতি, বাঘ, বিড়াল, খরগোশ, গরু এসব আবার একটি বা দুটি করে পাখিÑ ময়না, টিয়া, কাক, ময়ূর। ফল এঁকেছে আম, কাঁঠাল, আনারস, আপেল, কমলা এসব। এসব প্রতিদিন ২টি বা ৪টি ড্রয়িং পেপার ভরে এঁকে দেখাতে হতো। আর্টশিট সেন্টার থেকেই দিত। তাদের শুধু পেনসিল, স্কেল, রং পেনসিল নিতে হতো। পেনসিল, রং, জল রং, মোম রং যেকোনো কালার বক্স নিলেই চলত। সেটি ছিল বাচ্চাদের ইচ্ছে অনুসারে। তবে পালাক্রমে সব রংই নিতে হতো। এর জন্য প্রত্যেক স্টুডেন্টকে সব রকম বক্সই বাসায় কিনে রাখতে হতো। স্কুল থেকে কালার বক্স কেনা যেত। সুন্দর একটা কালারফুল শপ ছিল ড্রয়িং সেন্টারে। মাঝেমধ্যে ঘর বাড়িও আঁকতে হতো। আবার দৃশ্যও এঁকেছে। এসব আগে এঁকে দিত। আর সেসব দেখে ওরা আঁকত। আবার ড্রয়িং স্কুল থেকে বইও কিনতে বলত। সেই কালারশপে বইও পাওয়া যেত সুন্দর সুন্দর। যার যেটা প্রয়োজন সে সেই ড্রয়িং বইটা কিনে নিত। ফিফিনের মনে পড়ে তাদের ফ্লোরিং করে আঁকতে হতো। আঁকার সময় তার কতবার পেনসিল, রাবার হারিয়ে যেত। জানত পেছনে আম্মু আছে। তখনই আম্মুর কাছে চলে আসত এক্সট্রা পেনসিলের জন্য। পেনসিল শার্প করতে হলেও আম্মুর কাছে আসত। তবে টিচারকে বললে চিটারও সেটি করে দিত। স্টুডেন্ট বেশি তাই টিচারও ছিল ৬ থেকে ৮ জন। বেশিরভাগ মহিলা। দুজন শুধু পুরুষ স্যার ছিলেন। প্রায়ই তার পেনসিল, রাবার এসব হারিয়ে যেত। অনেক সময় কালারও ফেলে চলে আসত। আম্মুর কাছে সব গুছিয়ে নিয়ে এলে সেসব চেক করে আম্মু বলত একি খোকনমনা তোর সেই জাপানিজ পেনসিলটা কোথায়। সেই ফেইরিডল ইরেজারটা তো আজ বক্সে ভরিসনি। আস্ত পেন্টিং পেনসিল সেটাই এলো না। তার মতো অনেকেরই এ রকম অভ্যাস ছিল। তবে ফিফিন চেষ্টা করত প্রতিদিন তার ড্রয়িং করার জিনিসগুলো বক্সে গুছিয়ে। এরপরও যদি ফেলে রেখে আসে তাহলে তো তার আর কোনো দোষ নেই। সে তো আর ইচ্ছে করে বা জেনে বুঝে ফেলে আসে না। ড্রয়িং সেন্টার স্কুলটির কালারশপে পিজা, বার্গার, আইসক্রিম, জুস, রোল, সুইট রোল, চিকেন রোল চিপস, বরফি লাড্ডু এ সব পাওয়া যেত। আরও অনেক কিছুই হয়ত থাকত। কিন্তু এগুলোই যে তার পছন্দের। তাই আম্মু এসবই তাকে কিনে দিত। ছুটির পর তাকে এসব মজার মজার ফুড কিনে দেওয়া হতো। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো বাসায় যদি কখনও নাস্তা হিসেবে এসব দিত তাহলে আর কিছুই খেতে চাইত না। এমনকি ওই স্কুলটাতে তৈরি করা নুডলসও সে চেটেপুটে খেত যা বাসায় তার কাছে খাওয়া তো দূরের কথা দেখতেই পারত না। এমনকি স্কুলের ক্লাস শেষে বাসায় ফিরলে দুপুরে ভাতটা পর্যন্ত খেতে চাইত না। শুধু যখন ড্রয়িং করতে যাবে আর মজার মজার খাবার খাবে। বাসার কাছেই ড্রয়িং সেন্টার। তাই হেঁটে যেত আম্মুর সঙ্গে। ফেরার পথে আম্মু বেলুন কিনে দিলে বেলুন হাতে হেঁটে চলত। বেলুন কখনও ফাটিয়ে ফেলেছে হাতে চেপে আবার কখনও বাতাসে উড়িয়ে দিয়েছে। এতে তার খুব মজা লাগত। নিজেই হাততালি দিত। রাস্তার মাঝে চলে এলে আম্মু হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসত। পথে লোকজন বা রিকশা, গাড়ি থাকতে পারে। তবে বিকেল বেলা পথ ফাঁকাই থাকত। রেসিডেন্সিয়াল প্লেইস বলে তত জটলা হতো না। অনেক সময় আব্বুও নিয়ে যেত। তবে আব্বু বিজনেস নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকত। তাই সময় পেত না বেশি। কারণ সেখানে ঘণ্টাখানেক গার্জিয়ানদের সঙ্গে থাকতে হবে। তবে পেরেন্টস ডে তে আব্বু অবশ্যই সময় করে আম্মুকে নিয়ে স্কুলে চলে যেত। সেটি পাড়ার স্কুলেই হোক বা ড্রয়িং স্কুলেরই হোক। খোকনমনাদের সেটি ছিল চাইল্ড সেকশন। তারপর থার্ড সেমিস্টারে পাস করলে জুনিয়র সেকশনে উঠতে হয়। তখন সপ্তাহে ২ দিন যেতে হতো।
ছেলেমেয়েরা তাদের সুবিধা মতো দুদিন বেছে নিতে পারত। একদিন অনুপস্থিত থাকলে সপ্তাহের পাঁচ দিনের মধ্যে যেকোনো একদিন গিয়ে ক্লাস করে নেওয়া যেত। খোকনমনাকে শুক্র এবং শনিবার ছুটির দুটি দিনেই নিয়ে যাওয়া হতো। তবে ড্রয়িং ক্লাস শুধু বিকেল বেলাতেই হতো। বিজনেসের কারণে বিকেল বেলাতেই তার আব্বুর বেশি কাজ থাকত। তাই আব্বু মাঝে মধ্যেই তাকে নিয়ে যেত। তাও আম্মুর কোনো দরকারি কাজ বা কোনো অসুবিধা হলে তবেই আব্বু তাকে নিয়ে যেত। শুধু শুক্রবার আব্বু-আম্মু দুজনেই তাকে নিয়ে যেত। সেদিন ড্রয়িং শেষে তারা শিশুপার্ক, বিভিন্ন পার্টি বা ল্যাব, সিম্পোজিয়াম, বিখ্যাত স্থান, বড় বড় গার্ডেন স্পেস বা জাদুঘরে বেড়াতে যেত। বাচ্চাদের মঞ্চ অনুষ্ঠানও দেখতে যেত।
খোকনমনা যখন চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে তখন সে ড্রয়িং স্কুলে সিনিয়র সেকশনে উঠে গেছে। সে যতই ড্রয়িং করুক বা পুরস্কার পাক না কেন তার মনে হতো সবাই খুব সাধারণ জিনিস বিশেষ করে চাইল্ড সেকশনের আঁকাগুলোকে তো সে হিজিবিজি বলেই মনে করত। যদিও বাসায় কোনো আত্মীয় বা প্রতিবেশী এলে তার সেসব আঁকা দেখে খুব সুন্দর হয়েছে বলে প্রশংসাই করত। তার আম্মু-আব্বুও সব সময় তাকে উৎসাহ দিয়েছে। আর বড় হয়ে সে সাধারণ ছেলেমেয়ের মতো ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ বা শিক্ষাবিদ হবে এসবই ভেবে এসেছে। তাদের স্কুলে অন্যদের সঙ্গে সে এ শিক্ষা নিয়েই বড় হয়েছে। এমনকি ক্লাস সেভেন থেকে এসএসসি পড়া পর্যন্ত আর্টের সঙ্গে তার কোনো যোগাযোগই ছিল না। তবে এর আগে আর্ট কালচার সেন্টারে পড়ার সময় তার পরিচিতজনেরা বাড়িতে তাকে ক্ষুদে আর্টিস্ট, জিনিয়াস আর্টিস্ট, শিল্পী বা শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের শিষ্য এসব বিশেষণে ভূষিত করেছে। শুনলে সেও খুব খুশি হতো। তাকে হয়ত বিখ্যাতই ভাবছে সবাই। কিন্তু ড্রয়িং স্কুল থেকে পাস করার পর যে আর্টের সঙ্গে তার যোগাযোগ থাকবে এ ব্যাপারে সে ভাবেওনি বা কেউ তাকে এ সব নিয়ে কিছু বলেওনি। যে নিয়মে সে স্কুল-কলেজের পড়া শুরু করে গেছে। তবে আজ এই সুন্দর বাঁধানো পেইন্টিংটি হাতে নিয়ে তার বিস্ময়ের আর সীমা রইল না যেন। আসলে আজকের দিনটায় কেন যে তার আব্বু ফোন করে এত সকালে আসতে বলল বিজনেস কমপ্লেক্সের হলরুমে তা এসে বুঝতে পেরেছে। কারণ পেন্ডেল করা পেইন্টের দুপাশে বড় করে তার ছবি টানানো আছে। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এই আর্ট এক্সিবিশন। গেটে তার আব্বু আর ছোট দুটি ভাই-বোন তার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে জানে তার আম্মুর খুব অসুখ। বেড পেসেন্ট, তাই আম্মু এখানে নেই ভেতরে যেতে যেতে দেখল হলরুম জুড়ে তার আঁকা ছবি। কিন্তু এত অবাক করা খুশির মধ্যেও তার কষ্ট হতে লাগল। তার কেবলই মনে হতে লাগল যে, আম্মু যখন তাকে নিয়ে প্রতিদিন ড্রয়িং শিখতে নিয়ে যেত সেই সময় এখন আর নেই। তার ছোট দুই ভাই- বোন তখন ছিল না। সে তখন মা-বাবার একমাত্র সন্তান ছিল। হলরুমের ভেতরে কাচের দেয়াল করে তার বসার রুম করা হয়েছে। কাচের পার্টিশন করে চারটি রুমে ছবি সাজিয়ে রাখা আছে। সে কেবল ভাবছে ছবিগুলো তার আঁকা হলেও সেও অজানা দর্শকদের মতোই জানতে এবং দেখতে পারছে। তার ছোট বোন মিমনি আর ছোট ভাই প্রিসিন তার সঙ্গে চেয়ারে বসে সব ঘটনাই বলল। ওরা জানাল তাদের আম্মু ফিফিন ভাইকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যই আগে থেকে কিছু জানতে দেয়নি। আম্মু মিমনি আর প্রিসিনকে সঙ্গে নিয়েই সব করেছেন। প্রায় এক মাস থেকেই নাকি তারা এসব করতে ব্যস্ত। আম্মু ফিফিনের আঁকা সব ছবি দোকান থেকে বাঁধাই করে নিয়ে এসেছেন। ফিফিন শুনতে শুনতে কেঁদে ফেলে। এসব আম্মু অসুস্থ শরীরে কি করে করল। প্রায় চার মাস ধরে আম্মুর অসুখ। আম্মুকে নিয়ে আব্বুর আগামী মাসে সিঙ্গাপুর যাওয়ার কথা চিকিৎসার জন্য। আর আম্মু কি না তাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এভাবে তার জন্য আর্ট এক্সিবিশন সাজিয়ে দিয়েছে। খোকনমনা সব আর্ট গ্যালারি ঘুরে দেখল। ছোটবেলার প্রতিটি সেকশনের ছবি এ স্থানে বাঁধাই করে সাজানো হয়েছে। কোন ছবিটি কোথায় রাখতে হবে সবই আম্মু নিজে বুঝিয়ে দিয়েছে। আর সেভাবেই সব রাখা আছে এই আর্ট গ্যালারিতে।
ফিফিন দেখেছে চাইল সেকশনের সেই হ-য-ব-র-ল কিছু ছবিও সুন্দর করে সাজানো আছে। যেগুলো কি না বিভিন্ন রঙিন ফ্রেমে বাঁধাই করাতে সত্যিই অপূর্ব লাগছে। আম্মু তার ছোটবেলার আঁকা সব ছবিই এত যতœ করে রেখে দিয়েছিল যা সে বুঝতেই পারেনি আগে। চোখে তার কান্না এসে গেল। প্রতিটি ছবিরই একটি করে নাম দেওয়া আছে। কিন্তু সে ড্রয়িং শিক্ষাকালে স্কুল থেকে টিচাররা যা কিছু দিয়েছে আর কিছু নিজেকে দিতে হয়েছিল। আর সেগুলোর নাককরণবিহীন ছবি তার সবকয়টির নাম রাখা হয়েছে। আম্মু আর ছোট ভাই-বোনেরা এসব নামকরণ করেছে। বন্যপ্রাণীদের একটি ছবির নামকরণ করা হয়েছে ‘হিমশীতলতা’। সমুদ্রের পাশে বাড়িঘর আঁকা ছবির দৃশ্যের নাম ‘সামুদ্রিক বাংলো’। ভূতের ছবিও আছে কয়েকটা, একটির নাম হলো ‘ভূত বিলাস’। ছবিটি সে সময় তার নিজেরও খুব ভালো লাগত। একঝাঁক মানুষ নিয়ে আঁকা ছবি যার মধ্যে বুড়ো থেকে মাঝারি, বাচ্চা এবং ছোট শিশুরা রয়েছে, সেটির নামকরণ করা হয়েছে বংশপরম্পর। আরো বহু নামের ছবি টানিয়ে রাখা আছে। যেমনÑ ‘রূপকতার মানুষ,’ ‘পাহাড়ি ঝরনাধারা,’ ‘আমার বাড়ির রংরূপ,’ ‘বরফ আর আগুনের সংঘাত,’ ‘হিরের রাজ্যের গুপ্ত দরজা’ ইত্যাদি। ঘুরে ঘুরে এসব ছবি দেখতে দেখতে খোকনমনা এই বিশেষ ছবিটির কাছে এলো। ঠিক তখনই তার আম্মুর ফোনটি এলো। ফোনে আম্মুর কথা শুনে আবেগে খোকনমনার কান্না এলো। বলল আম্মু তুমি এসব কি করেছ। আম্মু আমাকে একবার শুধু বলতে আমি তোমাকে এখানে নিয়ে আসতাম। সবাই এক সঙ্গে এক্সিবিশনে যেতাম? আম্মু তুমি কেন এমন করলে। এতসব কখন করলে? আম্মু হাসতে লাগলে খোকনমনা ফোনে আম্মুর হাসি শুনে জোরেই কেঁদে ফেলল। আম্মু বলল খোকনমনা তুই কাঁদছিস কেন। আজ তোর জন্য এই পার্টি এক্সিবিশন করতে পেরে আমি যে কত খুশি সেটি তোকে কি করে বোঝাই। তবে আমার এই প্লান শুনে তোর আব্বু নিজেই এই হলরুমে এক্সিবিশন করার কথা বললেন। আর সব আয়োজন তোর আব্বুই করেছেন। তুই কাঁদিস না বাবা। আজ যে তোর বড় আনন্দের দিন। আজ তোর জন্মদিন। সে বলল আম্মু আমি এখনই আসছি। তুমি বাসা থেকে বেরুনোর সময় আমাকে কিছু বলোনি কেন। সিমনি, তিপিন, আব্বু কেউই তো তখন আমাকে জানাল না। আম্মু আমাকে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্য এতসব আয়োজন করে রেখেছ তোমরা। আম্মু বলল আরো আছে। সন্ধ্যায় কেক কেটে জন্মদিনের সেলিব্রেট করা হবে। আমি খাটে বসে বসেই সব তদারকি করছি। তুই শুধু মাঝে ফোন করে আমাকে ওখানকার খবর জানাস। লোকের ভিড়ে সময় কেটে গেল। অনেকেই তার অটোগ্রাফ নিয়েছে।
কেউ কেউ ছবির ব্যাখ্যা চেয়েছে। যতদূর পেরেছি তাদের বুঝিয়েছি। গোটা কতক পেইন্টিং বিক্রিও হয়েছে। অনেক প্রশংসাও শুনতে পেয়েছে। আব্বু সাংবাদিক ডেকে একটা ইন্টারভিউ করার ব্যবস্থা করেছে। ফটোগ্রাফাররা তার ছবিসহ তার অনেক ছবিও তুলে নিয়ে গেছে। আব্বু নিজের অফিস রুমে রাখবে বলে কয়েকটা পেইন্টিং বেছে রেখে দিয়েছে। দিন শেষে ফিফিন তার কাচের দেয়াল ঘেঁষা নিজের ঘরে এসে সবে বসেছে, এমন সময় দেখে এক মহিলা খুব দ্রুত তার দিকে এগিয়ে আসছেন। হাতে সেই পেইন্টিং যেটি দেখতে দেখতে তার আম্মুর আদরমাখা ফোনটি এসেছিল। উনি এসেই তার টেবিলে সেই বিশেষ ‘এক আকাশ ভরা ঈদ’ পেইন্টিংটি রেখে বলল, একি খোকন তুমি এই ছবিটি এখানে রেখে দিয়েছে কেন! এটি তোমার কাছে রাখ। ছবিটি আমি তোমায় উপহার দিয়ে গেলাম। ফিফিন বিস্মিত হয়ে ভদ্র মহিলার দিকে তাকাল। কেমন মা মা একটা ভাব। ঝলমলে একটা শাড়ি পরেছেন। তার মধ্যে আকাশি রঙের বুটিগুলি ফুটে উঠেছে। সেই মুহূর্তে ফিফিনের মনে হলো এগুলো যেন মিটমিট করে জ্বলছে। খোকনমনা মৃদু হেসে ছবিটা হাতে নিতেই মহিলা আর দেরি করলেন না, দ্রুত সেখান থেকে চলে গেলেন। সেই থেকে চুপচাপ খোকনমনা ছবিটির দিকে তাকিয়ে আছে। আম্মুর কথা ভাবছে। ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। মনে পড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে চাঁদ দেখার কথা। তার কাছে কখনো মনে হতো মরু চাঁদটি তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। আবার কখনো দেখেছে গোলাকার চাঁদ স্থিরভাবে আছে আর জ্বলজ্বল করে জ্যো¯œা ছড়াচ্ছে। আবার এমনও দেখেছে চাঁদ ধীরে ধীরে এক স্থান থেকে অন্য দিকে সরে যাচ্ছে। আজ তার জন্মদিন। কিছুক্ষণ পর সে বাসায় চলে যাবে আম্মুর কাছে। আম্মু কেক আর মোমবাতি নিয়ে তার জন্য অপেক্ষা করছেন বাসায়। এখানে এই আর্ট এক্সিবিশনে তার আব্বু আর ছোট ভাই-বোন দুটি আছে। তারা সবাই মিলে কিছুক্ষণের মধ্যেই বাসায় চলে যাবে। সেই সঙ্গে এই পেইন্টিংটিও নিয়ে যাবে। কিন্তু খোকনমনা এখনও জানে না কিছুদিন পর নয়, আগামীকালই আব্বু আম্মুকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যাবেন চিকিৎসার জন্য। এ কথাটি তার আব্বু এখনও বলেননি। এতসব আনন্দের মাঝে তিনি কি করে আদরের খোকনমনাকে এ খবরটি দেবেন!