পোকা মাকড়েরও বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের বুদ্ধি পশুপাখির বুদ্ধিকেও হার মানায়। একটি ক্ষুদ্র মশা কিংবা মাছি আপনার সারা রাতের ঘুমকে হারাম করে দিতে পারে। সযতেœ মশারি খাটাবেন অথবা স্প্রে করবেন গ্যারান্টি নেই। কোন ফাঁকে মশারিতে ঢুকে পড়বে আর কানের কাছে গিয়ে বেসুরো সংগীত বাজাবে, টের পাবেন না। তবে ভালো পোকাও আছেÑ তারা মানুষের অনেক উপকারে আসে, যেমন মৌমাছি অথবা প্রজাপতি। প্রজাপতির হাজারো রং-রূপ বৈচিত্র্য- নজরকাড়া আর মনকাড়া সৌন্দর্য। এরা কোনো ক্ষতি করে না বরং সৌন্দর্য বাড়ায়, মনকে প্রফুল্ল করে দেয়। বুদ্ধি, চালাকি বা বোকামি পোকা মাকড়ের মধ্যেও আছে! মানুষের চেয়ে তা কম হলেও একেবারে কম নয়।
মৌমাছি আর পিঁপড়াদের বুদ্ধিশুদ্ধির নানা রকম ধরন আছে। এরা ব্যক্তিগতভাবে বেকুব ইংরেজিতে বললে ‘ইডিয়ট’। একা থাকলে এরা পথ হারায়। জীবন সংগ্রামে বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। কিন্তু যখন তারা দলবদ্ধভাবে থাকে, একসঙ্গে চলে ও কাজ করে তখন তাদের বুদ্ধির প্রভাব প্রচ-ভাবে কাজ করে। তাদের চমৎকার প্রতিভার বিকাশ ঘটে একসঙ্গে থাকলে। তাই তারা একসঙ্গে থাকতেই ভালোবাসে। মৌমাছি যখন তাদের সংগৃহীত মধুর চাক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কমপক্ষে ৩০টি সম্ভাব্য পরিকল্পনা করে, যার মধ্যে থাকে স্থান নির্বাচন, পরিবেশের পরিস্থিতি দেখা, মধু সংগ্রহের উৎস সন্ধান, যথাযথ উৎসবের দূরত্ব, দলীয় নিরাপত্তা, কাজকর্মের ফাঁকে দলীয় বিনোদনের ব্যবস্থা ইত্যাদি। এসব কিছু বিবেচনায় রেখে ১৬ ঘণ্টার মধ্যে স্থান নির্বাচন করে মৌচাক নির্মাণের ও মধু সংগ্রহের কাজ তারা শুরু করে। আমাদের মানুষদের এ রকম একটা প্রকল্প কাজ শুরু করতে ১৬ মাস তো লাগবেই। পদ্মা সেতু বা একটি মহাসড়ক নির্মাণের প্রকল্প হলে তো সীমাহীন সময় প্রয়োজন।
এবার পিঁপড়াদের কথা ভাবুন। ব্যক্তিগতভাবে তারা অন্ধ, চোখে দেখে না। ইন্দ্রিয় ও বোধ শক্তি দ্বারা পরিচালিত। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই খেই হারিয়ে ফেলে। একা চললে বিপদের সম্মুখীন হয়। নির্বুদ্ধিতার খেসারত দিতে গিয়ে পদে পদে যন্ত্রণা আর লাঞ্ছনার শিকার হয়। আর এদের পাখা গজালে তো কথা নেই। ‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে।’ Ñ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী তার ‘পিপড়াবিদ্যা’য় এ রকম কিছু বলতে চেয়েছেন সম্ভবত। অথচ এই পিঁপড়ারাই যখন সংঘবদ্ধভাবে ঐক্যের পথে চলে তখন নিজেদের পথ ও পাথেয় সংগ্রহে ভুল করে না। ঐক্যবদ্ধভাবে তারা অদম্য সঞ্চয়ী। তারা সারিবদ্ধভাবে পথ চলে। গন্তব্যে গিয়ে ফিরে আসে নিজেদের আশ্রয়স্থলে। সবাই মিলে দীর্ঘদিনের জন্য খাবার সংগ্রহ করে রাখে। পথে বিপদ হলে কৌশলের আশ্রয় নিয়ে একে অপরকে নিরাপত্তা দেয়। তাদের চলার পথে ভিন্ন দিক থেকে আসা যাত্রীদের তারা হায় হ্যালো বলে। সালাম বা কুশল বিনিময় করে। ঐক্যবদ্ধভাবে তারা ‘সকলের তরে সকলে আমরা প্রত্যেকে আমরা পরের তরে’- এই আদর্শকে ধারণ করে জীবন যাপন করে।
এখন আসি আমাদের মানুষ নামের সৃষ্টির দিকে। ব্যক্তিগতভাবে আমাদের অনেকেই অসম্ভব জিনিয়াস। ছাত্রজীবন থেকে শুরু করে কর্মজীবনে অসম্ভব মেধার স্বাক্ষর রেখে জীবনকে উচ্চ থেকে উচ্চতর অবস্থানে নিয়ে যায় তারা। স্কুলের রিপোর্ট কার্ড বা মেধা তালিকায় নাম দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মেধাবীরা। নিজস্ব সাফল্যের বিবরণ দিয়ে পত্রিকায় ছবি প্রকাশ করে। ব্যক্তিগত জীবনে বা কর্মজীবনের সাফল্যে অবশ্যই তাদের কৃতিত্ব দিতেই হয়। এই মেধা আর ব্যক্তিগত অর্জন নিঃসন্দেহে কাম্য এবং ব্যক্তির উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নির্মাণের সোপান হিসেবে বিবেচিত। ব্যক্তিগত মেধা ও অর্জন প্রজন্মকে উৎসাহিত করে।
কিন্তু- এই মানুষরাই সংঘবদ্ধভাবে অথবা দলীয়ভাবে ‘ইডিয়ট’ না হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ। আমরা বিশ্বপরিসর বাদ দিয়ে বাংলাদেশি কাঠামোয় বিষয়টি দেখতে পারি। এ দেশে মেধাবীর অভাব নেই। বিশ্বসভায় বাংলাদেশি অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি স্ব পরিচয়ে কীর্তিমান। নোবেল পুরস্কার লাভসহ আন্তর্জাতিক পরিম-লে নিজ আসন পাকাপোক্ত করেছেন এবং অসামান্য অবদান রেখেছেন। দেশের ভেতরেও আমাদের অনেক বিশিষ্টজন আছেন যারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে ব্যক্তিকে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু যে মুহূর্তে একটি দল, সংগঠন বা সমিতির অন্তর্র্ভুক্ত হয়েছেন সে মুহূর্তেই তিনি বা তারা যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারেননি। আমাদের রাজনীতির কথাই ধরুন। এখানে মতৈক্যের পরিবর্তে মতানৈক্যই কাজ করে। কি দলের ভেতরে কি বাইরে, এক অস্বস্তিকর অবস্থা চলে আসছে। দলের ভেতরে দল, গ্রুপ, লবিং নিত্যদিনকার বিষয়। তাই তো এ দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা শত শত। সেই কবে এক বিদেশি লেখক বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে লিখেছিলেন, "ঙহব ইধহমধষবব ড়হব চড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃু, ঃড়ি ইধহমধষবব ঃড়ি চড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃু, ঃযৎবব ইধহমধষবব ঃযৎবব ঢ়ড়ষরঃরপধষ ঢ়ধৎঃু রিঃয ঃড়ি ভৎধপঃরড়হং" প্রায় আড়াই যুগ আগে মাত্র একবার এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো একটি বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছুতে পেরেছিল, যা পরবর্তী সময়ে আর টেকেনি। মৌলিক জাতীয় ইস্যুতে আলোচনা বা সংলাপের সম্ভাবনার বিষয় কল্পনাও করা যায় না। আমার শ্রদ্ধেয় ড. ফরাসউদ্দিন কিছুদিন আগে সিভিল সোসাইটির প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সংলাপকে ‘সঙ’-এর ‘প্রলাপ’ বলে তাচ্ছিল্য করে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আলোচনা না হোক অন্তত ‘ভালোচনা’ তো হতে পারে।
আমাদের দেশে পেশাদার সমিতিগুলো ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে পারে না; কারণ তারা কোনো জাতীয় বা নিজস্ব প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে এক হতে পারে না। অবশ্য তারা ‘মতানৈক্যের ব্যাপারে একমত’ হতে পারেন। দেশে দুর্বল ও ভঙ্গুর সিভিল সোসাইটি সংগঠনগুলো চলে সংকীর্ণ দলীয় পরিচয়ে। সে কারণে তাদের মতামতকে কেউ তোয়াক্কা করে না। গণমাধ্যমের কল্যাণে তারা প্রচার পায় ঠিকই কিন্তু তাতে অন্যদের কিছু আসে যায় না। সিভিল সোসাইটি নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টা করলেও তাতে সফল হয় নাÑ উল্টো তাদের বিভিন্ন মহল থেকে সমালোচনা ও গালমন্দ শুনতে হয়।
আমাদের আইনজীবী সমিতিগুলো একমত হতে পারে না জনসাধারণের আইনগত স্বার্থের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ইস্যুতে। সেখানে মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু হাতাহাতি-মারামারি খুবই অনাকাক্সিক্ষত বিষয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আমজনতা।
অতি সম্প্রতি জাতির বিবেক ও আশা-আকাক্সক্ষার স্থান প্রেসক্লাবে যে ঘটনা ঘটল তাতে আমরা সাধারণ মানুষরা হতচকিত ও বিস্মিত না হয়ে পারি কি? যাদের সংবাদ পরিবেশনের বা বিশ্লেষণের দিকে আমরা তাকিয়ে থাকি, যাদের সংবাদ বিশ্লেষণে আমরা একটা সমস্যার সমাধান খুঁজি, টেলিভিশন ‘টক শো’-তে যাদের মতামত বা উপদেশ শ্রবণ করতে দিশাহীন মানুষ রাত জেগে অপেক্ষা করে তারাই যদি ‘দখল বেদখলের খেলা’ খেলেন তাতে আমজনতা হতাশ বা নিরাশ তো হবেনই।
সরকারি লোকজন কাজ করে বলে প্রশাসন টিকে আছে। কিন্তু সেখানেও টিমওয়ার্ক কোথায়? আমি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সর্বোচ্চ পদে থেকে দেখেছি এসব জায়গায় অনেক দক্ষ কর্মকর্তা আছেন যারা ব্যক্তিগতভাবে অনেক পরিশ্রম করেন। কিন্তু টিম হিসেবে কাজ করতে গেলে তারা প্রয়োজনীয় সার্ভিস ডেলিভার করতে পারেন না। আমাদের অনেক দক্ষ আমলা আছেন, প্রথিতযশা প-িত শিক্ষক আছেন, প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ, বিজ্ঞানী, স্থপতি আছেন যারা দেশে যেমন পরিচিত তেমনি বিদেশেও সমাদৃত। কিন্তু তারা টিমে কাজ করতে পারেন না। সংগঠন চালাতে বা গড়ে তুলতে পারে না। তারা নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হন এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে তোষণ করতে গিয়ে অধীনস্থদের গড়ে তুলতে পারেন না। বরং নিজ স্বার্থে ‘একলা চল’ নীতিই তারা অনুসরণ করেন।
আমাদের খেলোয়াড়দের দেখি তারা বেশির ভাগ সময়েই টিমওয়ার্কে ব্যর্থ হন। যখনই তারা ব্যক্তি পারফরম্যান্সের ঊর্ধ্বে উঠে দলীয় স্বার্থে খেলতে নামেন ও শক্তিশালী টিম স্পিরিট গড়ে তোলেন এবং নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রাখেন তখনই তারা সাফল্য লাভ করেন। বাংলাদেশের ক্রিকেট দলের সাম্প্রতিক চমৎকার সাফল্যগুলো তারই প্রমাণ।
ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে একে অপরকে ভালোবেসে শ্রেণিবিদ্বেষ পেছনে ফেলে এক কাতারে শামিল হতে পিঁপড়া, মৌমাছিদের মতো মিলে মিশে চলার শিক্ষা আমাদের দেয় বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক আচার অনুষ্ঠান। এই যে বাঙালি মুসলমানদের ঘরে ঘরে পবিত্র ঈদুল ফিতর আসছে তার শিক্ষাও তাই। প্রতিবছরই ঈদ আসে। আমরা সাড়ম্বরে উদ্্যাপন করি কেউ কেউ বাণিজ্যিকভাবে। কৃত্রিম ফ্যাশন আর জৌলুসের ভোগবাদী আচরণে। কিন্তু ঈদের যে শিক্ষা নির্মল আনন্দের মাধ্যমে সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা ও বৈষম্য নিরসনের উদ্যোগ গ্রহণ, তা কি আমরা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করি? আসুন না এবারের ঈদটাকে আমরা সর্বজনীন আনন্দের কল্যাণমুখী উৎসব হিসেবে গ্রহণ করি।