কবি শামসুর রাহমান স্বাধীনতাকে তুলনা করেছিলেন ‘যেমন ইচ্ছা লেখার আমার কবিতার খাতা’র সঙ্গে। স্বকৃত নোমান আমাকে বৈশাখী সংখ্যার জন্য যা ইচ্ছা তাই লেখার অনুমতি দিয়েছেন। আমি একজন স্বাধীন মানুষ। আমিও যা ইচ্ছা তাই লিখব। আমি কবিতাপ্রতিবন্ধী মানুষ। কবিতা বুঝিই না ঠিকমতো, লেখা তো অনেক দূরের কথা। স্বকৃত নোমান আমার এই আবোলতাবোল লেখার নাম দিয়েছেন ‘মুক্তগদ্য’। তবে আমি বিশ্বাস করি, আমার স্বাধীনতা আপনার নাক পর্যন্ত। আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি, তবে তা যেন আপনার নাক স্পর্শ না করে। ছেলেবেলায় স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় একটি খুব পপুলার আইটেম ছিল যেমন খুশি তেমন সাজো। আর আজ হলো আমার যেমন ইচ্ছা তেমন লেখ। আগেই ঘোষণা দিচ্ছি, নোমানের দেওয়া স্বাধীনতার সর্বোচ্চ অপপ্রয়োগ করব। প্রিয় পাঠক আশা করি আপনাদের প্রশ্রয় পাব। আর চেষ্টা করব, আমার লেখার স্বাধীনতা যেন আপনাদের অনুভূতির নাক স্পর্শ না করে। তবে আমার স্বাধীনতার সর্বোচ্চ অপপ্রয়োগ ইতিমধ্যে করে ফেলেছি। বৈশাখী সংখ্যার লেখা যাচ্ছে ঈদ সংখ্যায়। সব লেখক এমন স্বাধীনতা পেলে সাপ্তাহিক পত্রিকার ডেটলাইন মিস হবে সপ্তাহে চৌদ্দবার।
ইদানীং ফেসবুকে সাংবাদিক উদিসা ইসলাম নিজেকে ‘বোকা উদিসা’ ঘোষণা করে কিছু প্রশ্ন করেন। প্রশ্নগুলো শুনে বুঝি উদিসা বোকা নন, আসলে দারুণ চালাক। এত চমৎকার সব প্রশ্ন যার মাথায় কিলবিল করে, তিনি বোকা হতে পারেন না। উদিসার প্রশ্নগুলো দেখে আমার খেয়াল হয়, আরে এমন অসংখ্য প্রশ্ন তো আমার মাথায়ও কিলবিল করে। তবে আমি সত্যি সত্যিই বোকা। আমার প্রশ্নগুলো শুনলেই আপনারা বুঝবেন, উদিসার মতো নয়, আমি সত্যি সত্যিই বোকা। প্রশ্নের সঙ্গে কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করব, আমার মতো করে।
কয়দিন আগে দেশের প্রধান দুই নগরীতে হয়ে গেল নির্বাচন। নির্বাচন দেখে, প্রার্থীদের প্রচারণা দেখে আমার অবাক লেগেছে, সব নির্বাচনেই লাগে। নির্বাচনে কোনো সেকেন্ড নেই। একজনই জেতে। তবুও অনেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। এটাই গণতন্ত্র। যেমন ঢাকা উত্তরে ১৬ জন, দক্ষিণে ২০ জন আর চট্টগ্রামে ১২ জন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এতজন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেও জিতবেন কিন্তু একজন। তবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয় দুই জন বা তিনজনের মধ্যে। তাহলে বাকিরা নির্বাচন করেন কেন? নিশ্চিত পরাজয় জেনেও অনেকে লড়াইয়ে নামেন কেন? লড়াই করার আনন্দে? ব্যাপারটা এমন নয় যে, চাইলেই নির্বাচন করা যায়। নির্বাচন করা একটি জটিল, কষ্টসাধ্য এবং ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া। মনোনয়নপত্র দাখিলই একটা জটিল প্রক্রিয়া। নানা রকমের কাগজপত্র, সার্টিফিকেট, ছাড়পত্র, স্টেটমেন্ট জোগাড় করতে হয়। আবদুল আউয়াল মিন্টুর মতো জাঁদরেল ব্যবসায়ীর মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে গেছে সমর্থক তার নির্বাচনী এলাকার ভোটার নন বলে। কত কিছু যে খেয়াল রাখতে হয়! মনোনয়ন দাখিলের প্রক্রিয়া দেখে আমার বিশ্বাস জন্মেছে, আমি কখনো কোনো নির্বাচনে মনোনয়নপত্রই দাখিল করতে পারব না। মনোনয়নপত্র দাখিল করতেই জামানত, ভোটার তালিকা কেনা ইত্যাদি বাবদ নাকি লাখ খানেক টাকা লেগে যায়। তারপর তো শুরু খরচ আর খরচ। পোস্টার, ব্যানার, মাইকিং, ক্যাম্পেইন, পোলিং এজেন্ট- খরচের কোনো শেষ নেই। নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিতের চেয়ে অনেক বেশি খরচ হয়ে যায়। নিশ্চিত পরাজয় জেনেও অনেকে নির্বাচনের জন্য লাখ লাখ, এমনকি কোটি কোটি টাকাও খরচ করেন। কেন? এই প্রশ্নের উত্তর কোনোদিনই আমার জানা হয় না। বলা হয়, কারো ক্ষতি করতে চাইলে, তাকে হয় নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দাও, নইলে তাকে কোনো মামলার বাদী করে দাও। ব্যস বাকি ক্ষতি ভূতে করবে। কিন্তু ইদানীং মনে হয়, এটা উল্টে গেছে। নির্বাচন নাকি এখন অনেক লাভজনক। এই শুভঙ্করের ফাঁকিটা আমি কোনোদিনই ধরতে পারি না। নির্বাচনের আগে যারা জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী, পরে দেখি তাদের জামানত বাজেয়াপ্ত। ঢাকা ও চট্টগ্রামের তিন সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত ছয় প্রার্থী ছাড়া সবার জামানত নির্বাচন কমিশন রেখে দিয়েছে। কিন্তু ভোটের দিন পর্যন্ত জয়ের ব্যাপারে কারো আত্মবিশ্বাসে ঘাটতি ছিল না। একজন তো আমেরিকা থেকে ছুটে এসেছিলেন মেয়র হওয়ার আশায়। আরেকজন তো ফেসবুকে নিজেকে সম্ভাব্য মেয়র হিসেবে পরিচয় দিচ্ছিলেন। দুয়েকজনের কথা বুঝি। ত্রিশ বছর আমেরিকায় থেকে অঢেল টাকা কামিয়েছেন। কারো হয়ত বাপ জমিদার। টাকা খরচ করার রাস্তা নেই। তারা না হয় নির্বাচন করে কিছু টাকা হালাল করলেন। কিন্তু অনেককেই চিনি, যাদের দিন আনি দিন খাই দশা। কিন্তু মেয়র হতে চান। কেউ কেউ মোটা বেতনের চাকরি ছেড়ে নির্বাচনে নেমেছেন। রহস্যটা কি? আমি জানি না, সত্যি জানি না। তবে বড় দলের সমর্থন প্রত্যাশী একজনের কথায় রহস্যের কিছুটা কিনারা হলো। দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি। তাই হতাশ কণ্ঠে তিনি বলছিলেন, দল আমাকে খাসি করে দিল। তিনি বললেন, পাস-ফেলের কথা জানি না। তবে নির্বাচনটা করতে পারলে, নির্বাচন শেষে সব খরচ বাদ দিয়ে ক্যাশ পাঁচ কোটি টাকা হাতে থাকত আমার। তিনি নাকি সেই টাকায় একটি ট্রাস্ট করারও পরিকল্পনা করেছিলেন। আহারে শুনতে শুনতে আমারও তার জন্য মায়াই লাগছিল। এমন পাঁচ কোটি টাকার লটারিটা বেচারার হাতছাড়া হয়ে গেল। জানতে চাইলাম, সেই টাকাটা কোত্থেকে আসবে? তিনি রহস্যটা ভাঙলেন না। খালি আমার দিকে এমন একটা চাহনি দিলেন, যার অর্থ, এমন বোকা লোক এতদিন সাংবাদিকতা করল কিভাবে? তাই নির্বাচন করার রহস্য উদঘাটনের দ্বারপ্রান্তে গিয়েও ফিরে এলাম খালি হাতেই। অনেকে বলেন, নির্বাচন করলে, পাস ফেল যাই হোক, নামটা অন্তত ফাটে। টিভিতে চেহারা দেখানো যায়। তাতে লাভটা কোথায়? সেটাও বুঝে এলো না। পেশার কারণে প্রায়ই টিভিতে চেহারা দেখাতে হয়। কিন্তু টিভিতে চেহারা দেখালে কী লাভ হয়, আজও বুঝতে পারিনি।
নির্বাচন নিয়ে আমার আরো কিছু প্রশ্ন আছে। বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচন দেখে বারবার এই প্রশ্ন আমার মনে আসে। পেশাজীবীদের স্বার্থ রক্ষায় সংগঠনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য সব পেশাজীবীর তো বটেই, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতাদের প্রতি আমার পরম শ্রদ্ধা। তারা নিজেদের কাজকর্ম ফেলে আমাদের স্বার্থে দৌড়ঝাঁপ করেন। ’৯৪ সালে বাংলাবাজার পত্রিকা থেকে চাকরি চলে যাওয়ার পর সাংবাদিক নেতারা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সাংবাদিক নেতাদের অনেককে দেখতাম বাসে ঝুলে বা রিকশায় অফিস করছেন। কিন্তু এখন মনে হয় দিন বদলে গেছে। সাংবাদিক নেতাদের চাকচিক্যময় জীবন চমকে দেয় অনেককেই। অনেক নেতা আছেন, যাদের কোনো চাকরি নেই। তাদের পেশাই নাকি সাংবাদিক নেতা। সম্ভবত ’৯৬ সালে আমি একবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে কার্যনির্বাহী সদস্য পদে নির্বাচন করেছিলাম। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে পাসও করেছিলাম। জনপ্রিয় সাংবাদিক নেতা শাহেদ চৌধুরী সেবার প্রথম হয়েছিলেন। তিনি পেয়েছিলেন ৩০৩ ভোট। আমি পেয়েছিলাম ৩০০ ভোট। নির্বাচনের পর আমার এক বন্ধু আফসোস করে বলেছিলেন, ইশ আগে জানলে তোকে সিঙ্গেল ভোট দিতাম। দুইটা সিঙ্গেল ভোট হলেই তো তুই ফার্স্ট হয়ে যেতি। আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম, ফার্স্ট হতে হবে, এমন টার্গেট আমার ছিল না, জীবনে কখনোই ফার্স্ট হতে চাইনি। আর আমি নিজেই তো সিঙ্গেল ভোট দেইনি, শাহেদ চৌধুরীকেও ভোট দিয়েছি। নির্বাচনের পর বুঝলাম ঠ্যালা। কিছুদিন পরপরই কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক, বিভিন্ন সাব কমিটির বৈঠক। প্রায়ই সেই বৈঠকের সঙ্গে আমার অফিসের অ্যাসাইনমেন্ট ক্ল্যাশ করত। এখন অ্যাসাইনমেন্টে যাব না মিটিংয়ে যাব? বুঝে গেলাম, এ কম্মো আমার নয়। আর যে দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতে পারব না, সে দায়িত্ব আমি কখনোই নিইনি। তাই এরপর আর নির্বাচনমুখী হইনি। তবে সবসময় ভালো ও পেশাদার সাংবাদিকদের নির্বাচনের ব্যাপারে উৎসাহ দিয়েছি। আমি চাই, আমরা যাদের ভোট দেব, যারা আমাদের নেতৃত্ব দেবেন; তারা হবে সৎ, দক্ষ, পেশাদার। যাক আমার নির্বাচনের কথা বলছিলাম। সে নির্বাচনে আমার নিট খরচ হয়েছিল ৩০০ টাকা। ভোরের কাগজের কম্পিউটারে কম্পোজ করে এক পৃষ্ঠায় আটটি নির্বাচনী স্লিপ বানিয়েছিলাম। তারপর সেটার প্রিন্ট নিয়ে ৩০০ কপি ফটোকপি করিয়েছিলাম। সেটা কেটে নেওয়াতেই হয়ে গেল ২ হাজার ৪০০ স্লিপ। ফটোকপি করার সেই ৩০০ টাকাই আমার খরচ। নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলাম মাসুদ কামালের মোটরবাইকে চড়ে। কিন্তু এখন দেখি জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএফইউজে, ডিইউজে বা রিপোর্টার্স ইউনিটির নির্বাচন প্রায় জাতীয় নির্বাচনের রূপ পেয়ে যায়। প্রার্থীদের রঙিন রঙিন পোস্টার, রঙ-বেরঙের স্লিপ, হরেক প্রতিশ্রুতিÑ কী নেই। এছাড়াও সমমনা ভোটারদের নিয়ে বড় বড় ক্লাবে পার্টি। কানাঘুষা শুনি বড় পদে প্রার্থীদের নির্বাচনী ব্যয় কয়েক লাখ টাকা হয়ে যায়। ব্যয় তো বুঝলাম, কিন্তু আয়ের উৎস কি? কয়েকজন নেতাকে চিনি যারা কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন জানি না, কিন্তু সারা দিন রিপোর্টার্স ইউনিটি বা প্রেসক্লাবেই থাকেন। নেতাদের কি অফিস টাইম নেই? তাদের কি অফিস করতে হয় না। কয়েকজন আছেন, যারা প্রতিবছরই কোনো না কোনো পদে নির্বাচন করেন। নির্বাচন করার জন্য প্রতিবছর তাদের লাখ লাখ টাকা কোন ভূতে জোগায়? আর লাখ লাখ টাকা খরচ করে নির্বাচিত হয়ে তাদের লাভ কি? এসব সংগঠনের পদধারীদের তো কোনো সম্মানীও নেই। নিছক সামাজিক মর্যাদা কেনার জন্য এত টাকা তারা পান কোথায়? পেশাজীবীদের নির্বাচনেও কি পাস-ফেল যাই হোক নির্বাচনের পর টাকা উদ্বৃত্ত থাকার কোনো গোপন কৌশল আছে?
আমি সঠিক সংখ্যাটা জানি না। কিন্তু বাংলাদেশে প্রতিদিন অসংখ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক পত্রিকার সংখ্যাও কম নয়। অনলাইন কত আছে, সম্ভবত তথ্য মন্ত্রণালয়ও জানে না। বাংলাদেশে টিভির সংখ্যা এখন ২৬টি। লাইসেন্স দেওয়া সবকয়টি অনএয়ারে গেলে এই সংখ্যাটা বেড়ে হবে ৪২। এফএম রেডিও, কমিউনিটি রেডিওর সংখ্যাও কম নয়। আমি যতদূর বুঝি, হাতেগোনা কয়েকটি পত্রিকা, সাময়িকী, টিভি, রেডিও লাভজনক বা অন্তত লসজনক নয়। তাহলে বাকি পত্রিকা, টিভি, রেডিও কেন চলে? গণমাধ্যমের সংখ্যা বেশি হওয়াতে আমাদের, মানে সাংবাদিকদের লাভ হয়েছে। আমাদের অনেকের কর্মসংস্থান হয়েছে, ভালো বেতন, কারো কারো গাড়িও মিলেছে। কিন্তু এই লসজনক প্রজেক্ট দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চালিয়ে মালিকের লাভ কি? সত্যি আমার মাথায় ঢুকে না। ২৫ বছর সাংবাদিকতা করার পরও অনেকে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মারে, বলে, আপনি বুঝবেন না। সাংবাদিক হলেই নাকি লাভ, ক্ষমতা, দাপট। কিন্তু লাভ, ক্ষমতা, দাপটের উৎসটা খুঁজে পেলাম না। গাড়িতে ‘এটিএন নিউজ’-এর স্টিকার লাগানো থাকার পরও, সব কাগজপত্র আপটুডেট থাকার পরও ট্রাফিক এসে জরিমানা করে দেয়। একাধিকবার এমন জরিমানা দিতে হয়েছে। একবার তো কোনো খুঁত না পেয়ে নম্বর প্লেট কেন এক লাইনে লেখা, এই অপরাধে জরিমানা গুনতে হয়েছে। তাহলে এই স্টিকার থাকার দরকার কি? ২৫ বছর ধরে বরাবরই ভালো প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার পর এখনও মাসের বেতন পেতে দেরি হলে বউয়ের মুখ ঝামটা সইতে হয়। মফস্বল থেকে অনেকে এসে খালি কার্ড চায়, বেতন-কড়ি লাগবে না। তাহলে তার সংসার চলবে কিভাবে? মালিকদের না হয় আরো অনেক ব্যবসা আছে। পত্রিকা বা টিভির অদৃশ্য দাপট খাটিয়ে সেই ব্যবসায় লাভ করেন। আর পত্রিকায় বা টিভিতে ভর্তুকি দেন। কিন্তু সাংবাদিকদের কাউকে কাউকে দেখেও হিসাব মেলে না। চার-পাঁচ বছর নামকাওয়াস্তে কোনো একটা পত্রিকা টিভিতে কাজ করার পরই বাড়ি-গাড়ি-ফ্ল্যাট দিয়ে রীতিমতো আখের গুছিয়ে ফেলেন। কিভাবে? সেই আলাদিনের চেরাগটা কোথায় জানি না। আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, আমি কি তাহলে পথের ফকির? ঢাকায় যখন এসেছি, তখন নিঃস্ব থাকলেও, এখন অবস্থা ততটা খারাপ নয়। বন্ধু-বান্ধব মিলে কিস্তিতে টুকটাক জমি কিনেছি। নিয়ম মতো আবেদন করে রাজউকের একটি প্লটও পেয়েছি। কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, আমার জীবদ্দশায় তার কোনোটিতেই গাছও লাগাতে পারব না। আমার বন্ধু-বান্ধবদের অনেকেই ব্যাংক লোন নিয়ে ফ্ল্যাট কিনেছেন। কিন্তু ডাউনপেমেন্টের টাকা কখনো জোগাড় করতে পারব না বলে, ২৫ বছর ধরে ঢাকার বাড়িওয়ালাদের কয়েকটি ফ্ল্যাটের দাম শোধ করে ফেলেছি।
এখন যেভাবে ব্যাঙের ছাতার মতো ঘরে ঘরে অনলাইন, ঘরে ঘরে সাংবাদিক। নিজের নামের সঙ্গে ২৪ডটকম জুড়ে দিলেই হলো। স্বামী প্রধান সম্পাদক, স্ত্রী সম্পাদক- সাংবাদিক পরিবার। কিন্তু অতগুলো অনলাইন চলে কিভাবে, কেন? আমার মাথায় ঢোকে না। পুরোটা কাট-পেস্ট করে চালালেও একটি অনলাইন চালাতে মাসে লাখ টাকার ওপরে খরচ হয়। এই লাখ টাকা দিয়ে অনলাইন চালাতে হবে কেন?
আরেকটা বিষয় আমার মাথায় ঢোকে না কখনো- বিদেশ ভ্রমণ। ২৫ বছরের ক্যারিয়ারে আমি মোট চারবার দেশের বাইরে গিয়েছি। দুইবার আমন্ত্রণে। আর দুবার নিজের পয়সায় বেড়াতে। কিন্তু আমার বন্ধু-বান্ধবদের পাসপোর্ট দেখি মোটা হতে হতে রচনাবলীর আকার নিয়ে ফেলেছে। কয়েকজনকে তো চিনি ডা. দীপুমনির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবেন। বিশ্বের ভ্রমণযোগ্য কোনো দেশ বাকি নেই। যেকোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনেই দেখি কিছু চেনা মুখ হাজির। একই লোক সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হন, আর কিভাবে সব সম্মেলনে হাজির হন, আমার মাথায় ঢোকে না। কে তাদের আমন্ত্রণ জানায়, কে তাদের টিকিট দেয়, হোটেল দেয়, কেন দেয়? এরা তো না হয় নিজেদের যোগ্যতায় (বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে আমন্ত্রণ যোগাড় করাটাও অবশ্যই একটা যোগ্যতা) বিভিন্ন সম্মেলন থেকে আমন্ত্রণ ম্যানেজ করে বিদেশে যান। কিন্তু সাংবাদিক বন্ধুদের অনেককেই দেখি হুটহাট কথায় কথায় এখানে সেখানে চলে যান। দেখা হলে বলেন, এই একটু চেকআপ করতে গিয়েছিলাম বামরুনগ্রাদে। শুনে আমি চমকে যাই। দুই বার বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বিদেশে যাওয়া অনেক খরচান্ত ব্যাপার। চেকআপও মুখের কথা নয়। একবার দেশের বাইরে বেড়াতে গেলে তার খরচ ম্যানেজ করতে সারা বছর হিসাব করে চলতে হয়। সাংবাদিক বন্ধু-বান্ধবদের অনেককেই দেখি বড় বড় ক্লাব বা হোটেলে জন্মদিন, ম্যারেজ ডে পালন করেন। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রই। যেভাবে টাকা উড়ে যায়, দেখে আমারই কষ্ট হয়। কেউ যেন ভাববেন না, আমি কিপটে। বরং উল্টোটা, সুযোগ পেলে আমিও খরচ করি। কিন্তু খরচ করার জন্য তো হাতে টাকাটা থাকতে হবে। সেটা আসবে কোত্থেকে? কে কত বেতন পান, সেটা তো আমরা জানিই। তাই কারো কারো খরচের বহর দেখলে চোখ কপালে উঠে যায়।
গত তিন বছর ধরে আমার একটা নতুন রোগ হয়েছে- বই প্রকাশ। ঢাকা আসার পর থেকেই, মানে ২৫ বছর ধরেই লেখালেখি করছি। তবে বই প্রকাশের কথা মাথায় আসেনি কখনো। ২০১৩ সালে প্রথম বই প্রকাশের পর পরের দুই বছরে দুটি করে আরো চারটি, মানে মোট পাঁচটি বই প্রকাশিত হয়ে গেছে। কেউ ভাববেন না, বই প্রকাশ করা খুব লাভজনক বা আমি খুব জনপ্রিয় লেখক। আমি খালি নিশ্চিত হতে চেয়েছি, আর যাই হোক, প্রকাশকের যেন লস না হয়। বই প্রকাশের আগেই আমি জেনে নিয়েছি, অন্তত কত কপি বিক্রি হলে প্রকাশকের লস হবে না। আশা করি আমার কোনো প্রকাশই আমাকে আড়ালে গালি দেন না। প্রকাশকের না হলেও প্রতিবারই আমার কিছু টাকা লস হয়েছে। আমার যে অল্প সংখ্যক পাঠক আছেন, তাদের জানানোর জন্য প্রথম আলোতে মেলার সময় একটা ক্ষুদ্রতম বিজ্ঞাপন দিয়েছি। ওই টাকাটাই লস। কিন্তু নিজের লেখা বই হাতে আসলে, যে আনন্দ হয়, তার কাছে ওই লসটা নিতান্তই নগণ্য। বইমেলায় আমি যাই পঁচিশ বছর ধরে। কিন্তু বই প্রকাশের পর থেকে বইমেলায় গেলে নানাকিছু নানাভাবে দেখি, আর অবাক হই। হাজার হাজার বই বেরুচ্ছে। চেনা-অচেনা অনেক লেখক। বইয়ের মেলায় গেলেই আমার ভালো লাগে। নতুন বইয়ের গন্ধটাই অন্যরকম। কিন্তু অনেক বই উল্টেপাল্টে দেখে বুঝি এগুলো আমার বইয়ের মতোই অপ্রয়োজনীয়, প্রকাশ না হলেও কোনো ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার জানার কৌতূহল এই অপ্রয়োজনীয় বইগুলো কার পয়সায় প্রকাশিত হয়, লেখকের না প্রকাশকের? আমার মতো অনেক লেখক আছেন, যারা গাঁটের টাকা খরচ করে বইয়ের বিজ্ঞাপন দেন বা বই প্রকাশ করেন। আমার তো না হয় বিজ্ঞাপনের টাকাটা লস হয়, কিন্তু অনেক লেখককে নিশ্চয়ই বই প্রকাশের টাকাও দিতে হয়। প্রকাশক কেন তার টাকায় অচেনা লেখকের অচল বই প্রকাশ করবেন। লেখকের না হয় তার বই নিয়ে অনেক আবেগ থাকে। প্রকাশকের কাছে তো প্রকাশনা একটা ব্যবসা, বই একটা পণ্য। আবেগের কারণে না হয় গাঁটের পয়সা খরচ করে একটি বই করা যায়। কিন্তু অনেক অচেনা লেখককে দেখি প্রতিবছরই বই প্রকাশ করেন। কেন, কিভাবে? খোঁজ নিয়ে জানলাম, মেলায় সাধারণ পাঠকরা বই না কিনলেও লেখক বা প্রকাশকের লস হয় না। সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প বা লাইব্রেরিতে বই গছিয়ে দেওয়া হয়। এভাবেই উঠে আসে লেখক বা প্রকাশকের লগ্নি। আরেকটা বিষয় আমার কাছে চির রহস্য হয়ে আছে- বইয়ের বিজ্ঞাপন। বইমেলার সময় আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বইয়ের বিজ্ঞাপন পড়ি। আগে এই বাণিজ্যটা ভালো জানতাম না। নিজে বই প্রকাশের সময় বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে দেখলাম, বইয়ের বিজ্ঞাপন দেওয়া অনেক খরচান্ত ব্যাপার। প্রথম আলোতে একটা ছোটখাটো বিজ্ঞাপন দিতেও হাজার দশেক টাকা বেরিয়ে যায়। কিন্তু অনেক লেখক বা প্রকাশককে দেখি দিনের পর দিন বড় বড় সাইজের বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানি প্রথম আলোতে আগাম টাকা দিয়ে বিজ্ঞাপন দিতে হয়। আমি হিসাব করে দেখেছি কোনো কোনো লেখকের বিজ্ঞাপনই ছাপা হয় কয়েক লাখ টাকার। এখন এবার একটু রয়েলিটির হিসাব বলি। বাংলাদেশের স্ট্যান্ডার্ড লেখক সম্মানী হলো ১৫ শতাংশ। মানে একশ টাকা দামের একটি বই বিক্রি হলে লেখক পাবেন ১৫ টাকা। ২০০ টাকা দামের একটি বই বিক্রি হলে লেখক পাবেন ৩০ টাকা। এখন তাকে এক লাখ টাকা সম্মানী পেতে হলে অন্তত সাড়ে ৩ হাজার বই বিক্রি হতে হবে, দুই লাখ টাকা পেতে হলে ৭ হাজার বই বিক্রি হতে হবে। তার ওপর আবার প্রকাশকরা নিয়মিত রয়েলিটি দেনও না। আমার প্রথম বইয়ের প্রকাশক আমাকে ১০ শতাংশ হারে রয়েলিটি দিয়েছেন। নতুন লেখক বলেই হয়ত ৫ শতাংশ কম দিয়েছেন। কিন্তু খোঁজ নিয়ে জেনেছি, নতুন লেখক, পুরান লেখক বলে আলাদা কিছু নেই। যার যত কপি বই বিক্রি হবে, তিনি সে অনুপাতে রয়েলিটি পাবেন। ‘স্বাধীনতা আমার ভালো লাগে না’র জন্য বিজ্ঞাপনের পেছনে যে সামান্য টাকা খরচ করেছিলাম, রয়েলিটিতে তার পুরোটা উঠে আসেনি। মানে প্রথম বইয়ে আমার সামান্য কিছু টাকা লস হয়েছে। প্রথম বই বলেই আবেগে সেই লস দিতে পেরেছিলাম। পরে আর যা দেইনি, দেওয়া সম্ভবও নয়। এটা ঠিক বইয়ের বিজ্ঞাপন আসলে লেখকের নয়, প্রকাশকের দেওয়ার কথা। কারণ পণ্যটা প্রকাশকের। কিন্তু বাংলাদেশে হাজারের ওপর বই ছাপা হয়, এমন লেখকই আছেন কয়েকজন। আমার বই হাজারের নিচে ছাপা হয়, বিক্রি হয় আরো কম। বেশিরভাগ লেখকই আমার দলে। অনেক রথী-মহারথী, সাহিত্যের ইতিহাসে যাদের স্থায়ী আসন, তেলবাজিতে সব্যসাচী লেখকদের বইয়ের বিক্রিও শয়ের ঘরে। প্রকাশকরাও বইয়ের বিজ্ঞাপন দেন। তবে সবার বই নয়, যার বই বিক্রি বেশি হয় তার। কারণ প্রকাশকের কাছে এটা নিছকই ব্যবসা। নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে লেখকের বই ছাপছেন, আবার পয়সা দিয়ে তার বইয়ের বিজ্ঞাপনও ছাপবেন, এতটা উদার তারা নন। এখানে একটা মজার চক্র আছে। প্রকাশকরা এমন লেখকের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেন, যার বই অনেক বিক্রি হয়, যাতে তার বিজ্ঞাপনের টাকা উঠে আসে। কিন্তু নতুন বা তরুণ লেখকদের বইয়ের বিজ্ঞাপন দেন না। কারণ দিলে বিজ্ঞাপনের টাকাটাই বাড়তি লস। কিন্তু যাদের বই চলে, পাঠকরা এসে খুঁজে খুঁজে তাদের বই কেনেন, জাফর ইকবালের বইয়ের বিজ্ঞাপন লাগে না। নতুন লেখকদের বই বরং বিজ্ঞাপন দিয়ে পাঠকদের জানাতে হয়। সমস্যাটা হলো যাদের বই চলে না, তাদের বই বিজ্ঞাপন দিলেও চলে না, অন্তত বিজ্ঞাপনের টাকা উঠে আসার মতো চলে না। এ এক অভেদ্য চক্র। আমার হিসাবে প্রকাশক বিজ্ঞাপন দিতে পারেন বা বই বিক্রি থেকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার টাকা উঠে আাসবে, এমন লেখক আছেন বাংলাদেশে বড় জোর ১০ জন। কিন্তু বইমেলার সময় পত্রিকার পৃষ্ঠাজুড়ে থাকে বইয়ের বিজ্ঞাপন। শুক্রবারে তো পত্রিকা ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে। তাহলে এই লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন কে দেয়, কেন দেয়? একবার-দুবার বা প্রথম বই, বিশেষ বইয়ের একটি বিজ্ঞাপন দেওয়া ঠিক আছে। কিন্তু কিছু লেখককে দেখি প্রতিবছরই কয়েক লাখ টাকা বিজ্ঞাপনের পেছনে খরচ করেন, কিন্তু রয়েলিটি পান বড়জোর কয়েক হাজার টাকা। লেখক হিসেবে নাম ফাটানোর জন্য প্রতিবছর কয়েক লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে অনেক টাকা থাকতে হয়। লেখার মান যেমনই হোক, বাংলাদেশে পয়সাওয়ালা লেখক অনেক আছেন। আপনারা বইমেলার সময় পত্রিকার বিজ্ঞাপনের পাতা দেখলেই তাদের নামের তালিকা পেয়ে যাবেন।
আরেকটা প্রশ্নের উত্তর আমি জানি না। আমি জানি, আমি ছাড়া সবাই জানেন এই প্রশ্নের উত্তর। তাই এই প্রশ্ন শুনে সবাই হাসবেন। বোকা ভাববে এই ভয়ে সামনাসামনি কখনো কাউকে জিজ্ঞাসাও করিনি। ভয়ডর ঝেড়ে ফেলে এবার করেই ফেলি। এই যে বাংলাদেশে এত এত এনজিও আছে, তাদের আয়ের উৎস কি? আমি জানি বাংলাদেশে অনেক এনজিও আছে, যারা অনেক ভালো কাজ করে। দেশের উন্নয়নে, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশুশিক্ষা, মাতৃস্বাস্থ্য ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু আমার বোকা প্রশ্নটা হলো, তারা যে এতসব জনহিতকর কাজ করেন, সেই টাকাটা আসে কোত্থেকে? শুনি বিদেশি ফান্ড আসে। কিন্তু বিদেশিরাই বা টাকাটা দেয় কেন? গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, আশা’র মতো ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠানের বিষয়টা তবু বুঝি, তারা চড়া সুদে ঋণ দিয়ে, মানুষের রক্ত চুষে টাকা আয় করে। কিন্তু সিপিডি বা টিআইবি’র মতো বড় প্রতিষ্ঠান, যাদের আয়ের কোনো দৃশ্যমান সংস্থান নেই, বিক্রিযোগ্য কোনো পণ্য নেই; তাদের আয়ের উৎসটা সত্যি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। প্লিজ কেউ আমাকে ভুল বুঝবেন না। এইসব এনজিওতে আমার অনেক পরিচিত বন্ধু বা শ্রদ্ধেয় মানুষেরা কাজ করেন। আমি কিন্তু তাদের কাজের মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না বা তাদের সততা নিয়েও প্রশ্ন তুলছি না। এ নিছক আমার ছেলেমানুষি কৌতূহল।
এমন কত ছেলেমানুষি কৌতূহল যে আছে তার ইয়ত্তা নেই। ইদানীং বাংলাদেশে অনলাইন বাজার খুব জনপ্রিয়। এখানে ইডটকম, বিক্রয়ডটকম...। এখানে সবকিছু বেঁচে দেওয়া যায়, কেনাও যায়। এখানে বিক্রির বিজ্ঞাপন দিতে কোনো টাকা দিতে হয় না। এখান থেকে কিছু কিনতে গেলেও কোনো কমিশন দিতে হয় না। কিন্তু তারা নিজেদের সাইটে বিজ্ঞাপন দিতে বিভিন্ন টিভি আর পত্রিকায় লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দেয়। আমার প্রশ্ন, তাদের আয়ের উৎস কি? আমি তাদের সাইট ঘুরে দেখেছি, সেখানে অত বিজ্ঞাপন নেই, যা দিয়ে তাদের দেওয়া বিজ্ঞাপনের টাকা উঠে আসবে।
আইন নিয়ে একটা কথা প্রায়ই শুনি- আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে। এর চেয়ে হাস্যকর কথা আমি আমার জীবনে শুনিনি। আপনারা শুনেছেন? একটা গল্প মনে পড়ে গেল। দুই গরিব মামলায় জড়ালে দুজনেই ধ্বংস হয়ে যায়। একজন ধনী, একজন গরিবের মধ্যে আইনি লড়াই হলে গরিব ধ্বংস হয়ে যায়। আর দুই ধনি আইনি লড়াইয়ে নামলে আইন ধ্বংস হয়ে যায়। আইনের যে নিজস্ব কোনো গতি নেই, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ জেনারেল মঞ্জুর হত্যা মামলা। ১৯৮১ সালের ৩০ মে তখনকার রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যার পর কৌশলে জেনারেল মঞ্জুরকেও হত্যা করা হয়। ঘটনার ১৪ বছর পর জেনারেল মঞ্জুরের ভাই এরশাদসহ অনেককে আসামি করে মামলা করেন। মামলা তো নয়, যেন এরশাদের গলায় সোনার দড়ি পরিয়ে দেওয়া হলো। ব্যস, এই এক মামলা দিয়ে ক্ষমতাসীনরা এরশাদকে নিয়ন্ত্রণ করেন। মনিবরা যেভাবে গলায় সোনালি বেল্ট বাঁধা কুকুর নিয়ে ঘুরে বেড়ান, তেমন। এরশাদ এখন মন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত। কিন্তু এই বিশেষ দূত পদ নয়, আসলে সোনার শেকল। এরশাদ যখনই বিপ্লবী হয়ে ওঠেন, গাইগুই করেন, টান পড়ে সোনার শেকলে, মানে মঞ্জুর হত্যা মামলার তারিখ পড়ে। ব্যস, এরশাদ আবার মনিবভক্ত কুকুরের মতো নতমস্তক। জেনারেল মঞ্জুরের ভাই আইনজীবী আবুল মনসুর আহমেদকে নিশ্চয়ই ক্ষমতাসীনরা দোয়া করেন, এমন চমৎকার একটি অস্ত্র বানিয়ে দেওয়ার জন্য। ২০ বছরে ২২বার এ মামলার বিচারক পরিবর্তন হয়েছে। এখন আপনারাই বলুন, আইনের নিজের গতি কোনটা? ক্ষমতাচ্যুতির পর বিএনপির শাসনামল পুরোটাই এরশাদ কারাগারে ছিলেন। একের পর এক মামলা, মনে হচ্ছিল, এরশাদকে বোধহয় বাকি জীবনটা জেলেই কাটাতে হবে। কিন্তু ’৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে জাতীয় পার্টির সঙ্গে সমঝোতা করে। ব্যস, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসতেই বদলে গেল আইনের গতি। একের পর এক মামলার জামিন নিয়ে বেরিয়ে এলেন স্বৈরাচারী এরশাদ। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে কারা খুন করেছে সবাই জানে। খুনিরা রেডিওতে ঘোষণা দিয়েছে। দেশি-বিদেশি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে দম্ভের সঙ্গে খুনের কথা স্বীকার করেছে। কিন্তু ২১ বছর তারা ছিল ধরাছোঁয়ার বাইরে। আইন যদি নিজস্ব গতিতে চলে, তাহলে এমন আত্মস্বীকৃত খুনিরা কিভাবে এতদিন বহাল তবিয়তে আইনের বাইরে থাকে? ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর মামলা হলো, বিচার শুরু হলো। কিন্তু শেষ হওয়ার আগেই ক্ষমতায় চলে এলো বিএনপি। তারপর পুরো পাঁচ বছর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা ডিপফ্রিজে। তখন আইনের গতি কোথায় ছিল? এবার আপনারাই বলুন, আইনের গতি কোনটা? আইন কি নিজের গতিতে চলে? নাকি ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছায় চলে?
বিশ্ব বেহায়া এরশাদের কথা লিখতে গিয়ে মনে পড়ে গেল আমাদের চারপাশে এমন আরো কত বেহায়া দেখি প্রতিদিন। রাজনীতির দলবদল দেখে প্রতিদিন আমার অবাক লাগে। একটা মানুষ কিভাবে এক মুখে এত কথা বলে? এই ধরুন এরশাদ। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে এরশাদ জেল থেকে মুক্তি পেল। কিন্তু কয়দিন বাদেই আবার বিএনপির সঙ্গে মিলে চারদলীয় জোট গড়ে আন্দোলনে নামল আওয়ামী লীগেরই বিরুদ্ধে। এভাবে এরশাদ যেন এক পেন্ডুলাম। সুবিধা মতো কখনো আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি। পটুয়া কামরুল হাসান অত আগে এরশাদের এমন একটি পারফেক্ট উপাধি দিলেন কিভাবে? রাজনৈতিক দলগুলোও কেমন নিপুণভাবে তাল মেলাচ্ছে। নিজেদের সঙ্গে থাকলে এরশাদ ভালো, প্রতিপক্ষের সঙ্গে জোট বাঁধলেই স্বৈরাচার। এই যেমন ধরেন ব্যারিস্টার মওদুদ। এই চতুর আইনজীবী তরুণ বয়সেই বঙ্গবন্ধুর খুব কাছেরজন ছিলেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর পর তরী ভেড়ালেন জিয়াউর রহমানের ঘাটে। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ ক্ষমতায় এসে দুর্নীতির দায়ে তাকে জেলে পাঠালেন। কিন্তু সেই দুর্নীতিবাজকেই তিনি মন্ত্রী বানালেন। জেল থেকে সরাসরি মন্ত্রিসভায়! তারপর মওদুদ জাতীয় পার্টির হয়ে আওয়ামী লীগের সঙ্গে মিলে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন। আবার সুযোগ বুঝে বিএনপিতে যোগ দিয়ে আইনমন্ত্রী বনে গেছেন। তারপর আইনকে ইচ্ছামতো গতি দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলাকে ডিপফ্রিজে রাখার কৃতিত্ব এই মওদুদের। নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বানাতে বিচারপতিদের চাকরির বয়স বাড়িয়ে জাতিকে জটিল এক গাড্ডায় ফেলে দেওয়ার একক কৃতিত্ব এই মওদুদের। আমার খুব অবাক লাগে ব্যারিস্টার মওদুদ যখন বেগম খালেদা জিয়াকে পরামর্শ দেন, তখন কি বেগম জিয়ার একবারও তার অতীত কর্মকা-ের কথা মনে পড়ে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তৃতা অনুষ্ঠানে দেখলাম এরশাদ আর মওদুদ পাশাপাশি বসে আছেন। দেখে খুব মজা লাগলো, এক সময়ের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট পাশাপাশি বসে আছেন। আমার খালি অবাক লাগে, এরশাদ কি কোনোদিন মওদুদকে জিজ্ঞাসা করেন না, আপনাকে আমি জেল থেকে মুক্ত করে মন্ত্রী বানালাম, প্রধানমন্ত্রী বানালাম, ভাইস প্রেসিডেন্ট বানালাম; আপনার তো সারা জীবন আমার পায়ের কাছে পড়ে থাকার কথা। কিভাবে আপনি ডিগবাজি দিলেন? একমুখে মওদুদ বঙ্গবন্ধুর আদর্শের কথা বলেছেন, জিয়ার আদর্শ বিলিয়েছেন, এরশাদের আদর্শ গেয়েছেন। কিভাবে সম্ভব? চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা কথা আছে। এই যেমন জাসদের জন্মই হয়েছিল আওয়ামী লীগের বিরোধিতার জন্য। ১৫ আগস্ট ফারুক-রশীদরা যা করেছে; তেমন একটা কিছু করার জন্যই তৈরি হচ্ছিল জাসদ, গণবাহিনী আর বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা। বলা যায়, জাসদই দেশজুড়ে অরাজকতা তৈরি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার পটভূমি তৈরি করেছিল। ১৫ আগস্টের পর কর্নেল তাহের খুনিদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। আবার সুযোগ বুঝে ৭ নভেম্বর ‘বিপ্লব’ করে বসেন। বিএনপি এখন যে ৭ নভেম্বর জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস পালন করে, সেটা তো আসলে জাসদের বিপ্লব, বিএনপির তো তখন জন্মই হয়নি। কিন্তু জাসদের ভাষায় জিয়াউর রহমানের বেঈমানির কারণেই তাদের বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে দিয়ে যা করাতে চেয়েছিলেন, তা কি হাজার হাজার মেধাবী তরুণকে স্বপ্ন দেখানো সেই বিপ্লব? নাকি সেনাবাহিনীর বঞ্চিত সৈনিকদের উস্কে দেওয়ার চেষ্টা? একটু খালি ভাবুন, তখন যদি জিয়াউর রহমান কর্নেল তাহেরের স্ক্রিপ্ট ফলো করতেন, তাহলে হয়ত তাহের প্রেসিডেন্ট, জিয়া প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক, হাসানুল হক ইনু হতেন তথ্যমন্ত্রী। ইতিহাসের নির্মম পরিহাস, সেই ইনু ভাই তথ্যমন্ত্রী হয়েছেন, তবে আওয়ামী লীগ সরকারের! ইনু ভাই যখন আজ অরাজকতার বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বলেন, শুনতে আমার খুব ভালো লাগে। খালি ভাবি, ’৭২ থেকে ’৭৫ পর্যন্ত একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার সময় এই জাসদ কি না করেছে। জাসদের কর্মীর লেখা বইয়ে আছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও কর্মসূচিতে প্রথম গুলিটি নাকি হাসানুল হক ইনু ছুঁড়েছিলেন। দলবদল বা আদর্শ বদল নিয়ে এমন অসংখ্য মজার মজার অবিশ্বাস্য গল্প শোনানো সম্ভব। আমার এলাকার এমপি মেজর জেনারেল (অব.) সুবিদ আলী ভুইয়া। ছোটবেলা থেকেই আমরা জানি, আমাদের এলাকায় একজন বড় সেনা কর্মকর্তা আছেন এবং তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ আছে। চাকরিতে থাকার সময়ই তিনি নানা উন্নয়ন কর্মকা- করতেন ভবিষ্যৎ রাজনীতি মাথায় রেখে। এতে দোষের কিছু নেই। অনেকেই এমনটা করেন। আমার পাশের উপজেলায় এম কে আনোয়ার চাকরি করার সময় এত উন্নয়ন করেছেন যে, তিনি রাজনীতিতে এসে নির্বাচন করলে অনায়াসে পাস করেন। যাক আমরা ছেলেবেলা থেকেই জানতাম জেনারেল ভুইয়া আওয়ামী লীগবিরোধী এবং প্রো-বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন সুবিদ আলী ভুইয়া তাঁর সামরিক সচিব ছিলেন। কতটা বিশ্বস্ত হলে প্রধানমন্ত্রী কাউকে সামরিক সচিব বানান, তা নিশ্চয়ই ব্যাখ্যা করতে হবে না। সবাই জানত চাকরি থেকে অবসরের পর সুবিদ আলী ভুইয়া বিএনপিতে যোগ দেবেন। কিন্তু সুবিদ আলী ভুইয়া যখন বুঝলেন, ড. খন্দকার মোশাররফ যতদিন বেঁচে আছেন, ততদিন আর যাই হোক বিএনপির মনোনয়ন তিনি পাবেন না; তখন কালবিলম্ব না করে নৌকায় চড়ে বসলেন। যেন বিএনপি করলেই মনোনয়ন পেতে হবে। যাই হোক জেনারেল মাঝির সুবাদেই দীর্ঘদিন পর দাউদকান্দির ঘাটে ভিড়ল আওয়ামী লীগের নৌকা। দাউদকান্দি বরাবরই আওয়ামী লীগ বিরোধী এলাকা। ’৭৩ সালেও খোন্দকার মুশতাককে জেতাতে ব্যালট বাক্স হেলিকপ্টারে করে ঢাকায় আনতে হয়েছিল। তারপর হয় জাসদ, নয় বিএনপি, নয় জাতীয় পার্টি; কিন্তু আওয়ামী লীগ কখনোই নয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী জোয়ারে সেই দাউদকান্দিও আওয়ামী লীগের। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো, সারা জীবন বিএনপির আদর্শে বিশ্বাস করে, খালেদা জিয়ার বিশ্বস্ততম সেনা কর্মকর্তা এখন কী করে বিএনপির বিপক্ষে বলেন?
আরেকটা বিষয় আমার মাথায় ঢোকে না- রাজনীতিবিদদের পেশা। সপ্তম সংসদ নির্বাচনের পর সংসদ নির্বাচন এবং সংসদীয় রাজনীতির ইতিবৃত্ত নিয়ে ‘প্রামাণ্য সংসদ’ নামে একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল আমিনুর রশীদের সম্পাদনায়। সেই বইয়ে সপ্তম সংসদের সদস্যদের সংক্ষিপ্ত জীবনী ও ছবি অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমরা একদল সাংবাদিক ঘুরে ঘুরে এমপিদের জীবনী ও ছবি সংগ্রহ করতাম। তখন আমি একদিন ঝালকাঠির জাতীয় পার্টির এমপি জুলফিকার আলী ভুট্টোর জীবনী সংগ্রহ করতে গিয়েছিলাম তার এমপি হোস্টেলের রুমে। অকাল প্রয়াত এই এমপি অনেক মজার মানুষ ছিলেন। অল্প বয়সেই জাতীয় পার্টির এমপি হয়েছিলেন। এরশাদের সময় ঝালকাঠি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কিন্তু কম বয়সের কারণে নাকি স্থানীয় জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপাররা তাকে অত পাত্তা দিতেন না। তো একবার এরশাদ ঝালকাঠি যাবেন। ভুট্টো আগেই ঢাকা এসে আবদার করল, স্যার আপনি যখন যাবেন, তখন আমি হেলিপ্যাডে থাকব না। আপনি খালি নেমে আমাকে একটু খুঁইজেন। চতুর এরশাদ যা বোঝার বুঝে নিলেন। ঝালকাঠিতে নেমে হেলিকপ্টারের দরজায় দাঁড়িয়ে চারদিকে চোখ বুলিয়ে এরশাদ বললেন, আমার ভুট্টো কোথায়? ব্যস, স্থানীয় প্রশাসনে তোলপাড়। এরপর আর পাত্তা পেতে ভুট্টোর অসুবিধা হয়নি। তো এই ভুট্টো সাহেবের জীবনীর ফর্ম পূরণ করছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার পেশা কী? হাসতে হাসতে বললেন, টাউটারি ছাড়া তো আর কিছু করি না। টাউটারিকে যদি ব্যবসা ধরেন, তাহলে ব্যবসা লেখেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো সত্য কথাটা অনায়াসে বলতে পেরেছিলেন। কিন্তু তার মতো অনেক ‘ব্যবসায়ী’ এখন রাজনীতি করেন। কিন্তু তারা সত্যিটা বলেন না। ইদানীং সত্যিকারের ব্যবসায়ীরা সরাসরি রাজনীতিতে যোগ দিয়েছেন। আগে ব্যবসায়ীরা পর্দার আড়ালে থেকে রাজনীতিবিদদের পালতেন। তারা হয়ত হিসাব করে দেখেছেন, সরাসরি রাজনীতি না করলে দুই দলকেই চাঁদা দিতে হয়। তার চেয়ে সরাসরি রাজনীতি করাই লাভজনক। এত গেল ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ বনে যাওয়া নেতাদের কথা। কিন্তু যারা ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ান তাদের কথা আলাদা। দেশের বাম দলগুলোতে অনেক ফুলটাইমার ছিলেন, এখনও মনে হয় দুয়েকজন আছেন। তারা দেশ ও আদর্শের জন্য নিজেদের উৎসর্গ করেন। অনেকে সংসারও করেন না। পার্টির দেওয়া যৎসামান্য টাকাতেই তাদের কোনোমতে চলে যায়। কিন্তু আওয়ামী লীগ-বিএনপির ফুলটাইমারদের দেখলে মনে হবে, রাজনীতি খুব আকর্ষণীয় পেশা। ছাত্রজীবন থেকে রাজনীতি ছাড়া আর কিছু করেননি। জীবনে কোনো চাকরি করেননি, ব্যবসা করেননি, বাবার হোটেলও খুব সমৃদ্ধ ছিল না। কিন্তু ঢাকায় অভিজাত এলাকায় বাড়ি, দামি গাড়ি, পার্টি, চালচলন সব রাজকীয়। দারুণ রুচিবান, বিদেশি ব্র্যান্ডের জিনিস ছাড়া পরেন না। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, টাকাটা আসে কোত্থেকে?
একসময় সিনেমার পোকা ছিলাম। এসএসসি পর্যন্ত হলে গিয়ে দু-তিনটি সেনেমা দেখেছি। কিন্তু এসএসসি পাসের পর যখন গ্রাম থেকে কুমিল্লা গিয়ে ভিক্টোরিয়া কলেজে ভর্তি হলাম, চোখ কান খুলে গেল। কুয়োর ব্যাঙ সাগরে পড়লে যা হয় আর কি। কুমিল্লায় সিনেমা হল ছিল পাঁচটি- দীপিকা, লিবার্টি, রূপকথা, মধুমতি, রূপালী। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই আমি কমপক্ষে পাঁচটি সিনেমা দেখতাম। পরীক্ষা টরীক্ষা থাকলে একদিনে একাধিক সিনেমা দেখে ফেলার মতো অসম্ভব কাজও করেছি। সিনেমা দেখে ঘেমে নেয়ে একাকার হতে হতো। কারণ মধুমতি ছাড়া বাকি সবকয়টিই ছিল পরিত্যক্তপ্রায়। কিন্তু এত সিনেমা দেখার টাকা কোথায় পেতাম, আমি জানি না। এখনও হিসাব মেলাতে পারি না। আব্বা যে টাকা দিতেন তা একদম কাটায় কাটায় হিসাব করা ছিল। হোস্টেলেই দিয়ে দিতে হতো সেই টাকার সিংহভাগ। তারপর প্রতি সপ্তাহে অন্তত পাঁচটি সিনেমা দেখা, সঙ্গে টুকটাক সিগারেট ফোঁকা- কোত্থেকে টাকা পেতাম জানি না। তখন থেকে আমার বিশ্বাস নেশার টাকা ভূতে জোগায়। কেউ যদি দিনে এক প্যাকেট সিগারেট কেনে তাহলে মাসে খরচ ৬ হাজার টাকা। সেই লোক সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দিলে কি এই টাকাটা সঞ্চয় হবে? বলছিলাম সিনেমার কথা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সেই সুদিন আর নেই। তখন বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাপ্তাহিক নাটক দেখার জন্যও রাস্তাঘাট ফাঁকা হয়ে যেত। জীবনে বহু আলতু ফালতু সিনেমা দেখেছি। কিছু ভালো সিনেমাও দেখেছি। আমার কাছে সিনেমা দেখে আনন্দ পাওয়াটাই সার। সিনেমার গ্রামার বুঝি না। তবে একটা জিনিস বুঝেছি সিনেমা আর টেলিভিশনে আকাশ পাতাল ফারাক আছে। আপনার সিনেমা বোঝার দরকার নেই। বিদেশি চ্যানেল সার্ফ করার সময় নাম বা অভিনেতা-অভিনেত্রী না দেখেই আপনি বুঝতে পারবেন কোনটা সিনেমা আর কোনটা নাটক। কিন্তু বাংলাদেশে এখন সিনেমা আর নাটকের পার্থক্য ঘুচে যাচ্ছে। সারা জীবন দেখে এসেছি, সিনেমা আগে হলে মুক্তি পায়। তারপর পুরনো হলে সেগুলো টিভিতে দেখানো হয়। আর ইদানীং ঘটছে উল্টো ঘটনা। এখন সিনেমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার হয় টিভি পর্দায়। তারপর দুয়েকটা হলে দুয়েক সপ্তাহ চলে বা না চলে। এগুলোকে বলা হয় পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা। দৈর্ঘ্যে হয়ত পূর্ণ, কিন্তু আসলে সিনেমাই নয়। টেলিভিশনের নাটককে একটু লম্বা করে তার গালভরা নাম দেওয়া হয় টেলিফিল্ম। আর সেই টেলিফিল্মে দুটি গান জুড়ে দিলেই হয়ে যায় পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা! এই তথাকথিত ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা’র দৌরাত্ম্যে মূল ধারার বাংলা সিনেমার প্রাণ যায় যায়। এখন দেশে একের পর এক হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ফলে সিনেমা দেখানোর জায়গা কমে আসছে। কঠিন হয়ে যাচ্ছে সিনেমা ব্যবসা। কালেভদ্রে একটা দুটা সিনেমা হিট বা সুপারহিট করে। বাকিগুলো ফ্লপ, আর ফ্লপ মানেই লস। একটা সিনেমা বানাতে দেড় দুই কোটি টাকা লাগে। তাই লস মানেই, অনেক টাকার ধাক্কা। আর বাংলাদেশে এখন বেশিরভাগ সিনেমাই ফ্লপ। তাহলে বছরের পর বছর কোনো ব্যবসায়ী সিনেমায় লগ্নি করে লস দেন? কেন দেন? জাস্ট সিনেমার প্রতি ভালোবাসা থেকে? শুনি অনেক নব্য ব্যবসায়ী তাদের কালো টাকা সাদা করতে সিনেমায় টাকা খাটান। আবার অনেকে নাকি নায়িকার সঙ্গে সখ্য গড়তে সিনেমা প্রযোজক বনে যান। একজন নায়িকাকে কাছে পেতে কোটি টাকার বিনিয়োগ একটু বেশি হয়ে গেল না? এতো গেল মূলধারার সিনেমার হিসাব-নিকাশ। কিন্তু তথাকথিত ‘পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা’র হিসাব অন্যরকম। তারা অনেক কম টাকায় সিনেমা বানিয়ে ফেলেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টিভির নায়ক-নায়িকাদের নেওয়া হয়। প্রডাকশনও হয় টিভি মানের, সিনেমা মানের নয়। চলচ্চিত্রকে হল থেকে টিভিতে বন্দি করার কৃতিত্ব (!) তাদের। কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জন্য এদের কান্নাটা বেশি। সিনেমা গেল গেল বলে শোরগোল তুলে এরা সিনেমা বাঁচানোর দায়িত্ব তুলে নেন কাঁধে। বাঁচানোর নয়, আসলে ধ্বংসের। এই ধারার সিনেমার মূল ব্যবসাটা নাকি অন্য। অমুক নিবেদিত, তমুক প্রযোজিত ইত্যাদি ইত্যাদি নামে নানা কোম্পানির কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। গানের অ্যালবাম বিক্রি করে টাকা নেওয়া হয়। টিভিতে ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করার সময়ও বিজ্ঞাপন নেওয়া হয়। তাই এইসব সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই প্রযোজকদের টাকা উঠে আসে। এরপর ভদ্রতা করে হলে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া হয় বটে, তবে দর্শক দেখল কি দেখল না তাতে কিছু যায় আসে না। বক্স অফিস জানেই না, কিন্তু সিনেমা সুপারহিট। এই সিনেমাপ্রেমীরা মূলধারার বাংলা সিনেমার ব্যবসা কঠিন করে দিচ্ছে। আবার কিছু বাংলা সিনেমা আছে বাংলাদেশে মুক্তিই পায় না বা পেলেও অনেক পরে। শুরু করে নানা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব থেকে। সেখান থেকে নানা পুরস্কার-টুরস্কার নিয়ে আমাদের গর্বিত করে যখন দেশে ফিরে, তখন দেখি আরে এতো সিনেমাই নয়, বড় দৈর্ঘ্যরে টেলিফিল্ম। বাংলাদেশের সিনেমার মান অনেক খারাপ, কিন্তু খারাপ হলেও তো খারাপ সিনেমা। কিন্তু যেসব সিনেমা বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে সেগুলো তো আসলে সিনেমাই নয়।
ব্যবসা কঠিন করে দেওয়ার প্রসঙ্গ যখন এলো, তখন আবার একটু প্রকাশনা শিল্পে ফিরে যাই। সংবাদপত্রে যেমন প্রথম আলো, প্রকাশনা শিল্পে তেমনি প্রথমা উৎকর্ষের একটি অনতিক্রম্য মান নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রথমার বই মানেই চোখ বন্ধ করে কেনা যায়। বিষয়, ছাপা, বাঁধাই, প্রুফ, প্রচ্ছদ- সব মিলিয়ে প্রথমার বই হাতে নিলেই মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু প্রথমা অন্য প্রকাশকদের ব্যবসা সত্যি কঠিন করে দিয়েছে। কারণ প্রথমার আছেন প্রথম আলো, অন্যদের তো তা নেই। প্রথমার বইয়ের নির্বাচিত অংশ প্রথমে প্রথম আলোতে ছাপা হয়। সাহিত্য পাতায় রিভিউ ছাপা হয়। প্রকাশনা উৎসবের বিশাল রিপোর্ট ছাপা হয়। এভাবে পাঠকদের মধ্যে তুমুল কৌতূহল তৈরি করা হয়। তারপর বই প্রকাশ হলেই হট কেক। সবচেয়ে বড় কথা হলো, প্রথমার বইয়ের যে বিজ্ঞাপন প্রথম আলোতে ছাপা হয়, অন্য কোনো লেখক বা প্রকাশকের পক্ষে তার দশ ভাগের একভাগও দেওয়া সম্ভব নয়। প্রথমার বইয়ের বিজ্ঞাপনকে টাকার অঙ্কে কনভার্ট করলে তা কারো পক্ষেই বহন করা সম্ভব নয়। হুমায়ুন আহমেদ বা জাফর ইকবালের বইয়েরও অত টাকার বিজ্ঞাপন করা সম্ভব নয়। প্রথম আলোর সহায়তায় প্রথমা যেভাবে তাদের কোনো কোনো বইয়ের পরিকল্পিত ও কৌশলী প্রচারণা চালায়; তা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব নয়। তাই প্রথমা প্রকাশিত কোনো বই যদি ৫ হাজার বিক্রি হয়, সেই একই বই অন্য কোনো প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হলে পাঁচশও বিকোবে না। বই তো আসলে মান দেখে বিক্রি হয় না, বিক্রি হয় হাঙ্গামা দেখে। এ কে খন্দকারের বিতর্কিত বই যত লোক কিনেছেন, তত লোক কি পড়েছেন? তাই বলাই যায়, সিনেমা শিল্পের মতো, প্রকাশনার শিল্পের মাঠও সমতল নয়।
ছেলেবেলায়ও আমার মাথায় নানা উদ্ভট প্রশ্ন আসত। মানুষ কেন পয়সা দিয়ে কিনে তিতা করলা বা পাট শাক বা চিরতার পানি খায়? মানুষ কেন কবিতা লেখে? মানুষ কেন এভারেস্টে ওঠে? মানুষ কেন ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দেয়? আমার কৌতূহলের শেষ নেই। ধর্ম নিয়েও আমার মাথায় গাদা গাদা প্রশ্ন। সব ধর্ম নিয়েই। অনেক কিছুই বিশ্বাস করতে মন চায় না। সাহস কম বলে ধর্ম নিয়ে প্রশ্নগুলো করিনি, করি না। করলে নিশ্চিত আমাকে মুরতাদ ঘোষণা করা হবে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নও বেড়েছে। উত্তর জানা নেই।
এতক্ষণ যারা এই লেখাটি পড়ছেন, তারা নিশ্চয়ই হাসছেন বা আমাকে গালাগালি করছেন, এমন বোকা একটা লোক এতদিন ধরে সাংবাদিকতা করছে কিভাবে? দোয়া করবেন, যেন আজীবন এমন বোকাই থাকতে পারি। চেষ্টা করলে যে এসব প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে না তা নয়। তবে এসব প্রশ্নের উত্তর জেনে বেঁচে থাকার আনন্দটা মাটি করতে চাই না। জীবন অনেক আনন্দময়, তাই জীবনটা আনন্দেই কাটাতে চাই।