রকিব উচ্চস্বরে চিৎকার করতে করতে অধ্যক্ষের রুমে ঢুকে পড়েন। কয়েকজন ছাত্রছাত্রী তাঁর চিৎকার শুনে বুঝতে পারে না, কেন উনি এমনটি করছেন। শহরের প্রাণকেন্দ্রে কলেজটি স্থাপিত হলেও ছাত্রছাত্রী তেমন বেশি নয়। কুৎসিত প্রশাসনিক ও শিক্ষক রাজনীতির কারণে কলেজের পড়াশোনার মান তেমন ভালো নয়। পড়াশোনার চেয়ে বরং নোংরা রাজনীতি চলে।
অধ্যক্ষ আলীম জিজ্ঞাসুনেত্রে তাকান। বলেন, বসুন। কি হয়েছে?
রকিব তার চিরাচরিত পদ্ধতিতে বক্তৃতা করা শুরু করে। এ বক্তব্য যেন একজন শিক্ষকের নয়, তৃণমূল পর্যায়ের কোনো রাজনৈতিক সুযোগ সন্ধানী কর্মীর বক্তব্য। আলীমের মাথা ধরে যায়। তারপরও ভদ্রতা বজায় রাখার জন্য বলেন, আপনি শান্ত হয়ে বসুন। তারপর সব কথা শুনব। সম্ভব হলে সমাধানের চেষ্টা করব।
মোটেই আলীমের ভদ্রতাকে রকিব গণনায় আনে না। বরং বলে, আপনি পদত্যাগ করুন। আপনার পদত্যাগই হচ্ছে সমাধানের একমাত্র পথ।
কেন, কী সমস্যা হয়েছে?
আপনাকে দেখলে আমার খারাপ লাগে। ঘৃণা লাগে।
অদ্ভুত কথা।
এ চেয়ারে বসার যোগ্যতা আপনার নেই। আপনি একজন অযোগ্য, অকর্মন্য লোক।
কিভাবে বুঝলেন? আমি এমফিল, পিএইচডি করেছি।
আমি জানি। ওইসব পড়াশোনার গুষ্টি কিলাই।
আপনি কি আমার বায়োডাটা দেখেছেন? ভদ্র ভাষায় একথা বলুন।
ওইসব দেখার দরকার নেই। এ কলেজটি সমাজের যে সব হোমরা-চোমরা প্রতিষ্ঠা করেছিরেন, তাদের সাথে আপনার মতাদর্শগত মিল নেই। আপনি বর্তমান সরকারকে সমর্থন করেন। আপনাকে কিছুতেই ছাড় দেওয়া যায় না। কবে বিদায় হবেন?
আমি কলেজের অধ্যক্ষ। নিরপেক্ষভাবে প্রশাসন চালাচ্ছি; ছাত্রছাত্রীদের অভিভাবকের ¯েœহে ভালো পাঠদানের ব্যবস্থা করছি। আপনারা যারা বিভিন্ন ধরনের পলিটিক্স করেন, তাদের ফলিটিক্স ছেড়ে দিতে বলেছি। বরং ছাত্রছাত্রীদের কিভাবে হিত করা যায় সে অনুরোধ করেছি।
দেখুন, আপনি বর্তমান সরকারের সমর্থক। এ ধরনের কাউকে অধ্যক্ষের চেয়ারে দেখতে চাই না। গভর্নিং বডিও চায় না।
পলিটিক্স করা বাদ দিন। আমি মুক্তিযুদ্ধ চেতনায় বিশ্বাস করি। আপনার কাজ শিক্ষকতা করা। গভর্নিং বডির সাথে আপনার যোগাযোগ নেই। দেখুন, আমাদের দেশনেত্রী সবকিছু তছনছ করে দেবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে পরশু দিন টকশোতে যে বক্তব্য রেখেছেন, তা প্রত্যাহার করতে হবে। ভবিষ্যতে যদি আমাদের দেশনেত্রীর বিরোধিতা করেন তবে দৈহিকভাবে আঘাত করব।
রকিব সাহেব, আপনার কাজ শিক্ষকতা করা।
আপনার তো টক শো নিয়ে কথা বলার কোনো দরকার নেই।
বরং আপনি তো ক্লাস ঠিকমতো নেন না।
আপনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চাইবেন, আর আমি নিষেধ করতে পারব না? আমাদের দেশনেত্রী সবকিছু ছারখার করে দেবেন।
আপনি শিক্ষক হিসেবে নিজের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করুন। আপনার বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে, আপনি জঙ্গিবাদীদের সাথে জড়িত। আপনাকে কাজ দিয়েছিলাম নববর্ষ পালন করার জন্য। আমি কিন্তু গভর্নিং বডিকে জানাব।
আপনি কিছু করতে পারবেন না। আমাদের হাত অনেকদূর লম্বা। গভর্নিং বডির মেম্বাররা আমার পক্ষে থাকবেন। আর বাংলা নববর্ষ হচ্ছে অনৈসলামিক কাজ।
তাই নাকি?
হ্যাঁ! উল্টো বেশি কিছু করলে আপনাকে মুরতাদ ঘোষণা করা হবে। কাফনের কাপড় বাসায় পাঠিয়ে দেব।
আচ্ছা, শিক্ষকতার সাথে জঙ্গিবাদী কর্মকা- পরিচালনার কি যোগসূত্র থাকতে পারে? কেন এ ধরনের ভ্রান্তপথ বেছে নিলেন?
সাবধান, আরেকটা কথা বলবেন না, তবে দৈহিকভাবে শাস্তি দেব। আপনাকে বারবার ঠিক হতে বলছি, ঠিক হচ্ছেন না। কবে বিদায় হবেন?
দুঃখিত, আপনি আসুন।
যাচ্ছি, যাওয়ার আগে সাবধান করে যাচ্ছি, আমাদের দেশনেত্রী এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কোনো বক্তব্য দিবেন না। এমনকি লন্ডন থেকে আমাদের নেতা বক্তব্য দিলে তারও বিরুদ্ধাচরণ করে কিছু বললে শাস্তি অবধারিত।
যারা এদেশের মানুষের সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করেছেন, তাদের বিচার বাংলার মাটিতে হচ্ছে। এটি এদেশের প্রতিটি সাধারণ নাগরিকের দাবি। আকাশ থেকে কোনো নেতা গজায় না।
ঘাড় ধরে কলেজ থেকে বের করে দেব। কমপ্লেইন করলে কোনো ফায়দা হবে না- তলে তলে আমরা অনেক শক্তিশালী। শিক্ষকরা ও কর্মকর্তারা ঐক্যবদ্ধ হতে বলেছি।
এমন সময় রোকেয়া প্রবেশ করে। বলে, স্যার আপনারা ঝগড়া করছেন? এটা ঠিক নয়। আপনি অধ্যক্ষ হয়ে নিজের মর্যাদা রাখতে পারছেন না।
আলীম কোনো কথা না বলে তাকিয়ে থাকে। রোকেয়ার কূটচাল অনেকটা ঘষেটি বেগমের মতো।
রকিব বলে, উনাকে পা-চাটাদের হাত থেকে ন্যায়ের পথে আনতে চেষ্টা করছি। এ দেশে যারাই আমাদের বিরোধিতা করবে, তাদের আমরা ১৪ ডিসেম্বরের মতো পরপারে পাঠিয়ে দেব। তলে তলে লিস্ট করছি। দরকার হলে ক্ষমতাসীনদের সাথে মিশে গিয়ে আমরা আমাদের কার্যোদ্ধার করব। তারপরও আমরা আমাদের মিশন চালিয়ে যাব। সাথে আছেন?
রোকেয়া বলে রকিব, স্যার ঠিকই বলেছেন। বর্তমান সরকারকে যারা সাপোর্ট করেছে তারা অন্যায় করছে। তাদের বিরুদ্ধে আসুন আমরা ঐক্যবদ্ধ হই।
আলীম এবার শক্তভাবে বলে, আপনার কাজ হচ্ছে প্রশাসন দেখা। আপনি কেন এ ধরনের আলাপ করছেন?
কয়েকদিন আগে ছাত্রছাত্রীরা গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের কাছে রোকেয়ার স্মাগলিংসহ অন্যান্য চুরির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। রোকেয়া এক পলকে রকিবের সাথে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করে। আলীম জানে তারা দুজন যেন শয়তানীতে জুড়ি মেলা ভার।
আলীম বলে, গতকাল যে বললাম, ওভারটাইমের বিল ইচ্ছে করে বেশি দেখিয়েছেন, সেটা কি ঠিক করেছেন?
রোকেয়া বলে, স্যার এ কলেজে ৯৯% শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী হচ্ছে ভিন্ন মতাদর্শের। আমাদের গভর্নিং বডির একজন মেম্বার যদিও বর্তমান সরকারকে সাপোর্ট করছেন, সেটি সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক কারণে।
তবে তলে তবে তিনিও কিন্তু আমাদের ঘরানার।
আমি যা জিজ্ঞেস করেছি, তার জবাব দিন?
আমরা জবাব দিতে বাধ্য নই। বরং আপনাকে উচিত শিক্ষা দেব।
আপনি আমাকে সেরা বেয়াদব ডেকেছেন। সেরা বেয়াদবের কি দেখেছেন?
দয়া করে আপনারা আসুন।
এবার রকিব বলে, আপনাকে ঠিক হতে বলেছি, আপনি ঠিক হোন, নইলে কবে যে বেঘোরে প্রাণ হারাবেন বলা যায় না।
প্রশান্তির হাসি জেগে উঠে রোকেয়ার মনে। তারা তলে তলে সংগঠিত হচ্ছে। মুখে বলে রকিব স্যার, আপনে ঠিকই বলেছেন। স্যার, যদি পদত্যাগ না করেন, তবে আমরা চাকরি করব না। এ কলেজ ছেড়ে চলে যাব। এ ধরনের দালালদের এ কলেজে স্থান নেই।
রকিব বলে, এমন প্যাঁচে ফেলব, সৎ হলেও কি হবে, কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। দেখি না সরকার তার জন্য কি করে?
আলিম বলে, যতসব আজেবাজে কথা বলছেন। রকিব সাহেব এখনকার মতো আসুন। পরে আপনার সাথে কথা বলব।
আমি আসছি, আপনাকে সোজা হতে বলছি। হয় আমাদের মতাদর্শে আসুন, নয়...।
আলীম জানেন কথায় কথা বাড়ে। হজম করতে বেশ কষ্ট হয়।
তারপরও বলে, আমি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি।
রকিব বলে, আপনার সাথে কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। অ্যাকশন দেখবেন।
রকিব চলে যায়। যাওয়ার সময়ে ইচ্ছে করে টেবিলে লাথি মারে।
রোকেয়ার দিকে তাকিয়ে আলিম বলেন, একটি কমিটি গঠন করেছি। আপনি টাইপিস্টটাকে পাঠান।
বোর্ডের পারমিশন ছাড়া কিছু হবে না।
ঠিক আছে আমি বোর্ডের সাথে কথা বলব।
দেখেন অ্যাপয়েনমেন্টই পান কি না। তারা আপনার উপর ক্ষেপে আছেন। কলেজের জায়গার জন্য কিছুই করতে পারলেন না। তাচ্ছিল্যের সুরে কথা বলে রোকেয়া রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
আলিম কয়েকবার গভর্নিং বডির চেয়ারম্যানের সাথে যোগাযোগ করতে চেয়েও ব্যর্থ হন। তার মন খারাপ হয়ে যায়। তিনি বুঝতে পারেন যে, এদের সাথে একলা ফাইট করা সম্ভব নয়। আজীবন বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাস করেছেন। মানুষকে সৎপথে থেকে যেটুকু সম্ভব সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন।
রোকেয়া রুমে এসে তার অধীনস্থদের সাথে অধ্যক্ষকে নিয়ে হাসাহাসি করে। মোস্তাক বলে, ম্যাডাম তাহরিন স্যারকে জানিয়ে রাখুন।
মনে মনে মোস্তাকের বুদ্ধির তারিফ করে। তাহরিন স্যার আসলে বেশ করিৎকর্মা। একটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে কয়েক কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন। আবার মৃত ব্যক্তির শেয়ার জাল করে আত্মসাৎ করেছেন। তবে উনি ম্যানেজ করায় বিশ্বাসী। দেব আর নেব এ হচ্ছে তার অসততার মূল মন্ত্র।
তাহরিনকে ফোন করতেই মধুমাখা কণ্ঠে বলেন, কতদিন ধরে তোমাকে দেখি না রোকেয়া?
আমার বুঝি সংসার নেই। কয়েকদিন আগে মালয়েশিয়া ঘুরে এলাম। তবু মাঝে মধ্যে আমাকে একটু আধটু সুযোগ দিলে পার।
আপনাকে কি কম দিচ্ছি? সুযোগ পেলেই ব্যবস্থা করছি।
আজ চলে এসো।
কোথায়
সেই পুরনো ফ্ল্যাটে।
ঠিক আছে।
বাসায় না গিয়ে বোনের বাসায় যায়। ব্যাঙের মতো দেখতে শরীরে উৎকট সাজসজ্জা করে। ভাবে, তাহরিন তাকে এখনো মনে রেখেছে, বড় পেয়ার করে। স্বামী সংসার ছেড়ে ইচ্ছে করলেই আগের মতো আসতে পারে না। তাহরিন অনেকক্ষণ ধরে রোকেয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। রোকেয়ার মধ্যে কি যে জাদু আছে তা কেবল উনিই বুঝতে পারেন। তাকে দেখলে জিভে লক লক করে লালা বেরিয়ে আসে।
রোকেয়া যখন আদর করে পান পাত্র উনাকে দিচ্ছিল, তখন উনি বলেন, তুমি চিন্তা করো না, বেয়াদবটাকে আমি তাড়াব, সে আমাকে একটুও সম্মান করে না?
রোকেয়ার তখন বড় সুখ লাগে। আনন্দে অষ্টাদশীর মতো আকাশে ভেসে বেড়াতে ইচ্ছে করে। যেন একটু হাত বাড়ালেই বিদীর্ণ সময়গুচ্ছে চাঁদ ধরতে পারত।
অভিসার শেষে রাতে বাসায় ফিরে আনন্দে রকিবকে ফোন করে। বলে, কাজ হাসিল হয়েছে। শিগগিরই অ্যাকশান দেখবেন।
এই অধ্যক্ষের জন্য হুজি প্রশিক্ষণ দিতে পারছিনে।
সব হবে স্যার! একটু ধৈর্য ধরুন।
উনাকে এমন প্যাঁচে ফেলব, নির্দোষ হলেও লেজগুটিয়ে পালাতে হবে। তবে ছাত্রছাত্রীরা উনাকে পছন্দ করে এটাই সমস্যা।
একজন মানুষের পক্ষে একা ফাইট করা সম্ভব নয়। কলেজে শিক্ষক ও কর্মকর্তা যারা আছেন তারা তাকে তেমন সাপোর্ট করে না বরং নিরপেক্ষ থাকবে।
তাহরিন পরের দিন সকালেই মর্নিং ওয়াকে বের হোন। আগের দিন দেওয়া প্রতিশ্রুতির কথা তার মনে পড়ে যায়। স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সাথে মোবাইলে কথা বলেন।
রকিব তার বিশ্বস্ত ছাত্রছাত্রীদের শলা-পরামর্শে বসেন। কিন্তু তারা বলে, স্যার সৎ মানুষ। উনার বিরুদ্ধে শুধু মতাদর্শের কারণে যাওয়া ঠিক হবে না। এতে হিতে বিপরীত হবে।
হঠাৎ তার মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে। প্রিন্সিপাল সাহেব দুপুরে খাওয়ার পর ঘণ্টা খানেক ন্যাপিং নেন। এ সময়ে তার দরজা খোলা থাকে। ইদ্রিসকে ফোন করে বলে, ওই ব্যাটা অধ্যক্ষ তো আমাদের বিরুদ্ধে বড় বেশি কথা বলছে। সরকারকে সাপোর্ট করে সমানে বক্তব্য রাখছে। আমাদের উচিত উনাকে সরিয়ে দেওয়া।
ইদ্রিস বলে, স্যার, আপনি যা বলবেন তাই হবে।
মনে মনে ইদ্রিস খুশি হয়। আলীমের সততার জন্য তার আলাদা উপার্জন বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া আগের মতো অধীনস্থ মহিলা কর্মকর্তাদের সাথে আকাম-কুকাম করা যাচ্ছে না। আগে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে ভাগ দিতে হতো। এখন সেটা বন্ধ থাকায় নিজের পাওনা-গ-া বুঝে নিতে পারছে না।
রকিবের কথা মতো ইদ্রিস ফটো তোলে। ফটো তোলার সময় ইচ্ছে করে, রকিবকে অধ্যক্ষের পাশে একটি চেয়ারে রেখে ছবি তোলে। এতে আলীমকে ঘুমন্ত দেখায়। আর রকিবকে মনে হয় জলদস্যুর মতো। কালো কুচকুচে সোমালিয়ান। একদিন চেয়ারে হাঁটু গেড়ে টেবিলের উপর রাখা কম্পিউটার ঠিক করছিল। সেই ছবিটিও পিয়নের সাহায্যে তুলে।
রকিব আর ইদ্রিস একসাথে গোপন বৈঠক করে রোকেয়ার সাথে। রোকেয়া সেই দুটি ছবি কয়েকজন শিক্ষকের স্বাক্ষর নিয়ে পাঠায় গভর্নিং বডির কাছে। গভর্নিং বডির চেয়ারম্যান ছবিগুলো দেখে বুঝতে পারেন যে, ছবিগুলো কোন কিছুই প্রমাণ করতে পারবে না।
তারপরও অপদস্থ করার জন্য বৈঠক ডাকেন। অত্যন্ত আবেগঘন বক্তৃতা দেন। এক পর্যায়ে আলীম যখন বলেন, ‘আমি সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত অফিস করি, মাঝখানে দু ঘণ্টা বিশ্রাম নেই। এটা কি অন্যায়?
একজন সদস্য বলেন, না তা নয়। আপনার বিরুদ্ধে দরখাস্ত এসেছে। তাহরিন বলেন, আমরা এ ধরনের অধ্যক্ষকে দেখতে চাইনে।
আলীম বলেন, আমার অপরাধ কি?
তাহরিন কড়া কন্ঠে বলে, আপনি অফিসে ঘুমান।
আলীম একটু রেগে বলেন, একজন শিক্ষককে এভাবে মিথ্য্ অপবাদ দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই। এটি রীতিমতো অন্যায়।
তাহরিন বলে, যারা আপনার বিরুদ্ধে লিখেছে তারাও শিক্ষক ও কর্মকর্তা। আর ন্যায়-অন্যায় ছাত্রছাত্রীদের শিখায়েন, আমাকে নয়।
আলীম বলেন, আমি যদি কোর্টে যাই, এগুলো টিকবে না। এমন সময় একজন সদস্য বলেন, আমার কাছে খবর আছে আপনি থাকলে কর্মকর্তারা ধর্মঘটে যাবে। এটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম নষ্ট করবে।
কোন অপরাধ ছাড়াই আপনারা এমন অভিযোগ করছেন? রোকেয়া হচ্ছে সেরা বেয়াদব ও মিথ্যাবাদী এবং ভালো একজন অভিনেত্রী।
এ সময়ে অন্য আরেকজন বলেন, কেন আপনি টক শোতে বর্তমান সরকারের পক্ষে আর যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেন?
আলীম নিজেকে ডিফেন্ড করতে চেষ্টা করে, আমি যা বলি সেটা আমার বিশ্বাস থেকে বলি। নিজের কোনো মুনাফার জন্য বলি না।
বাইরে যতই আমাদের মধ্যে বিভেদ দেখুন, একদম চিহ্নিত না হলে আমরা সমঝোতা করে চলি। কেননা একে অন্যকে চটিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করা যায় না। আমরা কিন্তুত ভালোই আছি। যেকোনো সময়ে আপনি ফায়ারে মরে যাবেন।
আলীমের মন খারাপ হয়ে যায়।
তাহরিন বলছে, ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বেটাকে বের করে দেওয়া দরকার।
আলীম তার কক্ষে ফেরার আগেই রোকেয়াকে তাহরিন শুভ সংবাদটি জানায়। রোকেয়া বেশ দক্ষতার সাথে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের মাঝে খবর চাউর করে দেয়।
আলীম এসে নিষ্পলক কিছুক্ষণ তার কক্ষে বসে থাকে। বুঝতে পারে না, এখন কিভাবে অন্যায়ের প্রতিবাদ করবে? মানুষ কি আসলেই বয়সের সাথে ঠা-া হয়ে যায়?
পরের দিন ডিজি অফিস, আর শিক্ষাবোর্ডে কলেজের সমস্যাগুলো জানিয়ে চিঠি দেয়। সে সাক্ষাৎও করে। কিন্তু কোনো ধরনের আশ্বাস পায় না। বরং ঘুষ চায়। যে নিজে ঘুষ খায় না, সে দেবে কোথা থেকে?
তাহরিন আদাজল খেয়ে উঠেপড়ে লেগে থাকে। তাকে রকিব খেপিয়ে তুলে। রকিবের মিষ্টি মিষ্টি কথা তার বেশ লাগে। অথচ আলীমের মধ্যে হামভরা ভাব। নিজেকে প-িত মনে করে।
রকিবের শিক্ষক হিসেবে চাকরির যোগ্যতা না থাকুক তবু তেল দেওয়ার ক্ষেত্রে জুড়ি নেই। হোক না সে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর, কিন্তু এভাবে কোনো শিক্ষক কখনো পদলেহন করতে পারে এটি বিস্ময়ের ব্যাপার ছিল।
রোকেয়া নতুন কূটচাল চালে। এমনভাবে ব্যবহার করতে থাকে যেন সে ইচ্ছে করলেই আলীমের সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। আলীমের ঘৃণা লাগে। মনে মনে স্বৈরিণী বলে রোকেয়াকে মনে হয়। বড্ড ইচ্ছে জাগে মনে স্বৈরিনী শব্দের পুং লিঙ্গ কি হয়? আসলে কোনো অংশেই রকিব আর ইদ্রিস ব্যতিক্রম নয়। তারা ধর্মের নামে রাজনীতি করে। ধর্ম ব্যবসায়ীরা এখন পরগাছা হয়ে যাচ্ছে।
আলীম মনে মনে প্রধানমন্ত্রীর সাহসের তারিফ করে। যেভাবে উনি যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তা বিরল।
চারদিক থেকে যেন একরাশ হতাশা আলীমকে ঘিরে ধরে। ভাবে সত্য-ন্যায়ের পথে থাকা কি অন্যায়? ছাত্রছাত্রীদের নিজ সন্তান ভাবা কি অন্যায়?
মনে সান্ত¦না জাগে, এত কিছুর পরও ছাত্রছাত্রীরা বিক্ষোভ করছে না।
এমন সময় বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো জীববিজ্ঞান শিক্ষক শিয়াব অন্যত্র চাকরি পেয়ে চলে যাওয়ার জন্য চিঠি দেয়। এটা নিয়ে রকিব শিক্ষকদের মধ্যে সেন্টিমেন্ট গড়ে তুলতে চায়। বেশ সফলভাবে অধ্যক্ষের রুমে গিয়ে টেবিল চেয়ারে লাথি মারে।
আলীমকে রোকেয়া পরামর্শ দেয় শিক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে।
তাদের কা-কীর্তি অপছন্দ হলেও তার মনে জাগে বনফুলের সেই অমৃত কবিতার কথা ‘কুকুরকে কি পাল্টা কামড় দেওয়া যায়?’
সমাজের মধ্যে মানুষ গড়ার কারিগররা এখন নানামুখী খেলায় মত্ত। কোনো কোনো শিক্ষক পড়াশোনা বাদ দিয়ে নোংরামি-ইতরামিতে ব্যতিব্যস্ত। ছাত্রছাত্রীদের কেউ কেউ বিপথগামী। ভুল পথে তাঁদের পরিচালনা করে।
আলীমের কষ্ট লাগে। নিজের জন্য নয়। শিক্ষকদের নোংরামি দেখে। ইতরামি করার জন্য হেডক্লার্কের সাথে মিশে যেভাবে কসরত করে তা দুঃখজনক। তাহরিনের জন্য অবশ্য খারাপ লাগে না। সে তো সব সময়েই দুধের সর খেয়ে অভ্যস্ত। অন্যায়ভাবে অন্যের সম্পদ নিজের করে নিচ্ছে।
যখন বিকেলের ম্লান আলো বাইরে ফুটে রয়েছে, কাঁপা কাঁপা হাতে আলীম পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে। কলেজ থেকে বেরিয়ে আসার সময়ে নিজের অশ্রু গোপন করে ছাত্রছাত্রীদের সালামের প্রত্যুত্তর দেয়।