মাসুদ কামাল বেসরকারি সেটেলাইট চ্যানেল বাংলাভিশনের সিনিয়র নিউজ এডিটর। দৈনিক নব অভিযান দিয়ে তার সাংবাদিকতা শুরু। এরপর সাপ্তাহিক সুগন্ধা, দৈনিক সকালের খবর, দৈনিক আল আমীন, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক আমার দেশ, দৈনিক যায়যায়দিনে কাজ করেছেন। তার সাংবাদিকতা জীবনের এটি দ্বিতীয় অধ্যায়। এর আগের অধ্যায়ে ছিল দৈনিক নব অভিযান এবং তার প্রাসঙ্গিক গল্প।
সুগন্ধায় আমার চাকরি জীবন ঠিক কবে শুরু হলো এতদিন পর সেটার আর দিনক্ষণসহ মনে নেই। তবে যতদূর মনে পড়ে ১৯৯০ সালের মাঝামাঝি কোনো একটা সময় হবে। খুব সম্ভবত আগস্ট কিংবা সেপ্টেম্বরের দিকে।
আসলে এখানে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত এ ধরনের সাপ্তাহিক পত্রিকার সঙ্গে আমার খুব ঘনিষ্ঠ কোনো পরিচয় ছিল না। সাপ্তাহিক বলতে শুরুতে আমি বুঝতাম বিচিত্রা এবং রোববার। বিচিত্রা বের হতো সরকার মালিকানাধীন দৈনিক বাংলা ভবন থেকে। সে সময় দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ছিল ইত্তেফাক। আর সরকারি মালিকানায় থাকার কারণে দৈনিক বাংলার গ্রহণযোগ্যতা পাঠক মহলে তেমন একটা ছিল বলে মনে হয় না। কিন্তু আমাদের বাসায় দৈনিক বাংলা রাখা হতো, আব্বা অবশ্য ইত্তেফাক নয়, চাইতেন সংবাদ রাখতে, কিন্তু আমার চাপে পারতেন না। আমি যে দৈনিক বাংলাকে খুব পছন্দ করতাম তা নয়। বিচিত্রাকে ভালোবাসতাম, তাই একই ভবনের পত্রিকা দৈনিক বাংলা রাখতাম। তাছাড়া ওই সময় খেলার খবরটা দৈনিক বাংলাতেই ভালো থাকত। সেটা সম্ভবত ১৯৭৮ সালের কথা। আব্বা তখন চাকরি করতেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে। ওখানেই কলেজে পড়তাম আমি। তখন জিয়াউর রহমান ক্ষমতায়। সরকারি পত্রিকা হওয়া সত্ত্বেও বিচিত্রার সেই সময়কার ভূমিকা আরও অনেকের মতো আমাকেও মুগ্ধ করত। ওই একই সময়ে ইত্তেফাক ভবন থেকে রোববার নামের সাপ্তাহিকটি প্রকাশিত হয়। শুরুর দিকে রোববারের কয়েকটি সংখ্যা খুব আগ্রহ নিয়ে কিনলেও পরে আর কেনা হয়নি, ভালো লাগেনি।
১৯৮০ সালে আমি ঢাকায় চলে আসি। শুরুতে ভর্তি হই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগে। থাকতাম ফজলুল হক হলে। এখানে থাকতে আর একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা আমাকে আকর্ষণ করে, সচিত্র সন্ধানী। সচিত্র সন্ধানী ছিল কিছুটা সাহিত্যধর্মী পত্রিকা। বিচিত্রার পাশাপাশি এই সাপ্তাহিকটি আমি রাখতাম এর একটি কলামের জন্য। কলামটির নাম ‘যায়যায়দিন’। টেলিফোন সংলাপভিত্তিক এই কলামটি অসাধারণ ছিল। সাধারণ গল্পচ্ছলে সেখানে রাজনীতির অনেক জটিল বিষয় নিয়ে আলোচনা হতো। মাঝে মধ্যে কিছু জোকস থাকত, জোকসগুলো হতো রাজনৈতিক কোনো ঘটনার সঙ্গে মিলিয়ে এবং কিছুটা প্রাপ্তবয়স্ক। আমার বন্ধুদের অনেকে এই কলামটি পড়ার জন্য অনেক সময় আমার রুমে আসত।
এর কিছুদিন পর ‘যায়যায়দিন’ নামেই একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। সন্ধানীর ওই যায়যায়দিন কলামটি যিনি লিখতেন, সেই শফিক রেহমানই সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের সম্পাদক। সেটা এরশাদের আমল, রাষ্ট্র ক্ষমতায় তখন সামরিক শাসক এরশাদ। যায়যায়দিনের প্রথম সংখ্যাটি এতদিন পরেও আমার চোখে ভাসে। কভারে একটা উটের ছবি, অনেকটা কার্টুনের মতো করে। সেই উটের আবার দুদিকে দুইটা মুখ। উটটা কোন দিকে যাবে, সেটা নিয়ে যেমন প্রশ্ন, তেমনি প্রশ্ন কিভাবে যাবে। আর এই ছবির নিচে লেখা, ‘অদ্ভুত উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। এই নামে একটা কবিতা আছে শামসুর রাহমানের।
যায়যায়দিনের সেই প্রথম সংখ্যা থেকেই অনেকটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি এর ভক্ত হয়ে পড়ি। আমাদের হলে অনেকেই এর গ্রাহক ও পাঠক হয়ে যায়। এটি সম্পূর্ণ নতুন ধরনের একটি সাপ্তাহিক। এটি আগের কোনোটির মতোই নয়, সম্পূর্ণ নতুন একটা ধারা যেন এর মাধ্যমেই শুরু হয়। ৩২ পৃষ্ঠার নিউজপ্রিন্টের ম্যাগাজিন। বিচিত্রা বা রোববারও ছাপা হতো নিউজপ্রিন্টে, কিন্তু পৃষ্ঠা সংখ্যা বেশি ছিল, ৬৪ পৃষ্ঠা। তাছাড়া বিচিত্রা, রোববারের কভারটি হতো চাররঙে, সাদা কাগজে। যায়যায়দিন এদিক দিয়েও ব্যতিক্রমী, এর কভার পেজটিও হতো নিউজপ্রিন্ট কাগজে। পেছনের কভারে কোনো বিজ্ঞাপন নেই, ওখানে বরং থাকত পাজল জাতীয় কিছু। সব মিলিয়ে তরুণ সমাজের জন্য এক নতুন স্বাদ।
এই বিচিত্রা, রোববার কিংবা যায়যায়দিন, এর কোনোটির মতোই কিন্তু ছিল না সুগন্ধা। শিক্ষা জীবনের শুরুতে আমার সাংবাদিক হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। মাঝামাঝি পর্যায়ে এসে এ আগ্রহটি জাগে। তবে তখন সংবাদপত্র বলতে যেগুলোকে বুঝতাম, যেগুলোকে দেখতাম, সেরকম কোনোটিতেই কিন্তু আমার চাকরি হয়নি। এমন এক পত্রিকায় প্রথম চাকরি করতে গেলাম, যেটিকে আগে কখনো দেখিওনি। সেখানে চাকরি শুরু করার পর, মানুষের হাতে কিংবা ফুটপাতে হকারের কাছে পত্রিকাটি আছে কি না, দেখার চেষ্টা করতাম। বলা বাহুল্য, বেশির ভাগ সময়ই হতাশ হতাম। এমনকি আমার নিজের বাসাতেও যে হকারটি পত্রিকা দিত, তাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম, জানতে চেয়েছিলাম সে নব অভিযান নামের দৈনিক পত্রিকাটি বিক্রি করে কি না। সে পত্রিকাটি চিনতেই পারেনি। তো আমি ছিলাম সেই নব অভিযানের সাংবাদিক!
সুগন্ধাও আমার জন্য অনেকটা ওই রকম ছিল। এখানে কাজ শুরু করার আগে, এই পত্রিকাটির একটি কপিও আমি কোনোদিন কিনিনি, কারও কাছ থেকে নিয়ে পুরোটা পড়িনি। একবার কেবল নব অভিযানে থাকতে, আলম রায়হানের ডেস্কে একটি কপি পড়ে থাকতে দেখেছিলাম। হাতে নিয়ে দু-একটা পৃষ্ঠা উল্টানোর পর, আর পড়ে দেখতে ইচ্ছা হয়নি। সুগন্ধা আমি প্রথম পড়ে দেখলাম, ওই অফিসে আলম রায়হানের সঙ্গে প্রথম দিন ঢোকার পর।
আলমভাই বলছিলেন পুরনো কয়েকটা সংখ্যা পড়তে, যাতে আমি এই পত্রিকাটির চরিত্র সম্পর্কে একটা ধারণা করতে পারি। পড়লাম এবং হতাশ হলাম। কিন্তু বিষয়টা নিয়ে আলমভাইকে কিছু বললাম না। আলমভাই এই ম্যাগাজিনের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই জড়িত, এতদিন তিনি ছিলেন এর চিফ রিপোর্টার। তাই পত্রিকাটি সম্পর্কে নেতিবাচক কোনো কথা তিনি সহ্য করবেন কেন? সে রকম কিছু বললে হয়ত আমার চাকরিটাই হবে না। একজন লোক হাতে ধরে আমাকে তুলে নিয়ে এসেছেন, আগে যে বেতন পেতাম তার দেড়গুণ বেতন দেবেন বলে জানিয়েছেন। যে উদ্দেশ্যে তিনি আমাকে নিয়ে এলেন, তা আমি আদৌ পারব কিনা, পারলে কতটুকু পারব, সে বিষয়ে কোনো পরীক্ষা পর্যন্ত নিলেন না। পুরো বিষয়টাই যেন আমার জন্য এক ধরনের আশীর্বাদ। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে, তার পত্রিকা সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলা আমার নিজের জন্যই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। তাই আমি মুখে কিছু বললাম না, তবে আলমভাই ঠিকই বুঝলেন।
আলমভাই ছোটাছুটি করছিলেন, কারণ আজকে লেখা জমা হওয়ার শেষ দিন, অথচ কোনো লেখকই নেই। লেখক-সাংবাদিক যারা ছিলেন, সকলকে নিয়েই চলে গেছেন খন্দকার মোজাম্মেল হক। গিয়ে নতুন একটা সাপ্তাহিক প্রকাশে নেমে পড়েছেন। এর নাম সাপ্তাহিক সূর্যোদয়। একই সম্পাদক, একই রিপোর্টার, একই ঘরানার লেখালেখি, একই ফরমেট, কেবল নামটা পরিবর্তন, সুগন্ধার জায়গায় সূর্যোদয়।
মোজাম্মেল সাহেবের এই কর্মকা-ের সঙ্গে তার প্রতি কৃতজ্ঞ সাংবাদিকদের মধ্যে একজন ছাড়া আর সকলেরই সমর্থন ছিল। আর সেই একজন আলম রায়হান। সবাই চলে যাওয়ার পর মালিক যখন দেখলেন একমাত্র আলম রায়হান যাননি, তিনি যেন হাতে স্বর্গ পেলেন। তাকে বললেন, যেকোনো উপায়েই হোক পত্রিকার প্রকাশনাটা অব্যাহত রাখতে। আর সেই ‘যেকোনো উপায়ে’ প্রকাশনা অব্যাহত রাখতেই আমার মতো আনাড়িকে হাত ধরে এখানে নিয়ে আসা। নিজেকে আনাড়ি বললাম আমি এই কারণে যে, এ ধরনের সাপ্তাহিক বা লেখালেখির সঙ্গে এর আগে আমার কখনোই কোনো পরিচয় ছিল না।
সে রাতে বাসায় ফিরলাম এই আশা নিয়ে যে, দেড়গুণ বেতন প্রাপ্তির কথা বলে শাহানাকে বোধকরি কিছুটা চমকে দিতে পারব। আমি একটু নাটকীয় ভঙ্গিতেই বর্ণনা করলাম, কিভাবে আলম রায়হান নামের লোকটি আমাকে নব অভিযান থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেল, সুগন্ধায় চাকরি দিল। তারপর বললাম, বলো তো কত বেতন ধরা হয়েছে আমার?
আমার ধারণা ছিল, শাহানা বোধকরি ১ হাজার ৫০০ টাকার কথা বলবে। দৈনিক নব অভিযানে পেতাম ১ হাজার ২০০ টাকা। সেখান থেকে এক লাফে বাড়লে আর কত আর বাড়বে? ২৫ শতাংশের বেশি তো আর নয়। তো সে যখন ১ হাজার ৫০০ টাকার কথা বলবে, আমি ১ হাজার ৮০০ বলে তাকে অবাক করে দেব, বাহবা নেব। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না।
Ñ কত ধরেছে, দুই হাজার?
আমি হতাশ হলাম। এক সঙ্গে অনেক কয়টি ভাবনা আমার মনে এলো। তাহলে কি ১ হাজার ৮০০ টাকা তেমন বেশি কিছু বেতন নয়? আমি তো ওখানে ১ হাজার ২০০ পেতাম, তাও আবার অনিয়মিত, চার মাস পরে। সে তুলনায় নিয়মিত এই ১ হাজার ৮০০ পেয়েও কি আমার খুশি হওয়া উচিত নয়? তাহলে শাহানাকে কি আমি আসলে খুবই কষ্টের মধ্যে রেখেছি? আজ এতদিন পর বুঝি, আসলেই মাস শেষে যে টাকা আমি তার হাতে তুলে দিতাম তা কেবল কষ্টকরই নয়, রীতিমতো অপমানজনক। কিন্তু বিষয়টি সে আমাকে বুঝতে দেয়নি। প্রথম বুঝলাম ওই দিন, যে দিন আমার বেতন বৃদ্ধির খবরটি তাকে দিলাম।
আমার উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। তাকে আস্তে করে জানালাম, না, ২ হাজার নয়, বেতন ধরেছে ১ হাজার ৮০০ টাকা।
এটা শুনে শাহানা কিন্তু অখুশি হলো না। বলল, যাক ভালো হয়েছে। এখন নতুন করে কিছু পরিকল্পনা করা যাবে। আর নতুন পরিকল্পনার প্রথমটিই হলো-বাসা পরিবর্তন। বাসা পাল্টালাম আমরা। মিরপুর ১২ নম্বরেই আর একটি বাসা নিলাম, এটাও এক রুমের, কিন্তু রুমটা একটু বড়। বেতন বাড়ল ৬০০ টাকা, আর বাসাভাড়া বাড়ল ২০০ টাকা।
হুট করেই দু’হাজার বলাতে আমি যে কিছুটা আশাহত হয়েছি, ওকে চমকে দেওয়ার আশাটা যে একেবারেই মাঠে মারা গেছে, এ বিষয়টিও শাহানা বুঝতে পারল। বলল, আগের তুলনায় ১ হাজার ৮০০ টাকা আসলেই অনেক ভালো। কিন্তু তোমার যে যোগ্যতা, তাতে তোমার বেতন আরও বেশি হওয়া উচিত।
ওর এই কথায় আমার খুশি হওয়া উচিত ছিল, কিন্তু আমি ভেতর থেকে তেমনটা হতে পারলাম না। আমার কাছে কেবলই মনে হতে লাগল, ও যদি মিথ্যা করেও একটু অবাক হওয়ার ভান করত, তাহলেই বুঝি আনন্দ পেতাম।
সুগন্ধার সঙ্গে ধীরে ধীরে নিজেকে মানিয়ে নিতে লাগলাম। আমার নিজের জীবনযাপনেও কিছুটা পরিবর্তন এলো। আগে নব অভিযানে প্রায়ই আমাকে নাইট ডিউটি করতে হতো। রাত ১২টার দিকে বের-ই হতাম অফিস থেকে, তারপর হেঁটে মালিবাগ মোড়, সেখান থেকে টেম্পুতে করে ফার্মগেট, ফার্মগেট থেকে বাস অথবা মিনিবাসে মিরপুর ১২ নম্বর। ১২ নম্বর বাসস্ট্যান্ডে নেমে ওই অত রাতে প্রায় এক কিলোমিটার হেঁটে একেবারে সিরামিক ফ্যাক্টরির কাছাকাছি আমার বাসা। বাসায় ফিরে দেখতাম শাহানা অপেক্ষা করছে। দু’জনে একসঙ্গে খেতে বসে নানা প্রসঙ্গে কথাবার্তা হতো। ঘুমাতে ঘুমাতে রাত ২টা-৩টা। কিন্তু সুগন্ধার সিডিউল অন্য রকম। গভীর রাতের কোনো ব্যাপারই ছিল না। এখানে সকাল ৯-১০টার দিকে অফিসে ঢুকে ৬টার দিকে বের হয়ে যেতাম। লেখা যেদিন ফাইনাল হতো, কম্পোজ থেকে ট্রেসিং বের হতো, সেদিন হয়ত একটু রাত হতো, তবে সেটাও রাত ৮-৯টার বেশি হবে না।
নতুন এই নিয়মের ফলে লাভ যেটা হলো, তা হচ্ছে আমি ঘরে সময় কিছু বেশি দেওয়ার সুযোগ পেলাম। পত্রিকা যেদিন বাজারে যেত সেদিন এবং তার পরের দিনও কিছুটা রিলাক্স থাকতে পারতাম। লেখালেখির মধ্যে একটা বৈচিত্র্য এলো, আগে যেমন ডেস্কে কাজ করতে গিয়ে কেবল আন্তর্জাতিক বিষয়ের উপরই লেখালেখি চলত, এখন সেটা পাল্টে গেল। আসলে আগে আমার নিজের কিছু লেখার এখতিয়ার ছিল না। বাইরে থেকে রয়টার্স বা এএফপি’র রিপোর্ট আসত, সেগুলো থেকে, ঠিক অনুবাদ নয়, অনুবাদের মতো মিলিয়ে মিশিয়ে একটা বানাতে হতো। কিন্তু সেখানে নিজস্ব মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। কিন্তু এখানে অন্য রকম। এমনিতে পুরো পত্রিকাটিই রাজনীতি-নির্ভর, রাজনীতি বলতে দেশীয় রাজনীতি। এ বিষয়গুলোর সঙ্গে আমি ঠিক অভ্যস্ত ছিলাম না, তাই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলাম। ব্যাপারটা আলম ভাইও বুঝতে পারলেন। একদিন তিনি আমাদের নিয়ে বসলেন।
আলম ভাই বললেন, দেখেন দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে সাপ্তাহিক পত্রিকার অনেক পার্থক্যের একটা হচ্ছে, দৈনিক পত্রিকায় তারা নিউজ বিক্রি করে, আর আমরা বিক্রি করি ভিউজ। ওখানে রিপোর্টার বা সাব-এডিটরের নিজে থেকে মতামত দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর এখানে মতামত না দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। দৈনিক পত্রিকায় যা কিছু ছাপা হয়, সেগুলোকেই আমরা আমাদের মতো করে বিশ্লেষণ করি, তারপর তা পরিবেশন করি পাঠকের কাছে।
খুব সহজ ভাষায় তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, আমার কাছ থেকে কি চান তিনি। ওখানে অবশ্য আমি ছাড়া আরও কয়েকজন ছিলেন, ছিলেন সাগর, মোস্তফা কামাল, সালাম। এরা আমি যাওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই সুগন্ধায় যোগ দিয়েছেন। এদের মধ্যে সালামকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। সে নব অভিযানে আমার সঙ্গে কাজ করত সাব-এডিটর পদে। ওখানে সে আমার জুনিয়র ছিল, বয়স এবং লেখাপড়ায় যেমন জুনিয়র, তেমনি পেশাতেও। কিন্তু আমি তাকে আপনি বলে সম্বোধন করতাম। আমি আসলে সকলকেই ‘আপনি’ বলে ডাকি। এই এখন, যখন মাথার চুল অর্ধেকেরও বেশি পেকে গেছে, আমার অর্ধেক বয়সী ছেলেমেয়েদের ‘তুমি’ বলতে অস্বস্তি বোধ করি। আগে আমার অবয়ব অনেক সময় মানুষকে কিছুটা বিভ্রান্ত করত, আমার চেহারা কিংবা শারীরিক গঠনে এমন কিছু একটা ছিল, যার কারণে অনেকেই আমাকে আমার বয়সের চেয়ে কিছুটা কম বয়সী মনে করত। আলম ভাইও সম্ভবত সে রকম কিছু একটা ভেবে থাকবেন। সুগন্ধায় আমাকে পদ দেওয়া হলো ‘সহকারী সম্পাদক’-এর। পত্রিকার প্রিন্টার্স লাইনে আমার নাম যেতে শুরু করল আমি ওখানে যোগ দেয়ার তিন কি চার সংখ্যা পর থেকে। নামটা দেখে খুশি হওয়ার চেয়ে হতাশই হলাম বেশি। কারণ সহকারী সম্পাদক হিসেবে দু’জনের নাম ছাপা হয়েছে। আঃ সালাম এবং মাসুদ কামাল। সালামের নামটা উপরে এবং আমারটা তার নিচে।
সাগর এবং মোস্তফা কামাল ঢুকল আমি যাওয়ার দু-একদিনের মধ্যেই। সাগরের পুরো নাম শওগাত আলী সাগর। সে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ছাত্র ছিল। যতদূর মনে পড়ে, অনার্স পরীক্ষা দিয়েই সে চলে এসেছিল সুগন্ধায়। আসলে সুগন্ধার জন্য সে আসেনি, এসেছিল জীবন বাঁচাতে। বিষয়টি প্রথমে শুনেছি অন্য কারও মুখ থেকে, পরে বিস্তারিত সাগরের কাছ থেকেও। চট্টগ্রামে সাগর ছাত্রলীগ করত, সক্রিয়ভাবেই করত এই ছাত্রসংগঠনটি। সে সময় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্রশিবিরের বিরাট দাপট। তো, সেই সময় কোনো একটি বিরোধকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের সঙ্গে শিবিরের সংঘর্ষ বাধে। তারই এক পর্যায়ে সাগরকে তুলে নিয়ে যায় শিবিরের ক্যাডাররা। বস্তার মধ্যে জীবন্ত অবস্থায় ভরে অমানুষিক নির্যাতন করে। এক পর্যায়ে তার মৃত্যুদ-ও ঘোষিত হয়। বস্তার মধ্যে বন্দি অবস্থায় সাগর যখন মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিল, তখন কারও একজনের বিশেষ বদান্যতায় প্রাণ রক্ষা পায় তার। তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে ছেড়ে দেওয়ার শর্ত হিসেবে বলা হয়, তাকে যেন আর কখনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে দেখা না যায়। জীবনের মায়ার কাছে পরাজিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেখাপড়ার মায়া। কোর্স শেষ না করেই চট্টগ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসে সাগর।
মোস্তফা কামালের বিষয়টি অবশ্য অন্যরকম। সে কুমিল্লার ছেলে। ওর সঙ্গে আমার কেবল নামের যে মিল রয়েছে তাই নয়, পারিবারিক গঠনেরও কিছু মিল আছে। বাবা তার সরকারি চাকরি করতেন, অনেক ভাইবোন। তাই শুরু থেকেই পরিবারের অনেকের দায়িত্বই সে নিজে কাঁধে নিয়ে বসে আছে। ঠিক এই জায়গাটিতেই অবশ্য ওর সঙ্গে আমার কিছুটা অমিল। আমি কখনোই পরিবারে কারো দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেইনি। আমি ছিলাম অনেকটাই স্বার্থপর। নিজেকে নিয়ে আমি এতটাই ব্যস্ত ছিলাম যে, আমার যে কোনো দায়িত্ব থাকতে পারে, তখন বিষয়টি আমি সেভাবে উপলব্ধিও করিনি।
কিন্তু মোস্তফা কামাল সম্পূর্ণই অন্যরকম। ওই বয়সেই সে সংসার, ভাইবোনের দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বসে ছিল। জগন্নাথ কলেজে পড়ত, আর ওই পড়তে পড়তেই বিভিন্ন পত্রিকায় লেখালেখি করত। সে বিবেচনায় সুগন্ধা মোটেই তার প্রথম পত্রিকা নয়। এ ধরনের ম্যাগাজিনে সে এর আগেও অনেক কাজ করেছে। বয়সের দিক দিয়ে সাগর এবং মোস্তফা কামাল ছিল কাছাকাছি।
সাগর ও মোস্তফা কামালের পর সুগন্ধায় যোগ দিল শহিদুল আজম। শহিদুল আজম এর আগে ‘সাপ্তাহিক সন্দ্বীপ’-এ ছিলেন। সাপ্তাহিকের জগতে সে মোটামুটি পরিচিত একটা নাম। তাকে করা হলো সুগন্ধার চিফ রিপোর্টার।
পরে সুগন্ধায় আরও একজনকে রিপোর্টার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়, তিনি জহিরুল আলম। জহিরের যোগদানের পরেই যেন পরিপূর্ণ হয় সুগন্ধা পরিবার। তবে জহিরের আগমনের আগেই ঘটে সালামের বিদায়।
সালাম চলে যাওয়ারও বেশ কিছুদিন পর সুগন্ধার রিপোর্টিং টিমে যোগ দিল জহিরুল আলম। সুগন্ধায় ওর যোগদানের ঘটনাটা আমার এখনও স্পষ্ট মনে আছে। জহির যখন আমাদের দলে এসে যোগ দিল, আমরা তখন অনেকটাই গোছানো। প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে উঠে বেশ সাবলীল গতিতেই এগিয়ে চলেছি। সার্কুলেশন বাড়ছে, প্রায় প্রতি সংখ্যাই আগেরটার চেয়ে ভালো হচ্ছে বলে নিজেদের কাছে মনে হচ্ছে। সার্কুলেশন বাড়ার কারণে বিজ্ঞাপনও বেশ পাচ্ছি। এরই মধ্যে একদিন মাহফুজ এলেন। মাহফুজ মানে আজকের জনপ্রিয় অভিনেতা ও নির্মাতা মাহফুজ। তিনি তখন সাপ্তাহিক পূর্ণিমাতে কাজ করেন। মাহফুজের সঙ্গে আর একটি ছেলে। আলম ভাই আর আমি একটি রুমে পাশাপাশি বসতাম। ওরা দুজনই এসে আলম ভাইয়ের টেবিলের সামনে বসল। মাহফুজের সঙ্গে আমার তখনও পরিচয় হয়নি। তিনি আলম ভাইয়ের সঙ্গেই কথাবার্তা শুরু করলেন। আলাপের ভঙ্গি দেখে বুঝলাম, তারা পূর্বপরিচিত। নানা প্রসঙ্গে আলাপের পর মাহফুজ বলল, সে আসলে এসেছে এই ছেলেটির একটা কাজের জন্য। ছেলেটি তার বন্ধু। এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে পড়ালেখা করে। বেশ একটা অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে গেছে। একটা চাকরি খুবই দরকার।
আলম ভাই ইশারায় আমাকে দেখিয়ে বললেন, কারও চাকরি হওয়া না হওয়ার বিষয়টা আসলে আমি নই, মাসুদ কামাল দেখে। সে-ই এখানে মালিকের প্রতিনিধি। আগেরবার মোজাম্মেল ভাই তার নিজের লোকদের চাকরি দিয়ে পরে সুযোগ মতো সবাইকে নিয়ে কেটে পড়ায় মালিকের বেশ একটা শিক্ষা হয়েছে। তাই এবার লোক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিজের লোক বসিয়েছে। চাকরির বিষয়ে ওর সঙ্গে কথা বলতে হবে।
আলম ভাইয়ের এই কথায় আমি রীতিমতো হতবাক হয়ে গেলাম। আজগুবি সব কথা বানিয়ে বানিয়ে বললেন। আর সেই সঙ্গে এটাও বুঝলাম, আসলে মাহফুজের প্রস্তাবে রাজি হওয়ার মতো কোনো ইচ্ছা তার নেই। তাই কেবল ‘না’ বলার জন্য বলটা তিনি আমার কোর্টে ঠেলে দিয়েছেন।
মাহফুজ এবার আমার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলেন। ওকে আমার ভালো লাগল, খুবই সাবলীল ভঙ্গিতে কথা বলছিলেন। এর আগে যে তার সঙ্গে আমার কখনো দেখাই হয়নি, সেটা আমাদের প্রথম দিনের সেই কথাবার্তা দেখলে কেউ বুঝতেই পারবে না। সে আমাকে বুঝাতে লাগলো, চাকরিটা জহিরের কত বেশি প্রয়োজন। বন্ধুর জন্য তার এই প্রচেষ্টা খুবই ভালো লাগলো আমার।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি নিজে পূর্ণিমাতে আছেন, সেটা তো আমাদেরটির চেয়ে আরও অনেক বড় ম্যাগাজিন। ওখানে কাজের সুযোগও অনেক বেশি। তাহলে ওর জন্য ওখানে চেষ্টা করছেন না কেন?
আমার এই প্রশ্নের কি জবাব সেদিন মাহফুজ দিয়েছিলেন, তা এতদিন পরে হুবহু মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে, তার সেদিনের সেই জবাব আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। তারপরও আমি জহিরের সঙ্গে কথা বলা শুরু করলাম। দু’একটা কথা বলার পরই আমার মনে হলো, এ ছেলেটি বেশ চটপটে এবং একই সঙ্গে মেধাবী। কিন্তু সাংবাদিকতায় তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই বলে আমার আগ্রহ অনেকটাই কমে গেল। এসব নতুন ছেলেদের নিয়ে কতরকম যে ঝামেলা হয়, সেটা আমাদের বেশ ভালোই দেখা আছে। এরা আসে খুবই আগ্রহ নিয়ে, তারপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ক্লান্ত হয়ে যায়। অথবা, পত্রিকার পলিসি ও স্টাইল অনুযায়ী যা আমরা চাই, তা দিতে পারে না। নিজেরা একটা কিছু লিখে নিয়ে আসে, ছাপার উপযুক্ত না হলেও সেটি প্রকাশের জন্য পীড়াপীড়ি করতে থাকে।
দুজনের কথা এখানে বলা যেতে পারে। আবু দারদা যোবায়ের এবং কনক সারোয়ার। এরা দুজনেই এখন ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক। যোবায়েরও প্রথম এসেছিল আলম ভাইয়ের কাছে। তার সঙ্গে দু-একটা কথা বলেই তিনি দ্রুত তাকে ঠেলে দিলেন আমার কাছে। ততদিনে আলম ভাইয়ের একটা ধারণা হয়ে গেছে যে, আমি খুব গুছিয়ে কথা বলতে পারি এবং পারি মিষ্টি করে ‘না’ বলতে। যোবায়ের এসে বসল আমার টেবিলের সামনে। আমি জানতে চাইলাম, কি চায় সে। সে জানাল, সাংবাদিক হতে চায়।
বললাম, আপনি একটু বসুন, আমি হাতের কাজটা সেরে নিই।
যোবায়ের বসে থাকলেন, কিছু সময় এদিক সেদিক তাকিয়ে সময় পার করল। কিন্তু আমার ‘হাতের কাজ’ আর শেষ হয় না। এটা আসলে ছিল আমার একটা টেকনিক। নতুন কেউ সাংবাদিক হতে এলে, এরকম প্রায়ই আসত, প্রথমেই তার ধৈর্যের একটা পরীক্ষা নিতাম। কোন কারণ ছাড়াই কিছু সময় বসিয়ে রাখতাম। দেখতাম সে কি করে। একটু পরেই দেখলাম, যোবায়ের মগ্ন হয়ে পত্রিকার ফাইল দেখছে। দৈনিক পত্রিকার ফাইল দেখা শেষে সে সুগন্ধার পুরনো কপিগুলো দেখতে শুরু করল। প্রথম পরীক্ষায় সে পাস করল। প্রায় ঘন্টাখানেক বসিয়ে রাখার পর তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম।
বললাম, আপনি এক কাজ করেন। বাসায় যান। আজ তো আমাদের লেখা জমা দেওয়ার শেষ দিন, তাই আজ আমরা একটু ব্যস্ত আছি। আপনি দু-তিন পরে আসুন। আর এসময়ে কিছু একটা রিপোর্ট লিখে নিয়ে আসুন। কিভাবে লিখতে হবে, কোন ধরনের লেখা আমরা ছাপি, তা বুঝতে হলে আমাদের কয়েকটা কপি পড়লেই হবে। এই স্টাইলে লিখে আনুন।
যতদূর মনে পড়ে, যোবায়েরের কাঁধে ঝোলানো একটা কাপড়ের ব্যাগ ছিল। সে সেখান থেকে বেশ কিছু কাগজ বের করল। বলল, আমি কয়েকটা রিপোর্ট লিখেই এনেছি। আপনি দেখুন।
সত্যি বলতে কি, আমি এতটা আশা করিনি। কিছুটা অনাগ্রহ নিয়েই বললাম, আজ তো দেখতে পারব না। দেখতেই পাচ্ছেন, আজ আমরা খুবই ব্যস্ত। পরে দেখব। এক কাজ করেন, পরে যখন আসবেন, তখন এগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে আসবেন।
যোবায়ের বলল, ঠিক আছে। তখন নতুন লেখা নিয়ে আসব। আজ যেগুলো এনেছি, সেগুলো একবার দেখেন।
সন্দেহ নেই আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম। তারও চেয়ে বেশি বিরক্ত হচ্ছিলেন আলম ভাই। আমার বিরক্তি যোবায়েরের উপর। আর আলম ভাইয়ের বিরক্তি আমার উপর। আমি কেন যোবায়েরকে এতটা সময় দিচ্ছি-এই নিয়ে তার বিরক্তি।
খুবই অনিচ্ছা নিয়ে হাত বাড়ালাম, ওর লেখা কাগজগুলো নিলাম। নিউজপ্রিন্টের প্যাডে লেখা। জিজ্ঞাসা করলাম, কি নাম আপনার?
বলল, আবু দারদা যোবায়ের।
তার কথাগুলো কি জড়িয়ে যাচ্ছিল? উচ্চারণ কি অস্পষ্ট ছিল? হতে পারে, আবার নাও হতে পারে। এতদিন পরে আসলে তা মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে, আমি তার নামটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি একটা কাগজ বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, এখানে আপনার নামটি স্পষ্ট করে লিখে দিন। সে লিখল। গোটা গোটা অক্ষরে। তারপরও আমার সন্দেহ হলো, আমি উচ্চারণ করে পড়লাম। বললাম, ঠিক আছে? সে মাথা নাড়ল। তারপর সালাম দিয়ে চলে গেল। আমি লেখাগুলো রেখে দিলাম টেবিলের উপর।
যোবায়ের চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলম ভাই আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার সমস্যাটা কি, বলেন তো।
-কেন? কি সমস্যা? আমার তো কোনো সমস্যা নেই?
-না, ওই ছেলে, দারদা না জরদা-কি যেন নাম, তার সঙ্গে এত আলাপের দরকারটা কি? পছন্দ হয়নি, তো এক কথায় বিদায় করে দেন। তা না, তার সঙ্গে আপনে দোস্তের মতো আলাপ শুরু করে দিলেন। শেষ পর্যন্ত নিবেন তো না, তাহলে এত আলাপের দরকারটা কি ছিল?
আলম ভাইয়ের কথা একদিক দিয়ে ঠিকই আছে। যেভাবে তার সঙ্গে কথাবার্তা বলেছি, তাতে ওর মনে এক ধরনের প্রত্যাশা কিন্তু তৈরি হয়েছে। সে হয়ত ভেবেছে তার লেখা এখানে ছাপা হবে, তারপর একসময় চাকরিও হবে। এত কিছুর পর না হলে বরং আশাভঙ্গের বেদনাটা বেশি হবে।
আমি বললাম, ওকে যে একেবারে নেবই না, সেটাও তো নিশ্চিত নয়। যদি তার লেখালেখি ভালো হয়, তাহলে অসুবিধা কোথায়? দু-এক জায়গায় কিছু ঘাটতি থাকতেই পারে। একটু হেল্প করলেই হয়ত সেটা দূর হয়ে যাবে।
আলম ভাই বললেন, ভালো, তাহলে একটা স্কুল খুলে বসেন। আরো অনেক জরদা, দারদা এসে জুটুক। আর আপনি মাস্টারি করতে থাকেন।
আমি আর কিছু বললাম না, চুপ করে থাকলাম।
যোবায়েরের একটা লেখা কিন্তু ওই সংখ্যাতেই ছাপা হয়েছিল। ছোট্ট একটা বক্স আইটেম। নগরজীবনের কি যেন এক সমস্যা নিয়ে লেখা। সমস্যাটি নিয়ে সে প্রায় দেড় হাজার শব্দ লিখেছিল। তার সেই বিষয়টা ঠিক রেখে আমি নিজেই দেড় দুই শ শব্দের মধ্যে লিখলাম। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল যে কোনো উপায়েই হোক ওর নামটা সুগন্ধার পাতায় ছাপানোর। বিষয়টি আলম ভাইও লক্ষ্য করলেন। বললেন, শখ করে নিজের বিপদ কিভাবে টেনে আনছেন, সেটা টের পাবেন খুব শিগগিরই।
টের পেতে সময় লাগল না। পত্রিকাটি বাজারে যাওয়া মাত্র সেটি নিয়ে হাজির যোবায়ের। সঙ্গে আরও বেশ কয়েকটি লেখা। আমি তাকে বললাম, এত বড় বড় লেখা তো আমরা ছাপতে পারব না, আপনার লেখাটিকে আমরা যেভাবে ছোট করেছি, ওইভাবে নিয়ে আসুন।
সে চলে গেল। পরদিন আবার এলো। এভাবেই চলতে থাকল। সে লেখা নিয়ে আসে, আমি আমার সাজেশান দেই, সে চলে যায়, পরদিন আবার আসে। আমি ক্লান্ত হয়ে গেলাম। কিন্তু যোবায়ের ক্লান্ত হলো না। এক পর্যায়ে আলম রায়হান ঘোষণা করলেন, এভাবে চলতে চলতে ওর লেখা যদি ছাপানোর যোগ্যও হয়, তবু তা ছাপা যাবে না। কারণ, তাহলে তার অত্যাচার আরও বেড়ে যাবে।
আজ এতদিন পর, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, শেষ দিকে যোবায়েরের লেখাগুলো মোটামুটি খারাপ হতো না। কিন্তু তারপরও আমি আর তার কোনো লেখা সুগন্ধায় ছাপানোর সাহস পাইনি। যোবায়ের এরপরও অনেকদিন সুগন্ধা অফিসে এসেছে, আমার সঙ্গে কথা বলেছে, লেখা দিয়ে গেছে। আমরা ছাপিনি, তারপরও এসেছে। আমাকে বলেছে, ছাপা না হোক, আপনি একটু দেখে দেন। ওর সেই অধ্যবসায়, সাংবাদিক হওয়ার জন্য লেগে থাকা আচরণ আমাকে মুগ্ধ করেছে।
মাঝে কয়েক মাস সে আর আসেনি সুগন্ধা অফিসে। একদিন আমি প্রেসক্লাবে গেছি। সেখানে যোবায়েরের সঙ্গে দেখা। বলল, আমি তো আজকের কাগজে জয়েন করেছি।
তার মুখে এই কথাটি শুনে আমি খুবই অবাক হলাম। আজকের কাগজ! আমি বিস্মিত হলাম।
ওই সময়টাতে আজকের কাগজকে বিবেচনা করা হতো একটি নতুন ধারার দৈনিক হিসেবে। তরুণদের স্বপ্ন ছিল আজকের কাগজে কাজ করার। সেই স্বপ্ন আমার মধ্যেও ছিল।
যোবায়ের তখনও বলছিল, মাত্র সপ্তাহখানেক হলো ওখানে রিপোর্টার হিসাব যোগ দিয়েছে সে। এর মধ্যে কয়েকটা রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে। সম্পাদক মতিভাই নাকি তাকে ট্রেনের উপর একটা সরেজমিন রিপোর্ট করতে বলেছে। এজন্য সে কমলাপুর থেকে এক রাতে বাহাদুরাবাদ ঘাট পর্যন্ত যাবে এবং ওই ট্রেনেই আবার ঢাকায় ফিরে আসবে। তারপর সরেজমিন রিপোর্টটা জমা দেবে।
আমি বললাম, ভালোই তো।
ওর কথা থেকেই বুঝে গেলাম আজকের কাগজে ওর যোগদানের রহস্য। বহুল আলোচিত এই পত্রিকাটি শুরুতে প্রকাশিত হয় নাইমুল ইসলাম খানের সম্পাদনায়। কাজী শাহেদ আহমেদ ছিলেন এর মালিক। কিছুদিন আগে মালিক ও সম্পাদকের মধ্যে কি নিয়ে যেন সৃষ্টি হয় বিরোধের। সম্পাদকের চাকরি চলে যায়, অথবা তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। যাওয়ার সময় নাইমুল ইসলাম খান বেশির ভাগ সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে যান। এদের নিয়ে তিনি বের করেন ভোরের কাগজ। যাই হোক, নাইমুল ইসলাম খান আজকের কাগজ ছেড়ে দেওয়ার পর মালিক কাজী শাহেদ আহমেদ তাড়াহুড়া করে দায়িত্ব দেন মতিউর রহমান চৌধুরীকে। এর আগে মতিউর রহমান চৌধুরী ইত্তেফাকের রিপোর্টার ছিলেন। তিনি অবশ্য আজকের কাগজে খুব অল্প সময়ই ছিলেন।
আজকের কাগজের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মতিউর রহমান চৌধুরীর প্রথম কাজ হলো ভাঙ্গা ঘরকে আবার গুছানো। কিন্তু তার সে কাজটি খুব ভালো হয়নি। ওই সময় যারা ওখানে গিয়েছেন, তাদের সবাইকেই তিনি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা প্রত্যাশিত সাফল্য পায়নি। তিনি নিজেও টিকে থাকতে পারেননি সেখানে।
যোবায়ের নিজেও আজকের কাগজে বেশিদিন থাকতে পারেননি। বিভিন্ন জায়গা ঘুরে গত বেশ কয়েক বছর ধরেই সে এটিএন বাংলা টেলিভিশনে। শুনেছি সে নাকি এখানে গুরুত্বপূর্ণ একজন রিপোর্টার। এটিএন বাংলায় যোগ দেওয়ার আগে এবং পরে বেশ কয়েকবার ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। ওর প্রতিটি উন্নতির খবর আমাকে আনন্দিত করেছে।
কনক সরোয়ারও এসেছিল প্রথম সুগন্ধায়, সাংবাদিক হতে। যোবায়ের যখন প্রথম আসে, তখন সে সম্ভবত মাত্র এইচএসসি পাস করেছে। আর কনক সরোয়ার এলো আরও কম বয়সে। জানাল সে নটরডেম কলেজের একজন ছাত্র। একটা পত্রিকা অফিসে প্রথমবার গিয়ে কলেজের ইন্টারমেডিয়েটের একজন ছাত্রের আচরণে যে ভীতি অথবা জড়তা থাকার কথা, তার কিছুমাত্র ছিল না কনকের মধ্যে। স্মার্টলি এসে বলল, সে আমাদের ম্যাগাজিনে কিছু কন্ট্রিবিউট করতে চায়।
-তো বলুন কি করতে চান? বললাম আমি।
আমার এই প্রশ্নের পর, আমার স্পষ্ট মনে আছে, তার প্রতিক্রিয়াটি ছিল দেখার মতো। প্রথমত, ইন্টারমেডিয়েটের একজন ছাত্র হিসেবে সে আশাই করেনি যে, পত্রিকা অফিসের একজন সাংবাদিক তাকে ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করবে। আমি কিন্তু তাকে বিব্রত করার জন্য ওটা করিনি। যোবায়েরও শুরুর দিকে আমাকে আনেক অনুরোধ করেছে ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করতে। পরে সে নিজেও যখন বড় প্রতিষ্ঠানে চাকরি পেয়ে গেছে তখন অবশ্য আর বলেনি, বরং এমন একটা ভাব দেখিয়েছে যে, আমরা যেন অনেকদিনের বন্ধু। তার এই পরিবর্তিত আত্মবিশ্বাস মুগ্ধ করেছে আমাকে।
কনক কিন্তু দ্রুতই সামলে নিল নিজেকে। তার মধ্যে চলে এলো এক ধরনের আত্মবিশ্বাস। সে বলল, আপাতত লেখালেখি নয়, আমি আপনাদের প্রতি সংখ্যায় কিছু কোলাজ কার্টুন দিতে চাই।
Ñঠিক আছে, দেবেন। কিন্তু আপনি কি একজন আর্টিস্ট?
Ñ জি না, আমি নটরডেম কলেজে পড়ি।
Ñ অসুবিধা নেই। কার্টুন কি কিছু করে এনেছেন?
বলতেই সে একগাদা কাগজ বের করল। সাদা কাগজে পত্রিকায় প্রকাশিত নেতা-নেত্রীদের কিছু ছবি সেঁটে দিয়ে সেখানে তাদের মুখে কৌতুককর কিছু সংলাপ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। আসলে এ কাজটি করতে শিল্পী হতে হয় না, কেবল রাজনৈতিক সচেতনতা এবং বিদ্রƒপাত্মক চিন্তা থাকলেই চলে। আমি কয়েকটি ওর হাত থেকে নিয়ে উলটে পালটে দেখলাম এবং সত্যি বলতে কি, ভালো লাগল। খুবই পরিণত। মনেই হলো না, ইন্টারমেডিয়েটের কোনো ছাত্রের কাজ এগুলো!
কনকের প্রথমদিনের আচরণে সুগন্ধায় আমার সহকর্মীরা স্পষ্টতই বিরক্ত হয়েছিল। কেউ একজন পিয়ন মিলনকে ডেকে বলেও দিল, এই ইঁচড়ে পাকা বেয়াদবটাকে যেন আর এখানে ঢুকতে দেওয়া না হয়।
আমি বললাম, ওটাই তো ওর প্রথম যোগ্যতা। কিছুটা বেয়াদব না হলে সাংবাদিক হবে কিভাবে? বড় বড় নেতাদের সমালোচনা করবে কিভাবে?
আলম ভাই বললেন, মাসুদ কামাল স্কুল খুলে বসেছে, তাকে মাস্টারি করতে দেন। কত তো এলো গেল, টিকল কয়জন?
আলমভাই আসলে ভুল বলেননি। অনেকেই আসত সাংবাদিক হতে। আমি তাদের একটা কিছু এসাইনমেন্ট দিয়ে দিতাম। তাদের বেশিরভাগই আর সেই এসাইনমেন্ট সম্পন্ন করে ফিরত না। অনেকে আবার ফিরে এসে এমন কিছু একটা লিখে জমা দিত, মনে হতো না ফিরলেই বুঝি ভালো হতো।
তবে কনকের ক্ষেত্রে সেটা হলো না। এরপর সে নিয়মিত আসতো সুগন্ধায়। ওর ওই কোলাজ কার্টুনই ছাপা হতে থাকল। বেশ কয়েক মাস এসেছে ও। মাঝে একবার লেখালেখির আগ্রহ প্রকাশ করলেও আমরা খুব একটা আগ্রহ দেখাইনি। এক সময়, কেন যেন সম্ভবত ওর পরীক্ষার কারণে, বন্ধ করে দিল ও সুগন্ধায় আসা-যাওয়া। কনকের সঙ্গে এরপর আরও বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। আমি তখন পত্রিকা পরিবর্তন করেছি। সেও পরিবর্তন করেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নটরডেম থেকে পাস করার পর যতদূর মনে পড়ে কনক ভর্তি হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তবে এই পুরো সময়টাই সে সাংবাদিকতার জগত থেকে সরে থাকেনি। প্রায়ই বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ওর লেখা দেখতাম। এর মাঝে সে মাস্টার্স পাস করে পিএইচডিও করে ফেলল। পিএইচডি করার পর ওর সঙ্গে যতবার দেখা হয়েছে, এক কথা দু-কথার পর সে জানিয়ে দিয়েছে যে, সে একজন ডক্টরেট করা ব্যক্তি।
কনক এখন ইটিভিতে। বেশ ভালো করছে বলেই শুনেছি, ওখানে নাকি সে বেশ প্রভাবশালীও বটে। আর জানা মতে, সাংবাদিকদের মধ্যে সে তৃতীয় ব্যক্তি, যার একটি পিএইচডি ডিগ্রি আছে।
বলছিলাম জহিরের কথা। আমার পুরনো এবং কার্যকর সেই স্টাইলেই আমি জহিরের বিষয়টা হ্যান্ডেল করার চেষ্টা করলাম। জহিরকে একটা অ্যাসাইনমেন্ট দিলাম। ওই সময় শুল্ক আদায় নিয়ে কি যেন একটা ঝামেলা চলছিল। জহিরকে বললাম, অর্থনীতির বিষয়ে কোনো ধারণা আছে?
সে বলল, আছে কিছুটা।
আমি চলমান ওই বিষয়টি নিয়ে তাকে কিছু বলতে গিয়ে দেখলাম, বিষয়টি সে জানে। বুঝলাম, এই ছেলে হোমওয়ার্ক করেই এসেছে। এখানে আসার আগেই আজকের পত্রিকাগুলো ভালোভাবে পড়ে এসেছে।
বললাম, এ বিষয়টি নিয়ে একটা রিপোর্ট লিখতে পারবেন?
Ñ কবে দিতে হবে?
আমি একটু ভাব নিয়ে বললাম, পত্রিকায় আগামীকাল বলে কোনো কথা নেই। আজই দিতে হবে। পারবেন?
সে মাথা নাড়ল, পারবে।
বিষয়টিকে আর একটু জটিল করার জন্য আমি বললাম, এমনি এমনি পত্রিকা দেখে লিখে দিলে তো চলবে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বক্তব্য লাগবে, ইন্টারভিউ নিয়ে করতে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় এনবিআরের চেয়ারম্যানের একটা ইন্টারভিউ নিয়ে আসতে পারলে।
ঠিক আগের সহজ ভঙ্গিতেই জহির জানাল, পারবে সে।
বললাম, তাহলে আর বসে আছেন কেন? যান, এখনই যান।
জহির বের হয়ে গেল। কিছু সময় মাহফুজও চলে গেল। আলম ভাই আমার দিকে মুখ তুলে বলল, যাক ভালোই বিদায় করেছেন। ও তো এনবিআর চেয়ারম্যানের অফিসেই ঢুকতে পারবে না।
আমারও তাই মনে হলো, তবে মুখে আর কিছু বললাম না। তবে আমার এ ধারণা ভুল প্রমাণ হতে বেশি সময় লাগল না। ঘন্টা তিনেকের মধ্যে ফিরে এলো জহির। এবং আমাদের অবাক করে দিয়ে জানাল, সে এনবিআর চেয়ারম্যানের ইন্টারভিউ নিয়ে এসেছে!
একেবারে শুরুর দিনেই যোগ্যতার যে পরিচয় জহির রেখেছিল, তারপর তাকে ‘না’ বলার কোনো অজুহাতও আমরা তৈরি করতে পারিনি। এমনিতেই তখন আমাদের রিপোর্টিং-এ পর্যাপ্ত লোক ছিল। চিফ রিপোর্টার শহিদুল আজম, স্টাফ রিপোর্টার শওগাত আলী সাগর এবং মোস্তফা কামাল। নির্বাহী সম্পাদক আলম রায়হান তো আছেনই। এরা সবাই নিয়মিত রিপোর্ট লিখতেন। লিখতেন সংবাদ বিশ্লেষণ। সেখানে যোগ হলো আরও একজন, জহিরুল আলম। সেই জহিরই এখন এনটিভি’র চিফ নিউজ এডিটর।
খুব দ্রুতই জহির নিজেকে প্রমাণ করতে থাকল। বিশেষ করে আমাদের যখন কোনো কুইক প্রডাকশন দরকার পড়ত, জহিরকে বলতাম। দ্রুতই সে নামিয়ে দিত। ওর আর একটি গুণ ছিল, সেটা হলো ইংরেজিতে দক্ষতা। আগেই বলেছি, ম্যাগাজিন হিসেবে সুগন্ধা খুব উঁচু শ্রেণির পাঠকের কথা চিন্তা করে বের হতো না। তবে আমরা সবাই যুক্ত হওয়ার পর এতে কিছুটা নতুনত্ব আনার চেষ্টা করলাম। টাইম, নিউজ উইক, এশিয়া উইক, ফরচুন এই চারটা আন্তর্জাতিক ম্যাগাজিনের আমরা গ্রাহক হয়ে গেলাম। মূলত আমার উৎসাহেই এটা হলো। বিদেশি ম্যাগাজিন আমরা এমনি আগেও কিনতাম, তবে সেগুলো ছিল ভারতীয়, ইন্ডিয়া টুডে, সানডে, আর কয়েকটা সিনে ম্যাগাজিন। বিদেশি ম্যাগাজিনগুলো নিয়মিত হওয়ার পর আমরা চেষ্টা করলাম আন্তর্জাতিক কলামটিকে নিয়মিত করার জন্য। এ কাজটি মূলত আমিই করতাম। আবার মাঝে মধ্যে যখন ব্যস্ততা থাকত, জহিরকে করতে দিতাম। দেখতাম, জহির খুব দ্রুত নামিয়ে দিত।
লেখালেখির ক্ষেত্রে অন্য রিপোর্টারদের এক একজনের মধ্যে দেখা গেছে এক এক ধরনের বৈশিষ্ট্য। সাগর ঠা-া মাথার ছেলে, কোনো কিছুতেই উত্তেজিত হতো না। কোনো একটা সাবজেক্ট বললে সেটা নিয়ে চিন্তাভাবনা করত, দরকারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে একটু পুরনো ফাইলপত্র ঘাটত, তারপর ধীরে সুস্থে একটা লেখা নামিয়ে দিত। শফিক বলত, সাগর স্যার হচ্ছেন গবেষক টাইপের লেখক।
শহিদুল আজম ছিল চিফ রিপোর্টার। আমার তখনও মনে হয়েছে, এখনও মনে হয়, সে চিফ রিপোর্টার হয়েছিল যতটা না অন্তর্গত যোগ্যতার কারণে, তারও চেয়ে বেশি অভিজ্ঞতার জোরে। এর আগে তার একাধিক সাপ্তাহিক পত্রিকায় লেখালেখির অভিজ্ঞতা ছিল। জহিরের মতো, সেও দ্রুত কোনো আইটেম নামিয়ে দিতে পারত। তবে পার্থক্য একটাই, সে প্রায়ই ভুলে যেত, কোথায় থামতে হবে। হয়ত একটা স্টোরি লিখতে দিলাম, বলা হলো, দুই হাজার শব্দের মধ্যে লিখুন। দেখা যাবে, সে লিখছে তো লিখছেই। মাঝে দু-তিন বার রিমাইন্ডার দেওয়ার পর, যখন সে থামবে, দেখা যাবে লেখা সাড়ে তিন হাজার শব্দ ছাড়িয়ে গেছে।
এদিক দিয়ে মোস্তফা কামালের মধ্যে ছিল ফরমায়েসি লেখকের গুণাবলী। তাকে যেভাবে লিখতে বলা হতো, লিখে নিয়ে আসত। তার লেখায় হয়ত সাগরের মতো গভীরতা বা অন্তর্দৃষ্টি থাকত না, জহিরের মতো দ্রুততা থাকত না, অথবা শহিদুল আজমের মতো বহুমুখিতা থাকত না, তবে আমরা যেভাবে চাইতাম-সে করার চেষ্টা করত। তার যোগ্যতা কিংবা সীমাবদ্ধতা, উভয় নিয়েই সে চেষ্টা করত অফিসের চাহিদা মেটাতে।
নির্বাহী সম্পাদক হলেও আলম রায়হান নিজেও লিখতেন। ওই সময় সুগন্ধার জনপ্রিয় একটা কলাম ছিল ‘গেদুচাচা’র খোলা চিঠি’। গেদুচাচা এখানে গ্রাম্য কিন্তু স্বশিক্ষিত একটা চরিত্র। গ্রাম্য ভাষায় সে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, কিংবা নেতা-নেত্রীদের কাছে চিঠি লিখতেন। সেই চিঠির মূল বক্তব্য থাকত রাজনীতি সংশ্লিষ্ট। নানা ঘটনাবলী প্রসঙ্গে নানা মন্তব্য দেওয়া হতো, কখনো কখনো সেসব হতো কিছুটা চটুল কিংবা হাস্যরসাত্মক।
আমি সুগন্ধায় যাওয়ার আগে থেকেই গেদুচাচা’র খোলা চিঠি সেখানে নিয়মিত ছাপা হতো। তখন সেটা লিখতেন, সেই সময়ের সম্পাদক খোন্দকার মোজাম্মেল হক নিজে। তিনি চলে যাওয়ার পর, লেখা শুরু করলেন আলম রায়হান। বিষয়টা সহজ ছিল না। খোন্দকার মোজাম্মেল হক সাহেবের বাড়ি ছিল সম্ভবত নোয়াখালী বা ওই অঞ্চলে। তাই তার লেখায় তার আঞ্চলিক অনেক শব্দ থাকত। আর আলম রায়হানের বাড়ি বরিশাল। তাই তার পক্ষে মোজাম্মেল সাহেবের আঞ্চলিক শব্দ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রয়োগ করা সহজ ছিল না। আলম রায়হান সেই চেষ্টাও করেননি। তিনি ধীরে ধীরে সেখানে বরিশালের আঞ্চলিক শব্দ ঢুকিয়েছেন।
ওদিকে মোজাম্মেল সাহেব সূর্যোদয় নামের সাপ্তাহিকটি শুরু করলেও গেদুচাচাকে কিন্তু ছাড়েননি। সেখানেও তিনি একই নামে, একই লোগো দিয়ে চালু করেন ‘গেদুচাচার খোলা চিঠি’। বিষয়টা আমার কাছে খুবই স্থূল মনে হলো। কোনো পত্রিকায় যখন বিশেষ কোনো নামে একটি কলাম বা বিভাগ চালু হয়, সেটি সেই পত্রিকারই সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়। সেটি কার হাত দিয়ে চালু হলো, তা বিবেচ্য বিষয় নয়। সেই হিসেবে ‘গেদুচাচার খোলা চিঠি’ তো সুগন্ধার সম্পত্তি। তাহলে খোন্দকার মোজাম্মেল হক সাহেব কিভাবে সেটি সূর্যোদয় পত্রিকায় প্রকাশ করতে থাকলেন? কেবল তাই নয়, কিছুদিন পর তিনি সূর্যোদয়ও ছেড়ে দেন, একই প্রক্রিয়ায় প্রকাশ করেন আজকের সূর্যোদয় নামে নতুন আর একটি সাপ্তাহিক। সেখানেও তিনি ওই গেদুচাচা কে বগলদাবা করে নিয়ে গেলেন। কেবল নিয়ে গেলেন বললে ভুল হবে। শুরু থেকেই এই চিঠিগুলোতে একটা ক্রমিক সংখ্যা থাকত। তিনি সূর্যোদয় এবং আজকের সূর্যোদয়ে সেই ক্রমিকের ধারাবাহিকতাও অব্যাহত রাখলেন। এসবের বালখিল্যের বিপরীতে আলম ভাইয়ের ছেলেমানুষিও ছিল দেখবার মতো। তিনি একবার করলেন কি, সুগন্ধায় গেদুচাচার খোলা চিঠি’র ক্রমিক সংখ্যা অনেকটাই বাড়িয়ে দিলেন। কারণ হিসেবে তিনি বললেন, লোকে যখন সূর্যোদয় আর আমাদেরটা মিলিয়ে পড়বে, দেখবে সুগন্ধার ক্রমিক অনেক বেশি, তখন তারা মনে করবে, আমরা অনেক আগে থেকেই লিখছি, আমাদেরটাই আসল!
তবে কোনটি আসল আর কোনটি নকল, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলতে পারি, এই দুই ম্যাগাজিনেরই মূল আকর্ষণ ছিল এই গেদুচাচার চিঠি। এমন অনেক পাঠকের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, যারা গেদুচাচার খোলা চিঠি’র খুবই সমালোচক ছিলেন। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, আপনাদের পুরো ম্যাগাজিনটা একরকম, আর ওই গেদুচাচাটা অন্যরকম। ওখানে একধরনের গ্রাম্যতা, স্থূলতা থাকে। ওইটা চালু রাখা কি খুবই জরুরি?
এমন একজনকে আমি একবার বললাম, আপনি কি সুগন্ধা নিয়মিত রাখেন?
Ñ না, নিয়মিত রাখি না। তবে প্রায়ই পড়া হয়।
Ñ কিনে পড়েন?
Ñ না, কিনে তেমন পড়া হয় না। কোথাও পেলে পড়ি।
আমি তখন একটু হেসে বললাম, তাহলে আপনি আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পাঠক নন। যারা এই ম্যাগাজিনটা নিয়মিত টাকা দিয়ে কেনেন, তাদের জিজ্ঞাসা করে দেখেন, তারা কিন্তু ওই গেদুচাচার জন্যই কেনেন এই সুগন্ধা।
আমি নিজেই মতিঝিলে অনেক অফিসের নিচে, গার্ড দারোয়ান কিংবা কেরানী শ্রেণির লোকদের ওই গেদুচাচার চিঠি পড়তে দেখেছি। একজন পড়ছে, আরও অনেকে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে।
মফস্বলের পাঠকদের মধ্যে এই প্রবণতা ছিল আরও অনেক বেশি।
তবে ওই যে পাঠক, গেদুচাচা’র গ্রাম্য উপস্থাপনা নিয়ে সমালোচনা করলেন, তার মতামতকে কিন্তু আমরা একেবারেই উড়িয়ে দিইনি। গেদুচাচা বাদ দিয়ে পত্রিকার বাকি অংশে আমরা আধুনিকতা আনার চেষ্টা করতে থাকলাম।
সহকারী সম্পাদক হিসেবে আমার কাজ ছিল লেখাগুলোকে এডিট করা। আলম রায়হানের লেখা গেদুচাচা’র খোলা চিঠি ছাড়া বাকি সব লেখাই আমাকে দেখতে হতো। আলম ভাই অবশ্য ওটিও আমাকে দিতেন দেখার জন্য, কিন্তু আমি দেখতাম না দুটি কারণে। প্রথমত, আমি বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা তেমন বুঝি না। আর দ্বিতীয়ত, তার চেয়েও কম বুঝতাম আলম ভাইয়ের হাতের লেখা। এমনিতেই তার হাতের লেখা আমার কাছে দুর্বোধ্য ছিল, তার উপর যখন দ্রুত লিখতেন, তখন সেটা বুঝতে পারা রীতিমতো অসম্ভব হয়ে পড়ত। তারপরও ওই লেখাটা আমাকে দেখতে হতো, সেটা লেখাটির আয়তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়ার জন্য।
আমাদের পত্রিকা ছিল ৩২ পৃষ্ঠার। এর মধ্যেই বিজ্ঞাপন, এবং লেখালেখি সবকিছু থাকতে হবে। কাজেই কোন লেখা কতটুকু যাবে, তার একটা হিসাব আগে থেকেই করা থাকলে সুবিধা হয়। এর একটা অর্থনৈতিক সুবিধাও ছিল। অফিসের পুরনোদের কাছে জেনেছি, আগে নাকি লেখা যেখান থেকে যা কিছু আসত সবই পাঠিয়ে দেওয়া হতো কম্পিউটারে কম্পোজের জন্য। ওই সময় কম্পিউটার অতটা সহজলভ্য বস্তুতে পরিণত হয়নি। ফলে বাইরের প্রতিষ্ঠান থেকেই সবকিছু কম্পোজ করিয়ে ট্রেসিংয়ে প্রিন্ট আনতে হতো। পরে ওই ট্রেসিং-এর পৃষ্ঠা হিসাব করে হতো বিল। ফলে যত বেশি লেখা পাঠাব, তত বেশি বিল হবে। এই বিষয়টা আমি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলাম। ট্রেসিং আনার পর সেটাকে কাঁচি দিয়ে কেটে ছোট করার চেয়ে কম্পোজে পাঠানোর আগেই নিয়ন্ত্রণ করতে চাইতাম। আর তাই আলম ভাইয়ের লেখাটি সম্পাদনা হয়ত করতাম না, কিন্তু আয়তনের হিসাবের জন্য ঠিকই হাতে নিতাম।
সম্পাদনা ছাড়াও আর একটা কাজ আমাকে নিয়মিত করতে হতো, সেটা হচ্ছে নিয়মিত বিভাগগুলোর লেখা তৈরি করা। নিয়মিত বিভাগ বলতে শুরুর দিকে ছিল চিঠিপত্র, আন্তর্জাতিক খবর, খেলাধুলা, এইসব। পরে অবশ্য নিয়মিত বিভাগ আরও বেড়ে যায়। যোগ হয় কুইজ, মত-পাল্টামত, টেলিভিশন সমালোচনা, সুগন্ধা স্পেশালÑ এ রকম আরও কিছু।
কুইজের ব্যাপারে আমার আগ্রহ সেই শৈশব থেকেই। পরে সাপ্তাহিক যায়যায়দিনে প্রথম আমি এর গতিশীল উপস্থাপনা দেখি। যায়যায়দিন তার শেষের পৃষ্ঠায় এগুলো ছাপত। প্রতিসংখ্যায় দুটি করে সমস্যা দেওয়া থাকত, সেই সঙ্গে সঠিক উত্তরদাতার জন্য পুরস্কারের ব্যবস্থা। সঠিক উত্তরদাতাদের মধ্যে থেকে দু’জনকে দেওয়া হতো একশ টাকার প্রাইজবন্ড। আমি নিয়মিত পাঠাতাম। প্রায় সবগুলোর উত্তরই আমি বের করতে পারতাম। কিন্তু পুরস্কারের ভাগ্য আর হতো না আমার। বুঝতাম, হয়ত অনেকেই সঠিক উত্তর দিতে পেরেছে, লটারিতে আমার নাম উঠেনি। তবে একবার আমি পুরস্কার পেয়েছিলাম। সেবার প্রশ্নটা বেশ কঠিন ছিল। সঠিক উত্তর দিতে পেরেছিল মাত্র দুজন। সেখানেও দেখলাম, ওই দুজনের মধ্যে আমার নাম দুই নম্বরে। বুঝলাম, সঠিক উত্তরদাতা তিনজন হলেই আমার খবর হয়ে যেত। যাই হোক, একশ টাকার প্রাইজবন্ড পেয়েছি, এই খবর সকালেই হলের অনেক বন্ধুর মাঝে চাউড় হয়ে গেল। সবাই ধরল, পুরস্কার পেয়েছ, এবার খাওয়াতে হবে।
আমি যতই বলি, পুরস্কারের ঘোষণাটি হয়েছে, হাতে তো এখনো পাইনি। কিন্তু তাতে কোনো কাজ হয় না। কে শোনে কার কথা। অতএব সেই সকালে অনেককেই নাস্তা করাতে হলো আমার। এক শ টাকা পুরস্কার হাতে পাওয়ার আগেই একশ বিশ টাকার মতো বের হয়ে গেল পকেট থেকে। ওই সপ্তাহেই যায়যায়দিন থেকে আমার ২৪৪ ফজলুল হক হলের ঠিকানায় একটি চিঠি এলো। অনেক উত্তেজনা নিয়ে সেটি খুললাম। শফিক রেহমান স্বাক্ষরিত ইংরেজিতে লেখা একটি চিঠি। তাতে কুইজে অংশ নেওয়া এবং বিজয়ী হওয়ার জন্য অভিনন্দন। আর সেই সঙ্গে প্রাইজবন্ড কেনার জন্য একশ টাকার একটি চেক। চেকটি আবার একাউন্ট পেয়ি। কিন্তু আমার কোনো ব্যাংক একাউন্ট তখন ছিল না। বন্ধুরা বলল, কোনো ব্যাংকে গিয়ে একাউন্ট করে ফেল। একবার এক ব্যাংকে গেলামও। তারা বলল, একাউন্ট করতে কমপক্ষে পাঁচশ টাকা লাগবে। পাঁচশ টাকা তখন আমার পকেটেই থাকত খুব কম, মাসের শুরুর দিকে যখন টিউশনি থেকে বেতন পেতাম, তখন হয়ত ওই রকম অঙ্কের একটা অর্থ থাকত। কিন্তু তার সিংহভাগ দিয়ে ব্যাংক একাউন্ট খুললে বাকি মাস চলবে কিভাবে? এই চিন্তা থেকে ব্যাংক একাউন্ট আর খোলা হয়নি। শফিক রেহমানের স্বাক্ষরিত চেকটা এরপরও অনেকদিন আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল। যতœ করে রেখে দিয়েছিলাম। তারপর হল ত্যাগের পর একসময় সেটা যেন কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল। এরও অনেক বছর পর, একসময় আমি শফিক রেহমানের পত্রিকায় কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। তখন একদিন গল্পচ্ছলে তাঁকে বলেছিলাম সেই চেক পাওয়া এবং সেটি না ভাঙানোর কথা। তিনি খুবই হাসলেন। বললেন, তাহলে তুমি তো আমার কাছে এখনো একশ টাকা পাও!
আমি চাইলাম, সুগন্ধায় ওই যায়যায়দিনের অনুকরণে কুইজ বা আইকিউ জাতীয় কিছু চালু করতে। বিষয়টি আলম রায়হানকে বললেন। তিনি বললেন, পারলে করেন। তবে আমি কিন্তু টাকা পয়সা কিছু দিতে পারব না। এমনিতেই ওস্তাদের আমলের বিশ্বকাপ কুইজের পুরস্কার দেওয়া নিয়ে মহাঝামেলায় আছি, সমস্যা আর বাড়াতে চাই না।
‘ওস্তাদ’ বলতে তিনি খোন্দকার মোজাম্মেল হককে বুঝাতেন। তিনি থাকতে বিশ্বকাপ ফুটবলের উপর একটা কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। তাতে নানা ধরনের অনেক পুরস্কারের ঘোষণা ছিল। পুরস্কারের মধ্যে টেলিভিশন, ক্যামেরা ইত্যাদি অনেক লোভনীয় বস্তু ছিল। হিসাব করে দেখা গেল, সব পুরস্কার দিতে গেলে আমাদের মোটামুটি লাখ দুয়েক টাকা লেগে যাবে। কিন্তু এত টাকা আসবে কোথা থেকে। মালিককে বললে, টাকার আতঙ্কে তিনি হয়ত পত্রিকাই বন্ধ করে দিতে চাইবেন।
আমি বললাম, এত পুরস্কার দেওয়ার অঙ্গীকার করতে গেলেন কেন? আর যে রকম সহজ প্রশ্ন করা হয়েছে, তাতে প্রথম, দ্বিতীয়, সব পুরস্কারই দিতে হবে। আর যদি পুরস্কার না দেন, তাহলে মানসম্মান বলে আর কিছু থাকবে না।
আমি তখন পুরস্কারপ্রাপ্তদের কাছ থেকে সে সময়ে যে সব ফোন আসত, তার দু-একটার কথা তাকে বললাম। পুরস্কার দেওয়া তো দূরে থাক, আমরা বিজয়ীদের নাম পর্যন্ত ঘোষণা করিনি তখনো। অথচ কথা ছিল, বিশ্বকাপ শেষ হওয়ার পরপরই একটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেয়া হবে।
প্রতিদিনই ফোনের সংখ্যা বাড়তে থাকলো। শুরুর দিকে তাগাদা, শেষ দিকে তা গালাগালিতে পরিণত হতে থাকলো। যে-ই ফোন করত, আমরা মুখস্থ উত্তর দিতাম, বলতামÑএই তো আর কয়েকদিনের মধ্যে লটারি করে বিজয়ী নির্বাচন করা হবে। কয়েক হাজার চিঠি এসেছে, সব চিঠি খুলতে হচ্ছে। কে সঠিক সেটা দেখতে হচ্ছে। এতে একটু সময় লাগছে।
আসলেই অনেক চিঠি এসেছিল। সব চিঠি বিরাট একটা বাক্সে জমা হয়েছিল। আর কিছু ছিল ছালার বস্তায়। এতটুকু সত্য। কিন্তু ওই যে বলতাম-সব চিঠি খোলা হচ্ছে, ভুল-শুদ্ধ চেক করা হচ্ছে-সেটা সর্বৈব মিথ্যা। কোনো চিঠিই আমরা তখন পর্যন্ত খুলিনি।
এসব অপমানজনক ফোন ও চিঠির পর আলম ভাইকে বললাম, এর একটা সুরাহা করা দরকার। তিনি বললেন, সমাধান তো আমিও করতে চাই, কিন্তু কিভাবে করব। এতগুলো টাকা কোথা থেকে আসবে? কে দেবে? আপনি দেবেন? পারলে দিয়ে দেন।
একটু পর আবার বললেন, বুঝলেন, আসলে ওস্তাদ ওস্তাদই। সে বুঝিয়ে দিয়ে গেছে, তার বুদ্ধির কাছে আমরা শিশু। এমন এক ঝামেলা তৈরি করে দিয়ে গেছে যে, পত্রিকা বের করব কি, এটা নিয়েই অস্থির থাকতে হচ্ছে। আমার কি মনে হয় জানেন, এই যে লোকজন ফোন করে, চিঠি লিখে, এ গুলোও তারই লোকজন। তিনিই করাচ্ছেন।
ঝামেলাগুলো কিভাবে হচ্ছে, কেন হচ্ছে, কার কারণে হচ্ছেÑএসব নিয়েই আলোচনা হলো। কিন্তু জানা গেল না কিভাবে এর সমাধান হবে।
আমি বললাম, আলম ভাই সবই তো বুঝলাম। কিন্তু এখন করণীয় কি? কিভাবে এর সমাধান করবেন, সেটা বলেন।
-আমার কাছে কোনো বুদ্ধি নেই। আপনি বলেন।
-বুদ্ধি একটা আছে, বিজয়ী যারা হয়েছে আমরা তাদের নাম ঘোষণা করি। তারপর ডাক যোগে পুরস্কার পাঠিয়ে দিই।
-পুরস্কার কোথা থেকে দেবেন? আছে নাকি আপনার কাছে?
বললাম, আমার কাছে একটা বুদ্ধি আছে। প্রথম তিন চারটা পুরস্কার, যেগুলো বেশি টাকার, সেগুলো আমরা দেব না। নিচের দিকেরগুলো দিয়ে দেব। এই সব মিলিয়ে ধরুন গিয়ে হাজার দশেক টাকা ব্যয় হবে।
-সেটা কিভাবে সম্ভব? নাম ঘোষণা যখন করবেন, তখন প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম বলবেন না?
-বলব, অবশ্যই বলব। তবে ওই পুরস্কারপ্রাপ্ত হিসাবে যাদের নাম ঘোষণা করা হবে, তাদের আসলে কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। আজগুবি তিনজনের নাম ঘোষণা করব। এবং সেই সঙ্গে এমন একটা ঠিকানা দেব, যা সত্য কি মিথ্যা যাচাই করা কারও পক্ষেই সম্ভব না হয়। আর যেহেতু কোনো অনুষ্ঠান করব না, ডাকযোগে পাঠিয়ে দেব বাকি পুরস্কারগুলো, তাই বিষয়টি নিয়ে কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতেও পড়তে হবে না।
আলম ভাই আমার সঙ্গে একমত হলেন। পরের সংখ্যাতেই আমরা পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করলাম। আজ এতদিন পর সঠিক মনে নেই, ১৫ কি ২০ জনের নাম ঘোষণা করা হলো বিজয়ী হিসেবে। সেই সঙ্গে বলা হলো, প্রথম পাঁচজনকে অফিসে এসে পুরস্কার নিতে হবে, বাকিদের ডাকযোগে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এই প্রথম পাঁচজনের মধ্যে চতুর্থ এবং পঞ্চম পুরস্কারপ্রাপ্ত অফিসে এসে নিয়ে গেলেন তাদের পুরস্কার। আর প্রথম তিনজন কখনোই এলেন না, কারণ তাদের কোন অস্তিত্বই ছিল না। আসলে একেবারেই অস্তিত্ব ছিল না, এমন নয়। লোকগুলো ছিল, তারা আমাদেরই আত্মীয় স্বজন এবং এমন লোক যারা কখনোই এই পুরস্কার দাবি করবে না।
জটিলতম ঝামেলার এমন সহজ সমাধানে সবাই খুশি হলো। আমিও অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে প্রতারণামূলক একটা কাজ করে বেশ একটা বাহাদুরির আবেশ অনুভব করলাম। ওই সময়ের এই কাজটির জন্য আজও আমি অত্যন্ত গ্লানি অনুভব করি। কিন্তু আবার পাশাপাশি এটাও মনে হয়, আবার যদি আমাকে এই ধরনের কোনো সমস্যায় পড়তে হয়, যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করি তার স্বার্থে ছোটখাটো কোনো প্রতারণার আশ্রয় নিতে হয়, তাহলে কি আমি তা করব না?
আসলে আমি জানি না, কি করব। হয়ত মানুষ নিজেই জানে না যে, সে কখন কি করবে।
বিশ্বকাপ কুইজের পুরস্কার প্রদান জটিলতার সমাধানের পর আমি সুগন্ধার পাতায় নিয়মিত কুইজ আয়োজনের প্রস্তাব করলাম। আলম ভাইয়ের সরল স্বীকারোক্তি-আমি ভাই কুইজ টুইজ বুঝি না। এটা চালালে কি লাভ হবে, সেটাও বুঝতে চাই না। আপনি কেবল বলেন, এতে আমাদের খরচ কত হবে। আবার আগের মতো কোনো ঝামেলায় পড়ব না তো?
আমি বললাম, প্রতি সপ্তাহে আমাদের তিনশ টাকার বেশি খরচ হবে না।
Ñ ঠিক তো? মাত্র তিনশ টাকা?
কিছুটা অবিশ্বাসের ভঙ্গিতেই জানতে চাইলেন তিনি।
-হ্যাঁ, তিন শ টাকাতেই হয়ে যাবে। আমরা যায়যায়দিন স্টাইলেই কুইজ দেব।
শুরু থেকে বন্ধ হয়ে যাওয়া পর্যন্ত, যায়যায়দিনের সব কয়টি সংখ্যাই আমার কাছে ছিল। সেখান থেকে কয়েকটা সংখ্যা এনে আলমভাইকে দেখতে দিলাম। তিনি বললেন, দেন দেখি।
নিয়ে তিনি খুব মনযোগ দিয়ে পড়া শুরু করলেন। আমি আর তাকে ডিস্টার্ব করলাম না। পরদিন এনিয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে হতাশ হলাম।
বললাম, যায়যায়দিনের কপিগুলো পড়েছেন?
Ñহ্যাঁ পড়েছি। আসলেই শফিক রেহমান ব্রিটিশ মাল। কথা কিভাবে বলতে হয়, কিভাবে আকারে ইঙ্গিতে মারতে হয়, তার মতো আর কেউ জানে বলে মনে হয় না।
এভাবে শুরু করে তিনি যায়যায়দিনে কি কি তার ভালো লেগেছে, কেন ভালো লেগেছে, আমাদেরও ওই রকম করার চেষ্টা করা উচিত- এই সব সবিস্তারে বলতে লাগলেন। তার ভালো লাগার বিষয়গুলোর মধ্যে রাজনীতি বিষয়ক লেখাগুলোর কথাই বারবার এলো। এমনকি মুনওয়ার বখত নামে এক ব্যক্তি যে টেলিভিশন সমালোচনা লিখতেন, সেটির প্রশংসাও করলেন তিনি। কিন্তু একটি কথাও বললেন না যায়যায়দিনের আইকিউ বিভাগটি নিয়ে। অথচ সেটি দেখার জন্যই আমি দিয়েছি তাকে পত্রিকাগুলো।
বললাম, আইকিউগুলো দেখেননি?
Ñ না, ওগুলো তো দেখা হয়নি।
Ñ তাহলে?
Ñ আমার দেখার দরকার নেই, ওসব আমি বুঝি না।
তারপরও আমি অনেকটা জোর করে তাকে দেখালাম কয়েকটা কুইজ। তিনি দেখলেন। বললেন, দেখেন এখানে সমস্যাগুলোকে কি সুন্দর গল্পের মতো করে লিখেছে। এভাবে পারবেন?
Ñ না পারার তো কোন কারণ দেখি না।
এখানে আমার এই আত্মবিশ্বাসের কারণটা একটু ব্যাখ্যা করা যেতে পারে।
যায়যায়দিনের আইকিউগুলো আমি প্রায় নিয়মিত দেখতাম। দেখতাম আর ভাবতাম, এত চমৎকার আর বুদ্ধিদীপ্ত পাজলগুলো তারা পায় কোথা থেকে। আসলে এইসব ধাঁধা, পাজল আমার সেই ছোটবেলা থেকেই খুব প্রিয় সাবজেক্ট।
আলম ভাই যখন আমাকে বললেন, আমি অতটা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারব কিনা, বিষয়টা আমার জন্য কিছুটা চ্যালেঞ্জ বলেই মনে হলো। প্রথমত, ঠিক করলাম ছোট বেলায় ধাঁধা হিসাবে যেসব শুনতাম, জানতাম, সেগুলোকেই কিছুটা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, গল্পের মধ্যে পাঞ্চ করে দেব। আর স্টক ফুরিয়ে এলে, হাত বাড়াব যায়যায়দিনের দিকে। গল্পটা পাল্টে, নতুন পটভূমিতে নতুনভাবে উপস্থাপন করব সমস্যাগুলোকে।
এর মধ্যে একদিন নিউমার্কেটে গেলাম, বইয়ের দোকানগুলোতে। জানতে চাইলাম, তাদের কাছে পাজল- এর কোনো বইপত্র আছে কি না। ‘রিডলস অ্যান্ড টিজার’ নামের একটা বই তারা বের করে দিল। এর কয়েকটা পৃষ্ঠা উল্টিয়ে আমি অনেকটা হতবাক হয়ে গেলাম। আরে, এটা তো যায়যায়দিনের আইকিউ পাতার ইংরেজি সংস্করণ। মনে হলো, ওই ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ৮০ শতাংশ পাজলই এই বই থেকে নেওয়া হয়েছে। কিছু সময় খোঁজাখুঁজি করতেই আরও কয়েকটি পাজল-এর বই পেয়ে গেলাম। সব মিলিয়ে শ’তিনেক টাকা ব্যয় করে যা পেলাম, তা দিয়ে বছর তিনেক আমি কাজ চালাতে পারব।
কুইজের এই বিভাগটা তখন খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তবে বিশ্বকাপ ফুটবল থেকে আমাদের একটা বড় শিক্ষা হয়েছিল। পুরস্কার দেওয়ার ব্যাপারে আমরা খুবই সিরিয়াস হয়ে গেলাম। শফিক রেহমানের কাছ থেকে চেক পাওয়া এবং তা না ভাঙানোর ঘটনাটি আলম ভাইকে বললাম। জানালাম, আমরাও চেক দেব, একাউন্টপেয়ী চেক। আর সেই সঙ্গে থাকবে চমৎকার ভাষায় লেখা একটা চিঠি। সেইভাবেই শুরু হলো। ফলও পাওয়া গেল দ্রুত, জনপ্রিয়তা বেড়ে গেল এই পাতাটির। প্রতি সপ্তাহে হাজার হাজার চিঠি আসতে থাকল। পাঠকদের সংশ্লিষ্টতা বাড়াতে পরে আমরা পুরস্কারের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলাম।
এভাবেই নতুন বিভাগে যুক্ত হলো টেলিভিশন সমালোচনা। দর্শক সম্পৃক্ততা বাড়াতে সেখানেও ছিল নানা প্রতিযোগিতা আর পুরস্কারের ব্যবস্থা। নতুন এই বিভাগটি চালু হলো আমারই পরামর্শে, আর এর সব কাজকর্ম, লেখালেখি থেকে শুরু করে প্রতিযোগীদের চিঠিপত্র বাছাই, পুরস্কার দেওয়া, সবই আমি করতাম। এটা খুবই জনপ্রিয় হয়ে গেল। তবে এটা কিন্তু নতুন কিছু ছিল না। ওই সময়ে বন্ধ থাকা যায়যায়দিনের অনুকরণে এ কাজটি করেছিলাম। এ রকম নকল করে আরও কয়েকটা নতুন বিভাগ চালু করলাম। সে হিসাবে বলা চলে, আমি ছিলাম বিশিষ্ট নকলবাজ। দেশি-বিদেশি প্রচুর ম্যাগাজিন দেখতাম। যেখানে যেটা ভালো লাগত, নকল করে চালিয়ে দিতাম সুগন্ধায়।
কেবল নতুন নতুন বিভাগই নয়, রাজনৈতিক নিবন্ধের ক্ষেত্রেও আমরা নতুন কিছু করতে চেষ্টা করলাম। চালু সাপ্তাহিকের মধ্যে তখন ছিল বিচিত্রা, রোববার, পুর্ণিমা, কাগজ, বিচিন্তা, সন্দ্বীপ, বিক্রম, আজকের সূর্যোদয়। ওই সময় দেশে সাপ্তাহিক পত্রিকায় নতুন একটা ধারা দেখা যায়। বিভিন্ন পত্রিকা ও সংবাদ মাধ্যমে কর্মরত খ্যাতিমান সাংবাদিকদের কলাম ছাপা হতো সাপ্তাহিকগুলোতে। কে কতো বিখ্যাত এবং বেশি সংখ্যক কলামিস্টকে তাদের সাপ্তাহিকে সম্পৃক্ত করতে পারে, তা নিয়ে একধরনের প্রতিযোগিতাও লক্ষ্য করা যেত। সুগন্ধায় ওই সময় নিয়মিত কলাম লিখতেন আবেদ খান, নাজিম উদ্দিন মোস্তান, মতিউর রহমান চৌধুরী, আজিজুল হক বান্না, ওবায়দুল কাদের, সাহজাহান সরদার (ইনি লিখতেন সাজু সরদার নামে)। এরা সবাই তখন বিভিন্ন মিডিয়াতে প্রতিষ্ঠিত সাংবাদিক ছিলেন। ওবায়দুল কাদের ছাড়া অন্য সবাই এখনও মিডিয়াতেই আছেন। আজকের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের তখন ছিলেন বাংলার বাণী’র সাংবাদিক। আমাদের আর একজন নিয়মিত কলাম লেখক ছিল। তার নাম রামকৃষ্ণ সাহা। এই ভদ্রলোক ঢাকায় থাকতেন না, থাকতেন সিরাজগঞ্জ বা এ রকম কোনো একটা জায়গায়। সম্ভবত একসময় বামপন্থি রাজনীতি করতেন। তিনি আসলে অন্যদের মতো প্রতি সপ্তাহে লেখা পাঠাতেন না, একবারে বড় একটা লেখা পাঠাতেন, সেখান থেকেই কিছু কিছু অংশ আমরা ধারাবাহিকভাবে ছাপতাম।
কলাম হিসেবে আরও ছাপতাম আমরা আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা। অন্য সব লেখককে লেখার জন্য সম্মানী দেওয়া হলেও গাফফার চৌধুরীকে কিছু দিতে হতো না। কারণ তিনি তো আমাদের লেখা দিতেন না, তার লেখাটি ছাপতাম আমরা চুরি করে। এই ‘চুরি’ শব্দটা নিয়ে কেউ কেউ হয়ত আপত্তি করতে পারেন। কিন্তু আমার কাছে কাজটিকে এখন যেমন চুরি মনে হয়, তখনও তেমনি চুরিই মনে হতো।
আবদুল গাফফার চৌধুরী থাকতেন লন্ডনে। সেখানে স্থানীয় বিভিন্ন বাংলা কাগজে তিনি লিখতেন। সুগন্ধা’র মালিক মোয়াজ্জেম সাহেব একবার কি এক প্রয়োজনে লন্ডন গেলেন, ফেরার সময় সেখানকার কয়েকটি বাংলা কাগজ নিয়ে এলেন। তার একটিতে গাফফার চৌধুরীর লেখা ছিল। সেটি পড়ে মোয়াজ্জেম সাহেব রীতিমতো উত্তেজিত। বললেন, দেখেন কি দারুণ লিখেছে। এক কাজ করেন, এই লেখাটি আমাদের এখানে ছেপে দেন।
লেখাটা আসলেই বেশ ভালো ছিল, তাতে তৎকালীন আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার কিছু সমালোচনা করা হয়েছিল। আর গাফফার চৌধুরী লেখেনও খুব ভালো, পড়তে ক্লান্ত লাগে না। কিন্তু ওই অন্য পত্রিকার লেখা আমরা ছাপব কিভাবে? আমাদের পাঠকরা বিষয়টিকে কিভাবে নেবে? আর তারও চেয়ে বড় কথা, লন্ডনের ওই পত্রিকাটিই বা কি ভাববে? আমি এসব প্রশ্ন তুলতেই আলম ভাই বললেন, আরে দূর, আপনি বেশি চিন্তা করেন। আমাদের পাঠকরা লন্ডনের ওই পত্রিকা সম্পর্কে জানেই না। তাছাড়া তিনি এই লেখাটা লিখেছেন কেন? নিশ্চয়ই পাঠকদের জানানোর জন্য। তার হয়ে আমরা বিষয়গুলো সুগন্ধার পাঠকদের জানিয়ে দিলাম। এতে অন্যায় তো দেখি না!
এর মধ্যে আর একটা ঘটনা হলো। ঢাকায় তখন অন্যতম জনপ্রিয় পত্রিকা ভোরের কাগজ। রাজনীতি সচেতন এবং তরুণ সমাজের মধ্যে এটি খুবই জনপ্রিয় ছিল। সেখানেও আবদুল গাফফার চৌধুরীর কলাম ছাপা হতো। ভোরের কাগজের পুরনো কপিগুলো ঘাটতে ঘাটতে একদিন হঠাৎ দেখলাম, যে লেখাটি আমরা লন্ডনের কাগজ থেকে মেরে দিয়ে সুগন্ধায় ছেপেছি, সেটি ভোরের কাগজেও ছাপা হয়েছে! তার মানে, ওই দুই পত্রিকার কোনো একজন অন্য পত্রিকা থেকে লেখাটি মেরে দিয়েছে। অথবা গাফফার চৌধুরী সাহেব নিজেই তার লেখা দুই কাগজে দিয়েছেন! তবে যাই হোক, এর পর আমরা তার লেখা চুরি করে ছাপার একটা জোরাল অজুহাত পেয়ে গেলাম।
এর পর আর ওই লেখা খুঁজে পেতে লন্ডনের কোনো পত্রিকার উপর নির্ভর করতে হলো না, ঢাকার ভোরের কাগজ থেকেই নির্লজ্জের মতো নিয়ে নিতাম। পুরো বিষয়টাতেই আমার মন সায় দিত না, আমাদের পাঠকদের এভাবে বোকা বানাতে ভালো লাগত না। বলতামও আমি তা। কিন্তু নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে আলম ভাই মালিকের পক্ষই নিলেন। বললেন, ভোরের কাগজ আর আমাদের পাঠক তো এক নয়।
একদিন মোয়াজ্জেম সাহেব এসে বললেন, এক কাজ করেন, ওই লেখাটির নিচে ছোট্ট করে লেখে দেন- ‘সৌজন্যে- ভোকা’। তারপর নিজেই এর একটা ব্যাখ্যা দিলেন, বুঝলেন না, ‘ভোকা’ মানে ভোরের কাগজ।
কিন্তু কারও সৌজন্যে কিছু ছাপতে গেলে যে সেই প্রতিষ্ঠানের অনুমতি নেওয়া দরকার, একথা কে বলবে তাকে? নির্বাহী সম্পাদক হিসেবে আলম ভাই বলতে পারতেন, কিন্তু তিনি বলেছেন বলে মনে হলো না। বরং তার মধ্যেও গাফফার চৌধুরীর লেখা ছাপার একটা আগ্রহ কাজ করত।
একদিন একটা কা- হলো। সুগন্ধায় একটা চিঠি এলো। তাতে একজন লিখেছেন, সুগন্ধায় আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা তিনি নিয়মিত পড়েন। এটা তার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু মাঝে একদিন তিনি দেখলেন, এই লেখাটাই ভোরের কাগজে ছাপা হয়েছে। এই যে সুগন্ধা থেকে চুরি করে ভোরের কাগজ ছাপল, এর জন্য আমরা তাদেরকে কেন কিছু বলছি না?
আলম ভাই বললেন, দেখেছেন? সুগন্ধার পাঠকরা আমাদেরটিকেই আসল মনে করছে!
কলাম যারা লিখতেন তাদের মধ্যে সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা এবং বয়সের দিক দিয়ে সবচেয়ে জুনিয়র ছিলেন ওবায়দুল কাদের। এটা অবশ্য আমাদের মতো। আমরা এ রকমই মনে করতাম। সেভাবেই আমরা ট্রিটমেন্ট দিতাম। তিনি নিজে হয়ত তেমনটি মনে করতেন না। এ নিয়ে একবার বেশ একটা ঝামেলাও হলো। প্রচ্ছদে আজিজুল হক বান্না’র নাম ছাপা হলো ওবায়দুল কাদেরের উপরে, লেখাটিও ছাপা হলো আগের পৃষ্ঠায়। এ নিয়ে কাদের ভাই সরাসরি আপত্তি জানালেন।
আপত্তির কারণটা আমরা বুঝি। বান্নাভাই তখন কাজ করতেন খুব সম্ভবত দৈনিক মিল্লাতে। এটি ছিল ফ্রিডম পার্টির পত্রিকা। সেই হিসেবে তাকে ওই ঘরানার সাংবাদিক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। তাছাড়া তার লেখালেখিও ছিল ওই রকম কট্টর আওয়ামী বিরোধী। আমাদের সম্পাদকীয় নীতি ছিল যে, আমরা সব লাইনের লেখককেই এখানে জড়ো করব। তাতে করে, আওয়ামী লীগ, বিএনপিÑ সব দলের সমর্থক পাঠকের চাহিদাই পূর্ণ হবে। এটা সম্ভবত ১৯৯১ সালের শেষ দিকের কথা। জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে গেছে। বিএনপি ক্ষমতায়। কিন্তু পরাজয়কে মেনে নিতে পারছে না আওয়ামী লীগ ও তার নেতা-কর্মীরা। শেখ হাসিনা বলেছেন, সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে। এই সময় বান্নাভাই একটা লেখায় দেশের মানুষ কেন আওয়ামী লীগকে প্রত্যাখ্যান করেছে, তা নিয়ে বিস্তারিত বললেন। বিজয়ীর পক্ষে যুক্তি সবসময়ই সহজে দেওয়া যায়। ফলে তার যুক্তিগুলোও বেশ তীক্ষè হলো। কাকতালীয়ভাবে, সেই সংখ্যাতেই ওবায়দুল কাদের যে লেখাটি দিলেন, সেটি ছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় কিভাবে ছিনতাই হয়ে গেল, সে বিষয়ে। কাদের ভাইয়ের লেখাটিতে যুক্তির চেয়ে আবেগ ছিল বেশি। লেখা দুটি আমরা পাশাপাশি ছাপলাম। আগে বান্না ভাইয়েরটি, পরে কাদের ভাইয়েরটি। লেখা দুটি পাশাপাশি পড়লে বান্না ভাইয়েরটিই বেশি ভালো লাগবে। অন্তত আমার কাছে ওই সময় তাই লেগেছিল। এমনিতেও লেখক হিসেবে বান্না ভাইকে আমার কাছে শার্প মনে হতো।
ওই সংখ্যাটি প্রকাশের পর ওবায়দুল কাদের খুবই মন খারাপ করলেন। মন খারাপ করাই স্বাভাবিক। কিন্তু নিজের লেখার গুণগতমান নিয়ে তো বলা কিছু নেই। তাই তিনি ধরলেন অন্য একটা বিষয়। বললেন, বান্না ভাইয়ের লেখা কেন তার আগে ছাপা হয়েছে। মন খারাপ থেকে অভিমান। কিন্তু আমরা তার ওই অভিমানকে খুব একটা পাত্তা দিলাম না। আমাদের ওই ঔদ্ধত্য হয়ত তিনিও পছন্দ করলেন না। এরপর থেকে তিনি লেখা ছেড়েই দিলেন। বিষয়টাকে আমরা তেমন গুরুত্বের সঙ্গে নিলাম না। কারণ তিনি না লিখলেও আওয়ামী ঘরানার আরও অনেক লেখকই তখন আমাদের ম্যাগাজিনে কলাম লিখতেন।
আসলে কেবল কলাম লেখকই নয়, ওই সময় সাংবাদিকদের মধ্যেও আওয়ামী ঘরানার লোক ছিল বেশি। ১৯৯১ সালের সেই নির্বাচনের কথাই ধরা যাক। নির্বাচনের প্রচারণা যখন চলছে, তখনকার পত্রিকাগুলো পড়লে যে কারোরই মনে হবে, আওয়ামী লীগের কাছে কোনো পাত্তাই পাবে না বিএনপি। আমরাও ওই ধারার বাইরে ছিলাম না। কলাম লেখক, কন্ট্রিবিউটার, যারই আসতেন আমাদের অফিসে, আমরা প্রসঙ্গটা তুলতাম। জানতে চাইতাম কে জিতবে? সবাই যারা যার যুক্তি দিতেন। তখন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমেদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সাহাবুদ্দীন সাহেব যেভাবে চালাচ্ছিলেন, সবার মনেই একটা দৃঢ় ধারণা ছিল, আর কিছু না হোক নির্বাচনটা খুবই সুষ্ঠু হবে। সবাই তাই বলতেন, আওয়ামী লীগই ক্ষমতায় যাবে। কারণ দেশের অনেক জায়গাতেই বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা তেমন ভালো নয়।
একদিন নাজিমুদ্দিন মোস্তান ভাইয়ের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। তিনি তখন ইত্তেফাকের জাঁদরেল রিপোর্টার। উল্টা তিনিই আমাদের প্রশ্ন করলেন, আচ্ছা বলুন তো, তেজগাঁও এলাকায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিএনপি প্রার্থী করেছে মেজর (অব.) মান্নানকে। এই ভদ্রলোক ব্যবসা বাণিজ্য করেন, ভালো টাকা-পয়সা আছে। মনোনয়নের জন্য প্রথমে গিয়েছিলেন তিনি শেখ হাসিনার কাছেই। কিন্তু হাসিনা তাকে মনোনয়ন দেবেন কেন? এই লোকের তো কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ই নেই। অথচ ভদ্রলোকের নির্বাচন করার শখ। এরপর তিনি গেলেন খালেদা জিয়ার কাছে। খালেদা জিয়া কি করলেন? শেখ হাসিনার বিরুদ্ধেই তাকে মনোনয়ন দিয়ে দিলেন। আচ্ছা আপনারাই বলেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মেজর মান্নান, হলো কিছু?
এই বলে তিনি ঢাকা শহরেরই আরও কিছু প্রার্থীর উদাহরণ টানলেন। পুরনো ঢাকায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিএনপির প্রার্থী হয়েছেন সাদেক হোসেন খোকা। মিরপুরে ড. কামাল হোসেনের মতো নেতার বিরুদ্ধে হারুন আল রশীদ মোল্লা! অথচ এই হারুন মোল্লা সারা জীবন আওয়ামী লীগ করেছেন। এবার ড. কামালকে যেহেতু মিরপুর থেকে মনোনয়ন দিতে হবে, তাই তাকে টিকিট দেয়নি আওয়ামী লীগ। তখন বিএনপি তাকে ডেকে নিয়ে মনোনয়ন দিল।
আমরা সাদা চোখে বিশ্লেষণ করতে লাগলাম। আলম ভাই বললেন, নির্বাচনের ঠিক আগে আমাদের যে সংখ্যাটি বের হবে, তাতে আমরা একটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতো করব। লেখাটা খুব মুন্সিয়ানার সঙ্গে হতে হবে। দু’পক্ষের কথাই বলা হবে, তবে একদিকে একটু ঝুঁকে থাকব। বোঝাই যাচ্ছে যে, আওয়ামী লীগ জিতবে, তাই সেদিকেই একটু ঝুঁকতে হবে।
তারপরও বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে আমরা কথা বলতে লাগলাম। বিশেষ করে আমাদের অফিসে যারা আসত, সেই সাংবাদিকদের সঙ্গেই আমাদের আলাপ হতে থাকল নানা দিক দিয়ে। সকলেরই এক কথা, পাত্তাই পাবে না বিএনপি। এদের মধ্যে ব্যতিক্রম ছিলেন কেবল আলী মামুদ। তিনি তখন দৈনিক দিনকাল পত্রিকার রিপোর্টার। তখন কি তিনি এর চিফ রিপোর্টার ছিলেন? না হলেও পরে তিনি দিনকালের চিফ রিপোর্টার হয়েছিলেন।
মামুদ ভাই সুগন্ধায় লিখতেন। তবে তার লেখা নিয়মিত না হলেও আমাদের সঙ্গে তার আড্ডা হতো নিয়ম মেনে। খুবই চমৎকার মানুষ। তবে সমস্যা একটাই, বিএনপির অন্ধ সমর্থক ছিলেন। তো এই মামুদ ভাইকে একদিন জিজ্ঞাসা করলাম, কারা জিতবে নির্বাচনে?
মুহূর্ত বিলম্ব না করে তিনি জবাব দিলেন, কেন, বিএনপি জিতবে।
আমি একটু অবাক হলাম। তার উত্তরের অন্তর্নিহিত ভাব জানতে পেরে নয়, অবাক হলাম তার বক্তব্যের দৃঢ়তা দেখে। দারুণ একটা আত্মবিশ্বাস নিয়েই তিনি বললেন কথাটা। এর আগে বিএনপিপন্থি আরও কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয়েছে আমাদের। তারাও কেউ বলেনি যে বিএনপি জিতবে। বড়জোর বলেছে যে, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হতে পারে।
আমি বললাম, মামুদ ভাই কি বলছেন আপনি! বিএনপি তো ভালো কোনো প্রার্থীই দিতে পারেনি। জোড়াতালি দিয়ে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে। এই ঢাকা শহরেই দেখেন, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দুটি আসনে প্রার্থী দিয়েছে মেজর মান্নান এবং খোকাকে, এটা কিছু হলো?
-দেখবেন, শেখ হাসিনা এই দুইজনের কাছেই হারবে।
মামুদ ভাইয়ের সঙ্গে এতক্ষণ আমিই কথা বলছিলাম। পাশের টেবিলে বলে আলম ভাই একমনে লিখছিলেন। তার এই কথা শুনে তিনিও দেখলাম লেখা রেখে মামুদ ভাইয়ের দিকে তাকালেন। তার এই বক্তব্যকে আমার কাছে নিছকই পাগলামি মনে হলো। তারপরও তাকে একটু বাজিয়ে দেখতে ইচ্ছা হলো।
কিন্তু তার আগেই মামুদ ভাই বলতে লাগলেন, কে কত বড় নেতা সেটা বড় কথা নয়, ভোটের রাজনীতি আলাদা জিনিস। সারা দেশে এখন বিএনপির পক্ষে একটা জোয়ার উঠেছে, দেখবেন ঠিকই তারা ক্ষমতায় চলে আসবে। আর আওয়ামী লীগ নিজেদের জয় নিশ্চিত মনে করে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। এটাই তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।
তারপর বললেন, পুরান ঢাকায় খোকার কাছে পাত্তাই পাবে না শেখ হাসিনা। আর তেজগাঁওতে নোয়াখালী এলাকার অনেক ভোট আছে, সেগুলো সব পাবে মেজর মান্নান।
মামুদ ভাই চলে গেলে আমরা তার বক্তব্য নিয়ে হাসাহাসি করতে থাকলাম।
নির্বাচনের ঠিক আগের সংখ্যাটির কভার স্টোরি কে লিখেছিল, এখন ঠিক মনে নেই। তবে এতটুকু মনে আছে সেখানে এমন ইঙ্গিতই দেওয়া হয়েছিল যে, আওয়ামী লীগই জিততে যাচ্ছে। এই ধারণার আলোকে কামাল পাশা চৌধুরী তার প্রচ্ছদও এঁকে দিয়ে গেলেন। আমাদের প্রচ্ছদ হতো কার্টুন দিয়ে। কামাল পাশা চৌধুরী জাসদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। প্রতি সপ্তাহে লেখালেখির শেষ দিন এসে তিনি প্রচ্ছদের ছবিটি এঁকে দিয়ে যেতেন। ওই সংখ্যাটির প্রচ্ছদের ছবিটি ছিল এ রকম : নদীতে অনেক কুমির, হা করে আছে সেগুলো, তার মধ্যে দিয়েই তরতর করে নৌকা বেয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন শেখ হাসিনা। আর নদীর পাড়ে বসে তা বিরস বদনে দেখছেন খালেদা জিয়া।
সব ঠিকঠাক হওয়ার পর রাত ৮টার দিকে আমি চলে গেলাম। ওই রাতেই পেস্টিং হবে। পেস্টিং এ আলম ভাই, শহিদুল আজম, মোস্তফা কামাল থাকবে। পরদিন পত্রিকা প্রিন্ট হবে। তাই ওইদিন ছিল আমাদের অঘোষিত ছুটি। তারও পরদিন পত্রিকা বাজারে গেল। আমি অফিসে এসে পত্রিকা দেখে তো রীতি মতো হতবাক। দেখি প্রচ্ছদের ছবি পাল্টে গেছে, উল্টে গেছে মূল রিপোর্টের বক্তব্যও। সেখানে বিএনপিকে বিজয়ী দেখানো হয়েছে। প্রচ্ছদের ছবি পাল্টে গেছে মানে কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন কোনো ছবি বসানো হয়নি। কামাল পাশার ওই ছবিটির উপরই কিছু কাটাকাটি করা হয়েছে। নৌকা যেটা তরতর করে এগিয়ে যাচ্ছিল, সেটাকে কিছুটা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আগের ছবিতে খালেদা জিয়ার মুখ ছিল বিষণœ, নতুনটিতে আশান্বিত। এ রকম টুকটাক পরিবর্তন।
কেন এবং কিভাবে হলো এটা? আলম ভাই জানালেন, ওই রাতে পেস্টিংয়ের সময় মালিক মোয়াজ্জেম সাহেব এসেছিলেন অফিসে। তিনি নাকি অনেকটা চাপ দিয়েই করিয়েছেন এই কাজটি। তার চাহিদা অনুযায়ী তাড়াহুড়া করে আর একটি স্টোরি লেখা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে, শেষ মুহূর্তে নাকি জনগণের মনোভাব পাল্টে যাবে এবং নির্বাচনে বিজয়ী হবে বিএনপি। আর প্রচ্ছদের ছবিটিতে ক্যারিকেচার করেছে শহিদুল আজম।
আমি আলম ভাইকে বললাম, উনি বললেন আর আপনি করলেন? একবার বাস্তবতার দিকে তাকালেন না? বিএনপি তো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দূরে থাক, পাত্তাই পাবে না। এখন সব মিলিয়ে আমাদের ভূমিকাটা কি দাঁড়াল? এটা তো কেবল পক্ষপাতদুষ্টই হবে না, সেই সঙ্গে হঠকারীও হবে। কারণ দুদিন পরেই নির্বাচন। যখন সেখানে দেখা যাবে আমাদের রিপোর্ট ও প্রচ্ছদের বিপরীত ফলটি হচ্ছে, তার কতটা নেতিবাচক ফল পত্রিকাটির ওপর পড়বেÑএকবার ভেবে দেখেছেন?
আলম ভাই বললেন, আমি কি করব? পত্রিকা কি আমার না আপনার? পত্রিকা মালিকের। তিনি যদি চান আমরা কি করতে পারি? কাল তো আপনি ছিলেন না, যদি দেখতেন তার হাবভাব। তিনি জোর দিয়ে বললেন, তার কাছে খবর আছে যে, নির্বাচনে বিএনপিই জিতবে। তিনি এতটা জোর দিয়ে বললেন যে, আমরা যারা ছিলাম কেউই প্রতিবাদ করতে পারলাম না। তাছাড়া আর একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছেন নিশ্চয়ই, তিনি কিন্তু কখনোই পত্রিকার বিষয়বস্তু বা লেখালেখিতে তেমন একটা হাত দেন না। এবার যখন এত রাতে এসে দিলেন, তখন আমিও ভাবলাম, হয়ত এর পেছনে কিছু কারণ আছে।
কারণ যে কিছুটা ছিল, সেটা বুঝতে আমাদের বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি।
তবে আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম নির্বাচনের রেজাল্ট আসার পর আমরা পাঠকের কাছে মুখ দেখাব কিভাবে? ইতোমধ্যে অন্য ম্যাগাজিনগুলোও বাজারে চলে এলো। দেখলাম, সবাই সম্ভাব্য বিজয়ী দল হিসাবে আওয়ামী লীগের দিকেই ইঙ্গিত করছে।
কিন্তু আমার এই মন খারাপ ভাবটা বেশিদিন স্থায়ী হলো না। সবাইকে অবাক করে দিয়ে ১৯৯১ সালের সেই জাতীয় নির্বাচনে বিএনপিই বিজয়ী হলো। ঢাকার দুটি আসনেই পরাজিত হলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। যা নিয়ে গত কয়েকদিন আমরা লজ্জা পাচ্ছিলাম, সেটাই আমাদের জন্য গর্বের কারণ হয়ে দাঁড়াল।
এখানে বলে রাখা ভালো, সুগন্ধার মালিক সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসাইন নিজে এই নির্বাচনে প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। ঝালকাঠি থেকে তিনি বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে দেওয়া হয়নি। মনোনয়ন না পেলেও তার এই সাপ্তাহিকের মাধ্যমে তিনি বিএনপির প্রতি তার দায়বদ্ধতার একটা প্রমাণ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়নি।
কলাম লেখকদের পাশাপাশি আমাদের বেশ কিছু নিয়মিত লেখকও ছিল। এদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো পত্রিকায় কাজ করতেন। সেখানকার কাজের ফাঁকে আমাদের এখানে সপ্তাহে একটা বা দুটা লেখা দিতেন। কখনো ছোট ছোট বক্স আইটেম, আবার কখনো বা বড় কোনো রিপোর্ট। এদেরকে আমরা বেশ ভালো অঙ্কের সম্মানী দিতাম। ‘ভালো অঙ্ক’ কথাটা বললাম এ কারণে যে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যেত, সম্মানীর ফিগারটা প্রথম দিকে তাদের প্রত্যাশার চেয়েও বড় হতো। টাকাটা হাতে পাওয়ার পর অনেককেই বলতে শুনেছি- এত টাকা! এত ছোট্ট একটা লেখার জন্য এত টাকা!
জবাবে বলতাম, আমরা তো লেখা ছাপি না, লেখক ছাপি।
-মানে?
-মানে হচ্ছে, আপনি কি লিখেছেন, সেটা আমাদের জন্য খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আপনার মতো একজন লোক যে আমাদের পত্রিকায় লিখছেন, সেই বিষয়টা। আপনার নামটা আমরা সুগন্ধায় প্রকাশ করতে পারছি, সেটাই আমাদের বড় প্রাপ্তি।
এ কথার পর, আপাতদৃষ্টিতে খুশি না হওয়ার কোনো কারণ আর থাকে না। তারা প্রায় সবাই খুশি হতেন।
এই যে কথাটা বলতাম, এটা কিন্তু কেবলই লেখকদের খুশি করার জন্য নয়। আসলেই অনেকটা এভাবে ভাবতাম আমরা। আমাদের চিন্তা ছিল, যত বেশি লেখককে পারা যায়, সুগন্ধার পাতায় সংযুক্ত করা। মাঝেমধ্যে আলম ভাই কিছু বড় বড় সাংবাদিককে ধরে নিয়ে আসতেন, আপ্যায়ন করাতেন, তারপর বলতেন একটা কিছু লিখে দিয়ে যান। অনেকটা পীড়াপীড়ি করেই অনেক সময় তাদের কাছ থেকে ছোট্ট একটা বক্স আইটেম লিখিয়ে নিতেন।
বড় সাংবাদিক মানে, বেশ একটা পরিচিত আছে বাইরে। পরিচিতি থাকলেই যে, তিনি খুব ভালো লেখতে পারবেন, তার কিন্তু কোনো গ্যারান্টি নেই। আমার এত বছরের অভিজ্ঞতায়, এমন অনেক বড় সাংবাদিক দেখেছি, যারা লেখালেখিতে খুবই অপটু। তারপরও কিভাবে যেন সাংবাদিক হিসেবে তাদের বিশাল একটা নামডাক হয়ে যায়!
তো, সে রকম বড় সাংবাদিকদের যখন আলম ভাই ধরে আনতেন, স্পষ্টতই আমি বিরক্ত হতাম। আলম ভাই আমার বিরক্তিটা বুঝতে পারতেন। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরতেন না। একবার তিনি বিষয়টা আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন। বললেন, দেখুন, এরা যে খুব ভালো লেখতে পারেন না, সেটা আমিও জানি। কিন্তু তারপরও এদের তো বেশ একটা নামডাক হয়ে গেছে। একজন পাঠক যখন পত্রিকাটি হাতে নেয়, প্রথমেই কিন্তু সে সব লেখা পড়ে না। প্রথমে কেবল লেখকের নামগুলো দেখে। কারা কারা লিখেছে, সেটা দেখে। এই লোকজনের নাম তো পরিচিত, তাই তাদের নাম ছাপতে পারা আমাদের জন্য লাভজনকই। তাছাড়া তারা যে ভালো লেখতে পারে না, সেটা যদি সত্য হয়, তাহলে পাঠকরাই সেটা বিচার করবে। পড়ার পর পাঠকরা বলবে, এতবড় নামকরা সাংবাদিক, এটা কি লিখল! সে বিবেচনায় তাদেরকে এক্সপোজ করারও একটা সুযোগ আপনি পেলেন।
তার এই যুক্তিটা আমার ভালো লাগল। এরপর তিনি আরও একটা কথা বললেন।
বললেন, দেখেন, এমনিতে বাজারে কিন্তু সুগন্ধার তেমন একটা সুনাম নেই। অনেকে মনে করে এটা আসলে শিক্ষিত শ্রেণির পত্রিকা নয়। ওস্তাদের (খোন্দকার মোজাম্মেল হক) আমলে তিনি তৈরি করে গেছেন এই ভাবমূর্তিটা। সেটা আমরা ভাঙার চেষ্টা করছি। এর মধ্যে ধীরে ধীরে অনেক পরিবর্তনও ঘটিয়েছেন আপনারা। কিন্তু অনেকেই সেটা এখনো জানে না। আবার কোথাও এ নিয়ে কথা উঠলে, না জেনেই অনেকে এই ম্যাগাজিনের বিরুদ্ধে যা তা বলে। আর এই বলাবলির তালিকায় এই সব বড় বড় সাংবাদিকের সংখ্যাই বেশি। তারা যখন বলে, তখন সেটাকে অনেকেই গুরুত্ব দেয়। এখন একটা কথা ভাবুন তো, যারা একবার এখানে লিখবেন, তাদের পক্ষে কি আর সুগন্ধার বিপক্ষে বলার কোনো সুযোগ থাকবে? লোক তখন বলবে, আপনি নিজেই তো লিখেছেন এখানে। আসলে এভাবে আমি লোকের মুখ বন্ধ করছি।
সন্দেহ নেই এটাও খুব ভালো যুক্তি।
এভাবে অনেক কন্ট্রিবিউটার জমা হয়েছিল তখন সুগন্ধায়। লিখতে গেলে বেশ একটা লম্বা তালিকা হয়ে যাবে নামের।
সুগন্ধায় আমি চাকরি শুরু করেছিলাম ১ হাজার ৮০০ টাকা বেতনে। ওই বেতনে খুশিই ছিলাম। এরপর অবশ্য কয়েক দফায় বেতন বেড়েছে। বেশ স্বল্প বিরতিতেই বেড়েছে। যতদূর মনে পড়ে, ১ হাজার ৮০০ থেকে প্রথম লাফ দিয়ে হলো ২ হাজার ২০০ টাকা, এটা তিন কি চার মাসের মাথায়। সেখান থেকে ২ হাজার ৭০০, ৩ হাজার, ৩ হাজার ৫০০, ৪ হাজার ৫০০ হয়ে একেবারে ৬ হাজার টাকায় গিয়ে থেমেছে। আর এই সবই হয়েছে মাত্র আড়াই বছরে। বেতন বৃদ্ধির এই ঘটনাগুলো আমার জন্য তখন অনেকটাই অভাবিত বলে মনে হয়েছে। কারণ, আমি আমার পিতাকে দেখেছি। তিনি সরকারি চাকরি করতেন। তার বেতন বাড়ত বছরে একবার, তাও প্রতিবারে অতি অল্প করে। ওই বেতন বৃদ্ধির আগে আগে আম্মা আর আব্বাকে দেখতাম হিসাব নিয়ে বসতে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তারা হিসাব করতেন, কত বাড়লে কোন কোন খাতে টেনশন কিছুটা কমবে, সেই হিসাব। প্রতিবারই দেখতাম, হিসাব মিলত না। আলোচনা শেষ হতো আম্মার সান্তনাসূচক কিছু উচ্চারণের মধ্যে দিয়ে। অভয় দিতেন তিনি। বলতেন, টেনশন করেন কেন? এখন যা পাচ্ছেন তা দিয়েই যখন চলে যাচ্ছে, কিছু বেতন বাড়লে আরও ভালো চলবে। তবে শেষ পর্যন্ত যা সামান্যই বাড়ত, তাই নিয়ে দেখতাম আম্মার উৎসাহের শেষ থাকত না। প্রথম কয়দিন ভালোমন্দ রান্না হতো।
এ রকমটি অবশ্য আমার নিজের পরিবারে হয়নি। তখনও আমরা স্বামী-স্ত্রী মিলে একা একাই থাকি। আমাদের উভয়ের পরিবার আমাদেরকে মেনে নিলেও তেমন বেশি দহরম মহরম শুরু হয়নি। প্রতিবার বেতন বাড়ার পর বাসায় গিয়ে আমি শাহানাকে অবাক করে দিতে চেষ্টা করতাম। বলতাম, বেতন বেড়েছে, বলো তো কত?
ওকে জিজ্ঞাসা করতাম, আর মনে মনে আশা করতাম, সে ছোট একটা ফিগার বলবে, আর আমি তার প্রত্যাশার চেয়েও বড় ফিগারটি বলে একটা বাহাদুরি নেব।
কিন্তু সে সুযোগটি কিছুতেই নিতে পারিনি। প্রতিবারই শাহানা এমন একটা ফিগার বলত, যা কি না বৃদ্ধির প্রকৃত ফিগারের চেয়ে কিছুটা বেশি। যে বার সবচেয়ে বেশি বাড়ল, ৪ হাজার ৫০০ থেকে একবারে ৬ হাজারে পৌঁছল, সেবারও সে ৬ হাজার ২০০ বলেছিল!
আবার এটা এমন নয় যে, সে খুবই বড়লোকের মেয়ে ছিল, টাকা পয়সা জীবনে এত দেখেছে যে, এই এত অল্প টাকা তার কাছে খুবই কম মনে হচ্ছে। হয়ত, আমাকে অবাক করে দিতে না পারাটাই সে তার যোগ্যতা বলে বিবেচনা করত। হয়ত বুঝাতে চাইত, আমার যা যোগ্যতা, তাতে আমার আরও বেশি পাওয়া উচিত।
এটা আমি আমার পরবর্তী জীবনেও দেখেছি। আমার কাছাকাছি যারা থাকত, তাদের মধ্যে আমাকে বড় করে দেখার, দেখানোর একটা প্রবণতা লক্ষ্য করেছি। তারা সবাই মনে করত, কর্মক্ষেত্রে আসলে আমাকে ঠকানো হচ্ছে। ওই সময়ের অনেক পরে, ততদিনে শাহানার সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে, যে নারীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক হয়, তার মধ্যেও দেখেছি সেই একই মনোভাব। সামাজিকভাবে বেশ একটা পরিচিত এই মহিলাও মনে করত, আমাকে বলত পর্যন্ত, অফিসগুলো আমাকে যথাযথ মূল্যায়ন করছে না।
যদিও আমি নিজে কখনো তা মনে করিনি, এখনো করি না। বরং কাছাকাছি লোকদের এই যে মনোভাব আমার প্রতি, একে আমার কাছে কিছুটা পক্ষপাতদুষ্ট বলেই মনে হয়। এতে অবশ্য আমার নিজেরও কিছুটা ভূমিকা হয়ত থেকে থাকবে। আমার আচরণে হয়ত এমন কিছু আছে, তাতে, আমি যতটা না যোগ্য, তার চেয়ে বেশি বলে কাছের লোকদের মধ্যে এক ধরনের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে যায়।
এই বিভ্রান্তির কারণেই বোধকরি আমি আপাদমস্তক একজন ডেস্কের লোক হওয়া সত্ত্বেও কেউ কেউ মনে করতেন আমি বুঝি রিপোর্টিংয়েও ভালো করব। তেমন লোকের মধ্যে শীর্ষে ছিলেন আলম ভাই। তিনি আমাকে কখনো রিপোর্টিং করতে দেখেননি, অথচ তার ধারণা ছিল, ডেস্কে বসে আসলে আমি আমার যোগ্যতার অপচয় করছি।
তবে রিপোর্টিংয়ে যাওয়ার প্রথম সুযোগটা কিন্তু পেলাম মেজবাহর কাছ থেকে। আজকের জিটিভি’র কর্তা ব্যক্তি মেজবাহ আহমেদ তখন আজকের কাগজের রিপোর্টার। মেজবাহর সঙ্গে আমি আমার প্রথম পত্রিকা নব অভিযানে কাজ করেছি। সে সেখানেও রিপোর্টার ছিল। আমার বড় ভাইয়ের নামও মেজবাহ। সে হিসাবে ওরা দুজন খুবই ঘনিষ্ঠ ছিল। আর যেহেতু সে আমার বড় ভাইয়ের বন্ধু, তাই আমার সমসাময়িক হলেও ভাব নিতো বড় ভাইসুলভ। আমার কাছে বেশ ভালোই লাগত।
তো সেই মেজবাহ একদিন হঠাৎ করেই আমাকে ফোন করল। আমি তখন সুগন্ধায় বসে বসে কাজ করছি। বলল-সারা জীবন কি সাপ্তাহিক পত্রিকাতেই কাজ করবেন নাকি? দৈনিকে আসুন। দৈনিক পত্রিকাই হলো মূলধারার সাংবাদিকতার জায়গা।
আমি বললাম-দৈনিকে যেতে তো চাই। কিন্তু নেবে কে? কেউ তো ডাকে না।
-এক কাজ করুন। আজ সন্ধ্যার পর আজকের কাগজে চলে আসুন। আমি আছি। দেখা যাক কি করা যায়।
মেজবাহর কথা আলম ভাইকে বললাম। তিনি বললেন, আজকেই যান। দেরি করবেন না। আর হ্যাঁ, ডেস্কে যাবেন না, রিপোর্টিংয়ে যাবেন। ডেস্কে কাজ তো এখানেই করছেন। রিপোর্টিংই হচ্ছে আসল সাংবাদিকতা।
সন্ধ্যার পর যখন আজকের কাগজে গেলাম, দেখি সেখানে বেশ একটা জমজমাট ভাব। যারা কাজ করছেন, তাদের অনেকেই আমার পূর্ব পরিচিত। মেজবাহ নিয়ে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে। পুরো নাম মাহবুব আলম, আগে বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। মাহবুব ভাই তখন ওখানে সম্ভবত চিফ রিপোর্টার। তিনি আমার সঙ্গে কথা বললেন। তবে তাকে আমার উপর খুশি বলে মনে হলো না। বিষয়টা আমার কাছে একটু অস্বাভাবিক মনে হলো। প্রথম দেখায় আমাকে অপছন্দ করেছে, এমন লোকের দেখা জীবনে খুব একটা পাইনি। এই তালিকায় মাহবুব ভাই বোধকরি প্রথম।
আমাকে দূরে রেখে মাহবুব ভাইয়ের সঙ্গে মেজবাহ কিছু কথা বললেন। তারপর আমার কাছে এসে বললেন, এখানে রিপোর্টিংয়ে এখন কোনো সুযোগ নেই। আপনি যদি করতে চান, তাহলে ডেস্কে কাজ করতে পারেন।
আমি অবশ্য আগেই মেজবাহকে বলে রেখেছিলাম, আমি রিপোর্টিংয়ে কাজ করতে চাই। মেজবাহ বললেন, এখানে করলে ডেস্কে করতে পারবেন। আর যদি একান্তই রিপোর্টিংয়ে কাজ করতে চান, তাহলে রঞ্জন দা’র কাছে পাঠাই।
রঞ্জন দা মানে রঞ্জন কিশোর চৌধুরী। দৈনিক নব অভিযানে নিউজ এডিটর ছিলেন আমার। আমাকে বেশ পছন্দ করতেন। নব অভিযানের পর তিনি দৈনিক রূপালীতে যান। সেখান থেকে এখন দৈনিক আল আমীনে।
মেজবাহ’র প্রস্তাব শুনে আমি একটু দমে গেলাম। আল আমীন এমনিতে তেমন ভালো কোনো পত্রিকা নয়। ওখানে গিয়ে কি আর এমন করার থাকবে। তাছাড়া রঞ্জন দা’র সঙ্গে আমার নিজেরই অনেক ভালো সম্পর্ক, এখানে মেজবাহ’র সুপারিশের কোনো দরকার তো দেখি না। তারপরও মেজবাহকে চটালাম না, বললাম- আচ্ছা আপনি দাদাকে বলে রাখেন। আমি গেলে কাল নাগাদ যাব।
আসলে মেজবাহকে চটাবো কি, তার উপর আমার বরং মায়া হতে লাগল। বেচারা অনেক বড়মুখ করে আমাকে ডেকে নিয়ে এসেছে, হয়ত তার কোনো পরিকল্পনা ছিল। তা সে করতে পারল না। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম, পুরো বিষয়টা এলোমেলো হয়ে গেল মাহবুব ভাইয়ের কারণে। মাহবুব আলম নামের এই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার পরবর্তীকালে একসঙ্গে কাজ করার ভাগ্য হয়েছে। সে প্রসঙ্গ পরে আসবে।
পরদিন আমি সুগন্ধায় বসে আলম ভাইকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। বললাম, হাতে এখন দুটো অপশন, আজকের কাগজে ডেস্কে এবং আল আমীনে রিপোর্টিংয়ে। তিনি বললেন, রিপোর্টিংয়ে যান।
তাই বলে আল আমীনে যাব?
পত্রিকার নাম কি-সেটা তো গুরুত্বপূর্ণ নয়। আপনি রিপোর্টিংয়ে যাবেন। তারপর ওখান থেকে অন্য বড় পত্রিকায় চলে যাবেন। এখন আপনার জন্য জরুরি হচ্ছে ট্র্যাক চেঞ্জ করা। আর একটা কথা, আপনি আল আমীন বা অন্য যেখানেই যান, সুগন্ধা তো ছাড়ছেন না। দুটো একসঙ্গে করবেন।
সেদিন সুগন্ধায় কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় আল আমীনে গেলাম। রঞ্জন দা আমাকে দেখে প্রথমে সেই কথাটাই বললেন, যেটি আমি ভেবেছিলাম। বললেন, তুই আমার এখানে কাজ করবি, সেটা কি মেজবাহকে দিয়ে বলাতে হয়?
আমি চুপ করে থাকলাম। তিনি বললেন, যা তাহলে কাজ শুরু কর।
আমি বললাম, দাদা কাল থেকে আসি? আজ যে আপনার এখানে আসব, সেটা বাসায় জানাইনি।
তিনি একটু হাসলেন। তারপর হাতে একটা ইন্টারন্যাশনাল হ্যারল্ড ট্রিবিউনের কপি ধরিয়ে দিলেন। তাতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এক যুদ্ধাপরাধীর এত বছর পর বিচার নিয়ে বিশাল একটা ফিচার ছিল। বললেন, কাল এটা অনুবাদ করে নিয়ে আসবি।
আমি বললাম, দাদা আমি তো ডেস্কে কাজ করতে চাই না। রিপোর্টিংয়ে করব।
তিনি বললেন, ঠিক আছে তাই করবি। এটা তাহলে হোক তোর সাব-এডিটর হিসেবে শেষ কাজ।
তো, এভাবেই শুরু হলো আল আমীন পত্রিকায় রিপোর্টার হিসেবে আমার নতুন যাত্রা।
আল আমীনে কাজ শুরু করলেও সুগন্ধা কিন্তু ছাড়লাম না। দিনের বেলায় আল আমীনের হয়ে বিভিন্ন অ্যাসাইনমেন্ট করতাম। এর মধ্যে এক ফাঁকে সুগন্ধা অফিসে যেতাম। কপি দেখা, প্ল্যানিং করা ইত্যাদি শেষে আমার নিজের কিছু কাজ একটা প্যাকেটে ভরে নিয়ে সন্ধ্যার দিকে মোহাম্মদপুরের আল আমীন অফিসে গিয়ে হাজির হতাম। রাত ১০-১১টা নাগাদ আল আমীন থেকে বের হয়ে বাসায় ফিরতাম। বাসায় ফিরে ওই অত রাতেও সুগন্ধা থেকে নিয়ে আসা কাজগুলো করতাম। কখনো কখনো সকালের নাস্তা করতে করতেও লেখালেখি চলত।
তখন আমার বাসা ছিল মিরপুরের মনিপুরে। আগের বাসাগুলোর তুলনায় এটা বেশ বড়ই ছিল। দু’জন মাত্র লোক আমরা, তার জন্য দুই বেডরুম, ড্রয়িং, ডাইনিং- এর বাসাটি একেবারে ছোট বলা যাবে না। আমার আয়ও তখন বেশ বেড়ে গেছে। সুগন্ধা থেকে পাই ৬ হাজার টাকা, আর আল আমীনে বেতন ধরা হয়েছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। এটা একানব্বই সালের কথা।
আল আমীনে আমি সংসদ বিট করতাম। সেখানে তখন খুবই সিনিয়র হিসেবে কাজ করতেন কামাল হায়দার ভাই। তিনি একসময় সংসদ সদস্যও ছিলেন। তিনিই আমাকে সংসদ রিপোর্টিংয়ে হাতেখড়ি দেন। প্রথম দিন যখন জাতীয় সংসদের বিভিন্ন রুম আমাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন, আমার কাছে রীতিমতো গোলকধাঁধার মতো লাগল। কোন দিক দিয়ে ঢুকতে হবে, সেটা বুঝলাম। কিন্তু কোন দিক দিয়ে কিভাবে বের হতে হবে, সেটা আর কিছুতেই মনে রাখতে পারছিলাম না।
মনে আছে, প্রথম দিনে সংসদ থেকে ফেরার পর কামাল ভাই জাতীয় সংসদে ঢোকার পর আমার মধ্যে যে বিহ্বল ভাব দেখা গিয়েছিল- তা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। অফিসে আমি বেশ একটা রসালো আলোচনার বিষয়ে পরিণত হলাম।
তবে আল আমীনে যতদিন ছিলাম কামাল ভাই আমাকে খুবই স্নেহ করতেন। রঞ্জন দা ছাড়াও এখানে স্নেহ পেয়েছি বাবু ভাইয়ের। রাশিদুন্নবী বাবুভাই সম্ভবত এখানে ছিলেন যুগ্ম বার্তা সম্পাদক। তার সঙ্গে অবশ্য পরেও আমার কাজ করার সুযোগ হয়েছিল।
দৈনিক আল আমীনে আমার বেশি দিন কাজ করা হয়নি। মাস ছয়েক ছিলাম বড়জোর। ওই সময়েই বেশ ঢাকঢোল পিটিয়ে বাজারে আসার আওয়াজ দিলো দৈনিক জনকণ্ঠ। বলা হচ্ছিল- এই পত্রিকাটি হবে সম্পূর্ণ নতুন ধারার। একসঙ্গে দেশের পাঁচ জায়গা থেকে বের হবে। বাংলাদেশের জন্য এটা সম্পূর্ণই নতুন একটা ধারা।
ইতোমধ্যে আল আমীন থেকে রিপোর্টার মোস্তাক মোবারকী ভাই জনকণ্ঠে যোগ দিয়েছেন। তিনি চাচ্ছিলেন, আমিও যেন যাই সেখানে। জনকণ্ঠে নির্বাহী সম্পাদক হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছেন বোরহান আহমেদ। বোরহান ভাই এর আগে আল আমীনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি এখান থেকে সরে যাওয়ার পর তার জায়গাতেই এসেছেন রঞ্জন দা। বোরহান ভাই আগে আল আমীনে ছিলেন বলে এখান থেকে আরও কয়েকজন এরই মধ্যে জনকণ্ঠে যেতে ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করছিল। একদিন ক্যামেরাম্যান মীর আহমেদ মীরু এসে আমাকে বলল, বোরহান ভাই আপনাকে দেখা করতে বলেছেন।
আমি একটু অবাকই হলাম। কারণ, বোরহান ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই। উনি তো আমাকে চেনেন না, তাহলে কেন ডাকবেন? তারপরও গেলাম দেখা করতে। জনকণ্ঠ অফিস তখন ছিল ৫৫ মতিঝিলে। আর এর পাশের ভবন, শরীফ ম্যানশন, ৫৬-৫৭ মতিঝিল ছিল সাপ্তাহিক সুগন্ধার অফিস। সেদিন দুপুরের পর থেকেই সুগন্ধায় ছিলাম। সেখান থেকে বের হয়ে আল আমীনে যাওয়ার আগে ভাবলাম একবার বোরহান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে যাই। আসলে দেখা করার জন্য এই সময়টার কথাই মীরু জানিয়েছিল আমাকে।
বোরহান ভাইয়ের রুমে তিনি ছাড়া আরও দুজন ছিলেন। এদের মধ্যে একজন বেশ লম্বা, সুদর্শন। আমি ঢুকতেই বোরহান ভাই আমাকে খুব আন্তরিকভাবে অভ্যর্থনা করলেন। বললেন, মাসুদ আস। বসো। কেমন আছ?
ওনার কথায় আমি মুগ্ধ। আমার জানা মতে, উনি তো আমাকে চেনেনই না। তারপরও এমনভাবে কথা বললেন যেন কতদিনের চেনা আমি। সেখানে টুকটাক কথা হলো। জানতে চাইলেন আল আমীনে আমি কোন বিটে কাজ করি। সংসদ বিট করি শুনে খুশি হলেন। সুদর্শন ভদ্রলোক এতক্ষণ চুপচাপ বসেছিলেন। উঠে আসার আগ মুহূর্তে বললেন, আপনি এই সপ্তাহ থেকেই জয়েন করুন।
বাসায় এসে আমার কর্মক্ষেত্রের প্রতিটি বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যা করি, তাই করলাম। বিষয়টা নিয়ে শাহানার সঙ্গে কথা বললাম। আগের প্রতিবারের মতো এবার তার কণ্ঠে কোনো উচ্ছ্বাস টের পেলাম না। বলল- জনকণ্ঠ নতুন পত্রিকা, এখনও তো বেরই হয়নি। কেমন হয়, না হয় কে জানে। কবে নাগাদ বের হবে, তারও তো কোন ঠিক নেই।
তারপর করল সেই মোক্ষম প্রশ্নটা, বেতন কত দেবে?
আমি ঠিক জানি না। তবে অন্যরা যা পায়, সে রকমই কিছু দেবে হয়ত।
অন্যরা কত পায়?
হুম, এই খোঁজটা আমি নিয়ে এসেছিলাম। ওখানে একেবারে নতুন স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে যারা যোগ দিয়েছে, তাদের বেতন দুই থেকে তিন হাজারের মধ্যে। আমি অবশ্য একেবারে নতুন নই, কিছুটা অভিজ্ঞতা আছে। সে হিসেবে হয়ত তিন অথবা বড়জোর সাড়ে তিন হাজার পাব।
শাহানা বলল, নাহ বাদ দাও। রিস্ক নেওয়ার কি দরকার। এখানে তো তুমি সাড়ে তিন হাজার পাচ্ছই। বোরহান ভাই সম্পর্কে যা শুনলাম, পত্রিকা খুব একটা ভালো হবে বলে তো মনে হচ্ছে না।
বোরহান ভাই সম্পর্কে ও কিছু কথা শুনেছে আমারই কাছ থেকে। আগের দিন, আল আমীনে বসে জনকণ্ঠে যোগ দেওয়ার বিষয়ে আমি কথা বলেছিলাম রঞ্জন দা’র সঙ্গে। বলেছিলাম, কাল জনকণ্ঠে যাব বোরহান ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে।
তিনি বললেন, দেখা করতে যাবি, যা। কিন্তু জনকণ্ঠে কেন যোগ দিবি? ওটা কি খুব ভালো কিছু হবে?
তারপর তিনি বললেন, দেখ বোরহান আগে তোদের এই আল আমীনে ছিল। এই পত্রিকা তার হাত দিয়েই শুরু। তারপর এটাকে সে কতদূর নিতে পেরেছিল?
আমি কিছু বললাম না। চুপ করে শুনছিলাম।
তিনি বলে চলেছেন, আমি এখানে এখন যে কাজ করছি, এটাই কিন্তু আমার স্ট্যান্ডার্ড। আমি এতটুকুই পারি। এখন কাল যদি আমাকে ইত্তেফাকের নিউজ এডিটর বানিয়ে দেওয়া হয়, পরশু সকালে যে ইত্তেফাকটা বের হবে, সেটা আসলে এখনকার এই আল আমীনের মতোই কিছু একটা হবে। আমি তো এতটুকুই পারি। তো বোরহান জনকণ্ঠই করুক, আর সেটা দশ জায়গা থেকেই বের হোক, সে তো তার স্ট্যান্ডার্ডের বাইরে যেতে পারবে না। কয়দিন আগে আল আমীন যা হয়েছে, তেমনই কিছু একটা হবে।
তারপর একটু হেসে বললেন, যেতে চাস যা। কয়দিন পরে তো ওই মালিক বোরহানের জায়গায় আমাকেই ডাকবে। কারণ, বোরহানের বিকল্প তো আমিই।
আমিও ঠিক এই জায়গাটিকেই ধরলাম। বললাম, দাদা তাহলে তো আর কোনো সমস্যাই নেই। আমি ওখানে যাই। কয়দিন পর তো আপনি আসছেনই!
তিনি হাত তুলে মার দেয়ার ভঙ্গি করলেন। বললেন, যা ভাগ। বেশি সেয়ানা হয়েছিস। ওই সপ্তাহেই জনকণ্ঠে যোগ দিলাম।