ছেলেটি পলকহীন দৃষ্টিতে বুড়িমার চিঠি লেখার দিকে তাকিয়ে আছে। একসময় সে কণ্ঠস্বরে কৌতূহলের সামান্য বরফকুচি ঢেলে জিজ্ঞেস করে, ‘বুড়িমা, তুমি কি আমাদের সম্পর্কে কোনো গল্প লিখছ? এটা কি আমাকে নিয়ে লেখা কোনো গল্প?’
ছেলেটির প্রশ্ন শোনার সঙ্গে সঙ্গেই বুড়িমা লেখা থামিয়ে দেন। তারপর নাতির মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে হাসি মুখে বললেন, ‘সত্যি তোমার সম্পর্কেই লিখছি। তবে লেখা ও বিষয়বস্তুর চেয়ে অধিক মূল্যবান হলো এই কাঠপেন্সিলটি, যেটি দিয়ে আমি এখন লিখছি। আশা করি তুমি বড় হয়ে এই কাঠপেন্সিলটি পছন্দ করবে।’
ছেলেটি অবাক চোখে তাকিয়ে কাঠপেন্সিলটির গোড়া থেকে সরু মাথা পর্যন্ত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরখ করে। কিন্তু সে কাঠপেন্সিলটির গায়ে কোনো বিশেষত্বের চিহ্ন দেখতে পেল না।
‘এটা তো দেখতে অন্য আর দশটা সাধারণ কাঠপেন্সিলের মতোই, তেমন কোনো বিশেষত্ব দেখছি না,’ হতাশার সুরে ছেলেটি বলল।
‘দেখার বিষয়টি কিন্তু তোমার দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে। জানো, কাঠপেন্সিলের পাঁচটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য বা গুণ আছে। তুমি যদি এই বৈশিষ্ট্যগুলো অনুসরণ করো, তাহলে তুমি এই অস্থির দুনিয়ায় সুখ ও শান্তিতে বসবাস করতে পারবে,’ মোলায়েম গলায় বুড়িমা বললেন।
বলেই বুড়িমা কয়েক পলকের জন্য থামলেন। তারপর একটু নড়েচড়ে বসে তিনি পুনরায় বলতে শুরু করেন :
‘প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো ধরো, অনেক বড় কাজ করার যোগ্যতা তোমার আছে। তবে কখনই ভুলে যেও না যে, তোমার প্রতিটি পদক্ষেপই কিন্তু অন্য একজনের হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। সেই অদৃশ্য হাতকে আমরা ঈশ্বর বলি এবং তিনি তার ইচ্ছে অনুযায়ী আমাদের সবাইকে সুনির্দিষ্ট পথে পরিচালিত করেন।
‘দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, নিশ্চয়ই তুমি লক্ষ্য করেছ, মাঝেমধ্যে আমি লেখা থামিয়ে কাঠপেন্সিল কেটে ধারালো করি। কাঠপেন্সিলের শরীর থেকে খানিকটা কাঠ কেটে ফেলার জন্য অবশ্যই ওটা কষ্ট সহ্য করে। তবে কাটার পর কিন্তু কাঠপেন্সিলটি বেশ ধারালো হয়। তাই তুমিও মাঝেমধ্যে কিছু দুঃখ-কষ্ট সহ্য করবে। তখন দেখবে সেই দুঃখ-কষ্ট তোমাকে একজন আদর্শ এবং ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।
‘তৃতীয় বৈশিষ্ট্য হলো, কাঠপেন্সিল দিয়ে লেখার পর প্রয়োজন হলে আমরা অনায়াসে ইরেইজার দিয়ে ঘষে লেখা মুছে ফেলতে পারি। তার অর্থ হলো, প্রয়োজনে কোনো কিছু পরিবর্তন বা পরিমার্জন করা মোটেও দোষনীয় নয়। বরং তা আমাদের ন্যায়-নীতি ও সরল পথে চলতে সাহায্য এবং সহযোগিতা করে।
‘চতুর্থ বৈশিষ্ট্য হলো, কাঠপেন্সিলের কাঠ কিন্তু আসল বিষয় নয়। বরং ভেতরের গ্রাফাইট হচ্ছে মূল জিনিস। সুতরাং তোমার মনের অভ্যন্তরের ঘটনার প্রতি সব সময়ই মনোযোগ দেবে।
‘সর্বশেষ অর্থাৎ পঞ্চম বৈশিষ্ট্য হলো, তুমি জানো কাঠপেন্সিল দিয়ে লেখার পরে সব সময় একটা দাগ থেকে যায়। ঠিক একই ভাবে তুমি জীবনে যা-ই কিছু করো না কেন, তার একটা চিহ্ন কিংবা প্রমাণ কিন্তু থেকে যাবে। সুতরাং বুদ্ধি-বিবেচনা করে জীবনের প্রতিটি কাজ করবে, যেন পেছনে কোনো খারাপ চিহ্ন বা উদাহরণ পড়ে না থাকে।
টোকিওর এক শুঁড়িখানায়
এক জাপানি সাংবাদিক আমাকে স্বাভাবিক নিয়মে প্রশ্ন করে, ‘আপনার প্রিয় লেখক কারা?’
আমিও সাদামাটা ভাবে বললাম, ‘জর্জে আমাদো, হোর্সে লুইস বোর্হেস, উইলিয়াম ব্লেক এবং হেনরী মিলার।’
দোভাষী মহিলা বিস্ফারিত চোখে আমার মুখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, ‘হেনরী মিলার?’
সঙ্গে সঙ্গেই দোভাষী বুঝতে পারে যে, পাল্টা প্রশ্ন করা তার কাজের আওতায় পড়ে না।
যাহোক, সাক্ষাৎকারের শেষ পর্যায়ে এসে আমি দোভাষীকে তার বিস্ময়ের কারণ জানতে চাইলাম। হেনরী মিলার রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে পরিপূর্ণ নন বলে গণ্য করা হয়, তাই? আমার দৃষ্টিতে তিনি একজন মহান লেখক। কেননা তিনি বিশাল এই ধরণীর তাবৎ জিনিস দেখার জন্য আমার চোখের সামনে তুলে ধরেছেন। তার গ্রন্থসমূহ আমার মনে শক্তি সঞ্চার করে এবং সমকালীন সাহিত্যের বিবিধ দিক আমার সামনে উন্মোচিত করেছে।
‘না, আমি মোটেও হেনরী মিলারের কোনো সমালোচনা করছি না। আমিও তার লেখার একজন ভক্ত, বলতে পরেন তুখোড় পাঠক,’ ত্বরিত গতিতে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে দোভাষী মহিলা বলল। তারপর একটু থেমে সে পুনরায় বলল, ‘আপনি কি জানেন, একসময় তিনি একজন জাপানি মহিলাকে বিয়ে করেছিলেন?’
আমি আপনমনে বললাম, অবশ্যই জানি। হেনরী মিলারের মতো একজন বিখ্যাত লেখকের অন্ধ পাঠক হিসেবে তার ব্যক্তিগত তথ্যাদি এবং জীবন সম্পর্কে আদ্যোপান্ত জানা নিয়ে আমি কোনো লজ্জাবোধ করি না। একবার আমি জর্জে আমাদোকে চাক্ষুষ দেখার জন্য এক বইমেলায় গিয়েছিলাম। এছাড়া আরেকবার আমি আটচল্লিশ ঘন্টা বাসে চড়ে হোর্সে লুইস বোর্হেসকে দেখতে গিয়েছিলাম (এবং আমার দুর্ভাগ্য, তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পরও আমি প্রচ- ঠা-ায় এত বেশি কাবু ছিলাম যে, কিছুতেই আমার ঠোঁটের ফাঁক গলিয়ে কোনো শব্দ উচ্চারিত হয়নি)। অন্য একসময় আমি জন লেননের সঙ্গে দেখা করার জন্য তার নিউ ইয়র্ক অ্যাপার্টমেন্টে গিয়ে দরোজায় কলিংবেল টিপেছিলাম। দারোয়ান এসে আমাকে একটা কাগজে আগমণের কারণ লিখে দিতে বলেছিল। দারোয়ান আরও বলেছিল, সময় করে জন লেনন নিজেই আমাকে ফোন করবেন। (কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, জন লেনন কোনোদিনই আমাকে ফোন করেননি।) হেনরী মিলারের সঙ্গে দেখা করার জন্য ‘বিগ সার’-এ যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম। কিন্তু সেখানে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে টাকাকড়ি সংগ্রহ করার আগেই তিনি ইহলোক ত্যাগ করে না-ফেরার দেশে চলে গেছেন।
‘সেই জাপানি মহিলার নাম হোকি,’ আমি গর্বিত গলায় বললাম। তারপর একটু থেমে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে আরও বললাম, ‘আমি এ-ও জানি যে, টোকিও শহরের কোথাও জলরঙের আঁকা তার চিত্রকর্মের একটা জাদুঘর আছে।’
‘আপনি কি আজ রাতেই মিসেস মিলারের সঙ্গে দেখা করতে চান?’ বিন্দুমাত্র সময় অপচয় না করে দোভাষী মহিলা সরাসরি জানতে চাইল।
কি অদ্ভুত প্রশ্ন! অবশ্যই আমি এমন একজনের সঙ্গে দেখা করতে যারপরনাই ইচ্ছুক, যিনি একসময় আমার অত্যন্ত প্রিয় একজন মানুষের সঙ্গে বসবাস করেছেন। জাপানি এই মহিলা মিস্টার মিলারের সঙ্গে প্রায় দশ বছর একত্রে সংসার করেছেন। আমার ধারণা, মিসেস মিলার উৎসাহী দর্শনার্থী এবং শুভাকাক্সক্ষীদের সঙ্গে দেখা করেন। এছাড়া তিনি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎকারও দেন, যা পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন পত্রপত্রিকা এবং ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। তবে তিনি সাধারণ দর্শকের সঙ্গে দেখা করে অযথা সময় অপচয় করেন না। কিন্তু দোভাষী যখন মিসেস মিলারের সঙ্গে দেখা করার সম্ভাবনার কথা বলেছে, তখন আমি তার কথা কিছুতেই ফেলনা হিসেবে ফেলে দিতে পারি না। আমি জানি, জাপানিরা কখনই কথার বরখেলাপ করে না।
তারপর সারা দিন আমি উৎকন্ঠায় অপেক্ষা করেছি। একসময় দোভাষী মহিলা এবং আমি একটা ট্যাক্সিতে চড়ি। যাত্রা পথে আমার মনে হয়েছে, সব কিছুই যেন ভৌতিক কাহিনির মতো একের পর এক অবলীলায় ঘটে যাচ্ছে। অবশেষে আমরা এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছি, যেখানে অতীতে হয়ত কোনোদিনই সূর্যের আলো এসে পৌঁছায়নি। কেননা সেই জায়গার ওপর দিয়ে রেলপথ চলে গেছে। দোভাষী একটা নড়বড়ে দালানের দোতলায় এক সাদামাটা এবং ভাঙাচোরা দ্বিতীয় শ্রেণির শুঁড়িখানার দিকে আঙুল তুলে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করে।
কিছুক্ষণের মধ্যে আমরা কয়েকটা সিঁড়ি পেরিয়ে ওপরে উঠে ফাঁকা শুঁড়িখানার ভেতর প্রবেশ করি এবং সেখানেই হোকি মিলারের সাক্ষাৎ লাভ করি।
সেই মুহূর্তে আমার উত্তেজনা প্রশমিত করার জন্য আমি আগ বাড়িয়ে মহিলার প্রাক্তন স্বামীর ভূয়সী প্রশংসা করা শুরু করি। একসময় আমাকে সঙ্গে করে মহিলা পেছনের দিকের একটা ঘরে ঢোকেন। তিনি এই ঘরটাকেই একটা ছোটখাটো জাদুঘর বানিয়েছেন। ঘরের ভেতর গুটি কয়েক ছবি, দুটি কিংবা তিনটি হেনরী মিলারের স্বাক্ষরযুক্ত জলরঙ ছবি, দর্শকদের মন্তব্য লেখার জন্য একটা বাঁধাই করা খাতা এবং চোখে পড়ার মতো অন্য আর কিছুই নেই।
একসময় মিসেস মিলার আমার সামনে তার ফেলে আসা জীবনের উজ্জ্বল সময়ের স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন। তিনি বলতে শুরু করেন, মিলারের সঙ্গে তার প্রথম দেখা হয়েছিল লজ অ্যাঞ্জেলেসে। তখন সেখানে তিনি মাস্টার্সে লেখাপড়া করছিলেন। রাতে তিনি একটা রেস্তোরাঁয় পিয়ানো বাজাতেন এবং ফরাসি সংগীত (তবে জাপানি ভাষায়) পরিবেশন করতেন। একবার মিলার সেই রেস্তোরাঁয় রাতের খাবার খেতে গিয়েছিলেন। তার কণ্ঠে পিয়ানোর সঙ্গে সেই সংগীত মিলারের অত্যন্ত ভালো লেগেছিল (জীবনের অনেকটা সময় মিলার প্যারিসে কাটিয়েছেন)। পরবর্তী সময়ে তিনি এবং মিলার একসঙ্গে বেশ কয়েকবার বাইরে বেড়াতে গিয়েছেন। অবশেষে একদিন মিলার তাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন।
শুঁড়িখানার একপাশে একটা পিয়ানো পড়ে আছে। আমার মনে হলো, আমাদের আলাপের মাঝে তিনি যেন মনের অজান্তে সেই পুরোনো দিনগুলোতে ফিরে গিয়েছেন, বিশেষ করে মিলারের সঙ্গে তার প্রথম মোলাকাতের মাহেন্দ্রক্ষণটিতে। যা হোক, ধীরে ধীরে তিনি তাদের দাম্পত্য জীবনের স্মরণীয় ঘটনাবলী বলতে শুরু করেন। একসময় তিনি বললেন যে, মিলার এবং তার মাঝে বয়সের বিস্তর ফারাকের জন্য তাদের মধ্যে মতের বেশ অমিল ছিল। (তখন মিলারের বয়স ছিল পঞ্চাশেরও বেশি এবং তার বয়স ছিল কুড়ি বছরেরও কম।) এসব একান্ত ব্যক্তিগত কথা একজন অপরিচিত লোকের কাছে বলতে তিনি কোনো সংকোচ অনুভব করেননি। তিনি এ-ও বলতে দ্বিধা করলেন না যে, মিলারের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হয়েছে তার আগের স্ত্রীদের গর্ভজাত সন্তানেরা, বিশেষ করে বইয়ের রয়্যালটি। তবে এ নিয়ে তিনি মনের ভেতর কোনো ক্ষোভ পোষণ করেন না। কেননা এত উঁচু মাপের এবং বিখ্যাত একজন লেখকের সঙ্গে তিনি ভালোবেসে একদিন ঘর বেঁধেছিলেন। সেই সুযোগ এবং অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে যে কোনো আর্থিক মূল্যের চেয়ে ঢের বেশি।
একসময় আমি মিসেস মিলারকে সেই সংগীত পরিবেশন করার জন্য সবিনয় অনুরোধ করি, যা তিনি মিস্টার মিলারের সম্মুখে পরিবেশন করে তাকে সম্মোহিত করেছিলেন। তিনি আমার অনুরোধ রক্ষা করে গানটি গেয়ে শোনান। তখন তার চোখের পাতা ছিল ভেজা । গানটি ছিল ‘শরতের ঝরা পাতা’ (অটাম লিভস)।গান শেষে দোভাষী এবং আমি মিসেস মিলারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি। মিস্টার মিলারের প্রাক্তন স্ত্রীদের ধনসম্পত্তি, কিংবা বই বিক্রির অর্থকড়ির বহমান গ্রোতধারা, এমনকি যে মহিলা আন্তর্জাতিক সুনাম কুড়িয়ে এখনও বেঁচে আছেন মনে হলো এসব কিছুই যেন এই শুঁড়িখানা, অবহেলায় পড়ে থাকা পিয়ানো এবং ফাঁকা ঘরের বন্ধ হাওয়ায় জাপানি মহিলার অনুরণিত সুরেলা কণ্ঠস্বরকে রীতিমতো অগ্রাহ্য করে চলেছে।
প্যান্ডোরার বাক্স
একদিন ভোরে আমি তিন মহাদেশ থেকে তিনটি সংবাদ পাই। সাংবাদিক লাওরো জারদিম ই-মেইলে আমার সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য যাচাই করার জন্য অনুরোধ করেছে এবং রিও ডি জেনিরো শহরের রচিনহার অবস্থা সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দিয়েছে। দ্বিতীয় সংবাদ হলো, ফ্রান্সে আমার স্ত্রী উড়োজাহাজ থেকে অবতরণ করেই আমাকে টেলিফোন করেছে। তার সঙ্গে আমাদের এক ব্রাজিলীয় বন্ধু দম্পতিও আছে। আমার স্ত্রী এই বন্ধু দম্পতিকে সারা দেশ ঘুরে দেখানোর দায়িত্ব পেয়েছে। তারা অত্যন্ত ভীতু এবং হতাশায় আক্রান্ত। সর্বশেষ অর্থাৎ তৃতীয় সংবাদ হলো, রাশিয়ার কোনো এক টেলিভিশনের সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার নিতে এসে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করেছে যে, ব্রাজিলে কি সত্যি ১৯৮০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত পাঁচ লক্ষেরও বেশি মানুষ খুন হয়েছে?
অবশ্যই এটা সত্যি না, জোর গলায় আমি বললাম। তারপর সাংবাদিক আমাকে ব্রাজিলের এক ইনস্টিটিউটের (ব্রাজিলিয়ান ইনস্টিটিউট অফ জিওগ্রাফি অ্যান্ড স্ট্যাটিস্টিক্স, যেভাবে লেখা রয়েছে) পরিসংখ্যান দেখায়।
পরিসংখ্যান দেখে আমি কোনো কথা না বলে চুপ করে থাকি। আপনমনে ভাবি, আমার দেশের নৃশংসতার খবর ভৌগোলিক সীমারেখা ছাড়িয়ে মহাসমুদ্র ও পাহাড়-পর্বত পেরিয়ে মধ্য এশিয়ায় গিয়ে পৌঁছেছে। আমার কি আর বলার আছে?
মুখের কথা পর্যাপ্ত নয়। কেননা কথা যদি কাজে বাস্তবায়িত করা না যায়, তাহলে ‘মহামারি’ আকারে সংক্রমিত হতে পারে। কথাটা আমার নয়, উইলিয়াম ব্লেকের। যাহোক, আমি আমার ভাগের অংশটুকু করে যাচ্ছি। দুজন, ইসাবেলা এবং ইয়োল্যান্ডা মাল্টারোলি, কর্মঠ ও উৎসাহীকে নিয়ে আমি একটা প্রতিষ্ঠান গড়ে করেছি। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বস্তির ৩৬০ ছেলেমেয়েকে স্নেহ-মমতার সঙ্গে লেখাপড়া করার সুযোগ করে দিয়েছি। আমি জানি, চরম হতাশার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য ব্রাজিলের অগণিত মানুষ ইদানীং সরকারি অনুদান ও আনুষঙ্গিক সহযোগিতা, এমনকি ব্যক্তিগত আর্থিক সাহায্য ছাড়াই নীরবে আমাদের চেয়ে ভালো কাজ করছে।
একসময় আমি মনে মনে ভাবতাম, আমরা যদি নিজেদের দায়িত্ব পরিপূর্ণ ভাবে পালন করি, তাহলে একদিন সব কিছুই বদলে যাবে। কিন্তু আজ রাতে আমি যখন চীনের সীমানার পাশে বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়ের দিকে তাকিয়েছি, তখন আমার মনে একধরনের সন্দেহের দানা বাঁধে। যদিও নিজের সাধ্যমতো সবাই কাজ করছে, তবুও শৈশবে আমি যে প্রবাদ শুনেছিলাম, তা হয়ত আজও সত্য হিসেবে প্রচলিত আছে। প্রবাদটা ছিল এ রকম : ‘শক্তি দিয়ে কখনই বাক-বিত-া করা যায় না।’
পুনরায় আমি চাঁদের স্নিগ্ধ আলোয় প্লাবিত উঁচু পাহাড়ের দিকে তাকাই। আপনমনে নিজেকেই জিজ্ঞেস করি, এটা কি আদৌ সত্যি যে, শক্তির বিরুদ্ধে কোনো বাক-বিত-া দাঁড়াতে পারে না? যাহোক, ব্রাজিলের আর দশজন সাধারণ মানুষের মতো আমিও ভাবতে চেষ্টা করেছি এবং বিশ্বাস করতে রীতিমতো সংগ্রাম করেছি যে, দেশের অশান্ত পরিস্থিতি একদিন ভালো হবে। কিন্তু সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে, চারপাশের পরিস্থিতি ততবেশী জটিল ও ভয়াবহ হচ্ছে। পরিস্থিতি এমন হয়েছে যে, কে কখন দেশের নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি, কোন রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আছে, কিংবা কিতাদের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, এমনকি প্রয়োজনীয় অন্য বিষয়গুলো না থাকলেও দেশ এগিয়ে যাবে, এগুলো কোনো বিষয়ই নয়।
আমি নিজের চোখে দেখেছি বিশ্বের চার কোণে সংঘটিত নানা ধরনের নৃশংসতা, হানাহানি। এখনও একটা ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। যুদ্ধের পরপরই লেবাননের রাজধানী বৈরুতের রাস্তায় ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে সৌলা সাদ নামের আমার এক মহিলা বন্ধু এবং আমি একদিন হাঁটছিলাম। সৌলা আমাকে বলেছিল, তার সেই শহরকে সাত বার ধ্বংস করা হয়েছে।
আমি কণ্ঠস্বরে কৌতুকের সামান্য রস ঢেলে বলেছিলাম, ‘তাহলে তোমরা কেন পুনর্নির্মাণের বিষয়টি মাথা থেকে তাড়াওনি এবং শহর ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওনি।’
‘কারণ এটা আমাদের শহর,’ সৌলা রীতিমতো গর্ব করে বলেছিল। তারপর সে কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক করে আরও বলেছিল, ‘কেননা কোনো মানুষ যদি তার পূর্বসূরিদের ভিটেমাটি অস্বীকার করে, যে মাটিতে তার পূর্বসূরীরা অনন্তকলের জন্য গভীর নিদ্রায় শুয়ে আছে, আসলে সে নিজেকেই অস্বীকার করে এবং সেই মাটি তাকে চিরদিন অভিসম্পাত দিবে।’
যে মানুষ তার মাতৃভূমিকে অসম্মান করে, প্রকৃতপক্ষে সে নিজের সত্তাকেই অসম্মান করে। এ কথাটি গ্রীক পৌরাণিকে আছে। প্রমিথিউস আগুন চুরি করে মৃতদের স্বাধীনতা দেওয়ার জন্য জিয়ুস অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছিল। তাই প্রমিথিউসকে শায়েস্তা করার উদ্দেশ্যে জিয়ুস প্রমিথিউসের ভাই ইফোমিথিউসকে বিয়ে করার জন্য প্যান্ডোরাকে পাঠিয়েছিল। সেই যাত্রায় প্যান্ডোরা সঙ্গে করে একটা বাক্স নিয়েছিল। কিন্তু সেই বাক্স খোলার জন্য তার উপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। যা হোক, খ্রিস্টানদের পৌরাণিক কাহিনির ঈভের মতো বাক্সের ভেতর দেখার জন্য একসময় তার অনুসন্ধিৎসু মন জেগে ওঠে। প্যান্ডোরা বাক্সের মুখ খোলে। ঠিক সেই মুহূর্তে বাক্সের ভেতর থেকে পৃথিবীর তাবৎ অশুভ শক্তি হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে। শুধু একটা জিনিস বেরিয়ে আসেনি কিংবা আসতে পারেনি, বরং ভেতরেই থেকে গেছে এবং তা হলো ‘আশা’।
সুতরাং আমার দুঃখবোধ, উদাসীনতা এবং কখনই কোনো পরিবর্তন না হওয়ার নিরাশা সত্ত্বেও যখন পরিস্থিতি আমার সঙ্গে বিরোধিতা করে, তখন আমি সবকিছু ছেড়ে দিতে পারলেও একটা জিনিস কিছুতেই ছাড়তে পারি না এবং সেটা হলো ‘আশা’। মুখোশধারী আঁতেলরা এই ‘আশা’ শব্দটি প্রতারণার সমার্থক শব্দ ছাড়া অন্যভাবে ব্যবহার করতে জানে না। এছাড়া সরকার এই শব্দটি ভীষণ বিশ্রীভাবে ব্যবহার করে। সরকার জানে, যে কাজ সে কখনই করতে পারবে না, অথচ সে সেই কাজ করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে। ফলে সরকারের মিথ্যা প্রতিজ্ঞার জন্য নিরীহ আমজনতার বুকের ভেতর হতাশার জন্য আরও বেশি ক্ষরণ হয়। তবুও সেই শব্দটি আমাদের সরল মনের আকাশে ভোরের নরম আলোর মতো প্রতিদিন উদয় হয়। তারপর গোধূলির দিকে ক্রমশ সময় গড়িয়ে যাওয়ার মতো আমাদের পরাণের গহিন ভেতর ক্ষতের চিহ্ন দীর্ঘ হতে থাকে। রাতের অন্ধকারে সেই দীর্ঘ ক্ষতের মৃত্যু হয় এবং পরদিন আরেকটা নতুন দিনের আগমনে সেই ক্ষতের পুনর্জন্ম হয়।
লেখক পরিচিতি : ব্রাজিলের স্বনামধন্য ঔপন্যাসিক, গল্প লেখক এবং গীতিকার পাওলো কোয়েলহো পর্তুগীজ ভাষায় প্রকাশিত ‘বেস্ট সেলার’ উপন্যাস ‘ও আলক্যুইমিস্তা’র (ইংরেজিতে ‘দ্য আলকেমিস্ট’) রচয়িতা। তিনি পর্তুগীজ ভাষায় সর্বকালের সেরা লেখক হিসেবে স্বীকৃত। তার জন্ম রিও ডি জেনিরোতে, ১৯৪৭ সালের ২৪ আগস্ট। শৈশবে তিনি প্রচলিত রোমান ক্যাথলিক জীবনধারার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন এবং স্বল্প সময়ের জন্য মানসিক হাসপাতালে ছিলেন। পরবর্তী সময়ে পরিবারের চাপে তিনি আইন বিষয়ে ভর্তি হন। কিন্তু এক বছর পরেই পড়ালেখা বন্ধ করে ১৯৭০ সালে দক্ষিণ আমেরিকা, মেক্সিকো, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন। তিনি ১৯৭২ সালে স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে রক সংগীত রচনায় আত্মনিয়োগ করেন। সেসব সংগীত রচনার জন্য তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন এবং দেশদ্রোহিতার অজুহাতে তাকে কিছু সময় কারাবাসে কাটাতে হয়। তার লেখালেখির হাতেখড়ি খুব অল্প বয়সে। বলা হয়, তার লেখার মধ্যে খলিল জিবরান, হেনরী মিলার, হোর্সে লুইস বোর্হেস এবং জর্জে আমাদোর প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। তিনি বিভিন্ন ধরনের ৩০টিরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। ‘দ্য আলকেমিস্ট’ উপন্যাসটি বিশ্বের আশিটিরও অধিক ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে। পাঠক নন্দিত এই উপন্যাস ছাড়া এই ঋদ্ধ লেখকের অন্য গ্রন্থের মধ্যে ‘ব্রাইডা’, ‘আলেফ’, ‘পিলগ্রিমেইজ’, ‘অ্যাডাল্টারী’, ‘ভেরোনিকা ডিসাইস টু ডাই’, ‘ইলেভেন মিনিটস্’ এবং ‘ম্যানিউস্ক্রিপ্ট ফাউন্ড ইন আক্রা’ উল্লেখযোগ্য। একজন সফল লেখক হিসেবে তিনি অনেক আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করেন। এ সব পুরস্কারের মধ্যে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ‘ক্রিস্টাল অ্যাওয়ার্ড’ অন্যতম।
গল্পসূত্র : ‘কাঠপেন্সিলের গল্পকথা’, ‘টোকিওর এক শুঁড়িখানায়’ এবং ‘প্যান্ডোরার বাক্স’ গল্প তিনটি পাওলো কেয়েলহোর ইংরেজিতে অনূদিত ‘লাইক দ্য ফ্লোয়িং রিভার’ সংকলনের যথাক্রমে ‘দ্য স্টোরি অফ দ্য পেন্সিল’, ‘ইন এ বার ইন টোকিও’ এবং ‘প্যান্ডোরা’স বক্স’ ছোটগল্পের অনুবাদ। পর্তুগীজ ভাষা থেকে গল্পগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন মার্গারেট জুল কস্টা।