ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশে সপ্তম-অষ্টম শতকেই মুসলমানদের আগমন ঘটে। এর প্রমাণ রয়েছে বগুড়ার মহাস্থানগড়ে প্রাপ্ত খলিফা হারুন-অর-রশীদের সময়কালের রৌপ্যমুদ্রায়। পূর্ব-বাংলায় মুসলমানদের আগমন ঘটে মূলত দুটি কারণে। সুফি-দরবেশরা এসেছিলেন ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে। আর তুর্কি-আরব বণিকদের উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য করা। বণিকরা নানা পথে এ ভূখ-ে আসতেন। তবে বিশেষত চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতেন ওরা। আমাদের এই অঞ্চলে তুর্কি-আরব বণিকদের যাতায়াতের ফলে সাংস্কৃতিক জগতেও নানা আদান-প্রদান হয়েছে। একটি চমৎকার উদাহরণ দিচ্ছি এ প্রসঙ্গে। ইংরেজি ভাষায় ‘তেঁতুল’কে ‘ট্যামারিন্ড’ বলা হয়। আরব বণিকরা এখানে এসেছিলেন খেজুর নিয়ে। বিনিময়ে ভারত থেকে ওখানে ‘তেঁতুল’ নিয়ে যেতেন। ওরা এর নাম দিয়েছিলেন ‘তামার-ই-হিন্দ’, মানে ভারতের খেজুর। ‘তামার’ অর্থ খেজুর, আর ‘হিন্দ’ মানে ভারতবর্ষ। পরের কয়েক শতকে মুসলমানরা স্পেন জয় করে ইউরোপে নিজেদের শাসন দৃঢ় করলেন। তখন দেখা গেল স্পেন হয়ে ইউরোপে এই ‘তামার-ই-হিন্দ’ শব্দটি চলে গেল। ইউরোপের উচ্চারণে এটা বিবর্তিত হয়ে ‘ট্যামারিন্ড’ হয়ে গেল। এভাবে ভারতের সঙ্গে আরব-তুর্কদের ব্যবসা-বাণিজ্যের ফলে বিভিন্ন জাতি- গোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিক জগতেও একটা মেলবন্ধন তৈরি হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে আরেকটি চিত্তাকর্ষক বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। আমাদের এ অঞ্চলে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী মুসলিমরা ধর্মপ্রচার ও ব্যবসার উদ্দেশ্যে এলেও, নামাজ-রোজা এই শব্দগুলো কিন্তু ফার্সি ভাষার শব্দ। ‘সালাত’ বা ‘রমজানুল মোবারক’ জাতীয় শব্দগুলো এখানে তত প্রচলিত নয়। তাতে বোঝা যায়, আমাদের ধর্মীয় আচারের ওপর আরবীয় প্রভাবের চেয়ে ইরানি প্রভাব বেশি ছিল।
সুফি-সাধকরা এখানে ধর্মপ্রচার করতে এসে জোর-জবরদস্তি করেননি। তারা চেয়েছিলেন, তাদের উন্নত জীবনযাপনের সৌন্দর্য, উদারতা, সরল আদর্শ এবং উচ্চমার্গীয় বিলাসিতাহীনতার দর্শন ভারতের সাধারণ মানুষকে নাড়া দেবে। ভারতে তখন বর্ণবাদের তীব্র কশাঘাতে বিপর্যস্ত ছিলেন সাধারণ হিন্দু নিম্নবর্গীয়রা। শাস্ত্রীয় নানা বিধি-নিষেধ আর অনুশাসনে আবদ্ধ জীবনে থেকে নিপীড়িত হতে হতে, একসময় ইসলামের আদর্শ তাদের কাছে ভিন্ন এবং বেশি আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল। যেখানে উচ্চবর্ণের হিন্দুর ছায়া মাড়ানোও নিষেধ ছিল নিম্নবর্ণের হিন্দুর জন্যÑসেখানে ইসলামে কোনো বর্ণভেদই নেই। বরং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই একই কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ছেন। সুফি-সাধক, পীর-আউলিয়ারা তাই প্রভাবিত করলেন তাদের।
আরেকটি বিষয়ও এখানে বলছি। যে আরব থেকে ইসলাম বিস্তৃত হয়েছে নানা দেশে, নানা জনগোষ্ঠীর মাঝেÑ সেই আরবের সঙ্গে এই বাংলার একটি বিষয়ে সাযুজ্য রয়েছে। আরবের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কর্মকা-ের কেন্দ্রভূমি ছিল মক্কা, যে শহরে মূলত অভিজাত ও বিত্তশালীদের প্রাধান্য ছিল। বিপরীতে মদিনা ছিল নিপীড়িত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আবাসস্থল। মক্কায় জন্ম নেওয়া ইসলামের নবী মদিনায় হিজরত করেছিলেন। ইসলামের জীবনাচরণ ও আদর্শ মদিনার দরিদ্রদের বেশি আকৃষ্ট করেছিল বলে ওখানে ইসলাম বেশি বিস্তৃত হয়েছিল। একইভাবে পূর্ব-বাংলার কৃষিজীবী-শ্রমজীবী-ক্ষেতমজুর শ্রেণি ইসলামের মধ্যে তাদের মুক্তির উপায় খুঁজে পেয়েছিলেন। তাছাড়া মুসলিম ধর্মপ্রচারকরা এই নব্য-মুসলিমদের সংস্কৃতিচর্চার ওপর দীর্ঘদিন কোনো আধিপত্য বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেননি। বরং কয়েক শতক ধরে এই অঞ্চলের স্থানীয় মুসলমানরা তাদের নিজস্ব আচার-অনুষ্ঠান পালনে স্বাধীন ছিলেন।
কেন তারা এটা করেছিলেন? তাদের তো একটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিলই। কারণ ধর্মপ্রচার বা বাণিজ্যের বিস্তৃতির জন্য রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা খুব জরুরি। তাই ওরা চেয়েছিলেন ধীরে ধীরে এখানে ইসলামের বিস্তার ঘটুক। তাছাড়া এ ভূখ-ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের আধিপত্যের কারণে আরব-তুর্কি মুসলিম বণিক ও দরবেশরা তাদের ধর্মীয় আচার পালন করতেন একান্তই অনাড়ম্বরভাবে। দীর্ঘদিন রোজা-নামাজ-ঈদের মতো ধর্মীয় আচারগুলো তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
১২০৪ বা ১২০৫ সালের দিকে ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মুসলমানরা আসীন হন। দিল্লির মসনদে বসলেন সুলতান ইলতুতমিশ। মূলত এর পর থেকেই আরেকটু সাড়ম্বরে ইসলামের আচারগুলো পালনের রেওয়াজ শুরু হয়। আরেকটি লক্ষণীয় বিষয় হলো, মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস জানতে আমাদের মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসা প-িত-গবেষক-ইতিহাসবেত্তাদের সাহায্য নিতে হয়। কারণ দিল্লির মসনদে মুসলিমদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ফার্সী ভাষার প-িতরা এ অঞ্চলে ব্যাপকভাবে আসতে থাকেন। তারাই লিখে গেছেন মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস। সেখান থেকে আমরা ষোড়শ শতকের দিকে ঢাকা ও এর আশপাশে রোজা ও ঈদ-উৎসব পালনের চিত্তাকর্ষক চিত্র পাই।
এ রকমই এক প-িত ছিলেন ‘বাহারিস্তান-ই-গায়েবী’ বইয়ের লেখক মির্জা নাথান। ১৬০৮ সালের দিকে সুবেদার ইসলাম খান মোগল শহর ঢাকার পত্তন করেন। তার সঙ্গেই ঢাকায় এসেছিলেন নাথান। তার বর্ণনায় পাই- ‘শাবান মাসের ২২তম দিন থেকে ঢাকা ও তার আশপাশের এলাকায় রমজানের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। মসজিদ সংস্কার ও ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন করা হতো। বাড়ির কর্ত্রী ঠা-া পানি রাখার জন্য নতুন সুরি ক্রয় করতেন। ইফতার তৈরির আয়োজন সারতে গোলাপ জল, কেওড়া ও তোকমা ব্যবহার করা হতো। সারা রোজার মাস ব্যবহারের জন্য পান, মসলা ও মধু রাখা হতো।’
বোঝা যাচ্ছে, ষোড়শ শতকে রোজা এবং ঈদ-উৎসব পালনের বিষয়টি বিস্তৃতি লাভ করে। এর আরেকটি প্রমাণ পাই সে সময়কার হিন্দু কবিদের লেখা থেকে। ষোড়শ শতাব্দীর কবি মুকুন্দরামের ‘চ-ীম-ল’ কাব্যে এমন চরণ দেখতে পাইÑ ‘প্রাণ গেলেও রোজা নাহি ছাড়ে।’ সপ্তদশ শতকের কবি ভরতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যেও উঠে এসেছে মুসলিমদের রোজা-পালনের রেওয়াজ। ফলে বোঝা যাচ্ছে, তখন এই সব আচার ব্যাপক বিস্তৃত হয়েছিল বলে হিন্দু কবিরাও এ নিয়ে লিখেছেন।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের আরও আট কি নয় শতক পর তাদের ধর্মীয় আচারগুলো দৃশ্যমান হয়েছে। তবে সবচেয়ে আড়ম্বরের সঙ্গে তখন রোজা-পালন ও ঈদ-উৎসব হতো মোগল সেনা ছাউনিতে। বিভিন্ন ইতিহাস বইতে তার চমৎকার বর্ণনা পাওয়া যায়। তাতে দেখা যায়, ‘রোজার শুরু থেকেই সৈন্যরা একে অন্যের তাঁবুতে গিয়ে পান-ভোজন করতেন। মোবারিশ খাঁ নামের এক ব্যক্তি রোজাদারদের জন্য ভোজনের আয়োজন করেন। সেখানে সৈন্যরা ছাড়াও বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি অংশগ্রহণ করেন। রোজাদারদের খাওয়ানোর সামাজিক রীতিও মোগল সৈন্যরাই চালু করেন। ঈদের চাঁদ দেখার অভিজ্ঞতাও ছিল মজার। চাঁদ উঠলে সবাইকে তোপধ্বনির মাধ্যমে জানিয়ে দেওয়া হতো। দূর-দূরান্তের মানুষকে ঈদের আগমন বার্তা পৌঁছে দিতে ভারী কামান দাগানো হতো।’
ঈদগাহ নির্মাণেও মোগলরাই ছিলেন অগ্রণী। ঢাকার ইতিহাস গ্রন্থে হাকিম হাবিবুর রহমান লিখেছেন, ‘সুবেদার শাহ সুজার নির্দেশে তার প্রধান অমাত্য মীর আবু কাশিম ১৬৪০ সালে ঢাকার ধানম-িতে একটি ঈদগাহ নির্মাণ করেন। এটির দৈর্ঘ ছিল ২৪৫ ফুট, প্রস্থ ১৩৭ ফুট। ভূমি থেকে উচ্চতা ৮ ফুট। এই ঈদগাহে এসে ঈদের নামাজ আদায় করতেন মোগল সৈন্যসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।’ সে সময়কার ঈদ-উদযাপনের আকর্ষণীয় ছবি ঢাকার জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। বর্ণাঢ্য ঈদ-মিছিলের ছবিও সেখানে রয়েছে। একসময় ঢাকাবাসীর ঈদ-মিছিল, হিন্দুদের জন্মাষ্টমী-মিছিল আর মুহররম মাসের তাজিয়া-মিছিল ছিল নজরকাড়া।
দেলোয়ার হোসেন নামের এক গবেষকও ঢাকার ঈদের চমৎকার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘নৌবাহারি মুর্শিদ কুলী খাঁ গ্রন্থের লেখক আজাদ হোসেন লিখেছেন, ঈদের দিনে নবাব সুজাউদ্দিনের অধীনস্থ নবাব মুর্শিদ কুলি খান ঈদগাহ পর্যন্ত পথে প্রচুর টাকা-পয়সা বিলি করতেন। নবাবের সহযাত্রী হয়ে আমরা নবাবের কর্মচারী ও সাধারণ জনগণও ঈদগাহে যেতাম।’ এই বর্ণাঢ্য আয়োজনে হিন্দুদের উৎসবের একটি প্রভাব পড়েছে বলে মনে হয়।
সাম্প্রতিককালে পাওয়া গেছে ঢাকার নবাবদের ডায়েরি। তাতে দেখা যায়, ঢাকার নবাব খাজা আহসানউল্লাহ বিভিন্ন পঞ্চায়েত থেকে কাসিদা দল বের করা শুরু করেন। একটি বর্ণনায় আছেÑ ‘আজ ১৯০৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি বকর-ই-ঈদ। নামাজ পড়া-শেষে নবাব সাহেব আমাকে আদেশ দেন অন্যদের নিয়ে বিনা খরচে ক্লাসিক থিয়েটারে গিয়ে নাটক দেখতে।’ এখানে একটি চিত্তাকর্ষক বিষয় লক্ষ্য করার মতো। ঈদ-উদযাপনে একসময় ধর্মীয় আবহ বেশি থাকলেও বিশ শতকের শুরু থেকে এতে একটি গুণগত পরিবর্তন আসে। ‘ক্লাসিক থিয়েটারে নাটক দেখার’ মতো ঈদের দিনে নানা বিনোদন করার চল তখন থেকেই শুরু হয়। আজ যে টেলিভিশন চ্যানেলে এত এত ঈদ-আয়োজন উপভোগ করা বা ঈদের দিনে বাইরে বিভিন্ন জায়গায় বেড়াতে যাওয়া হয়Ñ এই রেওয়াজগুলোর শুরু বলা যায় নবাবদের ওই থিয়েটার দেখার সংস্কৃতির মাধ্যমে। দেখা যাচ্ছে, উৎসবও আসলে বিবর্তিত হয়। প্রথমদিকে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠের এই ভূখ-ে মুসলমানরা তাদের আচার বা উৎসবগুলো কোনো রকমে চালু রেখে গেছে। ধীরে ধীরে এ সব উৎসব-আয়োজন দৃশ্যমান হয়েছে।
তবে ঈদ-উদযাপন তখনও এক হিসেবে সীমিতই ছিল। ঢাকার নবাব-বাড়িতে এটা বর্ণাঢ্য আয়োজনে হয়েছে। এছাড়া বিশ শতকের ত্রিশ বা চল্লিশের দশকেও ঈদ-উদযাপনে তেমন আড়ম্বর দেখা যায়নি। আবুল মনসুর আহমেদের বই থেকে আমরা বিষয়টা জানতে পারি। এর কারণ খুব স্পষ্ট। সমাজে একটি অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে না উঠলে উৎসব-আয়োজনে আড়ম্বর দৃশ্যমানভাবে হয় না। কারণ বিত্তশালীরা নিজেদের মতো করে উৎসব করেন। তারা এমনকি দেশের বাইরেও চলে যেতে পারেন। আর দরিদ্রদের তো নুন আনতে পানতা ফুরায়, উৎসব করবেন কীভাবে? ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক মন্ত্রিসভা গঠন করার পর মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের উদ্যোগ নেন। মুসলমানদের নানা সুযোগ-সুবিধা দেওয়া শুরু করেন। তখন থেকে এখানে একটি অবস্থাপন্ন মধবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হতে থাকে। কারণ গ্রামীণ জোতদারেরা তাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজে শিক্ষার জন্য পাঠাতে থাকেন। ফলে লেখাপড়া শিখে চাকরি-বাকরি করে তারা একটু অবস্থাপন্ন হতে থাকলে ঈদ-উদযাপনের আয়োজন ব্যাপকতা বাড়তে থাকে। এই অবস্থাপন্নরা ঢাকা বা কলকাতায় বড়সড় আয়োজনে ঈদ-উৎসব করতেন।
তবু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরও বাংলাদেশ নামের ভূখ-ে সেভাবে মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠেনি। ফলে সারা দেশে ঈদ নিয়ে এত জাঁকজমক ছিল না। পাকিস্তান আমলের শেষদিকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিটা গড়ে ওঠতে থাকলে কিছুটা আড়ম্বর বাড়ে। তবে সেটাও তেমন কিছু নয়।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পরই এখানে ধীরে ধীরে অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠতে থাকে। আশির দশক থেকে রপ্তানিমুখী গার্মেন্ট শিল্পের বিপুল বিকাশ ঘটে। বিদেশের শ্রমবাজারগুলোতে আমাদের মানুষজন কাজ করতে শুরু করেন। এ সব কারণে গ্রাম-শহরের জনগোষ্ঠীর আর্থিক সামর্থ্য বাড়তে থাকে। ধীরে ধীরে একটি বড়সড় মধ্যবিত্ত শ্রেণি এখানে গড়ে ওঠে। গত চার দশকে এখানে কিছুটা ইসলামাইজেশন যেমন হয়েছে তেমনি উৎসবগুলোও ব্যাপকতা পেয়েছে। মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে বলে এখন ঈদ-আয়োজনে বর্ণাঢ্যতা এসেছে। গ্রামের যে মেয়েটি গার্মেন্টে কাজ করতে ঢাকায় যায়, সে ঈদের ছুটিতে গ্রামে ফেরে আপনজনদের জন্য উপহার নিয়ে। কিছু নগদ অর্থও মা-বাবার হাতে তুলে দেওয়ার সামর্থ্য তার হয়েছে। গ্রামের ছেলেটি বিদেশে গিয়ে বিপুল অর্থের মালিক হয়ে দেশে ফিরেছে। ওখান থেকে সে প্রচুর উপহার নিয়ে এসেছে পরিজনদের জন্য। বাড়ির দাওয়ায় বসে সে সব উপহার সবাইকে দেখায় ছেলেটি। শহর-মফস্বলের জনগোষ্ঠীও চাকরি-বাকরি এবং ব্যবসার সূত্রে নানাভাবে সচ্ছল হয়েছে। এই যে আর্থিক সামর্থ্য এসেছে আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীর মধ্যেÑতারাই ঈদকে জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলছেন। এভাবে গ্রাম-শহরে অবস্থাপন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণিটির যত বিকাশ হবে, তত বিকশিত হবে উৎসব-আয়োজন পালনের ঢঙটিও।
ঈদ-উৎসব এখন আর শুধু উৎসব নয়, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্যও এটি একটি সুফলদায়ক বিষয়। এ দেশে এখন সারা বছর যত না ব্যবসা হয়, ঈদের সময় তার কয়েকগুণ বেশি হয়। খাবার-দাবারের সামগ্রী থেকে শুরু করে পোশাক-পরিচ্ছদ, এমনকি বিনোদনের জগতেও বিরাট বাণিজ্যের সুযোগ করে দেয় এই উৎসবটা। চ্যানেলে চ্যানেলে আজ যে এত আয়োজনের পসরা, তার কারণ এই ভূখ-ের জনগোষ্ঠীর উৎসব-উদযাপনের ব্যাপকতা।
আরেকটি দিক দিয়ে আমাদের দেশে ঈদের তাৎপর্য অসাধারণ। ঈদ গ্রাম-শহরের মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে চিন্তার আদান-প্রদান ঘটাতে সাহায্য করে। আমাদের গ্রাম থেকে শহরে কাজ করতে যাওয়া মানুষেরা যদি পুরোপুরি শহরমুখী জীবনে খাপ খাইয়ে নিত, গ্রামে আর ফিরতে না চাইত তাহলে এই আদান-প্রদান সম্ভব হতো না। ঈদ-উৎসব উদযাপনের জন্য শহরের মানুষেরা গ্রামের দিকে ছুটে যায়। আনন্দ-উল্লাসে মেতে থাকে কয়টি দিন। এ সময় তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে গল্প-আড্ডাও হয়। তাতে করে দেশের রাজনৈতিক এবং আর্থ-সামাজিক বিষয়ে তাদের মধ্যে চিন্তা-বিনিময় হয়। এভাবেই ভোট-প্রদানের মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলোও প্রভাবিত হয়।
আমাদের ঈদ-উৎসবে এখন যতটা না ধর্মীয় আবহ থাকে, তার চেয়েও অনেক বেশি করে এটি অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক চেতনা তৈরিতে সাহায্য করে, সারা দেশের মানুষকে একটি ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ করে, স্বজনদের সঙ্গে একটি সুন্দর আনন্দময় সময় কাটানোর সুযোগ করে দেয়। পাশাপাশি এই জনগোষ্ঠীর রুটি-রুজির সংস্থান করে, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়।
লক্ষণীয় যে, আমাদের ঈদ-উৎসবের এই ধরনটা পাশ্চাত্যের উন্নত কিছু দেশের উৎসবের চেয়ে ভিন্ন। ওখানে যোড়শ শতকেই পুঁজির বিরাট বিকাশ ঘটেছে। শিল্প-বিপ্লব হয়েছে। বিরাট সব কলকারখানা গড়ে ওঠেছে। এর ফলে ওখানে মানুষের চিন্তা-চেতনার জগতে বিরাট একটা বিপ্লব বা রেনেসাঁও সাধিত হয়েছে। এর ফলে গ্রাম থেকে শহরে যাওয়া মানুষগুলো শহরেই থেকে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে তার শেকড় থেকে। এভাবেই সেখানে নাগরিক-আধুনিকতার বিকাশ ঘটেছে। উৎসব-উদযাপনও তাই সেখানে শহরভিত্তিক। আমাদের এখানে শিল্প-বিপ্লব বা পুঁজির বিকাশ হয়নি। গত কয়েক বছরে নানা কারণে বরং কৃষি-বিপ্লব সাধিত হয়েছে। কিন্তু ভূমি-সংস্কার হয়নি বলে পাশ্চাত্যের নাগরিক-আধুনিকতাও এখানে নেই। তাই এখানে অনিবার্যভাবেই উৎসব-উদযাপনের জন্য মানুষ গ্রামেই ফিরে যায়। আর নতুন বিকশিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি এই উৎসবগুলোকে নিজেদের রঙে রাঙিয়ে দেয়।