অলীক বলল, শুনেছ রাই, আমাকে মেঘালয়ের সরগুঞ্জা হিল চলে যেতে হবে।
সরগুঞ্জা হিল, নাম শুনিনি তো এমনি কোনো পাহাড়ের,
কে জানে, ওটা মহাপাত্রর বানানো কোনো জায়গা হতে পারে।
বুঝতে পারলাম না। রাই বলল।
আমাকে বদলি করেছে মহাপাত্র।
বদলি মানে ট্রান্সফার, হোয়াই?
আই ডোন নো রাই, মনে হয় এটা পানিশমেন্ট ট্রান্সফার।
পানিশমেন্ট বদলি, কী করে বুঝলে?
জায়গাটার নাম কেউ শোনেনি, বললাম না বানানো জায়গা।
বানানো জায়গা মানে? রাইয়ের বিস্ময় বেড়ে যাচ্ছিল। জায়গা বানানো হয়, হতে পারে? অলীক অদ্ভুত সব কথা বলে। আর সেইটাই অলীকের প্রতি তার আকর্ষণ।
অলীক বলল, অ্যাকচুয়ালি ও রকম কোনো জায়গা হয় তো নেই, কিন্তু ট্রান্সফার অর্ডারে ওই জায়গার নাম, মহাপাত্র একবার পছন্দপুর নামে একটি জায়গায় একজনকে বদলি করেছিল, ওই জায়গাটা নাকি চক্রধরপুরে সঞ্জয় নদীর ধারে, সেই অনিমেষ তো গিয়ে কোথাও খুঁজে পেল না, গরমে ছুটে ছুটে হয়রান।
রাই হি হি করে হাসল, তোমাদের মহাপাত্র দারুণ তো, সঞ্জয় নদী, চক্রধরপুর, পছন্দপুর, অথচ তার কোনোটাই নেই?
না না, পছন্দপুরটাই শুধু নেই, বাকি সব আছে রাই, চক্রধরপুর এক রেলওয়ে জংশন, সেখানে সঞ্জয় আর রঞ্জয় নামের দুটো নদী আছে, তারা নাকি দুই ভাই, নদীরা আবার যমজ দুই ভাই, বোঝো রাই।
রাই বলল, দারুণ তো, তোমাদের মহাপাত্র এইসব খুঁজে বের করেন?
হু, আরো আছে, এই যেমন নীলাভকে বদলি করেছিল ন’পাহাড়ি, চাইবাসার কাছে, একটা ফিকটিসাস প্লেস, নেই, নীলাভ কী করল গুগুল সার্চ করে না পেয়ে গেল স্যারের কাছে, গুগুলে নেই এমন জায়গা আছে নাকি স্যার?
তারপর? রাইয়ের দম যেন বন্ধ হয়ে আসে, পেয়েছিল?
স্যার বলল, যেতে হবে না, অন্য লোক যাচ্ছে, গুগুল সব খোঁজ রাখে না, গুগুল ইজ নট গড, মানুষই ওতে অ্যাড করে, ভুলভালোও থাকে।
হি হি করে রাই হাসল, আমি অনেক কিছুই গুগুল থেকে জেনে নিই, হে হে হে, গুগুল জানে না, স্যার জানে?
ইয়েস, যেমন মহাপাত্র তাকে তখন জিজ্ঞেস করেছিল, হোয়াট ইজ দ্য নেম অফ ইওর নেটিভ ভিলেজ?
তারা দুজন এখন মুখোমুখি। রাই আর অলীক। এর ভিতরে রাইকে লাভার বয় নামের এক ফেক আইডির লোক এসে হাই করেছে দুবার, ছবি পাঠিয়েছে ম্যানহাটনের, গোলাপ দিয়েছে, রাই ফিরেও তাকায়নি। তখন সে থেমেছে নিজে নিজে। অলীকের সঙ্গে কথা বলে সুখ। অলীক এমন সব বিষয়ের অবতারণা করে যে তার কথা না শুনে পারা যায় না। কথায় কথা বেড়েই যেতে থাকে। হুঁ, নেটিভ ভিলেজ? আমার তো কোনো নেটিভ ভিলেজ নেই অলীক, সেই কবে কোনকালে আমার ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দা চলে এসেছিলেন সপ্তগ্রাম থেকে, সরস্বতী নদীর ধার থেকে, তারপর থেকে আমরা কলকাতার লোক, গঙ্গার ধারে, জোড়াবাগান, আমি হলে নেটিভ ভিলেজের নাম তো বলতে পারতাম না অলীক।
অলীক বলল, নীলাভর তো আছে নেটিভ ভিলেজ, পতিনা, তো স্যার গুগুলে সার্চ দিল, অ্যান্ড কুড নট ফাইন্ড, তখন নীলাভ চুপ।
অন লাইন রাই, অলীকও অন লাইন। রাই অলীকের ভার্চুয়াল ফ্রেন্ড। তারা কম্পিউটারে বসে এক বাস্তবতা তৈরি করে নিজেদের মতো করে। কল্পনার পৃথিবী। এই যেমন তারা এখনই বেরিয়ে মনি স্ক্যোয়ার মলের আলোয়। বাইরে অনুজ্জ্বল শহর। মেঘ এসেছে। ভিজে ভিজে বাতাস বইছে। কয়েকদিন ধরে চলছে এই মেঘের আনাগোনা। মধ্যে একদিন হঠাৎ করে সন্ধেয় ঠা-া বাতাস, মেঘের ডাক, হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল মেঘ। সেদিন নাকি খুব ভিজেছিল অলীক। ওর টনসিলের সমস্যা আছে। ঠা-া লাগলে গলা ব্যথা হয়, গলা বসে যায়। গায়ে তাপ চলে আসে। ছোটবেলা থেকে এই চলছে। আরো দু-তিন বছর গেলে তবে ঠিক হবে। রাইয়ের ছিল ছোট বেলায়। দশ বারো থেকে তা অদৃশ্য।
রাই বলল, আমরা এখন কোথায় অলীক?
কেন মনি স্কয়ারের ভেতরে একটা কাফেতে, বিশেষ কেউ নেই।
রাই বলল, এমন হতে পারে নাকি, কাফেটা শুধু তোমার আর আমার হয়ে গেছে?
হতেই পারে, এক একটা সময় গর্জমান সমুদ্র চুপ করে থাকে শোনোনি, অমনি কাফেও নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, কেউ নেই কোথাও।
রাই বলল, তুমি দেখতে পাচ্ছ না, ওখানে এখন তিনটে বুড়ো বসে আছে কফি নিয়ে।
আমরা আছি উইন্ডো সাইড, কাচের ভেতর দিয়ে কতদূর দেখা যায় রাতের কলকাতা, ওরা আছে একদম মধ্যিখানে, তিনটে বুড়োর তিন রকম পোসাক।
ইয়েস। অলীক বলল, একজন হাফ হাতা শার্ট আর গ্রে ট্রাউজারস, আর একজন ধুতি আর পাঞ্জাবী, থার্ড ম্যান...। অলীক থেমে যায়।
থার্ড ম্যান জিনস আর ব্ল্যাক টিশার্ট, গোল গলা, চোখে একটা নাইনটিন্থ সেঞ্চুরির শেষ দিকের চশমা, সোনালি রং, একেবারে গোল গোল দুটো চোখ, টোয়েন্টি ফার্স্ট অ্যান্ড নাইনটিন্থ সেঞ্চুরি মিশে আছে ওই ওল্ডম্যানের ভেতর। রাই হাসল বলতে বলতে।
অলীক বলল, ওল্ড ম্যানরা খুব ইয়াং অ্যান্ড বিউটিফুল খোঁজে।
রাই বলল, আই লাইক দেম, দে আর সেফ, তারা হেল্পফুল হয়, অনেক কিছু জানে।
অলীক জিজ্ঞেস করল, আমি কি ওল্ড ম্যান রাই?
রাই খিলখিল করে হাসে, তুমি হদ্দ বুড়ো, দুশো বছরের গ্রান্ড-গ্রান্ড ফাদার, দ্যাখো না কী সুন্দর তাকিয়ে আছে মানুষটা, আমাকে দেখছে।
উফফ, রাই, আমি এখনই বেরিয়ে যাব এই কাফে থেকে।
মোটেই না, লোকটাকে আমার চেনা মনে হচ্ছে অলীক। রাই বলল।
কে ওই লোকটা?
মনে হচ্ছে, আমার দাদুর বন্ধু মানসরঞ্জন, দাদু আর তিনি দাবা খেলতেন খুব, আমাদের একতলার বৈঠকখানার ঘরে, হি ওয়াজ আ সিভিল সারভেন্ট, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন ইউপিতে, মোরাদাবাদ ডিস্ট্রিক্টে, তাঁর টেনিওরে একটা বড় রায়ট বাঁধে, স্থানীয় এম,পি, ছিলেন তার হোতা, মানসরঞ্জন তাকে অ্যারেস্ট করে নন-বেলেবল সেকশন দিয়ে দিয়েছিলেন, সে একটা বড় স্টোরি অলীক। বলতে বলতে রাই থামে। যেন কাচের দেওয়াল দিয়ে সে বাইরের আলো-অন্ধকারের শহর দেখছে অন্যমনা হয়ে।
এই তাদের আলাপের খেলা। অন লাইনে আলাপ। কেউ কাউকে দ্যাখেনি এখনো। প্রতিদিন রাত সাড়ে ন’টার পর এখানে দেখা হয়। কম্পিউটারের সামনে। সেই সময়টা সকাল না বিকেল, বিকেল না সন্ধে তারা ঠিক করে নেয়। ঠিক করে নেয়, তারা সেই সময়ে কোথায়? সাউথ সিটি মল না মনি স্ক্যোয়ার কিংবা সিটি সেন্টার। অথবা গঙ্গার পাড়ে, রবীন্দ্রসদনের সিঁড়িতে। একাডেমি অফ ফাইন আর্টসের সামনে যে ফোয়ারা, সেখানে। কোথায় তাদের দেখা হয়েছে, সবটাই নিজ কল্পনা। কম্পিউটারে সকাল নেই সন্ধ্যে নেই, প্রকৃতির রোষ নেই, ভালোবাসা নেই। তবে বাইরে শীত বসন্ত ঋতুর চিহ্ন এখানে ছবিতে ধরা পড়ে। বাইরের ঝড় বৃষ্টি, তুফান সমস্তটা। আবার বসন্তের ফুল আর শীতের আগুন পোহানোর ছবিতে তারা সেই ঋতুর ভিতরে প্রবেশ করে।
নিউ প্লেস অফ পোস্টিঙে তুমি যাবে?
আই ডোন’নো।
নর্থ ইস্টে মেঘালয় খুব সুন্দর জায়গা। রাই বলল।
বেড়াতে গেলে সুন্দর, কিন্তু এমনিতে না। অলীক বলল, মহাপাত্র আমাকে সহ্য করতে পারে না, জায়গাটা নেই হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
হু ইজ মহাপাত্র?
আমার ইমেজিয়েট বস, দ্যাখো রাই, লোকটা আমাকে বিপদে ফেলতে চাইছে, ওখানে নর্থ ইস্টে টেররিস্টদের খুব প্রতাপ।
রাই চুপ করে থাকে। অলীক আবার তার অফিসের কথা আরম্ভ করল। অলীক সেখানে যাবে কী করে? সে কোনোদিন কলকাতা ছেড়ে কোথাও যায়নি। গ্রাম দেখেছে সে ট্রেনের জানালা থেকে। আর কখনো বা বেড়াতে গিয়ে বন বাংলোয় উঠে। অলীক বলছে, তাকে মহাপাত্র সেই জায়গায় বদলি করেছে, যেখানে এখনো নর্থ ইস্টের টেররিস্টরা এখনো সক্রিয়। আমাকে তাদের দিয়ে মারবে মহাপাত্র। সুনীতাকে বলেছে, অলীককে যেতেই হবে ওই রিমোট প্লেসে।
রাই বলল, ধুত, একবার বলছ জায়গাটা নেই, আবার বলছ টেররিস্ট, টেররিস্টরা আর আগের মতো নেই, ভয় পেও না।
অলীক বলল, এখন তারা মার্ডারের লাইন চেঞ্জ করেছে কদিনের জন্য, তারা টাকা তুলছে পাবলিকের কাছ থেকে, টু পারচেস আর্মস।
মাথা নাড়ে রাই, কে বলল, কই শুনি না তো।
শুনবে কি রাই, স্যালারির টেন পারসেন্ট আমাকে দিয়ে দিতে হবে, এটা মাস্ট।
নো নো নো, এটা রটনা, তোমার স্যালারি জানবে কী করে?
মহাপাত্র জানিয়ে দেবে, হি ইজ আ নটরিয়াস পারসন, সে আমার অ্যাকচুয়াল স্যালারি জানিয়ে দেবে, ডিডাকশনটাও ধরিয়ে দেবে, প্রচুর যাবে।
রাই বলল, তুমি ওসব মাথা থেকে তাড়াও অলীক, ওসব বলে তোমাকে ভয় দেখাচ্ছে তোমার মহাপাত্র, সে থাকে কলকাতায়, সে জানবে কী করে টেররিস্টদের খবর?
আমাদের কোম্পানিকে সব পার্টির চাঁদা দিতে হয়,না হলে মানি কালেকশন হবে কী করে। সেটা মহাপাত্র করে, সে যোগাযোগ করে সব পার্টির সঙ্গে, মহাপাত্র আমার সর্বনাশ করে দেবে। আমাদের মহাত্মা কোম্পানির কাজ কম্মো নিয়ে কথা উঠতে আরম্ভ করেছে।
রাই বলল, ইস, মানসরঞ্জন উঠে যাচ্ছেন অলীক, তুমি ওঁর কাছে জেনে নিতে পারতে মেঘালয়ে অমনি পাহাড় আছে কিনা।
তো, কী হলো, সেই যে রায়টে এম.পি. কে জেলে ভরে দিল? অলীক জিজ্ঞেস করল, উনি তারপর থাকতে পারলেন ওখানে? অলীক জিজ্ঞেস করে।
নো, কিন্তু রায়টের সময়টায় উনি ওখানেই, ড্রাস্টিক অ্যাকশন নিয়েছিলেন দাঙ্গাবাজদের বিরুদ্ধে, ক্রিমিনাল ল-য়ের এমন সব সেকশনজুড়ে দিয়েছিলেন যে এম.পিÑ জামিনই পায়নি, উনি তারপর বদলি হয়ে যান, আর কিছুদিন বাদে চাকরি ছেড়ে দিয়ে অধ্যাপনা করতে যান, দারুণ ছিলেন, কী হ্যান্ডসাম বলো অলীক।
উফ, এত কথা জিজ্ঞেস করছি না আমি রাই, মানসরঞ্জন কি এইট্টি হবেন?
নো, সেভেন্টি সেভেন হবেন, দাদুর চেয়ে ছোট ছিলেন কয়েক বছর, আমার জন্মের সময় ওরা সারা দিন দাবার বোর্ড বন্ধ করে চুপচাপ বসেছিলেন, আমি তখন কোচবিহারের এক নার্সিং হোমে জন্মাচ্ছি, ইন দ্য ইয়ার নাইন্টিন টু, ওখানে আমার মায়ের বাপের বাড়ি।
তারপর?
তারপর আর কী, মানসরঞ্জনকে জিজ্ঞেস করলে বলতে পারতেন, কতদিন বাদে দেখলাম, আচ্ছা অলীক, উনি কি আমাকে চিনতে পারেননি?
কী করে বলি বলতো।
আমাকে বার বার দেখছিলেন, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন যে তা আমি টের পাচ্ছিলাম, কতদিন বাদে দেখলাম মানুষটাকে।
কোথায় থাকেন?
তা তো জানি না অলীক।
না, চিনতে পারলে উনি তোমাকে ডাকতেন রাই।
রাই বলল, কী জানি, হয়ত তাই, চিনতে পারেনি মানস, আমি একদিন ওঁকে মানস বলে ডেকেছিলাম, দ্য হ্যান্ডসাম ইয়াং ম্যান অফ সেভেনটি, আমি তখন এইট্টিনে পড়লাম, জাস্ট এইট্টিন অ্যান্ড বিকেম অ্যাডাল্ট, উনি আমাকে কী বই গিফট করেছিলেন জানো?
কী বই?
ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ, হি হি হি, আমি বলেছিলাম, আই লাভ ইউ মানস, এমনি, মজা করে, আমি যদি অনেক বছর আগে জন্মাতাম, উফফ!
তুমি কি ওঁর প্রেমে পড়েছিলে?
কী জানি, হয়ত তাই, আবার না হতেও পারে, অলীক উনি এখন কোথায় তা কে জানে?
তার মানে? অলীক জিজ্ঞেস করে, কোথায় থাকেন?
আই ডোন নো অলীক, উনি আস্তে আস্তে সব ভুলে যাচ্ছিলেন, অ্যালঝাইমার হয়ে গিয়েছিল, সব কিছু ব্ল্যাক, বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফেরেননি আর। রাইয়ের চোখে অশ্রুবিন্দু। বলল, বহুদিন বাদে মনে হলো এই ভাবে দেখা হয়ে যেতে পারে হয় তো, চলো আর না, কাফেটা এত নিস্তব্ধ! মনে হচ্ছে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে, বেয়ারা, কাউন্টারের লোকটি, কিচেনের দুটো শেফ..., চলো বেরিয়ে পড়ি অলীক।
তাহলে বাড়ি ফিরে যাও, বিছানায় শুয়ে শুয়ে ভাব তুমি কী করবে, আমি অফ লাইন হই।
না রাই, কিন্তু আমি মহাপাত্রর সঙ্গে লড়ব কী করে?
রাই বলল, তুমি নিজেই জেনে যাবে।
রাই পোস্ট গ্রাজুয়েট করছে, ফাইনাল ইয়ার। আগের সেমিস্টারে ৭৪ পারসেন্ট নাম্বার পেয়েছিল, বলল, মেঘালয় কী আর কলকাতা কী, আমরা তো অন লাইন হবো, ওদিকে শীতের সময় স্নো-ফল হয়, এই সময় অন-লাইন হয়ে আমি তোমার সঙ্গে জানালায় বসে দেখব নিরবিচ্ছিন্ন তুষারপাত।
না না, আমিই যাবই না, আমি খুব শীত কাতুরে।
ইস, আঙুরের সুরা নিও, শীত চলে যাবে। রাই একটা স্মাইলি এঁকে দিল তার কথার পাশে।
অলীক বলল, আমি কলকাতার বাইরে কিছুই চিনি না রাই।
চিনে যাবে, এখন আমাদের ট্যাক্সি কতদূর গেল? রাই জিজ্ঞেস করে অন লাইনে তার বাড়িতে বিছানায় কাত হয়ে শুয়ে ল্যাপটপের কি বোর্ডে আঙুল সরাতে সরাতে।
অলীক বলল, বাই পাস থেকে বেরিয়ে মানিকতলার দিকে ছুটছে ট্যাক্সি। কিছুটা গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
কেন, দাঁড়াল কেন?
মিছিল।
কিসের মিছিল? বিরক্ত রাই জিজ্ঞেস করে, এখন তো রাত্তির।
না, আমরা দিনে ফিরে এসেছি।
উফফ, অলীক আমি দিনের ভিতরে যেতে চাই না, কী রোদ্দুর, ভ্যাপসা গরম।
অলীক বলল, কিন্তু দিনের বেলা ছাড়া মিছিল হয় না।
কেন হবে না, মোমবাতি নিয়ে রাস্তার ধার দিয়ে, কারো মুখে একটাও কথা নেই, সেই মিছিল বেশ ভালো, আমিও একবার সেই মিছিলে হেঁটেছিলাম, দিল্লির সেই গণধর্ষণে।
অলীক বলল, সে তো অন্যের পক্ষে মিছিল, আমার কিছু হয়নি, আমি অন্যের প্রতি সমবেদনা জানাতে মিছিল করছি, সেখানে রাগ, ক্ষোভ থাকে কম।
কিছুটা সত্যি, সমস্তটা নয়।
তা হয় তো ঠিক, কিন্তু ধরো বন্ধ জুটমিলের শ্রমিকদের মিছিল, ছিট ফান্ডে সর্বস্ব হারানোদের মিছিল, তা মোমবাতি নিয়ে হয় না। বলল অলীক, তোমাকে আমি তাই দিনের বেলায় নিয়ে এলাম রাত থেকে।
হুঁ, মানুষ খুব রেগে আছে অলীক, আমি দেখতে পাচ্ছি।
হ্যাঁ, রেগে যাচ্ছে। অলীক বলল।
কেন গো? রাই জিজ্ঞেস করে, আমার খুব ভয় করে কেউ রেগে গেলে, মানসরঞ্জন বলত, রাগের মাথায় মানুষ ল-ভ- করে দিতে পারে সব কিছু, রাগের ভিতরে কোনো কাজ করা উচিত নয়।
অলীক বলল, একের পর এক জুটমিল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
ইসস, জানি, পরপর, কেন গো?
অলীক বলল, সিনেমার নায়ক সাতটা ঘুমন্ত মানুষকে চাপা দিয়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, শাস্তি হতে হতেও হয় না।
জানি, খুব খারাপ লাগছে, সিনেমার গায়ক, নায়ক, নায়িকারা, আই পি এল ক্রিকেটাররা কি তার হয়ে কি মোমবাতি মিছিল করবে?
না, আমরা রাতে ফিরে এসেছি রাই, আমরা মিলেনিয়াম পার্স যাব বাট রাস্তা বন্ধ, নায়কের শাস্তি মকুবের জন্য মোমবাতি হাতে হাঁটছে গায়ক, ক্রিকেটার, হিরো হিরোইন, বছর কুড়ি বাইশের ছেলে মেয়ে, বুকে হিরোর মাসল ফোলান বডি।
উফ, তা হয় না অলীক, ওই হিরো মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চাপা দিয়েছিল সাতটা লোককে, খুনি, ওর জন্য মিছিল?
ইয়েস, ওর সঙ্গে জুড়ে গেছে জেলবন্দী মন্ত্রীর মুক্তি, আয় বহির্ভূত কোটি কোটি টাকার মালিক মন্ত্রীর বেকসুর মুক্তির দাবী, সুপারি কিলার লাগিয়ে নিরীহ স্বামীকে হত্যা করা স্ত্রী আর তার প্রেমিকের মুক্তি, প্রেমে সাতখুন মাপ। বলতে বলতে অলীক থেমে গেল। তার মনে হতে লাগল সে যা বলছে তা হলেও হতে পারে, খুব শিগিগির তেমন একটা মিছিল হবে, তেমন দাবিপত্র রচিত হবে। তাদের পথ আটকে যাবে। তাদের হাঁটতে বলা হবে সেই মিছিলে। সিনেমার নগ্নিকা আর উন্মুক্ত দেহী হিরোরা মিছিল করবে।
অলীক বলল, দিনের আলোয় সেই চিট ফান্ডে সবর্স্বান্ত লোকদের মিছিল, বন্ধ জুটমিলের শ্রমিকের মিছিল, নিহত ফুটপাথবাসীদের বাবা মায়ের মিছিল ।
উফফ, আমাদের কথা কোনদিকে চলে যাচ্ছে অলীক, আমার কেমন অস্বস্তি হচ্ছে, চিট ফান্ডে আমাদের কাজের মাসির চল্লিশ হাজার গেছে।
সর্বস্বান্তরা মিছিল করছে। অলীক বলল।
না, তারা কপাল কপাল করে হা হুতাস করছে। রাই বলল, আমাদের কাজের মাসি তাই করছে।
২২০০০ কোটি টাকা তুলে ফূরতি করে পালিয়ে গিয়েছিল লোকটি, এখন জেলে, জামিন হয়নি, বাট মোমবাতি মিছিলে হিরো তার কথাও বলছে।
কী করে হল বল দেখি, এত টাকা তুলল কী করে? রাই জিজ্ঞেস করে।
কী করে হবে, লোককে মিথ্যে বলে টাকা তুলেছে, আমাদের বাজারে সবজিওয়ালার পঁয়ষট্টি হাজার গেছে, ওর হাজব্যান্ড সবজি বেচে, ডেইলি রাখত টাকা।
রাই জিজ্ঞেস করে, তোমাদের অফিস কী করে?
অলীক বলল, আমি ঠিক জানি না রাই।
তুমি তো টাকা ব্যাঙ্কে রাখ অলীক, তোমার কোম্পানি কি বাজার থেকে টাকা কালেক্ট করে?
আমি তো বি কম, ডিস্টানস কোর্সে এম.বি.এ, আমি কোম্পানির কিছুই জানি না, শুনছি আমাদের কোম্পানি মেঘালয়ে বড় একটা প্রজেক্টে হাত দিয়েছে, আমাকে সেখানে বদলি করেছে, কিন্তু সবটাই ফেক হতে পারে, মহাপাত্র আমাকে হয়রাণ করতে এইসব করছে।
কী প্রজেক্ট?
জানে না অলীক, সে বানাতে লাগল, বলল, বোধ হয় রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন, একটার পর একটা গ্রাম ধরা হচ্ছে, আর খুটি পুতে তার লাগিয়ে সব ব্যবস্থা করবে আমাদের কোম্পানি, গভর্নমেন্ট দেবে পাওয়ার, কিন্তু আমি তো এমবিএ আমার এই কাজ নয়।
এখন ওসব দ্যাখে না অলীক, আভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার করছে আইটির কাজ, এখন এসব হচ্ছে।
গাড়ি এক এক কদম এগোচ্ছিল। মিছিল খালব্রিজ পার হয়ে বাম দিকে ঘুরে যাচ্ছে। গাড়ির গতি বাড়ছে। অলীক বলছে তার আশঙ্কার কথা। রাই তাকে আশ্বস্ত করতে চাইছে। তারা মিলেনিয়াম পার্কের দিকে এগোচ্ছিল ক্রমশ। রাত বাড়ছিল অন লাইনে।
৩.
মহাপাত্র আর অলীক এখন মুখোমুখি। মহাপাত্র ছ’ফুটের উপর। বাড়ি মেদিনীপুর ওড়িশার সীমানায়। মহাপাত্র একদম গ্রামের স্কুল থেকে পাস করে জেলার কলেজে পড়ে অরডিনারি গ্রাজুয়েট। কিন্তু সে এত এফিসিয়েন্ট যে এই কোম্পানিতে বড় কত্তার ডান হাত। বড় কত্তা বছরের অর্ধেক সময় বাইরে থাকেন, ইউ,কে, ইতালি, টার্কি, গ্রিস, ভূমধ্যসাগর টেমস নদীর হাওয়া খেয়ে বেড়ান। ভেনিসে গন্ডোলায় ভেসে বেড়ান। দেশে থাকলে কখনো দিল্লি, কখনো মুম্বাই, পুনে, লাতুর গিয়ে বসে থাকেন। লাতুরে ভূমিকম্প হয়েছিল বছর কুড়ি আগে। সেখানে এখনো কাজ চলছে। কোম্পানি সেখানে আবাসন নির্মাণ করছে। গুজরাতের ভূজেও কোম্পানি ওই কাজ করছে। নর্থ ইস্টেও হচ্ছে, রুরাল ইলেকট্রিফিকেশন, স্যানিটেশন এই সব। নির্মল ভিলেজ গড়ছে কোম্পানি। অলীক তুমি মেঘালয় গিয়ে কাজটা সাক্সেশফুল করে এস, ভার্জিন এরিয়া, প্রচুর টাকা, চা বাগান, কমলা লেবু বাগান, আনারস বাগান, প্রচুর টাকা লোকের হাতে, হাত বাড়ালেই কোম্পানির অ্যাকাউন্টে চলে আসবে, এরপর তোমাকে কোম্পানি ইউ,কে পাঠাবে।
স্যার, আমি কোথায় থাকব ওখানে?
সে ব্যবস্থা আছে, বাংলো রেডি, তোমার জন্য ওখানে স্টাফরা ওয়েট করছে।
অলীক বলল, আমি কোনোদিন গ্রামে যাইনি।
যাও, গ্রামই তো আমাদের সব কিছু দেয়, আর এতো সুরগুঞ্জা পাহাড়, মেঘালয় হিলস, অপূর্ব প্রকৃতি, সরল মানুষ, দরকারে সব পাবে, তবে সাবধান, রোগটোগ বাঁধিয়ে এসো না।
অলীক বলল, আমি না গেলে হবে না?
না, বড় সায়েবই তোমাকে সিলেক্ট করেছেন। মহাপাত্র বলল।
বড় সায়েবকে আমি দেখিনি স্যার, আমি তো আপনাকে জানি।
বড় সায়েবের নজরে আছ তুমি, এরপর ইউ.কে, টেমস-এর তীরে তুমি ঘুরবে, লরডসে বসে ক্রিকেট দেখবে, ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে ফুটবল, ক্যান ইউ ইমাজিন?
স্যার, জায়গাটা আছে তো?
তার মানে? মহাপাত্র সিধে হয়ে বসলেন, আছে মানে?
মানে সঞ্জয় আর রঞ্জয় নদীর ধারে পছন্দপুর, পছন্দপুর তো পাওয়া যায়নি।
কে বলেছে পাওয়া যায়নি, সেখানে অফিস চলছে।
অনিমেষ পাল তো পায়নি স্যার। অলীক সাহস করে বলল।
সে যায়ইনি, পাবে কী করে, চাকরি ছেড়ে চলে গেল, তাকে ওর পরে তো বলেছিলাম সাতপাহাড়ি যেতে, সে গেল না। মহাপাত্র বলল।
কিন্তু স্যার মেঘালয় যাই কী করে, ওই এরিয়াটা নাকি টেররিস্টদের দখলে আছে ।
হু সেজ দিজ, দেয়ার ইজ নো টেররিস্ট নাউ।
অলীক বলল, তারা আত্মগোপন করে আছে।
তা যদি থাকে, থাকতে পারে, তোমার কী?
অলীক বলল, আপনি তো জানেন স্যার, আপনি পনেরদিন ছিলেন ওখানে।
কে বলেছে?
আমি জানি স্যার।
মহাপাত্র বলল, ভিজিটে যেতে হয়, কিন্তু সে খুব সুন্দর জায়গা, পাহাড় আছে, ফরেস্ট আর একটা ছোট নদী, নদীটা সেই পাহাড় থেকে নেমেছে।
অলীক আচমকা জিজ্ঞেস করে নদীটা কতদূর গেছে।
মহাপাত্র বলল, ঠিক জানি না, কোথাও একটা গেছে, নেমে গেছে, কেন?
অলীক বলল, আপনি বড় সায়েবকে বলুন।
বড় সায়েব এখন লাতুরে, হি ইজ ওয়েটিং ফর আ ট্রেমর।
আরথ কোয়েক, ভূমিকম্পের জন্য অপেক্ষা করছেন, নেপালের খবর উনি জানেন না, হাজার হাজার মানুষ মরে গেছে।
হ্যাঁ, বাট, এখন আমাদের কাজ লাতুরে, আমরা ট্রেমর ফ্রি হাউজিং করেছি ওখানে জাপানি টেকনোলজিতে।
কিন্তু স্যার ওখানে আর ভূমিকম্প হবে না, নাইনটি নাইনটি থ্রির পর বাইশ বছর কেটে গেছে, বড় সায়েব নেপালে আসুন, নেপালের ভূমিকম্পে উনি লাতুরে বসে কেন?
উনি যাবেন নেপালে, নিশ্চয় যাবেন, কিন্তু ওটা তো আলাদা দেশ।
নেপাল এখনো কাঁপছে স্যার।
ট্রেমর থামলে যাবেন বড় সায়েব, তারপর ওয়েট করবেন ট্রেমরের জন্য।
আমার মনে হয় স্যার, এবার হলে অন্য কোথাও হবে, যেমন হয়েছে নেপালে, আমরা আগে থেকে জানতে পারব না কোথায় হতে পারে।
মহাপাত্র বলল, তুমি যাও, প্রজেক্টটা কমপ্লিট করে এস।
অলীক বুঝল মহাপাত্র করবে না। সে বলল, ওক্কে স্যার আমি ভেবে দেখি।
মহাপাত্র আর কথা বলল না। অলীক বেরিয়ে এল প্রাবৃট মহাপাত্রের ঘর থেকে। প্রাবৃট মানে মেঘ। কী রকম নাম! আন-কমন। অলীক বেরিয়ে এসে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসতে সুনীতা এল। ধলভূমগড়ের মেয়ে। সে অলীকের সহকর্মী বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী। অলীককে জিজ্ঞেস করল, কথা হলো?
মাথা নাড়ে অলীক, চাপা গলায় বলল, শয়তান।
সুনীতা বলে, রাগ করে কী হবে, তুমি বড় সাহেবের সঙ্গে যোগাযোগ করো, আসলে যেতে হতো মহাপাত্র সাহেবকে, বদলে তুমি।
বলছে এর পর ইউকে।
ঢপ, ওসব বলে, মেঘালয়ে যে ছিল সে টেররিস্টদের ভয়ে চাকরি ছেড়ে গেছে, তার জায়গায় তুমি।
কে বলো দেখি।
সুশান্ত কর, শুনেছ তো। সুনীতা বলল।
চিনি না তো।
এই অফিসে আসত না, তুমি ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারো।
নাম্বার আছে?
না। সুনীতা বলল মহাপাত্র স্যারের কাছে থাকতে পারে।
উনি কি দেবেন?
বলে দ্যাখো না।
আবার যাব?
ইন্টারকমে কথা বলো। বলে সুনীতা তার মোবাইল বাজতে তা শান্ত করতে সরে গেল সামনে থেকে। অলীক ইন্টারকমে ধরল মহাপাত্র স্যারকে। মহাপাত্র ধরল না। ফোন তুলে রেখে দিল। কেটে গেল লাইন। অলীক বুঝল লোকটা হয়ত মোবাইলে কথা বলছে। একটু বাদে আবার ফোন করল সে। এবার মহাপাত্র ধরে, কে অলীক সোম?
ইয়েস স্যার।
‘বলুন’ শুনে অলীক জিজ্ঞেস করে সুশান্ত করের কথা। শুনে আকাশ থেকে পড়ল মহাপাত্র, হু ইজ হি, কে সুশান্ত কর?
আমাদের কোম্পানির নর্থ ইস্ট ইনচার্জ।
সে কে, আমি তো চিনি না।
হি হ্যাজ রিজাইনড ফ্রম দ্য সারভিস।
কে বলল?
আমি জানি স্যার।
তুমি তো অদ্ভুত এক নাম বলছ !
সুশান্ত করের নাম্বার চাইছি স্যার।
আরে যে তোমাকে এই নাম বলেছে তার কাছে চাও, এই নামে কেউ কখনো ছিল বলে আমার জানা নেই। বলতে বলতে মহাপাত্র ফোন রেখে দিল। তখন সুনীতা ফিরে এল অলীকের টেবিলের ওপারে, জিজ্ঞেস করল, দিয়েছে, দেয়নি তো?
ওই নামে কেউ ছিল না বলছে।
হি ইজ আ লায়ার, ছিল, ভেরি মাচ ছিল।
বাড়ি কোথায়? অলীক জিজ্ঞেস করে।
বাঁকুড়ায়।
তুমি তো জানো সুনীতা, অ্যাড্রেসটা দিতে পারবে না, কন্ট্যাক্ট নাম্বার?
কম্পিউটার সারচ করে দেখি।
অলীক চুপ করে বসে থাকল। সে বুঝতে পারছিল মহাপাত্র তাকে কোনো ব্যাপারে সাহায্য করবে না। তাকে বড় কর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। কী ভাবে করবে তা তাকে নিজেকেই বুঝে নিতে হবে। আচ্ছা, বড় সায়েব কি সত্যিই লাতুরে বসে আছেন? হা হা হা, তা কি হতে পারে? নেপালে হলো ভূমিকম্প, উনি আছেন লাতুরে, ট্রেমর খুঁজছেন সেখানে? বাইশ বছর আগের কম্পন! সঞ্জয় রঞ্জয় নদীর ধারে পছন্দপুর খোঁজার মতো ব্যাপার। চাইবাসায় নপাহাড়ি। সুনীতা কিছু কিছু সাহায্য করলেও করতে পারে। কিন্তু তার বেশিদূর অবধি যাওয়ার ক্ষমতা নেই। উপায়ও নেই। সুনীতা একটু পরে ফিরে এসে বলল, নেই, যে অফিস ছাড়ে, তার সবটা আলাদা একটা ফাইলে সেভ করা হয়, জেনারেল ফাইল থেকে তার সব ডিটেইলস ডিলিট করে দেওয়া হয়। কিছুই নেই। আছে যে ফাইলে তার পাস ওয়ারড মহাপাত্র স্যার জানেন।
অলীক হতাশ হয়ে বসে পড়ে। তাকে সুরগুঞ্জা হিলস যেতেই হবে। সুনীতা বলল, সুশান্তকে অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল ওরা, সে কাউকে বলতেও পারছিল না।
তুমি জানলে কী করে? জিজ্ঞেস করে অলীক।
আমার সঙ্গে ওর যোগাযোগ ছিল।
তাহলে নাম্বার নেই কেন? অলীক আবার জিজ্ঞেস করে।
ওই নাম্বারটা এখন ইনভ্যালিড, তুমি চেষ্টা করে দেখতে পারো। সুনীতা হতাশ হয়ে বলল, তবে কি, না পোষালে চলে এস।
চাকরি ছেড়ে? অলীক জিজ্ঞেস করে।
সুনীতা বলল, মহাত্মা কোম্পানির কী হয় কে জানে?
কী হবে?
টের পাচ্ছ না অলীক, চারধারে কী হচ্ছে!
৪.
ফেসবুকে অন লাইন হয়ে রাই বলল, নাম্বারটা ফলস মনে হয়।
কেন?
ঠিক নাম্বার হলে প্লিজ চেক দ্য নাম্বার ইউ হ্যাভ ডায়ালড, এমন বলবে কেন?
তাহলে আমি কী করব?
রাই জিজ্ঞেস করে, কবে যেতে বলছে?
তা কিছু বলছে না, কিন্তু রেডি হয়ে থাকতে বলছে, বড় সায়েব ইয়েস বললেই চলে যেতে হবে, আমার কাছে মেইল আসবে।
প্রজেক্ট কবে শেষ হবে?
অলীক বলল, আমার তো মনে হয় অনন্ত কালেও না।
এমন বলছ কেন, কেউ কি গ্রামে যায় না সারভিস করতে?
কেন যাবে না রাই, কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না আমি ওখানে গিয়ে কী করব, উফফ, রিমোট ভিলেজ, গ্রামে টেররিস্টদের আস্তানা।
এত সব ভেবে নিয়েছ, ওয়েট করো, দ্যাখো কী বলে তোমার বস।
হুম, ওয়েট তো করছি, বস বলবে না মহাপাত্র বলবে তাই ধরতে পারছি না, বস আদপে আমাকে বদলি করেছে কিনা কে জানে।
স্মাইলি লিখল রাই, বলল, তুমি একটা কাজ করতে পার, ফেসবুকে লোকটাকে খোঁজ করো, সে নিশ্চয় থাকবে, আমি একটু উঠছি।
রাই-এর সঙ্গে কথা শেষ হয়ে গেল। ফেসবুকে কথা হচ্ছিল। রাই অফ লাইন হলো। তাদের সঙ্গে বছর দুই-এর বন্ধুতা। আলাপ এই ফেসবুকে। রাই তার ছবির পরিবর্তে শাদা কালোয় মধুবালা। তার বন্ধুর সংখ্যা আগে কম ছিল। কিন্তু তার ভিতরেই অলীক হয়ে গিয়েছিল। রাই ভেবেছিল অলীক তার আসল নাম নয়। ফেসবুকের বন্ধুদের মতো সে ভারচুয়াল ওয়ার্ল্ডের বাসিন্দা। অলীক তার অলীক নাম। সে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার রিয়েল নেম?
এইটা, আয়াম অলীক সোম।
তুমি কি সত্যিই অলীক?
হ্যাঁ অলীক।
ফেসবুকে অলীক?
নো খুকুমনি, আয়াম অলীক ইন মাই বার্থ সারটিফিকেট।
আয়াম নট খুকুমনি।
তুমি খুকুমনিই বটে।
তাহলে তুমি খোকাবাবু। রাই জবাব দিয়েছিল। হা হা করে হেসেছিল অলীক। রাই তখন প্রেমে প্রত্যাখ্যাত। তার তরুণ অধ্যাপক তার সঙ্গে এক বছর ঘুরে তাকে পরিত্যাগ করেছে। ফেসবুকে আলাপের সাতদিনের ভিতরে তা কবুল করেছিল রাই, আমি খুব ডিস্টারবড অলীক, আমি জানি না আমি কী করব।
সে থেকে রাইকে নানাভাবে উজ্জীবিত করেছে অলীক। এখন তারা খুব বন্ধু। রাইয়ের দুঃসময়ে অলীক তার পাশে দাঁড়িয়েছিল। সদ্য আলাপ তখন, ফেসবুকেই দেখা হতো ঠিক রাত সাড়ে ৯টার সময়। ওই-ই তাদের নিয়মিত সাক্ষাৎ। তারপর অনেক দিন, তা প্রায় বছর ঘুরে গেলে রাই একদিন বলল, তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হয় অলীক, তুমি কি আত্মপ্রকাশ করবে?
তুমি কি চাও আমি আত্মপ্রকাশ করি এখন?
হ্যাঁ, এতদিন ধরে আমি নিজেকে প্রস্তুত করেছি, সব পুরুষেই আমার ভয় হয়ে গিয়েছিল অলীক, দ্যাট ম্যান, সেই চক্রবর্তী আমাকে ওই একটা বছর কী ভাবে না ব্যবহার করেছিল, আমি ওর জন্য ক্লাস কামাই করে লাইব্রেরিতে বসে ৫০ বছরের পুরনো পত্রিকা ঘেঁটে ঘেঁটে কত আরটিকেল কপি করেছি, হারিয়ে যাওয়া রেকরড খুঁজে এনেছি ধর্মতলা থেকে, বাবার কালেকশনের বই ওকে দিয়ে দিয়েছি, রেয়ার বই, জারমান শেফারস এনে দিয়েছিল আমার মামাতো দাদা, ও দেখে বলল, ও নাকি পেন কালেক্টর, আমি দিয়ে দিয়েছি, ওহ, মানুষ এতো অকৃতজ্ঞ হয়!
প্রেম কি কৃতজ্ঞতা থেকে জন্মায়? অলীক জিজ্ঞেস করেছে।
আমি জানি না অলীক, যত ভাবছি, তত কাঁদছি, আমি কাঁদছি। চাপা গলায় বলল রাই।
সে চলে গেল কেন?
আর একটা মেয়েকে নিয়ে ঘুরছে, সেও ওর জন্য লাইব্রেরিতে গিয়ে বসে নোট করছে ওর দরকারি তথ্য, ওর জন্য কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ভাবনা শতক, ওই বই পাওয়া যায় না, রেয়ার, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদেও নেই।
অলীক বলল, তুমি জানলে কী করে?
কী করে জানব, ললিতাই তো আমাকে বলেছে।
সে জানে না তোমার ঘটনা?
কার কাছে যেন শুনেছিল, বিশ্বাস করেনি, না অলীক, আমি কিছু বলিনি।
যাকগে, ভালোই হয়েছে, একেও কাজ মিটলে ছেড়ে দেবে।
ও আমাকে রীতিমতো ইউজ করেছে, আমি তোমাকে সব বলতে পারব না।
বলতে হবে না, তুমি বেঁচে গেছ রাই।
আমি আসলে রাই নই, আমার নাম অন্য, কিন্তু রাই নামটা আমার খুব পছন্দ, আমি তাই ফেসবুকে ওই নামটা নিয়েছি, আমার আসল নাম অন্য কিছু মুখারজি, আমার দাদু , মায়ের বাবা দিয়েছিলেন একটা রুশ নাম, নাতাসা, ভানিয়া, সাশা, আনা...এই রকম কিছু।
আমি তাহলে ভানিয়া বলব না রাই বলব?
তোমার যা ইচ্ছে।
অলীক জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার কী ইচ্ছে?
রাই রাই, আমি রাই মুখারজি, দেয়ার ইজ নো এগজিস্টেন্স অফ রাই মুখার্জি ইন দি রিয়েল ওয়ার্ল্ড, রাই নামটা আমি ভুলেই গেছিলাম, আমার ঠাকুরদা দিয়েছিলেন এইটা, যখন চক্রবর্তী আমাকে চিট করল, আমি রাই হয়ে ফেসবুকে এলাম, মধুবালার ছবি সঙ্গে, প্রথম দিনেই চক্রবর্তী আমাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিল, ও নতুন নতুন চায়, ফেসবুক থেকে মেয়ে তোলে, অ্যান্ড আই রিফিউজড হিম।
অলীক বলল, রাই, তাহলে কবে দেখা হবে।
আমার ভয় করছে অলীক, আমি তারপর কোনো ছেলের সঙ্গে জড়াইনি, কিন্তু আমি তো কত চিঠি পেয়েছি, মেসেজ, রাই হয়ে ওই খারাপ লোকটার কাছ থেকেও, হি প্রোপোজড মি, হি ইজ সো ট্রেচারাস, তার জন্য ললিতা বই খুঁজে বেড়াচ্ছে, নিজের পয়সায় সিডি কিনে আনছে আর সে নেটে পরনো দেখছে, ফেসবুকে বসে মেয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে, প্রোপোজ করছে, চ্যাট করবে।
অলীক বলল, লোকটার নাম কী?
তুমি রিকোয়েস্ট পাঠালেও সে তোমার রিকোয়েস্ট অ্যাক্সেপ্ট করবে না, তার বন্ধুরা সবাই মেয়ে, তাদের সঙ্গে সে ইনবক্সে চ্যাট করে রাত ৯টা থেকে সাতটা অবধি ললিতা তার সঙ্গে থাকে, তারপর ফেসবুকের নারীরা।
একদিন ফেঁসে যাবে, তুমি জানো কত পুরুষ লোক মেয়ের নামে অ্যাকাউন্ট খোলে ফেসবুকে, তারপর লোকটার দুর্বলতা খুঁজে নিয়ে ব্ল্যাক মেইল।
জানে রাই। আবার এও জানে, স্যারের কাজ করে আনলে ললিতা একটু আদর পাবে, সে যেমন পেত। চুমু উম উম, বুকে ব্যথা পেয়েও কী সুখ। ইচ্ছে মতো শরীর ছেনে সে ক্ষান্ত হতো। তাতে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত রাই তার মুখের দিকে। শয়তান শয়তান। রাই বলছে সব, তুমি একটু বিপদে পড়েছ অলীক, এখন আমি তোমার পাশে দাঁড়াই তা তুমি চাও?
চাই তো।
এক বছরের উপর আমরা রাত নটা থেকে সাড়ে দশটা এগারটা বারোটা গল্প করি, কিন্তু কেউ কাউকে দেখিনি।
হুঁ। অলীক সাড়া দেয়।
এতদিন বাদে একটি পুরুষকে আমার দেখতে ইচ্ছে হচ্ছে।
অলীক বলল, আমার ফোটোটা তো অরিজিনাল, কিন্তু তোমার ছবিও তুমি নও, আমি জানি না কতদিন তোমাকে দেখেছি, কিন্তু চিনি না বলে পাস কাটিয়ে চলে গেছি, অদ্ভূত, আমরা এক অলীক সময় আর অলীক পৃথিবীতে দিন কাটিয়েছি রাই।
রাই বলল, এস তাহলে, আমরা পরস্পরের কাছে আত্মপ্রকাশ করি।
৫.
সুনীতা বলল, তোমাকে আমি একটা নাম দেব, তার সঙ্গে কথা বলে দেখতে পার।
সে কে?
অঞ্জন রায়, সে সুশান্ত করের বন্ধু।
তার কাছে নাম্বার আছে?
আছে, কিন্তু এই নাম্বার, সুশান্ত কি ইতালি নিয়ে চলে গেল? সুনীতা জিজ্ঞেস করল যেন নিজেকেই।
ইতালি !
হ্যাঁ, ইতালিতে আমাদের প্রজেক্ট আছে, টপ বস হয়ত সুশান্তকে ওখানে নিয়ে গেছেন, সুশান্ত হয়ত চাকরি ছাড়েনি। বলতে বলতে সুনীতা তার ওড়না ভালো করে পেতে নিল বুকের উপর। মেয়েটি পাঁচ ফুট আট। মেয়েদের এত হাইট দেখা যায় না। গায়ের রঙ ময়লা ময়লা, কালো চোখের মণি দ্যুতিময়। সুনীতা একজনের সঙ্গে এনগেজড। সেও রাঁচির ছেলে। শিবপুরের এঞ্জিনিয়ার। আছে বাংগালুরু। তার সঙ্গে খুব শিগগির বিবাহে বসবে সুনীতা, তাই বলেছে সে। সে অলীকের ভালো বন্ধু। অলীকের বদলির কথা থেকে তাকে নানা কথা নানা অনুমানের কথা বলে যাচ্ছে। এই যে এখন বলছে সুশান্ত কর ইতালিতে চলে যেতে পারে, যেমন সে যাবে ইউ.কে। বস কোনো ব্যাপারেই কোনো কিছুর প্রচার চান না। তিনি নিভৃতে কাজ করতে ভালোবাসেন।
ইতালিতে আমাদের কী প্রজেক্ট? অলীক জিজ্ঞেস করে।
জানি না তো।
প্রজেক্ট আছে কে বলল?
মহাপাত্র স্যার।
আমরা গিয়ে কী করছি?
সুনীতা বলে, কিছু একটা করছি। ইতালিতে
মহাপাত্রকে জিজ্ঞেস করলে কি বলবে? বলবে না।
না, আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, উনি বলেননি। সুনীতা বলল, কী দরকার জানার, যা হয় আছে।
অলীক চুপ করে বসে থাকে। সুনীতাও চুপ। মহাপাত্রকে ফোন করবে বলে অলীক ইন্টারকম তুলে এনগেজড সাউন্ড পায়। মনে হয় রিসিভার নামানো নেই। মহাপাত্র কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলতে চায় না। সুনীতা বলল, আমি নেট সারফ করে দেখেছি, কিন্তু তেমন কিছু পাইনি।
বড় সায়েব ইতালি ঘুরতে যান, তার মানেই ইতালিতে আমাদের প্রজেক্ট নয়।
আমরা ইরাকেও কাজ করছি, কন্সট্রাকশন ওয়ারক।
কে বলল, মহাপাত্র স্যার?
ইয়েস স্যার।
অলীক বলল, আচ্ছা মহাপাত্রই কি টপ বস হতে পারে?
তা কেন হবে, টপ বস তো পৃথিবীময় ঘুরে বেড়ান।
সেও তো মহাপাত্রর বলা। অলীক বিড়বিড় করে বলল।
হি ইজ দি রাইট হ্যান্ড অফ আওয়ার বস, তিনি সব জানেন।
অলীক বলল, নো, আমার মনে হচ্ছে শুধু ডান হাত নয়, তিনিই টপ বসের বডি, তিনিই হাত পা মাথা আর ব্রেন।
খিলখিল করে হাসে সুনীতা, বলল, তোমার ফেসবুকের রাইয়ের মতো নিজের আইডেন্টিটি লুকিয়ে?
ইয়া, হতেই পারে। অলীক জবাব দেয়।
তখন অলীকের ইন্টারকম বেজে ওঠে। সে তুলতেই ওপারে মহাপাত্রর কণ্ঠস্বর, আমার ঘরে একটু আসবে অলীক।
ইয়েস স্যার, যাচ্ছি।
সুনীতাকে বসিয়ে রেখে অলীক চলল। এই প্রতিষ্ঠান আসলে কী কাজ করে তা অলীক ভালো ভাবে জানে না। তার কাজও যে কি সে তা ভালো জানে না। এখনো পাসা কাজ দেয়নি। দায়িত্ব দেয়নি। তাকে মাঝে মধ্যে কম্পিউটারে অনেক নাম এন্ট্রি করতে হয়। কিন্তু তা করার পর মহাপাত্র হ্য়তো বলে বসে, ওগুলো ডিলিট করে দাও।
তাহলে এন্ট্রি করলাম কেন স্যার?
পরে শুনবে।
মহাপাত্রর ঘরে ঢুকল অলীক। ঘরে মহাপাত্রর সঙ্গে মহাত্মা গান্ধির ফটো। কী রকম লাগে দেখলে। মহাপাত্রর বয়স পঞ্চাশের বেশি নয়। গান্ধি তো দেড়শো পার হয়ে গেছেন। মহাপাত্রর এই ছবিটা সুপার ইম্পোজিশনে তৈরি। কিন্তু মনে হয় সত্যি। একটি ছবি বার বার দেখতে দেখতে সত্যি মনে হয়। যেমন রাইয়ের সঙ্গে মধুবালা। মধুবালার শাদা কালো ছবি রাইয়ের প্রোফাইল পিকচার। রাই আর অলীকের জন্মের অনেক আগে মধুবালা রক্ত বমি করতে করতে মারা গিয়েছিল। মধুবালা নাকি গান্ধার দেশ মানে আফগানিস্তানের মেয়ে ছিল। জন্মের সময় থেকে তার হৃদযন্ত্রে একটি ফুটো ছিল। এসব অলীক জেনেছে ইন্টারনেট থেকে। রাইয়ের কাছ থেকেই জেনেছে রাইয়ের ছবি মধুবালার। কিন্তু তার মনে হয় রাইয়ের ছবিই ঐটা। আসলে মধুবালার মুখে রাইয়েরই মুখ বসিয়ে দিয়েছে কেউ।
বসের নাম্বার দেবেন স্যার, আমি লানডান যেতে পারি, কিন্তু আপনার সরগুঞ্জা হিল যাবনা, তাহলে আমি রিজাইন দেব।
তোমাকে পার মান্থ এক লাখ দেওয়া হবে ওখানে আগে গেলে, আমরা সবাই একটু একটু করে ওখানে শিফট করে যাব, কলকাতা, ওয়েস্টবেঙ্গলে আমরা আর থাকব না, ক্যান ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?
ইয়েস স্যার, কিন্তু আমি তো লানডান যেতে রাজি।
লানডান যাবে সরগুঞ্জা হিল হয়ে।
অলীক বলল, বসের নাম্বারটা দেবেন স্যার।
মহাপাত্র চুপ করে থাকল একটু সময়, তারপর বলল, অলীক তুমি যাও, খুব সুন্দর জায়গা, কমলা লেবু আর চা বাগান, প্রচুর কাঁচা টাকা, কালেক্ট করতে হবে।
অলীক বলল, স্যার, সুশান্ত কর কি ভেনিস গেছে।
কে সুশান্ত?
সরগুঞ্জা হিলে ছিল, ম্যানেজার অফ এম কোম্পানি।
সরগুঞ্জা হিলে আমাদের কোনো ব্রাঞ্চ ছিল না, ছিল নর্থ ইস্ট মেঘালয়ের অন্য জায়গায়।
সুশান্ত কোথায় স্যার?
আমি তো অমন কাউকে চিনি না, হু টোল্ড ইউ?
আমি জানি স্যার সুশান্ত কর ছিল।
মহাপাত্র বলল, তুমি ঠিকঠাক জান না অলীক, শোনো, মহাত্মা ভেঙে মহাপাত্র কোম্পানি স্টার্ট করছি আমি সরগুঞ্জায়, সম্পূর্ণ নতুন জায়গা, এভরি থিং ইজ রেডি, ওখানে কেউ মহাত্মা কোম্পানিকে চিনত না, তুমি গেলেই মহাপাত্র কোম্পানিকে চিনবে, তারপর এই কলকাতার মহাত্মায় তালা পড়ে যাবে, নর্থ ইস্টের মহাত্মাতে তালা পড়ে গেছে, মহাত্মা ভ্যানিশ, এবার এদিকের ফ্রেস স্টাফ ওদিকে যাবে, ওদিকের সব এদিকে আসবে নতুন মহাপাত্র কোম্পানিতে। বুঝতে পারছ, এর পর এখানে থাকা রিস্কি, পাবলিক এসে ভীড় জমাবে, তারা তাদের টাকা ফেরত চাইবে, চার ধারে একটা সোরগোল পড়ে গেছে মানি মারকেটে, ভূমিকম্প হয়ে যাবে মনে হচ্ছে।
৬.
সুনীতা বলল, তুমি এখন কোথায় যাবে অলীক?
কোথাও না, বাড়ি ফিরতেও ইচ্ছে করছে না।
বাড়িতে তোমার কে আছে?
আমার মা বাবা আর বোন চন্দনা, বড়দা থাকে জামসেদপুর।
সুনীতা বলল, চলো আজ আমার ওখানে যাবে, তুমি আজ খেয়ে ফিরবে, মাকে বলে দাও ফোনে।
তুমি তো একা থাকো।
এখন আমার বোন রনিতা এসেছে, ওর একটা এগজাম আছে নেক্সট উইকে, সারাদিন ফাঁকা বাড়িতে বসে পড়ে।
কিসের এগজাম?
সিভিল সারভিস, ও খুব স্টুডিয়াস, আমার রুম মেট চন্দ্রিমা বাড়ি গেছে।
আজ রাত আটটার সময় অন লাইন হবে রাই। সেই কথাই আছে। এখন সাড়ে পাঁচ। বেরিয়ে সুনীতার ফ্ল্যাট নয়াপট্টি মহিষবাথানের সেই বিপুল জলাশয়ের সামনে পৌঁছতে এক ঘন্টা। তারপর সেখান থেকে বেরিয়ে তার নিজের বাড়ি পৌঁছতে আরো এক ঘণ্টা। আটটার সময় সে অন-লাইন হতে পারবে না। আজ তারা কলকাতা থেকে বেরিয়ে নিউ-টাউনে চলে আসবে ঠিক করেছিল। বিদেশি এক শহরের মতো গড়ে উঠছে সেই শহর। মস্ত মস্ত আকাশচুম্বী বাড়ি, আলোর মালায় সাজানো মল, চওড়া চওড়া রাস্তা, সেখানে গেলে সিঙ্গাপুর কিংবা ব্যাঙ্কক এসে গেছে মনে হয়। তারা শুধু ঘুরে বেড়াবে তাদের ওয়াগনর নিয়ে। আজ রাই একটা ওয়াগনর নিয়ে আসবে কথা আছে। সেই গাড়ির রঙ হবে স্টিল গ্রে। রাই নিজে ড্রাইভ করবে। আর যদি মনে হয় তারা যাবে না নিউ টাউন দেখতে, গাড়ি রেখে দিয়ে তারা হাঁটবে আপন মনে। নতুন সেই ওয়াগনার পড়ে থাকবে রাস্তার পাশে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘোড়ার মতো ঝিমোবে। তার উপরে ধুলো পড়বে। জল পড়বে আর রোদ পড়বে সারা বছর ধরে। তারপর সেই গাড়ি একদিন ধুলোর আস্তরণে ঢেকে যাবে। সেই ধুলোর ওপর বিন্দু বিন্দু সবুজ তৃণ, বলতে বলতে দুজনে যেন চোখের সামনে দেখতে পেয়েছিল সব। তাহলে রাত আটটায় অন লাইন হতে পারছে না সে। ফোন নাম্বার নেই কারোর কাছে কারোর, সংবাদ দেবে কী করে?
আর সেখানে যদি না যেতে ইচ্ছে হয়, তারা যাবে কলকাতার এমন একটি জায়গায়, যেখানে পথ এখনো বিরল নির্জনতায় ডুবে থাকে। কী করে যাবে? হেঁটে হেঁটে অনেকদূর। সেই পল্লীটি সারা দুপুর ঘুমিয়ে ঝিমিয়ে বিকেলে আড়ামোড়া ভেঙে ওঠে। কোনো বাড়ির জানালা দিয়ে রজনীগন্ধার সুবাস বেরিয়ে আসে। তারা চুপচাপ হাঁটবে আর একটি দুটি কথা বলবে, যা বলবে তা যেন না বলারই মতো। বাতাসের ফিসফিসানির মতো। সেই চলার সময় কখনো হয়ত আঙুলে ছুঁয়ে যাবে আঙুল। প্রায় মৃদু বাতাসের পরশ। সেখানে বিকেলে সেই আশ্চর্য বাতাস আসে অজানা এক পথ ধরে। যে পথ ধরে তারা হেঁটে এসেছে, সেই পথে পথেই যেন বাতাস এসেছে হেঁটে তাদের পিছু পিছু। আসলে সে দিকহারা হয়ে পাস খাচ্ছিল, ঘূর্ণি হয়ে আকাশে উঠে যাবে ভাবছিল। যে বাতাস ঘুম পাড়ায়, ভালোবাসার জন্ম দেয়, সেই বাতাসই তো টর্নেডো টাইফুন হয়ে ল-ভ- করে দেয় সব। দিকহারা হলেই বুঝি বাতাস এমন নিষ্ঠুর পাগল হয়ে যায়। অলীক আর রাইয়ের পিছু পিছু এসে সেই বাতাস বুঝি দিক খুঁজে পেয়ে শান্ত হতো।
কত সময় ধরে হাঁটবে অলীক? রাই জিজ্ঞেস করেছিল।
অলীক বলেছিল, যতক্ষণ না সেই চায়ের দোকানির দোকানে না পৌঁছাই।
রাই জিজ্ঞেস করেছিল, সেই চায়ের দোকানেই বা যেতে হবে কেন, পথে কি আর চায়ের দোকান পড়বে না?
হ্যাঁ পড়বে, তারা সব কয়লার আঁচ ধরিয়ে কালো কেটলি চাপিয়ে জল ফোটাতে আরম্ভ করে দেবে বিকেল হতেই, কিন্তু সেই লোকটা কয়েন জমায়।
ওমা, তাই নাকি, তুমি কী করে জানলে? রাই জিজ্ঞেস করে।
আমার বাবা বলেছিলেন।
বাবা কি সেখানে গিয়েছিলেন, কোথায় সেই জায়গা?
গেলেই আমরা বুঝতে পারব সেই জায়গার নামটা কী, তার আকাশটা কেমন।
অলীক, তুমি এমন কথা বল না, আকাশ আবার কেমন হবে, আকাশ তো আকাশই।
অলীক বলেছিল, সেই যে সুরগুঞ্জা পাহাড়, সেখানে আকাশ খুব ভারী।
কে বলল, আকাশ কি ভারী হয়?
ট্যাক্সিতে সুনীতা আর অলীক। তারা সেই ডায়মন্ড হারবার রোড ধরে আসছে। ঠাকুরপুকুরের কাছ থেকে পুরনো কালিঘাট ফলতা রোড, এখন যা বাইপাস, ধরে উত্তর পুবে যাচ্ছে মধ্য গতিতে। দুজনে দুটি জানালার ধারে। সুনীতা জিজ্ঞেস করল, তুমি কী ভাবছ বলো দেখি।
না কিছু না তো। অলীক সংক্ষিপ্ত জবাব দেয়।
চুপ করে আছ যে? সুনীতা জিজ্ঞেস করে।
আচ্ছা সেই সুরগুঞ্জা পাহাড়ের দেশে আকাশ কি ভারী?
কে বলল, তোমার সেই ফেসবুক ফ্রেন্ড?
না না, আমার মনে হল হঠাৎ।
সুনীতা হাসল, বলল, মেঘালয় তো, মেঘে মেঘে আকাশ ভারী হয়েই থাকে সেই মেঘের দেশে, একেক দিন আসবে, সারাদিন বৃষ্টি আর বৃষ্টি, আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদল দিনে, জানালার কাচের বাইরে দিয়ে বৃষ্টিই দেখে যাবে শুধু।
শুনল অলীক। কিছু বলল না। আজ যে জায়গাটায় তারা যেত অন-লাইন হয়ে সেখানে আকাশে মেঘ আছে, কিন্তু সেই মেঘ পালকের মতো ভেসে বেড়ায়। সেই মেঘের জন্ম হয়েছিল কপোতের ডানা থেকে খসে পড়া পালকে। সেই মেঘ আকাশকে হাল্কা করে দেয়। আর যে মেঘে আকাশ হয়ে ওঠে ভারী, সেই মেঘের জন্ম হয়েছিল পবর্তের ডানা থেকে। এক সময় পবর্তের নাকি ডানা ছিল। পবর্ত ডানা মেলে ঊড়ত। তার ফলে আকাশ হয়ে যেত ভীষণ ভার আর ঢেকে যেত সব আলো, চাঁদ আর সূয দেখাই যেত না। পর্বতের ছায়ায় ঢেকে যেত পৃথিবী। তখন দেবরাজ ইন্দ্র যুদ্ধে নামলেন, তিনিই পবর্তের ডানা ছিন্ন করলেন। সেই ছিন্ন ডানাই আকাশে ওড়ে। এই গল্প কে তাকে বলেছিল তা মনে নেই। নাকি কেউ বলেনি, সে নিজে নিজেই ভেবেছে এই রকম। সেই জায়গাটা, গত রাতে অন-লাইন হয়ে যেখানে সে আর রাই হেঁটে যাবে ভেবেছিল, কে বলেছিল তার কথা? তার বাবা কি? না সে নিজেই জেনেছে। একটা বুড়ো লোক সমস্ত জীবন ধরে নানা দেশের কয়েন, নোট জমিয়ে যাচ্ছে। কেউ দেখতে চাইলে দেখায়। ওই দেখতেই তার কাছে কতজন আসে। আর তাতেই তার দোকানটি চলে। পুরোন কয়েন, তামার পয়সা, ফুটো পয়সা, রুপোর টাকা, লাল দুয়ানি, সিকি আধুলি, মহান সম্রাট পঞ্চম জর্জের মুখ, মহারানি ভিক্টোরিয়ার মুখ খোদাই করা কয়েন দেখে কেউ কেউ ওকে পেনি রুবল ফ্রাঁ দিয়েও গেছে। আমাদের কাছে থাকবে না, তুমি রেখে দাও। সে খুঁজছে একটা নোট। কোন নোট, না সুন্দরবনের গোসাবা দ্বীপে স্যার ড্যানিয়েল হ্যামিল্টন প্রচলিত নোট। তাঁর সমবায়ে ওই নোটে কেনা বেচা হতো। এই সব কথা তাকে বলল কে? তার বাবা? নাকি অন্য কেউ? কোপেক, রুবল ফ্রাঁ, পেনি, লিরা, দিনার জমিয়ে জমিয়ে সেই বুড়ো এখন চায়ের দোকানটিকে যেন মস্ত একটা শপ করে দিয়েছে। সেখানে লিরা ফ্রাঁ দিনার রুবল একানি দুয়ানি চারানির বাজনা সমস্তদিন বাজতে থাকে। তার বস তাকে সরগুঞ্জা পাহাড়ে মেঘালয় পাঠাবে। সেখানে বসে চিনা ইয়েন আর বারমিজ কয়েন পাওয়া অসম্ভব কিছু না। আলিপুর দুয়ারে তো ভুটানি টাকার ছড়াছড়ি। সেই সব কালেক্ট করতেই যেন তাকে মেঘালয়ে পাঠাচ্ছে তার কোম্পানি। কোম্পানি তো সেই বুড়োর মতো কয়েন কালেক্ট করে থাকে। কয়েন নয় রুপি। রুপি এই দেশে আর সেই ইতালি ফ্রান্স ইংল্যান্ড তুরস্ক গ্রিসে সেই সেই দেশের কারেন্সি। কী অদ্ভুত! কী কথা থেকে কী কথা সে বুঝে ফেলল। তার কোম্পানি মহাত্মা ইনভেস্টমেন্ট আসলে ওই কাজই করে। কয়েন রুপি ফ্রাঁ লিরা দিনার পাউন্ড শিলিং পেনি কোপেক রুবল সংগ্রাহক। টাকা তুলে বেড়ায়। ইতালি ফ্রান্স ইংল্যান্ডেও তুলছে। এক পেনি দিলে দু পেনি দেব, দুকা চার চার কা আট বিশ কা হানড্রেড, হানড্রেড কা হাজার, টেন টাইমস।
সুনীতা বলল, চুপ করে আছ কেন অলীক?
সে বলল, কই চুপ করে।
বাহ, চুপ করেই তো আছ।
অলীক বলল, সেই সুশান্ত কি ইতালিতে লিরা কালেক্ট করছে এখন?
খিলখিল করে হাসে সুনীতা, বলল, তুমি কি তাই শুনেছ?
আমার মনে হচ্ছে তাই।
সুনীতা বলল, মহাত্মা কোম্পানি কী বলে?
আমাদের কোনো কথার উত্তর জানে না, কিন্তু ওর কথার উত্তর আমাদের জানতে হয়, আমি মহাপাত্রর কথা বলছি। বলতে বলতে অলীক দেখল তারা ইস্টার্ন মেট্রোপলিটন বাইপাসে ঢুকছে। আকাশে একটি দুটি, ক্রমশ ভরে উঠছে তারা। ডানদিকের জলাভূমি থেকে ধেয়ে আসছে নরম বাতাস। আহ! অলীকের চোখ জুড়িয়ে আসে যেন। আঁটটার সময় অন লাইন হয়ে অপেক্ষা করে করে রাই শেষমেশ একা একা হাঁটতে আরম্ভ করবে? নাকি সেই ওয়াগনার নিয়ে ঢুক পড়বে নিউ টাউনে। অন্ধকার শহরে তারার মতো জ্বলছে বহুতলের জানালাগুলি। রাই কোনো একটার সামনে দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় ডাকতে আরম্ভ করবে অলীক অলীক। হাই হাই। হেল্লো। রাই জানে না আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে এই ডাক দিলে কেউ শুনতে পাবে না। ভার্চুয়াল রিয়ালিটি আর দৈনন্দিন বাস্তবতা...স্বপ্ন আর বাস্তবতার মধ্যে যেখানে অদৃশ্য সেতু, সেখানে ওই কথা শোনা যায় কী করে? অলীক আর রাইয়ের ঠাকুমার ঝুলি, রূপকথা নেই, আছে ইন্টারনেট-ফেসবুক। সে তো প্রাচীন রূপকথার চেয়ে কম আকর্ষণীয় নয়। তার টান কম নয়।
৭.
এই হলো সুনীতার বোন রনিতা। ও কবিতা লেখে অথচ সিভিল সার্ভিস দেবে।
অলীক তার হাত বাড়িয়ে অভ্যাসে ডেকে ওঠে, হাই। ইদানীং কী হয়, কখনো কখনো সব কিছুই মনে হয় সত্য কিন্তু সত্য নয়। বাস্তবে থেকেও অলীক। সে যেন মস্ত এক ল্যাপটপ খুলে বসে আছে। তার সমুখে যারা তারা অন-লাইন হয়ে আছে। এই যেমন রনিতা নামের মেয়েটি। সে যেন সত্যই শাদা কালো ছবির যুগের কেউ। মুখখানি দেখ, ঠিক যেন তার জন্মের তিরিশ বছর আগের কেউ। মাথায় রাশি রাশি মেঘের মতো চুল। খোলা চুলেই ছিল সে। এক ঝটকায় দুহাত উপরে তুলে দুই কনুইয়ে শূন্যতা বিদ্ধ করে চুলে এলো খোপা করে হাত নামাতে নামাতে হাসি মুখে বলল, নমস্কার অলীকদা, তুমি ভালো আছ তো, তোমার কথা এত শুনি দিদির কাছে যে তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে অনেকদিনের আলাপ যেন তোমার সঙ্গে, তুমি শিলং পাহাড়ে বদলি হয়ে যাচ্ছ, গ্রেট।
অলীক বাস্তবতা বুঝে নিতে চাইছিল। সে বসে আছে সোফায়। সোজাসুজি ব্যালকনির দরজা খোলা। সেখানে যে অন্ধকার তার একটু অংশে ঘরের শাদা আলো গিয়ে একটা আয়তক্ষেত্র তৈরি করেছে। সে বলল, আপনি নাকি যেতে চাইছেন না?
ঐসস, ফেসবুকের প্রতিক্রিয়া তার মনের ভিতরে এসে যেন মিলিয়ে গেল। সে হেসে বলল, ঠিকই শুনেছ।
আমি তো ঠিক করেছি আমি যদি সিভিল সার্ভিস পাই আমি নর্থ ইস্টে অপশন দেব, সাতটি বোন সাতটি তারা সাতটি পাহাড়, উফফফ্ সে দারুণ হবে।
অলীক অবাক হয়ে যেন শাদা কালো ছবির এক অচেনা নারীকে দেখছিল । রাইয়ের যে ছবি সে অন-লাইন হয়ে দেখতে পায় তা মধুবালার। তার ঠাকুমার প্রিয় হিরোয়িন। কিন্তু এই মুখখানি কোন সুদূরের? এই উদ্ভাসিত ডিম্বাকার মুখ। চেক শাড়ি, কালো রঙের ব্লাউজ, দুই ভ্রুর সংযোগের দু’সুতো উপরে সুগোল একটি কালো টিপ। সে গৌরী নয়, মাজা মাজা তার গায়ের রং। হাতের নখে পাতলা গোলাপি নখ রঞ্জনী, বাম হাতে সোনার বালা, ডান হাতে মা বিপত্তারিনীর লালসুতো। সে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এইটা দেখছ তো, আমার ঠাকুমা পরিয়ে দিয়েছে, সামনে একজামের বিপদ, হা হা হা।
আই ডোন্ট নো, কিন্তু এটার ভিতরে ঠাকুমা ঢুকে বসে আছে যেন, আমি তো পরতে চাইনি, কিন্তু বুড়ি ঠাকুমা তো বিপত্তারিনীর পুজো করল, সাত বামুন খাওয়ালো, ভোগ বিলি করল, চন্নমেত্ত খেয়ে উপোস ভাঙল, আর এই সব নাকি আমার জন্য, আমি সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিতে ধলভূমগড় চাঁপাবনি থেকে কলকাতা আসছি দিদির কাছে, তাই।
রনিতা বলছিল, পরীক্ষা মানেই তো বিপদ। তার ঠাকুমার চার ছেলে। তার ভিতরে একজন তো এইচ,এস, পেরতেই পারছিল না, চার বছর না পেরে ক্ষান্ত দিয়েছিল, তখন ঠাকুমা বিপত্তারিনী করে রনিতা সুনীতার মেজ কাকাকে উদ্ধার করেন। তখন তো ছিল বিহার, এখন ঝাড়খ-। শোনা যায় মেজকাকার পরিবর্তে আর একজন দিয়েছিল পরীক্ষা। কিন্তু ঠাকুমা বলে, যাই হোক, মা বিপত্তারিনী, তিনি ছিলেন বলেই সব বিপদ থেকে রক্ষে। নইলে একজনের হয়ে আর একজন কি পরীক্ষা দিতে পারত?
অলীক বলে, তোমাদের চাঁপাবনির গল্প বলো, ওদিকে মাওয়িস্টরা আছে না?
হ্যাঁ আছে, কিন্তু অনেকটা দূরে, তা ধরো বিশ তিরিশ মাইল নর্থে, দলমা রেঞ্জে যে পাহাড় দেখা যায় নীল করে, সেদিকে।
অলীক জিজ্ঞেস করল, তোমাদের ওখানে সব নিরুপদ্রব?
হ্যাঁ, এখনো তাই।
আমাদের মহাত্মা কোম্পানি তো ওখানে যেতে পারে।
তোমাদের কোম্পানি কি ঠিক ব্যবসা করে? রনিতা জিজ্ঞেস করে।
জানি না। অলীক বলল।
যদি ভুল কাজ করে তো মাওবাদিদের টারগেট হয়ে যাবে।
অলীক বলল, তখন বিপত্তারিনীর লাল তাগা, তোমার ঠাকুমা বাঁচাবে।
হা হা করে হাসল রনিতা, বলল, তুমি দারুণ বললে কিন্তু।
তখন সুনীতা স্নান সেরে হাল্কা এক সালোয়ার কামিজ পরে এসে বসল, বলল, আমি ফোনে বলে দিয়েছি, সাড়ে আটে ডেলিভারি দেবে।
তুমি কি ডিনার করাবে বাইরে থেকে এনে?
ইয়েস বস, তা না হলে করব কী করে, কে প্রিপেয়ার করবে?
তুই আগে বলে দিয়ে যেতিস যদি, আমি করতাম দিদি।
চাঁপাবনি থেকে তুই এসেছিস কি ওই জন্য?
না না, অলীকদা আজ এল প্রথম, তাই, আর অলীকদা তো সেই নর্থ ইস্টে ট্রান্সফার হয়ে গেছে, বস বললেই গৌহাটির ফ্লাইটে উঠে পড়বে। বলতে বলতে উঠে পড়ে রনিতা, বলল, আমি চা আনি, তোরা কথা বল।
রনিতা যেতে সুনীতা বলল, চল ব্যালকনিতে গিয়ে বসি, আমাদের ব্যালকনি খুব সুন্দর, সামনে সেই ঝিল, দারুণ বাতাস, স্নিগ্ধ।
ঠিক তাই। ব্যালকনিতে একটি মোড়ার ওপর বসে অলীক আর সুনীতা মুখোমুখি। সামনে খুব ছোট গোলাকার একটি টিপয়। কম পাওয়ারের আলো শুধু সামনেরটুকু দেখার জন্য। রনিতা চা নিয়ে এল ট্রেতে সাজিয়ে। টিপয়ে রেখে আর একটি মোড়া টেনে বসে। গ্রিলের মধ্যে দিয়ে ওই রাস্তার ওপারে মস্ত জলাভূমির ওপারে সল্ট লেক সেকটর ফাইভের আলো। সেই আলোর রশ্মি ওপার থেকে জল বেয়ে বেয়ে প্রায় এপারে পৌঁছে গিয়ে হারিয়ে গেছে অন্ধকারে। বাতাস আসছে একটু মাতাল হয়ে। কী সুন্দর বাসস্থান খুঁজে বের করেছে সুনীতা! আসলে তাদের চাঁপাবনির এক ব্যক্তির ফ্ল্যাট এইটি। তিনি কবছরের জন্য ইউকেতে। ফ্ল্যাটটি দিয়ে গেছেন তাদের নামমাত্র ভাড়ায়।
রনিতা বলল, দিদি তো থাকবেই না কলকাতায়, বাঙ্গালুরু চলেই যাবে, দিদির কোনো চিন্তা নেই, কিন্তু তুমি তো আপাতত চাকরিটা করবে?
হু, কিন্তু এখনই করব কিনা ভাবছি, আমি নর্থ ইস্ট যাব কিনা তাই ঠিক করে উঠতে পারিনি।
আমাদের ওই দিকটা গরিবের দেশ, ওয়ান ক্রপ ল্যান্ড, ওখানে সেই রেনেসাঁ নামে একটি কোম্পানি টাকা তুলছিল, তারা এক চিঠিতে পালিয়েছিল। বলল রনিতা।
ভালো তো। মন্তব্য করে অলীক, তারপর বলে তারপর মহাত্মা নাম বদলে মহাপাত্র হয়ে আবার চলে যাবে চাঁপাবনি।
সুনীতা চমকে ওঠে, সত্যি নাকি অলীক?
হ্যাঁ সত্যি, সরগুঞ্জায় মহাপাত্র কোম্পানি যাচ্ছে, মহাত্মা অফিস বন্ধ করে পালিয়েছে শিলং থেকে, এবার শিলঙের বাইরে সরগুঞ্জা হিলস, মহাপাত্র ইনভেস্টমেন্ট।
আমাকে তো যেতে বলেনি। সুনীতা বলল।
তোমাকে বলবে কেন, মেয়েদের ওদিক থেকে অ্যাপয়েন্ট করবে।
তুমি কী করে জানলে অলীক?
আমাকে বলেছে, নতুন কোম্পানি বছর পাঁচ কাজ করে কয়েন রূপি কালেক্ট করে আবার হয়ত পালিয়ে যাবে।
সুনীতা বলল, আমি যে প্রতিমাসে ইনভেস্ট করছি স্যালারি থেকে কোম্পানিতে।
আমি জানি না কী হবে, কিন্তু আমি নর্থ ইস্টে যাব না।
ওটা আমার ম্যারেজের জন্য জমাচ্ছি অলীক, আমাদের ফ্ল্যাট সাজাব, আমি কাল টাকার জন্য মহাপাত্র স্যারকে বলব।
তখন রনিতা বলল, তোমাদের খুব বিপদ দিদি, তুই আর অফিস যাবি না কাল থেকে, যা টাকা গেছে চলে যাক, কিন্তু পাবলিক তোকেই হয়ত ফিজিক্যালি অ্যাসল্ট করবে।
কিন্তু আমি যাব। অলীক বলে, আমি যাব, আমি মোটা টাকা অ্যাডভান্স নেব, তারপর যাব না, হা হা হা।
তুমি কিন্তু বিপদে পড়তে পার। রনিতা বলে।
কেন, বিপত্তারিনী তো আছেন। বলতে বলতে হা হা করে হাসে অলীক। কী অদ্ভূত। এই ঘন্টাখানেক কথা বলে সে কত ভারমুক্ত! পাহাড়ের ডানার বদলে বকের শাদা পালক যেন তার গায়ে এসে পড়েছে।
৮.
অলীক দাঁড়িয়ে আছে সাবেক উত্তরা সিনেমার উল্টোদিকের ফুটপাথে। সে উত্তরার সামনে আসতে বলেছে রাই-মধুবালাকে। সেই কালো চোখ, মাথাভরা বর্ষার মেঘের মতো কালো চুল। আনন্দময়ী মুখ। অলীকের আজ আত্মপ্রকাশ হবে তার সামনে। রাইয়েরও আজ আত্মপ্রকাশ হবে অলীকের সামনে। অলীক পরে আছে ডিপ গ্রিন টি শার্ট আর জিনস। তার বাঁ হাতের কব্জিতে সোনালি মেটাল ব্যান্ডের ঘড়ি, ডান হাতের কব্জিতে লাল সুতো। লাল সুতোর বিপত্তারিনীর তাগা। পরশু যখন বেরবে তখন রনিতা বলল, দাঁড়াও, তোমার সামনে কত বিপদ, আমি বিপত্তারিনী বেঁধে দিই অলীকদা।
সুনীতা সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেছে একটা ফ্লোরে। অনীশের হাতে তখন এই সুতো পরিয়ে দিতে দিতে রনিতা বলেছিল, আমি তোমায় দিলাম অলীকদা, তোমার বিপদ হবে না হবে না হবে না।
কী স্নিগ্ধতা সেই কথায়, রনিতা একটু সময় নিল, বেশি সময় নিল যেন লাল সুতোয় তার কবজি বেঁধে ফেলতে। অলীক অবাক। শিহরিত হচ্ছিল। এই প্রথম কোনো অনাত্মীয় যুবতী আত্মীয়ের মতো হয়ে উঠে তাকে হাত ধরল। স্পর্শের কী মাদকতা! কেঁপে উঠেছিল অলীক। কী ভাবে সে তাকে জড়িয়ে নিচ্ছিল লালসুতোর পাকে পাকে।
কী হলো তো। শেষ গ্রন্থিটি দিয়ে রনিতা হেসেছিল তার দিকে চেয়ে। তারপর হাত জোড় করে বলেছিল, নমস্কার অলীকসুন্দর।
অলীক হাত বাড়িয়ে ডেকেছিল, হাই।
অবাক করে রনিতা সাড়া দিল, হেল্লো।
হাউ আর ইউ?
ফাইন, অ্যান্ড ইউ? মুখ টিপে হাসে রনিতা।
ফাইন, আজ ওয়েদার খুব সুন্দর, তাই না।
হ্যাঁ পালক মেঘ।
লেট’স গো। বলে হাহা করে হেসে রনিতা বলেছিল, নিচে যাও অলীকদা, দিদি ইজ ওয়েটিং ফর ইউ, ফোন করে চেনা ট্যাক্সিটা ডেকেছিল, এসে গেছে বোধহয়।
নামতে নামতে অলীক বলেছিল, হাতে জড়িয়ে দিলে তো, সব সময় তোমার টাচে থাকব।
অলীকের পিঠের ব্যাগ সাইডে ঝোলান। ব্যাগের রঙ লাল আর কালোয় মেশান। ওর ভেতরে সে ল্যাপটপ রাখে। আজ নেই। রাই আসবে জিনস আর সবুজ কালো চেক শার্ট গায়ে। তার কাঁধে থাকবে একটা জুট-ব্যাগ। মাথার চুলে খোপা। চোখে সান গ্লাস। ইউনিভার্সিটি থেকে সোজা এখানে। অলীক আগে সেভাবে নর্থের এই অঞ্চলে তেমন আসেনি। তার এক মাসি থাকত শ্যামবাজারে। সে অনেকদিন আগের কথা। রাই থাকে কোথায় ঠিক জানে না অলীক। একবার শুনেছিল শোভাবাজার। গঙ্গা তার বাড়ির খুব কাছে। রাই পড়ে একটা ইউনিভার্সিটিতে। কোন ইউনিভার্সিটি তা বলেনি। সে তিনটে টাইম দিয়েছে। তিনটে গেল, চারটে গেল। কই? অলীক বারবার রাস্তা পার হয়ে ওপারে গেছে বিভ্রমে পড়ে। ফিরে এসেছে। একটা মিলেছে, তিনটে মেলেনি। দুটো মিলেছে দুটো মেলেনি। তিনটে মিলেছে একটা মেলেনি। তার দিকে ফিরেও তাকায়নি তাদের কেউ। আবার এমন হয়েছে অবিকল রাইয়ের পোসাক, কাঁধের ব্যাগটি পর্যন্ত, সান গ্লাসটি পর্যন্ত। কিন্তু এক সঙ্গে তিনজন। তিনটি রাই। ফেসবুকের তিনটি আইডি। সাশা, ভানিয়া, রাই। রাই, নাতাশা, সোফিয়া, ভানিয়া। অলীক পার হয়ে খুঁজতে যাবে তো তিনজনই ঢুকে গেল মলের ভেতরে।
বিকেল পাঁচটায় এত মানুষ গিজগিজ করছে চতুর্দিকে। তিনটি রাই মধুবালার মুখচ্ছবি নিয়ে ভিতরে ঢুকে ভ্যানিশ হয়ে গেল। তার দিকে কেউ ফিরেও তাকাল না। পাঁচটা অবধি দাঁড়িয়ে ফিরে আসবে যখন অলীক, তখন পিছন থেকে ডাক এল, হাই অলীক।
চমকে ঘুরে তাকিয়ে অলীক দেখল, কে? নতুন এক সবুজ কালোয় চেক শাড়ি, সবুজ ব্লাউজ সবুজ টিপ দুটি বেনী বুকের দুই দিকে, এখানে কেন অলীক, তুমি না নর্থ ইস্ট যাবে, অফিস যাওনি?
তুমি যে এখানে? অলীক জিজ্ঞেস করে।
আমি সিনেমা দেখব বলে এসেছিলাম, দেখছি একটাও নেই, সেই অনেকদিন আগে প্রথম কলকাতায় এসেছিলাম, তখন আমি ক্লাস সিক্স, এখানের উত্তরা সিনেমায়, সবার উপরে, উত্তম সুচিত্রা, আজ দেখছি হলটা উঠে গেছে, কিন্তু সকাল থেকে আমার মনে হচ্ছিল এখানে হয়ত, ‘চলতি কা নাম গাড়ি’ হচ্ছে, কিশোরকুমার মধুবালা, আমি সেই মধুবালাকে দেখব বলে এসেছিলাম।
আমি তো দেখছি। অলীক বলল।
কী?
মধুবালার মুখ। অলীক বলল।
উফ, অলীকসুন্দর, তুমি যে কী!
অলীকের মনে হল সে তার জন্মের আগের শহরে দাঁড়িয়ে রনিতার সঙ্গে কথা বলছে। বুক কেঁপে উঠল, সমস্ত শরীর শিহরিত হলো। সাতাশ বছরের অলীকের বাল্যকাল যেন সাতাশ বছর পার করে পিছনে চলে গেল। লাল দোতলা বাস, খোলা পথ, টং টং করে ট্রাম চলেছে দ্রুত গতিতে। উত্তরা সিনেমায় ‘চলতি কা নাম গাড়ি’, রাধা সিনেমায় ‘সুরের আগুন’ শ্রী সিনেমায় ‘দেয়া নেয়া’। স্টার থিয়েটারে ডাক বাংলো নাটক...বাবার কাছে শুনেছে সে। রঙমহল থিয়েটারে ছায়াবিহীন...। উত্তর কলকাতার বিখ্যাত থিয়েটার পাড়া ছিল এইটা। সে কিছুই বলতে পারে না, ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল রনিতার দিকে। তারা হাঁটতে আরম্ভ করল। হাঁটতে হাঁটতে জনাকীর্ণ শহর ছেড়ে গেল। গেল এক নির্জন পথে। অপরাহ্ণের আলো সেখানে গা এলিয়ে আছে। বাতাসে অচেনা ফুলের গন্ধ। রাস্তার দুপাশের ব্যালকনিতে কেউ নেই, শুধু একটিতে এসে দাঁড়িয়েছে এক বৃদ্ধা। হাত তুলল অলীক, তিনিও হাত তুললেন। রনিতা বলল, চাঁপাবনির নিরূপমা দেব্যা, ওই যে ওই, আসলে উনিই দেবী বিপত্তারিনী।
রনিতা তুমি কি আমার জন্য এলে আজ? অলীক জিজ্ঞেস করে।
মোটেই না, আমি মধুবালার সিনেমা দেখতে এসেছিলাম। হাত ঘুরিয়ে রনিতা বলল।
দেখা হলো না তো।
সে তো তোমার জন্য অলীকসুন্দর। রনিতা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে থাকল।
বাড়ি ফিরে রাত ন’টায় অন লাইন হয়ে দেখল রাই মুখারজি নেই। নেই কিন্তু তার জন্য একটি মেসেজ এসে বসে আছে, ‘স্যরি, যেতে পারলাম না, অ্যাজ বিকজ ওই সিনেমা হলটির কোনো একজিস্টেনস নেই, মল হয়ে গেছে, আমি কোথায় যাব, অথচ হলটি ছাড়া তোমাকে পাব কোথায়? তাই আমি লাইব্রেরিতে গিয়ে বাসুস্যারের জন্য কবি রায়গুনাকার ভারতচন্দ্রের উপর যারা লিখেছে এ পর্যন্ত, তাদের লিস্ট বানালাম, কপি করলাম, করতে পাঁচটা বেজে গেল! হ্যাঁ, অলীক, হি ইজ নিউ কামার টু মায় রিয়েলিটি, হি ইজ ভেরি মাচ রিয়েল ইন মায় লাইফ, হি ইজ মাই নিউ মহাত্মা...আই লাভ হিম, রিয়েলি, সত্যি বলছি,’
লিখে একটা স্মাইলি এঁকে দিয়েছে রাই, বায় অলীক, আমি অনলাইন হবো অন্য সময়, অন্য নামে। আবার স্মাইলি। সরগুঞ্জা থেকে ফিরে এস। স্মাইলি। অলীক পরদিন অফিসে গিয়ে দেখল তালা বন্ধ। নর্থ ইস্টে বিহু উৎসব, তাই সাতদিন কলকাতার অফিস চিরতরেই যেন বন্ধ । অলীক ফোন করল রনিতাকে, হেল্লো, শুনছ কী হয়েছে..., ও মধুবালা শুনছ...।