মাঝরাতে রংপুরের প্রান্তর পূর্ণিমায় ভেসে যায়, জংগলের ভেতরে ঘুম ভেঙ্গে যায় নূরলদীনের। প্রথম তার মনে হয়, সে শুয়ে আছে তার শৈশবে, আব্বার পাশে, কুড়েঘরের মেঝেয় মাটির পরে এবং বাতাসে বড় শীত। যেমন সে শৈশবে আব্বাকে জড়িয়ে ধরতে যায় এবং তখুনি বাস্তব তার কাছে ফিরে আসে, শুয়ে আছে মাটিতেই তারা, পাশে তার স্ত্রী আম্বিয়া,তবে এখন তারা মোগলহাটের গহীন জংগলে।
ঘুমের ভেতরে আম্বিয়া স্বামীর সাগ্রহ বাহুর ভেতরে আরো খানিক সরে আসে, এবং নূরলদীন তৎক্ষণাৎ একটি তেতো ওষুুধের মতো স্মরণ করে ওঠে বিকেলে আম্বিয়ার একটি সংলাপ সে এখন আম্বিয়ার শরীর সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে, কিন্তু সহজ হয় না। পূর্ণিমার চাঁদ বাইরে, জংগলের মাথায়, জংগল পেরিয়ে প্রান্তরে ওপারে, নদীর পাড়ে দেবী সিংয়ের কাছারি বাড়ির শান বাঁধানো চত্বরের ওপর খল খল করে হেসে যায়।
ঘুমোতে যাবার কিছু আগে, নূরলদীনের স্মরণ হয় এবং সে চিন্তিত হয়ে পড়ে, বহুদূরে ঘোড়ার খুরের শব্দ সে মুহূর্তের জন্যে পেয়েছিল, তৎক্ষণাৎ মাটিতে সে কান লাগিয়ে শুনবার চেষ্টা করেছিল, অতিক্ষীণ কম্পন ভিন্ন কিছু, নয় কিংবা তাও হয়ত নয়, কিছুই সে সিদ্ধান্ত করতে পারেনি। নূরলদীন জানে দেবী সিং কোম্পানীর ফৌজ ডেকে এনেছে গ্রাম থেকে গ্রামে, প্রান্তর থেকে প্রান্তরে জংগল থেকে জংগলে সেই ফৌজ তাকে খুঁজে ফিরছে, গ্রামের পর গ্রাম তারা জ্বালিয়ে দিচ্ছে, কিষাণদের ধরে ধরে গাছের ডালে ফাঁসীতে ঝুলিয়ে দিচ্ছে, ত্রাসের ভেতর ঠেসে ধরে কিষাণ-দের তারা বাধ্য করতে চেষ্টা করছে নূরলদীন আর তার বাহিনীর সন্ধান বলে দেবার জন্যে, নূরলদীর ক্রমশ ডেরাবদল করতে করতে এখন এসে দেবী সিংহেরই কাছারির কাছে জংগলে সাস্তানা নিয়েছে, বরং শত্রুর কোলের বেশি নিরাপদ। কিন্তু ঘুমোতে যাবার আগে ঐ যৈ তার মনে হয়েছিল ঘোড়ার খুরের শব্দ খুব কাছেই, নুরলদীন হাড়ের ভেতর অস্থিরতা অনুভব করে ওঠে, যেমন তখন, তেমনি এখন এই মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে উঠে।
সে কি ভীত? ইংরেজ ফৌজের সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাবনায় সে এখন শীত অনুভব করছে? বিকেলে আম্বিয়ার কথাগুলো, আসলে সংক্ষিপ্ত সামান্য একটি মাত্র বাক্য তার আবার স্মরণ হয়, নূরলদীন নিশ্চিত হতে পারে না,তার এই শীতবোধ কি শত্রুর ঘোড়ার শব্দ পেয়ে, অথবা আম্বিয়ার মুখ থেকে কথাটা শুনে।
ধীরে, সন্তর্পণে, নূরলদীন আম্বিয়ার ঘুমন্ত হাত নিজের দেহ থেকে সরিয়ে দেয়, নিঃশব্দে সে উঠে দাঁড়ায়, তাবুর ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে ফাঁকা জায়গাটির দিকে অগ্রসর হয়, যেখানে ঘুমিয়ে আছে তার সংগীরা। যদি আব্বাসের সঙ্গে এখন সে কথা বলতে পারে, হয়ত মীমাংসা সম্ভব হবে, কেন তার এই শীতবোধ হাড়ের ভেতরে।অগ্রসর হবার প্রতিটি পদক্ষেপ নূরলদীনের বুকের ভেতর আব্বাসের ক্রোধ ফুঁসে উঠতে থাকে, মাঝে মাঝেই এই অনুভূতি তার হয়, ছেলেবেলার বন্ধুকে তার গলা টিপে হত্যা করতে ইচ্ছে করে একেক সময়। আব্বাস তার সঙ্গেই বেছে নিয়েছে এই কঠিন জীবন, গুপ্ত গণসৈনিকের জীবন, অনুসরণ করছে নূরলদীনকে ছায়ার মতো, কিন্তু কখনোই অস্ত্র হাতে ধরছে না বরং প্রতিটি আলোচনায় আব্বার বলছেÑএই যুদ্ধ করে লাভ নেই, এই যুদ্ধে তুমি কিছুই অর্জন করতে পারবে না।
অথচ, বাল্যবন্ধু বলেই তো আব্বাসের সবচেয়ে ভালো জানবার কথা, এই যুদ্ধ না করে নূরলদীনের আর কোনো কর্তব্য নেই। প্রতিটি খ-যুদ্ধের পর, সংগীরা যখন সকলেই উল্লাসে ফেটে পড়েছে, নূরলদীন লক্ষ করেছে আব্বাসের চোখেই কেবল মাছের মতো দৃষ্টি, আব্বাসের মুখেই কেবল ইষৎ বিদ্রুপের ঠা-া ছুরি।
তবু, এখন এই মাঝরাতে, পূর্ণিমায় যখন প্রান্তর জংগল ভেসে যাচ্ছে, ঘোড়ার খুরের স্মৃতি যখন হানা দিচ্ছে, যেনবা অতি নিকট, নূরলদীন মনে মনে সন্ধান করে আব্বাসকেই।
এবং তাকে সে পায়, সে দেখতে পায় আব্বাসকে, যখন সবাই ঘুমিয়ে, ইতঃস্তত, আব্বাস একা জেগে এবং আকাশের ঐ অতবড় চাঁদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে।
নিঃশব্দে নূরলদীন, আব্বাসের পেছনে এসে দাঁড়ায়। মনে মনে হেসে ওঠে নূরলদীন, আব্বাস এখনো গুপ্ত সৈনিকের কিছুই শেখেনি যদিও এতকাল সঙ্গে আছে, তার পেছনে একটি মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে, অথচ আব্বাস তার কিছুই টের পেল না। এভাবে আত্মাহারা হয়ে থাকলে তো কত সহজ তাকে বধ করা, যে কেউ তাকে চোখের পলকে আঘাত করতে পারবে, এবং এত ক্রোধ সত্ত্বেও নূরলদীন এখন আব্বাসের জন্যে প্রবল মমতা অনুভব করে ওঠে, সে শিউরে ওঠে, আব্বাসের দেহে কেউ আঘাত করেছে ভেবেও সে বিচলিত হয়ে পড়ে। নূরলদীন স্নেহের একটি হাত রাখে আব্বাসের পিঠে।
আব্বাস যেন জানতই নূরলদীন আসবে, যেন তার আসবার কথা ছিল এবং তারই অপেক্ষা সে করছিল সবাই যখন ঘুমন্ত তখন একাকী জেগে থেকে। আব্বাস স্মিত চোখে ফিরে তাকায় নূরলদীনের দিকে, কিছুক্ষণের জন্যে, তারপর আবার সে দেখতে থাকে পূর্ণিমার চাঁদ।
তুমিও তো জেগে। তুমিও তো তোমার পতœীকে ফেলে এখানে উঠে এসেছ, নূরল। কেন উঠে এলে? যদি তোমার আম্বিয়া কোনো কূস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে ওঠে?
কুস্বপ্ন? আব্বাসের কাঁধে নূরলদীনের হাত কঠিনভাবে বসে যায় ক্ষণকালের জন্যে। তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে নূরলদীন অপ্রতিভ গলায় বলে, কুস্বপ্নের কথা তোমার মনে এলো কেন, আব্বাস? স্বপ্ন কি কেবলই কুস্বপ্ন? আর কোনো জাত নেই স্বপ্নের? যেমন সুস্বপ্ন?
নূরলদীন হাড়ের ভেতরে আবার স্মরণ করে ওঠে বিকেলে আম্বিয়ার সেই সংক্ষিপ্ত সামান্য বাক্যটি। নূরলদীন বিস্মিত হয়ে যায়, আব্বাস কি করে এভাবে অনবরত তার মনের খবরগুলো এত সহজে অনুমান করে নেয়। সে জনেই বুঝি সহজ হয়, আব্বাসের সঙ্গে তার আলোচনা, স্পষ্ট করে কিছু না বলেও নূরলদীন আশা করতে পারে এত স্বাভাবিকভাবে যে আব্বাস তার সংশয় দূর করতে পারবে।
আব্বাস নূরলদীনের মৃদু তিরস্কার মেশনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে চাঁদের দিকে আঙুল তুলে বলে, ঐ দ্যাখো, কত বড় চাঁদ ভেসে যাচ্ছে নীলের ভেতর দিয়ে, অগণিত তারার বাহিনী তার সঙ্গে। এমন সুন্দর চাঁদ দেখলে কে বলবে পৃথিবীতে এত কষ্ট আছে, এত দুঃখ আছে?
নূরলদীন তেতো গলায় বলে ওঠে, তোমাকে দেখলেই বা কে বলবে তুমি সুখী কোনো গৃহবাসী নও, তুমি গুপ্ত সৈনিকের দলে জংগলে জংগলে পলাতক?
আব্বাস নীরবে হাসে।
গলায় আরো খানিক তেতো এনে নূরলদীন বলে, ঐ চাঁদ তো মাথার ওপর দিয়ে হেঁটে যায়, আব্বাস। তাকায় সে কখনো নিচে?
আব্বাস বিস্মিত হয়ে নূরলদীনের মুখের দিকে তাকায়। পূর্ণিমার আলোর স্পষ্ট তার মুখ দেখা যায়, নূরলদীনের মুখে এখন ভয়াবহ ক্রোধ সে লক্ষ্য করে।
নূরলদীন চাপাস্বরে বলে চলে, তিস্তার পানি রক্তে লাল আব্বাস, তোমার ঐ চাঁদ কি তা দ্যাখে? আঙিনায় আমাদের সন্তানেরা অনাহারে কাঁদে, চাঁদ কি তা শোনে? না, আব্বাস, না, পূর্ণিমার চাঁদ আমার চাই না, আমি চাই পূর্ণিমার মতো খল খল করে হেসে উঠুক আমাদের সন্তান, পূর্ণিমার মতো সুখ ভরে থাক আমাদের প্রতিটি আঙিনায়।
হঠাৎ নূরলদীন আব্বাসকে দুহাঁতে কাছে টেনে বলে, এই তো আমি চাই, এর বেশি তো আমি কিছু চাইনি? এর বিপরীত তো কিছু আমি কখনোই ভাবিনি? আব্বাস, তুই যদি আমার সিনায় কান পেতে শুনিস, তো শুনে দেখবি, এই প্রার্থনা ছাড়া আর কোনো প্রার্থনা নেই আমার। প্রতিটি নিঃশ্বাসে এই একটি কথাই উচ্চারিত Ñশোন, শুনে দ্যাখ।
আব্বাসকে আকর্ষণ করে বুকের কাছে প্রায় চেপে ধরেছিল নূরলদীন, সে এখন নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে স্মিত কৌতূহলের সঙ্গে তাকিয়ে থাকে লোকটির চোখের দিকে। তারপর মৃদু স্বরে উচ্চারণ করে, আমি তো কোনো প্রশ্ন করিনি, সন্দেহ প্রকাশ করিনি, তাহলে এই কৈফিয়ত কেন?
কৈফিয়ত? কি বলছিস, আব্বাস?
কৈফিয়ত নয় তো কি, নূরল? আমি তোমার গলায় শুনতে পাচ্ছি কৈফিয়তের সুর। বলো আমাকে, কী তোমার মনের ভেতর আছে? কোন কাঠঠোকরা তোমার মন এভাবে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে?
নূরলদীন অপ্রস্তুত হয়ে নীরব থাকে, দৃষ্টি একবার চাঁদের প্রতি রাখে, কিন্তু দ্রুত সেখান থেকেও চোখ ফিরিয়ে জংগলের অন্ধকারে রাখে, তারপর ধীরে সে চোখ ফিরিয়ে আনতে থাকে মাটির ওপরে শায়িত ঘুমন্ত তর সংগীদের দিকে।
আব্বাস অনুনয় করে বলে, আমাকে তা বলা যায় না নূরল? সেই কোন কাল থেকে দুজনে আছি যেন দুই ভাই। একই পাত থেকে দুজনে কত কত দিন ভাগ করে খেয়েছি অন্ন। আমাকে তুমি বলতে পারছ না, তোমার মনের ভেতরে কোন কষ্ট এত কষ্ট দিচ্ছে?
অনেকক্ষণ দুই বন্ধু তাকিয়ে থাকে পরস্পরের চোখে চোখ রেখে। নূরল একবার চোখ ফিরিয়ে নিতে যায়, কিন্তু কি সম্মোহনের টানে আবার তার চোখ ফিরে আসে আব্বাসের চোখে।
নূরণদীন অকস্মাৎ চোখ নামিয়ে বলে, আম্বিয়ার পরে আমি খুশি নই।
বিস্মিত হয়ে যায় আব্বাস, ঝুঁকে পড়ে নূরলদীনের চোখ সে ভলো করে দেখতে চায়, কিন্তু খন এই স্বচ্ছ প্রবল পূর্ণিমার আলোও তার কাছে আর যেেথষ্ট বলে বোধ হয় না। আম্বিয়ার বিষয়ে এমন কথা নূরলদীন আর কবে বলেছে বলে আব্বাসের মনে পড়ে না।
নূরলদীনকে আকর্ষণ করে একটা পতিত গাছের ডালের ওপর বসিয়ে দেয় আব্বাস নিজেও সে বসে এবং স্বগতোক্তির মতো প্রশ্ন করে চলে, কবে থেকে? কেন? কি হয়েছে? সে তোমার পতœী, তুমি তার পতিধন, তোমাকে নিয়ে সে এত গৌরব করে, তোমার সঙ্গে হাসিমুখে সে মেনে নিয়েছে জংগলের এই জীবন, আর তুমি তার পরে আর খুশি নও? কি বলছ, নূরল?
নিচু স্বরে নূরল উচ্চারণ করে সেই বোঝে যে ঘরবাস করে, যার ঘর আছে, সংসার আছে।
হেসে ফেলে আব্বাস।
আমার সংসার নেই, ঘর নেই , পতœী নেই, এ কথা আর স্মরণ করিয়ে দেবার দরকার কি, নূরল? পতœী নেই বলেই পতœীর রীতিও আমি জানি না, জীবনে আমার নারী নেই বলে নারীর মনও আমার খোঁজের বাইরে, সবাই সত্যি কথা, তবু এতো গর্দভ তো নই যে, বললে বুঝব না? বিশেষ করে, বন্ধুর মনের কষ্ট যদি শুনেও না বুঝতে পারি, তাহলে আর একসঙ্গে এতকাল থেকেই বা কি লাভ। না, তোমাকে বলতেই হবে, নূরল, কেন তুমি আম্বিয়ার ওপর এতখানি অসন্তুষ্ট? কি হয়েছে তোমার যে এই প্রথম তুমি এতবড় কঠিন একটি কথা উচ্চারণ করলে?
আব্বাসের হাতে নূরলদীন নিজের কাঁধে কয়েকটি ধাক্কা অনুভব করে, প্রবল সে ঝাঁকুনি, যেন এভাবে আব্বাস তার ভেতরের কথা বের করে আনতে চায়, যেন বা কলসী থেকে গাঢ় গুড়।
অনেকক্ষণ ইতঃস্তত করবার পর নূরলদীন বলে, আম্বিয়া আমার পরিবার, আমার সেই পরিবারই যদি আমাকে না বোঝে তাহলে আর কার কাছে আশা আছে? দুনিয়ার সকল জোড়ার সবচেয়ে বড় জোড়া মানুষের জোড়া, পতি পতœীর জোড়া, যেন একই ছবির আয়নায় দুটি প্রতিফলন, নয়? অবিকল, রূপ ও প্রতিরূপ, এতই তার শোভা যে সেই শোভা ভাংগতে মালেকুল মউতেরও বুক ভেংগে যায়, মউতের ফেরেশতারও চোখে পানি এসে যায়, নূরল।
বিস্মিত গালায় আব্বাস প্রশ্ন করে, ভাংগবার কথা বারবার কেন বলছ? ভাংগবার কথা কেন আসছে?
আসে, আব্বাস, আসে। মাঝির অন্তর যদি ভেংগে যায়, তাহলে তার সাধের নৌকোর খোলও টুকরো টুকরো হয়ে নদীর পানিতে ভেসে যায়, জানো না?
ধমক দেয় আব্বাস।
স্পষ্ট করে বল। আশপাশে কোনো কথা আমি বুঝতে পারি না। বলো।
দুম করে নূরলদীন তখন বলে বসে, আম্বিয়া স্বপ্ন দ্যাখে, আব্বাস, যে আমি বসে আছি সিংহাসনে, আর সে আমার বাম পাশে।
হাঃ করে হেসে ফেলে আব্বাস। মাথা দোলায় সে, যেন কত কৌতুক। আব্বাস তো এই কথাটিই কতবার আকারে ইংগিতে নূরলদীনকে বলতে চেয়েছিল, এই সন্দেহই সে করেছিল গোড়া থেকে, আজ তা নূরলদীনের কণ্ঠেই স্পষ্ট উচ্চারিত হতে শুনে সে বড় মজা অনুভব করে।
হাসছ?
না, হাসছি না। আব্বাস তবু হাসতে হাসতেই বলে, আম্বিয়া তোমাকে বড় ভালোবাসে, তাই সে এই স্বপ্ন দ্যাখে।
ভালোবাসে? চিৎকার করে ওঠে নূরলদীন। পরমুহূর্তে তার খেয়াল হয়, সংগীরা আশপাশেই ঘুমিয়ে আছে, সে সামলে নেয় নিজেকে। ফিসফিস করে আরেকবার এখন প্রতিধ্বনি করে, ভালোবাসে?
আব্বাস, নবাবের সিংহাসনে বসবার কোনো লোভ , কোনো স্বপ্ন যে আমার নেই, তা আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো। জানো না? তবু তুমি হাসছ, আর আমাকে বলছ, আম্বিয়া আমাকে ভালোবাসে? তুমি বলতে চাইছ, ভালোবেসে পতœী যে স্বপ্ন দ্যাখে পতির তাতে বিরূপ না হওয়াই কর্তব্য, এই তো?
আব্বাস পূর্ণিমার চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার নিজের সংসার নেই, পতœী নেই, নিজেই সে ধন্যবাদ দেয় এতকাল একাকী থাকবার জন্যে। ঈষৎ শিউরে ওঠে, তার বাল্যবন্ধুর এই সংকট স্মরণ করে। দুই বিপরীত অনুভূতির ভেতরে সে চাঁদের প্রবল আলোকে শব্দময় বলে বোধ করতে থাকে।
অশান্ত পায়চারী করতে করতে নূরলদীন বলে, কেউ বিশ্বাস করুন বা না করুক তাতে আমার কিছু এসে যায় না, আব্বাস। তোমার বিশ্বাসের ভেতরে আমার যেন স্থান হয়, এবং চিরকাল থাকে। তোর কি মনে পড়ে না, আব্বাস, সেই পাটগ্রামের কথা? মনে পড়ে? কিষাণেরা আমাকে সেদিন, এমনি এক পূর্ণিমার রাতে, প্রান্তরে মাথায় তুলে ধরল, আমাকে তাদের নেতা করল? মনে পড়ে রে? আমাকে তারা মাথায় তুলে প্রামের দিকে এগিয়ে গেল। তুই সঙ্গে এলি না। ঘরে ফিরে আমি দেওয়ানকে পাঠালাম তোর কাছে। তুই এলি মাঝরাতে। আমরা দুজনে বসলাম আঙিনায়, আর সেদিনও ছিল এমনি পূর্ণিমা। মনে পড়ে?
পড়বে না কেন? আমি আসতেই আমার হাত ধরে তুই জানতে চাইলি, আমি কেন গণের মিছিলে তোর সঙ্গে এলাম না গাঁয়ে। হ্যাঁ, বেশ মনে পড়ে।
নূরল তেতো গলায় বলে, আর আমারও মনে পড়ে কি উত্তর তুই দিয়েছিলি আমার কথার।
মনে আছে?
মনে আছে। তুই বলেছিলি, আমার কেমন আক্কেল যে মানুষের মাথায় আমি চড়ে বসলাম। তাই না? তুই না? তুই বলেছিলি, আমি ভুলিনি, আব্বাস , তুই বলেছিলি, মানুষ যে আমাকে মাথায় করে নাচে; আমাকে যে নাচায়, তারা নূরলদীনের নাচায় না, এক পুতুলকে নাচায়।
তাহলে তো মনেই আছে। সব কথা মনে আছে নূরল?
মনে আছে। তুই বলেছিলি, কোম্পানীর গোলা আছে, কামান আছে, শিক্ষিত সেপাহী আছে, আমার নাচন ছাড়া আর কি আছে? লাঠি? তাও তো অনেকেরই নেই। বলেছিলি, পরাজয় আমার হবে। বলেছিলি, আমাকে যারা মাথায় করে নাচে, পরাজয়কালে আমাকেই তারা দোষ দেবে, ফেলে চলে যাবে,আমার লাশের দিকে তারা ফিরেও তাকাবে না। তাই না?
হ্যাঁ। বলেছিলাম। এখনো বলছি।
এখনো? এত যুদ্ধে জয়ের পরও?
হ্যাঁ, এত যুদ্ধের তোমার জয়ের পরেও আমি বলছি, নূরল । মানুষ তোমার লাশের দিকে ফিরেও তাকাবে না।
কেন, আব্বাস? কেন?
সে রাতে কি আমি বলিনি, নূরল? বলিনি, যে মানুষ আসলে চায়Ñতুমি জয় করে দেবে, তুমি তাদের হাতের মুঠো ভরে দেবে, কিন্তু তার জন্যে যে ধৈর্য যে প্রস্তুতি দরকার তা তারা রাখবে না, নেবে না,? মানুষ বিজয় চায়, তারা লাশ চায় না, নূরল। মানুষ নগদ চায়, ধৈর্য ধরতে চায় না, নিজের জীবন ছেড়ে দূরের দিকে তারা তাকায় না, বড় লম্বা আন্দেলনে ভীত হয় মানুষ । তাই তো আমি বারবার বলি, তোমার এই আন্দোলনে তুমি সফল হবে না। তাই আমি বহুবার তোমাকে বলেছি, নূরল, লোকের কথায় না নেচে উঠে পাহাড়ী নদীর মতো সমতলে ঝাঁপ দিও না। আগে মানুষ তৈরি করো, ধীরে ধীরে পায়ের নিচে মাটিকে তৈরি করো, দেশের সন্তানকে গড়ে তোলো, এমন মাটিতে সবাইকে গড়ে তোলো যেন তারা জমিদার কি মহাজন কি নবাব না হয় নিজেরাই। যেন তারা সকলের সঙ্গে অন্নপান ভাগ করে খায়। ইংরেজের সঙ্গে লড়াই করো, ইংরেজ তো কালাপানির পাড়ের মানুষ, বিদেশের তারা, নবাব কি মহাজন তো বিদেশী নয়, তোমার আমার মতো তাদের জন্মও তা এই দেশেরই মাটিতে হয়েছে, হচ্ছে, হবে। বলো, কি নিশ্চয়তা আছে, যদি না মানুষকে সেভাবে তুমি তৈরি করো, আবার এই মাটিতেই নবাব বা মহাজন বা জমিদার জন্ম নেবে না? তাই তো বারবার আমি একটি কথাই তোমাকে বলি, নূরল, মানুষ তৈরি করো, মাটি শক্ত করো, তবে আগেই এভাবে তুমি ঝাঁপ দিও না।
নিস্তেজ গলার নূরলদীন একবার ডাক দেয়, আব্বাস।
আব্বাস অপেক্ষা করে।
অনেকক্ষণ নূরলদীন কিছু বলে না, গাছের ডালের ওপর স্থিরমূর্তির মতো বসে থাকে।
তারপর হঠাৎ সে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
কিন্তু আমার যে সহ্য হয় না, আব্বাস। আমার যে এই অনাহার, এই অত্যাচার দেখে আর রক্ত স্থির থাকে না। আমি যে আমার হাতের মুঠোয় অস্ত্র ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারি না। আমি তো মানুষ। মানুষ হয়ে কি করে আমি চোখের ওপরে দেখব ইংরেজ আর দেবী সিং আর মহাজনদের এই অত্যাচার?
আব্বাস তখন মৃদু গলায় স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষ তৈরি না করলে তোমাকেই একদিন নবাব বলে তারা তাজ পরিয়ে দেবে।
না।
এবং তুমিও হবে আরো এক নবাব।
না।
অন্য পরে কি কথা, নূরল? তোমার সবচেয়ে কাছের মানুষ যে আম্বিয়া, সেও তো তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দ্যাখে, তুমি নবাব।
না। চিৎকার করে ওঠে নূরলদীন। কিন্তু পরমুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে পড়ে সে, অপ্রতিভ চোখে ইতঃস্তত তাকায়, তার মনে পড়ে যায় বিকেলে আম্বিয়ার সেই সংক্ষিপ্ত বাক্য, আমার বড় সাধ তোমাকে নবাবের তাজ মাথায় দেখি।
নূরলদীন বিড়বিড় করে বলে চলে, আছে আল্লা মাথার ওপরে, তিনিই জানেন, আম্বিয়া না জানুক, আব্বাস না জানুক কেউ না জানুক, আল্লা তো জানেন আমার অন্তরে যে আগুন জ্বলছে সেই আগুনে দুনিয়ার সমস্ত সিংহাসন পুড়ে যায়। সে আগুন সেই দূর ছিয়াত্তরের, সূর্যের সেই আগুনে ঝলসে গিয়েছে মাঠ, পুড়ে গিয়েছে শস্য, দেবী সিংহের খাজনা দেবার জন্যে আমার আব্বা হালের বলদ বেচে দিয়েছেন, নিজে তিনি বলদের মতো হাল টেনে পোড়া মাটিতে শস্য ফলাবার চেষ্টা করেছেন। আমি তাকে দেখেছি, কাঁধে জোয়াল নিয়ে লাঙল টানতে টানতে কোমর ভেংগে পড়ে যেতে, দুপুরের ঝলসানো রোদের ভেতরে তার গলা দিয়ে গল গল করে রক্ত বেরিয়েছে, আমি দেখেছি তার সেই রক্তে মাঠ ভিজে যেতে, আমি শুনেছি সেই রোদের ভেতরে মাটিতে মুখে থুবড়ে পড়ে অন্তিমকালে বলদের মতো তাকে আর্ত হাম্বারব করে উঠতে। এই পূর্ণিমায় যতই কোমলতা থাক, আব্বাস সেই রোদের আগুন আর হলকা তো আমি ভুলতে পারি না। সে আগুন আমার বুকের ভেতর থেকে নেভে না, যেন তা না নেভে যতদিন পর্যন্ত না দুনিয়ার সব রাজ সিংহাসন পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
রংগপুরের আকাশে বাংলা এগারোশ উননব্বই সনের এক পূর্ণিমার চাঁদ হঠাৎ বীভৎস বলে বোধ হয়। আব্বাস ও নূরলদীন দুজনেই এই সেই দগ্ধ চাঁদের নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকে।
সৈয়দ শামসুল হকের ‘জ্যোৎস্নায় নুরুলদীনের নিঃসংগতা’ গল্পটি ছাপা হয়েছিল শাহাদত চৌধুরী সম্পাদি সাপ্তাহিক বিচিত্রার ১৯৮২ সালের বর্ষ ১১-এর ২৯ সংখ্যায়। একইভাবে সেলিনা হোসেনের ‘বুকের বাংকারে লাশ’ গল্পটি বিচিত্রার ১৯৭৪ সালের বর্ষ ২, সংখ্যা ৩৯-এ প্রকাশিত হয়। গল্প দুটির নাম শুনে তাঁরা দুজনই খুব বিস্মিত হলেন। এ গল্প তাঁরা লিখেছেন! গল্পের নাম বলাতে দুজনই স্বীকার করলেন এবং বিনীতভাবে জানালেন, তাঁদের কোনো বইয়ে এই গল্প নেই। এই সময় পাঠকদের জন্য অগ্রন্থিত গল্প দুটি পুনর্মুদ্রিত হলো। এ দুটি গল্প সংগ্রহ করেছেন কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক মাহবুব রেজা