একটা বুলেটের বিনিময়ে আমি একটা একটা জীবন হরণ করে ছিলাম। কথাটা ছন্দা জানে। ছন্দার সঙ্গে আমার ভালবাসা ভালবাসা খেলা জমে ওঠার অনেক পরের ঘটনা এটা। ঐ খুন আমার প্রয়োজন ছিল। জামিল আমার ঘনিষ্ট বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও ওকে আমি খুন করেছি। এর প্রধান কারণ রাজনীতিতে আমাদের মত পার্থক্য। আমি মনে করি ও আমার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। সে অপরাধের দেনা ওকে শাস্তি পেতে হবে। ইচ্ছে করলে জামিলও আমাকে খুন করতে পারত। কিন্তু সে সুযোগ ও পায়নি। পেলেও ওর তেমন সাহস ছিল না। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছি আমি। আমার বুকের ভেতর সাহস নামক বস্তুটা সমুদ্রের মত গমগম করে। ওকে মারতে আমার একটুও হাত কাঁপেনি। এজন্য আমার মনে কোন গ্লানি নেই। অপরাধবোধও নেই। যা আমি অপ্রয়োজনীয় মনে করেছি তাকে আমি নির্দ্বিধায় নর্দমায় নিক্ষেপ করেছি। ব্যস, ঝামেলা চুকে গেছে। কিন্তু মুশকিল হোল আমার খুনের সমুদয় দায় দায়িত্ব ছন্দা তার ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। যতসব বাজে ভাবনা। কোন মানেই হয় না স্নায়ুবিক দুর্বলতার এহেন আচরণের। আসলে ছন্দা সমগ্র ব্যাপারটাকে পৌঁচিয়ে ফেলেছে। আমার মনে হয় ছন্দার ব্রেনে অতিরিক্ত কতগুলো সেলের জন্ম হয়েছে। নইলে এমন অর্থহীন ভাবনায় ও সমস্ত কিছু গুলিয়ে ফেলছে কেন?
ছন্দাকে আমি ভালবাসতে চাচ্ছি। ছন্দা আমাকে অস্বীকার করছে। বলছে, খুনীকে ভালবাসা পাপ। পাপ। ছন্দা আমাকে পাপের কথা শেখায়। কিন্তু ছন্দাকে আমি কিছুতেই বুঝাতে পারছি না যে পাপের সংজ্ঞা বদলেছে। খুনির সংজ্ঞাও বদলেছে। আমাদের বিশ্বাসের প্রচলিত ধারাগুলো এখন আর কোন বস্তুতে নির্দিস্ট নেই। হাওয়ায় ভাসা বেলুনের মত ধারণাগুলো এখন ভাসমান । সব কিছুতেই স্পর্শ আছে। কোন কিছুতেই স্থিতি নেই। আমি যদি বলি ছন্দাও খুনি? তবে কি ও তা অস্বীকার করতে পারবে? পারবে না। পারা অসম্ভব। আমার প্রয়োজনে আমি খুন করেছি। কিন্তু ছন্দা বিনা প্রয়োজনে তিলে তিলে হত্যা করছে আমাকে। ছন্দার ব্যবহারটা ধীরে বিষক্রিয়ার মত। আমার রক্তস্রোতকে দূষিত করে তুলছে। আমার ভালবাসার বিরাট ফ্যানুসটা যখন সমস্ত আবেগ নিয়ে ফেটে পড়তে চায় তখন ছন্দা তার নির্লিপ্ততার ছুরি দিয়ে নির্মমভাবে কাটে। সে ক্ষতের রপ্তক্ষণ লাল নয় বলেই ছন্দা তা দেখে না। সে মিষ্টি ভাষী ছন্দা এখন রুঢ এবং কঠিন স্বরে কথা বলে। ছন্দা কেমন করে এমন বদলে গেল? আমি তা ভেবে কুলিয়ে উঠতে পারি না। একদিন আমাকে না দেখতে পেলে যার চোখ ছল ছলিয়ে উঠত সে এখন আমার মুখের দিকে তাকায় না। আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলে না। আমার আঙ্গুল কামড়ে দেয় না। ছন্দা এখন আর ওর অন্ডুত অন্ডুত ইচ্ছেগুলো আমার ঘাড়ে চাপায় না। বলে না, আলম তুমি পার রাত দুপুরে আমাদের ঐ মাধবীঝাড়ের নীচে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে? শুধুমাত্র আমার জন্য? আমি দারুণ উৎসাহে বলতাম পারি, পারি।
Ñ প্রমাণ দাও?
Ñদেব। আজ রাতে।
Ñ থাক। লাগবে না। আলম তুমি পার সাতদিন টানা না ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিত শুধু আমার জন্য।
শুধু আমার জন্য?
আমি উত্তর না দিয়ে পাশ কাটিয়ে বলতাম, তোমার ওপর তোমার খুব মায়া না ছন্দা?
Ñ হ্যাঁ। খুব।
ছন্দা এখন নিজের ওপর মায়া করছে না। নাকি আমারই ভুল? বুঝতে পারছি না। নিজের ওপর অসম্ভব মায়া বলে ছন্দা আমার থেকে অনেকদূরে সরে গেছে। মনে হয় ছন্দা এখন ঠিক সেই নির্জন বাংকারটার মত। স্বাধীনতার পর কামালপুরের এক অখ্যাত গ্রামে যাকে আমরা ফেলে এসেছি। সেখানে ফিরে যাবার আমার আর কোন পথ নেই। ঐ বাংকারের মত ছন্দা বুঝি আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। ট্রেনিংয়ের পর সেই ব্যাংকারটাকে কত আপন মনে হোত। ব্যাংকারের অন্ধকার আর স্যাঁতসেঁতে মাটি আমাকে ছন্দার স্পর্শের কথা মনে করিয়ে দিত। সেদিনগুলোর ছন্দাকে আমি আর কোথাও খুঁজে পাই না। ছন্দা এখন শুকনো ঘাসের মত রুক্ষ ও কর্কশ।
ছন্দাকে বলেছিলাম, আমার কর্মের প্রয়োজনে আমি যা করেছি তাকে তুমি আমার ভালবাসার সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে এক করে দেখো না। ছন্দা একটুও না রেগে খুব শান্ত স্বরে বলেছিল, যে ভালবাসার সঙ্গে কর্মের কোন যোগ নেই সে ভালবাসায় আমার কোন আস্থা নেই। আমি কোন কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে চাই না।
ছন্দা মুখটা নীচু করেই ছিল। ওর মাথার মাঝের চওড়া সিঁথিতে আমার দৃষ্টি আটকে ছিল। মনে হোল আমার বুকের মাঝেও ওরকম একটা সাদা দাগ পড়েছে। আমার চীৎকার করতে ইচ্ছে করছিল। পারছিলাম না। অসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বিণীত ভঙ্গীতে বললাম, যে হাতে মানুষ খুন করেছি তাকে আবার ভালবাসায় রাঙিয়ে তোমার দিকে প্রসারিত করেছি ছন্দা।
Ñনা। হয় না। ছন্দার কণ্ঠ ভারী ও তাপহীন।
Ñ কেন হয় না? আমি অসহিষ্ণু কণ্ঠে চীৎকার করেছিলাম। যেসব কথা সবাই ভুলে গেছে তাকে নিয়ে তোমার এত মাথাব্যথা কেন ছন্দা?
Ñ সবাই ভুলতে পারে কিন্তু আমি ভুলিনি।
ছন্দা যেন এক অলৌকিক স্থান থেকে দেবদূতের বাণীর মত উচ্চারন করেছিল সে কাণ্ড। আমি থমকে ওর মুখের দিকে তাকিয়েছিলাম। কি ছিল ওর চেতনায় আমি বুঝিনি। আমি সোজা সোজা কথা বুঝি। ভেতরে আবেগ আছে ভালবাসি। কিন্তু ভালবাসার তত্ত্বকথা আমি বুঝি না। হৃদয়ের অলিগলি। মার প্যাঁচ আমার ধাতে সয় না। আসলে ছন্দা ঠিক সে ধরণের মেয়ে যারা কষ্টগুলো বুকের ভেতর লালন করে আনন্দ পায়। বেড়া ভেঙ্গে বেরিয়ে আসতে পারে না।
নতমুখী ছন্দার দিকে তাকিয়ে আমার রাগ করছিল।
Ñআমি যা করেছি তার জন্য দেশের আইন রয়েছে ছন্দা তুমি নিজে কেন আদালত সেজে আইন তৈরি করেছ?
Ñদেশের আইন? ছন্দার কষ্টটা অদ্ভুত বিদ্রপাত্যেক। দেশের আইন আছে বলেই তো তুমি অমন নির্বিবাদে ঘুড়ে বেড়াচ্ছ। শান্ত স্নিগ্ধ ছন্দার দৃষ্টিতে বারুদ ফেটে পড়ে। সবার সামনে চীৎকার করে বলতে পারি যে তুমি একটা খুনী?
ছন্দা বিদ্রুপাত্মক ধ্বণিতে চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে।
Ñআমিযা নই তা চীৎকার করে প্রতিষ্ঠিত করার কোন প্রয়োজন আমার নেই।
Ñজোর করে অস্বীকার করতে চাইলেই কোন সত্যকে অস্বীকার করা যায় না।
আমার জেদ বাড়তে থাকে। ইচ্ছে হয় ছন্দার গায়ের ওপর পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। ইচ্ছে হয় ওর সমস্ত শরীর থেঁতলে পিষে ফেলতে।
Ñ বারবার তুমি একই কথায় ফিরে যাচ্ছ ছন্দা। অর্থহীন াবাস্তব কথা। শুধু এটুকু জেনে রেখো তুমি যদি এমনিতে রাজী না হও তবে বুলেটের বিনিমতয়ে আমি আমার ভালবাসা আদায় করে নেব।
Ñ পারলে তাই নিও। ছন্দার নির্লিপ্ত কণ্ঠ।
Ñ তুমি বুঝতে পারছ না আমাকে যে আমি কত রূঢ় এবং নিষ্ঠুর হতে পারি।
Ñ জানি। তুমি তা পার।
ছন্দা একদম উদাস হয়ে গেছে। ছন্দা যেন জোর করে আমার অস্তিত্বকে অস্বীকার করতে চাইছে। আমি ভীষণ জেদী কণ্ঠে বলেছিলাম, ছনদা যে লোককে আমি বিয়ে করবে তাকে আমি খুন করব।
ছন্দা অস্ফুট আর্তনাদ করে। আমার চোখে চোখ রেখে ফুঁপিয়ে ওঠে। তুমি সব পার। সব পার।
ছন্দার মুখের ওপর আমার হো হো করে হাসতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু আমি হাসিনি। ছন্দা বড় করুণভাবে পরাজিত সৈনিকের মত আমার সামনে থেকে পালিয়েছে। অথচ ছন্দা চলে যাবার পর আমার মনে হোল বুলেটের একটা গুলি অন্ধকারে ছুটে গেছে। সাঁই সাঁই করে কোথায় গিয়ে লাগলো আমি তা ঠাহর করতে পারলাম না। অথচ আমার অভ্যস্ত হাতের নিশানা কখনো মিস হয় না।
আমিও বাজী ধরেছি। নিজের সঙ্গে বাজী। ছন্দাকে আমার চাই। ছন্দা ছাড়া আমার সব মিথ্যে। জনতা যে কথা ভুলে গেছে ছন্দা তা মনে রেখেছে। ছন্দা প্রতিদিন সে কথাগুলো নিয়ে নাড়া চাড়া করে। হৃদয়ের দোলনায় ঘুম পাড়ায়। বুকের মধ্যে ভীষণ অসুখ বানিয়ে রাখে। মাঝে মাঝে ভয় হয় ছন্দা কেন ভুলে যেতে পারে না সব কথা? কি এমন শক্তি ছন্দার মধে কাজ করে। ছন্দার বুকের বাংকারে এখন পড়ে আছে একটা লাশ। সে লাশের পচা দূর্গন্ধে আমার ভালবাসা সৌরভের কোন মূল্য নেই। কিন্তু আমার প্রতিজ্ঞা ছন্দার বুকের বাংকার কেবল আমি থাকব। শুধু আমি আর আমার স্টেনগান। আর কেউ না। কোন লাশ না। ফুলে ফুলে ঢেকে রাখব সে লাশের মাংশাসী অস্তিত্ব। যে জিনিসে আমার লোভ তার থেকে আমি কোনদিন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসিনি। আসব না। যে প্রতিজ্ঞা নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে লড়েছিলাম সে একই প্রতিজ্ঞা নিয়ে এখন নিজের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছি। ছন্দা জানে না আমার বুকের ভেতর কি ভীষণ প্রতিজ্ঞা শত্র“র পুতে রাখা মাইনের মত পুঁতে রেখেছি।
অনার্স পরীক্ষার পরই খুব আকস্মিকভাবে ছন্দার বিয়ে হয়ে যায়। কোন রকম হৈ চৈ আনন্দ ছাড়াই একটা অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান ছন্দাকে আমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। খবরটা আমি পেয়েছি দশ বার দিন পর। ঘটনার আকস্মিকতার বিমূঢ় ভাবটা কাটিয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমার হাতটা নিসপিস করে ওঠে।অ মনে মনে শপথের মত উচ্চারণ করি, বুলেটের বিনিময়ে ভালবাসা চাই।
প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড়িয়েছি ছন্দাদের বাড়ির গেটের কাছে মাধবীলতার ঝাড়ের সামনে যেখানে ছন্দা আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতো শুধু ওর জন্য। ছন্দা এখন আর আমাকে চায় না। তবুও আমি দাঁড়িয়ে থাকি। কোনদিন কিছুদূর রাস্তার একটা গাছের আড়ালে। কখন দেখেছি ওটা হাসতে হাসতে বেরিয়েছে। ছন্দার মখে আলোর দীপ্তি। বিমান বিধসেী কামান থেকে গোলাগুলো বেরিয়ে লাল হয়ে আকাশে যেমন ছড়িয়ে যায় ছন্দার ঘুশীটা তেমনি। কখনো দেখেছি লোকটাকে একা বেরিয়ে যেতে। আমি কিছু করতে পারিনি। হাতদুটো কোন ট্রিগার খুঁজে পায় না। আমি নিঃশব্দে সরে আসি। বারবার মনে হয় আমি কি হেরে যাচ্ছি? হেরে যাচ্ছি কেন? ছন্দার প্রতি ভালবাসায় না লোকটার প্রতি দয়ায়? না কোনটাই না। যা করব বলে পণ করেছি তা আমার করা চাই। কোন আবেগতাড়িত ছেঁদো কথায় আমি পিছু হটে আসব না। ছন্দাকে আমি ভালবাসি। ছন্দাকে আমি চাই। এর বাইরে আমি আর অন্যকিছু বুঝি না। ছন্দা আর একটি লোককে নিয়ে সুখে সংসার করবে ঐ ভেবে আমি সান্ত্বনা পাব এ ধরনের মধ্যযুগীয় প্রেমে আমার আস্থা নেই। অতএব আমি আবার আমন্যৎ আপন শক্তির বলয়ে ফিরে আসি।
সাতদিনের মাথায় আমি একটা চমৎকার সুযোগ পাই। আমার অসুরিক শক্তিটা নিপুন দৈত্যের মত কাজ করে। মাত্র দুটো গুলিতে লোকটা রাস্তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। লোকজন জড়ো হওয়ার আগে আমি তখন হাওয়া। আমি জানি আমাকে ধরার সাধ্যি কারো নেই। আমি কোন সূত্র রেখে কাজ করি না।
তিনদিন পর আমি ছন্দাদের বাসায় যাই। প্রাণপণ চেষ্টায় মুখের ওপর একটা হাসি হাসি ভাব জাগিয়ে রাখার চেষ্টা করি। কিন্তু সব যেন কেমন এলোমেলো হয়ে যায়। মনে হয় মনের মধ্যে প্রচণ্ড একটা বোমা ফেটেছে। সেই বিশুদ্ধ পরিবেশে আমি কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। মনের সুস্থ অবস্থাতো নয়ই। কোন ভালবাসাও আর নেই।
ছন্দার রুক্ষ এলোমেলো চেহারার সামনে দাঁড়িয়ে আমি একটি পুরোপুরি যুদ্ধক্ষেত্র অবলোকন করি। আমার বুকটা কেঁপে ওঠে। ছন্দার তীব্র বিমর্ষ চাহনীর মধ্য থেকে রাশি রাশি ঘৃণা ঝরে পড়ে। ছন্দা মুখ ঘুরিয়ে চলে যায়। ছন্দা চীৎকার করে কাউকে বলে না যে আমিই ওর স্বামীকে হত্যা করেছি। হঠাৎ একটা বিপুল অপরাধবোধ আমাকে আচছন্ন করে। বারবার মনে হয় ছন্দা কেন চীৎকার করছে না। ছন্দা কেন সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছে না। আমি চাইছি ও বলে দিক সবাইকে। না তা নয়। আসলে ছন্দা বলতে চাইলেও বলতে পারছে না। আমার ভীষণ খুশি লাগছে। মনে হচ্ছে আমি এখন ওকে বলি, ছন্দা হৃদয়ের সব জানালাগুলো বন্ধ করে তুমি এখন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। শুধু আমার জন্য। ছন্দা শুধু আমার জন্য।
ছন্দার বাবা আমাকে বসতে দিয়েছেন। আামরা কেউ কোন কথা বলছি না। সমস্ত বাড়ীটা চুপচাপ। আমি খুব সজাগ হয়ে কানটা খাড়া করে রেখেছি কিছু একটা শুনব বলে। কোথাও কোন শব্দ নেই কেন? এ কেমন মৃতপুরী ? কেউ কি কিছু করতে পারছে না? কেই যদি কিছু করতে না পারে তাহলে চীৎকার করে কাদছে না কেন? আসলে আমি শব্দ চাই। কোলাহল চাই। এমন নি:শব্দ সমাহিতভাব আমার অসহ্য।
অকস্মাৎ পাশের ঘর থেকে কান্নার ধ্বনি ভেসে এলো। প্রথমে আস্তে। তারপর জোরে। আরো জোরে। ছন্দার বাবা মুখটা ঘুরিয়ে চোখ মুছলেন। আমার মনে হোল ছন্দার ঐ কণ্ঠস্বর আমি চিনি না। কোনদিন কখনো ছন্দা আমার সামনে কাঁদেনি।
ফোঁপানীর শব্দ চুপেচুপে আমার মগজে ঢুকছে। আমি পাগলের মত আমার সব অনুভূতিকে বধির করে দিতে চাইছি। পারছি না। ক্ষিপ্ত সাঁওতাল ছেলেটার একগুঁয়ে তীরের মত কান্না ধ্বনি আমার মগজে বিঁধছে। আমার চেতনার তলদেশে একটা হিম ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে।
আমি উপলব্ধি করছি ছন্দার বাবা একদৃষ্টে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। সেই স্নেহপ্রবল বৃদ্ধ ভদ্রলোকের মুখটা আস্তে আস্তে ছোট হতে হতে একটা বিরাট জন্তুর মত হয়ে যাচ্ছে। আমি অস্ফুট আর্তনাদ করে উঠি।
Ñকি হোল আলম? খুব খারাপ লাগছে তোমার? মেয়েটার কেন এমন হোল বলতো।
বৃদ্ধ উঠে আমার কাছে এলেন। আমি বৃদ্ধের মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। ভয় হচ্ছে। বৃদ্ধ যেন ঈশ্বর হয়ে আমার কাছেন কৈফিয়ৎ চাইছেন। আজ আমার শেষ বিচারের দিন। বৃদ্ধ আবার একই কথা আওড়ালেন। স্বগতের মত।
Ñমেয়েটার কেন এমন হোল বলতো? কপাল কি এতই খারাপ ওর?
Ñআমি জানি না। আমি জানি না।
আমি বিড়বিড় করি।
বৃদ্ধ উদাস হয়ে বলেন, জানো ওর জন্মের পর আমার ব্যবসার খুব উন্নতি হয়েছিল। একজন ওর যার জন্মখন আর রাশি গুণে বলেছিল, ও নাকি যার ঘরে যাবে তার ঘর উজ্জ্বল করবে। লক্ষী ভাগ্যবতী মেয়ে আমার ছন্দা।
আমার ভীষণ বলতে ইচ্ছে করল যে ছন্দা যে ঘর উজ্জ্বল করবে তা আমিই তৈরী করে রেখেছি। ভুল জায়গায় পড়লে সে ঘর উজ্জ্বল করা যায় না। কিন্তু আমি বলতে পারলাম না।
বৃদ্ধ উঠে পাশের ঘরে চলে যায়। ছন্দার কান্না থেমে গেছে। আবার সব চুপচাপ। ছোট নির্জন ঘরটা বিরাট জনপদের মত খাঁ খাঁ করছে। অনুভব করি আমার বুকটা কেমন শক্ত হয়ে গেছে। সারা বুকে জুড়ে স্টেনগান ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি পাগলের মত আমার ভালবাসা হাতড়ে বেড়াই। কামালপুরের নির্জন বাংকারে বসে সমগ্র দেশটাকে যেমন বুকের মধ্যে পুরে রাখতাম তেমন করে এখন আর কিছুই পারছি না। এতক্ষণে নিজেকে একটা পুরোপুরি খুনি মনে হচ্ছে।
শুধু ছন্দায় নয়, এখন আমার বুকের বাংকারেও পড়ে আছে একটা লাশ।