শুধু লেখক হওয়ার বাসনায় পত্রিকা জগতে চাকরি করতে আসা ওয়াসিমের। ছাত্রজীবনে যথেষ্ট কৃতিত্ব ও প্রতিশ্রুতিশীলতার পরিচয় দিয়েছে সে। কী করতে চাও তুমি? পরিবারের এই অনিবার্য প্রশ্নের কখনো সঠিক জবাব সে তৈরি করতে পারেনি। কেননা ততদিনে পাঠাভ্যাসের কল্যাণে সে সাহিত্যামোদী। লুকিয়ে লুকিয়ে বিপ্লবের কবিতা পড়ে। মৃদুল স্যার খেয়াল করেন ছাত্রটিকে। মৃদুল স্যার জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। মৃদুল স্যারের কল্যাণে ওয়াসিমের পড়া হয়ে যায় রাদুগা আর প্র্রগতি প্রকাশনীর প্রকাশিত কিছু গল্পের বই। কিছু বুঝেছে আর কিছু বুঝেনি। তার বাবার ‘কী তুমি করতে চাও’ প্রশ্নের জবাবে ততদিনে সে নির্দ্বিধায় বলতে পারল ‘যা কিছু হতে চাই তার মধ্যে সবচাইতে বেশি হতে চাই একজন লেখক।’
ওয়াসিমের বাবা মোজাহার মিয়া গ্রামের ডাক্তার। ছেলের এই ধরনের মতিগতি দেখে কেঁপে উঠেন তিনি। জিজ্ঞেস করেন ছেলেকে, লিখলে কি টাকা আসে?
নিজে সারা জীবন প্রায় আদর্শের কথা শুনালেও বরাবর চাইতেন ছেলে বড় চাকুরে হবে। অবশ্যই আদর্শ ব্যাপারটা খুব গোলমেলে ঠেকে মোজাহার মিয়ার কাছে। চুরি-ডাকাতি করবা না, বাইরে কারো সাথে মারামারি করবা না ইত্যাদি বলতেন তিনি ছেলেকে। সর্বোপরি ‘লেখাপড়া করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’তেই ছিল মোজাহার মিয়ার বিশ্বাস। তিনি ভাবতেন লেখাপড়া একদিন সবকিছু বদলে দিতে পারে। চোখের সামনে অনেক দেখেছেন তিনি। সামান্য এল এম এফ ডাক্তার হয়ে তিনি গ্রামে প্রায় এমবিবিএস ডাক্তারের মতো ক্ষমতা রাখেন। তার বাবা তাকে পড়াতে পারেননি। সেদিনে শিক্ষার চলই ছিল না। সারেমূলে তিনি দেখেন কয়েকটা অসুখের লক্ষণ এবং সেই লক্ষণ দেখে ওষুধ লিখে দেয়া ছাড়া তার আর কোনো বিদ্যা নেই। নিয়ত তার কাছে গ্রামের লোকজন আসা-যাওয়া করে। গ্রামের স্কুল শিক্ষকরা তাকে সন্দেহের চোখে দেখতেন একসময়। সেই সূত্রে তিনি অনেক চিন্তা করে নিয়মিত একটা জেলাওয়ারি খবরের কাগজের গ্রাহক হন। এখন স্কুলের মাস্টাররা তার দোকানের সামনে লম্বা টুল নিয়ে বসে খবরের কাগজ পড়েন। এতে গ্রামবাসীর কাছে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তার একটু নাম হয়েছে। এতেই মোজাহার মিয়া খুশি।
রাতে মোজাহার মিয়া দোকান বন্ধ করে খবরের কাগজটা বগলে ও টর্চটা হাতে নিয়ে বাসায় ফিরেন। এভাবেই পড়ার বাইরে খবরের কাগজগুলো পড়া হয়ে যেত ওয়াসিমের। তবে তার সবচেয়ে ভালো লাগত খবরের কাগজের শুক্রবারের আয়োজন। কয়েকটি কবিতা, ছড়া, কুইজ ও সভ্য সংগ্রহ। সভ্য সংগ্রহের নিয়ম ছিল ‘যে বা যাহারা সভ্য হইতে চাহে, তিনি বা তাহারা কুপনের যেখানে কাছি চিহ্ন রহিয়াছে তথায় কাটিয়া কুপনের শূন্যস্থান পূর্ণ করিয়া পত্রিকার দপ্তরে পাঠাইয়া দিবে। পরবর্তী সভ্য নির্বাচিত হইলে তাহাকে একটা নম্বর প্রদান করা হইবে। এবং তাহার নাম পরবর্তী সভ্যদের সহিত পত্রিকার সভ্যবিভাগে ছাপা হইবে।’
সেই ছিল প্রথম শিহরণ। যখন নম্বর সহযোগে সভ্য হিসেবে ওয়াসিমের নাম পত্রিকার সভ্যবিভাগে ছাপা হলো। মোজাহার মিয়া যখন সেদিন পত্রিকা নিয়ে আসে যেদিন ওয়াসিমের নাম ছাপা হয়েছে সভ্যহিসেবে। সে রাত ওয়াসিম ঘুমাতে পারেনি। বারবার নিজের নামের দিকে তাকিয়ে থেকেছে সে। হাত দিয়ে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে। পত্রিকাটাকে অনেক আপন মনে হলো তার। এবং এর সঙ্গে কিভাবে জড়িত থাকা যায় তা ভাবতে লাগল। শুক্রবারের আয়োজন পড়ে সে নিজেও ছড়া লেখা শুরু করে।
এই পথ ধরেই পত্রিকায় দু-একটা লেখা ছাপানো। তারপর ওয়াসিমের মনে হলো লেখকদের একমাত্র পেশা হলো পত্রিকা মানে সাংবাদিকতা। এর অনেক পর সে বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা আর গণযোগাযোগ বিষয়ে পড়ালেখা করে, যোগদান করে শিক্ষানবিস সাংবাদিক হিসেবে একটা প্রায় অখ্যাত দৈনিক পত্রিকায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন তার বাবার উপদেশ ছিল যেন কোনো প্রকারে লেখাপড়াটা করে বেরিয়ে যায়। যেন রাজনীতি না করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সে প্রথম ধাক্কা খায়। সবকিছুর প্রতি তার সন্দেহের সৃষ্টি হয়। কারণ সে দেখেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকার জন্য ছাত্রদের সিট নেই। অথচ বহিরাগত সরকারদলীয় সন্ত্রাসীদের জন্য ঠিকই সিটের বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। ছাত্রদের মধ্যে সবাই রাজনীতিমুখী। রাজনীতি মানে হরতাল, মিছিল ও হলদখলে ভাড়াটে গু-া হিসেবে কাজ করা। বিনিময়ে বিনা লেখাপড়ায় পাস আর টাকা আসে। এই দুটার জন্যই তো অনেকে পড়তে আসে ফলে অধিকাংশ ছাত্রের কাছে এইটায় একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। যাহোক মাঝে মধ্যে যে সেও মিছিল মিটিং করেনি তা নয়। তবুও নিরীহ গোবেচারা টাইপের ছাত্র হয়ে কোনো প্রকার পাস করে সে আজকের স্বপ্ন পত্রিকায় বিনোদন সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেয়।
সেখানে তাকে করতে হতো সিনেমা নাটকের নায়ক নায়িকা পার্শ্বঅভিনেতাদের কি রঙ পছন্দ, কি খায়, জাতীয় ইন্টারভিউ। সে প্রায়ই তাদের বিজ্ঞের মতো প্রশ্ন করে বসত ‘বই পছন্দ করেন?’ ‘কী ধরনের বই পড়েন।’ ওরা স্বাভাবিকভাবে শোনা দু-একজন জনপ্রিয় লেখকের নাম বলে যেত। তারাও বুঝতে পারত না এসব প্রশ্ন অভিনয় শিল্পীদের জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন কি। কিন্তু পত্রিকার বিনোদন সম্পাদক কখনোই এই প্রশ্নগুলো ছাপত না। এভাবে তার ব্যক্তিত্বের ভেতর সে দেখতে পেল এক আপসহীন মানস। সে পত্রিকাটি ত্যাগ করল।
চুল ঘাড় পর্যন্ত লম্বা গাঁজাখোর কবি সদানন্দ বসুর সাথে ওয়াসিমের অনেক দিনের আলাপ। তারা উভয়েই মূলত শাহবাগ আজিজ মার্কেটে আড্ডা দিত। কথায় কথায় সদানন্দকে বলেছিল ওয়াসিম যে, সে সম্প্রতি পত্রিকার রিপোর্টারের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। সদানন্দ বসু তখন ‘কাঁচাবাজার’ পত্রিকার সাহিত্যপাতার সম্পাদক। সেই সূত্রে সে বলে ফেলে ওয়াসিমকে- সাহিত্যপাতায় কাজ করবা?
ওয়াসিমের আত্মা শুধু সাহিত্য শব্দটা শুনে ছলকে উঠে। বাকিটুকু সে চোখ বন্ধ করে কবুল বলে। ওয়াসিম মনে মনে নিজেকে বেশ গুছিয়ে নেয়। নিরন্তর লেখালেখি চালিয়ে যায়।
কাজ শুরু করার পর থেকে সে উপলব্ধি করে কবি সদানন্দ বসুর কাজকামে কোনো মন নেই। কবিতাও লিখতে পারে না এখন। শুধু ভানটুকুই সম্বল। লম্বাচুল আর প্রকাশ্য গাঁজা খাওয়া। পত্রিকার লেখা বাছাই থেকে শুরু করে কম্পোজে দেয়া, ট্রেসিং থেকে পেস্টিং পর্যন্ত ওয়াসিমকেই দেখতে হয় নিরন্তর। ওয়াসিমের না নেই। কারণ এই কাজটা সে পছন্দ করে। তার মনে হতে লাগল এতদিনে তার আসল কাজ সে পেয়ে গেছে। ওয়াসিমের তত্ত্বাবধানে প্রথম সাহিত্যপাতাটা প্রকাশিত হওয়ার পর তার ওপর চরমভাবে বিগড়ে যায় কবি সদানন্দ বসু। শুধু রাগ দেখায় কিছু কয় না। ওয়াসিম বুঝতে পারে না গলদ কোথায়।
দাদা কি হয়েছে? কোনো ভুল করেছি আমি?
‘ভুল! আবার জিগাও ভুল করছ কিনা? তুমি এতদিনের তিলতিল করে গড়ে তোলা ইমেজের ওপর একটা কালো চোপ মাইরা দিছ মিয়া। সদানন্দ প্রত্যেক কথার শেষে ‘মিয়া’ শব্দটা ব্যবহার করে।’
‘কেন আমি তো পুরা বক্স ঘেঁটে ঘেঁটে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ কবিতাগুলো ছেপেছি।’
‘আরে সেটাই তো ভুল করেছো মিয়া। এ লাইনে আইছো তো নয়া। বুঝ বা। আরও কয়দিন যাক। আমারেই ফ্যাসাদে ফেললা আর কি।’
অচিরেই ওয়াসিম বুঝতে পারল ব্যাপারটা। বাংলাদেশে প্রত্যেক বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য সম্পাদকদের নিজস্ব একটা বলয় আছে। এরা অন্য বলয়ের লেখকদের লেখা ছাপে না। সদানন্দকে যারা লেখক হিসেবে গুরুত্ব দেয় না তাদের লেখা সে কস্মিনকালেও ছাপে না। পারতপক্ষে তাদের নামও সে উচ্চারণ করে না। এমনকি তার সামনে তাদের নাম উচ্চারণ করাও যায় না। ওয়াসিম একদিন বলছিল কবি মাহফুজ ইমরানের কথা। মাহফুজ ইমরান দৈনিকে লেখে না বললেই চলে। কোথাও ছাপে না। তা হলেও কেউ মাহফুজকে কবি হিসেবে ফেলে দিতে পারবে না। কিন্তু সদানন্দ বলেই ফেলল ও একটা কবি নাকি মিয়া। সুটেট বুটেট। মদ খায় না, গাঁজা খায় না, বেশ্যাপাড়ায় যায় না। চব্বিশ ঘন্টা গাল কামানো। মদ-গাঁজা আর বেশ্যাপাড়ার সাথে কবিতার যোগ কোথায় ওয়াসিম বুঝতে পারে না। সে নিজেও এসব জায়গায় যায় না। তবুও সে লিখতে পারে। ওয়াসিম বুঝতে পারে সদানন্দ শুধু কোনো একটা সাহিত্যিক গোষ্ঠীর ধারণা নিয়ে বেঁচে থাকা ‘হতে চেয়েছিলাম লেখক।’ তবুও ক্ষমতার বলে কোথাও কবিতা পড়ার জন্য দাওয়াত পায় সদানন্দরাই। যে প্রক্রিয়ায় সদানন্দর পাতায় লেখাগুলো ছাপা হয় তাতে শান্তি পায় না ওয়াসিম। তার মন খচখচ করতে থাকে। বিভিন্নভাবে সদানন্দকে যারা তোয়াজ করে। সদানন্দ যাদের কাছে সুবিধা আদায় করতে পারে। যেমন এক আমলা কবি সোহান মাহবুব। যে প্রতি বৃহস্পতিবার সদানন্দকে মদ খাওয়ায় সাকুরায়। তার কবিতা প্রতি সংখ্যায় ফলাও করে ছাপা হয়। যদিও তাতে কবিতা কিছুই খুঁজে পায় না ওয়াসিম। আরেকজন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্যের ইতিহাস পড়ায় মুহাম্মদ মইনুল ইসলাম। তিনি যা লিখেন তা আর যাই হোক না কেন কবিতা হয় বলে মনে হয় না ওয়াসিমের। সদানন্দ এর কবিতা ছাপে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক তার যোগাযোগের জন্য। সদানন্দ নিজে লেখাপড়া না করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের সাথে তার খাতির আছে সে রকম একটা অহমিকায় ভোগে। ভাবটা এমন যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িনি তো কি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাই আমার বন্ধু। ওয়াসিম বুঝতে পারে অসম্ভব হিসাব করে তার সাহিত্যিক ক্যারিয়ার গড়তে গিয়ে সদানন্দ আত্মহত্যা করেছে। ঢাকঢোল বাজানো ছাড়া সদানন্দর আত্মা এখন সম্পূর্ণ শুকিয়ে গেছে। সদানন্দ জেনে গেছে তার আর কিছুই দেওয়ার নেই। ফলে এখন সাহিত্যের রাজনীতিই তার একমাত্র আশ্রয়। অর্থাৎ সে যা লিখেছে তাকে সর্বৈসর্বা প্রমাণ করা।
সম্পাদনার ক্ষেত্রে ওয়াসিমের কোনো বাছাইয়ের স্বাধীনতা রইল না। মূলত হাজার পাঁচেক টাকার জন্য সে অনেকটা লেবারের মতো খাটে। সদানন্দ তেমন একটা অফিসেও আসে না। কবিতাগুলো নিয়ে ওয়াসিম চলে যায় সদানন্দের বাসায়। সদানন্দ কবিতাগুলো বেছে দিলে সেগুলো নিয়ে কম্পোজে দেয়া, প্রুফে দেয়া ইত্যাদি। এ রকমই একদিন ওয়াসিম সাহিত্যপাতার কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছে। ট্রেসিং বের করছে। সে সময় পত্রিকাটির সম্পাদক হাসিবুদ্দিন খান তাকে সম্পাদকের দপ্তরে ডেকে পাঠায়।
ওয়াসিম সম্পাদকের রুমে ঢুকে সালাম দেয়। সম্পাদক তাকে বসতেও বলে না। শুধু একটা কাগজ তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন। ‘এটা এই সংখ্যায় ধরাও।’
ওয়াসিম কাগজটা হাতে নিয়ে দেখে কবিতার মতোই। সে পড়ে দেখল। তাতে কবিতা না¤œী কোনো বস্তু নেই।
সে বলল ‘কিন্তু এ সংখ্যার কাজ তো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে ভাইয়া। এখন শুধু পেস্টিং বাকি।’
সম্পাদক একবার তার দিকে তাকাল রাগী চোখে। ‘সংখ্যার কাজ শেষ মানে তুমি কি বুঝাচ্ছো। প্রেসে যাওয়ার আগ পর্যন্ত লেখা বদলানো যায়।’
ওয়াসিম মূলত লেখাটার গুরুত্বহীনতার জন্যই বাদ সাধছিল। সম্পাদক সেটা বুঝে বলেন। ‘লেখা যাহোক উনি আমাদের অনেক বড় পার্টি। সরকারি কর্মকর্তা। অন্য একটা লেখা বাদ দিয়ে দ্রুত লেখাটা ছাপানোর ব্যবস্থা কর। আর কিছু একটা বললে আপত্তি করবা না। পত্রিকা আমাদেরই চালাতে হয়। বুঝেছ? সাহিত্য চর্চা করার জন্য পত্রিকা খুলে বসিনি বুঝেছ।’
ওয়াসিমের একটা চোখ যেন সেদিন খুলে দিয়েছিলেন সম্পাদক সাহেব। সম্পাদকের এই সত্য কথাটা সে এতদিন বুঝতে পারেনি। দৈনিক পত্রিকা আসলে সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে না। তার কাজ যেনতেন প্রকারে পৃষ্ঠা ভরানো। অথচ মফস্বলে থাকাকালে সে ভাবত এই বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোই সাহিত্য প্রসারে কাজ করে।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাকে অন্য একজনের কবিতা বাদ দিয়ে সেই আমলার কবিতা ধরাতে হয়। পাতা প্রকাশিত হলে সদানন্দ তাকে ফোন দেয় ‘কি মিয়া তুমি আবার কার একটা লেখা হান্দাইছো।’
ওয়াসিম তাকে খুলে বলে। সদানন্দ চুপ মাইরা যায়। সম্পাদকের ওপর কথা বলার ক্ষমতা তো সদানন্দেরও নেই। কবি সদানন্দের সাথে দুই বছর কাজ করেও গাঁজা খাওয়া ছাড়া ওয়াসিম কিছুই শিখতে পারেনি। সদানন্দের মতে ‘তোমারে দিয়া গাঁজা খাওয়াও হইব না মিয়া।’
লেখাপত্র সংগ্রহ করতে গিয়া প্রায় লেখকের সাথে ওয়াসিমের যোগাযোগ হয়। ওয়াসিমের মনে হয় বাংলাদেশে কোনো প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির লেখক বা কবি নেই। সাহিত্য মানে যদি হয় হিতের সহিত, তাহলে বাংলাদেশি সাহিত্যের অন্য কোনো নাম হওয়া উচিত। কৃমিত্য অথবা কেঁচোত্য এই ধরনের কোনো নাম হতে পারে। এদের সংজ্ঞা হতে পারে কৃমির সহিত ও কেঁচোর সহিত।
সাহিত্য পাতায় কাজ করতে করতে অন্যান্য পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের সাথে ক্রমে পরিচিত হতে থাকে ওয়াসিমের। আখেরি নিশান পত্রিকার সাহিত্য পাতার সম্পাদক ওমর খোরশেদের সাথে তার পরিচয় হয়। ওমর খোরশেদ নিজেও কবিতা লেখার চেষ্টা করে। তাকে আগে থেকেই চিনত সে। পত্রিকায় তার প্রচুর লেখা ছাপা হয়। এই লেখাগুলো কেন ছাপা হতো সে বুঝতে পারত না। এখন বুঝে। জাফর খোরশেদই আগ বাড়িয়ে তার সাথে আলাপ জমায়। ‘আপনি নাকি কাঁচাবাজার পত্রিকায় জয়েন্ট করছেন? কই আমাদের কাছে তো লেখা চাইলেন না। সদানন্দ দা কিন্তু আমাদের লোক।’
সদানন্দ যে আসলে কার লোক সেটা এখনো বুঝতে পারে না ওয়াসিম। ‘না অবশ্যই চাইব। লেখা দিবেন। পত্রিকা তো আপনাদের লেখা ছাপানোর জন্য।’
‘একদিন আমার অফিসে আইস।’ বলে সেদিন বিদায় নিয়েছিল ওমর খোরশেদ। খোরশেদকে দেখে কেন জানি ওয়াসিমের ঢেঙ্গা বাঁশের মতো মনে হয়। কথা বলার চাইতে হাসে বেশি। যখন হাসে তখন ওয়াসিমের হাতে কাঁধে হাত দিচ্ছিল। অনেকটা শরীরটাকে দোলায় হাসার সময়।
ওমর খোরশেদ বিদায় নিতেই তরুণ কবি সরহদ খানের সাথে দেখা হয়ে যায়। সরহদও জাহাঙ্গীরনগর ইউনিভার্সিটি থেকে পাস করেছে। ফলে ওয়াসিমের খুব কাছাকাছি। দেখা হতেই ওয়াসিমকে সরহদ বলে ‘হিজড়াটার সাথে কি কইলিরে।’ ওয়াসিম অবাক হয় ‘হিজড়া?’
‘হ অইডা তো হিজড়াই। সমকামি বুঝলি। পেসিব পেসিব। এর জন্যই তো আখেরি নিশানে চাকরি পাইল। আখেরি নিশানের সম্পাদক ফরিয়াদ রহমান আবার অ্যাকটিভ। অই পত্রিকায় যারাই জয়েন করে অটোমেটিকলি হিজড়া হয়ে যায় বুঝলি। পুরুষ হইলে মেইল হরমোন কমে যায় আর ফিমেইল হরমোন বাড়ে আর মাইয়া হইলে উল্টা। অই পত্রিকায় যে গুলা চাকরি করে... দেখবি আস্তে আস্তে পরিচয় হইব। এদের সবার চুল একই রকম আচড়ায়। সবাই কথা বলার সময় যার সাথে কথা বলে তার গায়ের বিভিন্ন জায়গায় হাতরায়।’ কথাগুলো বলতে বলতে দুজনই হাসছিল।
তুই বাদরামি করস? ওয়াসিম বলে। দেখবি আস্তে।
এই পত্রিকাটা খুব নাম করেছে দেশে সম্প্রতি। এই পত্রিকার বিক্রি বেশি যার কারণে প্রচারও বেশি তাই সবাই মানে যারা জনপ্রিয় ধারায় লিখতে চায় এখানে লিখতে চায়। যেন তার প্রচার বেশি হয়।
কবি হিসেবে সিরিয়াস টাইপের হলেও ওয়াসিমের ভেতরও নিজের অজান্তেই প্রায় একটু প্রচার পাওয়ার আকাক্সক্ষা আছে। হয়ত মানুষ নামের প্রাণীর ভেতরের বৈশিষ্ট্য এটি। একদিন কি মনে করে যেন ঘুরতে ঘুরতে ওয়াসিম যায় আখেরি নিশান অফিসে। পুরা অফিসটা কাচে ঘেরা। যেন একটা কাচের বৈয়াম। কাচ আর এয়ারকন্ডিশন মিলে একটা অদ্ভুত শীতলতা। সারা দালানজুড়ে এয়ার ফ্রেশনারের মৌ মৌ গন্ধ। প্রতিটি সিঁড়ির পাশেই একজন দারোয়ান দাঁড়ানো। হাতে বন্দুক। এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করে ‘কাকে চান?’
‘ওমর খোরশেদ কোথায় বসেন? ওয়াসিম জানতে চায়।’ লিফটে চার। চারতলায় ওঠে গ্লাস খুলে দাঁড়াতেই রিসিপশনে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। সে বলে আমি ওমর খোরশেদের কাছে এসেছি। একটু প্লিজ বলে মেয়েটি ফোন তুলে কথা বলতে থাকে। ওয়াসিম শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ, কাচ, এয়ার ফ্রেশনারের মৌ মৌ, রিসিপশনের ভেলভেটের সোফা, রিসিপশনিস্ট ইত্যাদির ভেতর বসে কেমন যেন যৌনতাড়িত হয়। আবার তার ভেতর এক ধরনের অপরাধবোধও কাজ করে। কেন যেন ওয়াসিম সবসময় এই ধরনের পরিবেশে আতঙ্কবোধ করে প্রায় নিজের অজান্তে সে বলতে পারে না।
তাদের পত্রিকার অফিসটা একেবারেই যেমনতেমন। সাধারণ। সবকিছু খোলামেলা। দাঁড়ালেই সব ডেস্ক চোখে পড়ে। একজন আরেকজনকে নিজের ডেস্ক থেকেই ডাক মারে। অমুক ভাই... তমুক ভাই...। কেমন যেন একটা বাড়ি বাড়ি পরিবেশ। ওয়াসিম সহজ হতে পারে। কিন্তু প্রথম নিশানের মতো অফিসগুলোতে আসলে তার আতঙ্ক আর যৌনানুভূতি মিলে একটা মিশ্র জটিল অনুভূতি হয়। অনেকক্ষণ পর ওয়াসিমকে রিসিপশনিস্ট মেয়েটা ভিতরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই একটা কাচের দরজায় লেখা দেখতে পায় ওয়াসিম। ‘আখেরি নিশান’-এর অফিস। অন্য নিশান এই পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী। সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে যায়।
‘আরে আসেন আসেন ভবিষ্যৎ সাহিত্য সম্পাদক’ বলে ওমর খোরশেদ দাঁড়িয়ে তার হাত ধরে ঝাকাতে থাকে। ঘরের ভেতর আরো দুইজন বসে আছে। দুইজনই আমলা কবি। ওমর খোরশেদ সবাইকে তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়।
‘এ হচ্ছে ওয়াসিম। তরুণ কবি ও কাঁচাবাজার পত্রিকার সাহিত্যপাতার সহ-সম্পাদক। আর এরা তো স্বনামধন্য কবি। যাদের এখন আর পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না হাসান বশরী চৌধুরী আর সরকার আসকার ইবনে মাহতাব।’ একজন আমলা ও একজন অধ্যাপক।
কবিদ্বয় তার অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ বায়োডাটা সব জানতে চায় একত্রে। সে এড়িয়ে গেল। সংক্ষেপে সে এতটুকু বলল যে, আমি নিজের কথা বলতে পছন্দ করি না। ওরা অবাক হয়। একজন বলে আরে একেবারে মৌলিক কবিদের মতো কথা। ওমর খোরশেদ বলে দেখতে হবে না কার সাগরিদ। ওয়াসিমের মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। মনে মনে শালা বলে গালি দেয় খোরশেদকে। কারণ সে কখনোই সদানন্দের সাগরেদ মনে করে না নিজেকে। সদানন্দকে সে এখন করুণা করে।
এদের বহুদিন ধরে কি কবিতা পড়বে সেটা বলছিলাম। ওয়াসিম অবাক হয় জাফর খোরশেদের এই মিথ্যাচারে। সাহিত্য পাতার সম্পাদক হতে পারলে সব শালাই গুরুর ভান ধরে মনে মনে ওয়াসিম বলে। অইদিন ওয়াসিম কিছু বলেনি, বলতেও পারেনি শুধু ওদের কথাবার্তা শুনেছে। সারাক্ষণ তাদের নিজেদের গুণগান গাইতেছিল তারা। তাদের নিজের কবিতা কত ভালো সে বিষয়ে নিজের লেখার উদ্ধৃতি দিয়ে তারা আহা উহু ইত্যাদি ধরনের চিৎকার করতে থাকে। ওয়াসিম একটা জাতির সাহিত্য সম্পর্কেই হতাশ হয়ে যায়। এদের স্রেফ কীটপতঙ্গ বলে মনে হয় তার কাছে। কিলবিল করা সাপের বাচ্চার কথা মনে পড়ে তার।
এদের সবার লেখাই সে পড়ে দেখেছে। এমন একটা লেখাও নেই যা তাকে টানতে পারে। এদের লেখার ভেতর সে কোনো কবিতার দেখা পায়নি। এদের লেখাগুলো কেন লেখা হয়েছে, এত কাগজ ব্যয় করে কেন এই বইগুলো ছাপানো হয়েছে তা সে বুঝতে পারে না। সে ধারণা করেছে এক ধরনের স্বমেহন থেকে এই লেখাগুলো বা বইগুলো তৈরি হয়েছে।
কবিদ্বয় সংক্ষেপে সংকেতের মাধ্যমে ‘সাকুরা’ পিকক জাতীয় কিছু শব্দ উচ্চারণ করছিল। ওয়াসিম একসময় বিরক্ত হয়ে উঠে ভেতরে ভেতরে। সে উঠে দাঁড়ায়। চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। জাফর তার হাত ধরে আবার বসায়। ‘বসেন কথা আছে। এতদিন পর এলেন।’
একসময় আত্মরতিকম্পিত কবিদ্বয় চলে যায়। চেয়ার টেনে জাফর ওয়াসিমের সামনে এসে বসে। ওমর বলতে শুরু করে ‘বুঝলেন না ছাগল কবি আর কি। চাকরির খাতিরে সবার সঙ্গে কথা বলতে হয়। তাই কথা বলা। এগুলার কবিতা কিছু হয়? আমাদের পত্রিকায় বিজ্ঞাপন পাইয়ে দেয়। প্রকাশক আর সম্পাদকের সঙ্গে খাতির তাই হেসে কথা বলতে হয়।’
এ আর নতুন কি? ওয়াসিম জানে এসব তার এ অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যে হয়ে গেছে।
যাহোক আসি বলে ওয়াসিম উঠে দাঁড়ায়। ‘দাঁড়ান দাঁড়ান’ বলে ওমর তার টেবিলের দিকে যায়। ড্রয়ার খুলে তিন-চারটা কবিতা বার করে। ওয়াসিমের দিকে বাড়িয়ে দেয়। গুচ্ছ হিসেবে ছাপাই দিয়েন। আর আপনার কবিতা দিয়ে যান। আমরা আমরাই বুজলা। অন্যের কথা চিন্তা করে লাভ নেই।’
ওয়াসিম হাত বাড়িয়ে কবিতাগুলো নেয়। তার ব্যাগে রাখে। ‘আজকে আমি কবিতা নিয়ে আসিনি। অন্য একদিন দিয়ে যাব। অথবা আপনার মেইলে পাঠিয়ে দেব।’
ওয়াসিম বেরিয়ে আসার জন্য পা বাড়ায়। ওমর হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ায় কিন্তু হ্যান্ডশেক না করে তার কাঁধে হাত রাখে। হাতটা আবার মোলায়েমভাবে তার বুকের ওপর থেকে নিচের দিকে নামিয়ে আনে। ওয়াসিমের মেরুদ-ে শিরশির করে উঠে। ওমরের হাতের স্পর্শে কি যেন আছে।
শুক্রবারে সাহিত্যপাতা প্রকাশিত হয়। অন্যান্য দিন তেমন একটা কাজ থাকে না। লেখাগুলো আস্তে আস্তে আসে। দু-একটা গুরুত্বপূর্ণ লেখা চেয়ে আনতে হয়। ফোন দিতে হয়। এবার পাতা প্রকাশ হওয়ার পর দুইদিন ছুটি কাটায় ওয়াসিম। কিন্তু ছুটি চেয়ে প্রথমে সে আরেক বিপদে পড়ে যায়। সে সদানন্দকে জানায় যে, তার দুইদিন ছুটি দরকার। সদানন্দ বিরক্ত হয়ে বলে ‘অইসব ছুটিফুটি মিয়া আমারে জিগাইও না। আমি এসবের কি বাল জানি।’
‘তাইলে কারে জিগামু’ বলে ওয়াসিম। ‘দেখ ছুটি কে দেয়।’ বলে কথা শেষ করে সদানন্দ। ওয়াসিম খোঁজ করে এডমিনের মনির ভাইকে বলে তার ছুটি দরকার। মনির অনেক কথা শোনায় ‘এক বছর আগে তো কাউকে ছুটি দেয়া হয় না।’ বালের চাকরি মনে মনে গোজ গোজ করতে থাকে ওয়াসিম। ছুটি না পেলেও ওয়াসিম ইচ্ছামতো ঘুরতে পারে। দুপুর ১২টার দিকেই সে অফিসে যায়। খুব তাড়াতাড়ি লেখা কালেকশনে যাচ্ছে বলে সে অফিস থেকে বেরিয়ে যায়। কারণ লেখা সংগ্রহই তো মূলত তার কাজ।
এ কয়দিনে সহকারী সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ওয়াসিমের অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো নয়। সৎ লেখক হতে চাওয়া একজন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে খুবই বেমানান। কারণ যারতার কাছে মানে যাদের কবিতা নামের কারণে চলে আদতেই কোনো ভালো লেখক নয়, সে রকম লেখকের কাছে তাকে লেখা চাইতে হয়। এটা তার চাকরি। সে দেখেছে ঢাকা শহরে যেসব কবির কবি হিসেবে নামডাক আছে সে শুধু কবিতার যোগ্যতার কারণে নয়। কবি কি চাকরি করে বা কতবড় চাকরি করে এবং সে কত সিন্ডিকেটবাজি করতে পারে তার ওপরেই নির্ভরশীল। আরেকদিন সদানন্দ বসু তাকে বলে, ‘সরকার আসকার ইবনে মাহতাবের নাম শুনছো না?’
তার মনে পড়ে এই আমলা কবির সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল আখেরি নিশানের সাহিত্য সম্পাদক ওমর খোরশেদের অফিসে। সে বলে চিনি।
‘ওরে একটা ফোন দিও, কিছু লেখা দেবে, আমার লগে কথা হইছে।’
সদানন্দর কাছে নাম্বার নিয়া ফোন দেয় ওয়াসিম। নিজের পরিচয় দেওয়ার পর মাহতাব তাকে ফোনে বলে, ‘তুমি আগামীকাল সন্ধ্যায় পিককে চইলা আসো।’
পরের দিন সন্ধ্যায় ফোন দেয় না ওয়াসিম। মাহতাবই ফোন দেয়। ‘তুমি কোথায়?’ ‘শাহবাগে’ বলে ওয়াসিম।
‘সোজা পিককে চইলা আসো’ বলে মাহতাব।
পিককে ঢোকার পর প্রথমে ¤্রয়িমান নীল আলোর মধ্যে ঠাহর করতে পারে না ওয়াসিম। কিন্তু ওয়াসিমকে চিনে ডাক দেয় মাহতাব। আসো আসো এই যে এইদিকে ।
আরো দুইজনসহ মোট তিনজন আগেই বসে পড়েছে একটা চেয়ার খালি সেইটা ওয়াসিমের জন্য রাখা হয়েছে। ওয়াসিম বসে জিরোয়। একটু পরেই মাহতাব বলতে থাকে ‘মদ খাওতো?’
‘অল্প, চলে
টেবিলটায় চার-পাঁচটা কাচের গ্লাস, একটা ঠা-া পানির দুই লিটারি বোতল, একটা বড় সাইজের প্লেটে কাঁচা পেঁপে, আরেকটা প্লেটে ছোলাভাজা। প্রত্যেক প্লেটেই অনেক চামচ দেয়া।
‘এই যে পরিচয় করিয়ে দিই’ বসে থাকা দুইজনের দিকে তাকিয়ে বলে মাহতাব। ‘ইনি হচ্ছেন কাঁচাবাজার পত্রিকার সহকারী সাহিত্য সম্পাদক ওয়াসিম, সদানন্দদার সহকারী হিসেবে জয়েন করেছে আর কি, আর এনারা হচ্ছেন ইনি ‘চিনেজোঁক’ লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক সোহান হাসান, আর ইনি একজন তরুণ প্রাবন্ধিক আনোয়ার ফারুক। সম্প্রতি কবিদের উপর প্রবন্ধ লিখছেন।’ দুইজনই হাত বাড়িয়ে দেয় ওয়াসিমের দিকে। হ্যান্ডশেক করে।
সোহান হাসান শুরু করে ‘গত চার দশকে সদানন্দ বসু আর মাহতাব ভাইয়ের মতো কবি বাংলাসাহিত্যে আসেনি। এ রকম মারভেলাস কবি...। সোহানের কথা শেষ হয় না ওয়াসিমের প্রস্রাব আসে। সে বলে ‘একটু মুইতা আসি।’ সোহান খানিকটা অবাক ও অবিশ্বাসের চোখে তাকায় ওয়াসিমের দিকে। ‘যাও যাও অই পাশে’ বইলা মাহতাব দেখিয়ে দেয় টয়লেট। ওয়াসিম মুইতা আসতে আসতে টেবিলে তার গ্লাসে ভোদকা ঢালা হয়। একচুমুকে গ্লাসটা খালি করে সে। সোহান আর আনোয়ার দুইজনই ওয়াসিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়। কারণ তাদের কাছে এটা একটা সুযোগ ওয়াসিমের সঙ্গে যদি সম্পর্ক ভালো করতে পারে তাহলে প্রতি সংখ্যায় তাদের লেখা ছাপতে পারবে। সেই চেষ্টাই করতেছিল দুইজন।
‘যাহোক তুমি কি গতবারের দখলি জমি পত্রিকার সাহিত্যপাতাটা দেখছিলা’ মাহতাব জিগায়। ‘হ দেখছি’ বলে ওয়াসিম। একজন সাহিত্য সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করার কারণে প্রায় সব পত্রিকার সাহিত্য পাতাই দেখতে হয় ওয়াসিমকে। দেখে সদানন্দকে বলতে হয়।
‘ওখানে আমার কবিতা নিয়া আনোয়ারের একটা গদ্য ছিল, আশা করি তোমার চোখে পড়ছে।’ বলে মাহতাব।
ওয়াসিম দেখে ঠিকই। প্রায় সাথে সাথেই ভুলে যায়। কারণ এসব তোয়াজ তোষণে ভরা লেখাগুলাকে ঠিক সাহিত্য হিসেবে মূল্য দেয় না সে। কারণ তার স্বতন্ত্র ধারণা তৈরি হয়েছে সাহিত্য সম্পর্কে। আর এই ধরনের প্রশ্ন তাকে বিব্রত করে। কেন আমাকে দেখতে হবে আপনার কবিতা নিয়ে লেখা এই ভাড়ামি। কিন্তু সে বলতে পারে না। চুপ করে থাকে।
‘ওটা লিখছিলাম মাহতাব ভাইয়ের জন্মদিন উপলক্ষে’ দাঁতগুলা বের করে হাসে আনোয়ার। আনোয়ার খুব স্মার্ট হতে চেষ্টা করে। সে বলে ‘যত কবি লেখকের জন্ম মৃত্যুদিন আছে সবই আমার কাছে লেখা আছে। আপনি চাইলে যে কারো উপরে লেখা দিতে পারি আমি। দেখেন আমরা সবাই তরুণ। আমাদের পরস্পরের বিকাশে আমাদেরই সহযোগিতা করতে হবে।’
দ্বিতীয় পেগটা গলায় ঢেলে ওয়াসিম বলে ‘হ ঠিক।’
লিটলম্যাগের সম্পাদক কবি সোহানের তেলমারা দেখে ওয়াসিম প্রস্রাব করে আসার পর থেকে সোহান হাসান নীরব হয়ে আছে। কোনো কথা বলছে না। আসলেই প্রস্রাব ধরেছিল ওয়াসিমের। তবে সোহানের নির্জলা মিথ্যা তেলমারাকে উপহাস করার জন্যই ঠিক সেই সময়ে সে প্রস্রাবের কথাটা বলেছিল। সেটা সোহান বুঝতে পেরেছে। আর সেই থেকে সে চুপ মেরে যায়। কোনো সিনিয়র কবি মদ খাওয়ালে তার চারদিকে জুনিয়র চাটুকারদের দেখতে অভ্যস্ত তরুণ কবিরাও ধীরে ধীরে সব কিছু মেনে নিতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু সেটার মাঝখানে যে ওয়াসিম এই রকম প্রতিক্রিয়া দেখাবে সেটা সোহান বুঝতে পারেনি। সোহান সুযোগ খুঁজতেছিল তার এই অপমানের মোক্ষম জবাব দেওয়ার।
ওয়াসিম এই শ্রেণিটা সম্পর্কে সচেতন। সাম্প্রতিক তরুণ কবি সাহিত্যিকদের মধ্যে কোনো রকমের নৈতিকতার বালাই নেই। সেটা সে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা দিয়েই বিচার করে। সে ভাবে আগে খেয়েপরে বেঁচে থাকা দরকার। বেঁচে না থাকলে একজন মানুষের আসলে সবই তো অর্থহীন। আর তো কিছুরই অর্থ নেই। বেশিরভাগ তরুণ মফস্বল থেকে কবিতা বা গল্পের প্রথম বই অথবা কিছু কবিতা গল্প সম্বল করে ঢাকায় আসে। ঢাকায় থাকার যে জঙ্গনামা এটাই তাকে স্টাবলিশ সিনিয়রদের চাটুকারে পরিণত করে। আর তরুণদের এই অসহায় অবস্থা দেখে হতে চেয়েছিলাম কবি সিনিয়ররা ওদেরকে দিয়ে যাতা করিয়ে নিচ্ছে। আবুল হাশেম সাহাবুদ্দিন নামের এক কবির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল ওয়াসিমের সঙ্গে। মিডিয়ায় বিশাল দাপট। সে মূলত ছড়াকার। তার ছড়াগুলোকে কেউ কবিতা বলে প্রবন্ধ ফাদলে তিনি তাকে চাকরির ব্যবস্থা করেন। আবুল হাশেমের অনুসারীদের মধ্যে জব্বর হক নামের এক উদ্ভট লেখকের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। জব্বর হক ওয়াসিমকে একটা প্রবন্ধের বই পড়তে দিয়েছিল। কবিতা বিষয়ক বইটির নাম ‘আমি সবার গোষ্ঠী কিলাই।’ নামের উদ্ভটত্ব দেখে তার ভালোই লেগেছিল। কিন্তু ভেতরে ঢোকার পর তার বমি আসে। সব প্রবন্ধতেই সক্রেটিস তলস্তয় বোদলেয়ার র্যাবোর উদ্ধৃতি দিয়ে জব্বর হক প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন আবুল হাশেম সাহাবুদ্দিন কত বড় কবি। আবুল হাশেম যেখানেই জয়েন করেন সেখানেই জব্বর হকের চাকরি হয়।
সোহান হাসান আর আনোয়ার এসবে দক্ষ হয়ে গেছে রীতিমতো। একটা চ্যানেল ম্যান্টেইন করা ছাড়া তাদের আর কোনো উপায় নেই। দিনের পর দিন এই সব করতে করতে তাদের আর মনেই পড়ে না। লেখালেখি কবিতা, গল্প বা উপন্যাস এটা শুধু রচনা নয়। এটার সঙ্গে নীতি-নৈতিকতা-দর্শন ইত্যাদি জড়িত। ওরা সিস্টেমের কাছে বলা যায় নিজেদের হারিয়ে ফেলেছে। আনোয়ার ও সোহান ওয়াসিমকে মূলত শিকার মনে করেছিল। কিন্তু এটার ভিন্ন প্রতিক্রিয়ার হওয়াতে খানিকটা দম নিচ্ছে। ওয়াসিমের খারাপও লাগছিল যে শাহবাগে আসলেই তো এদের সঙ্গেই দেখা হবে। ওয়াসিম জানে স্বার্থ সবসময় প্রতিক্রিয়াশীল। ওরাই আবার ঘুরে দাঁড়াবে, বাজারে কথা রটাবে ওয়াসিমের বিরুদ্ধে।
সিনিয়র কবি মাহতাব অনেক প্যাগ নিজের জন্য সাজিয়ে বসে আছে। একপর্যায়ে সে মাতাল হয়ে নিজের গুণগান গাইতে শুরু করে। সে আর কারো কথাই শুনতে রাজি নয়। ওয়াসিমের বমি বমি লাগে। মাহতাব অন্যদের চাইতে বংশমর্যাদায় কত বড় এবং তার শৌখিন লাইফস্টাইল নিয়েই বলছিল বেশি। ওয়াসিম মনে মনে ভাবে, শালা একটা নির্বোধ প্রাণী মাত্র।
আনোয়ার কথাটা বলার পর থেকে ওয়াসিমের ভেতর একটা প্রশ্ন জাগছে। প্রশ্নটা সে করেই ফেললো, এই যে আপনি বললেন সবার জন্ম-মৃত্যুদিবস আপনার কাছে লেখা আছে। কারো মরণের স্মৃতি কথা আর কারো জন্মদিনের গৌরব গাঁথা। এগুলো কি ঠিক লেখা মনে হয় আপনার? এগুলো তো এক ধরনের ফাইফরমায়েশ। এগুলো তো ঠিক ক্রিয়েটিভ লেখকসুলভ কাজ নয়। না আমি বলছি না, এগুলোর দরকার নেই।
মাহতাব টাল হয়েছিল। সে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে, বালের লেখক। আমরা সবাই বালের লেখক। ও একটা বাসটার্ড স্মৃতিকথার লেখক। কেউ মরলে শালা স্মৃতিকথা লিখতে বসে যায়। আনোয়ার হঠাৎ করে গম্ভীর হয়ে যায়। এরপর সোহান হাসান বলে উঠে, কাউকে এভাবে অপমান করা উচিত নয়। সারা জীবন লিটলম্যাগ করে আসছি। আমাদের একটা ব্যাকগ্রাউন্ড আছে।
আচ্ছা ঠিক আছে আপনাদের ব্যাকগ্রাউন্ড নেই সেই কথা কিন্তু আমি বলিনি। কিন্তু কথা হচ্ছে লিটলম্যাগ কাকে বলব। কেবল কি আকারে ছোট বলে? না লিটলম্যাগ বা ছোটকাগজের একটা সাহিত্যিক আন্দোলন যে দুনিয়াব্যাপী গড়ে উঠেছে। সমস্ত সেন্সর সিস্টেমকে অকেজো করে দিয়েছে সেটা। বলতে লাগলো ওয়াসিম।
এই ইতিহাস আমার জানা ও পড়া বলে উঠলো সোহান হাসান।
না ইতিহাস পড়াশোনার ব্যাপার নয়। পারসোনালি আপনাকে যদি আমি জিজ্ঞেস করি যে, আপনি লিটলম্যাগকে কি মনে করেন আসলে। যেহেতু আপনি নিজেকে একজন লিটলম্যাগকর্মী পরিচয় দিতেই পছন্দ করছেন।
এসব না শুনেই সোহান হাসান বলে চলে আমার পত্রিকায় এদেশে সেরা সেরা লেখকরা নিয়মিত লেখে। আমি আজেবাজে লেখা ছাপি না।
আপনি আমার কথা এড়িয়ে যাইতেছেন সোহান ভাই। তাহলে তর্ক করে তো কোনো লাভ নেই ওয়াসিম বলে।
দেখেন আমরা একটা ছোট দেশে থাকি। যে দেশটা ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়েছে। আমাদের মিলেমিশে থাকতে হবে। ফলে সবার লেখাই আমাদের ছাপতে হবে।
ওয়াসিম বলে, এটার সঙ্গে দেশ স্বাধীন হওয়ার বা ছোট দেশের কোনো সম্পর্ক নেই বলে ওয়াসিম। এটা বৈশ্বিক নৈতিকতার ব্যাপার। সাহিত্য কোনো একটা দেশেই কেবল উৎপাদিত হয় না। দুনিয়ার সব ভাষাতেই সাহিত্য আছে। সব ভাষাতেই সাহিত্য চর্চার দুটি ধরন আছে যুগ যুগ ধরে। কথা হচ্ছে কনসেপ্ট নিয়ে। আপনার কনসেপ্ট ক্লিয়ার কিনা সেটাই হচ্ছে আসল বিষয়। বড় কোম্পানির বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোর তো কোনো লেখক দরকার নেই। তাদের দরকার বিজনেস। এমনকি লেখা নিয়েও। তারা তারকা বানায়। তারকা বানাইলে তাদের লাভ অনেক। সেই তারকার পারপাসে পত্রিকাটার বিজ্ঞাপন বাড়ে। এই পলিসি দুনিয়ার সব বাণিজ্যিক পত্রিকারই। তো লেখার মাধ্যমকে যারা চিন্তার মাধ্যম হিসেবে ভাবে, যারা ভাবে ন্যায় নীতি নিয়ে, যারা ভাবে সাধারণের শোষণ বঞ্চনা নিয়ে, যারা ভাবে চিন্তা লেখার মাধ্যমে মানুষকে প্রভাবিত করবে তারা তো আর এসব রদ্দি বাণিজ্যিক পত্রিকায় লিখতে পারে না। মনে হয় এই জায়গা থেকেই বিকল্প কাগজ বা ছোটকাগজ করার স্বপ্ন জন্ম নেয়। আকারে ছোট তো অবশ্যই ওরা হক কথা বলবে, শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবে। ভন্ডামির সমালোচনা করবে। তো ওদের বিজ্ঞাপন দেবে ক্যাডা, পত্রিকা করার জন্য? তো নিজেদের খরচেই তারা কয়েকজন সমমনা একটা ছোট কাগজ করে। কিন্তু আমাদের দেশে বাণিজ্যিক পত্রিকা আর ছোট কাগজ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
ওয়াসিম বলেই চলে, আপনার লিটলম্যাগটা দেখলাম। আপনার পত্রিকায় বেশিরভাগই দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদকদের লেখায় ভরা। তাহলে আর দৈনিক পত্রিকার সঙ্গে আপনার লিটলম্যাগের ফারাক কি। আর কেনই বা আপনি এটাকে লিটলম্যাগ বলছেন? এতে কি আপনি লিটলম্যাগ ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়াচ্ছেন না? লিটলম্যাগ ঘাটের পয়সা খরচ করে মৌলিক চিন্তার জন্ম দেয় বলে লিটলম্যাগকর্মীদের যে আত্মমর্যাদাবোধ সেটা তো আপনি ঠিকই নিচ্ছেন। এটা ইললিগ্যাল।
আরে কোথাও একবার লেখা ছাপা হলেই হয়। এইগুলা নিয়ে এত কথা বলার কি আছে মাঝখানে বলে মাহতাব। মাহতাব কথা বললে সাধারণত কোনো তরুণ উল্টা কথা বলে না। মাহতাব নিজে টাকা দিয়ে মদ খাওয়ায়। ফলে সে বিতর্ক পছন্দ করে না। তার ধারণা সবাই তার কাছে আসবে, তার টাকায় মদ খাবে আর তার আত্মপ্রশংসা শুনবে।
লেখালেখিকে আমরা এত সাধারণ বিষয় কেনই বা মনে করছি মাহতাব ভাই, ওয়াসিম বলে চলে। লেখালেখি ধরেন একধরনের আত্মপ্রকাশ। লেখক কি চিন্তা করছে বা সমাজ-পৃথিবী-রাষ্ট্র-নারী-পুরুষ-ধর্ম-দর্শন ইত্যাদি সম্পর্কে তার ধারণাই আসলে সে প্রকাশ করে। তাহলে একজন লেখক আগে একজন মানুষ আসলে। তো মানুষটা যদি সৎ না হয়, দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন না হয় তাহলে তার কাছ থেকে কা-জ্ঞান সমৃদ্ধ কবিতা বা সাহিত্য আমরা আশা করতে পারি না।
মাহতাব বলে দূর মিয়া মদ খাইতে এসে এত বাজে প্যাচাল ভালো লাগে না। কবিতা কোনো দায়বোধ থেকে সৃষ্টি হয় না। এটা একটা শিল্প। একটা নারীর পাছা অথবা দুধকে বা নারী কবিটিও পুরুষের কোনো অঙ্গকে যদি গ্লামারাইজ করে তার কবিতায়, গল্পে আনতে পারে। সেটা পইড়া যদি আরেকজনের ফিলিংস হয় তাহলে সেটাই শিল্প। একধরনের চিত্রকল্প। অই যে জীবনানন্দের কবিতা পইড়া রবীন্দ্রনাথ যে বলেছিলেন চিত্রকল্পময়, সেটাই কবিতা। সাহিত্যও তাই।
তাহলে কি আপনি বলছেন সাহিত্যের কাজ হচ্ছে চিত্র আঁকা। তাহলে চিত্রকলার দরকার কি? বলে ওয়াসিম।
মাহতাব প্রায় ক্ষেপে গিয়ে বলে, চিত্রকলার দরকার কি ছিল মানে? চিত্রকলা মানে সৌন্দর্য। তুমি সবুজ দেখে কেন বলো আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। নীল দেখে কেন বলো বেদনার মতো নীল। অইটাই। একটার উপমা আরেকটা। এটাই শিল্প। এটাই কবিতা।
ঠিক আছে মাহতাব ভাই আমি আপনার কথা মানছি বলে ওয়াসিম। কিন্তু পৃথিবীর শিল্প ক্ষেত্রের সব বিভাগ এমনি এমনি সৃষ্টি হয়নি। একেকটার প্রকাশভঙ্গি, চিন্তার স্ট্রাকচার আলাদা বলেই এতগুলো শিল্পমাধ্যমের সৃষ্টি হয়েছে। উপন্যাসের প্রকাশ ভঙ্গি বা চিন্তার স্ট্রাকসার ঠিক কবিতার মতো নয়। উপন্যাস বর্ণনাধর্মী যেমন কবিতা আবার সংশ্লেষণধর্মী। গল্পের প্রকাশভঙ্গিও প্রবন্ধের প্রকাশভঙ্গি নয়। কোনটা কোনটার সঙ্গে বড় সেটা বলা আমার উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু এটাই বলতে চাই যে, এদের প্রত্যেকের প্রকাশভঙ্গি চিন্তার কাঠামো আলাদা। একই বিষয় নিয়েও হয়ত কবিতা-গল্প-উপন্যাস-সিনেমা-চিত্রকলা হতে পারে। কিন্তু সেটা দাঁড়াবে একেক রকম।
না আমার মনে হয় আমরা অন্য জায়গায় চলে যাচ্ছি বলে সোহান হাসান। আপনি বলছিলেন লিটলম্যাগাজিনের নৈতিকতার বিষয়ে।
কয়েক প্যাগ কেরুর ভোদকা টেনে মাথাটা ঝিমঝিম করছে ওয়াসিমের। তার চুপ করেই থাকতে ইচ্ছে করছিল। কথায় কথা বাড়ে সে জানে। কিন্তু মাহতাব চুপচাপ মদ খাওয়ার লোক নয়। সবাই একটু চুপ করলেই সে কোথায় কি পুরস্কার পেয়েছে সেসব বলে বলে সবার মাথা ভারী করছিল। সোহান হাসান ও আনোয়ার চুপচাপ শুনে উপর নিচ মাথা নাড়ালেও এসব নোংরা আত্মপ্রচার তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছিল ওয়াসিমের ভেতর। সে ভাবলো এ অবস্থায় ওঠে যাওয়াও সম্ভব নয়। সে মনে মনে ভাবলো তর্কাতর্কি যদি ঝগড়ার পর্যায়ে যায় তাহলে সে নিজেই নিজের বিল দিয়ে দেবে।
ওয়াসিম বলতে শুরু করলো, শিল্পের জন্য শিল্পর বিষয়টা সামন্তীয় যুগে সম্ভব ছিল। সাহিত্য শিল্প তো মানুষের জীবনের বাইরের কিছু নয়, তাই নয়। যেমন সেসব সামন্ত প্রভুদের পৃষ্ঠপোষকতায় অনেক কবিতা মহাকাব্য চিত্রকলা লেখা হয়েছে। বেশিরভাগই তাদের বন্দনা করে। যেমন হাফিজকে দিয়ে সুলতান মাহমুদ শাহনামা লিখিয়েছেন কিন্তু হাফিজের পারিশ্রমিক ঠিকমতো পরিশোধ করেননি। মোগলরাও করেছে এসব। আরাকান রাজসভার কবিরাও আলাওল দৌলত কাজীদের লেখাতেও সেই সময়ের নানা বিষয়ের বর্ণনা পাওয়া যায় সত্য কিন্তু সেসব সেই সামন্ত প্রভুদের ফ্রেমের ভেতর দিয়েই তারা বলত। এসব আত্মকাহিনি শুনতে পছন্দ করতেন তারা। কিন্তু পৃথিবী তো আগাচ্ছে মানে মানুষ তো নিত্য নয়া অভিজ্ঞতার সামনে যাচ্ছে। ফলে সে নিজেই এখন চলে এসেছে সাহিত্য শিল্পের কেন্দ্রবিন্দুতে।
ধরেন তলস্তয়েরও সব উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ছিল সামন্তীয় তথা ভোগবাদী সমাজের। অইদিক থেকে দেখলেই তাদের জন্য সুবিধা তলস্তয় নিজেও ছিলেন উচ্চবিত্ত সমাজের প্রতিনিধি। তার উপন্যাসের সব জায়গায় তার চরিত্ররা নিজেদের সঙ্গেই আত্মযুদ্ধে লিপ্ত। আনা কারেনিনার কনস্তানতিন পাভেল দগ্ধ হতে হতে যখন সিদ্ধান্ত নিল যে, সে তার পৈতৃক জমিদারি থেকে কিছু জমি চাষিদের দিয়ে দেবে, কারণ যারা চাষ করবে জমির মালিক হবে তারাই। কিন্তু চাষিরা সামন্তদের শোষণে এতই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল যে, তারা বিশ্বাসই করতে চাইল না পাভেলের এই প্রস্তাব। উল্টা তারা নিজেদের ভেতর আলাপ করছিল যে, মালিক এইটা আবার শোষণের নয়া চক্রান্ত করছে নাকি।
আবার দেখেন দস্তয়েভস্কির চরিত্রগুলো। দেখেন তার অপরাধ ও শাস্তির নায়ক রাসকলনিকভ শুরুতেই সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি। বলা যায় বাকিটা এখানেই। দস্তয়েভস্কির পর দুনিয়ার উপন্যাসের গল্পের কাঠামো বদলে যায়। গল্প-উপন্যাসের কেন্দ্রে চলে আসে ভ্রাত্য দুস্থ গরিব বেশ্যা ইত্যাদি। সামন্তীয় সাহিত্যে যাদের কোনো স্থানই ছিল না। স্থান থাকলেও তারা ছিল নিয়তি নির্ধারিত অপরাধী। তো নৈতিকতা প্রশ্ন আসলে এখানেই যে সামন্তীয় সাহিত্যের পরিচালক ছিল সামন্তীয় সমাজ। এ জন্য সাহিত্য প্রকাশিত হওয়ার আগে জারতন্ত্রের সেন্সরের কাঁচি তৈরি ছিল। কিন্তু এরপর যে কেউ হয়ে উঠলো কবি-সাহিত্যিক সেন্সরের কোনো তোয়াক্তা না করেই। নিজেরা নিজেদের স্থাপিত করলো কেন্দ্রে। ফলে নৈতিকতার ভারটাও পড়ল নিজের উপর। এখানেই নীতির প্রশ্ন। সামন্তীয় নীতি আর গরিবের নীতি তো এক হতে পারে না তাই না?
খুব অবজ্ঞার ভঙ্গিতে প্রায় না শোনার মতোই বাকি তিনজন শুনতেছিল ওয়াসিমের বক্তব্য। তারা পারলে ওয়াসিমকে বার থেকে বের করে দিত। নিরঙ্কুশ আত্মপ্রচার করতে না পেরে তেতে উঠেছে মাহতাব। তার মনে হচ্ছে আজকে বারের বিলটা একেবারেই বিফলে গেল ওয়াসিমের কল্যাণে। সে মূলত আশা করছিল আজকে তিনজনকে তার কবিতা নিয়ে তিনটা লেখার অ্যাসাইন্টমেন্ট দিয়ে দেবে মদ খাইয়ে। সেখানে ওয়াসিম নিজে তো তাকে কথাই বলতে দিচ্ছে না। বাকি দুইজনকেও উত্তেজিত করে দিচ্ছে। মাহতাব মনে মনে বললো শালা, শুয়রের বাচ্চা।
আপনি এতক্ষণ যা বললেন তাতে আমরা বুঝলাম আপনি অনেক খবরাখবর রাখেন। কিন্তু মি. ওয়াসিমের সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের সম্পর্ক কি। সেটা তো বললেন না। না না তর্ক তো এক জায়গায় থাকবে না। আমরা সবাই মাল খাইতেছি তাই না ওয়াসিম বলে। ওয়াসিম একটু ডানে-বামে তাকায়। পিককে শব্দ বেশি। কোথাও কে একজন ক্ষেপে গিয়ে টুং করে একটা গ্লাস ভেঙে ফেলল। চোখ-মুখ কচলে টেবিলে রাখা মাহতাবের প্যাকেট থেকে একটা গোল্ডলিফ সিগারেট নিয়ে টান দিতে লাগল ওয়াসিম। বারের পরিবেশটাই পুরা ধোঁয়া আক্রান্ত।
মাহতাব ভাই বিরক্ত হচ্ছেন না তো বলে ওয়াসিম মাহতাবের দিকে তাকায়। মাহতাবের চোখ লাল হয়ে আছে। সে কোনো কথা বলল না, হাত নেড়ে বলল চালিয়ে যাও।
ওয়াসিম আবার বলা শুরু করে, তো দেখেন আজ সবাই যার যা খুশি করতেছে। যার খুশি কবিতা লিখছে, গল্প লিখছে, উপন্যাস লিখছে। লেখক হওয়াটাই একটা স্বপ্নে পরিণত হয়েছে। সে কোন সমাজ থেকে আসলো। মফস্বল থেকে আসা একটা চাষার ছেলে, হাওর বা ভাটি অঞ্চল থেকে আসা একটা জেলের ছেলে সে লিখছে কবিতা-গল্প-উপন্যাস। তো তার লেখায় কার প্রতিনিধিত্ব থাকবে। সে কি লিখবে ভোগবাদীদের কায়কারবার? তার সম্পর্কে সে কি জানে। আর যা জানে না তা সে লিখবেই বা কেন? আপনি কি আপনার কৌমের লোকজনদের পেছনে রেখে দ্রুত ভোগের সমাজে ঢুকে পড়বেন? এটা একশ্রেণির মানুষ করবেই। তার অভাব দেখেছে আজন্ম, সে এখন যেকোনো প্রকারে সচ্ছলতা চায়। এটা নিঃসন্দেহে একটা সুবিধাবাদী অবস্থান। হয়ত মানুষের জিনের ভেতর এই ধরনের একটা ব্যাপার আছে। সে সহজে যেকোনো সমঝোতার মাধ্যমে দ্রুত একটা সুবিধাজনক অবস্থানে চলে যেতে চায়। কিন্তু আপনি দুনিয়ার ইতিহাসের দিকে তাকান। মানুষ কিন্তু একলা বাঁচতে পারে না। সেজন্য কৌমের প্রতি আপনার একটা দায়িত্ববোধ আছে। আপনি নিজে পালালেন তাইলে তো আপনি পলায়নবাদী। যেখান থেকে আপনার মতো একজন সচেতন মানুষ পালাচ্ছেন সেখানে অসেচতন মানুষ কিভাবে আগাবে। আপনি লিখতে পড়তে পারেন। মানে দুনিয়াদারি বোঝেন। আপনারই তো দায়িত্ব আত্মসন্ধান করা। গ্রামে মফস্বলের লেখক আপনি। আপনার লেখা দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ছাপা হয় না। তারা ছাপবে কেন? তাদের তো আপনার গ্রাম্য যন্ত্রণা ভালো লাগে না। তারা ভোগবাদীদের টাকায় পত্রিকা করে। সুতরাং আপনার কথা বা আপনার কৌমের কথা ছাপার কোনো দরকার বা দায়িত্ববোধ তাদের নেই। কিন্তু আপনি কি করছেন, বিকল্প ছাপাখানা হিসেবে লিটলম্যাগাজিন করে সেখানে আপনি সেই ভোগীদের পত্রিকার লোকজনের লেখাই ছাপাচ্ছেন। যারা আপনার কৌমের কথা বলতে দেবে না। আপনাকে গ্রাম্য মফস্বলি বলে তকমা মারবে সেই আপনিই যখন পত্রিকা করছেন সেখানে ভরে দিচ্ছেন তাদের লেখা। এর চেয়ে ট্রাজেডি আর কি হতে পারে। এখানে যদি শনাক্ত করে তাহলে আপনার অবস্থানটা কি? আপনি কে? আপনি আপনার কৌমের বিরুদ্ধে গিয়ে বিকল্প ছাপাখানাতেও জায়গা দিচ্ছেন তাদের, যারা আপনার কৌমসহ আপনাকে ওন করে না।
সেদিন মোটামুটি রাত হয়ে যায় বাসায় ফিরতে ওয়াসিমের। পিকক থেকে মদ্যপান করে ওরা চলে যায় শাহবাগ মোড়ে। শাহবাগ মোড়ে আবার আড্ডা হয়। ওয়াসিম নিজের নৈতিকতা নিয়ে নিজেকে আড়াল করে ফেলতে চায় না। কারণ একজন লেখক হিসেবে সে অনেক অভিজ্ঞতায় জারিত হতে চায়। অনেকেই আছেন বিভিন্ন নীতি-নৈতিকতার নামে নিজেকে একঘরে করে রাখেন। এটা প্রথম দিকে ওয়াসিমেরও ছিল। কিন্তু অচিরেই সে নিঃসঙ্গতায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। অবশেষে সে এর ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। সে মোটামুটি সব ধরনের পাবলিকের সঙ্গেই মেশে। মেশে তার পরিমাণ মতো। অন্যের পরিমাণ মতো নয়। সাহিত্য পাতার সহকারী সম্পাদক হওয়াতে তাকে সব ধরনের লেখকের সঙ্গেই মিশতে হচ্ছে ইদানীং।
ওয়াসিম থাকে মিরপুর পাইকপাড়ায়। মিরপুর ১ নম্বরের দিকে যাওয়ার পথে চাইনিজে নেমে ডান দিকের গলি দিয়ে হেঁটে যায় সে। ওয়াসিম মূলত পেয়িং গেস্ট হিসেবে থাকে তরুণ সিনেমা নির্মাতা অভিমন্যুর সঙ্গে। অভিমন্যু, স্ত্রী জোবায়দা ও তাদের এক বছর বয়সী সন্তান স্বর্ণা থাকে তিন রুমের এই বাসাটায়। দুই রুমে তারা থাকে আরেক রুম তারা ভাড়া দিয়েছে ওয়াসিমকে।
অভিমন্যুর সঙ্গে ওয়াসিমের প্রথম সাক্ষাৎ হয় আজিজ মার্কেটে। সিনেমা পাগল ছেলে, প্রচুর পড়াশোনা। তার এই পাঠাভ্যাসের কারণে তাকে খুবই পছন্দ করে ওয়াসিম। শাহবাগে আসলেই একসময় অভিমন্যু ও ওয়াসিমকে একসঙ্গে দেখা যেত। দুইজন আজিজের দোতলায় মামার চায়ের দোকানে অথবা পাঠক সমাবেশের সামনে অথবা জাদুঘরের সামনে আইল্যান্ডে অথবা ছবির হাটে। কোথাও না কোথাও ওদের দুজনকে একসঙ্গে দেখা যাবেই। অভিমন্যুর ধ্যানজ্ঞান সিনেমা। সে সিনেমার ওপর নিয়মিত লেখে। এখন কাজ করে একটা প্রোডাকশন হাউজে স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে। কিন্তু স্ক্রিপ্টরাইটার হিসেবে খুব বেশি টাকা দেয় না প্রোডাকশন হাউজগুলো। তাই টেনেটুনে চালাতে হয়।
৬ ফুটের উপরে লম্বা পেঠানো শরীর যদিও নিয়মিত সিগারেট খায়, তবুও শরীরটা এখনো চমৎকার অভিমন্যুর। সে অভিনয়ে নিয়মিত হলে অনেক অভিনেতার ভাত মারত বলে মনে করে ওয়াসিম। ওয়াসিম বহুবার বলেছিল তাকে অভিনয় করার জন্য। কিন্তু অভিনয়ে কোনো আগ্রহ নেই অভিমন্যুর। অভিমন্যু খুবই কষ্টেসৃষ্টে সংসার চালায়। স্ক্রিপ্ট লিখে যা পায় তাতে চলে না। বাচ্চার এটা ওটা কত কিছু লাগে। তাই ওরা একটা রুম ওয়াসিমকে ভাড়া দিয়ে দেয়। ওয়াসিমও খুশি। সে আগে দুইজন সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে কাঁঠালবাগান ঢালে গাদাগাদি করে থাকতো। খাওয়া- দাওয়ার কোনো ঠিক-ঠিকানা ছিল না। এখন সে একটা নিয়মের মধ্যে চলে এসেছে। আর অভিমন্যুর বইয়ের সংগ্রহটা তো বলতে গেলে ওয়াসিমের জন্য মূল আকর্ষণ। ওয়াসিম যেরুমে থাকে সেরুমেই মূলত অভিমন্যুর বইগুলো রাখা। ওয়াসিমের নিজের সংগ্রহও খারাপ না। সব মিলিয়ে ওয়াসিম মোটামুটি বইপত্রের ভেতর জায়গা করে ঘুমায়।
রুমের চারদিকেই দেয়ালের সঙ্গে ঠেস দিয়ে বইপত্রগুলো রাখা। চারদিকে বই পরিবেষ্টিত হয়ে থাকতে খুবই ভালো লাগে ওয়াসিমের। ঘুম থেকে সকালে জেগেই সে দেখে অজস্র পছন্দের বইপত্র।
অভিমন্যুর সঙ্গে জোবায়দার সম্পর্কটা এখন ভালো যাচ্ছে না। ওরাও পরস্পরকে পছন্দ করে বিয়ে করেছে। জোবায়দা অভিনেত্রী হতে চেয়েছিল। কিন্তু বিয়ে করে বাচ্চার মা হয়ে তার শরীর নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, তার ওপর অভাব থেকে বের হতে পারছে না। অভিমন্যু যা ইনকাম করে তাতে নুন আনতে পানতা ফুরায়। এই সব চিন্তায় তার মেজাজটা খুবই খারাপ থাকে সবসময়। এমন এমন দিনও যায় বাচ্চার দুধ কেনার টাকা থাকে না তাদের। একদিকে বইপত্রের আনন্দ অন্যদিকে এই সাংসারিক দোলাচল এভাবেই থাকে ওয়াসিম। ওয়াসিমের কাছে আলাদা কোনো চাবি নেই। বাসার মেইন গেট ও দরজার চাবিটা জোবায়দাই সংরক্ষণ করে। ওয়াসিমের রাত হলে সে নিচে দাঁড়িয়ে অভিমন্যুকে ফোন দেয়। ওদের ফ্ল্যাটটা তিন তলায়। জোবায়দা ওপর থেকে কনডেন্স মিল্কের খালি পটের ভেতর চাবিটা ঢুকিয়ে একটা দড়ি বেঁধে নামিয়ে দেয়। পট থেকে ওয়াসিম চাবিটা নিলে সে পটটা ওঠিয়ে নেয়। তার পর তালা খুলে ওয়াসিম ওপরে উঠে যায়।
অভিমন্যু কাজ করে মগবাজারে। আর ওয়াসিমের অফিস হচ্ছে তেজগাঁও শিল্প এলাকায়। সন্ধ্যায় দুজনই শাহবাগে আড্ডা দেয়। আড্ডা শেষে দুজন একসঙ্গে হতাশা আর নিরাশার গল্প করতে করতে লোকাল বাসে ঘরে ফেরে। মাঝেমধ্যে কাজ থাকলে আলাদা যায়। অভিমন্যু অবশ্য বেশ ভোরেই বাসা থেকে বেরিয়ে যায়। ভোরে ঘুম থেকে উঠতে ওয়াসিমের একদম ভালো লাগে না। তার উপর তার অফিস টাইম ১২টা থেকে। লোকাল ভোদকাটা ওরা দুজনই খুব পছন্দ করে। মাঝেমধ্যে একসঙ্গে সাকুরা অথবা পিকক থেকে টেনে যায়। প্রায় রাতেই জোবায়দার সঙ্গে অভিমন্যুর কথা কাটাকাটি হয়। কিন্তু অভিমন্যু অসম্ভব ধৈর্যশীল। সে কখনো ক্ষেপে না। সে উচ্চবাচ্য পছন্দ করে না। কিন্তু জোবায়দা ক্ষেপে গেলে তাকে আটকায় কার সাধ্য। সে উচ্চৈঃস্বরে অভিমন্যুকে খোটা দিয়ে কথা বলে। মুখ দিয়ে যা-তা বেরিয়ে যায়।
জোবায়দার জীবনটাও বেশ কঠিন। জোবায়দা এই ধরনের একটা জীবন চায়নি আসলে। জোবায়দা বেড়ে উঠেছে পুরান ঢাকায়। খুব ছোটবেলায় জোবায়দার মা-বাবার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর জোবায়দার বাবা বিদেশে চলে যায়। দীর্ঘদিন অনেক কঠিন সংগ্রাম করেছে একা জোবায়দার মা। জোবায়দাকে আসলে বিদেশে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ও তখন বাচ্চা তার বাবাও থাকত একা। ফলে মায়ের সঙ্গেই থাকত। মাঝেমধ্যে বিদেশ থেকে তার বাবা অল্প টাকা পাঠাতেন। তা দিয়ে চলতই না। জোবায়দার বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তার মা বিয়ে করে। প্রথম দিকে মেনে নিলেও ওর সৎ বাবা জোবায়দাকে মেনে নিচ্ছিল না। কারণ একটা বেড়ে উঠা বাচ্চার স্বেচ্ছাচার তার আপন বাবা-মা ছাড়া আর কেউ সহ্য করবে না। ফলে জোবায়দা কিছুদিন থাকত তার নানীর কাছে। তার নানী থাকত টঙ্গিতে। নানী মাঝেমধ্যে এসে নিয়ে যেত। আবার বেশি কান্নাকাটি করলে মায়ের কাছে দিয়ে যেত। ফলে এই দোটানার মধ্যে বেড়ে উঠেছে সে। জীবনযাপনের প্রতি একটা অদ্ভুত ধারণা হয়েছে তার। এই রাষ্ট্রে এক পিতৃহীন বালিকার বেড়ে উঠা খুবই কঠিন। জোবায়দা পদে পদে সাক্ষাৎ পেয়েছে সেই কাঠিন্যের। বাবাকে যখন সে পায়নি কখনো ফলে বাবার প্রতি তার কোনো মায়া নেই টান নেই। লোকটা মাঝেমধ্যে ইতালি থেকে অল্প টাকা পাঠায়। জন্মদিনে কিছু গিফট পাঠায় এই করেই সে নিজের দায়িত্ব সারে। কষ্টেসৃষ্টে সে ঢাকার একটা কলেজ থেকে প্রাইভেটে এম এ পাস করেছিল। সে টঙ্গী থাকলেও তার আড্ডা ছিল শাহবাগের দিকে। সেখানেই আড্ডায় পরিচয় হয় অভিমন্যুর সঙ্গে। অভিমন্যু হিন্দু হলেও সে কখনো তাকে হিন্দু হিসেবে দেখেনি। জোবায়দার মাথায় এটা কাজই করে না। জোবায়দা চেয়েছিল একটা সচ্ছল জীবন। এই জন্যই সে মূলত অভিনেত্রী মানে কমার্শিয়াল ছবির নায়িকা হতে চেয়েছিল। সে দেখেছিল অভিমন্যুর ভেতর প্রচুর সম্ভাবনা। অভিমন্যু সিনেমা-পাগল মানুষ। কোনো একদিন অভিমন্যু নাম করবে এটাই ছিল জোবায়দার টার্গেট। তখন সেও ভালো কোনো ক্যারেক্টার বাগিয়ে লাইমলাইটে আসবে।
কিন্তু অভিমন্যু সিনেমা-পাগল হলেও তার ভেতর কেমন যেন সাধকসুলভ একটা ব্যাপার আছে। অভিমন্যুর চেয়ে অনেক মেধাহীন তরুণ নাটক সিনেমা বানিয়ে বেশ নাম করেছে। যারা অভিমন্যুকে গুরু বলে মানে ও ডাকে। কিন্তু অভিমন্যু এখনো শুধুই পরিকল্পনা করে যাচ্ছে। অভিমন্যুর পরিকল্পিত কাহিনিগুলো শুনলে যে কেউ এক কথায় ‘অসাধারণ’ না বলে পারবে না। এগুলো চলচ্চিত্রায়ন করা গেলে কাল বা বার্লিন ফিল্ম ফ্যাস্টিভেলে সোনার পাতা বা সোনার ভালুক পেতেও পারতো। কিন্তু সেই সমঝদার প্রযোজক কোথায়? অভিমন্যু এই হতাশার ভেতরও সেরকম একজন সমঝদার প্রযোজকের খোঁজ করে চলে। অনেক নাটকের অফার থাকা সত্ত্বেও সে টিভি চ্যানেলগুলোর জন্য চানাচুর মার্কা নাটক বানাবে না। দরকার হলে জীবনে মাত্র একটা ছবি বানাবে। আর তার এই একরোখা ভাবটাকে শ্রদ্ধা করে ওয়াসিম।
কিন্তু অভিমন্যুর এই একরোখা ভাব পছন্দ করে না জোবায়দা। সচ্ছল জীবনকে অভিমন্যু কোনো এক অজানা কারণে পায়ে ঠেলছে দেখে ভেতরে ভেতরে সে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। ক্ষেপে থাকে ভেতরে ভেতরে। জোবায়দার স্বপ্নের পথ প্রশস্ত করার চাইতে স্বপ্নের পথে বাধা হয়ে থাকে যেন অভিমন্যু। প্রথমত সে স্লো। দ্বিতীয়ত তাদের বাচ্চা হয়েছে। যে বাচ্চা আবার জোবায়দাকেই লালন করতে হচ্ছে। এই যে বাসার ভেতর আবদ্ধ হয়ে থাকে, এতে জোবায়দার দম বন্ধ হয়ে আসে। ছেলেমেয়েদের জীবন বলে আলাদা কোনো জীবনে বিশ্বাসী নয় জোবায়দা। কিন্তু তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে ঘরের ভেতর আবদ্ধ থেকেও টেনশন মুক্ত হতে পারে না জোবায়দা। অভিমন্যু ঠিকমতো বাচ্চার খাবার-দাবারের ব্যবস্থাও করতে পারে না। মাস শেষে বাসাভাড়ার জন্যও টানাটানি। এই রকম একটা পরিস্থিতিতে হয়ত কোনো মহিলাই নিজেকে ঠিক রাখতে পারবে না। একটা ছোট বাচ্চা নিয়ে কোথাও যেতেও পারে না জোবায়দা। অভিমন্যুর প্রতি তার আর কোনো আবেগ কাজ করে না। অভিমন্যুকে কষ্ট দিতে পারলেই যেন খানিকটা জ্বালা মেটে তার। তবু বাচ্চার কথা চিন্তা করেই এখনো অভিমন্যুর সঙ্গে থাকা। কারণ এই মুহূর্তে অভিমন্যুকে ত্যাগ করলে সে এই ছোট বাচ্চা নিয়ে কি করবে?
অভিমন্যুও বাসাভাড়ার চাপটা খানিকটা লাগব করার জন্যই ওয়াসিমকে একটা রুম ভাড়া দিয়েছে। ওয়াসিমকে সে অবশ্য পছন্দ করে সৃষ্টিশীল মানুষ হিসেবে। তার চাইতেও বড় কথা হচ্ছে তার চিন্তার সঙ্গে ওয়াসিমের চিন্তার অনেক মিল। ব্যাচেলর ওয়াসিমকে দেখে খানিকটা ঈর্ষাও হয় তার। কারণ বিবাহিত জীবন এত কঠিন জানলে সে বিয়েই করতো না। জোবায়দার সঙ্গে তার সম্পর্কটা তিক্ততায় পর্যবসিত হয়েছে। এখন তাদের সম্পর্কটা টিকে আছে একমাত্র সন্তানকে কেন্দ্র করে। অভিমন্যু মাঝে মধ্যে আত্মহত্যার কথা ভাবে। কিন্তু আবার ভাবে যে, জীবনতো একটাই। হয়ত কেটে যাবে এই মেঘ। অভিমন্যু বুঝে তার ভেতরে কোথায় যেন একটা জমাট অন্ধকার আছে যা তাকে নগ্ন হয়ে এগিয়ে যেতে বাধা দেয়। সে যারতার সঙ্গে আপস করে এগিয়ে যাওয়া বা অর্থের মালিক হওয়ার পক্ষপাতী না। সে ভাবে অনেক সৃজনশীলদের মতোই একদিন হয়ত তার অবস্থার পরিবর্তন হবে। ইদানীং জোবায়দার সঙ্গে তার মানসিক ও শারীরিক কোনো ধরনের সম্পর্কেই সে ভেতর থেকে সাড়া পায় না। এখন পরস্পরের কাছে তারা ভীতিকর চরিত্র।
দিনের বেলায় প্রথমে অভিমন্যু বেরিয়ে যায়। তারও ঘণ্টাখানেক পর বের হয় ওয়াসিম। মাঝেমধ্যে বিকাল পর্যন্ত বইয়ে ডুবে থাকে ওয়াসিম। ওয়াসিম বিশেষ পছন্দ করে না জোবায়দাকে। সে ভাবে অভিমন্যুর জীবনটা নরক করে তুলেছে জোবায়দা। ঝগড়া শুরু হলে জোবায়দার মুখে কিছুই বাধে না। শুধু ডাইনিং টেবিলে খাবার দিলে জোবায়দা ডাক দেয়। ওয়াসিম...। জোবায়দাও ওয়াসিমের দিকে তেমন ঘেঁষে না। ভাবে অভিমন্যুর বন্ধু আরেক অভিমন্যু হবে আর কি। সারা দিন বইয়ে মুখ গুজে পড়ে থাকতে দেখে ওয়াসিমের ভবিষ্যৎ নিয়েও আঁতকে উঠে জোবায়দা। জোবায়দা সকালে রান্না সেরে বাচ্চাকে খাইয়ে দিয়ে সবাই বেরিয়ে গেলে দরজায় তালা দিয়ে মাঝে মধ্যে পাশের ফ্ল্যাটে চলে যায়। পাশের ফ্ল্যাটের রুনা ভাবীর সঙ্গেই গত বছর দুয়েক ধরে তার বন্ধুত্ব। রুনা ভাবীও নিজের সব কথা জোবায়দার সঙ্গে শেয়ার করে। জোবায়দাও তার সব কথা মোটামুটি রুনা ভাবীকে বলে।
রুনা ভাবী বেশ সাহসী ও রসিক। সেদিন কথায় কথায় জোবায়দাকে বলে বসে, আচ্ছা তুমি থাকো কেমনে, জামাইর সঙ্গে এতদিন এইভাবে সম্পর্ক খারাপ করে। এমন এক যৌবনকালে। যখন জামাইর সোহাগ পাওয়া উচিত।
ধুর, শালার খাবার আর বাড়িভাড়া দেওয়ার মুরোদ নেই আবার দেবে সোহাগ। জীবনটাই বৃথা গেল ভাবী বলে জোবায়দা।
তাইলে দেবরটারে ধর বলে রুনা হি হি হি করে হাসতে থাকে।
দেবর! বলে আশ্চর্যান্বিত হয় জোবায়দা। দেবর কে?
কেন অই যে তোমাদের বাসায় থাকে। দেখতে তো মাশাল্লাহ ভালোই। চেহারাসুরত। তাতে জামাইর ওপরও একহাত নেয়া যাবে। রুনা বলে।
জোবায়দা বুঝতে পারে। তার চেহারা লাল হয়ে আরক্তিম হয়ে উঠে। জোবায়দা মূলত কখনোই ওয়াসিমকে নিয়ে এই ধরনের কোনো কিছু ভাবেনি। ওয়াসিমের সঙ্গে ভালো করে তার আলাপ-সালাপই হয়নি এখনো। ওয়াসিমকে সম্পূর্ণ অন্তর্মুখী টাইপের মনে হয় জোবায়দার।
ধুর কি যে বলেন, আপা। একটার সঙ্গে পারছি না আরেকটা?
রুনা তার জীবনের কথা বলতে গিয়ে একবার জামাইর বাইরের এক প্রেমিকের কথা বলেছিল তাকে। যার সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক ছিল। রুনা মনে করে শারীরিক সম্পর্ক কোনো বাধ্যবাধকতা কিছু নয়। এটা নেহাত রেস্তোরাঁয় খাওয়ার মতো ব্যাপার। ক্ষিধা পেলে সুবিধাজনক জায়গায় খেয়ে নেওয়া। এতে নাকি সাংসারিক জীবন ভালো থাকে।
জামাই জানতে পারলে তোমার খবর আছে জোবায়দা রুনাকে বলে।
ধুর জামাই জানতে পারলে। জামাই জানবে কেন? সতর্ক থাকলেই হয়। জামাই বাইরে কত কিছু করে আসে তার কোনো খবর রাখো, বলে রুনা ভাবী। শুন তোর দেবরটা কিন্তু খাসা। তুই না পারলে আমার সঙ্গে লাইন করে দে রুনা হাসতে হাসতে বলে।
এরপর থেকেই মূলত জোবায়দা ওয়াসিমকে খেয়াল করে। যে শারীরিক চাহিদার কথা সে মানসিক সমস্যার কারণে এতদিন ভুলে ছিল তা যেন ফের জেগে উঠল তার ভেতর। ওয়াসিমকে সে খেয়াল করে মাঝে মধ্যে। কথা বাড়াতে চায় তার সঙ্গে। যদিও এতে ওয়াসিমের ধ্যানভঙ্গ হবওয়র মতো কিছুই ঘটেনি। ওয়াসিম খুব বেশি লম্বা নয়। লিকলিকে হলেও মোটামুটি তার শরীরটা দশাসই। এখনো সকালে ঘুম ভেঙে গেলে সে ১০-১২টা বুকডন মেরে নেয়। হাঁটা পথ হলে কখনো গাড়িতে চাপে না। লম্বা ঝাকড়া চুলের দিকে খেয়াল করে জোবায়দা। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়।
জোবায়দার সঙ্গে এখন আর এক বিছানায় থাকে না অভিমন্যু। একটা মাদুর পেতে একটু তফাতে ঘুমায়। খাটের উপর বাচ্চা আর জোবায়দা। এতেই তারা অভ্যস্ত। মাঝে মধ্যে গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলে এলোমেলো শুয়ে থাকা জোবায়দাকে দেখে তার শরীর জেগে উঠলে বালিশের কোণায় গর্ত করে হস্তমৈথুন করে। এতে প্রায় অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে অভিমন্যু। কারণ জোবায়দাকে সেক্স করার জন্য ডাকতে গেলে সে ঠা-া হয়ে যায়। কারণ তখন জোবায়দার যৌবনের চাইতে তার ঝগড়ার স্বভাবটাই ক্রমশ তাকে দখল করে ফেলে। তাই সে জোবায়দাকে পেছনে ফেলে হস্তমৈথুন করেই মাঝে মদ্যে নিজেকে শান্ত করে।
ওয়াসিম যেই রুমে থাকে তার সঙ্গে লাগোয়া বারান্দা। জোবায়দা একহাতে বাচ্চা ও অন্যহাতে কিছু ভেজা কাপড় নিয়ে বারান্দায় যাওয়ার সময় ইচ্ছে করেই ভান করলো যেন বাচ্চা পড়ে যাচ্ছে। অসিম অসিম...। আসলে দ্রুত ডাকতে গিয়ে ওয়াসিমকে সে অসিম করে ফেললো। ওয়াসিম বই থেক মুখ তুলে তাড়াতাড়ি বাচ্চাটাকে কোলে নেয়। পড়ে যাওয়া ভেজা কাপড় দড়িতে মেলে দিয়ে জোবায়দা ওয়াসিমের কাছ থেকে বাচ্চা না নিয়েই তার রুমে চলে যায়। ওয়াসিম প্রথম দিকে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে খেলার চেষ্টা করে কিন্তু বাচ্চাটা কেঁদেই যাচ্ছে। সে বিরক্ত হয়। নিজের রুম থেকে আসলে জোবায়দা দেখে ওয়াসিম কি করে। ওয়াসিম চরম বিরক্ত হয়ে বসে আছে বাচ্চাটা কোলে নিয়ে। দরজার দিকে ফিরে তাকায় জোবায়দার পদধ্বনির আশায়। কিন্তু মিনিটের পর মিনিট চলে গেলেও জোবায়দা আসে না। ওয়াসিম চিৎকার করে ডাকতে গিয়েও ডাকে না, কারণ তাতে বাচ্চাটা ভয় পেয়ে যেতে পারে। সে নরম করে ডাকে দিদি... ও দিদি...। ওয়াসিমের ডাক শুনেও না শোনার ভান করে জোবায়দা তার রুমে চুল ঠিক করতে থাকে। একটু পর ওয়াসিম আবার ডাকে ও জোবায়দা দি, বাচ্চা মুতে দিছে...। ওয়াসিমের জোবায়দা দি ডাকটা জোবায়দার ভালো লাগে, সে ওয়াসিমের রুমে ঢুকে।
ওয়াসিম খেয়াল করে জোবায়দার মুখ ও চোখের পরিবর্তন। কিন্তু এতে তার ভেতর কোনো ভাবাবেগ তৈরি হয় না। একে তো বন্ধুপতœী তারপর ঝগড়াটে স্বভাবের মহিলা। তার প্রতি কোনো মুগ্ধতা কখনো ছিল না ওয়াসিমের, এখনো নেই। জোবায়দার কোলে বাচ্চাটা দিয়ে ওয়াসিম কাপড়-চোপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকে। বাথরুমের হ্যাংগারে কাপড় রেখে সে ঝরনা ছেড়ে দেয়। গোসল করতে করতে সে ভাবে বাচ্চা লালন করা আসলে খুবই কঠিন কাজ। যা জোবায়দাকে একা একাই করতে হয়। অভিমন্যুতো বলতে গেলে সারা দিন বাসায় থাকে না। একটা বুয়া রাখার মতো সাধ্যও নেই তাদের। কি করার সবারই একই অবস্থা। অস্থির হয়ে না উঠলে, অসৎ পথে না গেলে নিজের অবস্থার পরিবর্তন অসম্ভব প্রায়। ওয়াসিম ভাবে তার নিজের কথা। তার তেমন কোনো চাহিদা নেই। ফলে সে প্রায় নিশ্চিন্তে সারাক্ষণ শুয়ে বসে বই পড়ে। চিন্তা করে, কিছু লেখার চেষ্টা করে। বিকালের দিকে অফিসে যায়। লেখা সংগ্রহ করে। কিন্তু অভিমন্যু সংসার নামক জালে ধরা দিয়েছে। ফলে তাকে একমাত্র সে নিজেই উদ্ধার করতে পারে, অন্য কেউ নয়।
একসঙ্গে থাকতে গেলে পরিবেশ আক্রান্ত হয় মানুষ। সেই হিসেবেই ওয়াসিম অভিমন্যু বা জোবায়দার সঙ্গে যুক্ত। প্রতিদিন একটু একটু করে তাদের সমস্যাগুলো তার কাছে স্পষ্ট হয়। তবে অনেক কিছুর ভেতর একটা মানবিক কারণেই সে তার প্রতিবেশীদের কথা আমল করে। সেটা প্রায় ভুলে যাওয়ার মতোই। কারণ ওয়াসিমের যাত্রাটা আসলে নিজের দিকেই। এই মহাবিশ্বের সমস্যাদির ভেতর তার অবস্থান কোথায়? এই হচ্ছে তার যাত্রাপথ।
গোসল শেষে ওয়াসিম বাইরে বের হওয়ার জন্য তৈরি হয়। শীত এসে যাচ্ছে প্রায়। সে হালকা একটা চাদর গলার দুইপাশে ঝুলিয়ে দেয়। অনেক দিন ধরে বিশ্ব সাহিত্যকেন্দ্র থেকে পড়তে আনা বই ফেরত দেয়া হয়নি। দুটি বই হাতে নেয়। ভেতরের জুতার রেক থেকে জুতো নিয়ে বাইরে গিয়ে পড়বে। তার দুই হাতই আটকানো। তবু সে দরজা খোলার জন্য বইসহ হাতটা বাড়ায় দরজার হুকের দিকে। মাথার ভেতর হাবিজাবি ভাবনা তখনো। অনেকবার ওয়াসিম ভেবেছে মানুষের মস্তিষ্ক সবসময় ক্রিয়াশীল। যখন সে ঘুমায় তখনও এমনকি মৃত্যুর আগ পর্যন্তই মনে হয় তার ভাবনা জারি থাকে।
হুক খুলতে হাত উঠানোর সময়ই সে অনুভূতিটা টের পায়। একটা ভেলভেট অনুভূতি ছেয়ে গেছে তার পৃষ্ঠদেশ। সঙ্গে একটা সুঘ্রাণ ভেসে এলো তার সামনে। পেছন থেকে তাকে কেউ জড়িয়ে ধরেছে। কেউ তার পিঠে মাথা রেখে ফোঁপাচ্ছে, খানিকটা গোঙানিও সে টের পেল। একটু ভয়, একটু উষ্ণতার অনুভূতিও তাকে আক্রান্ত করল। সে হুক না খুলেই ফেরার চেষ্টা করল। তাকে জড়িয়ে ধরা জোবায়দা এতে খানিকটা শঙ্কিত হলো বটে, তাকে ফেরার সুযোগ করে দিল। সে ফেরার পর জোবায়দা আরো বেশি নিবিড়ভাবে তার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সে কাঁদছে। তার পিঠ ফুলে উঠছে। ওয়াসিমের দুই হাতই আবদ্ধ। একহাতে জুতা অন্যহাতে বই। এই অবস্থায় সে কি করবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। কিন্তু একটি জীবন্ত বস্তুর প্রতিক্রিয়া অনড় বস্তুর প্রতিক্রিয়ার চাইতে অনেক বেশি। জোবায়দার নিবিড় আলিঙ্গন, তার চুল আর দেহের ঘ্রাণ ফোঁপানোর যেই কম্পন সেটা শোকের চাইতে অন্য এক আগুন তৈরি করছে। কারণ ওয়াসিমের সারা দেহই প্রায় জোবায়দার দখলে। ওয়াসিমের হাত থেকে বই ও জুতা পড়ে যায়। সে দ্রুত ভাবল, সে সহানুভূতি প্রকাশ করবে। কিন্তু সে ভাবলো জোবায়দার প্রতি তার যেহেতু অরিজিনাল কোনো রকম আবেগ কাজ করে না, সেটা কৃত্রিম হয়ে যাবে। তাই দুটি বই সে দুই পাশে ঝুলিয়ে রাখল। হাত দুটি নিয়ে সে কি অস্বস্তিতে পড়ল। কিন্তু নেহাত দৈহিক ভালো লাগা থেকে সে হাত দুটি ক্রন্দনরত জোবায়দার কেঁপে উঠা পিঠে রাখল। এতে যেন খানিকটা শঙ্কিত জোবায়দা আরো বেশি সুযোগ পেল। তার কান্না খানিকটা শব্দ পেল ও আরো বেশি জোরে সে আলিঙ্গন করলো ওয়াসিমকে। ওয়াসিম ক্রমে বুঝতে পারল মাঝখানে যাই থাক বা জোবায়দার মনে যেই দুঃখই থাক না কেন এখন আসলে সে সব বায়বীয়। কাজ করছে শুধু দুুটি দেহের ভালো লাগার অনুভূতি। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠার রসায়ন ক্রমশ অন্য অনুভূতিগুলোকে দখল করে ফেলে। জোবায়দার মাথার পেছনে ধরে তার মুখ তুলে ধরে ওয়াসিম। জোবায়দার মুখ এভাবে কখনো দেখেনি সে। কয়েকটা চুল লেপ্টে আছে চিবুকে চোখের পানির সঙ্গে। তার কম্পিত ঠোঁট হা হয়ে আছে। দুই চোখ বন্ধ। সম্ভবত এই ধরনের সিচুয়েশনের মুখোমুখি হওয়ার ভয়েই তার চোখ দুটি বন্ধ। ওয়াসিম ভাবে সেও দুই চোখ বন্ধ করে ফেলতে পারলে বোধহয় শান্তি পেত। এই অস্বাভাবিক আলিঙ্গন থেকে।
ততক্ষণে দেহ চেতনা হারায়। বৈকালিক শীত দেহদেশের গভীর শীত তাদের আক্রান্ত করে। উভয়ের ভেতরের ক্রোমাজমের দঙ্গল উভয়ের দিকে ধেয়ে আসে। ওয়াসিম পাগলের মতো তার ঠোঁট নামিয়ে আনে দ্বিধান্বিত, ক্রন্দনরত, প্রকম্পমান জোবায়দার ঠোঁটে। জোবায়দাও দ্বিধাহীন বারুদ হয়ে উঠে। দুজনের কাছে দুজনকে ছেড়ে দেয় তারা। পরস্পরকে অনাবৃত করে। দেহ যেন এক চেতনার জঙ্গল। এত চেনা তবু সে কতই না অচেনা। এতদিন এত কাছে থেকেছে ওয়াসিম ও জোবায়দা। কখনো নিজেদের এই চেতনার জঙ্গল পরিভ্রমণ করেনি। আজ নিমিশেই তারা ঢুকে পড়ল পরস্পরের অচেনা দেহদেশে। জোবায়দার চেতনার স্তরে অভিমন্যুকে লক্ষ্য করে সে যেন আরো বেশি ঢেলে দিচ্ছে নিজেকে। কারণ অভিমন্যুকে ঠকাতে পারলে, কষ্ট দিতে পারলেই তার শান্তি ও পরিতৃপ্তি। অন্যদিকে ওয়াসিমের ভেতর কাজ করছে জোবায়দার প্রতি ঘৃণা। এবং আর কখনো তার মুখাপেক্ষী না হওয়ার এক ধরণের স্বৈরাচারী বাসনা। সর্বোপরি এক অনড় আদিম অবসাদে তারা অবগাহন করে। পরস্পরের গোপন অঙ্গ নিয়ে মেতে উঠে তারা সেসবের আদিম ব্যবহারে। এসব ওরাল যৌনাচার তাদেরকে পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়। ওভাবেই যুক্তাবস্থায় তারা এমন কোনো বিছানার সন্ধান করে। কিন্তু বিছানায় যাওয়ার যেই বিচ্ছিন্নতা সেটা মানতে না পেরে দুজনই মেঝেতে শুয়ে পড়ে পরস্পরকে আলাদা হতে না দিয়েই। ঠা-া মেঝেতে শুয়েই জোবায়দা চিৎকার করে উঠে ওফ ঠা-া। সে পিঠ বাঁকা করে ফেলে ধনুকের মতো। পিঠের নিচে হাত দিয়ে তাকে আরো বেশি জড়িয়ে নেয় ওয়াসিম।
হাতিয়ে নিয়ে জোবায়দা নিজেই যন্ত্রটা স্থাপন করে। সক্রিয় হয়ে উঠার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় খালি পিঠে বিকট শব্দ হলো। দুজনই হেসে উঠল। পরস্পরকে কাপড়মুক্ত করলেও হালকা চাদরটা ওয়াসিমের গলাতেই আটকে ছিল। সেটা সে তাড়াতাড়ি জোবায়দার পিঠের নিচে গুজে দেয়। কোনো সমাধান ছাড়াই তারা এই অভিযাত্রা চালিয়ে যায়। এমনকি পরস্পরকে কোনো রকম ভালোবাসা না দিয়ে, কোনো প্রতিশ্রুতি না দিয়ে, কোনো সহানুভূতি না দিয়েই এই অমানবিক সঙ্গম তারা শেষ করে।
জোবায়দা ও ওয়াসিম এই নিদারুণ সঙ্গমের পরও কোনো রকম প্রতিক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়নি। আগে তারা যে যে অবস্থানে ছিল ঠিক সেই অবস্থান থেকে একচুলও নড়েনি। হতে পারে জোবায়দার ক্রাইসিস ওয়াসিম জানে। কিন্তু ওয়াসিমের ক্রাইসিস তো জোবায়দা জানে না। হয়ত জোবায়দা তার কোনো ব্যক্তিগত বিষয়ে জানতে চাইলেও ওয়াসিম এড়িয়ে যাবে এখনো। শরীরের এই ক্ষুদ্র অস্থায়ী লড়াই সেরে দুজনই সন্ধ্যার অন্ধকারে উঠে দাঁড়ায়। দুই উলঙ্গ মানব-মানবী। এই শারীরিক সংঘর্ষ যেই দুই মানব-মানবীর ভেতর কোনো সম্পর্কই তৈরি করেনি। পরস্পরকে ঘেঁটে যেন তারা কিছুই না পাওয়ার আস্বাদ নিয়ে নিজেদের কাপড়-চোপড় হাতিয়ে নিয়ে পরস্পরের রুমের দিকে পা বাড়ায় জোবায়দা ও ওয়াসিম। ওয়াসিম আর বের হয় না। সে তার জাজিমে ছেড়ে দেয় নিজেকে। অভিমন্যু আসলে দেখে ফেলতে পারে ভয়ে বই ও জুতো জোড়া ওয়াসিমের রুমের দিকে ঠেলে দেয় জোবায়দা।
পরদিন অফিসে গেলে সদানন্দ বসু একগুচ্ছ কাগজ ধরিয়ে দিয়ে তাকে বলে, এইগুলো কম্পোজ কর। তুমি তো মিয়া নষ্ট হয়া গেছ। তোমার তো চরিত্র খারাপ হয়ে যাচ্ছে। চমকে উঠে ওয়াসিম, মানে। কি করেছি আমি?
যারতার সঙ্গে মদ খাইতেছ। মদের টেবিলে বসে যাকে তাকে অস্বীকার করতেছ। বলে চলে সদানন্দ বসু। পিপীলিকার তো পাখা গজালে মরে, তোমার তো মিয়া পাখাও গজায়নি। মরবা কেমনে? সদানন্দকে আর সহ্যই করতে পারছে না ওয়াসিম। ওয়াসিম বুঝতে পারে মাহতাব সদানন্দকে তার সম্পর্কে যা-তা বলেছে হয়ত। সদানন্দের কথার পিঠে দশাসই কিছু একটা বলার জন্য তার মুখ চুলকাচ্ছিল। ওয়াসিম বলে, সাহিত্য সম্পর্কে নিজস্ব চিন্তা করার হক সবারই আছে দাদা। আমি অন্য কারো স্ট্রাকচারের ভেতর দিয়ে চিন্তা করতে চাই না। আমার অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে বা যাদের চিন্তা আমি পছন্দ করি তাদের স্ট্রাকচারের ভেতর দিয়ে চিন্তা করতে অভ্যস্ত।
ওয়াসিম একটা সূত্র আবিষ্কার করেছে, সে সব কিছুকেই নিজের সাবজেক্ট মনে করে। ফলে সে কারো আচরণে ব্যতীত হয় না। দৃশ্যগুলোকে সে মাথার ভেতর গেঁথে নেয় এবং ভাবে মানুষের প্রত্যেক আচরণে দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, তার অরিজিন ও সামাজিক অবস্থা তাকে কোথায় এনে দাঁড় করিয়েছে তাই সে বুঝে নেয়।
ওয়াসিম সদানন্দের দেয়া কাগজের তোড়া মেলে টেবিলে বসে পড়ে। কিছু কবিতা, দুয়েকটা গল্প, কয়েকটা প্রবন্ধ হাতে লেখা। সে ডেকস্টপে সেগুলো কম্পোজ করতে বসে যায়। কম্পোজ করতে করতে কাল ঘটে যাওয়া আকস্মিক ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে থাকে। মানুষের জীবনে কিছু একটা ঘটে যাওয়ার পর বা কিছু একটা বলে ফেলার পর সেটা আর ফিরিয়ে নেওয়া যায় না। অভিমন্যু বাসায় আসার আগে রাতে সে ঘুমিয়ে পড়েছিল। কিন্তু অভিমন্যুর মুখোমুখি হওয়ার সিচুয়েশন সম্পর্কে তার মনে কোথাও একটা অস্বস্তির জন্ম নিয়েছে। যদিও যৌনতা সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে যে, এটা একটা প্রয়োজনীয় এবং বেসিক জিনিস। উভয়ের বোঝাপড়া থাকলে কোনো দায়-দায়িত্ব ছাড়াই এটা সম্ভব। কিন্তু আমরা ইতিমধ্যে যৌনতাকে দায়-দায়িত্বের ভেতর দিয়েই উপলব্ধি করার এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছি, তার বাইরে আর কিছু আছে কিনা আমরা খতিয়ে দেখি না।
যদি প্রাগৈতিহাসিক যুগের কথা ধরা যায় বা মাতৃপ্রধান সমাজের কথা বা আদি সাম্যবাদী সমাজের কথা সেখানে পুরুষ আর নারীর ভেতর তো আলাদা কোনো পার্থক্য বা বৈষম্য ছিল না। যেকোনো সম্পর্কের নারী-পুরুষের মধ্যেই যৌনতার চল ছিল। একজন পুরুষ যেমন বহুজন নারীর সঙ্গে জড়িত থাকত তেমনি একজন নারীও বহুজন পুরুষের সঙ্গ উপভোগ করত। এটাকে বিশেষ কিছু হিসেবে দেখার চল বা ব্যক্তিগত অধিকারের জায়গায় নিয়ে যাওয়ার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। এবং এটাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসার পর মানে আমার স্বামী আমার স্ত্রী আমার প্রেমিকা ইত্যাদির পরপরই আসলে সম্পর্কের সন্ত্রাস শুরু হয়েছে। সম্পর্কের ভেতর অধিকারের প্রশ্নে ভায়োলেন্স প্রবেশ করেছে। আর এটা ছাড়া যে অন্য কিছু সম্ভব সেটা এখন অরিজিনগতভাবেই আমরা অস্বীকার করতে সদা প্রস্তুত।
যেমন অভিমন্যু মুক্তমনা ছেলে। হিন্দু-মুসলমানের আলাদা সম্পর্কও সে মানে না। সেটা তো সে নিজের জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছে। আবার তার সঙ্গে জোবায়দার সম্পর্কও প্রায় নড়বড়ে। বিয়ে ও বাচ্চার সূত্রে তারা হয়ত আবদ্ধ। ওয়াসিম মনে মনে ভাবে কিন্তু সেই অভিমন্যুও যদি জানতে পারে তার সঙ্গে গত সন্ধ্যায় ঘটে যাওয়া জোবায়দার যৌন-কারবার। তখন সেও এমন এক জায়গায় এসে দাঁড়াবে যে, যাকে সেও বলবে সম্পর্কের সন্ত্রাস। সে ওয়াসিমকেও প্রতারক ভাববে। এটাকে আলাদা ভাবে ছেড়ে দেয়ার কোনো ইতিহাস আমাদের জানা নেই। আর তাই এই ব্যাপারটা আকস্মিক ঘটে গেল যা আর কখনোই ফিরিয়ে নেয়া যাবে না। যেই ঘটনা বদলে দেবে তাদের তিনজনের সম্পর্কের পুরনো প্যাটার্ন। ওয়াসিম সেই ভবিষ্যৎ সম্পর্কের বাক নিয়েই চিন্তিত।
জোবায়দার ভেতর একটা স্বয়ংক্রিয় ব্যাপার আছে সেটাকে স্বতঃস্ফূর্ততাও বলা যায়, যেটা অধিকাংশ বাঙালি মুসলমান নারীর ভেতরই দেখা যায় না। কথাবার্তায় আগ্রাসী টাইপের মেয়ে হয়ত আছে কিন্তু যৌন আগ্রাসী মেয়ে নগণ্য সে ক্ষেত্রে জোবায়দা উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম। সেটা যেন তার চরিত্রে আলাদা এক ব্যক্তিত্ব যোগ করে। কিন্তু জোবায়দা এক গভীর খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছে অন্য আরো অনেক বাঙালি মেয়ের মতো। কারো ভবিষ্যতই আসলে নিশ্চিত না। এই অনিশ্চিত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য বা চক্রান্তের দান বলে ভাবে ওয়াসিম।
কিছু জিনিস গোপন থাকে না। আজ হোক কাল হোক অভিমন্যু জানবেই ব্যাপারটা। তখন হয়ত অভিমন্যু আর জোবায়দা নতুন বিষয় খুঁজে পাবে তাদের কলহের। কিন্তু যে কলহের ভেতর থাকতে মোটেই ইচ্ছুক ছিল না ওয়াসিম সে অহেতুক সেখানে ঢুকে পড়ল। ওয়াসিম বুঝে এখানে সিনিকাল হওয়া অসম্ভব। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের সম্পর্কের দ্বারা তাড়িত।
আর ওদিকে জোবায়দার ঘুম ভাঙে একটা নতুন সম্পর্কের আবেশে। জোবায়দার এখন বাক নেয়া দরকার সে জানে। না হলে এভাবে সে বেশিদিন এ জীবন চালিয়ে নিতে পারবে না। সে বাচ্চার দুধ গরম করতে করতে, বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে খাওয়াতে গতদিনে ওয়াসিমের সঙ্গে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে থাকে। প্রথমত ওয়াসিমকে তার খুবই নিরাপদ মনে হয়েছে। আর সে ওয়াসিমকে ফুসলিয়েছে বলে এক ক্ষুদ্র অপরাধবোধও আছে। তার চেয়েও বেশি সে আনন্দিত এই কারণে যে, সে সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছে এককভাবে। ওয়াসিমের দিক থেকে ব্যাপারটা কেমন সেটা সে ভাবে না। কারণ নারী তার নিজের দেহের সঙ্গে আর যাই হোক একটা মুগ্ধতা সবসময় বহন করে যা যে কোনো পুরুষেরই কাম্য। আর দায়হীন যৌন সম্পর্ক তো যে কোনো পুরুষই উপভোগ করার জন্য তৈরি এ রকমই অভিজ্ঞতা জোবায়দার আছে।
জোবায়দা দেখেছে প্রেম বা সম্পর্কের কমিটমেন্ট খুবই অস্থায়ী জিনিস। এই আবেগ খুব বেশিদিন টেনে নেয়া সম্ভব নয়। অন্তত এখন সম্ভব নয় সামগ্রিকভাবে এই সম্পর্কের কমিটমেন্ট বহন করা। যেমন প্রেমের মৃত্যু হয় বিয়েতে। আবার বিয়ে ছাড়া অন্য কোনো উপায়ও নেই প্রেমের পরিসমাপ্তি করার। কারণ বিয়ে মানেই বাস্তবতা। যে বাস্তবতার ভেতর দিয়ে অহরহ মানুষ নিজেদের বন্দিত্বকে মেনে নেয়। কারণ তারা ততক্ষণে দায়বোধে আবদ্ধ। এটা এমন এক দায় যা একই সঙ্গে সামগ্রিকভাবে মানুষ নিজেদের সর্বোচ্চ ক্ষমতাকেন্দ্রের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দেয়। টিকে থাকার প্রশ্নে, বংশ বিস্তারের প্রশ্নে তাকে মানবচৈতন্যে মুখোমুখি করে দেয়। এখানে এসে একজনের নিজের মতো গড়ে উঠা চিন্তার বৃত্ত সমাজ আস্তে আস্ত ভেঙে দেয়। তাকে টেনে নেয় নিজের বৃত্তে। আস্তে আস্তে বদলে দেয় তার নিজস্ব ধারণা। ফলে অভিমন্যুর সঙ্গে সম্পর্ক থাকা বা না থাকা তার কাছে সমান। ওয়াসিমকেও সে আলাদা কিছু ভাবে না। ওয়াসিমের প্রতি তার কোনো কমিটমেন্টও নেই। শুধু নতুন এক পরিধি হিসেবেই ওয়াসিম তার কাছে কাম্য। ওয়াসিমের সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক নিয়মিত করা মানে অভিমন্যুর ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়া সে ভাবে। অভিমন্যুর বৃত্ত থেকে বেরিয়ে নিজের বৃত্তের কাছে চলে আসা। যদিও অভিমন্যুর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক হয় না অনেক আগে থেকেই। কারণ জোবায়দা-অভিমন্যুর সম্পর্কটা এখন এমন এক জায়গা এসে দাঁড়িয়েছে, যেটা নেহাত সামাজিক বৃত্তের প্রশ্ন। বিয়া করছ বউ চালাইতে পারো না, তো উপোস থাক। টাকা না থাকলে যেমন পতিতালয়ে যেতে পারো না, তেমনি সংসার চালাইতে না পারলে বউয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করাও অন্যায়। এটা বুঝে অভিমন্যুও চুপচাপ থাকে। কিন্তু ওয়াসিমের ক্ষেত্রে এটা জোবায়দার নিজস্ব প্রয়োজন, কোনো সামাজিক দায়-দায়িত্বহীন। কিন্তু পুরুষতন্ত্রের একজন প্রতিনিধি হিসেবে এটা অভিমন্যুর পক্ষে কখনো মেনে নেয়া অসম্ভব এবং সেটা ভেবেই ওয়াসিমের প্রতি আরো বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠে জোবায়দা।
কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছিল তখনই সদানন্দ বসু বলে, শোন মিয়া আজকে পাবলিক লাইব্রেরিতে একটা কবিতা পাঠের আসর আছে তুমি গিয়া অইটা দেইখাও আস আর কি কি ঘটছে কারা কারা কবিতা পড়েছে এইসব টুকাইয়া আস। আস্যাইনমেন্টগুলো এভাবেই দেয় সচরাচর সদানন্দ। এমনিতেই প্রতিদিন ওয়াসিম অন্তত একবার শাহবাগ মোড়ে যাবেই। আগে নিয়মিত পাবলিক লাইব্রেরিতে পড়তে যেত। কিন্তু হঠাৎ করে পাবলিক লাইব্রেরিতে ইউনিভার্সিটির পোলাপানরা লেখাপড়া করতে শুরু করলে বসার জায়গার অভাবে সে যাওয়া প্রায় ছেড়ে দেয়। কিন্তু এর আশপাশ দিয়ে ছবির হাটে যায়। লাইব্রেরির বইমেলাগুলোতে ঢু মারে।
পাবলিক লাইব্রেরিতে ঢোকার মুখেই সে ব্যানারটা দেখতে পায়। জাতীয় বিশ্বম্ভর কবিতা সমিতি। এই নামধারী সংগঠনগুলো যে আসলে কবিতা নিয়ে ভাড়ামি ছাড়া আর কিছুই করে না সেটা সে আগে থেকেই জানে। অডিটরিয়ামের ভেতর ঢুকে প্রচ- আলোর ক্ষমতা থেকে চোখ বাঁচিয়ে সে অডিয়েন্সের একদম পেছনের দিকে চলে যায়। পেছনে বসে সে দেখতে থাকে মঞ্চে বসা অতিথিদের। কয়েকজন ছড়াকার। তার হাসি পায়। বাংলাদেশি বাংলা কবিতার শাসক কয়েকজন ছড়াকার। একটা এই সমিতি সভাপতি আরেকটা সাধারণ সম্পাদক। যারা কবিতা পড়ছে তাদেরকেও তেমন চিনে না ওয়াসিম। তার মাথা ঘুরে উঠে।
এই সমিতির সভাপতি ছড়াকার উপদ্রুত সামিল ছড়াকে কবিতা বানিয়ে কবিতা নিয়ে যা-তা বলছে তার বক্তৃতায়। খানিক হাসছে খানিক কান্নার ভান করছে। বেশিরভাগই বলছে আমরা স্বাধীন হয়েছি, আমরা স্বাধীন জাতি। আমরা মুক্ত জাতি এই সব। কারণ পাশেই সরকারের একজন সচিব কবি বসে আছেন। সম্ভবত তার বদান্যতায় এই অনুষ্ঠান হচ্ছে। আর তাই বক্তারা সরকারের যতরকম চাটুকারিতা করা যায় এবং এই লাইনে কতরকম তেলবাজি আছে সবই করছে তারা। বেশ কিছুক্ষণ কবিতা পাঠ শুনলো ওয়াসিম। কবিতার নামে যা পড়া হলো তা তার কাছে কবিতা বলে মনে হলো না। অন্তরদেশ থেকে কোনো সাড়া পেল না সে। কবিতার নামে ক্ষমতাসীন সরকারের গুণগানে মুগ্ধ সবাই। পুরো অনুষ্ঠানটাই তার কাছে এক তৃতীয় শ্রেণির রাজনৈতিক তোয়াজসভা বলে মনে হলো। তবুও সে তাদের কাছ থেকে অংশগ্রহণকারীদের নামধাম ইত্যাদি লিখে নিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়ল। পাবলিক লাইব্রেরির গেটে এসে তার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় প্রথাবিরোধী কবি আহমদ ইব্রাহিম খলিলের সঙ্গে। আহমদ ইব্রাহিম খলিল নিজেকে প্রথাবিরোধী কবি বলেই জাহির করে। যদিও তার কবিতা কোথাও ছাপা হয়েছে বলে মনে পড়ে না ওয়াসিমের। তবু সারাক্ষণ কবিতা কবিতা করেই পড়ে থাকে শাহবাগ এলাকায়। কোনো কাজবাজ করে না। খুবই নেতিবাচক তার ধ্যানধারণা। সারাদিন অন্য কবিদের গালাগালি করছে। সিনিয়র জুনিয়র সবাইকে একই কাতারে ফেলে সে গালাগালি করে। আবার প্রচারের মনোবাসনাও খুব প্রবল তার, ওয়াসিম লক্ষ্য করে। ওয়াসিমকে দেখেই হাতে জ্বলতে থাকা সিগ্রেটে একটা টান দিয়ে বলে, কি খবর কবি? ছড়ার অনুষ্ঠানে এসেছ বুঝি? আস অই পাশে দাঁড়াই বলে ওয়াসিমকে একপাশে নিয়ে যায়। সে বলতে থাকে, রাষ্ট্রের মাথায় ঘা হয়েছে বুঝলা? তাই দেশে সব ছড়াকারই আজ কবিতার অভিভাবক। যে অনুষ্ঠানে গেলা একটাও কবি দেখছো? তোমরা মিয়া নিজেরাও কবি না। তোমার বস সদানন্দ বসু ওরে কি কবি বলবা? শালা হাড়ে হাড়ে বদমাশ একটা। শুনতে ওয়াসিমের ভালোই লাগে। কিন্তু ওয়াসিম জানে এসবই প্রায় অন্তসারহীন কথাবার্তা। ভেতরে ভেতরে সদানন্দের সঙ্গেও যোগাযোগ রাখে ইব্রাহিম। ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে শাহবাগে অভিযোগ আছে, সে যাদের সারা দিন গালাগালি করে, যাদের টাকায় মদ খায়, তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েই সে বাড়িভাড়া দেয়। বিপদে পড়লেই তাদের কাছে গিয়ে হাজির হয়।
ইব্রাহিম খলিল কিছুই করে না বহু বছর ধরে। সারা দিন শাহবাগে ঘুরাঘুরি করে। একসময় হয়ত কবিতা-গল্প লিখতো কিন্তু সবাইকে সারা দিন গালাগালি করাই এখন তার একমাত্র সাহিত্যকর্ম। শাহবাগে আসা প্রত্যেক তরুণ কবিদের সঙ্গেই আগে তার সাক্ষাৎ হয়। প্রতিদিন কোনো না কোনো তরুণকে তার সঙ্গে দেখা যাবে। তরুণদের সঙ্গে খুব দ্রুত ঘনিষ্ঠ হতে তার জুড়ি নেই। কিন্তু প্রায়ই সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কারণ কবিতা সাহিত্য করে ঢাকা জয় করতে আসা তরুণরা খুব দ্রুতই তার ব্যবহারে আশাহত হয়ে তার কাছ থেকে পালায়। কারণ প্রায় সারা দিন সে কোনো না কোনো কবি-সাহিত্যিকের বিরুদ্ধে তরুণদের কানভারী করে। তরুণরা এসব শুনে প্রথম দিকে খুবই উৎসাহিত হয়। কারণ ইতিমধ্যে তারাও কোনো না কোনো সিনিয়রদের দ্বারা বঞ্চিত। কিন্তু কয়েকদিন পরই সে তরুণটির কাছ থেকে টাকা ধার নেবে এবং তারা অক্লান্ত নেতিবাচক প্রচার করে তরুণটাকে দিশেহারা করে ফেলে এবং তরুণটাও নিজের ভবিষ্যৎ দেখতে পায় আহমদ ইব্রাহিম খলিলের মতো, সে সারা দিন শাহবাগে বিভিন্ন লেখক-কবিকে গালাগাল করছে। নিজের এই ভবিষ্যৎ থেকে তখন ছুটে পালায় তরুণ কবি ও ইব্রাহিম খলিলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে থাকে। সবাই ইব্রাহিম খলিলকে পছন্দ করার ভান করে। আবার সবাই জানে খলিল শাহবাগে বসে রাজ্যসুদ্ধ সবারই বদনাম করে। এজন্য তাকে কেউ কাজবাজ দেয় না। সামান্য পয়সাকড়ি দেয় হয়ত। এজন্যই বছরের পর বছর চাকরিহীন কাটায় সে এবং এ ধরনের একটা জীবনে সে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। ওয়াসিম আর ইব্রাহিম খলিল যখন কথা বলছিল তখনই তাদের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল জিন্সের প্যান্ট ও টিশার্ট পরিহিত এক নারী। তাকে দেখেই হেই আলিয়া বলে ডাক মারে ইব্রাহিম। মেয়েটা তাদের কাছে এসে দাঁড়ায়। ওয়াসিম আলিয়াকে আগেই দেখেছে কিন্তু তার সঙ্গে কখনো দেখা হয়নি তার। ইব্রাহিম তাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। আলিয়াকে দেখতে সুন্দরীই বলতে হবে। লম্বা বেশ যতœ করে চুল আচড়ানো, লাল নেইলপলিশ, লাল লিপস্টিকে বেশ সেজেগুজে থাকে সে। ইব্রাহিম বলে তোমাদের পরিচয় আছে না? এ হচ্ছে কাঁচাবাজার পত্রিকার হবু সাহিত্য সম্পাদক। ইচ্ছে করেই খোচাটা মারে ইব্রাহিম। হ্যাঁ ওনাকে দেখেছি কিন্তু কখনো কথা হয়নি। একটা আঞ্চলিক টানে আলিয়া কথা বলে। আলিয়া হাত বাড়িয়ে দিলে ওয়াসিমও হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে। ইব্রাহিম বলে আর ও হচ্ছে আলিয়া। আবৃত্তি করে, কবিতার অনুষ্ঠান উপস্থাপনা করে। আলিয়া বেশ উৎসাহ দেখায় ওয়াসিমের ব্যাপারে। বলে, সদানন্দ দা তো আমাদের খুবই কাছের লোক। আলিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আমার কাজ আছে বলে চলে যায়। আলিয়া চলে যাওয়ার পর ইব্রাহিম আবার বলতে থাকে, নাম্বার ওয়ান খানকি একটা বুঝেছ, সারা দিন অ-কবিদের চোদা দিয়ে বেড়ায়। দুই টাকার মেধা নেই মাথায়। অই আমলা ছড়াকারদের পিছনে ঘুর ঘুর করে সারা দিন। অই আমলাগুলা মেয়েটারে মন্ত্রীদের কাছে পর্যন্ত পাঠায় উপঢৌকন হিসেবে। এগুলাই চলতেছে বুঝলা? হ্যাঁ ঠিক আছে ওয়াসিম বলে। ইব্রাহিম বলতে থাকে শালা এইটা বলে স্বাধীন দেশ কেমনে স্বাধীন, কে কে স্বাধীন। স্বাধীনভাবে একজন কবি কি বাঁচতে পারে এই দেশে? স্বাধীনভাবে একজন কবি কি তার পছন্দের পেশা বেছে নিতে পারে। তাহলে কবিতা কেমনে হবে। সারা দিন না খাইয়া বছরের পর বছর কোনো চাকরি বাকরি নেই। সেই টেনশনেই তো আমার মাথার চুল অর্ধেক হয়ে গেল। মাদারচুদরা সব কিলার আর ফাকার বুঝলা। তোমারে না খাইয়ে মারবে আর মহিলাদের সোজা লাইনে টেনে নামাবে। লিখতে পারে না ছড়া আবার কবিতা চোদায়। একটা কবিও নাই ঢাকা শহরে। সব শালা হতে চেয়েছিল কবি। প্রথম বই অথবা প্রথম বইয়ে কয়েকটি কবিতা লেখার চেষ্টা এই তাদের দৌরাত্ম্য। কবিতার রাজনীতি কইরা কবি হউন যায় না। তাই ছড়াকাররাই আজ দেশের কবিতা জগৎ শাসন করে।
আচ্ছা ঠিক আছে ইব্রাহিম ভাই, আমার কাজ আছে পরে দেখা হবে বলে ওয়াসিম সরে পড়তে চায়। যাও যাও সত্য কথা তো আর শুনবা না। কাল এসো আরেক নাটক দেখবা। কাল কবিদের মাঘ পুরস্কার দেয়া হবে বুঝলা? জাদুঘরে সুফিয়া কামাল অডিটরিয়ামে চইলা আইসো। আর আমাদের কবিতাটবিতা ছাপো। ওয়াসিম বলে আচ্ছা ঠিক আছে কবিতা দিয়েন। আরেকবার নিয়েছিল ওয়াসিম তার কাছে কবিতা। সদানন্দ ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। বলেছিল ও কবিতা লিখতে পারে না, একসময় লেখা আট-দশটা কবিতা বারেবারে ছাপে। এসব ভাবতে ভাবতে হাঁটতে থাকে ওয়াসিম।