তখন সকাল আটটা কি সাড়ে আটটা হবে। শান্ত গ্রামটির ঘুম সবে ভেঙেছে। দেশের অবস্থা ভালো নয়। ঢাকা শহরকে নরককু-ে পরিণত করার পর পশ্চিমা খান সেনারা দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ছে। একে একে জেলা সদরগুলোর পতন হচ্ছে। প্রতিটি জায়গায় মানুষ মারছে নির্বিচারে। জেলা শহরগুলো কব্জায় নেয়ার পর তাদের অভিযান সম্প্রসারিত হচ্ছে আরো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। থানা সদর এবং আরো দূর গ্রামগঞ্জে। বিশেষ করে সীমান্ত অঞ্চলে। দেশের অবস্থা ভালো না হলেও মানুষ দৈনন্দিন কাজ-কর্ম চালিয়ে যাচ্ছিল শান্ত গ্রামগুলিতে। এমনই একটা গ্রাম শংকর ঘোষ। নাম শংকর ঘোষ হলেও ঘোষদের কোন চিহ্ন নেই গ্রামে। গ্রামের অধিবাসী প্রায় সবাই মুসলমান। তবে পাশের গ্রাম জগৎপুর হিন্দু অধ্যূষিত। এরকম শান্ত চেহারার একটি গ্রামে পশ্চিমা সৈন্যরা এসে হাজির হবে, তা কেউ স্বপ্নেও ভাবেনি। গ্রামে গ্রামে তখনো মুক্তিবাহিনী (গ্রামের অধিবাসীদের ভাষায় মুক্তি) গড়ে ওঠেনি। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আছে অবশ্য কয়েকজন। তাদের প্রায় সবার বাড়ীঘর এই গ্রামে। দু’চারজন এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে। তারা নিকটবর্তী শহরের মানুষ। কিন্তু যা কেউ কল্পনা করে নি তাই ঘটলো। সরকার বাড়ীর কাজের মহিলা জয়নাব ওরফে জয়না দৌড়ে এসে খবরটা দিল। হাঁফাতে হাঁফাতে সে বললো, ফেরুজ, তরা এহনো নাস্তা করস? গেরামে যে ম্যালেটারী ঢুকতাছে এই খবর আছে? খবরটা যাকে সম্বোধন করে দেয়া হলো সেই ফিরোজ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার সঙ্গে একত্রে বসে নাশতা করছিল দুই ভাই। ছোট ভাইটি ফিরোজের বন্ধু। ওরা দুই ভাই ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ওদের পরিবার শহর ছেড়ে এসে এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে কয়েকদিন আগে। এইটা কি কও তুমি জয়না বু? মিলিটারী এই গ্রামে আসবো ক্যান? এহানে কি আছে? না কোন আওয়ামী লীগ, না কোন হিন্দু। তুমি সব কিছু বেশী বেশী কও জয়না বু। বেশ জোরে জোপরে কথাগুলো বললো ফিরোজ। কিন্তু শেষের দিকে তার গলার স্বর কেমন যেন কেঁপে উঠল। জয়না বললো দ্যাখ ফিরোজ, জয়না কোন সময় মিছা কথা কয় না। বিশ্বাস না অইলে ফুফার বাড়ীর হেই মুরা গিড়য়া দেখ গা। আমি নিজের চোখে দেখলাম, খাকি পোশাক পরা ম্যালেটারী ট্রাক লইয়া আইছে। একজন একজন কইরা লাফাইয়া বন্দুক লইয়া নামতাছে। তরা আর বাড়ীতে থাহিস না। এক কাম কর, ম্যালেটারী আওনের আগেই বিলকিসের শ্বশুড় বাড়ী চইলা যা। বিলকিস ফিরোজের চাচাতো বোন। পাশের গ্রামে বছর দেড়েক আগে তার বিয়ে হয়েছে। ঐ গ্রামটা রাস্তা থেকে আরো দূরে, একটু ভিতরের দিকে। দেখতে দেখতে সমগ্র বাড়ীটায় আতঙ্ক মিশ্রিত চঞ্চলতা ছড়িয়ে পড়লো। বাড়ীর মুরুব্বীরা একত্র হলেন। এরা সবাই সম্পর্কে ফিরোজের চাচা। এদের মধ্যে যিনি বয়োজেষ্ঠ তিনি জয়নার দেয়া খবর নিশ্চিত করলেন। বললেন, সত্যিই গ্রামে মিলিটারী ঢুকতাছে। তারা এই দিকেই আসতাছে। তাগোরে পথ দেখাইয়া আনতাছে সিরাজুল মুনশী। তিনিও অল্পবয়সী সবাইকে পাশের গ্রামে বিলকিস এর শ্বশুড়বাড়ীতে যেতে বললেন। ফিরোজ ও তার বন্ধুরা পাশের গ্রামে এসে উপস্থিত হলো। কিন্তু মন পড়ে রইল ছেড়ে আসা গ্রামে সরকার বাড়ী অর্থাৎ ফিরোজদের বাড়ীতে। এই গ্রাম থেকে বাড়ীটা স্পষ্ট দেখা যায়। মিলিটারী সত্যি সত্যি লাইন ধরে এগিয়ে আসছে। কাঁচা রাস্তা ছেড়ে ক্ষেতের আল ধরে এগুচ্ছে তারা। এরা যায় কোথায়? আমাদের বাড়ীতে কি? খুব নীচু গলায় ফিস ফিস করে বলে ফিরোজ। তোমাদের বাড়ীতে কেন যাবে? তোমাদের কেউ কি আওয়ামী লীগ করে? বরঞ্চ মুসলিম লীগ সমর্থক পাকিস্তানপন্থী মানুষ আছে একঘর, বললো ফিরোজের বন্ধু মানিক। তিনজন একটা বড় কড়ই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো মিলিটারীর গতিবিধি। এক লাইন ধরে এগিয়ে চলেছে তারা। আগে আগে পথ দেখিয়ে চলেছে সিরাজুল মুনশী। শ্মশ্রুধারী লুঙ্গি ও পাঞ্জাবী পরিহিত সিরাজুলকে দূর থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সিরাজুলের সাথে তো তাদের কোন শত্রুতা নেই, মনে মনে ভাবলো ফিরোজ। তবে কেন সে এদের নিয়ে তাদের বাড়ীর দিকে যাচ্ছে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বোঝা গেল ওরা ফিরোজ বাড়ীতে যাচ্ছে না। ওদের বাড়ী পাশ কাটিয়ে, পুকুরের ধার ঘেঁষে তারা এগিয়ে চলেছে অন্য একটি গ্রামের দিকে। সেই গ্রামটি হচ্ছে হিন্দু অধ্যূষিত জগৎপুর। জগৎপুরে পৌঁছতে ওদের বেশী সময় লাগলো না। এই গ্রাম থেকে জগৎপুর ও স্পষ্ট দেখা যায়। বাড়ী, ঘর-দোর, নিকানো উঠান, খড়ের গাদা, জবা ফুলের গাছ, ছোট্ট একটা পুঁজার ঘর, ভিতরে দেব-দেবীর মূর্তি। অন্যান্য গ্রামের মত এই গ্রামের মানুষ ও সকালের আলস্য কাটিয়ে নিত্যকর্মে হাত লাগাতে শুরু করেছে। তাদের কোন ধারণা নেই কি মহাবিপদ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। দেখতে দেখতে শান্ত, ছোট্ট গ্রামটাকে তিন দিক থেকে ঘিরে ফেললো উর্দি পরা মিলিটারীরা। কালো পোশাকের মিলিশিয়ারা তখনো আসেনি এদেশে। রাজাকার-আলবদরও পয়দা হয়নি। তবে শান্তি কমিটি গঠিত হয়েছে সর্বত্র, হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য। আচমকা কানে তালা লাগানো শব্দ হলো, গ্রেনেড বিস্ফোরণের। গর্জে উঠল একযোগে স্টেনগান, মেশিনগান, পিস্তল, রাইফেলসহ সকল অস্ত্র। গান পাউডার ছিটিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো ঘরবাড়ীগুলোতে। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলো পুরো গ্রামটি। তুলার মত উড়ে গেল খড়ের গাদা। ছুটতে ছুটতে গুলী খেয়ে লুটিয়ে পাড়লো পলায়নপর অসংখ্য মানুষ। সবচেয়ে মর্মান্তিক ছোট শিশুদের হত্যা দৃশ্য। ছোট ছোট পায়ে ছুটন্ত অবস্থায় গুলী খেয়ে ফুটবলের মত গড়িয়ে যাওয়া সেই দৃশ্য দেখে চোখ ভিজে উঠলো তিনজন তরুণের। তারা বুঝতে পারলো আর লুকিয়ে থাকা যাবে না। লড়াই আসন্ন। ছোট্ট গ্রামটিকে ধ্বংস স্তূপে পরিণত করতে তাদের বেশী সময় লাগলো না। তারপর শুরু হলো লুটপাট। গরু-বাছুর থেকে শুরু করে আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া তৈজসপত্র, এক কথায় সব কিছু লুটপাট করতে লাগলো এক শ্রেণীর লুটেরা। এরা বেশীরভাগই জগৎপুরের আহত ও নিহতদের প্রতিবেশী। বৈরী সময় তাদের নির্লজ্জ ও হিং¯্র করে তুলেছে। ঠিক সেই সময় বেতারে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ প্রচারিত হলো। পূর্ব বাংলায় গণহত্যা ও নারকীয় ধ্বংস যজ্ঞের প্রধান হোতা তার ভাষায় ‘পাকিস্তান ও ইসলামের শত্রুদের’ নিমর্ূূল করার প্রত্যয় পূনর্ব্যক্ত করার পাশাপাশি প্রহসনমূলক এক সাধারণ ক্ষমার কথা ঘোষণা করলো। যারা অস্ত্র পরিত্যাগ করে ‘স্বাভাবিক জীবনে’ ফিরে আসবে তাদেরকে নাকি ক্ষমা করা হবে, সাহায্য করা হবে, ইত্যাদি। ইয়াহিয়ার ভাষণ আংশিক শুনে এত দুঃখের মধ্যেও হাসি পেল ফিরোজ ও তার দুই বন্ধুর। একদিকে চলমান দৃশ্যমান গণহত্যা ও অপরদিকে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা। ইয়াহিয়ার মতো রক্ত পিপাসু নরখাদককেই এমন মিথ্যাচার ও প্রতারণা মানায়। বন্ধ কর রেডিও। চিৎকার করে উঠলো ফিরোজ। ছুড়ে ফেলে দাও পাশের ডোবায়। রেডিও অবশ্য ছুড়ে ফেলা হলো না। কারণ ওটা তাদের নয়। রেডিওটা ফিরোজের চাচাতো বোন বিলকিসের। জগৎপুরের আগুন জ্বলতে লাগলো সারাদিন ধরে। সেই সঙ্গে থেকে থেকে লুটপাট। ঘটি-বাটি, লেপ-কাঁথা বিছানা বালিশ কোন কিছুই বাদ গেল না। আশ্চর্য! এই লোকগুলোর অনেকেই জগৎপুরের অধিবাসীদের সঙ্গে পাশাপাশি বসবাস করেছে যুগযুগ ধরে। একজন অপরজনকে ভাই বলে ডেকেছে। আজ যুদ্ধের আগুন ও গনহত্যার হিং¯্রতা তাদের ভেতরে লুকিয়ে থাকা বর্বরতাকে উস্কে দিয়েছে। তারা বর্বর পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণে প্রায় ধ্বংসপ্রাপ্ত একটি গ্রামে পড়ে থাকা আহত ও নিহত মানুষের মরদেহ অবলীলাক্রমে ডিঙ্গিয়ে ধ্বংসস্তূপের ভেতর নানা জিনিস হাতড়ে বেড়াচ্ছে। দৃশ্যটি দেখে তিনজন তরুনের মনে হলো একপাল শকুন যেন একটি মরা গরুর উপর ঝাপিয়ে পড়ে কাড়াকাড়ি, লুটোপুটি করে ধারালো ঠোঁট আর নখ দিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে খাচ্ছে। তিন তরুণের রক্ত গরম হয়ে উঠলো এই বীভৎস তা-ব দেখে। হাত নিশপিশ করতে লাগলো মানুষরূপী জানোয়ারগুলোকে মারার জন্য। কিন্তু তারা নিরুপায়। পরিস্থিতি তাদের অনুকূল নয়। সবচেয়ে বড় কথা তাদের হাতে কোন অস্ত্র নেই যা দিয়ে তারা এই ঘৃণিত গৃধিনীদের বধ করতে পারে। তবুও একদম চুপচাপ এই দৃশ্য বেশীক্ষণ দেখা সম্ভব হলো না। এক পর্যায়ে প্রায় বৃদ্ধ এক লুটেরা-কে ফিরোজ তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় থামতে ইশারা করলো। কাছে গিয়ে দেখলো বৃদ্ধটি একটি বাঁশের বাঁক ঘাড়ে ঝুলিয়ে একদিকে লেপ-কাঁথা-বালিশ ও অপরদিকে কিছু হাড়ি-পাতিল বাসন-কোসন নিয়ে যাচ্ছে। ফিরোজের ভাব দেখে বোঝা গেল লোকটিকে সে চেনে। খানিকটা বিদ্রƒপের সুরেই সে লোকটিকে জিজ্ঞেস করলো, কি গো মিয়ার পুত, কইত্থনে আনলেন এই গুলান? বৃদ্ধ আচমকা ওই প্রশ্ন শুনে থতমত খেয়ে গেল। খানিকটা ইতস্ততঃ করে জবাব দিল, জগৎপুর থনে। ফিরোজ বললো, হেইডা তো বুঝতেই পারছি। ক্যান করলেন এই কাম? বাঁচবেন কয়দিন আর? বুড়ো বললো, কামডা খারাপ কি করছি? আমি এইগ্লা না নিলে অন্য কেউ নিতো। বলে সে চুপ করে গেল। ফিরোজ বললো, এই যে গন্ডগোলের মধ্যে জগতপুরে যাইয়া এইসব করলেন, যদি মিলিটারীর সামনে পড়তেন তাহলে কি হইতো। মারলো হইলো না আফনেরে মিয়ারপু? না, না, বৃদ্ধ বললো, আমগোরে মারবো ক্যা? আমরা তো মুসলমান। মারছে তো হিন্দুগোরে। ফিরোজ বললো, আচ্ছা। ম্যালেটারী তাইলে খালি হিন্দুগোরে মারে, না? তাইলে এই যে আমলীগের (আওয়ামী লীগ) মানুষটি, হেইডিরে মেলেটারী মারে ক্যা? তারা কি সব হিন্দু? বৃদ্ধ আবার অপ্রস্তুত হয়ে যায়। মাথা চুলকিয়ে বলে, হেইডা কবার পামু না বাফু। আমরা রাজনীতিক বুঝিও না, ঐতা করিও না। ফিরোজ গলার স্বর নীচু করে বললো, না কিছু বোঝেন না। কিন্তু এই বুড়া বয়সেও লুটপাট করা ভাল পারেন। কিছু কইলেন নাহি আমারেÑ বৃদ্ধ প্রশ্ন করলো। ফিরোজ বললো না। যানগা মিয়ার পু। বাড়ীতে যান। বাড়ীর মাইনষে আপনের আইজকার কামাই দেখলে খুশী অইবো। বুড়ো আর কিছু না বলে ধীরে ধীরে চলে গেল। ওদিকে ফিরোজদের বাড়ীতে জগৎপুরের ঘটনা নিয়ে অন্যধরনের তোলপাড় শুরু হলো। এই বাড়ির অনেকের সাথে জগৎপুরের অধিবাসীদের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ট। বিশেষ করে ফিরোজদের চাচাদের বন্ধু-বান্ধব ও কয়েকজন সহপাঠী রয়েছেন ঐ গ্রামে। এঁরা বলতে গেলে ছেলেবেলা থেকে এক সাথে বড় হয়েছে। জগৎপুরবাসীর এই ভয়াবহ বিপদের সময়ে তাদের পাশে গিয়ে অবশ্যই এই বাড়ীর মানুষের দাঁড়ানো উচিত। কিন্তু পাশাপাশি হানাদার বাহিনীর ভয় এবং তাদের সহযোগীদের বক্রদৃষ্টি তাদেরকে খানিকটা দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছে। এক দিকে বিপন্ন মানবতার আহ্বান, অন্যদিকে নিজেদেরও পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ- এই দোটানোর মধ্যে পড়ে বেশ কিছুক্ষণ দোদুল্যমান অবস্থায় রইল ফিরোজদের বাড়ি অর্থাৎ সরকার বাড়ীর মানুষগুলি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মানবতারই জয় হলো। বাড়ীর মুরুব্বীদের শলা পরামর্শের পরে স্থির হলো বিপন্ন জগৎপুরবাসীকে সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। সরকার বাড়ী হতে কয়েকজন মিলে দুপুরের পরেই রওয়ানা হয়ে যাবে জগৎপুরে। এদের নেতৃত্বে থাকবেন হাজী চাচা। হাজী চাচা হাজী হলেও উদার মনের মানুষ। ভাইদের মধ্যে তিনি সবার ছোট। কাজেই পরবর্তী প্রজন্মের মানুষ অর্থাৎ ভাতিজা-ভাগ্নেদের সঙ্গে বয়সের নৈকট্য হেতু তাঁর আন্তরিকতা বেশী। হাজী চাচা রওয়ানা হবেন জগৎপুর গ্রামে। তার সঙ্গে যাবে ৫/৭ জন তরুন যুবক। তারা বাড়ির বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। ঠিক এই সময় বাড়ির অন্য শরীকের সদস্য হাজী চাচার একজন চাচাতো ভাই এসে হাজির। ইনি একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। অত্যন্ত সাম্প্রদায়িক মনোভাব সম্পন্ন মানুষ। বর্তমানে পাক হানাদার বাহিনরি নৃশংস অভিযানের বিশিষ্ট সমর্থক। তিনি এসেই বললেন, হাজী, ক্যান তুমি এই হেন্দুগুলানরে সাহায্য করবার চাও? ওরা তো আমগোর দুশমনÑ পাকিস্তানের দুশমন। এইগ্লারে সাহায্য করা তো ইসলামের সঙ্গে দুশমনি। হাজী চাচা কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে বললেন, মাস্টার ভাই, জগৎপুরের মানুষটি মানুষই, অন্য কিছু না। তারাও এক খোদারই সৃষ্টি। তারা যুগ যুগ ধইরা আমগোর প্রতিবেশী। ঐ গেরামে আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব আছে, আপনারও থাকতে পারে। অহন মানুষ হইয়া মানুষের বিপদে আমরা কেমনে মুখ ফিরাইয়া রাহি। তার উপর তারা আমগো প্রতিবেশী। আমরা এক সঙ্গে বড় হইছি, লেহাপড়া করছি। এক সাথে কত খেলাধূলা করছি। আমগোর বাপ-দাদারাও তাগোর সঙ্গে মিশছে, এক সঙ্গে চলাফিরা করছে। এখন তাগোর ঘোর বিপদ। আমরা কেমনে তাগোর এই বিপদে হাত পা গুটাইয়া থাকি? তাইলে মানব জনমের অর্থ কি মাস্টার ভাই? হাজী চাচার এসব কথা শুনেও মাস্টার সাহেবের মন গললো না। তিনি বললেন, আমি এত কিছু বুঝি না হাজী। আমরা মুসলমান, তারা হিন্দু। তারা কোনদিন আমগোর ভালা চায় নাই। আমগোরে দেখার পারে নাই। অগোর সঙ্গে আমগোর কোন মিল মহব্বতের দরকার নাই। আর আগে যাই হইছে, এহন সময়ডা খুবই খারাপ। হাজী চাচা বললেন, সময় খারাপ তো সবার জন্যই মাস্টার ভাই। কারো জন্য বেশী খারাপ, কারো জন্য কম। এই দুঃসময়ে তো মানুষের সাহায্য মানুষের দরকার। মাস্টার সাহেব বুঝতে পারলেন এদেরকে আটকানো যাবে না। এরা জগৎপুরে যাবেই। তিনি খানিকটা উত্তপ্ত স্বরেই বললেন, তাহলে তোমরা হেন্দুগুলার কাছে যাইবা-ই, না? তার প্রশ্নের উত্তর দিল না কেউ। সবাই চুপচাপ। এবারে মাস্টার রেগে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, ক্যান যাইবা ঐ মালাউনগুলারে বাচাইতে? এবারে হাজী চাচা মাস্টার সাহেবের কাছে এগিয়ে এলেন। তার চোখের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে কিন্তু দৃঢ় স্বরে বললেন, আমরা যাইতাছি দুইটা কারণে মাস্টার ভাই। একটা কারণ হইল আমরা সবাই মানুষ। হেরাও, আমরাও। আরেকটা কারণ হইল আমরা মুসলমান। জালিমের অত্যাচারে বিপন্ন মানুষরে রক্ষা করা আমার অবশ্য কর্তব্য। এই কথা বলে সরকার বাড়ীর হাজী আজিজুর রহমান ঘুরে দাঁড়িয়ে জগৎপুরগামী কাঁচা সড়কের পথে পা বাড়ালেন। দৃঢ় পায়ে তাকে অনুসরণ করলো সাতজন যুবক। সিরাজুল মাস্টার অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলেন জগৎপুরের পথে আগুয়ান মানুষগুলোর দিকে। ঐদিন বিকালেই দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশে যাওয়ার উদ্দেশ্যে শংকর ঘোষ থেকে বহুদূরে জিঞ্জিরাম নদীর তীরে অবস্থিত বাঘারচর নামক গ্রামের পথে পায়ে হেঁটে রওয়ানা হলো ফিরোজ ও তার দুই বন্ধু। আলী কবীর ২৮.৫.২০১৫