কোনো মানুষ বা প্রাণী যেমন অচল কিছু নয়, কোনো জাতি বা রাষ্ট্রও তেমনি অচলায়তন নয়। যুগে বা সময়ে তার পরিবর্তন ঘটে। কোনো কোনো সময় তা সাথে সাথে টের পাওয়া যায়, কখনো বা অনেক পরে। উৎসবের আমেজ ভালোবাসা বা পরিবেশ কিভাবে পাল্টে যায় তা এখন বেশ টের পাই। মানুষ যত এগুচ্ছে, তার জীবনে যত নতুন নতুন বিষয় ঢুকছে তত উৎসবের দৃশ্যপট যাচ্ছে পাল্টে। একটা সময় ঈদ ছিল ধর্মীয় আর ভাবগম্ভীর পরিবেশের কিছু একটা। একথা বলছি না এখন মানুষ এই উৎসবে ধার্মিকতাকে সাথে রাখেনি। রেখেছে তো বটেই, সাথে ঢুকে গেছে সামাজিক বিনোদন আর সংস্কৃতির আমেজ। দেশে রোজার দিন শুরু হওয়ার পর থেকেই আসলে ঈদের দিন গোনার শুরু। বিশেষত যারা এখনো শৈশবে-কৈশোরে বা যৌবনে তাদের জন্য ঈদের আনন্দ মানেই বাড়তি কিছু পাওয়া।
একসময় আমাদের সাহিত্য শিল্পে পূজা সংখ্যার একক আধিপত্য ছিল চোখে পড়ার মতো। পশ্চিমবঙ্গের লেখকরা অনায়াসে ঢুকে পড়তেন অন্দরমহলে। দোষণীয় কিছু নয়। সে সূত্রে আমরা প্রচুর লেখা ও লেখক চিনেছি। পেয়েছি কালজয়ী সব সৃষ্টি। আমাদের জীবনধারাকে পাল্টে দিয়ে গেছেন তারা। খুলে দিয়েছিলেন নতুন বাতায়ন, নতুন যত দরজা। সে হাওয়ায় আমাদের বড় হয়ে ওঠার কালে একটা বিষয় নিশ্চিতভাবে ছিল অধরা। পদ্মাপাড়ের জীবন ও জীবনপ্রবাহের দিকটা তারা সেভাবে তুলে আনতেন না। সেটা তাদের উপজীব্যও নয়। অথচ যে ব্যাপারটা বিস্ময়ের ও ভাবনার, আমাদের পাঠকদের ব্যাপক সমর্থন ও সহযোগিতাতেই ছিল ওদের বাড়বাড়ন্ত।
বাংলাদেশের পাঠকদের কল্যাণে দর্শক-শ্রোতাদের আগ্রহ ও অবদানে পালে হাওয়া লাগলেও তাদের মিডিয়ায় আমাদের কাউকে খুব একটা দেখা যেত না। দু-একবার হুমায়ূন আহমেদকে সাথে নিলেও তাঁকে নাকি সেখানে পপুলার করা যায়নি। কেন যায়নি বা যেত কি না সে তর্ক এখন অচল। অচল দুটো কারণে প্রথমত তিনি এখন সবকিছুর ঊর্ধ্বে, অতঃপর নির্ভরতার ও প্রয়োজন নেই আর। আমাদের দেশে এখন উৎসব তার পত্র পল্লবে বিস্তার লাভ করে গেছে। গড়ে উঠেছে ধনিক মধ্যবিত্ত আর শ্রমজীবী মানুষের নতুন শ্রেণি। এ বাংলাদেশ আগের বাংলাদেশ নেই। যে কথা বলছিলাম ঈদের উৎসবে ধর্মের পাশাপাশি জাগতিক আনন্দ ও নিজের মতো করে তার জায়গা করে নিয়েছে। পোশাক আহার শিল্প গান বাজনা এমনকি অন্তর্জগতেও এসেছে বিপুল পরিবর্তন।
মজার ব্যাপার এই, দেশে যত ধর্মীয় রাজনীতি বা তার প্রচার সব এসে এখানে থমকে দাঁড়ায়। ব্যবসা-বাণিজ্য আর শিল্পস্রোতে আমরা মধ্যপ্রাচ্য বা পাকিস্তানের মতো এককেন্দ্রিক নয়। আমাদের হাজার বছরের যে ঐতিহ্য আর ভাবাবেগ বাংলা নামের দেশে যে মাটি নদী আর বাতাসের প্রবাহ তা আসলে কাউকে কখনো সাম্প্রদায়িক হতে দেয় না। যারা এর বিরোধিতা করেন বা জেনেও মানতে চান না তাদের বলি ঈদে আর কোনো দেশে বিনোদনের এমন অবাধ প্রবাহ দেখতে পাওয়া যায়? কোথায় রবীন্দ্রনাথ-নজরুল লালন বা পাশ্চাত্যের ধারায় জমে ওঠে এমন আনন্দ উৎসব? পোশাকে ভারতীয় বা হিন্দির প্রভাব, ফ্যাশনে চুলে গালে গায়ে হাতে মাথায় পায়ে নানা দেশের সজ্জা অথচ অন্তরে ধর্ম বা বিশ্বাস। এ জায়গাটা কেন চোখ মেলে দেখব না আমরা? দেখি বুঝি জানিও। কিন্তু এর বিপরীতে একটি ধারা বলা উচিত। এক ধারার বেশকিছু দল ও মানুষ আমাদের শুভবোধের বিরুদ্ধে নিয়ত লড়ছে। এরাই আমাদের উৎসব ও সর্বজনীন আনন্দের প্রতিবন্ধক।
দেশের বাইরে আছি অনেক বছর। কুড়ি বছরের দীর্ঘ সময়ে এদের অনাচার-অত্যাচার আর অপপ্রচারের কারণে বদলে যাওয়া বাঙালিরা উৎসবের এই মেজাজ ধারণ করতে পারেন না। তাদের মনে খামোখা ভয় ধরিয়ে দেয় এরা। কেউ দেশ থেকে এলে তার সতেজ ফুসফুস আর বাংলাভাষী মনে কীট ছাড়ার জন্য এক পায়ে খাঁড়া এদের প্রথম সবক হলো ভয় লাগানো। ভয় ধরিয়ে দেওয়ার পুরনো কায়দা হচ্ছে দুর্বল জায়গায় আঘাত করা। এদের অপপ্রচারের প্রাথমিক পর্বে আছে সন্তানদের ব্যাপারে ভীতি জাগানো। নতুন আধুনিক অগ্রসর ও চলমান দেশে নিরাপদ জীবনের পরও এই অন্ধরা বাচ্চাদের ব্যাপারে সাংঘাতিকভাবে একরোখা। আসলে বাচ্চা বা সন্তানদের জীবন নয়, এদের টার্গেট অন্য কিছু। নিজেরা এক বয়সে বিবার পান করবে, পানশালায় যাবে, কেউ কেউ নাইটক্লাবেও যাতায়াত করবে কিন্তু নতুন প্রজন্মের বেলায় এর একটাও মানবে না। বাবা-মার মনে ভয় ধরিয়ে দিয়ে বলবে : দেশ সংসার পরিবেশ ভাষা সব তো ফেলে এসেছেন, আছে খালি ধর্ম। এটার হেফাজত করেন। ধর্ম কোনোকালে কোনো দেশে কোনো জাতিতে নেই বা ছিল না? এটা বলার অর্থ হাতে-পায়ে বেড়ি পরিয়ে চিন্তার চোখে রুমাল বেঁধে দেওয়া। অভিভাবকদের দুর্বল মনে বাচ্চাদের ব্যাপারে ভয় ধরিয়ে এই যে শুরু, এর জের চলে আজীবন। এরপর পর্যায়ক্রমে খাবার পোশাক চিন্তার জগতে আঘাত এনে বাঙালিকে এরা দিকভ্রান্ত করে ফেলে। মনে পড়ছে আমাদের কমিউনিস্ট পার্টির এক বড় নেতার কথা। যিনি এই দলের শীর্ষ পদেও আসীন ছিলেন। তিনি এদেশে মানে অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে এসে থ বনে গিয়েছিলেন। নিকট আত্মীয়দের পাল্টি খাওয়া কিম্ভূতকিমাকার পোশাক আচরণ আর খাবারে চরম বিরক্ত এই ভদ্রলোক যাওয়ার আগে আমার সাথে ফোনালাপে বলেছিলেন তার মনে হচ্ছিল সারা জীবন তলোয়ারের ওপর দিয়ে হাঁটলেও এখন ঘরের ব্লেডে তার পা কেটে রক্তাক্ত। বড় দামি কথা। আমি মনে রেখে দিয়েছি। ভাবি আসলেই তো তাই। এদের অত্যাচারে আমাদের সন্তানদের কত কষ্ট আর দুর্ভোগ। এখন তো আরো ভয়াবহ অবস্থা। দেশে বিদেশে জঙ্গিবাদের যে কুপ্রভাব তার সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে বাঙালির সন্তান। কেন? এর বাহ্যিক উত্তর বা আলোচনা সমালোচনা যাই করুন না কেন আসলে এর জন্ম আমাদের ঘরে। বাচ্চাদের উদারতা আর মহতী দুনিয়া থেকে টেনে এনে অন্ধকূপে ফেলবেন আবার বলবেন না জঙ্গি হইও না তা কি বাস্তব না সম্ভব?
বলছিলাম উৎসবের কথা। বাইরের দুনিয়ার বাঙালির হাতে ডলার পাউন্ড ইয়েন বা অন্য মুদ্রা। তেজ বেশি মানে বড়। তাদের ইচ্ছেও কম নয়। তারা চায় ঈদ উৎসব বা যেকোনো উৎসবকে বাঙালিয়ানা দিয়ে ভরিয়ে তুলতে এ কাজটা আমাদের শিল্প সাহিত্য নাটক গান বা পোশাক খাবার সব বিষয়ে জরুরি ও ভালো অবদান রাখতে পারে। রাখছেও। সব ঈদের মাজেজা সব উৎসবের দান খয়রাতও এক নয়। পশুর চামড়া দান করা যেমন পুণ্যের মনের চামড়া শিল্পবোধে পুরু করাটাও সওয়াবের। সে জায়গাটায় যারা বিঘœ বা বাধার দেয়াল তৈরি করেন তাদের কাছে উৎসবের নেতৃত্ব চলে যাওয়াটা ভয়ের। কারণ এদের বেশিরভাগ মানুষ যা করেন তাতে সংগতি খুব কম। এরা বলেন এরা নাকি ইহজাগতিকতার জন্য বাঁচেন না। তাই যদি হয় তো এদের কাছে সন্তান বা আগামীর সম্ভাবনা কি? এরা জীবনের শেষপ্রান্তে এসে উৎসবের আনন্দ বা ভালোবাসার জায়গাটা কেড়ে নেবে এও কি মেনে নিতে হবে?
গোড়াতে বলছিলাম কিভাবে আমরা আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর উৎসবের বলয় গড়ে তুলেছি। যেখানে ঈদ মানে সম্প্রীতি আর ঐক্যের এক বিশাল সম্ভাবনা। সেটা কি কেবল ভাষা আর বোধের ব্যাপার? সেটা গড়ে উঠেছে নানামুখী চিন্তা দর্শন আর মানবিক মূল্যবোধে। এই বোধগুলো তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মানুষের লেখা গান নাটক যাত্রা সিনেমা বা অন্য কোনো সুজনের শক্তিতে। সেটাই আগলে রাখতে হবে। আশার ব্যাপার এই নবীনপ্রজন্ম আর বোধবুদ্ধিসম্পন্ন বয়সী মানুষরা লড়ছেন। দেশের মতো দেশের বাইরেও তারা সজাগ, ক্রীয়াশীল। আর ভয়ের ব্যাপার অধুনা সুশীল বা মননশীল নামে পরিচিতদের বিকৃত চেহারা। এরা জীবনানন্দকে হিন্দু মনে করেন। রবীন্দ্রনাথকে ভারতীয়, নজরুলকে কাফের। সেই পুরনো বুলি পুরনো রোগ। উৎসব মানে কিন্তু এদের যোগে আনন্দময় এক অন্য ভুবন। প্রার্থনা বা আচরণের দিকটা যার যার এটা বা এ জায়গাটা সবার।
সামনে আমাদের যে সম্ভাবনার সময় যে নতুন দিগন্ত তার সাথে এই বোধ ও বিবেক যোগ করে নিতে হবে। হিপোক্রেট লেখক সাহিত্যিক সুশীল বুদ্ধিজীবীদের মন ভোলানি জাতিগত বিভেদের তত্ত্ব বা রাজনীতির চেয়ে ঢের ভালো কোরআন শরীফ। সেখানে বরং শান্তির কথা আছে। ভালো নিজেরটা করে নিজের আলোয় বুঝেশুনে পথ চলা। এ কাজটা উৎসবের অতীত ও বর্তমানের সাথে ভবিষ্যতকে গ্রন্থিত করে রাখবে। আমাদের ঈদ এখন আর আগের মতো নেই। তার ঢেউ তার কল্লোল আর আবহ দেশ পেরিয়ে সপ্ত সিন্ধ দশদিগন্তে ব্যাপ্ত ও প্রসারিত। আমরা যেন তার সর্বজনীন আবহ ও ফসল নবীনদের হাতে তলে দিতে বলতে পারি : চৈরবতি। এগুতে থাক। যেখানে এক নতুন পৃথিবী ও নতুন জগৎ তোমার জন্য জেগে, তোমার পদধ্বনি শোনার জন্য কান পেতে আছি। আমরা যেন তা করতে পারি।