আজিজুর রহমান । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক। ১৯৭৬ সাল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। ২০১০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ছিলেন স্যার এ এফ রহমান হলের প্রভোস্ট। শিক্ষকতা জীবনের ৪০ বছরে কোনো বিতর্কের মুখোমুখি না হলেও সম্প্রতি দুটি ঘটনায় বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে পড়েন তিনি। হিজাব পরার কারণে দুই ছাত্রীকে ক্লাস থেকে বের করে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে।
এদিকে তাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে জানিয়ে থানায় ডায়েরি করেছেন তিনি। এরপর পুলিশি নিরাপত্তা বসানো হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের ফোরাম নীল দলের এই সদস্যের বাসায়।
এসব নিয়ে ঢাকাটাইমসের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেনবিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শামসুদ্দোহা মৃধা।
ঢাকাটাইমস: সেদিন আসলে কী ঘটেছিল?
আজিজুর রহমান: ঘটনাটা মূলত পূর্ববর্তী একদিনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। একদিন, দিনক্ষণ মনে নেই, আপাদমস্তক নেকাবে ঢাকা ওই ছাত্রী আমাকে একটা বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল। কিন্তু তার প্রশ্নটা আমি বুঝতে পারছিলাম না। তখন তাকে বললাম, ‘তোমার ঢাকনাটা সরিয়ে প্রশ্ন করো তাহলে আমার বুঝতে সুবিধা হবে।’ সে ঢাকনা সরায়নি, প্রশ্নও করেনি। সেদিন এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য হয়নি।
ঢাকাটাইমস:তারপর...
আজিজুর রহমান: এরপর সে একটু শক্ত হয়ে বসতে চাইল। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, তোমার কাছে ভার্সিটির আইডি কার্ড আছে?’ সে আইডি কার্ড দেখাল, তাতে তার পুরো মুখাবয়ব দেখা যাচ্ছে। তখন বললাম, ‘তুমি পর্দা মানো তাহলে আইডি কার্ডের ছবি দেয়ার সময় আপত্তি করলে না কেন? বললে না কেন আমার মুখ খুলে ছবি নেয়া যাবে না?’ কোনো উত্তর না পেয়ে আমি বললাম, ‘তাহলে তো বাবা আমার ক্লাসে মুখ খোলা অবস্থায় বসতে হবে; কারণ তুমি আদৌ আমার ছাত্র কি না, এটা তো আমাকে বুঝতে হবে। আমার ক্লাসে বসতে হলে আইডি কার্ডে যেভাবে ছবি দেয়া আছে, সেভাবে বসতে হবে।’ সে তখন আর কোনো প্রশ্নে যায়নি। ওই দিন বাকি ক্লাস নির্বিঘ্নে চলল। তবে আমি ওই ছাত্রীর অ্যাটেন্ডেন্স দেইনি।
ঢাকাটাইমস: এর পরের ঘটনা শুনতে চাইছি।
আজিজুর রহমান: এর সপ্তাহ দুই পরে, অর্থাৎ গত ২৬ এপ্রিল অ্যাটেন্ডেন্স নেয়ার পর আমি যখন টেক্সট আলোচনা করছিলাম, হঠাৎ একজন হাত তুলে বলল, ‘স্যার, প্রশ্ন আছে।’ অবশ্যই করো। ‘স্যার, গত কিছুদিন ধরে আমরা দেখছি আপনি একজন ছাত্রীকে অ্যাটেন্ডেন্স দিচ্ছেন না।’ আমি বললাম, ‘সজ্ঞানেই আমি তার অ্যাটেন্ডেন্স দিচ্ছি না।’ তখন আরেক বান্ধবী উঠল। আমি বললাম, ‘অ্যাটেন্ডেন্সের বিষয়ে তোমাদের জানার থাকলে ক্লাসের পরে আমার রুমে আসো।’ তারা বলল, ‘না, এটা ক্লাসের সমস্যা ক্লাসেই সমাধান করতে হবে।’
আমি বলেছি, “আমার ৪০ বছরের শিক্ষকতার জীবনে কেউ কোনো পেন্ডিমোনিয়াম সৃষ্টি করেনি। তোমরাই প্রথম আমার শিক্ষকতার ৪১তম বছরে এসে পেন্ডিমোনিয়াম সৃষ্টি করলে। সুতরাং আমি আজ থেকে তোমাদের আর ক্লাস নেব না।’ পরদিন ২৭ এপ্রিল সাড়ে নয়টায় আমার ক্লাস ছিল। আমি যথারীতি অফিসে যাওয়ার পর ২০-২৫ জন ছাত্র এসে আমাকে ক্লাস করানোর অনুরোধ করলে আমি ক্লাসে যাই। নরমাল ক্লাস নিলাম, আগের দিনের কোনো লেশ নেই ক্লাসে। এখনো স্বাভাবিকভাবেই ক্লাস নিচ্ছি।
অতএব কী দাঁড়াল! তারা অপবাদ দিয়েছে বোরকা পরায় ছাত্রীকে লাঞ্ছিত করে ক্লাস থেকে বের করে দিয়েছেন শিক্ষক। অথচ এর কিছুই ঘটেনি। ঘটনার দিন পেছন থেকে কে বা কারা ভিডিও করেছে। একের পিঠে অপরের তর্ক ও ভিডিও ভাইরালের চেষ্টাতে আমার মনে হয়েছে; এটা পূর্বপরিকল্পিত।
ঢাকাটাইমস: এর আগেও আপনার বিরুদ্ধে একই অভিযোগ আনা হয়েছে।
আজিজুর রহমান: ওটাও একই ধরনের। ওই ঘটনায় মেয়েটি নিজেই রাগ হয়ে ক্লাসরুম থেকে বের হয়ে গিয়েছিল। এবং পরদিন সে একই সময় ক্লাসে উপস্থিত ছিল। তবে সে মেয়েটা নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন হিজবুত তাওহীদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল। তার বন্ধু-বান্ধবীরাই আমাকে বলেছে সে হিজবুত তাওহীদের লিফলেট বিতরণ করেছে ও হিজবুত তাহরীরের সমর্থনপুষ্ট শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। মেয়েটি আমাকে টার্গেট করেছে। যেহেতু আমি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় জামাত-শিবির এবং এদের মদদপুষ্ট লোকদের বিরুদ্ধে বলি, তাই ভেবেছে এরা আমাকে কাবু করতে পারলে বিশ্ববিদ্যালয় গরম করতে পারবে। আর সাধারণ মানুষ তো গরম চুলা পেলে তাতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যদি একটা বড় ইস্যু বের করা যায়, তবেই সরকারের পতন নিশ্চিত করতে পারবে।
ঢাকাটাইমস:আপনি ওই ঘটনার পেছনে জামাত-শিবির এমনকি আল-কায়েদা বা এ ধরনের জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রতি ইঙ্গিত করছেন। অথচ ছাত্রী বা ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কারো বিষয়ে এমন সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
আজিজুর রহমান: এপ্রিলের ঘটনার ওই ছাত্রীর স্টেটমেন্টের যে ইনোসেন্ট ক্যারেক্টার, তাতে মনে হয় না সে কোনো দলের সঙ্গে জড়িত। হতে পারে তার বাবা, মা, কেউ না কেউ ওই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তারা তাদের মেয়েকে বাধ্য করেছেন। তবে জামাত-শিবির বলতে হরকাতুল জিহাদ, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম অর্থাৎ এই গোষ্ঠী কোনো না কোনোভাবে জড়িত।
ঢাকাটাইমস: এমন সন্দেহ হওয়ার কারণ কী?
আজিজুর রহমান: জামাত-শিবির যখন যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে পেট্রলবোমার সন্ত্রাসী করছিল, সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাতসমর্থিত শিক্ষকদের একটি অংশ এক গোপন বৈঠকে আমাকে হত্যার ষড়যন্ত্র করেছিল। এটা আমি জানলাম পরদিন সকালবেলা চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীর মাধ্যমে। তখনই আমার মধ্যে শঙ্কা কাজ করেছিল। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শিক্ষকদের একজন, তাই আমি তাদের চক্ষুঃশূল, অর্থাৎ টার্গেটে পরিণত হয়েছিলাম। তাই এসব ষড়যন্ত্রে তাদের সম্পৃক্ততা থাকতেই পারে।
ঢাকাটাইমস:সাম্প্রতিক ঘটনার পর হত্যার হুমকি পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। প্রশাসন থেকে কতটুকু নিরাপত্তা পেয়েছেন?
আজিজুর রহমান: জামাত-শিবিরের লোকেরা ইতিমধ্যে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে আমাকে হত্যার প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। শাহবাগ থানায় করা যে ডায়েরি আপনাকে দেখালাম, ডায়েরি করা মাত্রই সিকিউরিটি আসেনি। তখন ভিসি সম্ভবত চীন সফরে ছিলেন। উনি আসামাত্র তাকে এসব জানালাম। সেখানে দুই প্রো-ভিসি ও প্রক্টর ছিলেন। সেদিন ভিসি কোনো এক পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে যোগাযোগ করার পর বাসায় চারজন পুলিশ মোতায়েন হলো।
ঢাকাটাইমস: এখন নিশ্চয়ই নিরাপদ বোধ করছেন?
আজিজুর রহমান: এই নিরাপত্তায় আমি কখনোই স্বস্তি বোধ করি না। এটা কেবলই আমার পরিবারকে সান্ত্বনা দেয়া। বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে শাহবাগ থানার ওসি বলেন, ‘খুব সকালে বেরোবেন না এবং সন্ধ্যার পরে কোথাও একা বেরোবেন না।’ যদি বের হতেই হয় ওসিকে জানালে উনি আমার সঙ্গে ফলো করার জন্য একজন দিলে তখন বেরোতে। এখনো পর্যন্ত পুলিশের প্রটেক্ট নট ব্যাড। তবে এটাই যে পারফেক্ট তা বলতে চাচ্ছি না।
ঢাকাটাইমস:বোরকার বিষয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কী?
আজিজুর রহমান: এটা আমার তেমন কোনো দৃষ্টিভঙ্গির বিষয় না। বোরকা এক জিনিস। কিন্তু গত ১০-১৫ বছরে এর যে ডেভেলপমেন্ট, এখানে হিজাব-নেকাবের যে প্রচলন, এটা আগে ছিল না। আমাদের মা-দাদিরা বোরকা পরত, কিন্তু তাদের কখনো হিজাব-নেকাব পরতে দেখিনি। এই হিজাব-নেকাবকে আমি বলব বিজাতীয় সংস্কৃতি। এটা বিদেশ থেকে এসেছে। একটা গোষ্ঠী এটাকে হায়ার করছে। কে কী পরবে না পরবে, এ নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই।