একসময়ের ফুটবল আইকন এখন বিজনেস আইকন। দেশের ফুটবল আর রপ্তানিখাত এগিয়ে নিতে এখনো অবদান রেখে চলেছেন। যেখানে হাত দিয়েছেন, সেখানেই সোনা ফলিয়েছেন। সফল মানুষ আবদুস সালাম মুর্শেদী- তার জীবন, দর্শন, ফুটবল, ব্যবসা, দেশ সবকিছু নিয়ে বিশদ বলেছেন ঢাকাটাইমসকে। আজ দীর্ঘ আলাপচারিতার প্রথম পর্ব ছাপা হলো। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দেলোয়ার হোসেন।
আপনি ছিলেন দেশের ‘গ্রেট’ ফুটবলার। নতুন প্রজন্মের জন্য আপনার ক্যারিয়ার শুরুর গল্পটা বলবেন?
আমাদের পরিবারটাই হলো স্পোর্টস ফ্যামিলি। বাবা নিজেও খেলাধুলা করতেন। ভালো ফুটবল খেলতেন। আমরা চার ভাই দুই বোন। সবাই স্পোর্টসের সঙ্গে জড়িত। বড় ভাই ভালো ভলিবল খেলতেন। মেঝো ভাইও খেলতেন তবে অত ভালো ছিল না। আমার ইমিডিয়েট বড় ভাই একাধিকবার বডি বিল্ডিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। আমি নিজেও ফুটবল খেলেছি, জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। আমার ভাইও জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। আমার ভাবী শাহীন আজাদ সেও জাতীয় পর্যায়ে খেলেছে। আমরা খেলাধুলা নিয়েই ছিলাম। আমি খুব ভালো অ্যাথলেট ছিলাম। বাবা নিজে খেললেও আমাদের খুব উৎসাহ দিতেন না। বলতেন, পড়াশোনা করতে হবে। তবে মানাও করতেন না। ফুটবল যে কত স্বপ্নের ছিল, কত আকাক্সক্ষার ছিল, বলে বুঝাতে পারব না। স্কুল থেকে এলে বাবা কাজে ব্যস্ত রাখতেন। আমরা ওই কাজ শেষ করেই মাঠে দৌড় দিতাম। আসলে ফুটবলটা একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল। একদিন না খেললে সে দিনটাই ভালো যেত না।
বাবার কাছ থেকে কেমন উৎসাহ পেতেন?
বাবাও ফুটবল ভালোবাসতেন। ওই কথাটা বলি। বাবা একদিন মোহামেডানের খেলা দেখতে মাঠে এসেছেন। ভালো খেলিনি তারপরও আমার গোলে মোহামেডান জিতেছে। ঢাকার কালচারের সে পরিচিত ছিল। আমি যখন খারাপ করছিলাম তখন দর্শকরা গালি দিচ্ছিল। পরে বাবা বললেন আমি তোমার খেলা দেখেছি কিন্তু আর কোনোদিন যাব না। কারণ দর্শকদের গালাগালি। উনি রেডিওতে শুনতেন। আমাদের বলতেন আগে পড়াশোনা তারপর খেলাধুলা।
সবচেয়ে বেশি উৎসাহ পেয়েছেন কার কাছ থেকে?
মা। যখন প্রথম খেলে ১০ টাকা পেলাম, ওই টাকাটা মায়ের হাতে দেওয়াতে উনি খুশি হলেন। পরবর্তীতে খুলনায় শুরু করি ইয়ং মুসলিমে বর্তমানে ওটা মোহামেডান ক্লাব। আমি ওই সময়ই ক্লাব থেকে ২ হাজার টাকা পাই। মার হাতে টাকাটা দিয়েছি। তিনি খুব খুশি হয়েছেন।
প্রেরণা হিসেবে কাকে সামনে রেখেছিলেন?
আমাদের ওই সময়ে মানে ’৭০ থেকে ’৯০ সাল পর্যন্ত একাধিক প্লেয়ার ফ্যান বেইজ ছিল। আমি দেখেছি, মোহামেডান আবাহনী ছাড়াও অনেক ছোট ক্লাব থেকে একজন প্লেয়ারের জন্য অনেক দর্শক খেলা দেখত। ওয়ারী ক্লাবে লোবন ভাই খেলতেন। তার সঙ্গে যশোরের অনেক খেলোয়াড় খেলতেন। ওই সময়ের দু শতাধিক প্লেয়ারের নাম বলতে পারব। ওই সময়ে সালাউদ্দিন ভাই অনেক জনপ্রিয়, বাংলাদেশের লিজেন্ড। নান্নু ভাইয়ের খেলা দেখতে যেতাম। তার মতো এত স্টাইলিস্ট প্লেয়ার আমি দেখিনি। আমি এনায়েত ভাইয়ের খেলা দেখেছি। যদিও মোহামেডানে তার শেষ সময়ে আমি তাকে পেয়েছিলাম। এনায়েত ভাই ওই ধরনের খেলোয়াড় যে নিজে খেলতেন আবার অন্যকেও খেলাতে পারতেন। এরকম ওয়েলবিল্ড স্ট্রং প্লেয়ার আমাদের দেশে আর আসবে কি না আমার জানা নেই। যদিও তিনি টপ সময়ে মোহামেডান আবাহনীতে খেললে আরও বেশি জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারতেন। রহমতগঞ্জে খেলেছি। ’৭৮ সালে যখন আজাদে খেলি, তখন দলটিকে একটি ভালো পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলাম। ’৭৯ সালে বিজেএমসিতে লাস্ট যখন যাই, তখন দলকে চ্যাম্পিয়ন করি। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পরই আমি ব্রাদার্সের বিরুদ্ধে হ্যাটট্রিক করি। ব্রাদার্সে বাবলু ভাইসহ অনেক ভালো ভালো প্লেয়ার ছিলেন। পরে আমার স্বপ্ন ছিল আমি মোহামেডান আবাহনীর মতো দলে খেলার। যেহেতু আমি মোহামেডানের সাপোর্টার ওখানেই খুব করে খেলতে চেয়েছি। আমার ফুটবলের ক্যারিয়ারটা আরো বাড়াতে পারতাম কিন্তু আমি মোহামেডানে খেলা অবস্থায় ১৯৮৪ থেকে ব্যবসা শুরু করি। জাতীয় দলে থাকা অবস্থায়ই খেলা ছেড়েছি। লাস্ট টুর্নামেন্ট ছিল ’৮৬ সালের দিকে। ’৮২ সালে ২৭ গোল করে রেকর্ড করেছি।
ফুটবলের সেই দিনগুলো কতটা মিস করেন?
আজাদ ক্লাবে যখন থাকতাম, ক্যাম্পে থাকতাম। এ জীবনটাকে মনে হতো যে, বাসা থেকেও আনন্দ পাই। কারণ খেলার প্রতি ভালোবাসা ছিল। খেলছি খাচ্ছি কোনো চিন্তা নেই। মানুষ আমাদের দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকত। যখন মোহামেডানে আসি প্র্যাকটিস ম্যাচেই পাঁচ হাজার লোক হতো। সারপ্রাইজিং সকাল বেলায়ই ৫ হাজার লোক হওয়া। বিকাল হলে তো আরও বেশি হতো। এই যে সময়টা পার করেছি। দোকানে অনেক সময় দেখেছি খাওয়ার টাকা নিত না। এটা আমার কাছে মনে হতো হাইয়েস্ট অনার। যদিও আমি ফুটবলে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। ব্যবসায়ও পেয়েছি। যেমন সিআইপি। টেক্সটাইলে পেয়েছি যেটা গত ২৮ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন। এখনো ঢাকায় বা ঢাকার বাইরে দুটো জায়গারই অভিজ্ঞতার কথা বলি, কেউ আমাকে ব্যবসায়িক হিসেবে স্বীকৃতি দেয় না। এখনো সবাই আসলে ফুটবলার সালামই বলেন। সেটি আমি প্রমাণ পেয়েছি লন্ডনে গিয়েও। ওখানে এক কিলোমিটার হাঁটতে গিয়ে আমি একশবার বাধাগ্রস্ত হয়েছি। কারণ সবাই আমাকে চেনে। দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করে সালাম ভাই আপনি কবে এসেছেন, কেমন আছেন, ফুটবলের কি অবস্থা ইত্যাদি। ভাবতে ভালো লাগে কবে খেলা ছেড়েছি, এখনো মানুষ মনে রেখেছে। আমার জীবনের স্মরণীয় বলেন উপভোগ্য বলেন সবই ওই সময়টা যখন ফুটবল খেলেছি। আমি এখন যে লাইফে আছি এটা একটা ভিন্ন লাইফ। আমাদের গ্রুপে প্রায় ২০ হাজার কর্মজীবী মানুষ আছে, অনেক দায়িত্ব আছে, অনেক ভালো আছি, তারপরও যদি কখনো বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনে যাই তখন পুরনো বন্ধু-বান্ধব আসে তাদের স্মৃতি রোমন্থন করে, একটু খেলার মধ্যে থাকলে তখন ভুলে যাই টেনশনগুলো। আমার কাছে মনে হয়, আমার জীবনের এত সাফল্যের ভিত ফুটবল। ফুটবল না খেললে আমি ঢাকায়ই থাকতাম না বা ব্যবসা করার সুযোগও পেতাম না।
মাঠে ঈর্ষা হতো কাকে? মানে কাকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতেন?
আমি যখন আশির দশকে মোহামেডানে আসি তখন একাধিক প্লেয়ার ভালো খেলতেন, কার সম্পর্কে বলব। বিশেষ করে বললে বলা যায় সালাউদ্দিন তো অনেক জনপ্রিয় ছিল এবং খুবই স্টাইলিস্ট। একটা প্লেয়ার তখনই সফল হয় তার গড়ন সবকিছু মিলে। সালাউদ্দিন ভাই যখন মাঠে নামতেন সবাই দেখার জন্য মাঠে আসতেন। তার চলা, চুলের গড়ন, দেহের গড়ন, স্টাইল। একটা গোল করলে যে সেলিব্রেশন এভরিথিং ওকে। মানুষ যখন বিশ্ব সুন্দরী হয় অনেকে মনে করে সাদা রং দিলেই সুন্দরী আসলে তা নয়। অনেক কৃষ্ণাঙ্গ মহিলাও বিশ্ব সুন্দরী হয় তার স্টাইলে। আমার স্বপ্ন ছিল আমি টার্গেট করতাম সালাউদ্দিন ভাইকে। যদিও আমি স্ট্রাইকে খেলতাম। মোহামেডানে আসলে আমাকে পিছন থেকে স্টার্ট করাত। আমি যাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পেয়েছি যাকে আমি ফলো করতাম। চিন্তা করতাম তাকে বিট করে কিভাবে করা যায়। সেটা তো করেই ফেলেছি তার রেকর্ড যখন ভঙ্গ করেছি। মোহামেডানে এসে যখন আমাকে ফরোয়ার্ডে দিয়েছে তখন আমি মনে করেছিলাম আমি ভুল করেছি বিজেএমসি থেকে এসে। আমি এনায়েত ভাইয়ের জায়গায় খেলতে পারব এটা আমি চিন্তাই করতে পারিনি। আমাকে যখন এনায়েত ভাইয়ের জায়গায় দেওয়া হলো তখন আমি কোচকে জিজ্ঞেস করলাম আমি খেলতে পারব কি না। তারপরই আমি ওই ম্যাচে গোল করেছি, জিতেছি। চ্যাম্পিয়ন হয়েছি ফেডারেশন কাপে। এরপর এনায়েত ভাই কিন্তু আর খেলতে পারেননি। আমার ভালো লাগছে ওনার পজিশনে যে কম্পিটিশন করে খেলতে পেরেছি। আমার বলার উদ্দেশ্য হলো আজকের খেলোয়াড়দের কাছে আমার প্রশ্ন থাকবে যখনই বিদেশি খেলোয়াড় আসছে তাকে কম্পিটিশন করে তাকে বিট করে খেলার চেষ্টা কর। ভয় পেয়ো না। একটা ভালো প্লেয়ারকে যদি ফলো করা যায়, তাকে বিট করা যায় তাহলে তো আরো ভালো। এই জিনিসটাই তাদেরকে চ্যালেঞ্জে নিয়ে আসতে হবে। আর ভালো প্লেয়ারের সঙ্গে যদি না খেলেন ভালো খেলতেও পারবেন না, কিছু শিখতেও পারবেন না।
মেজর হাফিজের সঙ্গে আপনার বোঝাপড়া কেমন ছিল?
হি ওয়াজ ভেরি ডিসিপ্লিন পার্সন। খেলোয়াড় হিসেবে তো অবশ্যই ভালো। উনি আর্মিতে ছিলেন। সব মিলিয়ে উনি একজন ডিসিপ্লিন মানুষ। ওনার কাছে ডিসিপ্লিনটা শেখার ছিল। আমরা যখন আশির দশকে আসি তখন মোহামেডানে অত তারকা খচিত ছিল না। বাদল, মোসাদ্দেক, কোহিনুর, রামা খেলত। পিন্টু ভাই ছিলেন। রামাকে যেখানে চাইতাম সেখানে খেলে দিত। ওই সময় মোহামেডানের টিপু ভাই বাইরে থেকে কোচিং করে এসেছিলেন। মোহামেডানে একটি বিষয় ভালো ছিল এবং সেটা ডিসিপ্লিন। প্র্যাকটিসে পাঁচ মিনিট দেরি হলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। মেজর হাফিজ ভাই বলতেন, রাত দশটার পরে ঘুম আসুক আর না আসুক লাইট বন্ধ করতে হবে। সবার জীবনে এটি দরকার। ডিসিপ্লিন অ্যান্ড ডেডিকেশন না থাকলে সাফল্য আসবে না। আমরা ওই সময় দেখেছি সব খেলোয়াড় দুই বেলা প্র্যাকটিস করত। সকালে টিম প্র্যাকটিস হতো। আর বিকেল বেলা যাদের ব্যক্তিগত দুর্বলতা আছে সেই জায়গা নিয়ে কাজ করা। কিন্তু এখনকার খেলোয়াড়দের মধ্যে এগুলো খুব বেশি দেখি না। এখন তো আরও বেশি সুযোগ আছে। টিভি খুললেই সুন্দর সুন্দর খেলা দেখা যায়। তাছাড়া একজন খেলোয়াড় একটি দলের বিরুদ্ধে কেমন খেলল তা পরে ভিডিওতে দেখে বুঝতে পারে তার কোথায় কোথায় সমস্যা আছে। কিন্তু এই সুযোগটা বর্তমানের খেলোয়াড়রা নিচ্ছে না।
আপনাদের সময় আবাহনী ও মোহামেডানের ম্যাচে ভীষণ ক্রেজ ছিল। আবাহনী ও মোহামেডান ম্যাচের আগের দিন রাতে আপনাদের মানসিক অবস্থা কেমন থাকত?
শুধু আগের দিন রাত না। সাত-আটদিন আগে থেকেই জরিপ চলত, লেখালেখি হতো, আলোচনা চলত। ওই সময় আমি দেখেছি স্টেডিয়ামে ঢাকার বাইরে থেকে এসে দর্শকরা খেলা দেখত। ওই সময় ভক্তদের মাঝেও আলাদা ক্রেজ কাজ করত। বিশেষ করে আবাহনী ও মোহামেডানের সাপোর্টারদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলত কারা কত বড় পতাকা উড়াবে। দেখা যেত, একটি বাসায় দুই দলেরই সাপোর্টার থাকত। বাবা এক দলের, ছেলে বা পরিবারের অন্য সবাই এক দলের। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও অনেক মজা করত। যদিও খেলা বিটিভিতে দেখাত, রেডিওতে কমেন্ট্রি হতো তারপরও দেখেছি মাঠে ঢুকতে পারেনি এমন ২০ হাজার লোক মাঠের বাইরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। দশ টাকার টিকিট ১০০ টাকায়ও বিক্রি হয়েছে। আমরা তো যথেষ্ট স্নায়ুচাপে থাকতাম। ওই সময় আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের দিন দুপুরের মধ্যে মতিঝিলের সব অফিস বন্ধ থাকত। এটা ছিল সরকারি নির্দেশ। একটা সংশয় থাকতই যে, হারা দলের সাপোর্টাররা কিছু করে বসে কি না। স্টেডিয়াম থেকে দলের খেলোয়াড়দের বেরোতেও তিন-চার ঘণ্টা লেগে যেত। ওই সময় জিতলে যেমন মনে করতাম বড় একটা ম্যাচ জিতেছি। ফ্যানরাও এমনটাই মনে করত। দেখা যেত দল হেরে খেলে অনেক সমর্থক রাতে খায়নি। বা দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে মারামারি লেগে গেছে। এমনকি বাসার মধ্যেও এক ভাই আরেক ভাইয়ের দিকে তাকাত না। ফুটবল বাংলাদেশে এখনো জনপ্রিয়। বিশ্বকাপ এলে দেখা যায়। পতাকা এখনো মানুষ আগের মতোই উড়ায়। এটাই প্রমাণ করে, বাংলাদেশে ফুটবল এখনো জনপ্রিয়, শহর, মফস্বল সবখানের মানুষই ফুটবলকে ভালোবাসে।
আপনার ক্যারিয়ারে সেরা ম্যাচ কোনটা?
এরকম অনেক ম্যাচ আছে। তবে দুটি ম্যাচের কথা আমার ভালোভাবে মনে আছে। আমি যখন ১৯৭৯ সালে বিজেএমসিতে খেলেছি তখন দেখতাম গোল করেছি, পেপারে ছবি বের হয়েছে। কিন্তু সমর্থক নেই। অন্যদিকে মোহামেডান খেলছে ওয়ারীর সঙ্গে বা দিলকুশার সঙ্গে তারপরও দর্শক ভরা। ওই বছরই আমি যখন চ্যাম্পিয়ন হই, আমার মনে আছে, বিজেএমসিতে তখন বাসু ক্যাপ্টেন ছিলেন। সে সময়কার খেলোয়াড়দের নামও আমার ভালোভাবে মনে আছে। আমাদের শেষ ম্যাচ ছিল ব্রাদার্সের সঙ্গে। ওই ম্যাচের আগে আমাদের টিম ব্রিফিং হচ্ছিল। ওই ম্যাচ যদি আমরা জিতি তাহলে চ্যাম্পিয়ন। সেদিন বাসু দা বলেছিলেন, ‘মনু, কিছু মনে হইরো না। মোগো নাকের ডগায় পানি বোঝছো। আজকে কিন্তু জান দিয়ে খেলতে হবে।’ ১৯৭৭-৭৮ সালে আমি যখন আজাদে খেলেছি তখনও জাতীয় দলে খেলেছি। ইরানে খেলতে গিয়েছি। তবে মোহামেডানের সময়টা আমার সময় ভালো ছিল। কারণ, আশিতে সব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন। একাশিতে অর্ধেক টুর্নামেন্ট চ্যাম্পিয়ন। ১৯৮২ সালে সব টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন। আমার অনেক স্মরণীয় ম্যাচ আছে। কিন্তু যে ম্যাচে রেকর্ড গড়েছিলাম ওই ম্যাচের কথা আমার বেশি মনে পড়ে। আমি শেষ ম্যাচ খেলেছি ১৯৮৭ সালে ওয়ান্ডারার্সের বিরুদ্ধে। ওই ম্যাচে আমার একটি গোল আছে। আমরা ম্যাচটিতে ৩-২ গোলে জিতেছিলাম। শেষ গোলটি আমি করেছিলাম। ওই গোলটির কথাই আমার বারবার মনে পড়ে। ওই গোলটিই ছিল আমার শততম গোল। অনেক পত্রিকায় এসেছিল খবরটি।
ক্যারিয়ারে ঘাত-প্রতিঘাত থাকে। আপনার খেলোয়াড়ি জীবনের সবচেয়ে কঠিন সময় ছিল কোনটি?
১৯৮১ সালে দুবার আমার হাত ভেঙে গিয়েছিল। পায়ে তো অনেক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। অপারেশন করেছি। কিন্তু দুই হাতই আমার ভাঙা। মালয়েশিয়ার বিপক্ষে খেলতে গিয়ে আমার হাত ভেঙেছিল। ওই ম্যাচে আমরা জিতেছিলাম। আমাকে সিটি ক্লিনিকে নিয়ে গিয়েছিল। আমি হাসপাতালে ছিলাম, এর মধ্যে খবর শুনি আমার মায়ের বাথরুমে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে গেছে। তখন একই ক্লিনিকে আমার মায়ের অপারেশন হয়েছিল। ওই সময় আমার বড় ভাই ব্যাংকে চাকরি করতেন। ছোটখাটো একটা ভুলে তিনি জেলে গিয়েছিলেন। ওই সময়টা ছিল আমার জীবনের কঠিন সময়।
ফুটবলের সোনালি দিন হারিয়ে যাওয়ার কারণ কী?
ফুটবলের দৈন্যদশার বড় একটা কারণ হলো অফিসিয়াল টিমগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়া। তখন অনেকেই জাতীয় দলে সুযোগ পেত ঢাকা ইউনিভার্সিটি, রাজশাহী ইউভার্সিটি, বুয়েট থেকে। এই সুযোগগুলো এখন বন্ধ হয়ে গেছে। তখন ৫০-৬০টি খেলোয়াড় জাতীয় দলে সুযোগ পেত। ঢাকায় ৮ থেকে ১০টি অফিসিয়াল টিম ছিল। যেমন বিআরটিসি, পুলিশ, বিজেএমসি ইত্যাদি। খেলোয়াড়রা সবাই এখানে চাকরি করত। খুলনায় ৮টি টিম ছিল, চিটাগাংয়েও এ রকম ৭-৮টি দল ছিল। খেলোয়াড়রা সেখানে খেলত এবং চাকরি করত। তাদের একটা ফিক্সড সিকিউরড ছিল মোটামুটিভাবে। এই টিমগুলো যখন বন্ধ হয়ে গেছে এই প্লেয়াররা চাকরি হারিয়েছে। আর তখন নিরুৎসাহিত হয়েছে অভিভাবকরা। তাদের সন্তানদের খেলতে দিতে চাননি। আমি মনে করি, ফুটবল উন্নয়নে দুটো জায়গায় কাজ করা উচিত। অতীতে যেমন অফিসিয়াল টিমগুলো ছিল সেই ধারা আবার নিয়ে আসা। ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটা যোগসূত্র থাকতে হবে। কারণ স্কুল ফুটবল, পাইওনিয়ার ফুটবল খেলতে গেলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে লাগে। এজন্য দুই মন্ত্রণালয়ের যোগসূত্রটা একটা হলে গ্রাস রুট থেকে যে খেলোয়াড়গুলো আসছে না, তারা আবার আসবে। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কিন্তু খেলাধুলাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন এবং প্রায়োরিটি দেন। শুধু যে ফুটবল-ক্রিকেট তা নয়, সব খেলাকেই উৎসাহ দেন। ভালো টুর্নামেন্ট হলে অনেক ব্যস্ততার মধ্যেও খেলা দেখতে যান। প্রশানমন্ত্রীর নির্দেশে ফুটবলের জন্য মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে। আমার পরামর্শ হলো, প্রত্যেকটা উপজেলায় যেন খেলাধুলা করার মতো একটা সুন্দর মাঠ থাকে। স্টেডিয়াম প্রকল্প বাজেটের সঙ্গে রিলেটেড। একটা বাজেট শেষ না হলে আরেকটি বাজেটে বরাদ্দ দিতে হয়। আমার আবেদন থাকবে, উপজেলা পর্যায়ে যে মাঠগুলো থাকবে সেগুলোতে যেন হাজার দুই মানুষ বসতে পারে।
এখনকার ফুটবল নিয়ে দেশবাসীর হতাশার শেষ নেই। সুদিন আসবে মনে করেন?
আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। তারপরও কাজী সালাউদ্দিন ভাইয়ের নেতৃত্বে আমরা যারা বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) দায়িত্বে আছি, তারা চেষ্টা করছি খেলোয়াড়দের যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার। কোনো টুর্নামেন্টই আমরা বাদ দিচ্ছি না, যাতে করে খেলোয়াড়রা খেলার মধ্যে থাকতে পারে। সীমাবদ্ধতার মধ্যেও আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কোচ, ডিরেক্টর সবই আনছি। দল খারাপ করলে আমাদেরও খারাপ লাগে। আপনি দেখুন, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে বাংলাদেশ ভালো করায় স্টেডিয়ামে দর্শক ভরা ছিল। জাতীয় দলের সাফল্য মানে অনেক কিছু। তবে এখনো যদি ঢাকার বাইরে ভালো খেলা হয় তাহলে স্টেডিয়ামে দর্শক ভরে যায়। ফুটবলে নতুন ফ্যান তৈরি না হওয়ার কারণ হচ্ছে, তারকা খেলোয়াড় তৈরি না হওয়া। পাইপলাইনও ভালো হচ্ছে না।
বাফুফেতে সালাউদ্দিন, মুর্শেদীর মতো কিংবদন্তি থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের ফুটবল এগোচ্ছে না কেন- এই প্রশ্ন চারদিকে।
আমি এতটুকু বলব যে, ফুটবল আমরা মাঠে আনতে পেরেছি। খেলা হচ্ছে। তবে প্রত্যাশিত জায়গায় নিতে পারিনি। সেটা আমাদের ব্যর্থতা। এটা আমাদের তৃতীয় টার্ম। আগে ঢাকার বাইরে লিগ হতো না। হলেও দু-একটি। কিন্তু এখন আমরা ঢাকার বাইরে লিগের সিংহভাগ ম্যাচের আয়োজন করেছি। এখন আমরা স্কুল ফুটবল, জেলা ফুটবল ও একাডেমির প্রতি জোর দিচ্ছি। ট্যালেন্ট হান্ট হচ্ছে। পাইপলাইনে প্লেয়ার না থাকলে ন্যাশনাল টিম শক্তিশালী হবে না। এবার যেমন দেখেন, ঢাকার বাইরে ফুটবল আসছে। বাচ্চারা, গার্ডিয়ানরা খেলা দেখছে। তারা উদ্বুদ্ধ হচ্ছে। দেখেন, কয়েকদিন পরে তারাও ফুটবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়বে। আমরা অনেক প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। আগামী চার বছরে আমাদের এটি বাস্তবায়ন করতে হবে। আমরা ফুটবলকে কোথায় নিতে পারব তা বলতে পারব না, তবে ফুটবলের জাগরণ তৈরি করে ছাড়ব।
এক সঙ্গে কাজ করছেন। কাজী সালাউদ্দিনের সঙ্গে আপনার ব্যক্তিত্বের কোনো সংঘাত হয় কি না?
না। দেখুন, বিজিএমইএর সভাপতি হওয়া খুবই কঠিন কাজ। এমপি হওয়ার চেষ্টা করলে কিন্তু আমি পারব। বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংকিং, হাসপাতালসহ আমি অনেক কিছুর সঙ্গে জড়িত, অনেক ইনস্টিটিউশন চালিয়েছি। আমি মনে করি, সালাউদ্দিন ভাই আমাদের বয়সে সিনিয়র, খেলাধুলার দিক থেকে সিনিয়র। ওনার সঙ্গে কাজ করতে পেরে আমি অবশ্যই নিজেকে গর্বিত মনে করি। উনি আমার প্রতি যথেষ্ট আস্থা রাখেন। আমাকে উনি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি দায়িত্ব দিয়েছেন। একটি হলো ফাইন্যান্স ও আরেকটি হচ্ছে পেশাদার লিগ। পেশাদার লিগে চারটি খেলা হয়। চারটিই কিন্তু আমার এখান থেকেই হয়। আমার যেহেতু ইনস্টিউশন চালানোর অভিজ্ঞতা আছে সেহেতু আমি এই কাজ উপভোগ করি। সালাউদ্দিন ভাই আমাকে যথেষ্ট মূল্যায়ন করেন। কোনো বিষয়ে সমস্যা হলে আমার সঙ্গে আলোচনা করেন।
আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব: বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ এখন ব্র্যান্ড