ইলিয়াস কাঞ্চন- চিত্রনায়ক হিসেবে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। দুর্ঘটনায় স্ত্রী জাহানারা কাঞ্চনের মৃত্যুতে সড়ক নিরাপদ করার সামাজিক আন্দোলনে একপর্যায়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বেদের মেয়ে জোছনাখ্যাত বড়পর্দা কাঁপানো এই তারকা। ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান হিসেবে এখন দারুণ সক্রিয়। পর্দার নায়ক শুধু নয়, সড়কের নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনেরও চিন্তাভাবনা উঠে এসেছে ঢাকাটাইমসের আলাপে। আজ প্রকাশিত হচ্ছে এর প্রথম পর্ব। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সৈয়দ ঋয়াদ ও শেখ সাইফ
ফাঁকা রাস্তায় দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে, এর কারণ কী?
ফাঁকা রাস্তায় দুর্ঘটনা বেশি এর কারণ হচ্ছে, রাস্তায় গাড়ি চালানোর একটা লিমিটেশন আছে। উন্নত দেশগুলোতে সিসিটিভির মাধ্যমে সেই লিমিটটাকে কন্ট্রোল করা হয়। এবং আমাদের দেশে শিক্ষিত ড্রাইভার কম। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কিন্তু শিক্ষিত ড্রাইভার আছে। তারপরও সরকার কিন্তু গাড়ির গতি কন্ট্রোল করার জন্য রাস্তার মধ্যে সিসিটিভি ব্যবহার করে। যাতে কেউ এই স্পিড ভায়োলেশন না করে। যদি ভায়োলেশন করে তবে সঙ্গে সঙ্গে সেটা ক্যামেরায় ধরা পড়ে এবং পরের দিন তার বাসায় ফাইন-এর কাগজপত্র চলে যায়। এবং সেই সঙ্গে তার ড্রাইভিং লাইসেন্স এর ও পয়েন্ট কাটা যায়। ফাঁকা রাস্তায় আমাদের দেশে যখন গাড়ি চালানো হয় তখন ওভার স্পিড দেওয়া হয়। এর ফলে যখন প্রবলেম ফেস করে তখন এটাকে কন্ট্রোল করা যায় না। স্পিড কন্ট্রোল করা যায় না। এর জন্য শহরের সড়কের ডিজাইন অনুযায়ী, গাড়ি চলার পরিবেশ তৈরি করলে দুর্ঘটনা কম হবে। শহরে যে রকম হাটবাজার বসে সেই জায়গাগুলোতে স্পিড কমাতে হবে। না হলে দুর্ঘটনা ঘটবে। আর আমাদের দেশে রাস্তা ফাঁকা হলেও রাস্তা পারাপার ফাঁকা হয় না কখনো। পৃথিবীর কোথাও দেখা যাবে না যে হাইওয়ে ক্রস করে রাস্তা পার হচ্ছে। তাদের রাস্তা ক্রস করে পার হওয়ার সিস্টেমই নেই। এমনভাবে রাস্তা ডিজাইন করে বানানো হয়, একটা লোক চাইলেও ইচ্ছে করে রাস্তা ক্রস করতে পারে না। আর আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে এখানে সেখানে রাস্তা পার হচ্ছে, মোবাইলে কথা বলতে বলতে রাস্তা পার হচ্ছে। তখনই দুর্ঘটনা ঘটছে। হয় গাড়িতে গাড়িতে সংঘর্ষে বা সাইড দিতে গিয়ে রাস্তার খাদে পড়ে গিয়ে, না হয় রিকশা-ভ্যানের সঙ্গে লেগে দুর্ঘটনা ঘটছে।
গত কয়েক দিনে অনেক বেশি দুর্ঘটনা ঘটেছে, এ নিয়ে আপনারা কিছু করছেন?
আমাদের দেশে ঈদের সময় রোড এক্সিডেন্ট ভয়াবহ আকার নেয়। এছাড়া এখানে যে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান আমাদের কাছে আছে সেটি কিন্তু কমই বলা চলে। সাউথ ইস্ট এশিয়া রিজিওনের ভিতরে যে এগারোটা দেশ আছে সেই এগারোটা দেশের মধ্যে মালদ্বীপের দুর্ঘটনার পরিমাণ খুবই কম। মালদ্বীপে দুর্ঘটনার হার ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এটি একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। গাড়িও তেমন সেই। এছাড়া অন্য দেশগুলোতে আমাদের দেশের তুলনায় দুর্ঘটনার হার অনেক বেশি। আমাদের দেশে এই হার ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ। ভারতে ১৬ শতাংশের উপরে আছে। ব্যাংককে আছে ২১ শতাংশ। এক সময় আমাদের দেশ দুর্ঘটনায় এক নম্বরে ছিল। সেই জায়গা থেকে আমাদের কিছু কিছু পদক্ষেপের কারণে, জনগণের অ্যাওয়ারনেসের কারণে, সরকারের পদক্ষেপের কারণে এটা কমে আসছে। কিন্তু আমাদের ঈদ যখন আসে তখন দেখা গেছে এটা কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারছে না। এটা কন্ট্রোল করতে পারছে না এই জন্য। এটা কেউ বোঝে না, ইভেন সরকারও বোঝে না। ঈদ যখন আসে তখন আগের গাড়িগুলো দিয়েই অতিরিক্ত যাত্রী আনা নেওয়া করা হয়। মনে করেন প্রতিদিন ৩০-৫০ লাখ লোক আনা নেওয়া করা হচ্ছে। ঈদ এলে তখন ঢাকা থেকেই ১ কোটি লোক চলে যাচ্ছে। তো এর জন্য কোনো অতিরিক্ত গাড়ি নামানো হয় না, অতিরিক্ত ড্রাইভার নেওয়া হয় না। তাহলে কিভাবে এত লোক পারাপার করা হচ্ছে। মাথায় এই বিষয়টা কেউ চিন্তাও করল না। সরকারও চিন্তা করল না। যারা ব্যবসা করে তারাও বুঝল না। তাহলে কিভাবে নেওয়া হচ্ছে এত লোক? সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত গতি দেওয়া হয়েছে, অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া হচ্ছে, ইভেন প্রতিটা গাড়ি রাতদিন ট্রিপ মারছে। অর্থাৎ সব কিছু ওভার করা হয়েছে। অনেক বেশি ট্রিপ মারা হচ্ছে। এর ফলে দুর্ঘটনা বেশি হচ্ছে। এই হিসাবটা কেউ করছে না। এটাই মূল ঘটনা। এখানে লোভ কাজ করছে। আমাদের এখানে যাত্রীদের ও ডিমান্ড বেড়ে যায়। তারে যাবেই। না গেলেই হবে না। নাড়ির টান। এটার জন্য শুধু একতরফা সরকারকে দোষ দিলে হবে না। আমাদের কিন্তু ভাবনার বিষয় আছে। নাড়ির টানে যে মানুষ বাড়ি যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে যাচ্ছে, সে মানুষই গ্রামে পোস্টিং করা হলে তারা জয়েন করে না। তাছাড়া আপনি গাড়ি বাড়াচ্ছেন না। ড্রাইভার নিলেন না অতিরিক্ত। একই ড্রাইভার দিয়ে অতিরিক্ত ট্রিপ নিচ্ছেন। ড্রাইভার তো গাড়ি চালাতে চালাতে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে, ঘুমিয়ে পড়ছে। তখন রেলিং ভেঙে পড়ছে, ওভারটেক করছে, গাড়ির কন্ট্রোল হারাচ্ছে, তখন খাদে পড়ছে। রেলিং ভেঙে নদীতে পড়ছে, হেলপারের কাছে দিচ্ছে গাড়ি চালাতে। এটা আমরা কেউ ভাবি না। একা কি সরকারের পক্ষে সম্ভব?
আপনি দেখেন মানুষ যখন সৌদিতে হজ করতে যায় তখন সৌদি সরকার যাত্রী সেবা দেওয়ার জন্য অতিরিক্ত গাড়ি রেখে দেয়। অতিরিক্ত ড্রাইভার আনে অন্য দেশ থেকে। ৬০-৬৫ লাখ লোক প্রতি বছর হজ করতে যায় প্রচুর টাকা-পয়সা খরচ করে। তাদের সেবা দেওয়ার জন্য সৌদি সরকার এই পদক্ষেপ নিয়ে থাকে। তাদের দুর্ঘটনা ঘটে না। আর আমাদের দেশে ঈদের সময় কি ব্যবস্থা নেওয়া হয়? কি হচ্ছে ঈদের সময়! ড্রাইভার ক্লান্ত হয়ে হেলপারের কাছে গাড়ি চালাতে দেয়, এই সব কারণে ঈদ এলে দুর্ঘটনার মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে আপনারা কাজ করছেন। ঢাকা শহরে ১৫-১৬ বছর বয়সী ছেলেরা পর্যন্ত গাড়ি চালাচ্ছে। এটা কেউ দেখছে না।
আমাদের দেশে রাজনৈতিক একটা বিষয় এক্ষেত্রে কাজ করছে। রাজনীতিতে যারা ছোটখাটো নেতা-কর্মী থাকে তাদের রাজনৈতিক দলের কাছে চাওয়ার থাকে পাওয়ার থাকে। আমি নিজে দেখেছি গ্রীন রোডের কিছুু ১৪-১৫ বছরের ছেলেরা সেখানে গাড়ি চালায়। যারা চালাচ্ছে এই গাড়িগুলো তারা কিন্তু মালিক নয়। মালিক ছোটখাটো পাতি নেতা। ওরা তখন চিল্লাচিল্লি করে বলে আমি দলের জন্য এই করেছি, ওই করেছি আমাকে কিছু দিলেন না? তখন বলে তুই কি চাস তখন সে বলে এই রোডে আমার গাড়ি দরকার। এভাবে সে রোডে গাড়ি নামিয়ে ফেলে। যেই পাতি নেতা রাস্তায় গাড়ির অনুমোদন পেলো, সে এখন ড্রাইভার কই পাবে? সে তখন যাকে পাচ্ছে তাকেই নিয়ে নিচ্ছে। সে রাজনীতি করে ফলে তার ড্রাইভারের লাইসেন্স আছে কি নেই সেটা বড় কথা নয়। কারণ তাকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কিছু করতে পারবে না। যেহেতু সে রাজনৈতিক দলের নেতা। আর তারা ব্যাংক লোন করে গাড়িগুলো আনে কিন্তু পরে আর ব্যাংক লোনও শোধ করে না। কারণ ব্যাংকের লোনের টাকা আনলে সেটা তো আপনার। শোধ করার প্রয়োজ নেই। যেহেতু ব্যাংকের টাকায় গাড়ি কিনলেন, শোধ করতেও হচ্ছে না সেক্ষেত্রে ভুয়া ড্রাইভার গাড়ি চালিয়ে নষ্ট করলেও আপনার কিছু যায় আসে না। রাজনীতি যতদিন ঠিক না হবে ততদিন দুর্নীতিও কমবে না। আর এসব জিনিসও ঠিক হবে না।
অপরিণত বয়সে ছেলেদের কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ ছাড়াই লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে কি সরকারের কিছুই করার নেই?
প্রশিক্ষিত ও দক্ষ ড্রাইভার তৈরি করার জন্য যে ধরনের অবকাঠামো বা ইনস্টিটিউট দরকার তেমন ভালো কোন ইনস্টিটিউটও নেই। তাহলে আপনি দক্ষ ড্রাইভার কোথায় পাবেন? ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। সারা পৃথিবীতে যেখানে নিয়ম হলো প্রথমে লাইট বা হালকা গাড়ির লাইসেন্স দিয়ে ড্রাইভিং শুরু করতে হয়। তিন বা পাঁচ বছর চালানোর পর তাকে আবার পরীক্ষা দিয়ে মিডিয়াম গাড়ির লাইসেন্স নিতে হয়। সেটাও চার বা পাঁচ বছর চালানোর পর পরীক্ষা দিয়ে নিতে হয় ভারী গাড়ির লাইসেন্স।
এমন নিয়ম তো আমাদের দেশে দেখি না।
আমাদের দেশে দুর্ঘটনাগুলো এজন্যই বেশি ঘটে। তারা একজন ড্রাইভারকে দক্ষ করার জন্য এসব করে। নতুন যে ছেলেটা ড্রাইভিং শুরু করে সে রাস্তা সম্পর্কে জানতে পারে, তার ধৈর্য শক্তি বাড়ে। যখন তার মধ্যে একটু দায়িত্ববোধ কাজ করে ঠিক সে বয়সেই উন্নত দেশে হেভি বা ভারী লাইসেন্স দেওয়া হয়। তাছাড়া বড় গাড়িগুলো অ্যাকসিডেন্ট হলে ক্ষতির পরিমাণও অনেক দাঁড়ায়। তাই অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ববোধ তৈরি হলেই কেবল হেভি গাড়ি চালাতে পারে। আমাদের এখানে আন্দোলন করে বিষয়টা এমন হয়ে গেছে যে, যে ছেলেটা হেভি গাড়ির হেলপার সে শুরু করবে হেভি গাড়ি দিয়ে। সে কেন লাইট বা মিডিয়াম গাড়ি চালাবে? যে বাসের হেলপার সেও ছোট গাড়ি চালাবে না। অর্থাৎ কোনো ধরনের প্রক্রিয়া বা উন্নত প্রশিক্ষণ ছাড়াই এই হেলপাররা ভারী গাড়ির লাইসেন্স পেয়ে যায়। এজন্যই দুর্ঘটনা রোখা যাচ্ছে না। কারণ আপনি তো নিয়ম মানছেন না। একটা বন্দুকের গুলিতে একজন মানুষের প্রাণ যায় কিন্তু একটা গাড়ি অ্যাকসিডেন্ট করলে শত শত পরিবার ক্ষতির মুখে পড়ে।
প্রশাসনও কি এ ক্ষেত্রে ব্যর্থ?
গত ১৮ তারিখ পর্যন্ত ২৪৫ জন মানুষ মারা গেছে। সেটা কি সরকারের একার দায়দায়িত্ব? বিরোধী দলের কি এ ব্যাপারে কোনো দায়িত্ব নেই? তারা কি কোনো প্রতিবাদ করেছে? তারা কি কোনো সহমর্মিতা জানিয়েছে? তারা সেটা করেনি। কারণ তাদের দল যখন ক্ষমতায় তাকে তারা সেটা রোল করে। আওয়ামী লীগের শাজাহান সাহেব আছেন, আছেন জাতীয় পার্টির রাঙ্গা সাহেব তারা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করছেন? তাহলে জনগণের স্বার্থটা কে দেখবে?
আমাদের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাহেব অনেক কথা বলেছেন, বাহবাও পাচ্ছেন, কাজের কাজ হচ্ছে কি?
আসলে উনি পারছেন না। উনি ওনার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারছেন না। তবে তার আন্তরিকতা আছে। রাজনীতির কারণে উনি পারছেন না। রাজনীতি করতে গেলে পাতি নেতাদের অনেক ডিমান্ড থাকে, তাদের সেসব ফুলফিল করতে গেলে ইচ্ছে থাকলে কাজটা যথাযথভাবে করা হয়ে ওঠে না। আপনি তো রাজনীতি করেন দলকে ক্ষমতায় আনার জন্য। দল ক্ষমতায় আসলে আপনার লাভ হবে। আপনি তো সেজন্যই রাজনীতি করেন। আপনি দেশের জন্য রাজনীতি করেন না। ফলে দল ক্ষমতায় আসলে আপনি নিজের লাভ খোঁজবেন। আর যারা ভাগের জন্য রাজনীতি করে আপনি তাদের ভাগ না দিয়ে পারবেন না। রাজনীতির আমূল পরিবর্তন দরকার। তাহলেই এসব পরিবর্তন হবে, না হলে নয়।
সরকারের ভূমিকা কি?
সরকারের ভূমিকা কিছুই না। এই যে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে প্রায় ১১১ জনের প্রাণহানি ঘটেছে, তাদের সবাই ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। যে গাড়িগুলো পুড়েছে তারাও ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। কিন্তু এ বছর ২৪৫ জন মারা গেলেন, তাদের জন্য সরকার কি করলেন? কিছুইতো করলেন না। তার মানে কি? ওটা ছিল একটি রাজনৈতিক কর্মকা-। বিরোধী দল হরতাল ডেকেছে সেটি প- করতে যেহেতু তারা গাড়ি চালিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে সেহেতু রাজনৈতিক দল বা সরকার সেটির ক্ষতিপূরণ আদায় করল। কিন্তু যারা সাধারণ মানুষ তাদের ক্ষতিপূরণের কথা সরকার চিন্তা করল না।
আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব : পুরস্কার নয়, পেয়েছি জুতার মালা